Views:
A+
A-
এতেকাফের ফযীলত
সিয়াম ও রমজান : শিক্ষা-তাৎপর্য-মাসায়েল (২য় পর্ব)
১ম পর্ব | ২য় পর্ব
এতেকাফ : তাৎপর্য, উদ্দেশ্য ও বিধানাবলী
এতেকাফের সংজ্ঞা
এতেকাফের ফযীলত
এতেকাফ একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি বছরই এতেকাফ পালন করেছেন। দাওয়াত, তরবিয়ত, শিক্ষা এবং জিহাদে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রমজানে তিনি এতেকাফ ছাড়েননি। এতেকাফ ঈমানী তরবিয়তের একটি পাঠশালা, এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিদায়াতি আলোর একটি প্রতীক। এতেকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। এতেকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মূখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ঈমানী চেতনাকে প্রাণিত করে তোলা ও উন্নততর পর্যায়ে পৌছেঁ দেয়ার চেষ্টা করা।
আল-কুরআনুল কারিমে বিভিন্নভাবে এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে, ইবরাহীম আ. ও ইসমাইল আ. এর কথা উল্লেখ করে এরশাদ হয়েছে :
'এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।'[১০৫]
এতেকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ হবে তা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন:
'আর তোমরা মসজিদে এতেকাফ কালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না।'[১০৬]
ইবরাহীম আ. তাঁর পিতা এবং জাতিকে লক্ষ্য করে মূর্তির ভর্ৎসনা করতে যেয়ে যা বলেছিলেন, আল্লাহ তা'আলা তা উল্লেখ করে বলেন:
'যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: 'এই মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজারি (এতেকাফকারী) হয়ে তোমরা বসে আছ'?[১০৭]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অসংখ্য হাদীস এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্য হতে ফযীলত সম্পর্কিত কিছু হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হল:
عن عائشة رضي الله عنها قالت: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر حتى توفاه الله، ثم أزواجه من بعده. البخاري:১৮৮৬ و مسلم :২০০৬
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: 'রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষের দশকে এতেকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রী গণ এতেকাফ করেছেন।'[১০৮]
عن عائشة رضي الله عنها قالت: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان . البخاري: ২০৪১
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: 'রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমজানে এতেকাফ করতেন।'[১০৯]
অন্য এক হাদীসে এসেছে,
إني اعتكفت العشر الأول ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي إنها في العشر الأواخر فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف، فاعتكف الناس معه، قال: وإني أُريتها ليلة وتر وأني أسجد صبيحتها في طين وماء، فأصبح من ليلة إحدى وعشرين وقد قام إلى الصبح، فمطرت السماء فوكف المسجد، فأبصرت الطين والماء، فخرج حين فرغ من صلاة الصبح وجبينه وروثة أنفه فيهما الطين والماء، وإذا هي ليلة إحدى وعشرين. مسلم:১৯৯৪
আমি (প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে এতেকাফ পালন করি। অত:পর এতেকাফ পালন করি মাঝের দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশে) এতেকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে এতেকাফ পালন করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ ছেপে বৃষ্টি নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত।[১১০]
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كان النبي صلي الله عليه و سلم يعتكف في كل رمضان عشرة أيام، فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوماً. البخاري: ১৯০৩
'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিন এতেকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি বিশ দিন এতেকাফে কাটান।'[১১১]
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত হাদীসে উভয়টির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন,
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان عشرة أيام فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوما. البخاري: ১৯০৩
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। তবে যে বছর পরলোকগত হন তিনি বিশ দিন এতেকাফ করেছেন।'[১১২]
عن عائشة رضي الله عنها أن النبي صلى الله عليه وسلم اعتكف معه بعض نسائه وهي مستحاضة ترى الدم فربما وضعت الطست تحتها من الدم) البخاري:২৯৮
আয়শা রা. বলেন, 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে তাঁর জনৈকা স্ত্রীও এতেকাফ করলেন। তখন তিনি ছিলেন এস্তেহাজা অবস্থায়, রক্ত দেখছেন। রক্তের কারণে হয়তো তাঁর নীচে গামলা রাখা হচ্ছে।[১১৩]
রাসূল বলেন্ত
রাসূল বলেন্ত
إني اعتكفت العشر الأُوَل ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي: إنها في العشر الأواخر؛ فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف؛ فاعتكف الناس معه. مسلم:১৯৯৪
'আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিন। অত:পর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হল যে তা শেষ দশদিনে। সুতরাং তোমাদের যে এতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে।' ফলে, মানুষ তার সাথে এতেকাফ যাপন করল।[১১৪]
এতেকাফের উপকারিতা
১- এতেকাফকারী এক নামাযের পর আর এক নামাযের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফযীলত রয়েছে।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إن الملائكة تصلي على أحدكم ما دام في مصلاه ما لم يحدث: اللهم اغفر له، اللهم ارحمه لا يزال أحدكم في مصلاه ما دامت الصلاة تحبسه، لا يمنعه أن ينقلب إلي أهله إلا الصلاة. مسلم:৬১১
'নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাযের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাযের স্থানে থাকবে, ও নামায তাকে আটকিয়ে রাখবে, তার পরিবারের নিকট যেতে নামায ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।'[১১৫]
২- এতেকাফকারী কদরের রাতের তালাশে থাকে, যে রাত অনির্দিষ্টভাবে রমজানের যে কোন রাত হতে পারে। এই রহস্যের কারণে আল্লাহ তা'আলা সেটিকে বান্দাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যেন তারা মাস জুড়ে তাকে তালাশ করতে থাকে।
৩- এতেকাফের ফলে আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এবং আল্লাহ তা'আলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তা'আলা বলেন:
অর্থাৎ: আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।[১১৬]
আর এ ইবাদতের বিবিধ প্রতিফলন ঘটে এতেকাফ অবস্থায়। কেননা এতেকাফ অবস্থায় একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁধে নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
আল্লাহ তা'আলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে দিয়ে বলেছেন:
অর্থাৎ: বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[১১৭]
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে- বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করি যখন সে প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মান্য করে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। সম্ভবত তারা পথ প্রাপ্ত হবে।[১১৮]
৪- যখন কেউ মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ করতে লাগ্তে যা সম্ভব প্রবৃত্তিকে অভ্যস্ত করানোর মাধ্যমে, কেননা প্রবৃত্তিকে যে বিষয়ে অভ্যস্ত করানো হবে সে বিষয়েই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ব্তে মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ হতে শুরু করলে মসজিদকে সে ভালোবাসবে, সেখানে নামায আদায়কে ভালোবাসবে। আর এ প্রক্রিয়ায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। হৃদয়ে সৃষ্টি হবে নামাযের ভালোবাসা, এবং নামায আদায়ের মাধ্যমেই অনুভব করতে শুরু করবে হৃদয়ের প্রশান্তি। যে প্রশান্তির কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে বলেছিলেন:
(أرحنا بها يا بلال، أرحنا بها يا بلال) المعجم الكبير للطبراني:৬০৯০
'নামাযের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল! নামাযের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল!'[১১৯]
৫- মসজিদে এতেকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তা'আলার উদ্দেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়ার কারণে মুসলমানের অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয় দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায় নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার কারণে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়।
মসজিদে এতেকাফ করার কারণে ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, ফলে এতেকাফকারী ব্যক্তির আত্মা নিম্নাবস্থার নাগপাশ কাটিয়ে ফেরেশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফেরেশতাদের পর্যায় থেকেও বরং ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস পায়। কেননা ফেরেশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে না। আর মানুষের প্রবৃত্তি থাকা সত্ত্বেও সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত হয়ে যায়।
৬- এতেকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।
৭- বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৮- ঐকান্তিকভাবে তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।
৯- তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়।
১০-সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।
এতেকাফের আহকাম
ইসলামী শরিয়াতে এতেকাফের অবস্থান
এতেকাফ করা সুন্নাত। এতেকাফের সবচেয়ে উপযোগী সময় রমজানের শেষ দশক, এতেকাফ কুরআন, হাদীস ও এজমা দ্বারা প্রমাণিত।
ইমাম আহমদ রহ. বলেন: কোন মুসলমান এতেকাফকে সুন্নাত বলে স্বীকার করেনি, এমনটি আমার জানা নেই।
এতেকাফের উদ্দেশ্য
১- আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা
আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়া ও আল্লাহকেন্দ্রিক ব্যতিব্যস্ততা যখন অন্তর সংশোধিত ও ঈমানী দৃঢ়তা অর্জনের পথ, কেয়ামতের দিন তার মুক্তিও বরং এ পথেই। তাহলে এতেকাফ হল এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে বান্দা সমস্ত সৃষ্টি-জীব থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব প্রভুর সান্নিধ্যে চলে আসে। বান্দার কাজ হল তাঁকে স্মরণ করা, তাঁকে ভালোবাসা ও তাঁর ইবাদত করা। সর্বদা তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, এরই মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়।
২-পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দুরে থাকা
রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অতিরিক্ত পানাহার ও যৌনাচারসহ পশু প্রবৃত্তির বিবিধ প্রয়োগ থেকে, অনুরূপভাবে তিনি এতেকাফের বিধানের মাধ্যমে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ সংস্পর্শ, ও অধিক ঘুম হতে।
এতেকাফের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ অর্থে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। নামায, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও দোয়া ইত্যাদির নির্বাধ চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অফুরান সুযোগের আবহে সে নিজেকে পেয়ে যায়।
৩- শবে কদর তালাশ করা
এতেকাফের মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত হাদীস সে কথারই প্রমাণ বহন করে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إني اعتكفت العشر الأول ألتمس هذه الليلة ثم اعتكفت العشر الأوسط ثم أتيت فقيل لي إنها في العشر الأواخر فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف فاعتكف الناس معه. مسلم : ১১৬৭
'আমি প্রথম দশকে এতেকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশে। অতঃপর এতেকাফ করেছি মাঝের দশকে। অত:পর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম। তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ এতেকাফ করতে চায় সে যেন এতেকাফ করে।' অত:পর লোকেরা তাঁর সাথে এতেকাফ করল।[১২০]
৪-মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা
এতেকাফের মাধ্যমে বান্দার অন্তর মসজিদের সাথে জুড়ে যায়, মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। হাদীস অনুযায়ী যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের ছায়ার নীচে ছায়া দান করবেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি মসজিদের সাথে যার হৃদয় ছিল বাঁধা :
(ورجل قلبه معلق بالمساجد) البخاري:৬২০
' এবং ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে বাঁধা।'[১২১]
৫- দুনিয়া ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দুরে থাকা
এতেকাফকারী যেসব বিষয়ের সাথে জীবন যাপন করত, সেসব থেকে সরে এসে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে ফেলে। এতেকাফ অবস্থায় দুনিয়া ও দুনিয়ার স্বাদ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ঠিক ঐ আরোহীর ন্যায় যে কোন গাছের ছায়ার নীচে বসল, অতঃপর সেখান থেকে উঠে চলে গেল।
৬- ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস ও কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা
কেননা এতেকাফ দ্বারা খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত থাকার ট্রেন্ড গড়ে উঠে। এতেকাফ তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় নিজেকে ধৈর্যের গুণে গুণান্বিত করতে ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে শানিত করতে। এতেকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বের হয়ে আসার সুযোগ পায়। যা পরকালে উপকারে আসবে না তা থেকে বিরত থাকার ফুরসত মেলে।
এতেকাফের বিধানাবলী
১- এতেকাফের সময়সীমা
সবচেয়ে কম সময়ের এতেকাফ হল, শুদ্ধ মত অনুযায়ী, একদিন এক রাত। কেননা সাহাবায়ে কেরাম রাদি-আল্লাহু আনহুম নামায অথবা উপদেশ শ্রবণ করার অপেক্ষায় বা জ্ঞান অর্জন ইত্যাদির জন্য মসজিদে বসতেন, তবে তারা এ সবের জন্য এতেকাফের নিয়ত করেছেন বলে শোনা যায়নি।
সর্বোচ্চ কতদিনের জন্য এতেকাফ করা যায় এ ব্যাপারে ওলামাদের মতামত হল, এ ব্যাপারে নির্ধারিত কোন সীমা-রেখা নেই।
২- এতেকাফে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময়
এতেকাফকারী যদি রমজানের শেষ দশকে এতেকাফের নিয়ত করে তা হলে একুশতম রাত্রির সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবে, কেননা তার উদ্দেশ্য কদরের রাত তালাশ করা, যা আশা করা হয়ে থাকে বেজোড় রাত্রগুলোতে, যার মধ্যে একুশের রাতও রয়েছে। ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর সে এতেকাফ থেকে বের হতে পারবে।
৩- এতেকাফের শর্তাবলী
এতেকাফের অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। শর্ত গুলো নিম্নরূপ:
এতেকাফের জন্য কেউ কেউ রোজার শর্ত করেছেন, কিন্তু বিশুদ্ধ মত হল রোজা শর্ত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত আছে যে তিনি কোন এক বছর শাওয়ালের প্রথম দশকে এতেকাফ করেছিলেন, আর এ দশকে ঈদের দিনও আছে। আর ঈদের দিনে তো রোজা রাখা নিষিদ্ধ।
* এতেকাফের জন্য মুসলমান হওয়া শর্ত। কেননা কাফেরের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না।
* এতেকাফকারীকে বোধশক্তিসম্পন্ন হতে হবে, কেননা নির্বোধ ব্যক্তির কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আর উদ্দেশ্য ব্যতীত কাজ শুদ্ধ হতে পারে না।
* ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে, কেননা কম বয়সী, যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না, তার নিয়তও শুদ্ধ হয় না।
*এতেকাফের নিয়ত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়তো এতেকাফের নিয়তে হবে অথবা অন্য কোনো নিয়তে। আর এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়তের প্রয়োজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো বলেছেন :
إنما الأعمال بالنيات ، وإنما لكل إمري ما نوى . البخاري:০১
'প্রত্যেক কাজের নির্ভরতা নিয়তের উপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তাই পাবে।'[১২২]
* এতেকাফ অবস্থায় মহিলাদের হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র থাকা জরুরি, কেননা এ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা হারাম, অবশ্য এস্তেহাজা অবস্থায় এতেকাফ করা বৈধ। আয়েশা রা. আনহা বলেন :
اعتكفت مع رسول الله صلي الله عليه وسلم امرأة من أزواجه مستحاضة فكانت ترى الحمرة والصفرة فربما وضعنا الطست تحتها وهي تصلي. البخاري : ২০৩৭
'রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে তাঁর স্ত্রী-গণের মধ্য হতে কেউ একজন এতেকাফ করেছিলেন এস্তেহাজা অবস্থায়। তিনি লাল ও হলুদ রঙ্গের স্রাব দেখতে পাচ্ছিলেন, আমরা কখনো তার নীচে পাত্র রেখে দিয়েছি নামাযের সময়।'[১২৩]
এস্তেহাজাগ্রস্তদের সাথে অন্যান্য ব্যাধি গ্রস্তদেরকে মেলানো যায়, যেমন যার বহুমূত্র রোগ আছে। তবে শর্ত হল মসজিদ যেন অপবিত্র না হয়।
* গোসল ফরজ হয় এমন ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতে হবে। অপবিত্র লোকের মসজিদে অবস্থান করা হারাম। যদিও কোন কোন আলেম ওজু করার শর্তে মসজিদে অবস্থান বৈধ বলেছেন। আর যদি অপবিত্রতা, যৌন স্পর্শ অথবা স্বামী -স্ত্রীর মিলনের ফলে হয়, তবে সকলের মতে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি স্বপ্নদোষের কারণে হয়, তা হলে কারোর মতে এতেকাফ ভঙ্গ হবে না। যদি হস্ত মৈথুনের কারণে হয় তা হলে সঠিক মত অনুসারে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
* এতেকাফ মসজিদে হতে হবে : এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে এতেকাফ মসজিদে হতে হবে। তবে জামে মসজিদ হলে উত্তম। কেননা এমতাবস্থায় জুমার নামাযের জন্য এতেকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে না।
মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধান
* এতেকাফকারী যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় তাহলে তার এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
* আর এতেকাফের স্থান থেকে যদি মানবীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য বের হয় তাহলে এতেকাফ ভঙ্গ হবে না।
* মসজিদে থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্ভব না হলে মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি আছে।
* বাহক না থাকার কারণে এতেকাফকারীকে যদি পানাহারের প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয় অথবা মসজিদে খাবার গ্রহণ করতে লজ্জা বোধ হয়, তবে এরূপ প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে।
* যে মসজিদে এতেকাফে বসেছে সেখানে জুমার নামাযের ব্যবস্থা না থাকলে জুমার নামায আদায়ের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া ওয়াজিব, এবং আগে ভাগেই রওয়ানা হওয়া তার জন্য মুস্তাহাব।
* ওজরের কারণে এতেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারে। ছাফিয়্যা রা. থেকে বর্ণিত হাদীস এর প্রমাণ :
أنها جاءت إلى رسول الله صلي الله عليه وسلم تزوره في اعتكافه في المسجد في العشر الأواخر من رمضان فتحدثت عنده ساعة ثم قامت تنقلب فقام النبي صلي الله عليه وسلم معها يقلبها. البخاري :১৮৯৪
ছাফিয়্যা রা. রমজানের শেষ দশকে এতেকাফস্থলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কতক্ষণ কথা বললেন, অতঃপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিদায় দিতে উঠে দাঁড়ালেন।[১২৪]
* কোন নেকির কাজ করার জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। যেমন রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। এ মর্মে আয়শা রা. বলেন:
السنة علي المعتكف أن لا يعود مريضا ولا يشهد جنازة ولا يمس إمرأة ولا يباشرها ولا يخرج لحاجة إلا لما لا بد منه أبو داود : ২১১৫
'এতেকাফকারীর জন্য সুন্নত হল, সে রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় উপস্থিত হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না ও তার সাথে কামাচার থেকে বিরত থাকবে এবং অতি প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না।'[১২৫]
* এতেকাফ-বিরুদ্ধ কোন কাজের জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়, যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্বামী-স্ত্রীর মিলন ইত্যাদি।
এতেকাফকারীর জন্য যা কিছু বিধিবদ্ধ
* ইবাদত আদায়, যেমন নামায, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও দোয়া ইত্যাদি। কেননা এতেকাফের উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তা'আলার সমীপে অন্তরের একাগ্রতা নিবেদন করা এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যা উপরোক্ত ইবাদত আদায় ছাড়া সম্ভব নয়।
অনুরূপভাবে যেসব ইবাদতের প্রভাব অন্যদের পর্যন্ত পৌঁছায় যেমন সালামের উত্তর দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বারণ, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, পথ দেখানো, ইলম শিক্ষা দেওয়া, কুরআন পড়ানো ইত্যাদিও করতে পারবে। কিন্তু শর্ত হল এগুলো যেন এত বেশি না হয় যে এতেকাফের মূল উদ্দেশ্যই ছুটে যায়।
* এতেকাফকারীর জন্য মুস্তাহাব হল, তার এতেকাফের স্থানে কোন কিছু দ্বারা পর্দা করে নেয়া। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুর্কি তাবুর ভিতরে এতেকাফ করেছেন যার দরজায় ছিল চাটাই।
اعتكف في قبة تركية على سدتها حصير ( مسلم :১৯৯৪)
* এতেকাফকারী তার প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র সঙ্গে নেবে যাতে নিজের প্রয়োজনে তাকে বার বার মসজিদের বাইরে যেতে না হয়। আবু সাইদ খুদরি রা. এর হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন:
اعتكفنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم العشر الأوسط فلما كان صبيحة عشرين نقلنا متاعنا، فأتانا رسول الله صلي الله عليه وسلم فقال: من اعتكف فليرجع إلى معتكفه البخاري :১৮৯৯
অর্থাৎ: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে রমজানের মাঝের দশকে এতেকাফ করলাম, যখন বিশ তারিখ সকাল হল আমরা আমাদের বিছানা-পত্র সরিয়ে নিলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে বললেন: 'যে এতেকাফ করেছে সে তার এতেকাফের স্থানে ফিরে যাবে।'[১২৬]
এতেকাফকারীর জন্য যা অনুমোদিত
* এতেকাফকারীর জন্য মসজিদে পানাহার ও ঘুমানোর অনুমতি আছে। এ ব্যাপারে সকল ইমামদের ঐক্যমত রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। কেননা আল্লাহর প্রতি একাগ্রচিত্ত এবং একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশের জন্য কম খাওয়া কম ঘুমানো সহায়ক বলে বিবেচিত।
* গোসল করা, চুল আঁচড়ানো, তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার, ভাল পোশাক পরা, এ সবের অনুমতি আছে। আয়েশা রা. এর হাদীসে এসেছে :
أنها كانت ترجل النبي صلي الله عليه وسلم وهي حائض وهو معتكف في المسجد وهي في حجرتها يناولها رأسه ) البخاري : ২০৪৬)
অর্থাৎ: তিনি মাসিক অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাথার কেশ বিন্যাস করে দিতেন, যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে এতেকাফরত অবস্থায় থাকতেন, আয়েশা রা. তার কক্ষে থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাথার নাগাল পেতেন।[১২৭]
* এতেকাফকারীর পরিবার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে, কথা বলতে পারবে, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রীগণ এতেকাফকালীন তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু সাক্ষাৎ দীর্ঘ না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এতেকাফকারী যা থেকে বিরত থাকবে
* ওজর ছাড়া এতেকাফকারী এমন কোন কাজ করবে না যা এতেকাফকে ভঙ্গ করে দেয়, আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
'তোমরা তোমাদের কাজ সমূহকে নষ্ট করো না।'[১২৮]
* ঐ সকল কাজ যা এতেকাফের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে, যেমন বেশি কথা বলা, বেশি মেলামেশা করা, অধিক ঘুমানো, ইবাদতের সময়কে কাজে না লাগানো ইত্যাদি।
* এতেকাফকারী মসজিদে অবস্থানকালে ক্রয়-বিক্রয় করবে না, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।[১২৯]
نهى عن البيع والاشتراء في المسجد. المسند لأحمد : ৬৯৯১
এমনিভাবে যা ক্রয় বিক্রয়ের কাজ বলে বিবেচিত, যেমন বিভিন্ন ধরনের চুক্তিপত্র, ভাড়া, মুদারাবা, মুশারাকা, বন্ধক রাখা ইত্যাদি। কিন্তু যদি মসজিদের বাহিরে এমন ক্রয়-বিক্রয় হয়, যা ছাড়া এতেকাফকারীর সংসার চলে না তবে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
আনাস রা. এর হাদীসে এসেছে, যখন বেদুইন লোকটি মসজিদে প্রস্রাব করেছিল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন:
إن هذه المساجد لا تصلح لشيئ من هذا البول ولا القذر إنما هي لذكر الله عز وجل والصلاة وقراءة القرآن. مسلم : ৪২৯
অর্থাৎ: মসজিদ প্রস্রাব, ময়লা-আবর্জনার উপযোগী নয়, বরং মসজিদ অবশ্যই আল্লাহর যিকির এবং নামায ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য।[১৩০]
* এতেকাফ অবস্থায় যৌন স্পর্শ নিষেধ, এ ব্যাপারে সকল ওলামাদের ঐকমত্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ ওলামাদের মতে বীর্য স্খলনের দ্বারাই কেবল এতেকাফ ভঙ্গ হয়।
সদকাতুল ফিতর
আমাদের প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরেকটি অনুগ্রহ যে তিনি আমাদের ইবাদত-বন্দেগীতে কোন ত্রুটি হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। যেমন নফল নামায দ্বারা ফরজ নামাযের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এমনি সিয়াম পালনে যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে তার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য সদকাতুল ফিতর আদায়ের বিধান দিয়েছেন। সাথে সাথে দরিদ্র ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষেরা যেন ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থাও দিয়েছেন। কেউ যেন অর্থাভাবে ঈদের খুশি থেকে বঞ্চিত না থাকে সে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইসলামী সমাজকে এ বিধান দিয়েছেন। এ ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে থাকে। তিনিই তো সিয়াম পূর্ণ করা ও রমজানের রাতে কিয়াম সহ অন্যান্য নেক আমল এবং কল্যাণকর কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন।
১-সদকাতুল ফিতরের বিধান:
হাদীসে এসেছে,
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر طهرة للصائم من اللغو والرفث وطعمة للمساكين، فمن أداها قبل الصلاة فهي مقبولـة، ومن أداها بعد الصلاة فهي صدقة من الصدقات. أبوداود:১৩৭১
'ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়াম পালনকারীর জন্য সদকাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন। যা সিয়াম পালনকারীর অনর্থক, অশ্লীল কথা ও কাজ পরিশুদ্ধকারী ও অভাবী মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বে এটা আদায় করবে তা সদকাতুল ফিতর হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তা অপরাপর (নফল) সদকা হিসেবে গৃহিত।'[১৩১]
অতএব সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু ওয়াজিব করেছেন তা পালন করা উম্মতের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
'যে রাসূলের আনুগত্য করল সে তো আল্লাহর-ই আনুগত্য করল। এবং যে মুখ ফিরিয়ে নিল (জেনে রেখ) আমি তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাইনি।'[১৩২]
অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নির্দেশ দিয়েছেন তা মূলত আল্লাহর-ই নির্দেশ। আল্লাহ বলেন:
'তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসূলের।'[১৩৩]
২- সদকাতুল ফিতর কার উপর ওয়াজিব ?
প্রত্যেক এমন মুসলমান ব্যক্তির উপর ওয়াজিব যারা ঈদের দিনে তার পরিবারের এক দিন এক রাতের খাবারের অতিরিক্ত যদি এক সা' পরিমাণ খাদ্যের মালিক থাকে তবে তার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। তবে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর মতে ঐ ব্যক্তির উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব যে ঈদের দিন ভোরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ হিসেবে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সম-পরিমাণ সম্পদের মালিক। যার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন তেমনি নিজের পোষ্যদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন।
৩- সদকাতুল ফিতর এর পরিমাণ :
প্রধান খাদ্য হিসেবে যে সকল বস্তু স্বীকৃত যেমন গম, যব, ভুট্টা, চাউল, খেজুর ইত্যাদি থেকে এক সা' পরিমাণ দান করতে হবে। যেমন হাদীসে এসেছে,
عن ابن عمر رضي الله عنهما قال : فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر من رمضان، صاعا من تمر أو صاعا من شعير. مسلم:১৬৩৫
ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের যাকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা' খেজুর অথবা এক সা' গম আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন।।'[১৩৪]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমলের সা'-র হিসেবে এক সা'-তে ২ কেজি ৪০ গ্রাম হয়ে থাকে। এটা অধিকাংশ ইমামের মত। আর ইমাম আবু হানীফা রহ.-র মতে অর্ধ সা' পরিমাণ আটা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা জায়েয। তবে 'এক সা' পরিমাণ আদায় করলে আদায় হবে না, অর্ধ সা' দিতেই হবে' এমন কথা কখনো কোন হানাফী ইমাম বলেননি। বরং যুক্তির দিক দিয়েও এটাই উত্তম যাতে মানুষের বিশেষ করে দরিদ্র অসহায়দের উপকার বেশি হয়। তাই এক সা' পরিমাণ খাদ্য সদকাতুল ফিতর হিসেবে দান করা হানাফি মাজহাবের বিরোধী নয়, বরং উত্তম। কেননা অধিকাংশ সহীহ হাদীসে এক সা' পরিমাণ আদায় করতে বলা হয়েছে।
তা ছাড়া হানাফী মাযহাবে যে অর্ধ সা' এর কথা বরা হয়েছে, সেটি ইরাকী সা' এর হিসাবে। ইরাকী সা' এর হিসাবে অর্ধ সা' তে এক কেজি সাত শত পঞ্চাশ গ্রাম হয়ে থাকে।
৪- কখন আদায় করবেন সদকাতুল ফিতর ?
সদকাতুল ফিতর আদায় করার দুটো সময় আছে। একটি হল উত্তম সময় অন্যটি হল বৈধ সময়। আদায় করার উত্তম সময় হল ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করা।
যেমন হাদীসে এসেছে,
عن ابن عمر رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم أمر بزكاة الفطر قبل خروج الناس إلى الصلاة. مسلم:১৬৪৬
'ইবনে উমার থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।'[১৩৫]
সদকাতুল ফিতর আদায় করার সুযোগ দেয়ার জন্যই ঈদুল ফিতরের সালাত একটু বিলম্বে আদায় করা মুস্তাহাব। সদকাতুল ফিতর আদায় করার বৈধ সময় হল: যদি কেউ ঈদের দু একদিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করে তবে আদায় হয়ে যাবে। সহীহ বুখারীতে আছে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. এভাবে আদায় করতেন। তবে কোন সংগত কারণ ব্যতীত ঈদের সালাতের পরে আদায় করলে সদকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় হবে না বরং একটি নফল সদকা হিসেবে আদায় হবে। ওজর বা বিশেষ অসুবিধায় কেউ যদি ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করতে না পারে তবে সে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে।
৫- সদকাতুল ফিতর কাকে দেবেন ?
নিজ শহরের অভাবী ও দরিদ্র মানুষদের সদকাতুল ফিতর দান করবেন। যারা যাকাত গ্রহণের অধিকার রাখে এমন অভাবী লোকদেরকে সদকাতুল ফিতর প্রদান করা হবে। একজন দরিদ্র মানুষকে একাধিক ফিতরা দেয়া যেমন জায়েয আছে, তেমনি একটি ফিতরা বণ্টন করে একাধিক মানুষকে দেয়াও জায়েয।
ঈদের তাৎপর্য ও করণীয়
ঈদের সংজ্ঞা :
ঈদ আরবী শব্দ। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বার বার ফিরে আসে। এটা আরবী শব্দ عاد يعود থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ ফিরে আসা। অনেকে বলেন এটা আরবী শব্দ العادة আদত বা অভ্যাস থেকে উৎপত্তি হয়েছে। কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। সে যাই হোক, যেহেতু এ দিনটি বার বার ফিরে আসে তাই এর নাম ঈদ। এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দিবসে তার বান্দাদেরকে নেয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বার বার ধন্য করেন ও বার বার তার এহসানের দৃষ্টি দান করেন। যেমন রমজানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। ছদকায়ে ফিতর, হজ-যিয়ারত, কুরবানীর গোশত ইত্যাদি নেয়ামত তিনি বার বার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নেয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগত ভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।
ইসলামে ঈদের প্রচলন
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদীসে এসেছে,
عن أنس بن مالك رضي الله عنهما قال: قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم المدينة، ولهم يومان يلعبون فيهما، قال: ما هذان اليومان؟ قالوا كنا نلعب فيهما في الجاهلية، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: قد أبدلكم الله خيرا منهما : يوم الأضحى ويوم الفطر. أبو داود:৯৫৯
'রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনা বাসীদের দুটো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু দিনের কি তাৎপর্য আছে? মদিনা বাসীগণ উত্তর দিলেন : আমরা মূর্খতার যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : 'আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।'[১৩৬]
শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দুটো দিন ছিল আল্লাহ তাআলা তা পরিবর্তন করে এমন দুটো দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, তার যিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে।
ঈদের তাৎপর্য
ইতিপূর্বে আলোচিত আনাস রা. বর্ণিত হাদীস থেকে ঈদের তাৎপর্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। তা হল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উম্মতে মুহাম্মদীকে সম্মানিত করে তাদের এ দুটো ঈদ দান করেছেন। আর এ দুটো দিন বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন ও সেরা ঈদ।
ইসলামের এ দু'টো উৎসবের দিন শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিন নয়। বরং এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসব এর সাথে সাথে জগৎসমূহের প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা সুসজ্জিত করা হবে। যিনি জীবন দান করেছেন, দান করেছেন সুন্দর আকৃতি, সুস্থ শরীর, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, যার জন্য জীবন ও মরণ তাকে এ আনন্দের দিনে ভুলে থাকা হবে আর সব কিছু ঠিকঠাক মত চলবে এটা কীভাবে মেনে নেয়া যায়? তাই ইসলাম আনন্দ-উৎসবের এ দিনটাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত-বন্দেগী, তার প্রতি শুকরিয়া-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা সু-সজ্জিত করেছে।
ঈদের দিনের করণীয়
ঈদের দিনে কিছু করণীয় আছে যা নীচে আলোচনা করা হল :
(১) গোসল করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা। ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মুস্তাহাব। কেননা এ দিনে সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। যে কারণে জুমআর দিন গোসল করা মুস্তাহাব সে কারণেই ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছ্তে
صح عن ابن عمر رضي الله عنهما أنه كان يغتسل يوم الفطر قبل أن يغدو إلى المصلى رواه الإمام مالك في أول كتاب العيدين وقال سعيد بن المسيب سنة الفطر ثلاث: المشي إلى المصلى والأكل قبل الخروج و الاغتسال. إرواء الغليل للألباني ২/১০৪
ইবনে উমার রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে তিনি ঈদুল-ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। সায়ীদ ইবনে মুসাইয়াব রহ. বলেন : ঈদুল ফিতরের সুন্নত তিনটি : ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া, ঈদগাহের দিকে রওয়ানার পূর্বে কিছু খাওয়া, গোসল করা।[১৩৭]
এমনিভাবে সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে,
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال: أخذ عمر جبة من استبرق تباع في السوق، فأخذها فآتى بها رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقال يا رسول الله ابتع هذه تجمل بها للعيد والوفود، فقال له رسول الله صلى الله عليه وسلم: إنما هذه لباس من لا خلاق له . البخاري: ৯৪৮
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত যে, উমার রা. একবার বাজার থেকে একটি রেশমি কাপড়ের জুব্বা আনলেন ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে দিয়ে বললেন : আপনি এটা কিনে নিন। ঈদের সময় ও আগত গণ্যমান্য প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাতে পরিধান করবেন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : 'এটা তার পোশাক যার আখেরাতে কোন অংশ নেই।'[১৩৮]
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিনে উত্তম পোশাক পরিধান করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি সম্মতি দিয়েছেন। আর উক্ত পোশাকটি রেশমি পোশাক হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেননা, ইসলামী শরীয়তে পুরুষদের রেশমি পোশাক পরিধান জায়েয নয়।
عن ابن عمر ، أنه كان ্র يلبس في العيدين أحسن ثيابه. معرفة السنن والآثار للبيهقي :১৯০১
ইবনে উমার রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত যে তিনি দু ঈদের দিনে সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন।[১৩৯]
ইমাম মালেক রহ. বলেন: 'আমি ওলামাদের কাছ থেকে শুনেছি তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও সাজ-সজ্জাকে মুস্তাহাব বলেছেন।' (আল-মুগনি: ইবনে কুদামাহ)
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন।[১৪০]
এ দিনে সকল মানুষ একত্রে জমায়েত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হল তার প্রতি আল্লাহর যে নেয়ামত তা প্রকাশ ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করনারথে নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। হাদীসে এসেছ্তে
عن عبد الله ابن عمرو قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن الله تعالى يحب أن يرى أثر نعمته على عبده. حسنه الألباني في صحيح الجامع: ১৮৮৭
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দার উপর তার প্রদত্ত নেয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।'[১৪১]
ফর্মা-৭
(২) ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ প্রসঙ্গে
সুন্নত হল ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা। আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। হাদীসে এসেছে,
عن بريدة رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم لا يخرج يوم الفطر حتى يأكل، ولا يأكل يوم الأضحى حتى يرجع فيأكل من أضحيته. أحمد: ১৪২২ وصححه الألباني في صحيح ابن ماجه
বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোশত খেতেন।[১৪২]
ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে তিনটি, পাঁচটি অথবা সাতটি এভাবে বে-জোড় সংখ্যায় খেজুর খাওয়া সুন্নত। যেমন হাদীসে এসেছ্তে
عن أنس رضي الله عنه قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يغدو يوم الفطر حتى يأكل تمرات، ويأكلهن وتراً. البخاري:৯০০
সাহাবী আনাস রা. বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন না, আর খেজুর খেতেন বে-জোড় সংখ্যায়।[১৪৩]
সম্ভবত আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের হুকুম অতি তাড়াতাড়ি আদায় করার ইচ্ছায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ করতেন। কেননা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম আদায়ের পর আল্লাহর নির্দেশ হল পানাহার করা। এটা করতে যেন দেরি না হয়ে যায় এজন্য তিনি উপস্থিতভাবে খেজুর হলেও খেয়ে নিতেন। যিনি কুরবানী দেবেন, তার জন্য সুন্নত হল ঈদুল আজহার দিনে প্রথমে কুরবানী দিয়ে তার গোশত খাওয়া। আর যিনি কুরবানী দেবেন না তিনি ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু খেতে পারেন।
(৩) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া
ঈদগাহে তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত। যাতে ইমাম সাহেবের নিকটবর্তী স্থানে বসা যায় ও ভালো-কাজ অতি তাড়াতাড়ি করার সওয়াব অর্জন করা যায়, সাথে সাথে সালাতের অপেক্ষায় থাকার সওয়াব পাওয়া যায়। ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া হল মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে,
عن علي رضي الله عنه قال: من السنة أن تخرج إلى العيد ماشيا. الترمذي:৪৮৭ وحسنه وقال: والعمل على هذا عند أكثر أهل العلم : يستحبون أن يخرج الرجل إلى العيد ماشيا، وأن لا يركب إلا بعذر.
আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : 'সুন্নত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।' ইমাম তিরমিযী হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন হাদিসটি হাসান। তিনি আরো বলেন : অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ অনুযায়ী আমল করেন। এবং তাদের মত হল পুরুষ ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাবে, এটা মুস্তাহাব। আর গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহণ করবে না।[১৪৪]
আর একটি সুন্নত হল : যে পথে ঈদগাহে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসবে। যেমন হাদীসে এসেছে,
عن جابر رضي الله عنه قال : كان النبي صلى الله عليه و سلم إذا كان يوم العيد خالف الطريق . البخاري:৯৩৩
জাবের রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : 'নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।'[১৪৫]
অর্থাৎ যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে পথে ফিরে না এসে অন্য পথে আসতেন।
তিনি এটা কেন করতেন ? এর ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন হিকমত বর্ণনা করেছেন। অনেকে বলেছেন : যেন ঈদের দিনে উভয় পথের লোকদেরকে সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায় এ কারণে তিনি দুটো পথ ব্যবহার করতেন। আবার অনেকে বলেছেন ইসলাম ধর্মের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করার জন্য তিনি সকল পথে আসা-যাওয়া করতেন যেন সকল পথের অধিবাসীরা মুসলমানদের শান-শওকত প্রত্যক্ষ করতে পারে। আবার কেউ বলেছেন গাছ-পালা তরুলতা সহ মাটি যেন অধিক হারে মুসলমানদের পক্ষে সাক্ষী হতে পারে সে জন্য তিনি একাধিক পথ ব্যবহার করতেন। আসল কথা হল, হিকমত ও উদ্দেশ্য যাই হোক, আর তা বুঝে আসুক বা না আসুক, আমাদের কর্তব্য হল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সুন্নত অনুসরণ করা।[১৪৬]
(৪) ঈদের তাকবীর আদায়
হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। যখন সালাত শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবীর পাঠ করতেন না। আর কোন কোন বর্ণনায় ঈদুল আজহার ব্যাপারে একই কথা পাওয়া যায়। আরো প্রমাণিত আছে যে ইবনে উমার রা. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদগাহে এসে ইমামের আগমন পর্যন্ত এভাবে তাকবীর পাঠ করতেন। আগে আলোচিত হয়েছে যে, সুন্নত হল মসজিদ, বাজার, রাস্তা-ঘাট সহ সর্বত্র উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল মানুষ এ সুন্নতের প্রতি খুবই উদাসীন। আমাদের সকলের কর্তব্য হবে এ সুন্নতটি সমাজে চালু করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। শেষ রমজানের সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদুল ফিতরের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করবে। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যখন বের হবে ও ঈদগাহে সালাতের অপেক্ষায় যখন থাকবে তখন গুরুত্ব সহকারে তাকবীর পাঠ করবে।
ঈদের সালাত :
(১) ঈদের সালাতের হুকুম :
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
'তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও কুরবানী কর।'[১৪৭]
অধিকাংশ মুফাসসিরে কেরামের মতে এ আয়াতে সালাত বলতে ঈদের সালাতকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা এ সালাত আদায় করেছেন। কোন ঈদেই ঈদের সালাত পরিত্যাগ করেননি। ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেছেন : 'ঈদের সালাত প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। তবে ফরজ নয়।'
ইবনে তাইমিয়া রহ. ও এ মত পোষণ করেন। আর ঈদের সালাত যে ওয়াজিব এর আরেকটা প্রমাণ হল, যদি কোন সময় জুমআর দিনে (শুক্রবার) ঈদ হয় তখন সে দিন যারা ঈদের সালাত আদায় করেছে তারা জুমআর সালাতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে। অর্থাৎ জুমআর সালাতে অংশ না নিলে কোন গুনাহ নেই। তবে এলাকার ইমামের কর্তব্য হল, সে ঈদের দিনে জুমআর সালাতের ব্যবস্থা করবে, যাদের আগ্রহ আছে তারা যাতে শরিক হতে পারে। মনে রাখতে হবে ঈদের দিন জুমআর সালাত পরিত্যাগ করার অনুমতি আছে। আর এ অনুমতির ভিত্তিতে কেউ জুমআর সালাত ত্যাগ করলে তার অবশ্যই জোহরের সালাত আদায় করতে হবে। তবে উত্তম আমল হবে জুমআর দিনে ঈদ হলে জুমআ ও ঈদের সালাত উভয়টাই আদায় করা। কোন অবস্থাই কেউ যেন ঈদের সালাত আদায়ে অলসতা না করে। শিশু-সন্তানদের ঈদের সালাতে নিয়ে যাবে ও ব্যবস্থা থাকলে মেয়েদের যেতে উৎসাহিত করবে। মনে রাখতে হবে ঈদের সালাত ইসলামের একটি শিআ'র তথা মহান নিদর্শন। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ. বলেছেন : 'প্রত্যেক জাতির এমন কিছু উৎসব থাকে যাতে সকলে একত্র হয়ে নিজেদের শান-শওকত, সংখ্যাধিক্য প্রদর্শন করে। ঈদ মুসলিম জাতির এমনি একটি উৎসব। এ কারণেই তো শিশু, নারী, এমন মহিলা যারা সাধারণত ঘরের বাইরে বের হয় না ও ঋতুবতী মেয়ে লোক -যাদের সালাত আদায় করতে হয় ন্তাএদের সহ সকলকেই এ দিনে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মুস্তাহাব।[১৪৮]
(২) ঈদের জামাতে মহিলাদের অংশগ্রহণের নির্দেশ
পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জামাতে ও জুমআর সালাতে মহিলাদের অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেয়েদেরকে ঈদের সালাতে অংশ গ্রহণ করার হুকুম (নির্দেশ) দিয়েছেন। যেমন হাদীসে এসেছে,
عن أم عطية رضي الله عنها قالت: أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نخرج في الفطر والأضحى، العواتق والحيض وذوات الخدر، فأما الحيض فيعتزلن الصلاة ويشهدن الخير ودعوة المسلمين، قالت : يا رسول الله إحدانا لا يكون لها جلباب، قال: لتلبسها أختها من جلبابها. مسلم:১৪৭৫
'উম্মে আতিয়া রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা মেয়েরা যেন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতে সালাতের জন্য বের হয়ে যাই ; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবতী ও গৃহবাসিনী সকলেই বের হবে। কিন্তু ঋতুবতী মেয়েরা (ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে) সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের দোয়ায় অংশ নেবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো কারো ওড়না নেই। (যা পরিধান করে সে ঈদের সালাতে যেতে পারে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : তার বোন তাকে নিজের ওড়নাগুলো থেকে একটি ওড়না পরিধান করাবে।'[১৪৯]
দুঃখের বিষয় হল আজকে দেখা যায় অনেকে মেয়েদের ঈদের সালাতে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত করেন। অনেকে বাধা দেন। আবার কোথাও মহিলাদের জন্য ঈদের সালাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব হলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বা এটাকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়। বলা হয়, বর্তমান যুগ ফিতনার যুগ, কোন নিরাপত্তা নেই ইত্যাদি বলে কত অজুহাত সৃষ্টি করা হয়্তযাতে মেয়েরা ঈদের সালাতে অংশ না নেয়। আসলে কোন অজুহাতই এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নির্দেশ ও তাঁর সুন্নাহর বিপরীতে যত অজুহাত ও যুক্তি দেয়া হোক না কেন সবই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যেমন আমরা এ হাদিসটিতে দেখি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন অজুহাত গ্রহণ করেননি। কেউ বলেছিল অনেকের ওড়না নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, 'তার বোন তাকে ওড়না ধার দেবে।' এমনকি যারা ঋতুবতী ছিল তাদেরকেও নির্দেশ দেয়া হল যে, তোমরা ঈদগাহে যাবে। তাদের সালাত আদায় বৈধ না হওয়া সত্ত্বেও ঈদের জামাত ও সালাত প্রত্যক্ষ করবে। তাই আমাদের কর্তব্য হবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মৃতপ্রায় এ সুন্নতকে বাস্তবায়ন করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে যুগের ফিতনা ও মেয়েদের ফিতনা সম্পর্কে আমাদের চেয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক বেশি সচেতন ছিলেন।
(৩) ঈদের সালাত আদায়ের সময় :
সূর্যোদয়ের পর যখন তা এক লেজা (অর্ধ হাত) পরিমাণ উপরে উঠে তখন থেকে শুরু করে সূর্য ঠিক মাথার উপরে আসা পর্যন্ত সময়টা হল সালাতুল ঈদ আদায়ের ওয়াক্ত। এ সময়ের মাঝে যে কোন সময় ঈদের সালাত আদায় করা যায়। ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের সালাত দেরি করে আদায় করতেন আর ঈদুল আজহার সালাত প্রথম ওয়াক্তে তাড়াতাড়ি আদায় করতেন।[১৫০]
ঈদুল ফিতরের সালাত একটু দেরিতে আদায় করতেন, যাতে মুসলমানগণ সদকাতুল ফিতর আদায় করার প্রয়োজনীয় সময় পায়। আর ঈদুল আজহার সালাত তাড়াতাড়ি আদায় করতেন, যাতে মুসলমানগণ সালাত শেষ করে দুপুরের পূর্বে কুরবানীর পশু জবেহ সম্পন্ন করতে পারে।
(৪) ঈদের সালাত কোথায় আদায় করবেন ?
হাদীসে এসেছে :
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخرج يوم الفطر والأضحى إلى المصلى . رواه البخاري:৯০৩
আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হতেন...।'[১৫১]
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন: 'রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ হল তিনি সর্বদা ঈদের সালাত ঈদগাহে আদায় করতেন।'[১৫২]
ইবনে কুদামাহ রহ. বলেন: 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো উত্তম কাজ পরিত্যাগ করেননি। কখনো পরিপূর্ণতা বাদ দিয়ে অপূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি অনুসরণ করেননি। তার চেয়ে বড় কথা হল আমাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব দিকে লক্ষ্য করে আমাদের অবশ্যই ঈদের সালাত ঈদগাহে (উন্মুক্ত প্রান্তরে) আদায় করা উচিত।'
আর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ঈদের সালাত মসজিদে আদায় করেছেন এমন কোন বর্ণনা নেই। অবশ্য আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ বর্ণিত একটি হাদীসে জানা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার কোন এক অসুবিধা থাকায় মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করেছেন। তবে এ হাদিসটিকে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী দুর্বল বলে প্রমাণ করেছেন। তাই আমাদের অলসতা পরিত্যাগ করে কিছুটা কষ্ট করে হলেও ঈদের সালাত ঈদগাহে আদায় করার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। এ দিনে মুসলিমগণ এক সম্মেলনে মিলিত হবেন। মসজিদ এ কাজের জন্য যথাযথ প্রশস্ত স্থান হতে পারে না। মসজিদে সালাত আদায়ের ফযীলত থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা ঈদগাহে ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এমনিভাবে মসজিদের ফযীলত থাকা সত্ত্বেও নফল নামায ঘরে আদায় করা উত্তম।
(৫) ঈদের সালাতের পূর্বে কোন সালাত নেই
হাদীসে এসেছে :
عن ابن عباس رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم خرج يوم الفطر فصلى ركعتين لم يصل قبلها ولا بعدها. البخاري:৯৩৫
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, 'নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল-ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাআত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামায আদায় করেননি।'[১৫৩]
সুন্নত হল ঈদের সালাতের ওয়াক্তে শুধু ঈদের নামায আদায় করবে অন্য কোন নফল নামায আদায় করবে না। তবে যদি কোন অসুবিধার কারণে ঈদের সালাত মসজিদে আদায় করতে হয় তাহলে মসজিদে প্রবেশ করে দু রাকাআত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা যেতে পারে।
(৬) ঈদের সালাতে আযান ও একামত নেই। হাদীসে এসেছে :
عن ابن عباس و جابر رضي الله عنهما قالا : لم يكن يؤذن يوم الفطر ولا يوم الأضحى. رواه البخاري:৯০৭
ইবনে আব্বাস ও জাবের রা. থেকে বর্ণিত তারা বলেন: 'ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সালাতে আযান দেয়া হতো না।'[১৫৪]
وعن جابر بن سمرة رضي الله عنه قال : صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم العيدين غير مرة ولا مرتين بغير أذان ولا إقامة. مسلم:১৪৬৭
জাবের ইবনে সামুরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: 'আমি একাধিকবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাথে দু ঈদের সালাত আদায় করেছি কোন আযান ও ইকামাত ব্যতীত।'[১৫৫]
(৭) ঈদের সালাত আদায়ের পদ্ধতি
ঈদের সালাত হল দু রাকাআত। হাদীসে এসেছে,
قال عمر رضي الله عنه : صلاة الجمعة ركعتان وصلاة الفطر ركعتان وصلاة الأضحى ركعتان وصلاة السفر ركعتان. النسائي:১৪০৩ وصححه الألباني
উমার রা.বলেন: 'জুমআর সালাত দু রাকাআত, ঈদুল ফিতরের সালাত দু রাকাআত, ঈদুল আজহার সালাত দু রাকাআত ও সফর অবস্থায় সালাত হল দু রাকাআত।'[১৫৬]
ঈদের সালাত শুরু হবে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে।
ঈদের সালাতে অতিরিক্ত প্রত্যেক তাকবীরের পর হাত উঠাতে হবে। তাকবীর সমূহ আদায় করার পর সুরা ফাতেহা পড়বে, তারপর প্রথম রাকাতে সূরা আ'লা' পড়বে আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা গাশিয়াহ পড়বে। অথবা প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা কাফ পড়বে আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কামার পড়বে।
এভাবে পড়া মুস্তাহাব। কেউ এভাবে না পড়ে অন্য সূরা দিয়ে পড়লে কোন ক্ষতি নেই। সালাত শেষ হওয়ার পর ইমাম সাহেব খুতবা দেবেন। মনে রাখা দরকার, ঈদের খুতবা হবে সালাত আদায়ের পর। সালাত আদায়ের পূর্বে কোন খুতবা নেই। হাদীসে এসেছে,
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخرج يوم الفطر والأضحى إلى المصلى، فأول شيء يبدأ به الصلاة، ثم ينصرف فيقوم مقابل الناس والناس جلوس على صفوفهم، فيعظهم ويوصيهم ويأمرهم. البخاري:৯০৩
আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল-আজহার দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন। ঈদগাহে প্রথম সালাত শুরু করতেন। সালাত শেষে মানুষের দিকে ফিরে খুতবা দিতেন, এ খুতবাতে তিনি তাদের ওয়াজ করতেন, উপদেশ দিতেন, বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। আর এ অবস্থায় মানুষেরা তাদের কাতারে বসে থাকতো।'[১৫৭]
এ হাদীস দ্বারা যে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হল তার মাঝে: ঈদের সালাতের পূর্বে কোন ওয়াজ-নসিহত বা খুতবা হবে না। ইমাম সাহেব ঈদগাহে এসে সালাত শুরু করে দেবেন।
(৮) ঈদের খুতবা শ্রবণ
সালাতের পর ইমাম দুটো খুতবা দেবেন। সে খুতবায় তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা, গুণ-গান ও অধিক পরিমাণে তাকবীর পাঠ করবেন। তবে ঈদের সালাত আদায়কারীকে ঈদের খুতবা শুনতেই হবে এমন কথা নেই। যেমন হাদীসে এসেছে,
عن عبد الله بن السائب رضي الله عنه قال: شهدت العيد مع النبي صلى الله عليه وسلم فلما قضى الصلاة قال: إنا نخطب فمن أحب أن يجلس فليجلس ومن أحب أن يذهب فليذهب أبو داود:৯৭৫ وصححه الألباني
আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সালাত শেষ করলেন, বললেন: 'আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভাল লাগে সে যেন বসে, আর যে চলে যেতে চায়, সে যেতে পারে।'[১৫৮]
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে খুতবা শুনলে অনেক সওয়াব অর্জন করা যাবে। তাতে যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিকির আছে, দ্বীনি শিক্ষা বিষয়ক কথা-বার্তা রয়েছে তেমনি রয়েছে ফেরেশতাদের আগমন ও আল্লাহ তা'আলার সাকীনা ও রহমত। তাই এটা অবহেলা করে হারানো উচিত নয়।
(৯) ঈদের সালাতের কাজা আদায় প্রসঙ্গে
কারো যদি ঈদের সালাত ছুটে যায় তাহলে সে কি করবে। কাজা করা দরকার কিনা? এ বিষয়ে উলামাদের একাধিক মত রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ মত হল কাজা আদায় করবে। এরপর কথা থেকে যায় সে কাজা আদায় করতে যেয়ে কত রাকাআত আদায় করবে। চার রাকাআত না দু রাকাআত? এ বিষয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন : 'যদি কেউ ঈদের সালাত ধরতে না পারে তবে দু রাকাআত কাজা আদায় করবে।' আতা রহ. বলেছেন: 'যদি ঈদের সালাত ছুটে যায় তবে কাজা হিসেবে দু রাকাআত আদায় করবে।' হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেছেন: 'যদি ঈদের সালাত ছুটে যায় তবে ইমামের সাথে দু রাকাআত আদায় করবে।' অর্থাৎ কাজা করবে জামাতের সাথে। মূলত দু রাকাআত কাজা আদায় করা যুক্তি সংগত। ইমাম মুযনী সহ একদল ফিকাহবিদ বলেছেন, 'ঈদের সালাত ছুটে গেলে তা কাজা করার প্রয়োজন নেই।' আর ইমাম সওরী ও ইমাম আহমদ বিন হান্বল রহ. বলেছেন, 'যদি কেউ একা একা ঈদের সালাতের কাজা আদায় করে তবে সে দু রাকাআত আদায় করবে। আর যদি জামাতের সাথে আদায় করে তবেও দু রাকাআত।'
ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেছেন : 'যদি কেউ ঈদের সালাত কোন কারণে আদায় করতে না পারে তবে সে ইচ্ছা করলে কাজা আদায় করতে পারে, আর না করলে কোন অসুবিধা নেই। যদি আদায় করে তবে চার রাকাআতও আদায় করতে পারে আবার দু রাকাআতও।'[১৫৯]
(১০) ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা
একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানো, অভিবাদন করা মানুষের সুন্দর চরিত্রের একটি দিক। এতে খারাপ কিছু নেই। বরং এর মাধ্যমে অপরের জন্য কল্যাণ কামনা ও দোয়া করা যায়। পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরীয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন :
(ক) হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেছেন: 'জোবায়ের ইবনে নফীর থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত যে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন:
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ. المعجم الكبير للطبراني:১৭৫৮৯
'আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন।'[১৬০]
(খ) ঈদ মুবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
(গ) প্রতি বছরই আপনারা ভাল থাকুন: وَكُلُّ عَامٍ وَأَنْتُمْ بِخَيْرٍ বলা যায়। এ ধরনের সকল মার্জিত বাক্যের দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লেখিত বাক্য (تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ) দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবায়ে কেরাম রা. এ বাক্য ব্যবহার করতেন ও এতে পরস্পরের জন্য কল্যাণ কামনা ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া রয়েছে। আর যদি কেউ সব বাক্যগুলো দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে চায় তাতে অসুবিধা নেই। যেমন ঈদের দিন দেখা হলে বলব্তে
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ، وَكُلُّ عَامٍ وَأَنْتُمْ بِخَيْرٍ، عِيْدُكَ مُبَارَكٌ
'আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার ও আপনার সৎ-কর্ম সমূহ কবুল করুন। সারা বছরই আপনারা সুখে থাকুন। আপনাকে বরকতময় ঈদের শুভেচ্ছা।'
(১১) আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ খবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া:
সদাচরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে সবচেয়ে বেশি হকদার হল মাতা ও পিতা। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সকল প্রকার মনোমালিন্য দূর করার জন্য ঈদ হল একটা বিরাট সুযোগ। কেননা হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে খারাপ সম্পর্ক এমন একটা বিষয় যা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। হাদীসে এসেছে,
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : تفتح أبواب الجنة يوم الاثنين والخميس، فيغفر لكل عبد لا يشرك بالله شيئا إلا رجلا كانت بينه وبين أخيه شحناء، فيقال: أنظروا هذين حتى يصطلحا ! أنظروا هذين حتى يصطلحا ! أنظروا هذين حتى يصطلحا !. رواه مسلم: ৪৬৫২
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: 'সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। যে আল্লাহর সাথে শিরক করে তাকে ব্যতীত সে দিন সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় কিন্তু ঐ দু ভাইকে ক্ষমা করা হয় না যাদের মাঝে হিংসা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তখন (ফেরেশতাদেরকে) বলা হয় এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়!! ' (তাহলে তাদেরও যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়)।[১৬১]
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় যে নিজেদের মাঝে হিংসা, বিবাদ, দ্বন্দ্ব রাখা এত বড় অপরাধ যার কারণে আল্লাহর সাধারণ রহমত তো বটেই বিশেষ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। হাদীসে আরো এসেছে,
عن أبي أيوب الأنصاري رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : لا يحل لمسلم أن يهجر أخاه فوق ثلاث ليال، يلتقيان فيعرض هذا ويعرض هذا، وخيرهما الذي يبدأ بالسلام . مسلم:৪৬৪৩
আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় বয়কট করবে বা সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।'[১৬২]
এ সকল হাদীসে ভাই বলতে শুধু আপন ভাইকে বুঝানো হয়নি বরং সকল মুসলমানকেই বুঝানো হয়েছে। হোক সে ভাই অথবা প্রতিবেশী কিংবা চাচা বা বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, সহপাঠী বা অন্য কোন আত্মীয়। তাই যার সাথে ইতিপূর্বে ভাল সম্পর্ক ছিল এমন কোন মুসলমানের সাথে সম্পর্ক খারাপ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায়। যদি কেউ এমন অন্যায়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে তার এ অন্যায় থেকে ফিরে আসার এক মহা সুযোগ হল ঈদ।
ঈদে যা বর্জন করা উচিত :
ঈদ হল মুসলমানদের শান-শওকত প্রদর্শন, তাদের আত্মার পরিশুদ্ধতা, তাদের ঐক্য সংহতি ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। কিন্তু দুঃখজনক হল বহু মুসলিম এ দিনটাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে জানে না। তারা এ দিনে বিভিন্ন অইৈসলামীক কাজ-কর্মে মশগুল হয়ে পড়ে। এ ধরনের কিছু কাজ-কর্মের আলোচনা করা হল :
(১) কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখে এমন ধরনের কাজ বা আচরণ করা
মুসলিম সমাজে এ ব্যাধি ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে তারা যেমন সাংস্কৃতিক দৈন্যতার পরিচয় দিচ্ছে অপর দিকে নিজেদের তাহজীব-তামাদ্দুনের প্রতি অনীহা দেখাচ্ছে। এ ধরনের আচরণ ইসলামে শরীয়তে নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে,
عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من تشبه بقوم فهو منهم رواه أبو داود:৩৫১২ وصححه الألباني
সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সা-দৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।'[১৬৩]
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, 'এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ হল, যে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে কাফের হয়ে যাবে। যদি এ বাহ্যিক অর্থ (কুফরীর হুকুম) আমরা না-ও ধরি তবুও কমপক্ষে এ কাজটি যে হারাম তাতে সন্দেহ নেই।'
(২) পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ ধারণ করা ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ: পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলার পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদীসে এসেছে,
عن ابن عباس رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم : أنه لعن المتشبهات من النساء بالرجال والمتشبهين من الرجال بالنساء. أبو داود:৩৫৭৪
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সকল মহিলাকে অভিসম্পাত করেছেন যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং ঐ সকল পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন যারা মহিলার বেশ ধারণ করে।[১৬৪]
(৩) ঈদের দিনে কবর যিয়ারত
কবর যিয়ারত করা শরীয়ত সমর্থিত একটা নেক আমল। যেমন হাদীসে এসেছে,
عن أنس رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : كنت نهيتكم عن زيارة القبور، ألا فزورها فإنها ترق القلب وتدمع العين وتذكر الآخرة، ولا تقولوا هجراً. صحيح الجامع: ৪৫৮৪
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, হ্যাঁ এখন তোমরা কবর যিয়ারত করবে। কারণ কবর যিয়ারত হৃদয়কে কোমল করে, নয়নকে অশ্রুসিক্ত করে ও পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে তোমরা শোক ও বেদনা প্রকাশ করতে যেয়ে সেখানে কিছু বলবে না।'[১৬৫]
কিন্তু ঈদের দিনে কবর যিয়ারতকে অভ্যাসে পরিণত করা বা একটা প্রথা বানিয়ে নেয়া শরীয়ত সম্মত নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
لا تجعلوا قبري عيداً . . . أبو داود:১৭৪৬
'তোমরা আমার কবরে ঈদ উদযাপন করবে না বা ঈদের স্থান বানাবে না...।'[১৬৬]
যদি ঈদের দিনে কবর যিয়ারত করা হয়, তাহলে তা কবরে ঈদ উদযাপন বলে গণ্য হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে 'ঈদ' মানে যা বার বার আসে। প্রতি বছরে অথবা প্রতি মাসে বা প্রতি সপ্তাহে। যদি বছরের কোন একটি দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া হয় আর তা প্রতি বছরে করা হয় তা হলে এটার নামই হল কবরে ঈদ উদযাপন। আর সেটা যদি সত্যিকার ঈদের দিনে হয় তবে তা আরো মারাত্মক বলে ধরে নেয়া যায়। যখন আল্লাহর রাসূলের কবরে ঈদ পালন নিষিদ্ধ, তখন অন্যের কবরে ঈদ উদযাপন করার হুকুম কতখানি নিষিদ্ধের পর্যায়ে পড়ে তা একটু অনুমান করা যেতে পারে।
(৪) বেগানা মহিলা পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ:
(ক) মহিলাদের খোলা-মেলা অবস্থায় রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া। মনে রাখা প্রয়োজন যে খোলামেলা ও অশালীন পোষাকে রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
'আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন মূর্খতার যুগের মত নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।'[১৬৭]
হাদীসে এসেছে,
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : صنفان من أهل النار لم أرهما : قوم معهم سياط كأذناب البقر يضربون بها الناس، ونساء كاسيات عاريات، مميلات مائلات، رؤسهن كأسنمة البخت المائلة لا يدخلن الجنة ولا يجدن ريحها، وإن ريحها ليوجد من مسيرة كذا وكذا . مسلم :৩৯৭১
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'জাহান্নামবাসী দু' ধরনের লোক আছে যাদের আমি এখনও দেখতে পাইনি। (আমার যুগের পরে দেখা যাবে) একদল লোক যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে প্রহার করবে। আর এক দল এমন মেয়ে-লোক যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ মানুষের মত হবে। অন্যদের আকৃষ্ট করবে ও তারা অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না। যদিও তার সুগন্ধি বহু দূর থেকে পাওয়া যাবে।' [১৬৮]
(খ) মহিলাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ
অনেককে দেখা যায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই গুনাহের কাজটা ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নিকট আত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শরীয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়। হাদীসে এসেছে,
عن عقبة بن عامر رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله قال : إياكم والدخول على النساء، فقال رجل من الأنصار: يا رسول الله أفرأيت الحمو؟ قال : الحمو : الموت. مسلم:৪০৩৭
সাহাবী উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'তোমরা মেয়েদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে।' আনসারী সাহাবীদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল ! দেবর-ভাসুর প্রমুখ আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি উত্তরে বললেন : 'এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন তো মৃত্যু।'[১৬৯]
এ হাদীসে আরবী 'হামউ' শব্দ নেয়া হয়েছে। এর অর্থ এমন সকল আত্মীয় যারা স্বামীর সম্পর্কের দিক দিয়ে নিকটতম। যেমন স্বামীর ভাই, তার মামা, খালু প্রমুখ। তাদেরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করার কারণ হল, এ সকল আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমেই বে-পর্দাজনিত বিপদ আপদ বেশি ঘটে থাকে। যেমনটি অপরিচিত পুরুষদের বেলায় কম ঘটে।
(৫) গান-বাদ্য
ঈদের দিনে এ গুনাহের কাজটাও বেশি হতে দেখা যায়। গান ও বাদ্যযন্ত্র যে শরীয়তে নিষিদ্ধ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আবার যদি হয় অশ্লীল গান তাহলে তো তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন ভিন্নমত নেই। হাদীসে এসেছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ليكون أقواما من أمتي يستحلون الحر والحرير والخمر والمعازف. البخاري:ص২৯৮ باب:১৭
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে।'[১৭০]
এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় গান-বাদ্য নিষিদ্ধ। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে 'তারা হালাল মনে করবে'। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় মূলত এটা হারাম। ইসলামী শরীয়ত কিছু কিছু পর্বে বিনোদনের অনুমতি দিয়েছে। তাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম নিম্নোক্ত কয়েকটি সময়ে দফ (একদিকে খোলা ঢোল জাতীয় বাদ্য) বাজানোকে জায়েয বলেছেন :
(ক) বিবাহের অনুষ্ঠানে : হাদীসে এসেছে,
عن الربيع بنت معوذ بن عفراء قالت : جاء النبي صلى الله عليه وسلم حين بني علي فجلس على فراشي كمجلسك مني، فجعلت جويريات لنا يضربن بالدف، ويندبن من قتل من آبائي يوم بدر، إذ قالت إحداهن : وفينا نبي يعلم ما في غد. فقال : دعي هذه وقولي بالذي كنت تقولين. البخاري:৪৭৫০
রবী বিনতে মুয়াওয়াজ রা. বর্ণনা করেন : 'যখন আমার বিবাহের অনুষ্ঠান হচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছে এসে আমার বিছানায় এমনভাবে বসলেন যেমন তুমি বসেছ। তখন কয়েকজন বালিকা দফ বাজাচ্ছিল ও আমাদের পূর্ব-পুরুষদের মাঝে যারা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল তাদের প্রশংসামূলক সংগীত পরিবেশন করছিল। এ সংগীতের মাঝে এক বালিকা বলে উঠল, 'আমাদের মাঝে এমন এক নবী আছেন যিনি জানেন আগামী কাল কি হবে।' তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: 'এ কথা বাদ দাও এবং যা বলছিলে তা বল।'[১৭১]
(খ) ঈদের সময়ে : যেমন হাদীসে এসেছে,
عن عائشة رضي الله عنها قالت : دخل أبو بكر وعندي جاريتان من جواري الأنصار تغنيان بما تقاولت الأنصار يوم بعاث، قالت وليستا بمغنيتين، فقال أبو بكر : أمزامير الشيطان في بيت رسول الله ؟ وذلك يوم عيد، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يا أبا بكر إن لكل قوم عيداً وهذا عيدنا . البخاري:৮৯৯
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন আবু বকর রা. আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন দু জন আনসারী বালিকা বুয়াছ যুদ্ধে তাদের বীরত্ব সম্পর্কিত গান গাচ্ছিল, কিন্তু তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। আবু বকর রা. বললেন : 'আশ্চর্য, আল্লাহর রাসূলের ঘরে শয়তানের বাদ্য !' এদিনটা ছিল ঈদের দিন। আবু বকর রা. এর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : 'হে আবু বকর ! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এদিন হল আমাদের ঈদ।'[১৭২]
অন্যান্য নফল সিয়াম
রমজান মাসের সিয়াম ফরজ। এ ছাড়া আরো কিছু সিয়াম বা রোজা আছে যা পালন করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান ব্যতীত অন্য কোন মাসে এক মাস ব্যাপী সিয়াম পালন করতেন না। হাদীসে এসেছ্তে
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصوم حتى نقول إنه لا يفطر، ويفطر حتى نقول أنه لا يصوم، ما رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم استكمل صيام شهر إلا رمضان، وما رأيته أكثر صياما منه في شعبان. البخاري:১৮৩৩
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে নফল সিয়াম পালন করতেন আমরা ধরে নিতাম তিনি সিয়ামে বিরতি দেবেন না। আবার এমন ভাবে সিয়াম পরিত্যাগ করতেন আমরা মনে করতাম তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। রমজান ব্যতীত অন্য কোন মাসে তাকে পূর্ণ মাস সিয়াম পালন করতে দেখিনি। আর শাবান মাস ব্যতীত অন্য মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করতে দেখিনি।[১৭৩]
এ হাদীস দ্বারা বুঝে আসে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করতেন। তিনি কি কি ধরনের নফল সিয়াম পালন করতেন তা নিম্নে আলোচনা করা হল :
১- শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা :
عن أبي أيوب الأنصاري رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من صام رمضان ثم أتبعه ستا من شوال كان كصيام الدهر. مسلم:১৯৮৪
আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: 'যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম পালন করল অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি সিয়াম আদায় করল সে যেন সাড়া বছর সিয়াম পালন করল।'[১৭৪]
উলামায়ে কেরাম সাড়া বছর সিয়াম পালনের সওয়াবের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব দশগুণ দেয়া হয় সে হিসেবে রমজানের এক মাস সিয়াম পালনে দশ মাস সিয়াম পালনের সওয়াব। শাওয়ালের ছয়টি সিয়ামে দু মাস সিয়াম পালনের সওয়াব। এভাবে পুরো বছর সিয়াম পালনের সওয়াব পাওয়া যেতে পারে শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম পালন করলে। যদি কারো দায়িত্বে রমজানের কাজা সিয়াম থাকে তবে সে প্রথমে কাজা আদায় করবে তারপরে শাওয়ালের সিয়াম পালন করবে। শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম একাধারে আদায় করা যায়, আবার বিরতি দিয়েও আদায় করা যায়। তবে শাওয়াল মাস চলে যাওয়ার পর ছয় রোজার কাজা হিসেবে সিয়াম পালনের বিধান নেই।
২- আরাফা দিবসের সওম : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে আরাফা দিবসের (জিলহজ মাসের নবম তারিখে) সওম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন :
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله والسنة التي بعده. مسلم:১৮৯৫
'আরাফা দিবসের সওম সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তাকে বিগত ও আগত বছরে পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।'[১৭৫]
তবে যারা পবিত্র হজ পালনরত আছেন তারা এ দিনে রোজা রাখবেন না।
৩- মুহাররম মাসের সওম :
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم، وأفضل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل . مسلم:১৯৮২
'রমজান মাসের পর সর্বোত্তম সওম হল আল্লাহর মাস মুহাররমের সওম। আর ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত।'[১৭৬]
৪- শাবান মাসে সিয়াম : হাদীসে এসেছে,
عن عائشة رضي الله عنها قالت : . . ما رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم استكمل صيام شهر إلا رمضان، وما رأيته أكثر صياما منه في شعبان. البخاري:১৮৩৩
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনে : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে শাবান মাস ব্যতীত অন্য মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করতে দেখিনি।[১৭৭]
তিনি শাবান মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম আদায় করতেন। এর কারণ সম্পর্কে উসামা বিন যায়েদ রা. বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে তিনি বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল ! নফল সিয়ামের ব্যাপারে আমি তো শাবান মাস ব্যতীত অন্য কোন মাসে আপনাকে এত বেশি সিয়াম পালন করতে দেখি না। তিনি বললেন: শাবান, রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী এমন একটি মাস যাতে মানুষ সিয়াম সম্পর্কে উদাসীন থাকে।
৫-প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করা : হাদীসে এসেছে,
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : أوصاني خليلي صلى الله عليه وسلم بثلاث : صيام ثلاثة أيام من كل شهر، وركعتي الضحى، وأن أوتر قبل أن أنام. البخاري:১৮৪৫
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেন, আমার বন্ধু আমাকে তিনটি বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন : প্রত্যেক মাসে তিনটি সিয়াম পালন করা, দ্বি-প্রহরের পূর্বে দু রাকাআত সালাত আদায় করা ও নিদ্রার পূর্বে বিতির সালাত আদায় করা।[১৭৮]
এ তিনটি সিয়াম আদায় করলে পূর্ণ বছর নফল সিয়াম আদায়ের সওয়াব লাভের কথা এসেছে। একটি নেক আমলের সওয়াব কমপক্ষে দশগুণ দেয়া হয়। তিন দিনের সিয়ামের সওয়াব দশগুণ করলে ত্রিশ দিন হয়। যেমন আবু কাতাদা রা. বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে,
صوم ثلاثة أيام من كل شهر ورمضان إلى رمضان فهذا صيام الدهركله. مسلم:১৯৭৬
'প্রত্যেক মাসে তিনটি সিয়াম ও এক রমজান থেকে আরেক রমজান সিয়াম পালন করলে পূর্ণ বছর সিয়াম আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব ধরা হয়।'[১৭৯]
মাসের যে তিন দিন সিয়াম পালন করা হবে সে তিন দিনকে হাদীসের পরিভাষায় বলা হয় 'আইয়ামুল বীয'। এ তিন দিন হল হিজরি মাসের তেরো, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখ। বীজ শব্দের অর্থ আলোকিত। এ তিন দিনের রাতগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাঁদের আলোতে আলোকিত থাকে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সিয়াম গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। যেমন হাদীসে এসেছে,
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يفطر أيام البيض في حضر ولا سفر. النسائي:২৩০৫
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফর ও দেশে থাকা অবস্থায় আইয়ামে বীযের সিয়াম ত্যাগ করতেন না।'[১৮০]
৬- সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম :
সপ্তাহে দু দিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করা সুন্নত। হাদীসে এসেছে,
عن أبي قتادة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم سئل عن صوم يوم الاثنين، فقال ذلك يوم ولدت فيه ويوم بعثت فيه أو أنزل علي فيه . مسلم:১৯৭৭
সাহাবী আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে সোমবারে সিয়াম পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, 'এ দিনে আমার জন্ম হয়েছে এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়াত দেয়া হয়েছে বা আমার উপর কুরআন নাযিল শুরু হয়েছে।'[১৮১]
হাদীসে এসেছে :
হাদীসে এসেছে :
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: تعرض الأعمال يوم الاثنين والخميس، فأحب أن يعرض عملي وأنا صائم .رواه الترمذي رواه مسلم بغير ذكر الصوم
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। কাজেই আমি পছন্দ করি, যখন আমার আমল পেশ করা হবে তখন আমি সিয়াম অবস্থায় থাকব।'[১৮২]
৭- একদিন পর একদিন সওম পালন :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أحب الصيام إلى الله صيام داود، وكان يصوم يوما ويفطر يوما. مسلم:১৯৬৯
'আল্লাহর কাছে (নফল সিয়ামের) সবচেয়ে প্রিয় সিয়াম হল দাউদ আ.-এর সিয়াম। তিনি একদিন সিয়াম পালন করতেন আর একদিন সিয়াম ত্যাগ করতেন।'[১৮৩]
৮- আশুরার সিয়াম পালন : হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ. الترمذي: ৬৮৩
আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'আমি আল্লাহর নিকট আশা রাখি, আশুরা দিবসের রোজা আল্লাহ তাআলার কাছে বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।'[১৮৪]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عن أبي قتادة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : . . . . . صيام يوم عاشوراء احتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله. مسلم:১৯৭৬
'আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ...আমি আশা রাখি আশুরার দিনের সওমকে আল্লাহ তাআলা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।'[১৮৫]
হাদীসে আরো এসেছে,
হাদীসে আরো এসেছে,
عن ابن عباس رضي الله عنهما أنه قال: حين صام رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم عاشوراء وأمر بصيامه، قالوا إنه يوم تعظمه اليهود والنصارى. فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم ( فإذا كان العام المقبل إن شاء الله صمنا اليوم التاسع) قال : فلم يأت العام المقبل حتى توفي رسول الله صلى الله عليه وسلم. مسلم:১৯১৬
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার সওম পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন : 'এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা সম্মান করে থাকে।' তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : 'আগামী বছর আসলে ইনশা আল্লাহ আমরা নবম তারিখে সওম পালন করব।' ইবনে আব্বাস রা. বলেন : 'পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করলেন।'[১৮৬]
হাদীসে এসেছে,
হাদীসে এসেছে,
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : صوموا يوم عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، وصوموا قبله يوما أو بعده يوما. أحمد:২০৪৭
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'তোমরা আশুরা দিবসে সওম পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধিতা কর। তাই তোমরা আশুরার একদিন পূর্বে অথবা একদিন পরে সওম পালন করবে।'[১৮৭]
কীভাবে আশুরার সওম পালন করবেন ?
(ক) মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে সওম পালন করা। এ পদ্ধতি অতি উত্তম। কারণ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই আশুরার সওম পালনের সংকল্প করেছিলেন। যেমন ইতিপূর্বে আলোচিত ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীস এর প্রমাণ বহন করে।
(খ) মুহাররম মাসের দশম ও একাদশ দিবসে সওম পালন করা। এ পদ্ধতিও হাদীস দ্বারা সমর্থিত। যদি কেউ নবম তারিখে কোন কারণে সওম পালন করতে না পারেন তিনি এ পদ্ধতিতে সওম পালন করবেন।
(গ) শুধু মুহাররম মাসের দশম তারিখে সওম পালন করা। এ পদ্ধতি মাকরূহ। কারণ এটা ইহুদীদের আমলের সাথে সংগতিপূর্ণ।[১৮৮]
নিষিদ্ধ সিয়াম :
বছরের পাঁচটি দিন সিয়াম পালন নিষিদ্ধ। এগুলো হল-
এক. ঈদুল ফিতরের দিন।
দুই . ঈদুল আজহার দিন (জিলহজ মাসের দশ তারিখ)
তিন. জিলহজ মাসের এগারো তারিখ।
চার. জিলহজ মাসের বার তারিখ।
পাঁচ. জিলহজ মাসের তেরো তারিখ।
রমজান মাসে আল-কুরআন কিভাবে তিলাওয়াত করা উচিত :
যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় এমন একটি গ্রন্থের নাম বলতে পারেন কি যেটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাঠ করা হয়? উত্তরে আপনি বলবেন : হা, পারি। সে গ্রন্থখানা হল পবিত্র আল-কুরআন আল-কারিম। বিগত কালে ও বর্তমানে ইনশা আল্লাহ ভবিষ্যতেও যে গ্রন্থখানা সবচেয়ে বেশি পঠিত, তা হল আল-কুরআন। ভাবতে আশ্চর্য লাগবে সাড়া বিশ্ব থেকে যদি এর সকল কপি নিঃশেষ করে দেয়া হয় -আল্লাহ না করুন - তা হলেও আল-কুরআন সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ হিসেবেই টিকে থাকবে। বরং এমতাবস্থায় আল-কুরআনের পঠন কয়েক হাজার গুন বেড়ে যাবে। কারণ সাড়া বিশ্বে যে লক্ষ লক্ষ হাফেজে কুরআন আছেন তারা তাদের কুরআন চর্চা কয়েকশত গুন বাড়িয়ে দেবেন। এবং মুসলমানদের মাঝে যারা এতদিন কুরআন হিফজ করাকে অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন, তারা তাদের সন্তানদেরকে কলেজ ভার্সিটি থেকে বের করে এনে তাহফীজুল কুরআন বিভাগে ভর্তি করে দেবেন। আর বলবেন, আল্লাহর কালামের এ সংকটময় সময়ে তার রক্ষার ফযীলত থেকে মাহরুম হতে পারি না। আর এভাবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার দ্বীনের দুশমনদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়ে তার কালামকে রক্ষা করবেন। এরপর যদি প্রশ্ন করা হয় এমন একটি গ্রন্থের নাম বলতে পারেন যেটা পাঠ করা হয় অথচ পাঠকরা এর অর্থ বোঝেন সবচেয়ে কম। এর উত্তরে আপনি বলবেন সে গ্রন্থটি হল আল-কুরআন। তারপর যদি প্রশ্ন করা হয় এমন একটি গ্রন্থের নাম বলতে পারেন, যার পাঠকেরা তার বাণী জীবনে বাস্তবায়ন করেন সবচেয়ে কম ? এর উত্তরেও আপনি বলবেন, তা হল পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন। মূলত আমাদের আলোচনার বিষয়, কীভাবে কুরআন অধ্যয়ন করা উচিত। এ বিষয়ে বলতে যেয়ে প্রথমে বলব যারা কুরআন পাঠ করেন তাদের নিয়ে। যারা আল-কুরআন পাঠ করেন তাদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমত : যারা আরবীতে কুরআন তিলাওয়াত করেন সাথে সাথে তরজমা বোঝেন অথবা পাঠ করে বুঝে নেন।
দ্বিতীয়ত : যারা শুধু আল-কুরআনের অনুবাদ পাঠ করেন। আরবীতে পাঠ করতে পারেন না।
তৃতীয়ত : যারা আরবীতে কুরআন তিলাওয়াত করেন কিন্তু তরজমা বোঝেন না বা বুঝে পাঠ করার প্রয়োজন অনুভব করেন না। আমি এ প্রবন্ধে আল-কুরআন অধ্যয়নে এ তিন দলের ভূমিকা নিয়ে নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম প্রকারের যারা আরবী ভাষায় কুরআন তিলাওয়াত করেন ও অর্থ-তরজমা বোঝেন, তারাই সঠিক ভাবে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম রা. তাদের পরবর্তী উম্মতের ইমাম ও আলেমগণ এভাবে অর্থ ও তরজমাসহ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। এবং আল্লাহ নিজেও চান বান্দা তার কালামের অর্থ বুঝে শুনে তিলাওয়াত করুক। তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাই চেয়েছেন ও তার সাহাবাগণও এরকম আমলই করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'আমি তো তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি কিতাব, যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ। তোমরা কি তা বুঝবে না ?'[১৮৯]
'তোমরা কি তা বুঝবে না' প্রশ্নের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা কুরআন বুঝার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন :
'এ হল এক কল্যাণময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি। যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধ শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।'[১৯০]
এখানে আল্লাহ তাআলা কুরআন অনুধাবন ও উপদেশ গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ দুটোর কোনটাই অর্থ বুঝা ব্যতীত শুধু তিলাওয়াত দ্বারা সম্ভব নয়। এ ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে, যাতে আল্লাহতাআলা কুরআন অর্থ বুঝে তিলাওয়াত করা ও গভীর ভাবে অনুধাবন করার জন্য বলেছেন। শুধু এতটুকুই নয় বরং যারা আল-কুরআন তিলাওয়াত করে অথচ অর্থ বুঝে না, আল্লাহ তাদের সমালোচনা করেছেন।
যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'আর তাদের মাঝে এমন কতক নিরক্ষর লোক আছে যাদের মিথ্যা আশা (আমানিয়্যা) ব্যতীত কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই, তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে।'[১৯১]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী বলেন : 'আমানিয়্যার অর্থ হল : তরজমা অনুধাবন ব্যতীত শুধু তিলাওয়াত করা অর্থাৎ তিলাওয়াত করা ছাড়া তাদের কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। অর্থ বুঝে না, গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করে না।'[১৯২]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন : 'আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে দু ধরনের লোকদের তিরস্কার করেছেন। প্রথমত যারা আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত করেছে, দ্বিতীয়ত যারা তিলাওয়াত ছাড়া আল্লাহর কিতাবের আর কোন খবর রাখে না। অর্থ অনুধাবন ব্যতীত তিলাওয়াতকেই বলে আমানিয়া।' (বাদায়ে আত-তাফসীর)
তাই বলা যায়, যারা আল-কুরআন শুধু তিলাওয়াত করে, অর্থ অনুধাবনের কোন চেষ্টা করে না আল্লাহ তাদের তিরস্কার করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতকারীদের প্রশংসা করতে যেয়ে বহু আয়াতে বলেছেন, যারা তিলাওয়াত করে তাদের অন্তর বিগলিত হয়, ঈমান বৃদ্ধি পায়, অশ্রু প্রবাহিত হয় ইত্যাদি। আর আমরা সকলেই জানি ও বুঝি ; অর্থ অনুধাবন ব্যতীত এগুলোর কোনটিই হয় না। অতএব নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় আল্লাহ যে সকল তিলাওয়াতকারীর প্রশংসা করেছেন, তারা হলেন, যারা অর্থ-তরজমা বুঝে বুঝে তিলাওয়াত করেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কোরআনে এরশাদ করেন :
'রাসূল বলবেন : হে আমার প্রতিপালক ! আমার সম্প্রদায় তো এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে।'[১৯৩]
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাশরের ময়দানে যে সকল উম্মত কুরআন ত্যাগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে এভাবেই নালিশ করবেন। আচ্ছা তার উম্মতের মাঝে কারা কুরআন ত্যাগ করল? আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন : 'যারা কুরআন তিলাওয়াত অগ্রাহ্য করল, তারা কুরআন ত্যাগের অভিযোগে অভিযুক্ত। যারা কুরআনের অর্থ অনুধাবন ও তা গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করল না, তারাও কুরআন ত্যাগের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। যারা কুরআনের বিধি-বিধান মানল না, তারাও কুরআন ত্যাগকারী বলে অভিযুক্ত হবে।'[১৯৪]
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন: 'কুরআন ত্যাগের বিভিন্ন প্রকার আছে তার মাঝে একটি হল কুরআনের তরজমা অনুধাবন পরিহার করা।' (বাদায়ে আত-তাফসীর)
হাসান বসরী রহ. বলেছেন: আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এজন্য যে, তা মানুষ বুঝবে ও আমল করবে। কিন্তু আফসোস! মানুষ আজ শুধু তার তিলাওয়াতকেই আমল হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।[১৯৫]
বিখ্যাত সাহাবী ইবনে মাসঊদ রা. বলেন : 'আমাদের যুগে কুরআন হিফজ করা কঠিন ছিল আর তা আমল করা সহজ ছিল। আমাদের পর এমন যুগ আসবে যখন কুরআন হিফজ করা সহজ হবে কিন্তু তার উপর আমল করা কঠিন হবে।'[১৯৬]
পূর্ববর্তী আকাবিরে দ্বীন, সালাফে সালেহীন ও মুফাসসিরে কেরামগণ এভাবে আল-কুরআন বুঝার জন্য মুসলিম উম্মাহকে হিদায়াত দিয়েছেন। আল-কুরআন বুঝে-বুঝে তিলাওয়াত করার জন্য মানুষদের উৎসাহিত করার দায়িত্ব মূলত আলেম-ওলামা, দায়ী ও আইম্মায়ে মাসাজিদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের অধিকাংশের ভূমিকা নেতিবাচক। তাদের অনেকে মনে করেন সাধারণ মানুষ তরজমাসহ কুরআন তিলাওয়াত করলে গোমরাহ হয়ে যেতে পারে। হা হতে পারে ! তবে এ আশঙ্কায় মানুষকে কুরআন বুঝা থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব আপনার নয়, আপনার দায়িত্ব তাদের উৎসাহিত করা। আলেমদের অনেকে কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত বয়ান করতে যেয়ে এমন সব কথা বলেন যা শুনে মানুষ মনে করে কুরআনের অর্থ বুঝার দরকার নেই। তারা কুরআনের অর্থ-তরজমা বুঝতে নিরুৎসাহিত হন।
যেমন বলা হয়, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: '... কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি হরফে ১০ টি করে সওয়াব পাওয়া যায়। আলিফ লাম মীম একটি হরফ নয়, তিনটি হরফ। এটা পড়লে তিনটি সওয়াব পাওয়া যায়। আলিফ লাম মীম এর অর্থ বুঝা যায় না তা পাঠ করলে যখন সওয়াব পাওয়া যায় তখন আল-কুরআন অর্থ না বুঝে পড়লেও সওয়াব পাওয়া যাবে।' আমি বলব, আপনার এ দলীল পেশ করা বা যুক্তি মোটেই ঠিক নয়। কখনো সঠিক নয়। কয়েকটি কারণে:
এক. এ হাদীসে আল্লাহর রাসূলের এ বাণীর উদ্দেশ্য (নস) হল আলিফ লাম মীম একটি হরফ নয়, তিনটি হরফ এ কথা বুঝানো।
দুই. এ হাদীসের ইশারা ইঙ্গিতে (দালালাহ ও ইশারাহ দ্বারা) বুঝে আসে কেউ যদি আল-কুরআনের হুরূফে মুকাত্তায়াহ বা আয়াতে মুতাশাবিহা তিলাওয়াত করে যার অর্থ সাধারণত বুঝে আসে না তা হলেও সে সওয়াব পাবে।
তিন. এ হাদীসে আলিফ লাম মীম-এর কথা বলা হয়েছে যা আয়াতে মুতাশাবিহার অন্তর্ভুক্ত। এর সাথে আয়াতে মুহকামাহ-র (যার অর্থ স্পষ্ট ভাবে বুঝে আসে) কিয়াস (তুলনা) করা ঠিক নয়। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
চার. এ হাদীস দ্বারা কখনো রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর উদ্দেশ্য মানুষকে কুরআনের অর্থ অনুধাবনে নিরুৎসাহিত করা ছিল না। আমি কিন্তু এ কথা বলছি না যে অর্থ-তরজমা অনুধাবন ছাড়া আল-কুরআন তিলাওয়াতে সওয়াব নেই। সওয়াব হলে হতেও পারে। বরং আমি আমি বলতে চাচ্ছি, অর্থ অনুধাবন ব্যতীত আল-কুরআন পাঠে সওয়াব পাওয়ার যে দলীল ও যুক্তি দেয়া হয় তা মোটেই সঠিক নয়। এবং আল-কুরআন বুঝা, গবেষণা ও গভীর চিন্তা করতে যা মানুষকে অনুৎসাহিত করে এমন ধরনের কথা বলা মোটেই শুদ্ধ নয়। তাই আল-কুরআন নাযিলের এ মাসে অর্থ সহ আল-কুরআন তিলাওয়াতের জন্য আমরা কর্মসূচী গ্রহণ করব, অন্যকে উপদেশ দেব। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা.-এর একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি। যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَقْرَأَ الْقُرْآنَ غَضًّا كَمَا أُنْزِلَ فَلْيَقْرَأْهُ عَلَى قِرَاءَةِ ابْنِ أُمِّ عَبْدٍ. مسند أحمد: ৩৫(ج ১ / ص ৩৮)
'যে ব্যক্তি চায়, কুরআন যেভাবে নাযিল হয়েছে সেভাবেই পাঠ করবে, সে যেন ইবনে উম্মে আব্দ (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ)-এর মত পাঠ করে।'[১৯৭]
কী তার পদ্ধতি? তিনি বলেছেন :
كان الرجل منا إذا تعلم عشر آيات لم يجاوزهن حتى يعرف معانيهن والعمل بـهـن. جامع البيان للطبري: ص:৮০
'আমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যখন দশটি আয়াতের তিলাওয়াত শিখত তখন সামনে আর অগ্রসর হতো না, যতক্ষণ না সে দশটি আয়াতের অর্থ অনুধাবন করত ও সে মোতাবেক আমল করত।'[১৯৮]
অর্থাৎ দশটি আয়াত প্রথম তিলাওয়াত, তারপর অর্থ-তরজমা অনুধাবন, অতঃপর হিসাব নেয়া যে, এর বাস্তবায়ন আমার জীবনে কতটুকু। এ রকমই ছিল সাহাবায়ে কেরামের কুরআন তিলাওয়াত পদ্ধতি।
সম্মানিত পাঠক ! একটু চিন্তা করে দেখুন, যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের নিজ অনুগ্রহে হাজারও নেয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন। নিজ মেহেরবানিতে আমাদের ইসলামের মত মহা-নেয়ামত দান করেছেন, তিনি আমাদের জন্য একটা কিতাব পাঠালেন যেটি আমাদের প্রতি তার একমাত্র পত্র হিসেবে গণ্য করা যায়। সে পত্রটি পাঠ করতে ও বুঝতে আমাদের কত অলসতা! কত উদাসীনতা! আপনার কি ইচ্ছে হয় না আমার প্রভু আমার উদ্দেশ্যে কী বলতে চাচ্ছেন, সাড়া জীবনে একটি বার হলেও জেনে নেই? আমাদের অনেকে বছরে কয়েক বার এমন কি শুধু রমজান মাসে কয়েক বার কুরআন পাঠ করে 'খতম' করি, অথচ একটি বারও তার অর্থ অনুধাবন 'শুরু' করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি কি? এমনকি আরবী ভাষা জানে ও বুঝে এমন অনেক লোককে দেখেছি, তারা যখন কুরআন পাঠ করেন তখন অর্থ বা তরজমার দিকে খেয়াল করার সামান্য প্রয়োজন অনুভব করেন না। তাই সকলকে আহ্বান জানাই আর বেশি বেশি কুরআন 'খতম' করা নয়, বরং তিলাওয়াত ও বুঝার চেষ্টা 'আরম্ভ 'করি। আমরা কি পারি না, প্রত্যেকে এ সিদ্ধান্ত নিতে জীবনে একবার হলেও আমি কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থ বুঝে বুঝে তিলাওয়াত করব। শুরু করেই দেখুন না ! আপনি অভিভূত হয়ে যাবেন। মনে হবে আপনি সত্যিই মহান আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলছেন আর আল্লাহ আপনার সামনে উপস্থিত। আপনি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছেন। মনে হবে তাঁকে প্রশ্ন করছেন, তিনি উত্তর দিচ্ছেন। মনে হবে, আপনি যেন নতুন করে ঈমান গ্রহণ করলেন। আপনার বিশ্বাস হতে চাইবে না যে, এ কুরআন চৌদ্দ শত বছর আগে অবতীর্ণ হয়েছে। মনে হবে মাত্র কিছুক্ষণ আগে নাযিল হয়েছে। আর তখনই প্রতিফলন দেখতে পাবেন আল্লাহর সে কথাগুলোর যা তিনি কুরআন তিলাওয়াত কারীদের প্রশংসায় বলেছেন। আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা করছি আল্লাহ তাআলা যেন আমাদেরকে ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভূত না করেন, যাদের সম্পর্কে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
وَيَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ . صحيح البخاري:৪৬৭০
'তারা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে, কণ্ঠ অতিক্রম করে অন্তর পর্যন্ত পৌঁছোবে না।'[১৯৯]
সমাপ্ত
--------------------------------------------------------------------------------
[১] সূরা ইউনুস : ৫৮
[২] নাসায়ী : ২১০৫
[৩] সূরা বাকারা: ১৮৩
[৪] বুখারী : ৭৪২৩
[৫] সূরা বাকারা : ১৮৫
[৬] মুসলিম : ২৫৪৭
[৭] সূরা আল-কদর : ৩-৫
[৮] দুরুসুন রামজানিয়া
[৯] মাজমুউ মুআল্লাফাতিল আলবানী : ১০০২
[১০] জামেউল উসুল ফি আহাদিসির রাসূল : ১৪১০
[১১] আস সুনান আস সুগরা : ১৪২৯
[১২] সূরা যুমার : ১০
[১৩] মুসলিম : ২৭৬০
[১৪] নাসায়ী : ২৫৩৪
[১৫] মুসলিম : ১৫৫১
[১৬] মুসলিম : ১৪০০
[১৭] মুসলিম : ১৫৫১
[১৮] আহমদ : ৯২১৪
[১৯] মুসলিম : ২৭৬৯
[২০] বাইহাকী : ৩৬০৫
[২১] নাসায়ী : ২২২০
[২২] বুখারী : ১৭৯৭, মুসলিম : ১১৫২
[২৩] বুখারী : ১৭৯০, মুসলিম : ১১৫১
[২৪] বুখারী : ১৭৯০, মুসলিম : ১১৫১
[২৫] আহমদ : ৬৬২৬
[২৬] সূরা হুদ : ১১৪
[২৭] বুখারী : ১৭৯৫, মুসলিম : ৭৪৫০
[২৮] বুখারী : ২০১৪, মুসলিম : ১৮১৭
[২৯] মুসলিম : ৫৭৪
[৩০] সূরা নিসা: ৩১
[৩১] বুখারী : ৬০৫৭
[৩২] আহমদ : ৯০৯১
[৩৩] মুসলিম : ১৭৩
[৩৪] সুনানে নাসায়ী : ১৬১৬
[৩৫] আহমাদ : ৬৬২৬
[৩৬] মুসলিম : ৩২০৮
[৩৭] মুসলিম : ১১৭১
[৩৮] মাজমাউল কাবীর : ৭২২, জামেউল আহাদীস : ১৪৩৭৯
[৩৯] আহমদ : ২২৩০২
[৪০] সূরা আল-বাকারা : ১৮৬
[৪১] বাইহাকী ফি শুআবুল ইমান : ৭২০৫
[৪২] জামেউল উসুল : ১৪১০
[৪৩] মুসলিম : ১১৭৪
[৪৪] মুসলিম : ১১৭৫
[৪৫] বুখারী : ৫৭১
[৪৬] সূরা আল-ইসরা :৮৫
[৪৭] সূরা আল-বাকারা : ১৮৩
[৪৮] মুসলিম : ১৪০০
[৪৯] মুসলিম : ১১৫১
[৫০] সূরা বাকারা :১৮৭
[৫১] সূরা বাকারা : ২০৮
[৫২] দারামী : ২৭২০
[৫৩] মুসলিম : ১১৫১
[৫৪] হাকেম : ১৫২০
[৫৫] বুখারী : ৬০৫৭
[৫৬] সূরা আল-বাইয়েনা: ৫
[৫৭] বুখারী : ২০১৪, মুসলিম : ১৮১৭
[৫৮] মুসলিম : ৪৫৯০
[৫৯] সূরা মায়িদাহ: ২৭
[৬০] বুখারী : ১৯২৩, মুসলিম : ২৬০৩
[৬১] মুসলিম : ২৬০৪
[৬২] আবু দাউদ : ২৩৪৭
[৬৩] আহমদ : ১১৩৮৪
[৬৪] সূরা যারিয়াত: ১৮
[৬৫] বুখারী : ১১৪৫, মুসলিম : ১৮০৮
[৬৬] দারামী : ১৪৬০
[৬৭] সূরা বাকারা : ১৮৭
[৬৮] বুখারী : ১৮৫৩
[৬৯] বুখারী : ১৮৫২, মুসলিম : ১০৯৮
[৭০] আবু দাউদ : ২৩৫৫
[৭১] মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৭৬১৮
[৭২] মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক : ৭৫৯১
[৭৩] সূরা জাসিয়া, আয়াত ১৮
[৭৪] আবু দাঊদ : ১৪৩৩
[৭৫] সূরা আলে ইমরান : ৩১
[৭৬] সূরা হাশর, আয়াত: ৭
[৭৭] আহমদ : ১৩০১২
[৭৮] হাকেম : ৭১৩৯
[৭৯] বাইহাকী : ৩৬০৫
[৮০] আবু দাউদ : ২৩৫৭
[৮১] সূরা আল-বাকারা : ১৮৬
[৮২] আহমদ : ৬৬২৬
[৮৩] সূরা মায়িদা : ২৭
[৮৪] মুসলিম : ৩২০৮
[৮৫] সুরা বাকারা : ১৮৫
[৮৬] মুসলিম: ১০৮১
[৮৭] সূরা আনফাল: ৩৮
[৮৮] সুনানে নাসায়ী : ৫৬২৬
[৮৯] সূরা আল-বাকারা: ২৮৬
[৯০] সূরা বাকারা : ১৮৫
[৯১] মুসলিম : ২৬৬৬
[৯২] আহমাদ : ১৯৫৬৩
[৯৩] সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৪
[৯৪] বুখারী : ৪৯৬৮
[৯৫] সূরা বাকারা, আয়াত ১৭৮
[৯৬] আবু দাউদ : ১২৩
[৯৭] আবু দাউদ : ২০২৩
[৯৮] তিরমিযী : ৬৫৩
[৯৯] সূরা আদ-দুখান: ৩-৪
[১০০] সূরা আল-কদর
[১০১] বুখারী : ১২৬৬, মুসলিম : ৩৪
[১০২] বুখারী : ১৮৭৪
[১০৩] বুখারী : ১৮৭৩, মুসলিম : ১৯৮
[১০৪] ইবনে মাজাহ : ৩৯৮২
[১০৫] সূরা বাকারা: ১২৫
[১০৬] সূরা বাকারা : ১৮৭
[১০৭] সূরা আম্বিয়া : ৫২
[১০৮] বুখারি : ১৮৬৮, মুসলিম : ২০০৬
[১০৯] বুখারি ২০৪১
[১১০] মুসলিম : ১৯৯৪
[১১১] বুখারী : ১৯০৩
[১১২] বুখারী : ১৯০৩
[১১৩] বুখারী : ২৯৮
[১১৪] মুসলিম : ১৯৯৪
[১১৫] মুসলিম : ৬০১১
[১১৬] সুরা আজ-জারিয়াত: ৫৬
[১১৭] সুরা যুমার : ৫৩
[১১৮] আল-বাকারা : ১৮৬
[১১৯] আল মাজমাউল কাবীর : ৬০৯০
[১২০] মুসলিম : ১১৬৭
[১২১] বুখারী : ৬২০
[১২২] বুখারী : ০১
[১২৩] বুখারী : ২০৩৭
[১২৪] বুখারী : ১৮৯৪
[১২৫] আবু দাউদ : ২১১৫
[১২৬] বুখারী : ১৮৯৯
[১২৭] বুখারী : ২০৪৬
[১২৮] সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত ৩৩
[১২৯] মুসনাদ আহমদ : ৬৯৯১
[১৩০] মুসলিম : ৪২৯
[১৩১] আবু দাউদ : ১৩৭১
[১৩২] সূরা নিসা : ৮০
[১৩৩] সূরা নিসা: ৫৯
[১৩৪] মুসলিম : ১৬৩৫
[১৩৫] মুসলিম : ১৬৩৬
[১৩৬] আবু দাউদ : ৯৫৯
[১৩৭] ইরওয়া উল গালিল : ২/১০৪
[১৩৮] বুখারী : ৯৪৮
[১৩৯] বায়হাকী : ১৯০১
[১৪০] যাদুল মায়াদ
[১৪১] সহীহ আল-জামে হাদীস নং ১৮৮৭
[১৪২] আহমদ : ১৪২২
[১৪৩] বুখারী : ৯০০
[১৪৪] তিরমিযী : ১৮৭
[১৪৫] বুখারী : ৯৩৩
[১৪৬] যাদুল-মায়াদ
[১৪৭] সূরা কাউসার : ০২
[১৪৮] হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ
[১৪৯] মুসলিম : ১৪৭৫
[১৫০] যাদুল-মায়াদ
[১৫১] বুখারী : ৯০৩
[১৫২] যাদুল-মায়াদ
[১৫৩] বুখারী : ৯৩৫
[১৫৪] বুখারী : ৯০৭
[১৫৫] মুসলিম : ১৪৬৭
[১৫৬] নাসায়ী : ১৪০৩
[১৫৭] বুখারী : ৯০৩
[১৫৮] আবু দাউদ : ৯৫৭
[১৫৯] ফাতহুল বারী
[১৬০] আল মুজামুল কাবির লিত তাবারি : ১৭৫৮৯
[১৬১] মুসলিম : ৪৬৫২
[১৬২] মুসলিম : ৪৬৪৩
[১৬৩] আবু দাউদ ৩৫১২
[১৬৪] আবু দাউদ ৩৫৭৪
[১৬৫] সহীহ আল-জামে হাদীস নং ৪৫৮৪
[১৬৬] আবু দাউদ : ১৭৪৬
[১৬৭] সূরা আহযাব : ৩৩
[১৬৮] মুসলিম : ৩৯৭১
[১৬৯] মুসলিম : ৪০৩৭
[১৭০] বুখারী : পৃ: ২৯৪ অধ্যায়: ১৭
[১৭১] বুখারী: ৪৭৫০
[১৭২] বুখারী : ৮৯৯
[১৭৩] বুখারী ১৮৩৩
[১৭৪] মুসলিম ১৯৮৪
[১৭৫] মুসলিম ১৮৯৫
[১৭৬] মুসলিম ১৯৮২
[১৭৭] বুখারী ১৮৩৩
[১৭৮] বুখারী ১৮৪৫
[১৭৯] মুসলিম ১৯৭৬
[১৮০] নাসায়ী ২৩০৫
[১৮১] মুসলিম ১৯৭৭
[১৮২] মুসলিম :, তিরমিযী :
[১৮৩] মুসলিম ১৯৬৯
[১৮৪] মুসলিম, তিরমিযী
[১৮৫] মুসলিম :
[১৮৬] মুসলিম
[১৮৭] আহমদ :
[১৮৮] ইকতেজাউ সিরাতিল মুস্তাকীম: ইমাম তাইমিয়া ও রদ্দুল মুহতার : ইবনে আবেদীন
[১৮৯] সূরা আম্বিয়া : ১০
[১৯০] সূরা সাদ : ২৯
[১৯১] সূরা বাকারা : ৭৮
[১৯২] তাফসীর ফতহুল কাদীর :
[১৯৩] সুরা আল-ফুরকান : ৩০
[১৯৪] তাফসীরে ইবনে কাসীর :
[১৯৫] সিয়ারু আ'লাম আন-নুবালা :
[১৯৬] আল-জামে লি আহকামিল কুরআন :
[১৯৭] মাসনাদে আহমদ: ভলিয়ম:০১ পৃ:৩৮: হাদিস: ৩৫
[১৯৮] তাফসীরে তাবারী : পৃ: ৪০
[১৯৯] বুখারী : ৪৬৭০
_________________________________________________________________________________
সংকলন: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদনা : মুহাম্মদ শামসুল হক সদ্দিকি
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন