Views:
A+
A-
মাহে রামাযান: অসংখ্য কল্যাণের হাতছানি
২) রামাযান মাসে রোযা রাখা ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ:
৪) রামাযান মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়:
আবু হুরায়রা (রাহ:)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
যখন রামাযান আগমণ করে তখন জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়।”
অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
যখন রামাযান আগমণ করে তখন আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়।”[4]
৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান ছাড়া অন্য কখনো পুরো মাস রোযা রাখতেন না:
আয়েশা (রাহ:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:
৬) এক রামাযান অন্য রামাযানের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে সংঘটিত পাপরাশীর জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ:
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:
৭) মাহে রামাযানে অসংখ্য কল্যাণের হাতছানি:
৮) একই বছরে রামাযান এবং যিল হজ্জ মাস একসাথে অপূর্ণ হবে না:
আবু বাকরা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
অর্থাৎ এ দুটি মাস একই বছরে এক সাথে অসম্পূর্ণ হবেনা। একটি ২৯ দিনে হলে অন্যটি অবশ্যই ৩০ দিনে হবে। আরেকটি মত হল, হাদীসটির অর্থ এ দুটি মাসে আমলের সাওয়াব কম হবে না।[9]
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় শবে কদরে কিয়ামুল লায়ল করবে তার পূর্বে সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রামাযান মাসে রোযা রাখবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে।”[10]
২) রামাযান মাসে রোযা রাখা জান্নাতে যাওয়ার একটি বিরাট মাধ্যম:
ক) আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত।
এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। তিনি বললেন:
খ) মুআয বিন জাবাল (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা এক সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে ছিলাম। পথে চলতে চলতে আমি তাঁর নিকটে এসে পৌঁছলাম। এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: হে আল্লাহর নবী, আমাকে এমন আমলের কথা বলুন যার মাধ্যমে আমি জান্নাতে যেতে পারব এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে পারব। তিনি বললেন:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সোওয়াবের আশায় রামাযানে কিয়ামুল লাইল বা তারাবীহর নামায আদায় ররে তার পূর্বের সমস্ত (ছোট) গুনাহ মোচন হয়ে যাবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
তারবীর নামায সম্পর্কে কিছু কথা:
ক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরজ হওয়ার আশংকায় দুই বা তিন রাতের বেশি জামাআতের সাথে আদায় করেন নি:
উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একরাতে নামায আদায় করলেন। অন্যান্য লোকেরাও তার সাথে নামায আদায় করলেন। পরের রাতেও তিনি নামায পড়লেন। তাতে প্রচুর পরিমান লোকের সমাগম হল। অতঃপর তৃতীয় বা চতুর্থ রাতে নামাযের জন্য লোকজন একত্রিত হল কিন্তু তিনি বাড়ি থেকে বের হলেন না। সকাল হলে তিনি বললেন:
অন্য বর্ণনায় রয়েছে: আর যদি এটা ফরয করে দেয়া হয় তবে তোমরা তা পালন করতে পারবে না।”[14]
খ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের নামায কত রাকাত কিভাবে পড়তেন?
আবু সালামা আব্দুর রাহমান উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:) কে জিজ্ঞেস করলেন: রামাযান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায কেমন ছিল? তিনি বললেন:
গ) উমর (রা:) এর যুগে পুনরায় জামাআত বদ্ধভাবে তারাবীর নামায চালু হয়:
আব্দুর রাহমান বিন আব্দুল কাদেরী বলেন: রামাযানের এক রাতে আমি উমর (রা:) এর সাথে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম লোকজন বিচ্ছিন্নভাবে নামায পড়ছে। কেউ একাকী নামায আদায় করছে। কেউবা কয়েকজনকে নিয়ে জামাআত করছে। এ অবস্থা দেখে উমর (রা:) বললেন: এ সমস্ত লোককে একজন ক্বারীর পেছনে নামায পড়ার জন্য একত্রিত করা হলে তা হবে অতি উত্তম। অতঃপর তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং উবাই ইব্ন কাব (রা:) এর পেছনে নামায পড়ার জন্য লোকজনকে একত্রিত করার ব্যাবস্থা গ্রহণ করলেন।
এরপর আর এক রাতে তাঁর সাথে বের হলাম। এ সময় লোকেরা তাদের উক্ত ক্বারীর পেছনে জামআতবদ্ধ হয়ে নামায আদায় করছিলেন। এটা দেখে উমর (রা:) বললেন: “এ নতুন পদ্ধতিটি কত চমৎকার! যারা এখন ঘুমাচ্ছে (কিন্তু শেষ রাতে আদায় করবে) তারা এখন যারা পড়ছে তাদের চেয়ে উত্তম। এ সময় মানুষ প্রথম রাতেই কিয়ামুল লাইল করত।”[16]
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:
খ) রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত:
আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত।
আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ওফাত দেয়া পর্যন্ত রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।”[18]
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রামাযানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর সফরে যাওয়ায় ইতিকাফ করতে পারেন নি। তাই যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন ।[19]
লাইলাতুল কদর (শবে কদর)
লাইলাতুল কাদর (শবে কদর) রামাযানের শেষ দশকের যে কোন বেজোড় রাতে হবে:
১) আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত:
২) আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
৩) ইব্ন উমার (রা:) হতে বর্ণিত।
কয়েকজন সাহাবী স্বপ্ন মারফত রামাযানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল ক্বদর হতে দেখেছেন। অতএব, কেউ এ রাতটির সন্ধান পেতে চাইলে সে যেন রামাযানের শেষ সাত দিনে তা খোঁজ করে।”[22]
একটি মাসআলা:
রামাযানে সফরকারীর জন্য রোযা ভেঙ্গে ফেলা বৈধ:
ক) ইব্ন আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান মাসে মক্কা (বিজদের উদ্দেশ্যে) বের হলেন। তিনি রোযা অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু কুদাইদ (মক্কা থেকে মদীনার দিকে বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থানের নাম) পৌঁছে রোযা ভেঙ্গে ফেললেন এবং তার সাথে যে সকল সাহাবী ছিলেন তারাও রোযা ভাঙ্গলেন।[23]
খ) আবুদ দারদা (রা:) বলেন: আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কোন এক সফরে বের হলাম। সে দিনটি ছিল প্রচন্ড গরম। প্রচন্ড গরমের কারণে কেউ কেউ মাথায় হাত রাখছিল আর আমাদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা:) ছাড়া কেউ রোযা ছিল না।”[24]
গ) আনাস বিন মালিক (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা (রামাযান মাসে) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সফরে যেতাম। কিন্তু তিনি আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোযা রাখত তাকে দোষারোপ করতেন না আবার যে ব্যক্তি রোযা ভাঙ্গতেন তাকেও দোষারোপ করতেন না।”[25]
১) রামাযানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে বিদ্আত:
রামাযানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু লোক চাঁদের দিকে হাত উঁচু করে শাহাদাত আঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করে থাকে। এটা বিদআত। কেননা, কুরআন-সুন্নাহতে এর কোন ভিত্তি নাই।
তবে নতুন চাঁদ দেখলে নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করা সুন্নাত:
অর্থ: হে আল্লাহ, এ চাঁদকে আমাদের মাঝে বরকত, ঈমান, শান্তি-নিরাপত্তা ও ইসলামের সাতে উদিত কর। আমার ও তোমার রব আল্লাহ।”
২) সেহরী সংক্রান্ত বিদআত:
দেখা যায়, রামাযান মাসে শেষ রাতে মুআযযিনগণ মাইকে উচ্চ আওয়াযে কুরআন তেলাওয়াত, গযল, ইসলামী সঙ্গীত ইত্যাদি গাওয়া শুরু করে। অথবা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে বক্তাদের ওয়াজ, গজল বাজাতে থাকে। সেই সাথে চলতে থাকে ভায়েরা আমার, বনেরা আমার, উঠুন, সাহরীর সময় হয়েছে, রান্না-বান্না করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন” ইত্যাদি বলে অনবরত ডাকাডাকি। অথবা কোথাওবা কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে হুইশেল বাজানো হয়।
এর থেকে আরো আজব কিছু আচরণ দেখা যায়। যেমন, এলাকার কিছু যুবক রামাযানের শেষ রাতে মাইক নিয়ে এসে সম্মিলিত কন্ঠে গযল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের বাড়ির দুআরে দুআরে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। অথবা মাইক বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। এ ছাড়াও এলাকা ভেদে বিভিন্ন বেদআতী কার্যক্রম দেখা যায়।
আমাদের জানা উচিত, শেষ রাতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিচের আসমানে নেমে আসেন। এটা দুআ কবুলের সময়। আল্লাহ তাআলার নিকট এ সময় কেউ দুআ করলে তিনি তা কবুল করেন। মুমিন বান্দাগণ এ সময় তাহাজ্জুদের নামায পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহান আল্লাহ তাআলা তায়ালা দরবারে রোনাযারী করে থাকেন। সুতরাং এ সময় মাইক বাজিয়ে, গযল গেয়ে বা চাঁদা তুলে এ মূল্যবান সময়ে ইবাদতে বিঘ্নিত করা নিঃসন্দেহে গুনাহর কাজ। এতে মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো হয়। যার ফলে অনেকের সেহরী এমনকি ফজরের নামায পর্যন্ত ছুটে যায়। এই কারণে অনেক রোযাদারগণ সেহরীর শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব না করে আগে ভাগে সেহরী শেষ করে দেয়। এ সবগুলোই গুনাহের কাজ।
তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে ক্ষেত্রে সুন্নত কী?
এ প্রকৃত পক্ষে সুন্নাত হচ্ছে, সেহরীর জন্য দুটি আযান দেয়া। দুটি আযান দেয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত ছিল। ১ম আযান সেহরী খাওয়ার জন্য এবং ২য় আযান সেহরী খাওয়া শেষ করার জন্য এবং এজন্য দুজন মুআজ্জিনও নিয়োগ করা ছিল। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
সুনানুন নাসাঈর হাদীসে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
সুতরাং এ দুটির বেশি কিছু করতে যাওয়া বিদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়। এজন্যই ওলামাগণ বলেছেন: যখন একটি সুন্নত উঠে যায় তখন সেখানে একটি বিদআত স্থান করে নেয়।” আমাদের অবস্থাও হয়েছে তাই। সুন্নত উঠে গিয়ে সেখানে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতি স্থান দখল করে নিয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে পুনরায় সুন্নতের দিকে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন। আমীন।
৩) সেহরী খাওয়ার সময় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বিদআত:
সেহরী খাওয়া একটি ইবাদত। আর যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত অপরিহার্য শর্ত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
তাই রোযা রাখার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
নিয়ত কাকে বলে?
নিয়ত অর্থ: ইমাম নববী (রাহ:) বলেন: মনের মধ্যে কোন কাজের ইচ্ছা করা, সিদ্ধান্ত নেয়া। সুতরাং রোযা রাখার কথা মনে মধ্যে সক্রিয় থাকাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। ইসলামী শরীয়তে কোন ইবাদতের নিয়ত মুখ দিয়ে উচ্চারণের কথা আদৌ প্রমণিত নয়।
অথচ আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ওযুর নিয়ত, নামাযের নিয়ত, সেহরী খাওয়ার নিয়ত ইত্যাদি চর্চা করা হয়। নামায শিক্ষা, রোযার মাসায়েল শিক্ষা ইত্যাদি বইতে এ সব নিয়ত আরবীতে অথবা বাংলা অনুবাদ করে পড়ার জন্য জনগণকে শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্ত আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দ্বীনের মধ্যে এভাবে নতুন নতুন সংযোজনের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন:
তাই মুসলমানদের কর্তব্য হল, দলীল-প্রমাণ ছাড়া গদবাধা নিয়ত সহ সব ধরণের বিদআতী কার্যক্রম পরিত্যাগ করা এবং সুন্নতকে শক্তভাবে ধারণ করা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
৪) বিলম্বে ইফতার করা:
কিছু রোযাদারকে দেখা যায়, স্পষ্টভাবে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও অতি সর্তকতার কারণে আরও কিছুক্ষণ পরে ইফতার করে। এটি স্পষ্ট সুন্নত বিরোধীতা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
৫) তারাবীহ নামায সংক্রান্ত বিদআত:
অনেক মসজিদে দেখা যায়, তারাবীহর নামাযের প্রতি দু বা চার রাকাত শেষে মুসল্লীগণ উঁচু আওয়াজে সুবাহানা যিল জাবারূতে ওয়াল মালাকূতে…” দুআটি পাঠ করে থাকে। অথচ এটা স্পষ্ট বিদ্আত। অনুরূপভাবে অন্য কোন দুআ এক সাথে উঁচু আওয়াজে পাঠ করাও বিদআত। কারণ, এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদীস নেই। বরং নামায শেষে যে সকল দুআ সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পাঠ করা সুন্নত। যেমন, তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ”, একবার আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম ওয়ামিন্কাস সালাম, তাবারাক্তা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকারাম” ইত্যাদি।
৬) তারাবীর নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামায পড়া।
অনেক মসজিদে রামাযানে তারাবীর নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করা। যার কারণে তেলাওয়াত ঠিক মত বুঝাও যায় না। নামাযে ঠিকমত দুআ-যিকিরও পাঠ করা যায় না। এটা নি:সন্দেহে সুন্নত পরিপন্থী। কেননা, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতের কিয়ামুল লাইল হত অনেক দীর্ঘ এবং ধীরস্থির।
৭) বদর দিবস পালনকরা বিদআত:
২য় হিজরীর রামাযনের সতের তারিখে বদরের প্রান্তরে মক্কার মুশরিক সমম্প্রদায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার জানবাজ সাহসী সাহাবয়ে কেরামের মাঝে এক যুগান্তকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধ ছিল অস্ত্র-সম্ভার এবং জনবলে এক অসম যুদ্ধ। মুসলমানগণ অতি নগণ্য সংখ্যক জনবল আর খুব সামান্য অস্ত্র-শস্ত্র সহকারে কাফেরদের বিশাল অস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর প্রতিরোধ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা সে দিন অলৌকিকভাবে মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেছিলেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য মিথ্যার মাঝে চুড়ান্ত পার্থক্য সূচিত হয়েছিল।
এতো ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু প্রতি বছর রামাযানের সতের তারিখে এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্বরণ করার জন্য লোকজন একত্রিত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। তারপর বদরের বিভিন্ন ঘটনা, সাহবীদের সাহসীকতা ইত্যাদি আলাচনা কর হয়। এভাবে প্রতি বছর এই দিনে ‘বদর দিবস’ পালন করা হয়। এটি যদিও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এটির প্রচলন তেমন নেই। কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের কিছু ইসলামী সংগঠন প্রতি বছর বেশ জোরে শোরে সাংগঠনিক কার্যক্রম হিসেবে এই বিদআত পালন করে থাকে। অথচ উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার সর্বোত্তম আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং সালাফে সালেহীন থেকে এ জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের কোন ভিত্তি নাই। বদরের এ ঘটনা নি:সন্দেহে মুসলমানদের প্রেরণার উৎস। এ সম্পর্কে জ্ঞান অজর্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এভাবে দিবস পালন করা শরীয়ত সম্মত নয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ:) বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াত জীবনে রয়েছে অনেক বক্তৃতা, সন্ধি-চুক্তি এবং বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা, যেমন, বদর, হুনাইন, খন্দক, মক্কা বিজয়, হিজরত মূহুর্ত, মদীনায় প্রবেশ, বিভিন্ন বক্তৃতা যেখানে তিনি দ্বীনের মূল ভিত্তিগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি তো এ দিনগুলোকে আনন্দ-উৎসব হিসেবে পালন করা আবশ্যক করেন নি। বরং এ জাতীয় কাজ করে খৃষ্টানরা। তারা ঈসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে ইহুদীরাও এমনটি করে। ঈদ-উৎসব হল শরীয়তের একটি বিধান। আল্লাহ তায়ালা শরীয়ত হিসেবে যা দিয়েছেন তা অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় এমন নতুন কিছু আবিস্কার করা যাবে না যা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়।”[28]
মূলত: এ জাতীয় কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শরীয়ত থেকে দূরে রাখার একটি অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং শরীয়ত যে কাজ করতে আদেশ করে নি তা হতে দূরে অবস্থান করে রামাযান মাসে অধিকহারে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায আদায় করা, জিকির-আযকার এবং অন্যান্য এবাদত-বন্দেগী বেশি বেশি করা দরকার। কিন্তু মুসলমানদের অন্যতম সমস্যা হল শরীয়ত অনুমোদিত ইবাদত বাদ দিয়ে নব আবিস্কৃত বিদআতী আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।
৮) ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা:
ইতিকাফ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রামাযানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু এ সম্পের্কে আমাদের দেশে মনে করা হয় যে, সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসতে হবে তা না হলে সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, ইতিকাফ হল একটি সুন্নত ইবাদাত। যে কোন মুসলমানই তা পালন করতে পারে। যে ব্যক্তি তা পালন করবে সে অগণিত সোওয়াবের অধিকারী হবে। সবার পক্ষ থেকে একজনকে ইতিকাফে বসতেই হবে এমন কোন কথা শরীয়তে নেই।
৯) জুমুআতুল বিদা পালনের বিদআত:
আমাদের দেশে দেখা যায়, রামাযানের শেষ শুক্রবারে জুমুআতুল বিদা পালন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে জুমুআর নামাযে প্রচুর ভিড় পরিলক্ষীত হয়। অথচ কুরআন সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন ধারণা পাওয়া যায় না। আমাদের কর্তব্য প্রত্যেক জুমুআকে গুরুত্ব দেয়া। শেষ জুমুআর বিশেষ কোন ফযীলত আছে বলে কোন প্রমাণ নাই।
১০) ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রে সুন্নাতের বরখেলাপ:
খাদ্য দ্রব্য না দিয়ে টাকা দিয়ে অথবা কাপড় কিনে ফিতরা দেয়া সুন্নতের বরখেলাপ। কারণ, হাদীসে ফিতরা হিসেবে খাদ্য দ্রব্য প্রদান করার কথাই বর্ণিত হয়েছে । যেমন ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:
তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও দিনার-দিরহামের প্রচলন ছিল কিন্তু তিনি অথবা তার কোন সাহাবী দিনার-দিরহাম দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন বলে কোন প্রমাণ নাই। তাই সুন্নত হল, আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য দ্রব্য (যেমন চাউল) দ্বারা ফিতরা আদায় করা।
আরেকটি বিষয় হল: হাদীসে বর্ণিত এক সা’র পরিবর্তে আধা সা ফিতরা দেওয়াও সুন্নতের বরখেলাপ। যেমনটি উপরোক্ত হাদীসে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও আমাদের সমাজে আধা সা ফিতরা দেয়ার মাসআলাই দেয়া হয়।
আল্লাহ তাআলা সকল ক্ষেত্রে তার নবীর সুন্নতকে যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দান করুন এবং সকল বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
তথ্য সূচী:
[2] বুখারী ও মুসলিম।
[3] বুখারী, সাওম অধ্যায় ও মুসলিম, ঈমান অধ্যায়।
[4] সহীহ বুখারী, কিতাবুস সাওম। সহীহ মুসলিম কিতাবুস সিয়াম।|
[5] বুখারী ও মুসলিম।
[6] সহীহ মুসলিম। পবিত্রতা অধ্যায়।
[7] তিরমিযী, রোযা অধ্যায়। মুসতাদরাক হাকেম। আল্লামা আলবানী (রা.) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ তারগীব ওয়াত্ তারহীব। হাদীস নং ৯৯৮।
[8] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: রোযা। সহীহ মুসলিম অধ্যায়: রোযা।
[9] সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাত্হুল বারী। অধ্যায়: দু মাস এক সাথে কম হবে না। ১৭৭৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যা।
[10] বুখারী ও মুসলিম।
[11] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান।
[12] মুসনাদ আহমাদ, ৫/২৩১, সুনান তিরমিযী, ঈমান অধ্যায়। ঈমাম তিরমিযী বলেন: “হাদীসটি হাসান সহীহ”। সুনান ইব্ন মাজাহ্, অধ্যায়: ফিত্না -ফাসাদ।
[13] বুখারী, অধ্যায়: তাহাজ্জুদ। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামায ।|
[14] বুখারী,অধ্যায়: তারাবীহর নামায। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামায।
[15] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: তারাবীহর নাামায। অনুচ্ছেদ: রামাযান মাসে রাতের নামায পড়ার ফযীলত।
[16] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ইতিকাফ, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।
[17] সহীহ বুখরী, অধ্যায়: শবে কদরের ফযীলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।
[18] সহীহ বুখারী
[19] মুসনাদ আহমাদ,৫/ সুনান আবু দাউদ, অধ্যায়: রোযা, তিরমিযী, অধ্যায়: রোযা অনুচ্ছেদ। আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[20] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কাদরের ফযীলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোযা।
[21] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কাদরের ফযীলত।
[22] বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল ক্বাদ্র এর ফযীলত। মুসলিম, অধ্যায়: রোযা।
[23] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: রোযা অধ্যায়। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোযা। তবে সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, সাহাবীগণ সকল ক্ষেত্রে সর্ব শেষ বিধানের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ করতেন।
[24] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: রোযা, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোযা।
[25] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সাওম। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম। তবে সহীহ মুসিলমের ভাষ্য হল: “আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে রামাযান মাসে সফরে যেতাম…”।
[26] মুসনাদ আহমাদ, তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণিত (৩/৪২০), তিরমিযী, অনুচ্ছেদ: চাঁদ দেখার সময় কী বলবে? আল্লামা আলবানী (রাহ:) বেেলন: হাদীসটি সহীহ।
[27] বুখারী, অনুচ্ছেদ: ফজরের আগে আযান দেয়া। মুসলিম: অনুচ্ছেদ: ফজর উদিত হলে রোযা শুর হবে……।
[28] ইকতিযাউয সিরাতিল মুস্তাকীম। (২/৬১৪ ও ৬১৫)
মাহে রামাযান: অসংখ্য কল্যাণের হাতছানি
“রামাযান হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী” (বাকারা: ১৮৫)
ভূমিকা: খর তপ্ত জমিন। মানুষ-জন, পশু-পাখি, গাছ-পালা, তৃণ-লতা সব কিছু একপশলা বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে। হঠাৎ আকাশ জুড়ে শুরু হল মেঘের আনাগোনা। মুশলধারে বৃষ্টি বর্ষণ হল। প্রাণে প্রাণে জাগল জীবনের স্পন্দন। আবার কলকাকলিতে ভরে উঠল পৃথিবী। মাহে রামাযানের উদাহরণ অনেকটা এমনই। পৃথিবী যখন পাপ-পঙ্গীলতায় ভারি হয়ে উঠে। গুমোট অস্থিরতায় সমগ্র পৃথিবী কাঁপতে থাকে। ঠিক এমন সময় আল্লাহ তায়ালা মাহে রামাযানকে উপহার হিসেবে দেন বিশ্ববাসীর নিকট। যেন তারা তাদের পেছনে ফেলে আসা পাপরাশীকে সিয়াম, কিয়াম ও অন্যান্য নেকী অর্জনের মাধ্যমে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে নিতে পারে। আল্লাহর অশেষ রহমতের বারি ধারায় সিক্ত হয়ে শুরু করতে পারে নতুন ভাবে পথ চলা।
প্রিয় ভাই, এই রামাযান আমাদের মাঝে সমাগত। নিঃসন্দেহে রামাযান মুসলমানদের জন্য এক বিরাট কল্যাণের মাস। এ মাসে মুসলমানদের জন্য রোযা পালন করা ফরয। এ রোযা ইসলামের ৫টি রোকন (স্তম্ভ) এর মধ্যে অন্যতম। আল্লাহ তাআলা এ মাসে মানব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য মহা গ্রন্থ আল কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন। এ মাসে রয়েছে এমন একটি রাত যা এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আর তা হল, রামাযানের শেষ দশকের কদরের রাত বা শবে কদর। কুরআন-সুন্নায় এ মাসের মর্যাদা এবং এতে ইবাদত-বন্দেগী করার ব্যাপারে অনেক আলোচনা এসেছে। নিম্নে এ প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদীসে আলোকে অতি গুরুত্ব পূর্ণ একটি আলোচনা উপস্থাপনা করা হল। শেষে রয়েছে রামাযানকে কেন্দ্র করে আমাদের সামাজে প্রচলিত কতিপয় বিদআত ও সুন্নাত বিরোধী কার্যকলাপ।
আসুন, আমরা রামাযানের যথাযথ আদব রক্ষা করে সিয়াম সাধনা করে আল্লাহ তায়ালার নিকট গুনাহ-খাতা মোচন করিয়ে নেই এবং সেই সাথে দু হাত ভরে উপার্জনের চেষ্টা করি পরকালের পাথেয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
রামাযান মাসের মর্যাদা ও রোযার গুরুত্ব
১) মুসলমানদের জন্য রামাযানের রোযা রাখা ফরয:
রামাযান মাসে রোযা রাখা ফরজ হওয়ার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।” (সূরা বাকারা: ১৮৩)
২) রামাযান মাসে রোযা রাখা ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ:
ক) আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
بني الإسلام على خمس: شهادة أن لا إله إلا الله ، وأن محمداً رسول الله ،وإقامة الصلاة ، وإيتاء الزكاة ، والحج، وصوم رمضان)
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। লা ‘ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ তথা এ কথার স্বাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই এবং নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্জ আদায় করা এবং রামাযান মাসে রোযা রাখা।[1]
খ) আবু হুরায়রা (রাহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন মানুষের সামনে ছিলেন এমতবস্থায় তাঁর নিকট এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল: ঈমান কী? তিনি উত্তরে বললেন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন মানুষের সামনে ছিলেন এমতবস্থায় তাঁর নিকট এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল: ঈমান কী? তিনি উত্তরে বললেন:
الإيمان أن تؤمن بالله ، وملائكته ، وبلقائه ، ورسله، وتؤمن بالبعث
“ঈমান হল, আল্লাহ, তাঁর ফেরেশ্তাগণ, তাঁর সাথে স্বাক্ষাৎ হওয়াকে এবং তাঁর রাসূলগণকে বিশ্বাস করবে এবং সেই সাথে বিশ্বাস করবে মৃত্যুর পর পূণরুত্থানকে।” সে ব্যক্তি আবার জিজ্ঞেস করল, ইসলাম কী? তিনি বললেন:
الإسلام أن تعبد الله ولا تشرك به وتقيم الصلاة وتؤتي الزكاة المفروضة وتصوم رمضان
ইসলাম হল: এমনভাবে আল্লাহর এবাদত করবে যে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। তাঁর সাথে শির্ক করবে না, নামায পড়বে, ফরয যাকাত দিবে এবং রামাযান মাসে রোযা রাখবে।”
লোকটি পূণরায় জিজ্ঞেস করল, ইহসান কী? তিনি বললেন:
أن تعبد الله كأنك تراه ، فإن لم تكن تراه فإنه يراك
“ইহসান হল, এমনভাবে আল্লাহর এবাদত করবে যে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তাকে দেখতে না পাও তবে (এ মনোভাব রাখবে) যে তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন…।”[2]
গ) আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এক বেদুইনের কথোপকথন:
ত্বালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রাহ:) হতে বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এক বেদুঈন আগমণ করল। তার মাথার চুল ছিল উসকো-খুশ্কো। লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে বলুন, আল্লাহ তাআলা আমার জন্য কী পরিমাণ নামায ফরয করেছেন? তিনি বললেন: “পাঁচ ওয়াক্ত নামায। তবে কিছু অতিরিক্ত নফল নামায পড়তে পার।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এক বেদুঈন আগমণ করল। তার মাথার চুল ছিল উসকো-খুশ্কো। লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে বলুন, আল্লাহ তাআলা আমার জন্য কী পরিমাণ নামায ফরয করেছেন? তিনি বললেন: “পাঁচ ওয়াক্ত নামায। তবে কিছু অতিরিক্ত নফল নামায পড়তে পার।”
লোকটি বলল: আপনি আমাকে বলুন, আল্লাহ তাআলা আমার জন্য কী পরিমাণ রোযা ফরয করেছেন? তিনি বললেন: “রামাযান মাসের রোযা। তবে কিছু অতিরিক্ত নফল রোযা রাখতে পার।”
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল: আপনি আমাকে বলুন, আল্লাহ তাআলা আমার উপর কী পরিমাণ যাকাত ফরয করেছেন?
বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্নকারীকে ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান দান করলেন। অতঃপর লোকটি বলল: সে প্রভুর শপথ করে বলছি, যিনি আপনাকে সত্য দ্বারা সম্মানিত করেছেন, আমি অতিরিক্ত কোন কিছুই করব না এবং আল্লাহ তাআলা আমার উপর যা ফরয করেছেন তা থেকে কোন কিছুই কমও করব না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “সে সত্য বলে থাকলে সফল হবে।” অথবা তিনি বলছেন: “সে সত্য বলে থাকলে জান্নাতবাসী হবে।”[3]
৪) রামাযান মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়:
আবু হুরায়রা (রাহ:)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
যখন রামাযান আগমণ করে তখন জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়।”
অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
যখন রামাযান আগমণ করে তখন আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়।”[4]
৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান ছাড়া অন্য কখনো পুরো মাস রোযা রাখতেন না:
আয়েশা (রাহ:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصوم حتى نقول لا يفطر ، ويفطر حتى نقول لا يصوم ، وما رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم استكمل صيام شهر إلا رمضان ، وما رايته أكثر صياماً منه في شعبان)) متفق عليه
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নফল রোযা রাখা শুরু করলে আমরা বলতাম, তিনি হয়ত আর রোযা বাদ দিবে না। আবার রোযা বন্ধ করলে আমরা ধারণা করতাম হয়ত তিনি আর রোযাই রাখবেন না। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে রামাযান ছাড়া অন্য কখনো সারা মাস ধরে রোযা পালন করতে দেখিনি এবং শাবান মাসে তার চেয়ে বেশি আর কাউকে রোযা রাখতে দেখিনি।”[5]৬) এক রামাযান অন্য রামাযানের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে সংঘটিত পাপরাশীর জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ:
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:
الصلوات الخمس ، والجمعة إلى الجمعة ، ورمضان إلى رمضان ، مكفرات ما بينهن ، إذا اجتنب الكبائر
“পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ এবং এক রামাযান থেকে আরেক রামাযানের মধ্যবর্তী গুনাহসমূহ মোচন হয়ে যাবে যদি কবীরাগুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়।”[6]৭) মাহে রামাযানে অসংখ্য কল্যাণের হাতছানি:
إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن ، وغلقت أبواب النيران فلم يفتح منها باب ، وفتحت أبواب الجنة فلم يغلق منها باب ، وينادي مناد يا باغي الخير أقبل ، ويا باغي الشر أقصر ، والله عتقاء من النار وذلك كل ليلة
“রামাযান মাসের প্রথম রাতেই শায়তান এবং উশৃংখল জিনদেরকে শিকলবন্দী করে ফেলা হয়, জাহান্নামের সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়-যার একটিও খোলা রাখা হয় না এবং জান্নাতের সবগুলো দরজা খুলে দেয়া হয়- যার একটিও বন্ধ রাখা হয় না। আর এক আহবানকারী আহবান করতে থাকে, হে কল্যাণ প্রাত্যাশী, অগ্রসর হও। হে অন্যায়কামী, বিরত হও। আর আল্লাহ তাআলা অনেক জাহান্নামীকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর তা রামাযানের প্রতি রাতেই।”[7]৮) একই বছরে রামাযান এবং যিল হজ্জ মাস একসাথে অপূর্ণ হবে না:
আবু বাকরা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
((شهران لا ينقصان ، شهر عيد : رمضان وذو الحجة )) متفق عليه
“দুটি মাস (একই বছরে) অপূর্ণ হবে না। সেগুলো হল: ঈদের দু মাস তথা রামাযান এবং যুল হিজ্জা।”[8] অর্থাৎ এ দুটি মাস একই বছরে এক সাথে অসম্পূর্ণ হবেনা। একটি ২৯ দিনে হলে অন্যটি অবশ্যই ৩০ দিনে হবে। আরেকটি মত হল, হাদীসটির অর্থ এ দুটি মাসে আমলের সাওয়াব কম হবে না।[9]
রামাযান মাসে ইবাদত করার মর্যাদা
১) রামাযান মাসে রোযা রাখলে পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মোচন হয়ে যায়:আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় শবে কদরে কিয়ামুল লায়ল করবে তার পূর্বে সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রামাযান মাসে রোযা রাখবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে।”[10]
২) রামাযান মাসে রোযা রাখা জান্নাতে যাওয়ার একটি বিরাট মাধ্যম:
ক) আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত।
এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। তিনি বললেন:
تعبد الله لا تشرك به شيئاً ، وتقيم الصلاة المكتوبة ، وتؤدي الزكاة المفروضة ، وتصوم رمضان . قال : والذي نفسي بيده لا أزيد على هذا . فلما ولى قال النبي صلى الله عليه وسلم : من سره أن ينظر إلى رجل من أهل الجنة فلينظر إلى هذا
আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না। ফরজ নামায আদায় করবে, ফরয যাকাত দিবে, রামাযানে রোযা রাখবে।” লোকটি বলল: ঐ সত্বার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ এর চেয়ে বেশি আমি কিছুই করব না। অত:পর লোকটি চলে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: কেউ জান্নাতী লোক দেখতে চাইলে যে যেন এ লোকটিকে দেখে।”[11]খ) মুআয বিন জাবাল (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা এক সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে ছিলাম। পথে চলতে চলতে আমি তাঁর নিকটে এসে পৌঁছলাম। এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: হে আল্লাহর নবী, আমাকে এমন আমলের কথা বলুন যার মাধ্যমে আমি জান্নাতে যেতে পারব এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে পারব। তিনি বললেন:
لقد سألت عن عظيم وإنه ليسير على من يسره الله عليه، تعبد الله ولا تشرك به شيئاً، وتقيم الصلاة ، وتؤتي الزكاة، وتصوم رمضان، وتحج البيت
“তুমি অনেক বড় জিনিসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছ। তবে আল্লাহ তাআলা যার জন্যে সহজ করে দেন তার জন্য তা সহজ। আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, রামাযান মাসে রোযা রাখবে এবং কাবা ঘরের হজ্জ আদায় করবে… ।[12]তারাবীহর নামায আদায় করা গুনাহ মাফের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায়
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সোওয়াবের আশায় রামাযানে কিয়ামুল লাইল বা তারাবীহর নামায আদায় ররে তার পূর্বের সমস্ত (ছোট) গুনাহ মোচন হয়ে যাবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
তারবীর নামায সম্পর্কে কিছু কথা:
ক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরজ হওয়ার আশংকায় দুই বা তিন রাতের বেশি জামাআতের সাথে আদায় করেন নি:
উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একরাতে নামায আদায় করলেন। অন্যান্য লোকেরাও তার সাথে নামায আদায় করলেন। পরের রাতেও তিনি নামায পড়লেন। তাতে প্রচুর পরিমান লোকের সমাগম হল। অতঃপর তৃতীয় বা চতুর্থ রাতে নামাযের জন্য লোকজন একত্রিত হল কিন্তু তিনি বাড়ি থেকে বের হলেন না। সকাল হলে তিনি বললেন:
« قَدْ رَأَيْتُ الَّذِى صَنَعْتُمْ وَلَمْ يَمْنَعْنِى مِنَ الْخُرُوجِ إِلَيْكُمْ إِلاَّ أَنِّى خَشِيتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْ
তোমরা রাতে যা করেছ তা আমি দেখেছি। কিন্তু এ নামায তোমাদের উপর ফরয হয়ে যেতে পারে এ আশংকায় তোমাদের নিকট আসা হতে বিরত ছিলাম।” এটা ছিল রামাযান মাসে।[13] অন্য বর্ণনায় রয়েছে: আর যদি এটা ফরয করে দেয়া হয় তবে তোমরা তা পালন করতে পারবে না।”[14]
খ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের নামায কত রাকাত কিভাবে পড়তেন?
আবু সালামা আব্দুর রাহমান উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:) কে জিজ্ঞেস করলেন: রামাযান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায কেমন ছিল? তিনি বললেন:
مَا كَانَ يَزِيدُ فِى رَمَضَانَ ، وَلاَ فِى غَيْرِه عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً ، يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ ، ثُمَّ يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ ثُمَّ يُصَلِّى ثَلاَثًا
“তিনি রমাযান বা অন্য কোন মাসে এগার রাকাতের বেশী নামায পড়তেন না। (দুই সালামে) চার রাকাআত পড়তেন এত সুন্দর এবং দীর্ঘ করে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস কর না। আবার চার রাকাআত পড়তেন এত সুন্দর করে ও দীর্ঘ করে যে, সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস কর না। এর পর তিন রাকাআত (বিত্র) পড়তেন।”[15]গ) উমর (রা:) এর যুগে পুনরায় জামাআত বদ্ধভাবে তারাবীর নামায চালু হয়:
আব্দুর রাহমান বিন আব্দুল কাদেরী বলেন: রামাযানের এক রাতে আমি উমর (রা:) এর সাথে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম লোকজন বিচ্ছিন্নভাবে নামায পড়ছে। কেউ একাকী নামায আদায় করছে। কেউবা কয়েকজনকে নিয়ে জামাআত করছে। এ অবস্থা দেখে উমর (রা:) বললেন: এ সমস্ত লোককে একজন ক্বারীর পেছনে নামায পড়ার জন্য একত্রিত করা হলে তা হবে অতি উত্তম। অতঃপর তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং উবাই ইব্ন কাব (রা:) এর পেছনে নামায পড়ার জন্য লোকজনকে একত্রিত করার ব্যাবস্থা গ্রহণ করলেন।
এরপর আর এক রাতে তাঁর সাথে বের হলাম। এ সময় লোকেরা তাদের উক্ত ক্বারীর পেছনে জামআতবদ্ধ হয়ে নামায আদায় করছিলেন। এটা দেখে উমর (রা:) বললেন: “এ নতুন পদ্ধতিটি কত চমৎকার! যারা এখন ঘুমাচ্ছে (কিন্তু শেষ রাতে আদায় করবে) তারা এখন যারা পড়ছে তাদের চেয়ে উত্তম। এ সময় মানুষ প্রথম রাতেই কিয়ামুল লাইল করত।”[16]
রামাযানের শেষ দশক
ক) রামাযানের শেষ দশকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী-পরিবার সহরাত জেগে ইবাদত করতেন:উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:
إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ
“রামাযানের শেষ দশক প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন, নিজে সারা রাত জাগতেন এবং পরিবারকেও জাগাতেন।”[17]খ) রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত:
আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত।
আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ওফাত দেয়া পর্যন্ত রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।”[18]
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রামাযানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর সফরে যাওয়ায় ইতিকাফ করতে পারেন নি। তাই যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন ।[19]
লাইলাতুল কদর (শবে কদর)
১) আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত:
« تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান কর।”[20]২) আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أَيْقَظَنِى بَعْضُ أَهْلِى فَنُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِى الْعَشْرِ الْغَوَابِرِ
“আমাকে লাইলাতুল ক্বদ্র দেখানো হল। কিন্তু আমার এক স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ায় আমি তা ভুলে গিয়েছি। অতএব, তোমরা তা রামাযানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর।”[21]৩) ইব্ন উমার (রা:) হতে বর্ণিত।
কয়েকজন সাহাবী স্বপ্ন মারফত রামাযানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল ক্বদর হতে দেখেছেন। অতএব, কেউ এ রাতটির সন্ধান পেতে চাইলে সে যেন রামাযানের শেষ সাত দিনে তা খোঁজ করে।”[22]
একটি মাসআলা:
রামাযানে সফরকারীর জন্য রোযা ভেঙ্গে ফেলা বৈধ:
ক) ইব্ন আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান মাসে মক্কা (বিজদের উদ্দেশ্যে) বের হলেন। তিনি রোযা অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু কুদাইদ (মক্কা থেকে মদীনার দিকে বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থানের নাম) পৌঁছে রোযা ভেঙ্গে ফেললেন এবং তার সাথে যে সকল সাহাবী ছিলেন তারাও রোযা ভাঙ্গলেন।[23]
খ) আবুদ দারদা (রা:) বলেন: আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কোন এক সফরে বের হলাম। সে দিনটি ছিল প্রচন্ড গরম। প্রচন্ড গরমের কারণে কেউ কেউ মাথায় হাত রাখছিল আর আমাদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা:) ছাড়া কেউ রোযা ছিল না।”[24]
গ) আনাস বিন মালিক (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা (রামাযান মাসে) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সফরে যেতাম। কিন্তু তিনি আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোযা রাখত তাকে দোষারোপ করতেন না আবার যে ব্যক্তি রোযা ভাঙ্গতেন তাকেও দোষারোপ করতেন না।”[25]
রামাযান মাসে কতিপয় বিদআত ও সুন্নাত বিরোধী কার্যক্রম
রামাযান মাসে সমাজে একধিক বিদ্আত প্রচলিত রয়েছে। যেগুলো এক জায়গায় এক রোকম, অন্য জায়গায় আর এক রোকম। এক দেশের লোকাচার অন্য দেশ থেকে ভিন্ন। নিম্নে আমরা আমাদের দেশে প্রচলিত এ সংক্রান্ত কিছু বিদআতী কাজের চিত্র তুলে ধরব।১) রামাযানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে বিদ্আত:
রামাযানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু লোক চাঁদের দিকে হাত উঁচু করে শাহাদাত আঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করে থাকে। এটা বিদআত। কেননা, কুরআন-সুন্নাহতে এর কোন ভিত্তি নাই।
তবে নতুন চাঁদ দেখলে নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করা সুন্নাত:
اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالإِيمَانِ وَالسَّلاَمَةِ وَالإِسْلاَمِ رَبِّى وَرَبُّكَ اللَّهُ
আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম। রাব্বী ওয়া রাব্বুকাল্লাহ”। [26]অর্থ: হে আল্লাহ, এ চাঁদকে আমাদের মাঝে বরকত, ঈমান, শান্তি-নিরাপত্তা ও ইসলামের সাতে উদিত কর। আমার ও তোমার রব আল্লাহ।”
২) সেহরী সংক্রান্ত বিদআত:
দেখা যায়, রামাযান মাসে শেষ রাতে মুআযযিনগণ মাইকে উচ্চ আওয়াযে কুরআন তেলাওয়াত, গযল, ইসলামী সঙ্গীত ইত্যাদি গাওয়া শুরু করে। অথবা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে বক্তাদের ওয়াজ, গজল বাজাতে থাকে। সেই সাথে চলতে থাকে ভায়েরা আমার, বনেরা আমার, উঠুন, সাহরীর সময় হয়েছে, রান্না-বান্না করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন” ইত্যাদি বলে অনবরত ডাকাডাকি। অথবা কোথাওবা কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে হুইশেল বাজানো হয়।
এর থেকে আরো আজব কিছু আচরণ দেখা যায়। যেমন, এলাকার কিছু যুবক রামাযানের শেষ রাতে মাইক নিয়ে এসে সম্মিলিত কন্ঠে গযল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের বাড়ির দুআরে দুআরে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। অথবা মাইক বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। এ ছাড়াও এলাকা ভেদে বিভিন্ন বেদআতী কার্যক্রম দেখা যায়।
আমাদের জানা উচিত, শেষ রাতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিচের আসমানে নেমে আসেন। এটা দুআ কবুলের সময়। আল্লাহ তাআলার নিকট এ সময় কেউ দুআ করলে তিনি তা কবুল করেন। মুমিন বান্দাগণ এ সময় তাহাজ্জুদের নামায পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহান আল্লাহ তাআলা তায়ালা দরবারে রোনাযারী করে থাকেন। সুতরাং এ সময় মাইক বাজিয়ে, গযল গেয়ে বা চাঁদা তুলে এ মূল্যবান সময়ে ইবাদতে বিঘ্নিত করা নিঃসন্দেহে গুনাহর কাজ। এতে মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো হয়। যার ফলে অনেকের সেহরী এমনকি ফজরের নামায পর্যন্ত ছুটে যায়। এই কারণে অনেক রোযাদারগণ সেহরীর শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব না করে আগে ভাগে সেহরী শেষ করে দেয়। এ সবগুলোই গুনাহের কাজ।
তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে ক্ষেত্রে সুন্নত কী?
এ প্রকৃত পক্ষে সুন্নাত হচ্ছে, সেহরীর জন্য দুটি আযান দেয়া। দুটি আযান দেয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত ছিল। ১ম আযান সেহরী খাওয়ার জন্য এবং ২য় আযান সেহরী খাওয়া শেষ করার জন্য এবং এজন্য দুজন মুআজ্জিনও নিয়োগ করা ছিল। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« إِنَّ بِلاَلاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ ، فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ »
“বেলাল রাতে আযান দেয়। অত:এব তোমরা বেলালের আযান শুনলে পানাহার করতে থাক ইবনে উম্মে মাকতুমের আযান দেয়া পর্যন্ত।”[27]সুনানুন নাসাঈর হাদীসে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إِنَّ بِلَالًا يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ لِيُوقِظَ نَائِمَكُمْ وَلِيَرْجِعَ قَائِمَكُمْ وَلَيْسَ أَنْ يَقُولَ هَكَذَا يَعْنِي فِي الصُّبْحِ
“বেলাল আযান দেয় এজন্য যে, যেন ঘুমন্ত লোক জাগ্রত হয় আর তাহাজ্জুদ আদায়কারী ফিরে আসে অর্থাৎ নামায বাদ দেয় এবং সেহরী খায়।”সুতরাং এ দুটির বেশি কিছু করতে যাওয়া বিদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়। এজন্যই ওলামাগণ বলেছেন: যখন একটি সুন্নত উঠে যায় তখন সেখানে একটি বিদআত স্থান করে নেয়।” আমাদের অবস্থাও হয়েছে তাই। সুন্নত উঠে গিয়ে সেখানে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতি স্থান দখল করে নিয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে পুনরায় সুন্নতের দিকে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন। আমীন।
৩) সেহরী খাওয়ার সময় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বিদআত:
সেহরী খাওয়া একটি ইবাদত। আর যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত অপরিহার্য শর্ত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ »
সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারী) তাই রোযা রাখার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَنْ لَمْ يُبَيِّتْ الصِّيَامَ قَبْلَ الْفَجْرِ فَلَا صِيَامَ لَهُ
“যে রাতে (ফজরের আগে) রোযা রাখার নিয়ত করে নি তার রোযা হবে না।” (সুনান নাসাঈ, আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)নিয়ত কাকে বলে?
নিয়ত অর্থ: ইমাম নববী (রাহ:) বলেন: মনের মধ্যে কোন কাজের ইচ্ছা করা, সিদ্ধান্ত নেয়া। সুতরাং রোযা রাখার কথা মনে মধ্যে সক্রিয় থাকাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। ইসলামী শরীয়তে কোন ইবাদতের নিয়ত মুখ দিয়ে উচ্চারণের কথা আদৌ প্রমণিত নয়।
অথচ আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ওযুর নিয়ত, নামাযের নিয়ত, সেহরী খাওয়ার নিয়ত ইত্যাদি চর্চা করা হয়। নামায শিক্ষা, রোযার মাসায়েল শিক্ষা ইত্যাদি বইতে এ সব নিয়ত আরবীতে অথবা বাংলা অনুবাদ করে পড়ার জন্য জনগণকে শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্ত আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দ্বীনের মধ্যে এভাবে নতুন নতুন সংযোজনের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন:
« مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ »
“যে আমাদের এই দ্বীনে এমন নতুন কিছু তৈরি করল যা তার অন্তর্ভূক্ত নয় তা পরিত্যাজ্য।” (বুখারী ও মুসলিম)তাই মুসলমানদের কর্তব্য হল, দলীল-প্রমাণ ছাড়া গদবাধা নিয়ত সহ সব ধরণের বিদআতী কার্যক্রম পরিত্যাগ করা এবং সুন্নতকে শক্তভাবে ধারণ করা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
৪) বিলম্বে ইফতার করা:
কিছু রোযাদারকে দেখা যায়, স্পষ্টভাবে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও অতি সর্তকতার কারণে আরও কিছুক্ষণ পরে ইফতার করে। এটি স্পষ্ট সুন্নত বিরোধীতা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
« لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ »
মানুষ ততদিন কল্যাণে উপর থাকবে যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)৫) তারাবীহ নামায সংক্রান্ত বিদআত:
অনেক মসজিদে দেখা যায়, তারাবীহর নামাযের প্রতি দু বা চার রাকাত শেষে মুসল্লীগণ উঁচু আওয়াজে সুবাহানা যিল জাবারূতে ওয়াল মালাকূতে…” দুআটি পাঠ করে থাকে। অথচ এটা স্পষ্ট বিদ্আত। অনুরূপভাবে অন্য কোন দুআ এক সাথে উঁচু আওয়াজে পাঠ করাও বিদআত। কারণ, এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদীস নেই। বরং নামায শেষে যে সকল দুআ সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পাঠ করা সুন্নত। যেমন, তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ”, একবার আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম ওয়ামিন্কাস সালাম, তাবারাক্তা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকারাম” ইত্যাদি।
৬) তারাবীর নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামায পড়া।
অনেক মসজিদে রামাযানে তারাবীর নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করা। যার কারণে তেলাওয়াত ঠিক মত বুঝাও যায় না। নামাযে ঠিকমত দুআ-যিকিরও পাঠ করা যায় না। এটা নি:সন্দেহে সুন্নত পরিপন্থী। কেননা, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতের কিয়ামুল লাইল হত অনেক দীর্ঘ এবং ধীরস্থির।
৭) বদর দিবস পালনকরা বিদআত:
২য় হিজরীর রামাযনের সতের তারিখে বদরের প্রান্তরে মক্কার মুশরিক সমম্প্রদায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার জানবাজ সাহসী সাহাবয়ে কেরামের মাঝে এক যুগান্তকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধ ছিল অস্ত্র-সম্ভার এবং জনবলে এক অসম যুদ্ধ। মুসলমানগণ অতি নগণ্য সংখ্যক জনবল আর খুব সামান্য অস্ত্র-শস্ত্র সহকারে কাফেরদের বিশাল অস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর প্রতিরোধ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা সে দিন অলৌকিকভাবে মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেছিলেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য মিথ্যার মাঝে চুড়ান্ত পার্থক্য সূচিত হয়েছিল।
এতো ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু প্রতি বছর রামাযানের সতের তারিখে এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্বরণ করার জন্য লোকজন একত্রিত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। তারপর বদরের বিভিন্ন ঘটনা, সাহবীদের সাহসীকতা ইত্যাদি আলাচনা কর হয়। এভাবে প্রতি বছর এই দিনে ‘বদর দিবস’ পালন করা হয়। এটি যদিও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এটির প্রচলন তেমন নেই। কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের কিছু ইসলামী সংগঠন প্রতি বছর বেশ জোরে শোরে সাংগঠনিক কার্যক্রম হিসেবে এই বিদআত পালন করে থাকে। অথচ উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার সর্বোত্তম আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং সালাফে সালেহীন থেকে এ জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের কোন ভিত্তি নাই। বদরের এ ঘটনা নি:সন্দেহে মুসলমানদের প্রেরণার উৎস। এ সম্পর্কে জ্ঞান অজর্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এভাবে দিবস পালন করা শরীয়ত সম্মত নয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ:) বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াত জীবনে রয়েছে অনেক বক্তৃতা, সন্ধি-চুক্তি এবং বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা, যেমন, বদর, হুনাইন, খন্দক, মক্কা বিজয়, হিজরত মূহুর্ত, মদীনায় প্রবেশ, বিভিন্ন বক্তৃতা যেখানে তিনি দ্বীনের মূল ভিত্তিগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি তো এ দিনগুলোকে আনন্দ-উৎসব হিসেবে পালন করা আবশ্যক করেন নি। বরং এ জাতীয় কাজ করে খৃষ্টানরা। তারা ঈসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে ইহুদীরাও এমনটি করে। ঈদ-উৎসব হল শরীয়তের একটি বিধান। আল্লাহ তায়ালা শরীয়ত হিসেবে যা দিয়েছেন তা অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় এমন নতুন কিছু আবিস্কার করা যাবে না যা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়।”[28]
মূলত: এ জাতীয় কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শরীয়ত থেকে দূরে রাখার একটি অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং শরীয়ত যে কাজ করতে আদেশ করে নি তা হতে দূরে অবস্থান করে রামাযান মাসে অধিকহারে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায আদায় করা, জিকির-আযকার এবং অন্যান্য এবাদত-বন্দেগী বেশি বেশি করা দরকার। কিন্তু মুসলমানদের অন্যতম সমস্যা হল শরীয়ত অনুমোদিত ইবাদত বাদ দিয়ে নব আবিস্কৃত বিদআতী আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।
৮) ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা:
ইতিকাফ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রামাযানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু এ সম্পের্কে আমাদের দেশে মনে করা হয় যে, সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসতে হবে তা না হলে সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, ইতিকাফ হল একটি সুন্নত ইবাদাত। যে কোন মুসলমানই তা পালন করতে পারে। যে ব্যক্তি তা পালন করবে সে অগণিত সোওয়াবের অধিকারী হবে। সবার পক্ষ থেকে একজনকে ইতিকাফে বসতেই হবে এমন কোন কথা শরীয়তে নেই।
৯) জুমুআতুল বিদা পালনের বিদআত:
আমাদের দেশে দেখা যায়, রামাযানের শেষ শুক্রবারে জুমুআতুল বিদা পালন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে জুমুআর নামাযে প্রচুর ভিড় পরিলক্ষীত হয়। অথচ কুরআন সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন ধারণা পাওয়া যায় না। আমাদের কর্তব্য প্রত্যেক জুমুআকে গুরুত্ব দেয়া। শেষ জুমুআর বিশেষ কোন ফযীলত আছে বলে কোন প্রমাণ নাই।
১০) ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রে সুন্নাতের বরখেলাপ:
খাদ্য দ্রব্য না দিয়ে টাকা দিয়ে অথবা কাপড় কিনে ফিতরা দেয়া সুন্নতের বরখেলাপ। কারণ, হাদীসে ফিতরা হিসেবে খাদ্য দ্রব্য প্রদান করার কথাই বর্ণিত হয়েছে । যেমন ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:
فَرَضَ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ ، عَلَى كُلِّ حُرٍّ أَوْ عَبْدٍ ، ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى ، مِنَالْمُسْلِمِينَ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন, দাস, পুরুষ অথবা নারী সকলের উপর এক সা (প্রায় আড়াই কেজি) পরিমান খেজুর অথবা জব যাকাতুল ফিতর হিসেবে আবশ্যক করেছেন।” (বুখারী ও মুসলিম) এখানে খাদ্য দ্রব্যের কথা সুস্পষ্ট।তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও দিনার-দিরহামের প্রচলন ছিল কিন্তু তিনি অথবা তার কোন সাহাবী দিনার-দিরহাম দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন বলে কোন প্রমাণ নাই। তাই সুন্নত হল, আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য দ্রব্য (যেমন চাউল) দ্বারা ফিতরা আদায় করা।
আরেকটি বিষয় হল: হাদীসে বর্ণিত এক সা’র পরিবর্তে আধা সা ফিতরা দেওয়াও সুন্নতের বরখেলাপ। যেমনটি উপরোক্ত হাদীসে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও আমাদের সমাজে আধা সা ফিতরা দেয়ার মাসআলাই দেয়া হয়।
আল্লাহ তাআলা সকল ক্ষেত্রে তার নবীর সুন্নতকে যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দান করুন এবং সকল বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
তথ্য সূচী:
________________________________________________________________________
[1] বুখারী ও মুসলিম।[2] বুখারী ও মুসলিম।
[3] বুখারী, সাওম অধ্যায় ও মুসলিম, ঈমান অধ্যায়।
[4] সহীহ বুখারী, কিতাবুস সাওম। সহীহ মুসলিম কিতাবুস সিয়াম।|
[5] বুখারী ও মুসলিম।
[6] সহীহ মুসলিম। পবিত্রতা অধ্যায়।
[7] তিরমিযী, রোযা অধ্যায়। মুসতাদরাক হাকেম। আল্লামা আলবানী (রা.) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ তারগীব ওয়াত্ তারহীব। হাদীস নং ৯৯৮।
[8] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: রোযা। সহীহ মুসলিম অধ্যায়: রোযা।
[9] সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাত্হুল বারী। অধ্যায়: দু মাস এক সাথে কম হবে না। ১৭৭৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যা।
[10] বুখারী ও মুসলিম।
[11] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান।
[12] মুসনাদ আহমাদ, ৫/২৩১, সুনান তিরমিযী, ঈমান অধ্যায়। ঈমাম তিরমিযী বলেন: “হাদীসটি হাসান সহীহ”। সুনান ইব্ন মাজাহ্, অধ্যায়: ফিত্না -ফাসাদ।
[13] বুখারী, অধ্যায়: তাহাজ্জুদ। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামায ।|
[14] বুখারী,অধ্যায়: তারাবীহর নামায। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামায।
[15] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: তারাবীহর নাামায। অনুচ্ছেদ: রামাযান মাসে রাতের নামায পড়ার ফযীলত।
[16] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ইতিকাফ, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।
[17] সহীহ বুখরী, অধ্যায়: শবে কদরের ফযীলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।
[18] সহীহ বুখারী
[19] মুসনাদ আহমাদ,৫/ সুনান আবু দাউদ, অধ্যায়: রোযা, তিরমিযী, অধ্যায়: রোযা অনুচ্ছেদ। আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[20] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কাদরের ফযীলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোযা।
[21] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কাদরের ফযীলত।
[22] বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল ক্বাদ্র এর ফযীলত। মুসলিম, অধ্যায়: রোযা।
[23] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: রোযা অধ্যায়। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোযা। তবে সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, সাহাবীগণ সকল ক্ষেত্রে সর্ব শেষ বিধানের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ করতেন।
[24] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: রোযা, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোযা।
[25] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সাওম। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম। তবে সহীহ মুসিলমের ভাষ্য হল: “আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে রামাযান মাসে সফরে যেতাম…”।
[26] মুসনাদ আহমাদ, তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণিত (৩/৪২০), তিরমিযী, অনুচ্ছেদ: চাঁদ দেখার সময় কী বলবে? আল্লামা আলবানী (রাহ:) বেেলন: হাদীসটি সহীহ।
[27] বুখারী, অনুচ্ছেদ: ফজরের আগে আযান দেয়া। মুসলিম: অনুচ্ছেদ: ফজর উদিত হলে রোযা শুর হবে……।
[28] ইকতিযাউয সিরাতিল মুস্তাকীম। (২/৬১৪ ও ৬১৫)
_________________________________________________________________________________
অনুবাদ ও গ্রন্থনা: আব্দুল্লাহিল হাদী
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন