Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

See Our Articles In Different Styles... Grid View List View

মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৩

কুরবানী: ফযিলত ও আমল

Views:

A+ A-

 কুরবানী: ফযিলত ও আমল




কুরবানী: ফযিলত ও আমল

إن الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه أجمعين أما بعد
কুরবানী আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এক  বিশেষ অনুগ্রহ। কেননা বান্দাহ কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে। কুরবান শব্দটি কুরবুন শব্দ থেকে উৎকলিত। অর্থাৎ নিকটবর্তী হওয়াসান্নিধ্য লাভ করা। যেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার মাধ্যম হল কুরবানী তাই এর নাম কুরবানীর ঈদ। এই দিনে ঈদ পালন করা হয়ে থাকে এজন্য একে কুরবানীর ঈদ বলে। এ ঈদের অপর নাম ঈদুল আদ্বহা। আরবি শব্দ আদ্বহা অর্থ কুরবানীর পশুযেহেতু এই দিনে কুরবানীর পশু যবেহ করা হয়তাই একে ঈদুল আদ্বহা বলা হয়।

কুরবানীর গুরুত্ব

কুরবানী হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন:
﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ٢ ﴾ [الكوثر: ٢] 
তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর। [সূরা আল-কাউসার : ২] 
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا»
যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে। [মুসনাদ আহমাদইবন মাজাহ- ৩১২৩ হাদীসটি হাসান] 
যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদীস একটি সতর্কবাণী।
অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার  নির্দেশ দিয়ে বলেন,
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّة»
হে লোক সকলপ্রত্যেক পরিবারের উপর কুরবানী দেয়া অপরিহার্য। [সুনান ইবন মাজাহ-৩১২৫হাদীসটি হাসান]। 
উল্লেখিত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যেকুরবানী করা ওয়াজিব। তবে অনেক ওলামায়ে কিরাম কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন।


কুরবানীর ইতিহাস

কুরবানী আল্লাহ তাআলার একটি বিধান। আদম আলাইহিস সালাম হতে প্রত্যেক নবীর যুগে কুরবানী করার ব্যবস্থা ছিল। যেহেতু প্রত্যেক নবীর যুগে এর বিধান ছিল সেহেতু এর গুরুত্ব অত্যধিক। যেমন ইরশাদ হয়েছে :
﴿ وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ ﴾ [الحج: ٣٤]
আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছিতিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেনসেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। [সূরা আল-হাজ্জ৩৪]
﴿ ۞وَٱتۡلُ عَلَيۡهِمۡ نَبَأَ ٱبۡنَيۡ ءَادَمَ بِٱلۡحَقِّ إِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانٗا فَتُقُبِّلَ مِنۡ أَحَدِهِمَا وَلَمۡ يُتَقَبَّلۡ مِنَ ٱلۡأٓخَرِ﴾ [المائ‍دة: ٢٧] 
আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা করযখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর একজন থেকে গ্রহণ করা হলো আর অপরজনের থেকে গ্রহণ করা হলো না। [সূরা আল-মায়িদাহ:৩৪]
আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বন্ধু ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছেন এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর স্মরণ করযখন ইবরাহীমকে তার রবের কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেনঅতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেনআমি তোমাকে নেতা বানাবো’। [সূরা আল-বাকারাহ-১২৪] নিজ পুত্র যবেহ করার মত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখিন হয়েছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। এ বিষয়ে সূরা আস-সাফ্ফাতের ১০০ থেকে ১০৯ আয়াতে বলা হয়েছে,
﴿ رَبِّ هَبۡ لِي مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١٠٠ فَبَشَّرۡنَٰهُ بِغُلَٰمٍ حَلِيمٖ ١٠١ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡيَ قَالَ يَٰبُنَيَّ إِنِّيٓ أَرَىٰ فِي ٱلۡمَنَامِ أَنِّيٓ أَذۡبَحُكَ فَٱنظُرۡ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَٰٓأَبَتِ ٱفۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُۖ سَتَجِدُنِيٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٠٢ فَلَمَّآ أَسۡلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلۡجَبِينِ ١٠٣ وَنَٰدَيۡنَٰهُ أَن يَٰٓإِبۡرَٰهِيمُ ١٠٤ قَدۡ صَدَّقۡتَ ٱلرُّءۡيَآۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٠٥ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ ٱلۡبَلَٰٓؤُاْ ٱلۡمُبِينُ ١٠٦ وَفَدَيۡنَٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيمٖ ١٠٧ وَتَرَكۡنَا عَلَيۡهِ فِي ٱلۡأٓخِرِينَ ١٠٨ سَلَٰمٌ عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ ١٠٩ ﴾ [الصافات: ١٠٠،  ١٠٩] 
অর্থ: তিনি বললেনহে প্রভু! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম এক অতীব ধৈর্যশীল সন্তানের। পরে যখন সে সন্তান তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানোর বয়সে পৌঁছলো তখন তিনি (ইবরাহীম আ:) একদিন বললেনহে বৎস ! আমি স্বপ্নে দেখেছি যেআমি আল্লাহর হুকুমে তোমাকে যবেহ করছি এখন তুমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখ এবং তোমার অভিমত কীতিনি (ইসমাঈল) বললেনহে পিতা আপনি তাই করুন যা করতে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন । ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর যখন দুজনই আল্লাহর আদেশ মানতে রাজি হলেনতখন তিনি (ইবরাহীম আ:) পুত্রকে যবেহ করার জন্য শুইয়ে দিলেন। আমি তাকে ডেকে বললামহে ইবরাহীম ! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই নেক বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি বড় পরীক্ষা। আর আমি তাকে বিনিময় করে দিলাম এক বড় কুরবানীর দ্বারা এবং তা পরবর্তীর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহীম (আ:) এর উপর। 
একমাত্র আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় এবং আল্লাহ প্রদত্ত কঠিনতম পরীক্ষায় সাফল্যজনকভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে এক মহান পিতার প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানী করার মধ্য দিয়ে ধৈর্যশীলতার উত্তম নমুনা পেশ পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। কুরআন মাজীদে উল্লেখিত আয়াতসমূহে ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস সালামের আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি সীমাহীন আনুগত্যের সাবলীল বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যেস্বীয় পুত্র যবেহ না হয়ে দুম্বা যবেহ হওয়ার মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়।


কুরবানীর উদ্দেশ্য

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার ইবাদত করার জন্য। তাই আল্লাহ তাআলার বিধান তাঁর নির্দেশিত পথে পালন করতে হবে। তিনি বলেন :
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦] 
আমি জিন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যেতারা শুধু আমার ইবাদত করবে। [সূরা আয্যারিয়াত-৫৬]

• আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কুরবানীর বিধান আমাদের উপর আসার বেশ কিছূ উদ্দেশ্যও রয়েছে:

১. শর্তহীন আনুগত্য 
আল্লাহ তাআলা তার বান্দাহকে যে কোন আদেশ দেয়ার ইখতিয়ার রাখেন এবং বান্দাহ তা পালন করতে বাধ্য। তাই তার আনুগত্য হবে শর্তহীন। আল্লাহর আদেশ সহজ হোক আর কঠিন হোক তা পালন করার বিষয়ে একই মন-মানসিকতা থাকতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে মায়া-মমতা প্রতিবন্ধক হতে পারে না। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। এ জন্য মহান আল্লাহ যেভাবে বিশ্ব মানবমন্ডলীকে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করেছেন ঠিক সেভাবে সর্বশেষ জাতি হিসেবে মুসলিম জাতির পিতাও মনোনয়ন দিয়েছেন । কুরআনে এসেছে :
﴿مِّلَّةَ أَبِيكُمۡ إِبۡرَٰهِيمَۚ هُوَ سَمَّىٰكُمُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ﴾ [الحج: ٧٨] 
এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত; তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।’ [সূরা আল--হাজ্জ ৭৮]

২. তাকওয়া অর্জন 
তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
﴿ لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧ ﴾ [الحج: ٣٧]   
আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্তবরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যেতিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেনসুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে। [সূরা আল-হাজ্জ৩৭]

৩. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা
প্রত্যেক ইবাদাতই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। তাই কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
﴿كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧ ﴾ [الحج: ٣٧] 
এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যেতিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেনসুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে। [সূরা আল-হাজ্জ৩৭]

৪. ত্যাগ করার মহান পরীক্ষা
কুরবানীর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ত্যাগ করার মানসিকতা তৈরী করা। আল্লাহর বিধান পালনে জান-মালের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কুরবানীর ঈদকে গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত করা নয়বরং নিজেদের মধ্যকার পশুসুলভ আচরণ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কুরবানীর উদ্দেশ্য।
﴿ وَلَنَبۡلُوَنَّكُم بِشَيۡءٖ مِّنَ ٱلۡخَوۡفِ وَٱلۡجُوعِ وَنَقۡصٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٥ ﴾ [البقرة: ١٥٥] 
আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ভয়দারিদ্র্যসম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতি করার মাধ্যমে পরীক্ষা করবো। [সূরা আল-বাকারাহ১৫৫]


কুরবানীর ফযিলাত

১.      কুরবানীদাতা কুরবানীর পশুর জবাই এর মাধ্যমে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের বাস্তবায়ন করতে পারে। আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
﴿ وَفَدَيۡنَٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيمٖ ١٠٧ ﴾ [الصافات: ١٠٧]
আর আমরা মহা কুরবানীর বিনিময়ে তাকে মুক্ত করেছি। [সূরা আস-সাফফাত১০৭] 
এ আয়াতের তাফসীরে তাফসীর বিশারদগণ উল্লেখ করেছেনসকল কুরবানী এ মহাকুরবানীর অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়েদ ইবনে আরকাম বর্ণিত হাদীসেও কুরবানীকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর সুন্নাত হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

২.      কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿ لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧ ﴾ [الحج: ٣٧]  
আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যেতিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্ম পরায়ণদেরকে।” [সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭]

৩.      কুরবানী আল্লাহ তাআলার অন্যতম নিদর্শন। সূরা হজ্জের ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- 
﴿ وَٱلۡبُدۡنَ جَعَلۡنَٰهَا لَكُم مِّن شَعَٰٓئِرِ ٱللَّهِ لَكُمۡ فِيهَا خَيۡرٞۖ فَٱذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَيۡهَا صَوَآفَّۖ فَإِذَا وَجَبَتۡ جُنُوبُهَا فَكُلُواْ مِنۡهَا وَأَطۡعِمُواْ ٱلۡقَانِعَ وَٱلۡمُعۡتَرَّۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرۡنَٰهَا لَكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٣٦ ﴾ [الحج: ٣٦] 
কুরবানীর উটসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম করেছি। তোমাদের জন্য যাতে কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থা এগুলোর উপর তোমরা আল্লাহর নাম স্মরণ করো আর যখন কাত হয়ে পড়ে যায় তখন সেগুলো হতে খাও। আর আহার করাও ধৈর্য্যশীল অভাবী ও ভিক্ষাকারী অভাবগ্রস্তকে এভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছিযাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। 
এ আয়াতে কুরবানীর ফযিলত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং কুরবানীর পশুকে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

৪.      পশু দ্বারা কুরবানীর মাধ্যমে আল্লহর যিকির বা স্মরণের বাস্তবায়ন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : 
﴿ وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ ﴾ [الحج: ٣٤]
আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছিতিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেনসেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। [সূরা আল-হাজ্জ৩৪]

৫.      কুরবানীর প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তাআলার কাছে দুটি কুচকুচে কালো ছাগলের চেয়ে প্রিয় ও পবিত্র। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«دَمُ عَفْرَاءَ أَحَبُّ إلى الله مِنْ دَمِ سَوْدَاوَيْنِ».
অর্থাৎ কুরবানীর প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তাআলার কাছে দুটি কুচকুঁচে কালো ছাগলের চেয়ে অধিক প্রিয়। [সুনান বায়হাকী ]

৬.      ইসলামে হাজ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইবাদত। হজ্জের সাথে কুরবানীর অনেক বিষয় জড়িত। হাজীগণ এ দিনে তাদের পশু যবেহ করে হজ্জকে পূর্ণ করেন। এ জন্য এর নাম হল (يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ) বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। হাদীসে এসেছে, ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَفَ يَوْمَ النَّحْرِ بَيْنَ الْجَمَرَاتِ فِي الْحَجَّةِ الَّتِي حَجَّ فَقَالَ أَيُّ يَوْمٍ هَذَا قَالُوا يَوْمُ النَّحْرِ قَالَ هَذَا يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ»
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিনসাহাবাগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন্নাহর বা কুরবানির দিন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনএটা  হলো ইয়াওমুল হজ্জিল আকবার বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। [সুনান আবু দাউদ]

.      কুরবানীর মাধ্যমে সামাজিক ও পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রেরণা তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
﴿ وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ﴾ [ال عمران: ١٠٣] 
তোমারা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। [সূরা আলে ইমরান : ১০৩]

.      কুরবানীতে গরীব মানুষের অনেক উপকার হয়। যারা বছরে একবারও গোশত্ খেতে পারে নাতারাও গোশত্ খাবার সুযোগ পায়। দারিদ্র বিমোচনেও এর গুরুত্ব রয়েছে। কুরবানীর চামড়ার টাকা গরীবের মাঝে বণ্টন করার মাধ্যমে গরীব-দুখী মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। অপরদিকে কুরবানীর চামড়া অর্থনীতিতে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে।


কুরবানীর পশু

১.      কুরবানীর পশু উৎসর্গ করা হবে কেবল এক আল্লাহর উদ্দেশ্যেঅন্য করো জন্য নয়কেননা কুরবানী হচ্ছে ইবাদত। তিনি বলেন :
﴿قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣ ﴾ [الانعام: ١٦٢،  ١٦٣] 
বলুন! আমার সালাতআমার কুরবানীআমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতি পালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যেতাঁর কোন শরীক নেইআর আমি এর জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম। [সূরা আল-আনআম : ১৬২-১৬৩]

২.      আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে কুরবানীর পশু উৎসর্গ বা যবেহ করা যাবে নাবরং এ প্রকার কাজ শিরক। এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তির বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لَعَنَ اللَّهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللَّهِ»
যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু যবেহ করে আল্লাহ তার উপর লানত করেন। [সহীহ মুসলিম]

৩.      এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল উটগরুমহিষছাগলভেড়াদুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় বাহীমাতুল আনআম। যেমন ইরশাদ হয়েছে :
﴿ وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ ﴾ [الحج: ٣٤]
আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছিতিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেনসেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। [সূরা আল-হাজ্জ৩৪]

৪.      শরিয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরী। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু বছরের হতে হবে। ছাগলভেড়াদুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। হাদীসে এসেছে, জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَا تَذْبَحُوا إِلَّا مُسِنَّةً إِلَّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنْ الضَّأْنِ»
তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (নির্দিষ্ট বয়সের পশু) কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার। [মুসলিম- ১৯৬৩]

৫.      গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হল কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্টঅধিক গোশত সম্পন্ননিখুঁতদেখতে সুন্দর হওয়া। কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদীসে এসেছে, বারা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
«قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيَدِي أَقْصَرُ مِنْ يَدِهِ فَقَالَ أَرْبَعٌ لَا يَجُزْنَ الْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا وَالْعَرْجَاءُ الْبَيِّنُ ظَلْعُهَا وَالْكَسِيرَةُ الَّتِي لَا تُنْقِي»
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন আর আমার হাত তার হাতের চেয়েও ছোট; তারপর বললেনচার ধরনের পশুযা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না। (অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে পরিপূর্ণ হবে না) অন্ধযার অন্ধত্ব স্পষ্টরোগাক্রান্তযার রোগ স্পষ্টপঙ্গুযার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহতযার কোন অংগ ভেংগে গেছে। নাসায়ির বর্ণনায় আহত শব্দের স্থলে পাগল উল্লেখ আছে। [তিরমিযি-১৫৪৬নাসায়ি- ৪৩৭১হাদীসটি সহীহ ]

.      উট ও গরু-মহিষে সাত ভাগে কুরবানী দেয়া যায়। যেমন হাদীসে এসেছে, জাবের ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْبَدَنَةُ عَنْ سَبْعَةٍ».
উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা বৈধ। [ইব্ন মাজাহ- ৩১৩২]

.      মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানী করা জায়েয : প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর প্রচলন জীবিত ব্যক্তিদের জন্য। যেমন আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ নিজেদের পক্ষে কুরবানী করেছেন। অনেকের ধারণা কুরবানী শুধু মৃত ব্যক্তিদের জন্য করা হবে। এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। তবে মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ হতে কুরবানী করা জায়েয আছে। কুরবানী এক প্রকার সদকাহ। আর মৃত ব্যক্তির নামে যেমন সাদাকাহ করা যায় তেমনি তার পক্ষ হতে কুরবানীও দেয়া যায়।


কুরবানীর পশু যবেহ

১.      কুরবানীদাতা নিজের কুরবানীর পশু নিজেই যবেহ করবেনযদি তিনি ভালভাবে যবেহ করতে পারেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যবেহ করেছেন। আর যবেহ করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের নিজের কুরবানী নিজে যবেহ করার চেষ্টা করা উচিত। ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন : আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের মেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজ হাতে নিজেদের কুরবানীর পশু যবেহ করেন। [ফাতহুল বারী ১০/২১]

২.      কুরবানীর পশু যবেহ করার দায়িত্ব নিজে না পারলে অন্যকে অর্পণ করা জায়েয আছে। কেননা সহীহ মুসলিমের হাদীসে এসেছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেষট্টিটি কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করে বাকিগুলো যবেহ করার দায়িত্ব আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অর্পণ করেছেন। [সহীহ মুসলিম- ১২১৮]

৩.      কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় তার সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবেতাকে আরাম দিতে হবে। যাতে পশু কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। হাদীসে এসেছে, শাদ্দাদ ইবন আউস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 
«ثِنْتَانِ حَفِظْتُهُمَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ فَإِذَا قَتَلْتُم فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ»
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দু’টি বিষয় আমি মুখস্থ করেছি, তিনি বলেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল বিষয়ে সকলের সাথে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন যবেহ করবে তখনও তা সুন্দরভাবে করবে। তোমাদের একজন যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যা যবেহ করা হবে তাকে যেন প্রশান্তি দেয়। [সহীহ মুসলিম-১৯৫৫]

.      যবেহ করার সময় তাকবীর ও বিসমিল্লাহ বলা। যেমন হাদিসে এসেছেজাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত ...
وَأُتِىَ بِكَبْشٍ فَذَبَحَهُ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- بِيَدِهِ وَقَالَ «بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ هَذَا عَنِّى وَعَمَّنْ لَمْ يُضَحِّ مِنْ أُمَّتِى»
“আর তার কাছে একটি দুম্বা আনা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে যবেহ করলেন এবং বললেন বিসমিল্লাহ ওয়া আল্লাহু আকবারহে আল্লাহ! এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে। [আবু দাউদ: ২৮১০]
অন্য হাদীসে এসেছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«ضَحَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ وَسَمَّى وَكَبَّرَ وَوَضَعَ رِجْلَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا»
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি শিংওয়ালা ভেড়া যবেহ করলেনতখন বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন। [সহীহ বুখারী]

.      যবেহ করার সময় যার পক্ষ থেকে কুরবানী করা হচ্ছে তার নাম উল্লেখ করে দো‘আ করা জায়েয আছে। এভাবে বলা, ‘হে আল্লাহ তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও। যেমন হাদীসে এসেছেআয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দুম্বা যবেহ করার সময় বললেন :
«بِسْمِ اللهِ، اَللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ، وَآلِ مُحَمَّدٍ، وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ»
আল্লাহর নামেহে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন। [মুসলিম- ১৯৬৭]

.      ঈদের সালাত আদায় ও খুতবা শেষ হওয়ার পর পশু যবেহ করা। কেননা হাদীসে এসেছে, জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«صَلَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ النَّحْرِ ثُمَّ خَطَبَ ثُمَّ ذَبَحَ»
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন সালাত আদায় করলেন অতঃপর খুতবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন। [সহীহ আল-বুখারী: ৯৮৫]


কুরবানীর গোশত

১.      কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতা ও তার পরিবারের সদস্যরা খেতে পারবেআল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :
﴿فَكُلُواْ مِنۡهَا وَأَطۡعِمُواْ ٱلۡبَآئِسَ ٱلۡفَقِيرَ ٢٨ ﴾ [الحج: ٢٨] 
অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থঅভাবগ্রস্তকে আহার করাও। [সূরা আল-হজ্জ২৮]

২.      উলামায়ে কিরাম বলেছেনঃ কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেরা খাওয়াএক ভাগ দরিদ্রদের দান করা ও এক ভাগ উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজনবন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের দান করা মুস্তাহাব।

৩.      কুরবানীর গোশত যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যাবে। কুরবানীর গোশত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«كُلُوا وَأَطْعِمُوا وَادَّخِرُوا»
তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর।   [সহীহ  আল-বুখারী ৫৫৬৯]

৪.      কুরবানীর পশুর গোশতচামড়াচর্বি বা অন্য কোন কিছু বিক্রি করা জায়েয নেই। কসাই বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানীর গোশত দেয়া জায়েয নয়। হাদিসে এসেছে :
«وَلَا يُعْطِيَ فِي جِزَارَتِهَا شَيْئًا»
‘আর তা প্রস্তুতকরণে তা থেকে কিছু দেয়া হবে না। [বুখারী -১৭১৬] 
তবে দান বা উপহার হিসেবে কসাইকে কিছু দিলে তা না-জায়েয হবে না।


কুরবানীর সময়কাল

কুরবানীর শেষ সময় হচ্ছে যিলহজ মাসের তের তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএব কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় হলো চার দিন। কুরবানী ঈদের দিন এবং ঈদের পরবর্তী তিনদিন অর্থাৎ  যিলহজ মাসের দশএগারবার ও তের তারিখ। এটাই উলামায়ে কেরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। কারণআল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন
﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِ﴾ [الحج: ٢٨] 
যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। [সূরা আল-হাজ্ব : ২৮]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন : ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন: এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে বুঝায়, কুরবানীর দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন। [ফাতহুল বারী২য় খন্ডপৃ-৫৬১] অতএব এ দিনগুলো আল্লাহ তাআলা কুরবানীর পশু যবেহ করার জন্য নির্ধারণ করেছেন। এ ব্যাপারে জুবাইর ইবন মুত‘ইম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«كُلُّ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ ذَبْحٌ» .
আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিন যবেহ করা যায়। [মুসনাদ আহমদ- ৪/৮২হাদীসটি সহীহ]
আর আইয়ামে তাশরীক সম্পর্কে বলা হয়,  
أيام التشريق هي اليوم الحادي عشر والثاني عشر والثالث عشر من شهر ذي الحجة
আইয়ামে তাশরীক বলতে এগারবার ও তের যিলহাজ্জকে বুঝায়। فتاوى الإسلام سؤال وجواب]
তবে কারো কারো মতেকুরবানী ঈদের দিন এবং ঈদের পরবর্তী দুই দিন করা যায়।


কার উপর কুরবানী আবশ্যক?

কুরবানীর পশু যবেহ করতে আর্থিকভাবে সামর্থবান ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব। সামর্থবান কাকে বলা হবে এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের মতপার্থক্য রয়েছে।
       ১. হানাফী মাযহাবের আলেমদের মতেব্যক্তিগত আসবাব পত্র ও ঈদের দিনগুলোর মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার অতিরিক্ত যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।
      ২. একদল আলেমের মতেঈদের দিনগুলোতে কুরবানীর পশু খরিদ করার মত অর্থ যার কাছে রয়েছে সে কুরবানী আদায় করবে। (তাবয়ীনুল হাক্বাইক-৩/৬শারহ আর-রিসালাহ- পৃ: ৩৬৭হাশিয়াতুল বাজুরী ২/৩০৪কাশ্শাফুল কিনা ৩/১৮)।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস দ্বিতীয় মতটিকে শক্তিশালী করে। হাদীসে এসেছে :
«مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا»
যে কুরবানী করার মত আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করে সে যদি কুরবানী না করে তবে সে যেন আমাদের ইদগাহে না আসে।’ 
এতে প্রমাণিত হয়েছে কুরবানীর পশু যবেহ করার স্বচ্ছলতাই এর জন্য অন্যতম শর্ত। কুরবানীর জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত নয়।


কুরবানী দাতার করণীয়

১.      শুধু কুরবানীর গোশত খাওয়ার জন্য কুরবানীর পশু যবেহ করা নয়বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার কুরবানী করবেন । এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
«وَمَنْ نَحَرَ قَبْلَ الصَّلاَةِ فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لِأَهْلِهِ، لَيْسَ مِنَ النُّسْكِ فِي شَيْءٍ»
“আর যে কেউ সালাতের পূর্বে নাহর করবে বা যবেহ করবে, সে তো তার পরিবার বর্গের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করলকুরবানীর কিছু আদায় হল না। [সহীহ বুখারী: ৯৬৫ ]

২.      কুরবানীদাতা ঈদের চাঁদ দেখার পর স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত বিরত থাকবেন। হাদীসে এসেছে, উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ»
তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করার ইচ্ছে করে সে যেন যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও  নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৩.      কুরবানীর দ্বারা পরিবেশ দূষিত হয় এমন কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সুতরাং পশুর রক্ত মাটি দ্বারা ঢেকে দেয়াময়লাআবর্জনা সরিয়ে ফেলা একান্ত প্রয়োজন ।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরাবানীর মাধ্যমে  আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার তাওফীক দিন । আমীন

وصلى الله على نبينا محمد وعلي اله وأصحابه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين


وأخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين


লেখক: হাবীবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলামহাউজ







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন