Views:
A+
A-
মৃত্যু ও কবর সম্পর্কে করণীয় ও বর্জনীয়
মৃত্যু ও কবর সম্পর্কে করণীয় ও বর্জনীয়
মৃত্যু ও কবর সম্পর্কে করণীয় ও বর্জনীয়
সূচীপত্র
১ সূচীপত্র
২ ভূমিকা
৩ কোন মুসলিম মৃত্যু বরণ করলে তার জন্য করণীয়
৪ মৃত্যুর সংবাদ শুনে ‘‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পাঠ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা
৫ মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া, কাফন, জানাযা এবং দাফন সম্পন্ন করা
৭ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-সদকা করা
৮ এমন জিনিস দান করা উত্তম যা দীর্ঘ দিন এবং স্থায়ীভাবে মানুষের উপকারে আসে
৯ উপকারী এবং স্থায়ী দান কয়েক প্রকার দান
১০ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ ও উমরা সম্পাদন করা
১১ যে ব্যক্তি বদলী হজ্জ করবে তার জন্য আগে নিজের হজ্জ সম্পাদন করা আবশ্যক
১২ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোযা রাখা
১৩ মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ এবং ওসীয়ত পালন করা
১৪ ওসীয়ত (বা সম্পত্তি উইল) করার বিধান
১৫ স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে মহিলাদের শোকপালন করা
১৬ শোকপালনের পদ্ধতি
১৭ মৃত্যু সম্পর্কিত কতিপয় বিধি-বিধান
১৮ মৃত্যুশোকে ক্রন্দন করা
১৯ মসজিদের মাইকে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা
২০ গোরস্থানে জুতা বা সেন্ডেল পায়ে হাঁটা
২১ শবদেহের পাশে আগরবাতী জ্বালানো বা আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা
২২ জানাজার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়া ও জানাজার সালাতের মধ্যে মৃতের জন্য দুয়া করা
২৩ জানাযার সালাতে মহিলাদের অংশ গ্রহণ
২৪ মহিলাদের জন্য জানাজার সাথে গোরস্থানে যাওয়া বা দাফন ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করা
২৫ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় লাশ নিয়ে দাফন করা
২৬ কবরের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করা
২৭ মসজিদের মধ্যে কবর থাকলে তাতে সালাত আদায় করার বিধান
২৮ নবী সা. এর কবর মসজিদে নববীর মধ্যে থাকার ব্যাপারে একটি সংশয়ের জবাব
২৯ অমুসলিমের কবর যিয়ারত করা
৩০ মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করার বিধান
৩১ কবরস্থানে গজিয়ে উঠা গাছ কাটা
৩২ কবর, মাযার ও মৃত্যু সম্পর্কিত কতিপয় বিদয়াত
৩৩ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা বিদয়াত
৩৪ কুলখানি বা চল্লিশা পালন করা বিদয়াত
৩৫ মৃতের বাড়িতে খাবার প্রসঙ্গে একটি সংশয়ের জবাব
৩৬ নির্দিষ্ট কোন দিনে কবর যিয়ারতের জন্য একত্রিত হওয়া এবং হাফেজদের দিয়ে কুরআন খতম করিয়ে পারিশ্রমিক দেয়া বিদয়াত
৩৭ সবীনা পাঠ করা বিদয়াত
৩৮ রূহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠের বিদয়াত
৩৯ কবরে মান্নত পেশ, পশু যবেহ এবং খতমে কুরআনের বিদয়াত
৪০ কবরে ফাতিহা খানী করা বিদয়াত
৪১ পথের ধারে বা মাযারে কুরআন পাঠ
৪২ মৃতকে গোসল দেয়ার স্থানে আগরবাতী, মোমবাতি ইত্যাদি জ্বালানো
৪৩ দাফনের পর কবরের চার পাশে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা বিদয়াত
৪৪ মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তির পাশে বসে বা মৃত ব্যক্তির রূহের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম করা বিদয়াত
৪৫ কবর পাকা করা, কবরের উপর বিল্ডিং তৈরী করা, কবরে চুনকাম করা
৪৬ মৃতকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আরও কতিপয় কুসংস্কার ও গর্হিত কাজ
৪৭ মৃত ব্যক্তি কি কুরআনখানীর সওয়াব লাভ করে?
৪৮ মানুষ মৃত্যু বরণ করার পর কিসের মাধ্যমে উপকৃত হয়?
৪৯ কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য
৫০ ইসালে সওয়াব বা সওয়াব দান করা কি শরীয়ত সম্মত?
৫১ কতিপয় সংশয় নিরসন
৫২ মৃতের উদ্দেশ্যে ফাতেহাখানী করার ব্যাপারে একটি সংশয়ের জবাব
৫৩ কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াব সম্পর্কে জগদ্বিখ্যাত মুফাসসিরগণে অভিমত
৫৪ মুহাদ্দিসগণের অভিমত
৫৫ চার মাযহাবের সম্মানিত আলেমদের অভিমত
৫৬ ফিকাহ শাস্ত্রের উসূলবীদগণের অভিমত
৫৭ মৃতের উদ্দেশ্য কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াব করা কেন শরীয়ত সম্মত নয়?
৫৮ আল্লামা শায়খ আহমদ ইবনে হাজার (রহ.) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য
৫৯ কবর যিয়ারতের সঠিক নিয়ম
৬০ মৃতদের জন্য হাত তুলে দুয়া কর
৬১ মৃতদের জন্য সম্মিলিতভাবে দুয়া করার বিধান
৬২ কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা
ভূমিকা
الحَمدُ لِلهِ والصَّلاةُ والسَّلاَمُ عَلي رَسُولِ اللهِ وبعد
মৃত্যু নি:সন্দেহে মানব জীবনের অবধারিত বিষয়। এ থেকে পালানের কোন পথ নেই। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন:
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ
আর পরকালীন জীবনের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে জীবদ্দশায় কৃত আমলের উপর। তাই যতদিন এ দেহে প্রাণের স্পন্দন থাকে ততদিন আমল করার সময়। মৃত্যুর পরে সমস্ত আমলের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তবে মানুষ জীবদ্দশায় যদি কিছু সদকায়ে জারিয়া করে যায় তবে কবরে থেকেও তার সওয়াব পেতে থাকে।
যারা জীবিত আছে তাদেরও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে মৃত মানুষের প্রতি। আমাদের সমাজে মৃত ও কবর সংক্রান্ত এমন কিছু কার্যক্রম ও রীতি-নীতি প্রচলিত রয়েছে যেগুলো ইসলামে আদৌ সমর্থন করে না। উক্ত বিষয়গুলো নিয়েই এই পুস্তিকাটির অবতারণা।
সম্মানিত পাঠকের নিকট অনুরোধ, পুস্তিকাটি পড়তে গিয়ে কোথাও যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় তবে অনুগ্রহ পূর্বক আমাদেরকে জানালে পরবর্তী সংস্করণে তা শুধরে নেয়ার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
দুয়া করি, আল্লাহ তায়ালা আমাদের সমাজকে সকল প্রকার শিরক ও বিদয়াতের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করুন এবং প্রতিটি মানুষকে তাওহীদ ও সুন্নাহর আলোয় আলোকিত করুন। তিনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাশীল।
বিনীত নিবেদক,
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
Abuafnan12@gmail.com
প্রকাশ কাল ১২/১/২০১৬
কোন মুসলিম মৃত্যু বরণ করলে তার জন্য করণীয়:
কোন মুসলিম মৃত্যু বরণ করলে তার জন্য জীবিতদের কতিপয় করণীয় রয়েছে। সেগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
১) মৃত্যুর সংবাদ শুনে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন” পাঠ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা।
২) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া, কাফন, জানাযা এবং দাফন সম্পন্ন করা।
৩) মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করা।
৪) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-সদকা করা।
৫) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ বা উমরা আদায় করা।
৬) মানতের রোযা বাকি থাকা অবস্থায় কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার পক্ষ থেকে তা পালন করা। আর রামাযানের রোযা বাকি থাকলে প্রত্যেক রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করা।
৭) সে যদি ঋণ রেখে মারা যায় অথবা কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বা ওসীয়ত করে যায় তবে তা প্রাপকের কাছে বুঝিয়ে দেয়া।
৮) মহিলার জন্য স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে শোক পালন করা।
নিম্নে উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা পেশ করা হল:
১) মৃত্যুর সংবাদ শুনে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পাঠ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা:
মৃত্যু সংবাদ শুনে `ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করা, ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর তকদীরের উপর সন্তুষ্ট থাকা আবশ্যক। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন:
الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّـهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ أُولَـئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ – وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
“যখন তারা বিপদে পতিত হয়,তখন বলে, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” (নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো) তারা সে সমস্ত লোক,যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। “[2]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« مَا مِنْ مُسْلِمٍ تُصِيبُهُ مُصِيبَةٌ فَيَقُولُ مَا أَمَرَهُ اللَّهُ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ اللَّهُمَّ أْجُرْنِى فِى مُصِيبَتِى وَأَخْلِفْ لِى خَيْرًا مِنْهَا. إِلاَّ أَخْلَفَ اللَّهُ لَهُ خَيْرًا مِنْهَا »
“কোন মুসলিমের বিপদ হলে সে যদি বলে: “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন আল্লাহুম্মা আজুরনী ফী মুসীবাতী ওয়া আখলিফলী খাইরান মিনহা” (আমরা আল্লাহরই। আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ, আমার বিপদে তুমি আমাকে প্রতিদান দাও। এই বিপদের বিনিময়ে এর চেয়ে উত্তম প্রতিদান দাও) তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার বিনিময়ে তাকে আরও উত্তম প্রতিদান দিবেন। “[3]
আর কোন ব্যক্তি যদি বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য বিরাট পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ لَا يَرْضَى لِعَبْدِهِ الْمُؤْمِنِ إِذَا ذَهَبَ بِصَفِيِّهِ مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ فَصَبَرَ وَاحْتَسَبَ بِثَوَابٍ دُونَ الْجَنَّةِ
“আল্লাহ তায়ালা যখন কোন মুমিন ব্যক্তির কোন প্রিয় মানুষকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যান তখন সে যদি সবর করে এবং আল্লাহর নিকট প্রতিদান আশা করে তবে তিনি তার জন্য জান্নাতের আদেশ ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হন না। ”[4]
২) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া, কাফন, জানাযা এবং দাফন সম্পন্ন করা:
কোন মুসলিম মৃত্যু বরণ করলে জীবিত মানুষদের উপর আবশ্যক হল, তার গোসল, কাফন, জানাযা এবং দাফন কার্য সম্পন্ন করা। এটি ফরযে কেফায়া। কিছু সংখ্যক মুসলিম এটি সম্পন্ন করলে সকলের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। এ বিষয়টি মুসলিমদের পারস্পারিক অধিকারের মধ্যে একটি এবং তা অনেক সওয়াবের কাজ। যেমন আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« مَنْ شَهِدَ الْجَنَازَةَ حَتَّى يُصَلِّىَ عَلَيْهَا فَلَهُ قِيرَاطٌ ، وَمَنْ شَهِدَ حَتَّى تُدْفَنَ كَانَ لَهُ قِيرَاطَانِ » . قِيلَ وَمَا الْقِيرَاطَانِ قَالَ « مِثْلُ الْجَبَلَيْنِ الْعَظِيمَيْنِ »
“যে ব্যক্তি জানাযার নামাযে উপস্থিত হবে তার জন্য রয়েছে এক কিরাত সমপরিমাণ সওয়াব আর যে দাফনেও উপস্থিত হবে তার জন্য দু কিরাত সমপরিমাণ সওয়াব। জিজ্ঞাসা করা হল, কিরাত কী? তিনি বললেন: দুটি বড় বড় পাহাড় সমপরিমাণ। “[5]
২) মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করা:
জীবিত ব্যক্তিগণ মৃত ব্যক্তির জন্য বেশি বেশি দুয়া করবে। কারণ, মানুষ মারা যাওয়ার পর তার জন্য সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন দুয়া। তাই তার জন্য আমাদেরকে দুয়া করতে হবে আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে ক্ষমা করে দেন তার গুনাহ-খাতা মোচন করে দেন। যেমন আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
“যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে,হে আমাদের প্রতিপালক,আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বে যারা ঈমানের সাথে (দুনিয়া থেকে) চলে গেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মুমিনদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ রাখিও না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তো অতি মেহেরবান এবং দয়ালু।”[6]
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার আমলের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত: যদি সে সাদকায়ে জারিয়া রেখে যায়,এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করে যায় যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে এবং এমন নেককার সন্তান রেখে যায় যে তার জন্য দুয়া করবে।” [7]
তবে এ দুয়া করতে হবে একাকী, নীরবে-নিভৃতে। উচ্চ আওয়াজে বা সম্মিলিতভাবে অথবা হাফেজ-কারী সাহেবদেরকে ডেকে দুয়া করিয়ে নেয়া এবং তাদেরকে পয়সা দেয়া ভিত্তিহীন এবং বিদয়াত যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
৩) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-সদকা করা:
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-সদকা করা হলে কবরে তার সওয়াব পৌঁছে। চাই মৃতের সন্তান, পিতা-মাতা অথবা অন্য কোন মুসলাম দান করুক না কেন। যদিও কতিপয় আলেমের মত হল, দান-সদকা শুধু সন্তানের পক্ষ থেকে হলে পিতা-মাতা কবরে সওয়াবের অধিকারী হবেন।
عَنْ عَائِشَةَ – رضى الله عنها – أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِىِّ – صلى الله عليه وسلم إِنَّ أُمِّى افْتُلِتَتْ نَفْسُهَا ، وَأَظُنُّهَا لَوْ تَكَلَّمَتْ تَصَدَّقَتْ ، فَهَلْ لَهَا أَجْرٌ إِنْ تَصَدَّقْتُ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে জিজ্ঞাসা করল যে,আমার মা হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেছে। আমার ধারণা মৃত্যুর আগে কথা বলতে পারলে তিনি দান করতেন। এখন আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করি তবে কি তিনি সওয়াব পাবেন? তিনি বলেন: হ্যাঁ।[8]
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম কে বললেন:
أِنَّ أَبِى مَاتَ وَتَرَكَ مَالاً وَلَمْ يُوصِ فَهَلْ يُكَفِّرُ عَنْهُ أَنْ أَتَصَدَّقَ عَنْهُ قَالَ « نَعَمْ»
“আমার আব্বা মৃত্যু বরণ করেছেন। কিন্তু কোন ওসীয়ত করে যান নি। আমি তার পক্ষ থেকে দান করলে তার কি গুনাহ মোচন হবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। “[9]
এমন জিনিস দান করা উত্তম যা দীর্ঘ দিন এবং স্থায়ীভাবে মানুষের উপকারে আসে: হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّى تُوُفِّيَتْ أَفَيَنْفَعُهَا إِنْ تَصَدَّقْتُ عَنْهَا فَقَالَ نَعَمْ قَالَ فَإِنَّ لِى مَخْرَفًا وَإِنِّى أُشْهِدُكَ أَنِّى قَدْ تَصَدَّقْتُ بِهِ عَنْهَا
ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত। তিনি বলেন,এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা মারা গেছেন। আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান করি তবে কি তাঁর উপকারে আসবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। তখন লোকটি বলল: আমার একটি ফলের বাগান আছে (খেজুর, আঙ্গুর ইত্যাদি)। আমি আপনাকে স্বাক্ষী রেখে বলছি, ঐ বাগানটি আমি আমার মায়ের পক্ষ থেকে দান করে দিলাম। [10]
উপকারী এবং স্থায়ী দান কয়েক প্রকার:
১) পানির ব্যবস্থা করা
২) এতিমের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করা
৩) অসহায় মানুষের বাসস্থান তৈরি করা
৪) গরীব তালিবে ইলমকে সাহায্য-সহযোগিতা করা
৫) দাতব্য চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল নির্মান
৬) মসজিদ নির্মান ইত্যাদি।
২) এতিমের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করা
৩) অসহায় মানুষের বাসস্থান তৈরি করা
৪) গরীব তালিবে ইলমকে সাহায্য-সহযোগিতা করা
৫) দাতব্য চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল নির্মান
৬) মসজিদ নির্মান ইত্যাদি।
৪) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ ও উমরা সম্পাদন করা:
ক) ফরজ হজ্জ : কোন ব্যক্তি যদি এমন অবস্থায় মারা যায় যার উপর ফরজ হজ্জ বাকি আছে তাহলে তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি থেকে তার পক্ষ থেকে হজ্জ সম্পাদন করা আবশ্যক। তবে যে ব্যক্তি এই বদলী হজ্জ সম্পাদন করবে তার জন্য আগে নিজের হজ্জ সম্পাদন করা অপরিহার্য। চাই সে মৃত্যুর আগে তার পক্ষ থেকে হজ্জ করার জন্য অসীয়ত করুক অথবা না করুক। এর মাধ্যমে সে ব্যক্তি তার ফরজ হজ্জ থেকে অব্যহতি লাভ করবে।
খ) নফল হজ্জ ও উমরা: মানুষ যদি মারা যায় তবে তার পক্ষ থেকে যে কোন মুসলিম নফল হজ্জ ও ওমরা সম্পাদন করতে পারে। অর্থাৎ কেউ তার পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরা করলে ইনশাআল্লাহ সে কবরে শায়িত অবস্থায় তার সওয়াব লাভ করবে।
গ) মানতের হজ্জ: কোন ব্যক্তি যদি হজ্জের মান্নত করে কিন্তু হজ্জ সম্পাদনের আগেই মারা যায় তবে তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি থেকে বদলী হজ্জ সম্পাদন করা আবশ্যক।
যেমন সহীহ বুখারীতে প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত,বনী জুহাইনা সম্প্রদায়ের এক মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বললেন, আমার মা হজ্জের মানত করেছিলেন,কিন্তু হজ্জ করার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ পালন করব? তিনি বললেন,“তোমার মায়ের উপর যদি ঋণ থাকত তবে কি তুমি তা আদায় করতে না? আল্লাহর পাওনা আদায় কর। কারণ,আল্লাহ তো তাঁর পাওনা পাওয়ার বেশী হকদার।” [11]
উক্ত হাদীসে এ কথা স্পষ্ট যে, কোন ব্যক্তি যদি হজ্জ করার মানত করে কিন্তু হজ্জ করার আগেই মারা যায় তবে তার পক্ষ থেকে তার আত্মীয়গণ বদলী হজ্জ সম্পাদন করলে সে ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হবে।
তবে এখান থেকে বুঝা যায় যে, মানতের হজ্জ যেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ ছিল না বরং সে নিজের জন্য ফরজ করে নিয়েছে সেটা পালন করা আবশ্যক। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হজ্জ ফরজ ছিল আরও সঙ্গতভাবে তা পালন করা আবশ্যক হবে।
আর মানতকে ঋণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং ফরজ হজ্জ তো আরও বড় ঋণ যা পালন না করে মারা গেলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না যতক্ষণ না তা আদায় করা হয়।
যে ব্যক্তি বদলী হজ্জ করবে তার জন্য আগে নিজের হজ্জ সম্পাদন করা আবশ্যক:
যে ব্যক্তি বদলী হজ্জ করবে তার জন্য শর্ত হচ্ছে সে আগে নিজের ফরজ হজ্জ আদায় করবে। সে যদি আগে নিজের হজ্জ আদায় করে থাকে তবে পরবর্তীতে সে অন্যের পক্ষ থেকে হজ্জ করতে পারবে। কারণ এ ব্যাপারে হাদীসে বণির্ত হয়েছে:
عن ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- سَمِعَ رَجُلاً يَقُولُ لَبَّيْكَ عَنْ شُبْرُمَةَ. قَالَ « مَنْ شُبْرُمَةَ ». قَالَ أَخٌ لِى أَوْ قَرِيبٌ لِى. قَالَ « حَجَجْتَ عَنْ نَفْسِكَ ». قَالَ لاَ. قَالَ « حُجَّ عَنْ نَفْسِكَ ثُمَّ حُجَّ عَنْ شُبْرُمَةَ »
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বিদায় হজ্জে যাওয়া প্রাক্কালে এহরাম বাঁধার সময়) এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, সে বলছে: لَبَّيْكَ عَنْ شُبْرُمَةَ লাব্বাইকা আন শুবরুমা অর্থাৎ: “শুবরুমার পক্ষ থেকে উপস্থিত। “
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: শুবরুমা কে? উত্তরে লোকটি বলল, সে আমার ভাই অথবা বলল, আমার নিকটাত্মীয়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি নিজের হজ্জ সম্পাদন করেছ? লোকটি বলল, না। তিনি বললেন, নিজের হজ্জ আগে সম্পাদন কর পরে শুবরুমার পক্ষ থেকে করবে। ”[12]
মৃত্যু ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সম্পাদনকারী যদি মৃতের নিকটাত্মীয় হয় তবে তা উত্তম। তবে নিকটাত্মীয় হওয়া আবশ্যক নয়।
৫) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোযা রাখা:
ক) মানতের রোযা:
এ ব্যাপারে প্রায় সকল আলেম একমত যে, মৃত ব্যক্তির উপর যদি মানতের রোযা থাকে তবে তার ওয়ারিসগণ তা পালন করতে পারবে। কারণ এ ব্যাপারে হাদীসগুলো স্পষ্ট। যেমন:
এ ব্যাপারে প্রায় সকল আলেম একমত যে, মৃত ব্যক্তির উপর যদি মানতের রোযা থাকে তবে তার ওয়ারিসগণ তা পালন করতে পারবে। কারণ এ ব্যাপারে হাদীসগুলো স্পষ্ট। যেমন:
عن ابن عباس رضي الله عنه: (أن امرأة ركبت البحر فنذرت إن الله تبارك وتعالى أنجاها أن تصوم شهرا، فأنجاها الله عز وجل، فلم تصم حتى ماتت، فجاءت قرابة لها )إما أختها أو ابنتها (إلى النبي (ص)، فذكرت ذلك له، فقال: أرأيتك لو كان عليها دين كنت تقضينه؟ قالت: نعم قال: فدين الله أحق أن يقضى
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত,এক মহিলা সাগরে সফর কালে আসন্ন বিপদ দেখে মানত করল যে আল্লাহ যদি তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করেন তবে একমাস রোযা রাখবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করলে সে উক্ত রোযা না রেখেই মারা যায়। তখন তার এক নিকটাত্মীয় (বোন অথবা মেয়ে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে ঘটনা বর্ণনা করল। তিনি প্রশ্ন করলে, তার উপর কোন ঋণ থাকলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। তিনি বললেন: আল্লাহর ঋণ তো পরিশোধ করা আরও বেশি হকদার। অন্য বর্ণনায় আছে: তিনি তাকে আরও বললেন: “তুমি তার পক্ষ থেকে রোযা পালন কর। ” [13]
মৃতের পক্ষ থেকে মানতের রোযা পালন করার আরেকটি হাদীস:
أَنَّ سَعْدَ بْنَ عُبَادَةَ – رضى الله عنه – اسْتَفْتَى رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – فَقَالَ إِنَّ أُمِّى مَاتَتْ وَعَلَيْهَا نَذْرٌ . فَقَالَ « اقْضِهِ عَنْهَا »
সাদ ইবনে উবাদা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন: আমার মা মৃত্যু বরণ করেছেন কিন্তু তার উপর মানত ছিল। তিনি তাকে বললেনে: তুমি তার পক্ষ থেকে তা পূর্ণ কর। ”[14]
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে মৃতের পক্ষ থেকে মানতের রোযা রাখা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
খ) মৃতের পক্ষ থেকে রামাযানের ফরয রোযা রাখা:
মৃতের পক্ষ থেকে ফরয রোযা পালন করা যাবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে।
ইমাম শাফঈ, ইবনে হাযম সহ একদল মনিষী বলেন, মৃতের পক্ষ থেকে মানতের এবং রামাযানের ফরয রোযা উভয়টি পালন করা যাবে। কারণ, এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ »
“যে ব্যক্তি এমন মৃত্যু বরণ করল এমন অবস্থায় যার উপর রোযা বাকি আছে তার ওলী তথা নিকটাত্মীয়গণ তার পক্ষ থেকে রোযা রাখবে। “[15]
যেহেতু এ হাদীসে সাধারণভাবে রোযা রাখার কথা বলা হয়েছে তাই মৃতের বাকি থাকা রোযা চাই মানতের হোক বা রামাযানের কাযা হোক তার নিকটাত্মীয়গণ আদায় করতে পারে। |
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল সহ কতিপয় আলেম বলেন, মৃতের পক্ষ থেকে মানতের রোযা ছাড়া আর কোন রোযা রাখা যাবে না। এ পক্ষের আলেমগণ উপরোক্ত হাদীসের ব্যাপারে বলেন, এটাকে মানতের রোযা হিসেবে ধরতে হবে। কারণ, অন্যান্য হাদীসগুলোর মাধ্যমে এটাই বুঝা যায় এবং তারা তাদের মতের সমর্থনে আর আয়েশা এবং ইবনে আব্বাস রা.এর সিদ্ধান্ত এবং মতমতকেও প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন। যেমন:
আয়েশা রা. এর সিদ্ধান্ত: উমরা রা. বর্ণনা করেন, তার মা মারা যান এবং তার উপর রামাযানের রোযা বকি ছিল। আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন: আমি কি আমার মায়ের পক্ষ থেকে উক্ত রোযাগুলো পুরা করব? তিনি বললেন: না। বরং প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে অর্ধ সা (প্রায় সোয়া কেজি চাল, গম ইত্যাদি) খাদ্য দ্রব্য প্রদান কর। [16]
ইবনে আব্বাস রা. এর সিদ্ধান্ত: কোন যদি ব্যক্তি রামাযানে অসুস্থ হওয়ার কারণে রোযা রাখতে না পারে এবং এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে তবে তার পক্ষ থেকে খাবার দিতে হবে এবং তা আর কাযা করার প্রয়োজন নাই। কিন্তু যদি মৃতের উপর মানতের রোযা বাকি থাকে তবে তার নিকটাত্মীয়গণ তার পক্ষ থেকে তা কাযা করবে। [17]
উক্ত মত বিরোধের সমাধানে আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. এর মত:
আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দী আলবানী রাহ. “আহকামুল জানাইয কিতাবে উভয় পক্ষের মতামত ও প্রমাণাদী আলোচনা করার পর বলেন:
“উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. এবং উম্মতের শ্রেষ্ঠ আলেম ইবনে আব্বাস রা. যে সমাধান দিয়েছেন এবং ইমামুস সুন্নাহ ইমাম আহমদ বিন হাম্বল যে মত গ্রহণ করেছেন তার প্রতি মনের পরিতৃপ্তি আসে এবং অন্তর ধাবিত হয়। আর এ মাসআলায় এটাই সবচেয়ে ইনসাফপূর্ণ এবং মধ্যপন্থী মত। এর মাধ্যমে কোন হাদীসকেই বাদ দেয়া হয় না বরং সবগুলোর হাদীসের সঠিক অর্থ বুঝতে পারার সাথে সাথে সবগুলোর প্রতি আমল হয়। ”[18]
মোটকথা:
১) মৃত ব্যক্তির উপর যদি মানতের রোযা বাকি থাকে তবে তার অবিভাবকগণ তা পুরণ করবে।
২) মৃত ব্যক্তির উপর যদি রামাযানের রোযা বাকি থাকে তবে সব চেয়ে মধ্যমপন্থী কথা হল, তার অবিভাবকগণ তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি থেকে প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে আধা সা বা প্রায় সোয়া এক কেজি খাদ্যদ্রব্য প্রদান করবে।
৬) মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ এবং ওসীয়ত পালন করা:
কোন ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যায় অথবা কোন কিছু দান করার ওসিয়ত করে যায় তবে তার উত্তরাধীকারীদের জন্য আবশ্যক হল, তার পরিত্যাক্ত সম্পদ থেকে সবার আগে ঋণ পরিশোধ করা। কারণ, এটা মৃতের সম্পদে ঋণ দাতার হক। যতক্ষণ তা আদায় করা না হবে মৃত ব্যক্তি তা হতে মুক্তি পাবে না। ঋণ পরিশোধের পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে ওসীয়ত পালন করতে হবে।
তাই তো আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে বিধান দিয়েছেন যতক্ষণ না ওসিয়ত বাস্তবায়ন করা হয় অথবা ঋণ পরিশোধ করা হয় ততক্ষণ পরিত্যাক্ত সম্পত্তি উত্তরাধীকারীদের মাঝে বণ্টন করা হবে না। আল্লাহ বলেন:
مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ
“(মৃতের পরিত্যাক্ত সম্পদ বণ্টন করা হবে) ওসিয়তের পর, যা করে সে মৃত্যু বরণ করেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। ”[19]
অনুরূপভাবে সহীহ বুখারীতে সালামা বিন আকওয়া রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তির জানাযা পড়তে রাজি হন নি যতক্ষণ না তার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
ওসিয়ত (বা সম্পদ উইল) করার বিধান:
মানুষ তার সম্পত্তি থেকে সর্বোচ্চ তিন ভাগের এক ভাগ ওসীয়ত তথা আল্লাহর পথে বা জন কল্যাণকর কাজে ব্যায় করার আদেশ করতে পারে। এর চেয়ে বেশি জয়েয নাই। বরং এর চেয়ে কম করাই উত্তম। কারণ,
মানুষ তার সম্পত্তি থেকে সর্বোচ্চ তিন ভাগের এক ভাগ ওসীয়ত তথা আল্লাহর পথে বা জন কল্যাণকর কাজে ব্যায় করার আদেশ করতে পারে। এর চেয়ে বেশি জয়েয নাই। বরং এর চেয়ে কম করাই উত্তম। কারণ,
সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বিদায় হজ্জের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লামের সাথে ছিলাম। পথিমধ্যে আমি প্রচণ্ড রোগে আক্রান্ত হলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার সেবা-শুশ্রূষা করতে এলে আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমার অনেক সম্পত্তি। কিন্তু আমার ওয়ারিস হওয়ার মত কেউ নাই একজন মাত্র মেয়ে ছাড়া। আমি আমার সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ ওসিয়ত করব? তিনি বললেন: না। আমি বললাম: অর্ধেক? তিনি বললেন: না। আমি বললাম, তবে তিন ভাগের একভাগ? তিনি বললেন: “তিন ভাগের একভাগ। তিন ভাগের একভাগই তো বেশি। সাদ, তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে দরিদ্র অবস্থায় রেখে যাবে আর তারা মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে বেড়াবে এর চেয়ে তাদেরকে সম্পদশালী করে রেখে যাওয়াই উত্তম। “[20]
তবে এক তৃতীয়াংশের চেয়ে কম করা উত্তম। কেননা, ইবনে আব্বাস রা. বলেন:
لَوْ غَضَّ النَّاسُ إِلَى الرُّبْعِ ، لأَنَّ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – قَالَ « الثُّلُثُ ، وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ أَوْ كَبِيرٌ »
“মানুষ যদি (সম্পত্তি ওসিয়ত করার ক্ষেত্রে) এক তৃতীয়াংশ থেকে এক চর্তুথাংশে নেমে আসত তবে উত্তম হত। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তিন ভাগের একভাগ। তিন ভাগের একভাগই তো বেশি। [21]
কোন ব্যক্তি যদি এক তৃতীয়াংশের বেশি ওসীয়ত করে মৃত্যু বরণ করে তবে তার ওয়ারিসগণের জন্য এক তৃতীয়াংশের বেশি দান করা আবশ্যক নয়।
৭) স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে মহিলাদের শোক পালন করা:
কোন মহিলার স্বামী মারা গেলে তার জন্য শোকপালন করা আবশ্যক। এর ইদ্দত (মেয়াদ) হল, চার মাস দশ দিন যদি সে গর্ভবতী না হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرً
“আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে,তখন স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেদেরকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। “[22]
আর গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَأُولَاتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَنْ يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ
“গর্ভবর্তী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। ” [23]
অনুরূপভাবে পিতা, মাতা, ভাই, বোন, সন্তান ইত্যাদি নিকটাত্মীয় মারা গেলে তার জন্য সবোর্চ্চ তিন দিন শোক পালন জায়েজ আছে কিন্তু ওয়াজিব বা আবশ্যক নয়।
আবু সালামার মেয়ে যয়নব বলেন, শাম থেকে আবু সুফিয়ান রা. এর মৃত্যু সংবাদ আসার পর তৃতীয় দিন (তাঁর মেয়ে উম্মুল মুমিনীন) উম্মে হাবীবা রা. কিছু হলুদ বা যাফরান (অন্য বর্ণনায় সুগন্ধি) আনতে বললেন। অত:পর তা আনা হলে তিনি তা তার চেহারার দুপাশে ও দুগালে এবং দুবাহুতে মাখলেন। অত:পর বলেন: এটা করার আমার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু আমি এমনটি এজন্যই করলাম যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« لاَ يَحِلُّ لاِمْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أَنْ تُحِدَّ عَلَى مَيِّتٍ فَوْقَ ثَلاَثٍ ، إِلاَّ عَلَى زَوْجٍ ، فَإِنَّهَا تُحِدُّ عَلَيْهِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا »
“যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে তার জন্য স্বামী ছাড়া কারও মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালন করা বৈধ নয়। স্বামীর মৃত্যুতে সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। “[24]
তবে স্বামীকে খুশি রাখতে যদি অন্য কোন মানুষের মৃত্যুতে স্ত্রী শোক পালন না করে তবে সেটাই উত্তম। কারণ, স্বামীর সুখ কামনাতেই নারীর জন্য অজস্র কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
শোকপালনের পদ্ধতি:
মৃতের প্রতি শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে মহিলার জন্য করণীয় হল, সে সকল প্রকার সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা থেকে দূরে থাকবে।
– আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করবে না। তবে তৈল, সাবান, রোগ-ব্যাধীর জন্য ঔষধ ইত্যাদি ব্যবহারে অসুবিধা নাই যদিও তাতে সুগন্ধি থাকে। কারণ এগুলো মূলত: সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। অনুরূপভাবে চুল আঁচড়াতেও কোন অসুবিধা নাই।
– সৌন্দর্য বর্ধক পোশাক পরবে না। বরং স্বামী মারা যাওয়ার আগে স্বাভাবিকভাবে যে পোশাক পরিধান করত তাই পরিধান করবে। তবে শুধু সাদা বা শুধু কালো পোষাক পরিধান করতে হবে এমন ধারণা ঠিক নয়।
– সুরমা, কাজল ইত্যাদি ব্যবহার করবে না।
– মেহেদী, খেযাব বা আলাদা রং ব্যবহার করবে না।
– কোন ধরণের অলংকার যেমন, দুল, চুরি, নাকফুল, আংটি, নুপুর ইত্যাদি ব্যবহার করবে না।
– শোক পালনের দিন শেষ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থাকবে। এমনকি সে সময় যদি সে তার পিতার বাড়িতেও থাকে তবে স্বামীর মৃত্যুর খবর পেলে নিজ বাড়িতে ফিরে আসবে। তবে একান্ত প্রয়োজন যেমন, বিপদের আশংকা, বাড়ি পরিবর্তন, চিকিৎসা বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা ইত্যাদি জরুরী কাজে বাড়ির বাইরে যেতে পারবে।
মোটকথা, স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী এমন সব আচরণ করবে না বা এমন সৌন্দর্য অলম্বন করবে না যা তাকে বিয়ের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে। এটা এ কারণে যে, এর মাধ্যমে স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়,স্বামীর পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয় এবং তাদের বেদনা বিধুর অনুভূতির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ হয়। সর্বপরি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশের আনুগত্য করা হয়।
মৃত্যু সম্পর্কিত কতিপয় বিধি-বিধান
এখানে যে সকল বিধি-বিধান আলোচিত হয়েছে সেগুলো হল:
১) মৃত্যুশোকে ক্রন্দন করা
২) মসজিদের মাইকে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা
৩) গোরস্থানে জুতা বা সেন্ডেল পায়ে হাঁটা
৩) লাশের পাশে আগরবাতী জ্বালানো বা আতর–সুগন্ধি ব্যবহার করা
৪) জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়া ও মৃতের জন্য দোয়া করা
৫) জানাযার সালাতে মহিলাদের অংশ গ্রহণ
৬) মহিলাদের জন্য জানাজার সাথে গোরস্থানে যাওয়া বা দাফন ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করা
৭) এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় লাশ নিয়ে দাফন করা
৮) কবরের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করা
৯) মসজিদের মধ্যে কবর থাকলে তাতে সালাত আদায় করার বিধান
১০) অমুসলিমের কবর যিয়ারত করা
১১) মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করার বিধান
১২) কবরস্থানে গজিয়ে উঠা গাছ কাটা
মৃত্যু সম্পর্কিত কতিপয় বিধান:
১) মৃত্যুশোকে ক্রন্দন করা
মানুষ মারা গেলে নীরবে চোখের পানি ফেলা অথবা নিচু আওয়াজে ক্রন্দন করা বৈধ। রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছেলে ইবরাহীম যখন মারা যায় তিনি তাকে কোলে নিয়ে ছিলেন। আর তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন:
»تَدْمَعُ الْعَيْنُ وَيَحْزَنُ الْقَلْبُ وَلاَ نَقُولُ إِلاَّ مَا يَرْضَى رَبُّنَا وَاللَّهِ يَا إِبْرَاهِيمُ إِنَّا بِكَ لَمَحْزُونُونَ«.
“চক্ষু অশ্রু সজল হয়,অন্তর ব্যথিত হয়। তবে আমরা কেবল সে কথাই বলব যা আমাদের প্রভুকে সন্তুষ্ট করে। আল্লাহর কসম,হে ইবরাহীম,তোমার বিচ্ছেদে আমরা ব্যথিত। “[25]
তবে চিৎকার করে কান্নাকাটি করা,মাটিতে গড়াগড়ি করা,শরীরে আঘাত করা,চুল ছেড়া,কাপড় ছেড়া ইত্যাদি হারাম। কেননা,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
“সে ব্যক্তি আমাদের লোক নয় যে গালে চপেটাঘাত করে, জামার পকেট ছিঁড়ে এবং জাহেলিয়াতের মত ডাকে। “[26]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
النِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ
“বিলাপ করা (কারও মৃত্যুতে চিৎকার করে কান্নাকাটি করা, মৃত ব্যক্তির বিভিন্ন গুণের কথা উল্লেখ করে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি করা, শরীরে আঘাত করা, জামা-কাপড় ছেঁড়া ইত্যাদি) জাহেলী যুগের কাজ। ” [27]
২) মসজিদের মাইকে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা
মানুষ মৃত্যু বরণ করলে স্থানীয় লোকজনকে খবর দেয়ার উদ্দেশ্যে মাইকে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা জায়েজ আছে।
৩) গোরস্থানে জুতা বা সেন্ডেল পায়ে হাঁটা:
কবরস্থানে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া জুতা-সেন্ডেল পায়ে হাঁটা উচিৎ নয়। বাশীর ইবনে খাসাসিয়া রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
بينما أماشي رسول الله صلى الله عليه وسلم . . . أتى على قبور المسلمين . . . فبينما هو يمشي إ ذ حانت منه نظرة ،فإذا هو برجل يمشي بين القبور عليه نعلان، فقال : يا صاحب السبتيتين ألق سبتيتيك ، فنظر ، فلما عرف الرجل رسول الله صلى الله عليه وسلم خلع نعليه ، ورمى بهما
“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হাঁটছিলাম…। তিনি মুসলিমদের কবরস্থানে আসলেন…। চলতে চলতে হঠাৎ দেখতে পেলেন এক ব্যক্তি জুতা পায়ে কবরগুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটছে। তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, ““হে জুতাধারী, তুমি জুতা খুলে ফেল।” ” সেই ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনতে পেরে জুতা খুলে ফেলে দিল। [28]
ইমাম আহমদ হাদীসটির প্রতি আমল করতেন। আবু দাউদ তাঁর মাসায়েল গ্রন্থে বলেন, ইমাম আহমদ যখন কোন জানাযায় যেতেন তখন কবরের কাছাকাছি গেলে তার জুতা খুলে ফেলতেন। [29]
৩) শবদেহের পাশে আগরবাতী জ্বালানো বা আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা
দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য বা পরিবেশকে ভাল রাখার উদ্দেশ্যে মৃতের পাশে আগরবাতি জ্বালানো বা যে কোন সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করা দেয়া জায়েজ।
৪) জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়া ও মৃতের জন্য দোয়া করা
জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারটি যদিও মতবিরোধ পূর্ণ। তবে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত হল, জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। কারণ:
১) প্রখ্যাত সাহাবী উবাদা বিন সামেত রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ »
“যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না তার নামায হবে না।”[30]
আর জানাযার সালাত একটি সালাত। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ
“আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও (জানাযার) সালাত পড়বেন না।”[31]
আল্লাহ তায়ালা এখানে জানাযার সালাতকেও সালাত বলে উল্লেখ করেছেন।
২) ইমাম বুখারী রহ. জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার বৈধতার ব্যাপারে একটি অনুচ্ছেদ আলাদাভাবে উল্লেখ করে তার নিচে একাধিক হাদীস উল্লেখ করেছেন। যেমন,
عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَوْفٍ قَالَ صَلَّيْتُ خَلْفَ ابْنِ عَبَّاسٍ – رضى الله عنهما – عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ قَالَ لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ
“তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ বিন আউফ বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রা. এর পেছনে জানাযার সালাত পড়লাম। তিনি ফাতিহাতুল কিতাব তথা সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন। অত:পর বললেন, “এটাই আল্লাহর নবীর আদর্শ।” ”[32]
আর জানাযার সালাতে ৩য় তাকবীরের পর মৃত ও জীবিত ব্যক্তিদের জন্য হাদীসে বর্ণিত নিম্নোক্ত দুয়াটি পাঠ করতে হয়। দুয়াটি হল,
اللَّهُمَّ اغفِرْلحَيِّنا ومَيّتِنا، وشاهِدِنا وغائِبِنا، وصَغيرِنا وكبيرِنا، وذَكرِنا وأُنْثانا، اللَّهُمَّ من أحيَيتَهُ منَّا فأحيهِ علَى الإسلامِ، ومن تَوَفَّيتَهُ منَّا فَتَوَفَّهُ علَى الإيمانِ، اللَّهُمَّ لا تَحرِمنا أجرَهُ ولا تُضِلَّنا بعدَهُ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাফির লি হায়্যিনা ও মায়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গাইবিনা ওয়া সাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনসানা ও আল্লাহুম্মা মান আহইয়াতাহু মিন্না ফা আহ্ইহী আলাল ইমান ওয়া মান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আ’লাল ইসলাম। আল্লাহুম্মা লা তাহরিমনা আজরাহু ওয়ালা তুযিল্লানা বাদাহু।
অর্থ: হে আল্লাহ তুমি আমাদের জীবিত- মৃত, উপস্থিত-অনুপস্থিত, ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা সকলকে ক্ষমা করে দাও।
হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যাদেরকে জীবিত রেখেছ তাদেরকে ঈমানের উপর অটুট রাখ। আর যাকে মৃত্যু দিয়েছ তাকে ঈমানের উপর মৃত্যু দাও।
হে আল্লাহ, আমাদেরকে এই মৃত্যুর প্রতিদান থেকে বঞ্চিত কর না। আর তার চলে যাওয়ার পর আমাদেরকে বিপথগামী কর না। “[33]
৫) জানাযার সালাতে মহিলাদের অংশ গ্রহণ
জানাযার সালাত ফরযে কেফায়া। কিছু সংখ্যক মানুষ এটি আদায় করলে অন্যরা গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। পক্ষান্তরে জানা সত্বেও যদি কেউই জানাযার সালাত না পড়ে তবে সকল মুসলিম গুনাহগার হবে। এতে পুরুষের সাথে নারীরাও অংশ গ্রহণ করতে পারবে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
أَنَّ عَائِشَةَ رضي الله عنها : “أَمَرَتْ أَنْ يَمُرَّ بِجَنَازَةِ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ فِي الْمَسْجِدِ ، فَتُصَلِّيَ عَلَيْهِ فَأَنْكَرَ النَّاسُ ذَلِكَ عَلَيْهَا ، فَقَالَتْ : مَا أَسْرَعَ مَا نَسِيَ النَّاسُ ! مَا صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى سُهَيْلِ بْنِ الْبَيْضَاءِ إِلَّا فِي الْمَسْجِدِ
আয়েশা রা. সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস রা. এর মরদেহ মসজিদে নব্বীতে আনার আদেশ দিলেন যেন তিনিও তার জানাযার সালাতে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু লোকজন মসজিদের ভেতর মরদেহ আনতে অস্বীকৃতি জানালে আয়েশা রা. বললেন, “মানুষ কত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো সুহাইল ইবনে বায়যা এর জানাযার মসজিদের ভেতরেই পড়েছিলেন।”[34]
সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্যান্য স্ত্রীগণও এ জানাযার সালাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
তবে কথা হল, মহিলাদের জন্য জানাযায় শরিক হওয়া যদিও জায়েজ তবুও ঘর ছেড়ে বাইরে পুরুষদের সাথে জানাযার সালাতে না যাওয়াই তার জন্য উত্তম। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত মসজিদের চেয়ে নিজ ঘরে পড়াকেই অধিক উত্তম বলেছেন সেহেতু জানাযার সালাত (যা ফরজে আইন নয় বরং ফরজে কেফায়া) পড়ার জন্য ঘর থেকে বের না হওয়াই তার জন্য অধিক উত্তম ও পর্দাশীলতার জন্য উপযোগী। তবে যথার্থ পর্দার সাথে মহিলাদের জন্য জানাযার সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করা হলে তাতে তাদের অংশ গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই। আল্লাহই সব চেয়ে ভালো জানেন।
৬) মহিলাদের জন্য জানাজার সাথে গোরস্থানে যাওয়া বা দাফন ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করা
মহিলাদের জন্য জানাযার সাথে গোরস্থান পর্যন্ত যাওয়া বা মৃতের দাফন ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করা হারাম। প্রখ্যাত মহিলা সাহাবী উম্মে আত্বিয়া রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
نُهينا عنِ اتِّباعِ الجنائزِ ولَمْ يُعزَمْ علينا» رواه البخاري ومسلم
“আমাদেরকে জানাযার সাথে (গোরস্থানে) যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে দৃঢ়তার সাথে নিষেধ করা হয় নি।” ”[35]
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, উক্ত নিষেধাজ্ঞা শক্ত নয়। কিন্তু সাধারণভাবে নিষেধাজ্ঞার অর্থ হল, হারাম। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ مَا نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ، وَمَا أَمَرْتُكُمْ بِهِ فَخُذُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ “
“তোমাদেরকে যখন কোন বিষয়ে নিষেধ করা হয় তখন তোমরা তা বর্জন কর। আর যখন কোন কাজের আদেশ করা হয় তখন যথাসম্ভব বাস্তবায়ন কর। ” ”[36]
৭) এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় লাশ নিয়ে দাফন করা
ইসলামী শরীয়তে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি লাশ দাফন করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই শরীয়ত সম্মত প্রয়োজন ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে লাশ স্থানান্তর করা ঠিক নয়।
জাবের রা. বর্ণনা করেন,উহুদ যুদ্ধের দিন আমার ফুফু আমার পিতাকে দাফন করার জন্য নিজেদের কবরস্থানে নিয়ে আসেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করলেন,তোমরা শহীদদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরত নিয়ে আস। [37]
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে,আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রা. হুবশী নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন,তাঁকে ঐ স্থান হতে মক্কায় এনে দাফন করা হয়। আয়েশা রা. হজ্জ বা উমরা করতে মক্কায় গমন করলে তিনি তাঁর কবরের নিকট আসেন অত:পর বলেন,আমি তোমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত থাকলে তোমাকে সে স্থানেই দাফন করতাম যেখানে তোমার মৃত্যু হয়েছে। [38]
উপরোক্ত দলীল সমূহের আলোকে আলেমগণ বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যে এলাকায় মারা যাবে তাকে সে এলাকার কবরস্থানে বা নিকটবর্তী কোনো কবরস্থানে দাফন করা উত্তম। ওজর ব্যতিত দূরবর্তী এলাকায় নিয়ে দাফন করা অনুত্তম।
তবে ওজর বশত: তা জায়েজ আছে। যেমন,
যদি এমন হয় যে, যে দেশে মৃত্যু বরণ করেছে সেখানকার অধিবাসীরা মুসলিম নয়।
অথবা সে স্থানে মুসলিমদের জন্য আলাদা গোরস্থান নাই অথবা নিকটের কোথাও কবরস্থান বা দাফনের সুব্যবস্থা নেই।
অথবা বন্যা-জলচ্ছাস ইত্যাদি কারণে কবর নদী বা সাগর গর্ভে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ইত্যাদি।
তবে শর্ত হল, লাশ স্থানান্তর করতে যেন এত বিলম্ব না হয় যে, তা পঁচে-ফেটে বিকৃত হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয় এবং মৃতের সম্মান ক্ষুন্ন না হয়।
৮) কবরের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করা
কবরের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করা নেহায়েত গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ। এ কাজের দ্বারা কবরবাসীকে অপমান করা হয়। তাই যারা এ কাজ করবে তাদেরকে বারণ করা এবং শরীয়তের বিধান সম্পর্কে অবহিত করা জরুরী। তারা কবরের উপর যেসব সালাত আদায় করেছে,তা সব বাতিল ও বৃথা। কবরের উপর বসাও অত্যন্ত গর্হিত কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছেন,
« لا تُصَلُّوا إِلَى الْقُبُورِ وَلا تَجْلِسُوا عَلَيْهَا »
“তোমরা কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়বে না এবং কবরের উপর বসবে না। ” [39]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লম আরও বলেছেন,
لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ -رواه البخاري
“আল্লাহ ইহুদী ও নাসারাদের উপর লানত করেছেন,কারণ তারা তাদের নবীদের কবর সমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে।”[40]
এ হাদীস সম্পর্কে আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাণী দ্বারা তাদেরকে তাদের গর্হিত কাজের জন্য সতর্ক করেছেন।
৯) মসজিদের মধ্যে কবর থাকলে তাতে সালাত আদায় করার বিধান:
যদি কোন মসজিদের মধ্যে কবর পাওয়া যায়। তবে দেখতে হবে কোনটি প্রথম নির্মিত হয়েছে। যদি মসজিদই সর্ব প্রথম নির্মিত হয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে মসজিদের মধ্যে মৃতকে দাফন করা হয় তবে ঐ কবর খুঁড়ে সেখান থেকে লাশ বা লাশের অবশিষ্ট হাড়-হাড্ডিগুলো বের করে মুসলমানদের কবরস্থানে পুনরায় দাফন করা অপরিহার্য। যারা এভাবে দাফন করেছিল এটি তাদের দায়িত্ব। তারা না করলে মুসলিম সরকারের জন্য তা করা অপরিহার্য। যত দিন কবর খুঁড়ে লাশ বা হাড়-হাড্ডি বাইরে বের করা না হবে ততদিন মসজিদ কর্তৃপক্ষ গুনাহগার হতে থাকবে। তবে এই মসজিদে মুসল্লীদের সালাত আদায় করা বৈধ হবে এই শর্তে যে, তারা সালাতের সময় যেন কবরকে সরাসরি সামনে না রাখে। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরে দিকে মুখ করে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন।
পক্ষান্তরে যদি কবরই পূর্বে থেকে থাকে; পরবর্তীতে তার উপর মসজিদ নির্মিত হয় তবে মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা আবশ্যক হবে মসজিদ নির্মানকারীর উপর অন্যথায় মুসলিম সরকার সেটা বাস্তবায়ন করবে। এ ধরণের কবরওয়ালা মসজিদ পরিত্যাগ করা আবশ্যক এবং তাতে সালাত আদায় করা জায়েয নয়। কেননা, হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
لَمَّا نَزَلَ بِرَسُولِ اللَّهِ طَفِقَ يَطْرَحُ خَمِيصَةً لَهُ عَلَى وَجْهِهِ، فَإِذَا اغْتَمَّ بِهَا كَشَفَهَا عَنْ وَجْهِهِ، فَقَالَ: ” وَهُوَ كَذَلِكَ، لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا
আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন (মৃত্যু শয্যায়) অসুস্থ ছিলেন, তখন তিনি একটি চাদর স্বীয় চেহারা মুবারকে রাখতেন,অসুবিধা বোধ করলে তা সরিয়ে নিতেন। এমতাবস্থায় তিনি বললেন, “ইহুদী ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত। কেননা তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করেছে।” তিনি স্বীয় উম্মতকে সেই ইহুদী-নাসারাদের কর্ম হতে সতর্ক করার জন্যই তা বলেছেন।[41]
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ঐ সমস্ত লোকদের কৃতকর্ম হতে তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন। কারণ তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, অচিরেই তিনি মৃত্যু বরণ করবেন এবং দূর ভবিষ্যতে হলেও এ ধরণের কাজ সংঘটিত হবে।
তাঁকে ঘরে দাফন করার পিছনে একটি কারণ হল, তিনি নিজেই হাদীছ শুনিয়েছিলেন যে,
إِنَّ النَّبِيَّ لا يُحَوَّلُ مِنْ مَكَانِهِ ، يُدْفَنُ حَيْثُ يَمُوتُ
“নবীকে তাঁর মৃত্যুর স্থান থেকে স্থানান্তর করা যাবে না। বরং যেখানে তিনি মৃত্যু বরণ করবেন সেখানেই তাঁকে দাফন করা হবে।” অত:পর
فَنَحَّوْا فِرَاشَهُ ، وَحَفَرُوا لَهُ فِي مَوْضِعِ فِرَاشِهِ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকালের পর সাহাবীগণ তার বিছানা সরিয়ে সেখানেই কবর খনন করলেন।”[42]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর মসজিদে নব্বীর মধ্যে থাকার ব্যাপারে একটি সংশয়ের জবাব:
আমরা দেখি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর বর্তমানে তো মসজিদে নব্বীর মধ্যে। এর জবাব কি?
এর জবাব কয়েক ভাবে দেওয়া যায় :
১. মসজিদটি মূলত: কবরের উপর নির্মাণ করা হয়নি বরং এ মসজিদ নির্মিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবদ্দশায়।
২. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মসজিদেই দাফন করা হয় নি। কাজেই একথা বলার অবকাশ নেই যে, ইহাও সৎ ব্যক্তিদেরকে মসজিদে দাফন করায় কুপ্রথার অন্তর্ভুক্ত। বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর ঘরে দাফন করা হয়েছে।
৩. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঘরগুলোকে- যার অন্যতম হল আয়েশার ঘরটি (যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শায়িত রয়েছেন) মসজিদে প্রবেশ করানো সাহাবীদের যৌথ সিদ্ধান্তে হয়নি বরং তাদের অধিকাংশের মৃত্যুর পর হয়েছে। তখন তাঁদের অল্প কয়েকজন মাত্র বেঁচে ছিলেন। উহা ঘটেছিল ৯৪ হিজরী সনে মসজিদ সম্প্রসারণ কালে। বস্তুত: এই কাজটি সাহাবীদের অনুমতি বা তাদের যৌথ সিদ্ধান্তে হয়নি। তাদের কেউ কেউ উহাতে দ্বিমতও পোষণ করেছিলেন এবং বাধা দিয়েছিলেন। তাবেঈনদের মধ্যে সাঈদ বিন মুসাইয়েব তাদের অন্যতম।
৪. কবরটি মূলত: মসজিদে নেই। কারণ উহা মসজিদ হতে সম্পূর্ণ পৃথক রুমে রয়েছে। আর মসজিদকে ওর উপর বানানো হয় নি। এজন্যই এই স্থানটিকে তিনটি প্রাচীর দ্বারা সংরক্ষিত ও বেষ্টিত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচীরকে এমন একটি দিকে রাখা হয়েছে যা কিবলা হতে বিপরীত পার্শে রয়েছে এবং উহার এক সাইড উল্টা দিকে রয়েছে,যাতে করে কোন সানুষ নামায পড়া কালীন উহাকে সম্মুখীন না করতে পারে কারণ উহা কিবলা হতে এক পার্শে রয়েছে।
আশাকরি উক্ত আলোচনা দ্বারা ঐ সমস্যা দূরীভূত হয়েছে যা দ্বারা কবর পন্থীগণ দলীল গ্রহণ করে এই মর্মে যে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবরে মসজিদ বানানো রয়েছে।[43]
১০) অমুসলিমের কবর যিয়ারত করা
শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে হলে অমুসলিমের কবর যিয়ারত করা জায়েয। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন
زَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ ، ثُمَّ قَالَ: “اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِي ، وَاسْتَأْذَنْتُهُ أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথে যে সাহাবীগণ ছিলেন তারাও কাঁদলেন। অতঃপর তিনি বললেন,
““আমি আমার মায়ের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর দরবারে আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে সে অনুমতি প্রদান করা হয়নি। তবে আমি মায়ের কবর যিয়ারতের জন্যে আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। অতএব,তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা কবর যিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। ”” [44]
উক্ত হাদীসে প্রমাণিত হয়, শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুশরিকদের কবর যিয়ারত করা জায়েজ।
১১) মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করার বিধান
মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করা জায়েয কি না এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে দ্বিমত পরিলক্ষীত হয়। তবে অগ্রাধিকারযোগ্য মত হল, মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করা জায়েজ নয়। কারণ, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে,
أنَّ النبيَّ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ لعن زائراتِ القبورِ
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের প্রতি লা’নত করেছেন। ”[45]
এই বিষয়ে ইবনে আববাস ও হাসসান ইবনে ছাবিত রা. থেকে হাদীস বর্ণিত আছে।
কতক আলিম মনে করেন,হাদীসটি হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদানেরও পূর্বের। সুতরাং কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদানের পর এখন পুরুষ-মহিলা সকলেই এই অনুমতির অন্তর্ভুক্ত।
কোন কোন আলিম বলেন,মহিলাদের মাঝে ধৈর্য কম এবং কান্নাকাটির আধিক্য হেতু তাদের জন্য কবর যিয়ারত অপছন্দনীয় বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
অবশ্য কোন মহিলা যদি যিয়ারতের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে গোরস্থানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তবে সেখানে থেমে কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে সালাম দিলে তাতে কোন সমস্যা নাই।
১২) কবরস্থানে গজিয়ে উঠা গাছ কাটা
প্রশ্ন: কবরস্থানে গজিয়ে উঠা গাছ কাটা কি জায়েজ আছে না কি না কাটাই উত্তম?
উত্তর: কবরস্থানে গজিয়ে উঠা গাছ কাটায় কোন অসুবিধা নাই। তবে কবরের সম্মান বজায় রাখতে হবে। কবরকে পদদলিত করে বা সেখানে গর্ত খনন করে তার সম্মানহানী করা যাবে না।
তবে যদি এ আশংকা সৃষ্টি হয় যে, উক্ত গাছ থেকে মানুষ বরকত গ্রহণ করবে বা তাকে সম্মান করবে তবে তা কেটে ফেলা জরুরী। অনুরূপভাবে যদি করবের সালাম দেয়া ও দুয়া করতে আসা যিয়ারতকারীদের জন্য সেটি কষ্টদায়ক হওয়ার আশংকা থাকে তবুও তা কেটে ফেলতে হবে। কেননা, তাতে পোকা-মাকড় বা সাপ-বিচ্ছু বসবাস করতে পারে। তাই সেটা রাখার চেয়ে কেটে ফেলাই উত্তম।[46]
কবর, মাযার ও মৃত্যু সম্পর্কিত কতিপয় বিদয়াত
এখানে যে সব বিদয়াত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে:
১) মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা
২) কুলখানি বা চল্লিশা পালন করা
৩) নির্দিষ্ট কোন দিনে কবর যিয়ারতের জন্য একত্রিত হওয়া এবং হাফেযদের দিয়ে কুরআন খতম করিয়ে পারিশ্রমিক দেয়া
৪) সবীনা পাঠ করা
৫) রূহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠের বিদ’আতঃ
৬) কবরে মান্নত পেশ,পশু যবেহ এবং খতমে কুরআন
৭) কবরে ফাতিহা খানী করা
৮) পথের ধারে বা মাযারে কুরআন পাঠ
৯) মৃতকে গোসল দেয়ার স্থানে আগরবাতী, মোমবাতি ইত্যাদি জ্বালানো
১০) দাফনের পর কবরের চার পাশে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা
১১) মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তির পাশে বসে বা মৃত ব্যক্তির রূহের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম করা
১২) কবর পাকা করা, কবরের উপর বিল্ডিং তৈরী করা ও কবরে চুনকাম করা । এছাড়াও প্রচলিত আরও কিছু কুসংস্কার ও গর্হিত কাজ আলোচিত হয়েছে।
কবর,মাযার ও মৃত্যু সম্পর্কিত কতিপয় বিদয়াত:
ঘন কালো মেঘের আড়ালে অনেক সময় সূর্য্যের কিরণ ঢাকা পড়ে যায়। মনে হয় হয়ত আর সূর্য্যের মুখ দেখা যাবে না। কিন্তু সময়ের ব্যাবধানে নিকশ কালো মেঘের বুক চিরে আলো ঝলমল সূর্য্য বের হয়ে আসে। ঠিক তেমনি বর্তমানে আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যাবে বিদয়াতের কালিমা ইসলামের স্বচ্ছ আকাশকে ঘিরে ফেলেছে। যার কারণে কোন কাজটা সুন্নাত আর কোন কাজটা বিদয়াত তা পার্থক্য করাটাই অনেক মানুষের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। তাই যত বেশী কুরআন-সুন্নাহর প্রচার প্রসার হবে তত দ্রুত এই বিদয়াতের অন্ধকার বিদূরিত হবে। আমরা চাই, কুরআন-সুন্নাহর বর্ণিল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠুক সমাজের প্রতিটি গৃহকোন। বিদূরিত হোক শিরক, বিদয়াত আর মূর্খতার ঘোর আমানিশা।
যা হোক শত রকমের বিদয়াতের মধ্য থেকে এখানে শুধু কবর,মাযার ও মৃত্যু সম্পর্কিত কয়েকটি প্রসিদ্ধ বিদয়াত তুলে ধরা হল। যদিও এ সম্পর্ক আরও অনেক বিদয়াত আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। যদি এতে আমাদের সমাজের বিবেকবান মানুষের চেতনার দুয়ারে সামান্য আঘাত হানে তবেই এ প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
১) মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা বিদয়াত:
বর্তমান সমাজে পিতা-মাতা,দাদা-দাদী সন্তান-সন্ততি ইত্যাদির মৃত্যুবার্ষিকী অত্যন্ত জমজমাট ভাবে পালন করা হয়ে থাকে। সেখানে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে বিশাল খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়। যদিও গরীব শ্রেণীর চেয়ে অর্থশালীদের মধ্যে এটা পালন করার ব্যাপারটি বেশি চোখে পড়ে, কিন্তু আমরা ক’জনে জানি বা জানার চেষ্টা করি যে, মৃত্যু বার্ষিকী কিংবা কারও মৃত্যু উপলক্ষ্যে শোক দিবস পালন করা জঘন্যতম বিদয়াত? ইসলামের দৃষ্টিতে এ উপলক্ষ্যে শামিয়ানা টাঙ্গানো,ঘর-বাড়ী সাজানো, আলোকসজ্জা করা এবং কুরআন তেলাওয়াত বা বিভিন্ন তাসবীহ-ওযীফা ইত্যাদি পাঠ করে সেগুলোর সওয়াব মৃতব্যক্তির রূহের উদ্দেশ্যে বখশানো বিদয়াত। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন,“মৃত ব্যক্তিকে ছায়া দিতে পারে কেবল তার আমল;তাঁবু টানিয়ে ছায়া দেয়া সম্ভব নয়।”
মৃত্যু বার্ষিকী বা জন্ম বার্ষিকী পালন করা মুসলিমদের রীতি নয়। বরং এ সব রীতি ইহুদী-খৃষ্টান থেকে আমাদের মাঝে আমদানি করা হয়েছে। তাই এসব কার্যক্রম বিদয়াত হওয়ার পাশাপাশি বিধর্মীদের অনুসরণও বটে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি (ধর্ম বা রীতি-নীতির ক্ষেত্রে) অন্য সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদেরই মধ্যেই গণ্য হবে। “[47]
অনুরূপভাবে জানাযা দিয়ে ফিরে আসার পর জানাযায় অংশগ্রহণকারীদেরকে,যে সমস্ত মানুষ শোক জানাতে আসে তাদেরকে অথবা ফকীর-মিসকীনদের খানা খাওয়ানো, বৃহস্পতিবার,মৃত্যু বরণ করার চল্লিশ দিন পর অথবা মৃত্যু বার্ষিকীতে খাওয়ার অনুষ্ঠান করা,মীলাদ মাহফিল করা, ‘চার ‘কুল’ এর ওযীফা পড়া ইত্যাদি সবই হারাম এবং বিদ’আতী কাজ। কারণ,নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত এবং সাহাবীগণের কার্যক্রমে এ সব কাজের কোন প্রমাণ নেই। এ সব জীবিকা উপার্জন,অর্থ অপচয় এবং ধ্বংসের মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়।
২) কুলখানি বা চল্লিশা পালন করা বিদয়াত:
মৃতকে দাফন দেয়ার পর দাফন দিতে আসা লোকদের নাম লিখে রেখে তিন,সাত বা চল্লিশ দিনের দিন তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে কুলখানি করা,চল্লিশা করা, বিনা খতম করা, মিলাদ মাহফিল করা এবং এ উপলক্ষে লোকজন জমায়েত করে খাবার-দাবার করা, সিন্নী বিতরণ করা বেদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়।
অনুরূপভাবে মানুষ মারা যাওয়ার চল্লিশদিন পর্যন্ত প্রত্যেক বৃহস্পতিবার শোক পালন করা,মৃত্যুর পর প্রথম ঈদকে বিশেষভাবে শোকদিবস হিসেবে পালন করা,সে দিন হাফেজ বা কারী সাহেবদের ডেকে কুরআন পড়ানো এবং শোক পালনের জন্য লোকজন একত্রিত করাও বিদয়াত এবং হারাম। কারণ,এ সকল কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের আমল ছিল না। এ জাতীয় কাজ পরবর্তী যুগের মানুষদের সৃষ্টি। সুতরাং এ সকল কাজ থেকে বিরত থাকা মুসলিমদের জন্য অপরিহার্য।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এবং ইমাম ইবনে মাজাহ রহ. সহীহ সনদে আব্দুল্লাহ আল বাজালী রা. থেকে বর্ণনা করেন,তিনি বলেন “আমরা মৃত্যুবরণকারী সাহাবীগণের কাফন-দাফন সম্পন্ন করে মৃতের বাড়ীতে একত্রিত হওয়া এবং তাদের পক্ষ থেকে খাবারের আয়জন করাকে ‘`নাওহা’ এর মতই মনে করতাম।” ইমাম আহমদ বলেন,“এটি একটি জাহেলী কাজ।” নাওহা অর্থ কারও মৃত্যেুতে চিৎকার করে কান্নাকাটি করা,শরীরে আঘাত করা, চুল ছেড়া,জামা-কাপড় ছেড়া …ইত্যাদি। এসব কাজ করা ইসলামে হারাম।
উক্ত বিদয়াতের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয় তা যদি শরীয়ত সম্মত পন্থায় গরীব অসহায়-মানুষের সাহায্যে দান করা হত বা কোন জনকল্যাণ মূলক কাজে ব্যয় করা হত তাহলে একদিকে অসহায় মানুষের উপকার হত অন্য দিকে মৃত ব্যক্তিও কবরে সওয়াব লাভ করত।
মৃতের বাড়িতে খাবার প্রসঙ্গে একটি সংশয়ের জবাব:
কিছু মানুষ ‘‘মিশকাতুল মাসবীহ’ এর মুজিযা শীর্ষক অধ্যায় থেকে একটি হাদীসের মাধ্যমে দাফনের পর মৃতের বাড়িতে খাবার অনুষ্ঠান করার বৈধতার প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকেন। হাদীসটি হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক সাহাবীর দাফন শেষ করে ফিরে আসছিলেন। তখন উক্ত ‘‘মৃতের স্ত্রী’ তাঁকে খাবার দাওয়াত দিলেন। তিনি দাওয়াত গ্রহণ করলে এবং তার বাড়িতে গেলেন। অত:পর খাদ্য উপস্থিত করা হলে তিনি এবং অন্য লোকজন খাবার গ্রহণ করলেন। [48]”
জবাব: উক্ত হাদীসে দাওয়াত প্রদানকারী ‘‘মৃতের স্ত্রী’ ছিল একথাটি ঠিক নয়। বরং সে ছিল এক সাধারণ কুরাইশ মহিলা। এখানে হাদীসের মূল ভাষ্যে (ه) সর্বনামটি অতিরিক্ত থাকায় এ সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
মূল হাদীসে এসেছে- دَاعِي امْرَأَةٍ “ জনৈক মহিলার পক্ষ থেকে এক আহবানকারী”। কিন্তু এর পরিবর্তে মিশকাত গ্রন্থকার ভুলবশতঃ دَاعِي امْرَأَته ““মৃতের স্ত্রীর পক্ষ থেকে এক আহবানকারী”” লিখেছেন। কারণ, আবু দাঊদ ও বায়হাকী সহ যত হাদীসের কিতাবে এ বর্ণনাটি এসেছে সব জায়গায় دَاعِي امْرَأَةٍ “জনৈক মহিলার পক্ষ থেকে এক আহবানকারী” কথাটি উল্লেখ রয়েছে। دَاعِي امْرَأَته “মৃতের স্ত্রীর পক্ষ থেকে এক আহবানকারী” কোথাও পাওয়া যায় না। সুতরাং এতে প্রমাণিত হয় যে, এটি একটি ভুল যা মিশকাতুল মাসাবীহ গ্রন্থের লেখকের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।
তাছাড়া কোন সাহাবীর নিকট এ আশা করা যায় না যে,তিনি বিদয়াত করবেন। কেননা,মৃতের গৃহে সম্মিলিত হয়ে ভোজ অনুষ্ঠান করা একটি বিদ’আতী কাজ এবং জাহেলী প্রথা। সুনান ইবনে মাজার সহীহ হদীছে এ জাতীয় কাজকে ’নাওহা’ বলা হয়েছে যা হারাম এবং অভিশাপযোগ্য কাজ।
সুতরাং উপরোক্ত হাদীছ মৃতের বাড়িতে খাবার-দাবারের আয়োজন করার বৈধতার পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা মোটেও ঠিক নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য আব্দুর রহমান মোবারকপুরী রহ. লিখিত ’কিতাবুল জানায়িয’ গ্রন্থের ৮৭ হতে ৯১ পৃষ্ঠা অধ্যায়ন করা যেতে পারে।
৩) নির্দিষ্ট কোন দিনে কবর যিয়ারতের জন্য একত্রিত হওয়া এবং হাফেযদের দিয়ে কুরআন খতম করিয়ে পারিশ্রমিক দেয়া বিদয়াত:
ঈদ বা জুমার দিন পুরুষ-মহিলা একসাথে বা আলাদা আলাদাভাবে কবরের পাশে একত্রিত হওয়া,খানা বিতরণ অথবা কিছু তথাকথিত মৌলোভী বা কুরআনের হাফেজদেরকে একত্রিত করে কুরআন পড়িয়ে তাদেরকে পারিশ্রমিক দেয়া ইত্যাদি কাজ সুস্পষ্ট বিদয়াত এবং নাজায়েয।
কবর যিয়ারতের জন্য জুমা বা ঈদের দিনের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট প্রামাণিত নয়। অনুরূপভাবে কাবরের পাশে কুরআন পড়া বা পড়ানো একাটি ভিত্তিহীন কাজ। একে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা আরও বেশি অন্যায়।
৪) সবীনা পাঠ করা বিদয়াত:
মৃতের রূহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম বা সবীনা খতম করা আমাদের সমাজে বহুল প্রচিতল একটি বিদয়াত। রমাযান বা অন্য মাসে সারারাত ধরে কুরআন খতম করানো এবং এজন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শিক্ষা এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি বিরুদ্ধ কাজ। নির্ভরযোগ্য কোন কিতাবে এর দলীল নেই। শরীয়তের দাবী হল,আমরা নিজেরা কুরআন পাঠ করব,নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করব এবং কুরআনের মর্ম-উদ্দেশ্য বুঝার জন্য গবেষণা করব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নিয়ম ছিল,তিনি রমাযানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগীর জন্য কোমর বেঁধে নিতেন,আর বাড়ীর সবাইকে জাগিয়ে রাত জাগরণ করাতেন।[49] কিন্তু কুরআনের সবীনা পড়া করা অথবা হাফেজ সাহেবদের ডেকে অর্থের বিনিময়ে কুরআন পড়ানোর কোন প্রমাণ নেই। তাই মৃতের রূহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম করা বা সবীনা খতম করা বিদয়াত। এই বিদয়াত বর্জন করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
৫) রূহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠের বিদ’আতঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের রূহের প্রতি ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ফরয নামাযের পর এই বিশ্বাস সহকারে সূরা ফাতিহা পড়া বিদয়াত যে,এ সকল পবিত্র রূহের উদ্দেশ্যে সূরা ফাতিহা পড়লে তাঁরা মৃত্যুর পর গোসল দেয়ার সময় এবং কবরে সওয়াল-জওয়াবের সময় উপস্থিত থাকবেন। আফ্সোস! এটা কত বড় মূর্খতা এবং গোমরাহী! এসব কথার না আছে ভিত্তি; না আছে দলীল। এদের বিবেক দেখে বড় করুণা হয়।
অনুরূপভাবে,কোথাও কোথাও নামাযের শেষে দু’আ শেষ করে করে মৃতের ফাতিহা পাঠের রেওয়াজ দেখা যায়। কোন জায়গায় জুমআর নামায শেষ করে ইমাম হুসাইন রা. এর উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠের নিয়ম চালু রয়েছে। এসবই বিদয়াত।
অনুরূপভাবে কোন কবর বা মাযারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং হাত উঠিয়ে কবর বা মাযারে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ফাতিহা পাঠ করা,আবার মাযারের কথিত ওলী বা পীরের নিকটে ফরিয়াদ করা বা তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা,মৃত মানুষের দাফন শেষে গোরস্থান থেকে ফিরে আসার সময় চল্লিশ কদম দূরে দাঁড়িয়ে ফাতিহা পাঠ করা এবং সাধারণ মৃত মুসলিমদের রূহের উদ্দেশ্যে সওয়াব রেসানীর উদ্দেশ্যে ফাতিহা পড়া শুধু মূর্খতাই নয় বরং বিদয়াত।
৬) কবরে মান্নত পেশ, পশু যবেহ এবং খতমে কুরআনের বিদয়াত:
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কবরে খতমে কুরআন আয়োজন করা, পশু যবেহ করে কুরআনখানী বা মৃতবার্ষিকীতে অংশ গ্রহণকারীদেরকে খানা খাওয়ানো এবং কবরে টাকা-পয়সা মান্নত হিসেবে পেশ করা জঘন্যতম বিদয়াত। এসব কাজের সাথে যদি বিশ্বাস করা হয় যে,কবরবাসীরা এগুলোতে খুশি হয়ে আমাদের উপকার করবে,আমাদেরকে ক্ষয়-ক্ষতি এবং বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবে এবং যদি বিশ্বাস করা হয় যে, তারা এ হাদিয়া-তোহফা দিলে কবুল করেন তবে তা শুধু বিদয়াতই নয় বরং শির্ক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএ ধরণের ক্রিয়াকলাপকে লানত করেছেনঃ
لَعَن اللَّهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللَّهِ
“যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করে তার প্রতি আল্লাহর অভিশম্পাত।”[50]
মান্নত একটি ইবাদত। আর গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত করা শির্ক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“এক ব্যক্তি একটি ছোট মাছির জন্য জান্নাতে গেছে এবং অন্য একজন জাহান্নামে গেছে। সাহাবীগণ কারণ,জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,পূর্ববর্তী উম্মতের দু জন লোক সফরকালে এমন এক জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল যেখানে ছিল একটি মূর্তি। মূর্তির সেবকগণ এ দু জন লোককে মূর্তির উদ্দেশ্যে কোন কিছু উৎসর্গ করতে আদেশ করল। এমনকি হুমকি দিয়ে বলল, অবশ্যই কিছু না কিছু উৎসর্গ করতে হবে। কমপক্ষে একটি মাছি হলেও মূর্তির উদ্দেশ্যে দিতে হবে। অন্যথায় তোমাদেরকে হত্যা করা হবে। কোন উপায় না পেয়ে হয়ে দু জনের মধ্যে একজন একটি মাছি ধরে মূর্তির মণ্ডপে নিক্ষেপ করল। যার ফলে সে জাহান্নামে স্থান করে নিল। আরেকজন কোন কিছু দিতে অস্বীকার করল। ফলে তাকে হত্যা করা হল এবং সে জান্নাতবাসী হয়ে গেল। ”[51]
৭) কবরে ফাতিহা খানী করা বিদয়াত:
নির্দিষ্ট সংখ্যায় সূরা ফাতেহা পড়ে তার সওয়াব কবরে মৃতদের উদ্দেশ্যে বখশানো একটি ভিত্তিহীন কাজ। ইসলামী শরীয়তে যার কোন প্রমাণ নেই।
আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. কবরের নিকট সুরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারার শেষাংশ তেলাওয়াতের উপর গুরুত্ব দিতেন বলে যে একটি বর্ণনা প্রসিদ্ধ তা ‘‘শায’ এবং সনদ বিহীন। তাছাড়া সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে থেকে কেউ তার সমর্থন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অনুরূপভাবে সূরা নাস,ফালাক,তাকাসূর,কাফেরূন ইত্যাদি পড়ে সেগুলোর সওয়াব মৃতদের উদ্দেশ্যে বখশানো একটি বাতিল প্রথা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বক্তব্য এবং সাহাবায়ে কেরামের কার্যক্রমে তার কোন সর্মথন পাওয়া যায় না। অথচ এ সব ভিত্তিহীন বিদআতী কার্যক্রম আমাদের সমাজে নির্দিধায় করে যাচ্ছি। কোন দিন এগুলোর দলীল তলিয়ে দেখার গরজ আমাদের হয় নি!
৮) পথের ধারে বা মাযারে কুরআন পাঠঃ
মাজার,পথের ধারে বা লোক সমাগম হয় এমন কোন স্থানে কুরআন তেলাওয়াত করে ভিক্ষা করা বিদয়াত এবং হারাম। কেননা,মহাগ্রন্থ কুরআনকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ। এর মাধ্যমে আল্লাহর কালামকে অপমান করা হয়। ইসলাম সাধারণভাবে ভিক্ষাবৃত্তিকেই তো নিন্দা করেছে আবার কুরআনকে মাধ্যম ধরে ভিক্ষা করা!এটা শুধু হারামই নয় বরং কঠিন গুনাহের কাজ।
৯) মৃতকে গোসল দেয়ার স্থানে আগরবাতী, মোমবাতি ইত্যাদি জ্বালানো:
মৃতকে যেখানে গোসল করানো হয় সেখানে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বরই গাছের শুকনো ডাল ও বাতি জ্বালিয়ে রাখা এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে আগরবাতি জ্বালানো ইত্যাদি মারাত্মক কুসংস্কার। ইসলাম এ জাতীয় কাজ সমর্থন করেই। এগুলো হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর বিধর্মীদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা রীতি-নীতি অনুসরণ করা মুসলিমদের জন্য হারাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি (ধর্মীয় ক্ষেত্রে) অন্য সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। “[52]
১০) দাফনের পর কবরের চার পাশে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা বিদয়াত:
জানাজা নামায শেষ করার পর অথবা দাফন সম্পন্ন করার কবরের চার পাশে দাঁড়িয়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত নয়। এর কোন প্রমাণ নাই। বরং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে নিজে মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করবে। এ ক্ষেত্রে একাকি হাত তুলে দুয়া করা জায়েজ আছে। কারণ, হাত তুলে দুয়া করা দুয়া কবুলের অন্যতম কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ التَّثْبِيتَ فَإِنَّهُ الآنَ يُسْأَلُ
“তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা চাও। দুয়া কর যেন দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিতে পারে। কারণ, তাকে এখন প্রশ্ন করা হবে। “[53]
এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু ক্ষমা চাওয়ার জন্য দুয়া করতে বলেছেন। তিনি নিজে এবং সাহাবায়ে কেরাম দুয়া করতেন। কিন্তু এমন একটি হাদীসও পাওয়া যায় না যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাফন করার পর সবাইকে নিয়ে হাত তুলে সম্মিলিতভাবে দুয়া করতে বলেছেন বা তিনি নিজে কিংবা সাহাবায়ে কেরাম কখনো করেছেন। সুতরাং এটা করা কি আমাদের জন্য উচিৎ হবে? অবশ্যই না।
তাই প্রত্যেক ব্যক্তি আলাদা আলাদা ভাবে চুপি স্বরে মৃত ব্যক্তির ক্ষমার জন্য এবং কবরে ফিরশতাদের প্রশ্নোত্তরের সময় দৃঢ় থাকার জন্য আল্লাহর নিকট দুয়া করবে। আওয়াজ উঁচু করবে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের পাশে আওয়াজ উঁচু করতে নিষেধ করেছেন।
১১) মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তির পাশে বসে বা মৃত ব্যক্তির রূহের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম করা বিদয়াত:
কুরআন নাজিল হয়েছে জীবিত মানুষের জন্য; মৃতের জন্য নয়। মানুষ যদি জীবিত অবস্থায় কুরআন পাঠ করে এবং কুরআন অনুযায়ী আমল করে তবে সে সওয়াবের অধিকারী হয়। পক্ষান্তরে মারা যাওয়ার পর অন্য ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য কুরআন পড়লেও এতে তার ফায়দা নেই। মৃত ব্যক্তির পাশে বসে কুরআন পাঠ করাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পয়সার বিনিময়ে হাফেজ বা কারী ভাড়া করে কুরআন পড়িয়ে তার সওয়াব মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বখশানোর কোন প্রমাণ নাই। এটাই সব চেয়ে বিশুদ্ধ কথা। সুতরাং এ কাজগুলো বিদয়াত।
বরং আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত হল: মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তিকে লাইলাহা এর তালকীন দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ
“তোমরা মৃত্যুর পথযাত্রীকে ’লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর তালকীন দাও। “[54]
তালকীন দেওয়ার অর্থ হল, তার পাশে বসে তাকে ’লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করতে বলা। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« مَنْ كَانَ آخِرُ كَلاَمِهِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ »
“যার শেষ কথা হবে ’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। “[55]
১২) কবর পাকা করা, কবরের উপর বিল্ডিং তৈরী করা ও কবরে চুনকাম করা:
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কবর পাকা করা,চুনকাম করা,কবর উঁচু করার প্রবনতা দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ,ভারত ও পাকিস্তানে এ ধরণের কর্মকাণ্ড খুবই বেশী। দেখা যায় করবস্থানে,রাস্তার আশে-পাশে,চৌরাস্তায় ও বটগাছ তলায় কবর পাকা করে,চুনকাম করে,তাতে উন্নত নেমপ্লেট ব্যবহার করে মৃত ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু তারিখ ও বিভিন্ন বাণী লিখে রাখা হয়। এ কাজগুলো সম্পূর্ণ বিদয়াত। বিশিষ্ট সাহাবী জাবের রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন,
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরে চুনকাম করা, তার উপর বসা এবং তার উপর বিল্ডিং নির্মান করতে নিষেধ করেছেন।” ”[56]
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হল যে,কবরে প্লাস্টার করা, চুনকাম করা,পাকা করা,কবরের উপর বিল্ডিং ও গম্বুজ নির্মাণ করা হারাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ওয়া সাল্লাম এর যুগে বদর,উহুদ, খন্দক,তাবুক যুদ্ধ ছাড়াও যে সকল সাহাবী শহীদ হয়েছেন অথবা মৃত্যু বরণ করেছেন তাঁদের কারও কবর উঁচু করা হয় নি। তাঁদের কারও কবর পাকা ও চুনকামও করা হয়নি এবং তাতে নামও লিখা হয়নি। তাঁদের কারও কবর মোজাইক অথবা পাথর দ্বারা বাঁধানো হয়নি বরং এ সকল কাজ যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন, তাঁর পরে স্বর্ণ যুগের খোলাফায়ে রাশেদীন কঠোর হস্তে দমন করেছেন। এর একটি উজ্জল উদাহরণ হল,প্রখ্যাত তাবেয়ী আবুল হাইয়াজ আল আসাদী বলেন,আমাকে আলী রা. বললেন,
أَلاَّ أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ لاَ تَدَعَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلاَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْته وفي رواية وَلَا صُورَةً إِلَّا طَمَسْتَهَا
“তোমাকে কি আমি এমন একটি কাজ দিয়ে পাঠাবো না যে কাজ দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম? তা হল কোন প্রতিকৃতি পেলে তা মুছে দিবে আর কোন উচুঁ কবর পরিলক্ষিত হলে তা সাধারণ কবরের সমান করে দিবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, কোন ছবি পেলে তা নিশ্চিহ্ন করে দিবে।”[57]
মৃতকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আরও কিছু কুসংস্কার ও গর্হিত কাজ:
১) জানাযার খাট বহন করার সময় তার পেছনে পেছনে উচ্চস্বরে তাকবীর দেয়া ও যিকির করা।
২) কবরে গোলাপ জল ছিটানো।
৩) আয়াতুল কুরসী বা কুরআনের আয়াত লেখা চাদর দ্বারা মৃত দেহ আবৃত করা।
৪) মরদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় দু বার খাট রাখা।
৫) চার কুল পড়ে কবরের চার কোনায় খেজুরের ডাল পোঁতা।
৬) কবর যিয়ারত করতে গিয়ে সাতবার সুরা ফাতিহা, তিনবার সুরা ইখলাছ,সাতবার দরূদ ইত্যাদি পাঠ করা।
৭) নির্দিষ্ট করে ২৭ রামাযান,দু ঈদের দিন কিংবা জুম’আর দিন কবর যিয়ারত করতে যাওয়া।
৮) তথাকথিত শবেবরাত,শবে মেরাজ ইত্যাদি রাতে কবর যিয়ারত করা।
৯) লাশ দেখার জন্য মহিলাদের ভিড় করা।
১০) মৃত ব্যক্তির নামে ভারতের আজমীরে কিংবা বিভিন্ন খানকা,দরবার ও মাযারের উদ্দেশ্যে টাকা-পয়সা,গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পাঠানো। [58]
১১)অনুরূপ লাশ জানাযা-দাফনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর সামাজিক,রাজনৈতিক বা দলীয় প্রথা পালনের উদ্দেশ্যে লাশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করা যেমন,লাশকে স্থানে স্থানে নিয়ে প্রদর্শন করা,শ্রদ্ধা নিবেদন করা,লাশের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা,ভিডিও করা,লাশকে সামনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে জীবনালোচনা করা,বিভিন্নমুখী ভাষণ-বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি সবই গর্হিত কাজ। এগুলোর মধ্যে জীবিত-মৃত কারোরই কোনো কল্যাণ নেই। এসব অনর্থক কর্মকাণ্ড পরিহার করা সকলের জন্য জরুরি।
এভাবে অসংখ্য শিরক, বিদয়াত ও কুসংস্কার আমাদের সমাজে এমনভাবে জেঁকে বসে আছে যেগুলোর প্রতিবাদ করতে গেলেও হয়ত প্রতিবাদকারীকে উল্টো বিদয়াতী উপাধী নিয়ে ফিরে আসতে হবে।
তবে বর্তমানে জ্ঞান চর্চার অবাধ সুযোগে আমাদের নতুন প্রজন্ম,যুব সমাজ,তরুণ আলেম সমাজ সবাই যদি উন্মুক্ত হৃদয়ে দ্বীনে ইসলামের বুক থেকে বিদয়াতের পাথরকে সরানোর জন্য তৎপর হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে ইসলাম তার আগের মহিমায় ভাস্বর হবে। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য্যে ভরে উঠবে আমাদের সপ্নিল বসুন্ধরা। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।
♦ ♦ ♦
কুরআনখানী
প্রশ্নঃ মৃত ব্যক্তি কি কুরআনখানীর সওয়াব লাভ করে?
উত্তরঃ এক দ্বীনি ভাই প্রশ্ন করেছেন,মৃত ব্যক্তি কুরআনখানীর সওয়াব লাভ করে কি না। তাই এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে শরীয়তের সিদ্ধান্ত পেশ করতে চাই। তবে তার আগে কবর যিয়ারত ও ইসালে সওয়াব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করছি।
কবর যিয়ারতের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত:
কবর যিয়ারতের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেক যে সকল নির্দেশনা পাওয়া যায় তার মোটামাটি সারাংশ নিম্নরূপঃ
১) মৃতদের জন্য দুয়া করা।
২) মৃতদের প্রতি সালাম প্রদান করা।
৩) কবর দেখে শিক্ষা গ্রহণ করা।
কুরআন পড়া, ফাতিহাখানী করা বা এ জাতীয় কোন কিছু করার কথা কুরআন-হাদীসে নেই। কবর যিয়ারতের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একাধিক দুয়া বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি দুয়া হলঃ
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنْ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُونَ أَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةَ
“কবর গৃহের হে মুমিন-মুসলিম অধিবাসীগণ,আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ চাইলে আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হব। আমি আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করছি। ”[59]
সুনানে আবূ দাঊদে বর্ণিত হয়েছে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাফন ক্রিয়া শেষ করে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতেন,
اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ التَّثْبِيتَ فَإِنَّهُ الآنَ يُسْأَلُ
“তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা চাও। দুয়া কর যেন সে স্থির থাকতে পারে। কারণ,তাকে এখনই প্রশ্ন করা হবে।”[60]
সুনান ইবনে মাজাতে বর্ণিত হয়েছে,লাশ কবরে রাখা হলে তিনি এ দুয়া পাঠ করতেনঃ
بِسْمِ اللهِ وَعلى مِلَّةِ رَسُولِ اللهِ
“বিসমিল্লাহি আলা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ” “আল্লাহর নামে আল্লাহর রাসূলের আদর্শের উপরে এই মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখলাম। ”[61]
এ সম্পর্কে হাদীসের কোথাও উল্লেখ নেই যে,তিনি কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে কোন সূরা পাঠ করেছেন। অথচ কবরের পাশে কুরআনের বিভিন্ন সূরা পাঠ করা বর্তমানে আমাদের সমাজের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে!
সহীহ হাদীসে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে,
زَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ ، ثُمَّ قَالَ : “ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِي ، وَاسْتَأْذَنْتُهُ أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথে যে সাহাবীগণ ছিলেন তারাও কাঁদলেন। অতঃপর তিনি বললেন,
“আমি আমার মায়ের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে সে অনুমতি প্রদান করা হয়নি। তবে আমি মায়ের কবর যিয়ারতের জন্যে আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। অতএব,তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা কবর যিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। ”[62]
এ হাদীস থেকে জানা যায়,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিয়ম ছিল,মৃতদের জন্য শুধু ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। মৃতদের উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করা আদৌ তাঁর রীতি ছিল না। এটাই হাদীস ও কুরআনে বর্ণিত সঠিক পদ্ধতি এবং বিবেক সম্মত পন্থা। কারণ কুরআনে প্রকৃতপক্ষে আলোচনা করা হয়েছে,জীবন পরিচালনার বিভিন্ন রীতি-নীতি,বিধি-বিধান,হালাল-হারাম ইত্যাদি বিষয়। মানুষ মারা গেলে এসব দিয়ে তার কোন উপকার হয় না এবং কুরআন-হাদীস দ্বারাও এটা প্রমাণিত নয়।
মানুষ মৃত্যু বরণ করার পর কিসের মাধ্যমে উপকৃত হয়?
মৃত ব্যক্তি কেবল ঐ সকল জিনিস দ্বারাই উপকার লাভ করতে পারে যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত। যেমন:
১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার আমলের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীতঃ সদকায়ে জারিয়া,এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন নেককার সন্তান যে তার জন্য দু’আ করে”। [63]
২) নিম্নোক্ত হাদীস অনুযায়ীও মৃত ব্যক্তি উপকৃত হয়ে থাকে। আনাস রা. হতে বর্ণিত,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ
سبعٌ يَجري للعبدِ أجرُهُنَّ ، و هوَ في قَبرِه بعدَ موتِه : مَن علَّمَ علمًا ، أو أجرَى نهرًا ، أو حفَر بِئرًا ، أوغرَسَ نخلًا ، أو بنَى مسجِدًا ، أو ورَّثَ مُصحفًا ، أو ترَكَ ولدًا يستغفِرُ لهُ بعد موتِه
“সাত প্রকার কাজের সওয়াব মারা যাওয়ার পরও বান্দার কবরে পৌঁছতে থাকে। যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেয়, নদী-নালায় পানি প্রবাহের ব্যাবস্থা করে,কুপ খনন করে, খেজুর গাছ রোপন করে,মসজিদ তৈরী করে,কুরআনের উত্তরাধিকারী রেখে যায় অথবা এমন সুসন্তান রেখে যায় যে তার মারা যাওয়ার পরও তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমার জন্য দুয়া করে। ”[64]
৩) মৃত ব্যক্তি যদি তার জীবদ্দশায় কোন পরিত্যক্ত সুন্নতকে আমলের মাধ্যমে পূণর্জীবিত করে এবং তার মৃত্যুর পরেও উক্ত আমল চালু থাকে তবে এর সওয়াব সে কবরে থাকা অবস্থায়ও লাভ করতে থাকবে। যেমন,বিশুদ্ধ সূত্রে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
من سنَّ في الإسلامِ سُنَّةً حسنةً ، فعُمِلَ بها بَعٌدَه ، كُتِبَ لَه مثلُ أجرِ مَنٌ عَمِلَ بها . ولا يُنٌقَصُ مِن أجورِهم شَيٌءٌ
“যে ব্যক্তি ইসলামে কোন সুন্নত চালু করল সে ব্যক্তি এই সুন্নাত চালু করার বিনিময়ে সওয়াব পাবে এবং তার মারা যাওয়ার পর যত মানুষ উক্ত সুন্নাতের উপর আমল করবে তাদেরও সওয়াব সে পেতে থাকবে। অথচ যারা আমল করবে তাদের সওয়াব কিছুই হ্রাস করা হবে না। ”[65]
৪) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোন দান-সদকা করা হলে মৃত ব্যক্তি তার সওয়াব লাভ করে। যেমন,সহীহ বুখারীতে উদ্ধৃত হয়েছে:
عن ابْنُ عَبَّاسٍ – رضى الله عنهما – أَنَّ سَعْدَ بْنَ عُبَادَةَ – رضى الله عنه – تُوُفِّيَتْ أُمُّهُ وَهْوَ غَائِبٌ عَنْهَا ، فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّى تُوُفِّيَتْ وَأَنَا غَائِبٌ عَنْهَا ، أَيَنْفَعُهَا شَىْءٌ إِنْ تَصَدَّقْتُ بِهِ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ . قَالَ فَإِنِّى أُشْهِدُكَ أَنَّ حَائِطِى الْمِخْرَافَ صَدَقَةٌ عَلَيْهَا
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত,সা’দ ইব্ন উবাদাহ রা. এর মা মারা গেল। এ সময় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন,হে আল্লাহর রাসূল,আমার মা মারা গেছে। সে সময় আমি অনুপস্থিত ছিলাম। আমি তার পক্ষ থেকে সদাকা করলে তার কি কোন উপকার হবে? তিনি বললেন,“হ্যাঁ”। তিনি বললেন,তাহলে আমি আপনাকে স্বাক্ষী রেখে বলছি,আমি আমার মিখরাফ নামক প্রাচীর বেষ্টিত খেজুর বাগানটি আমার মায়ের উদ্দেশ্যে সদকা করলাম। ” [66]
৫) সা’দ বিন উবাদাহ রা. থেকে বর্ণিত,তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাস করলেন:
يا رسولَ اللَّهِ، إنَّ أمَّ سعدٍ ماتت، فأيُّ الصَّدقةِ أفضلُ؟ ! قالَ: الماءُ، قالَ : فحفَرَ بئرًا ، وقالَ : هذِهِ لأمِّ سعدٍ
“হে আল্লাহর রাসূল,আমার মা মৃত্যু বরণ করেছেন,তার পক্ষে কোন দানটি সবচেয়ে ভাল হবে? তিনি বললেন,“পানি”। তারপর সা’দ রা. একটি কুপ খনন করে ঘোষণা করলেন, “এই কুপ সাদের মায়ের উদ্দেশ্যে দান করা হল। ” [67]
৬) সহীহ মুসলিমে বর্ণিত রয়েছে,এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন,আমার পিতা-মাতা অর্থ-সম্পদ রেখে মারা গেছেন। এ ব্যাপারে তারা আমাকে কোন ওসিয়ত করে যাননি। এখন আমি তাদের উদ্দেশ্যে দান-সদকা করলে তা তাদের জন্যে কি যথেষ্ট হবে?তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“হ্যাঁ”।
৭) জীবিত মুসলিমগণ মৃত মানুষের জন্য দু’আ ও ইস্তেগফার করলে তাদের নিকট এর সওয়াব পৌঁছে। যেমন,কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
“যারা তাদের পরবর্তীতে আগমণ করেছে (অর্থাৎ পরে ইসলাম গ্রহণ করেছে) তারা বলে,হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বে যে সকল ঈমানদার ভাই অতিবাহিত হয়ে গেছেন তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মুমিনদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ বদ্ধমূল রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক,আপনি তো পরম দয়ালু,অতি মেহেরবান। ”[68]
জীবিত মানুষের পক্ষ থেকে মৃত মানুষের নিকট সওয়াব পৌঁছানোর ব্যাপারে উপরোল্লোখিত হাদীস সমূহ দ্বারা শুধু ঐ সকল বিষয়ই প্রমাণিত যেগুলো পূর্বে আলোচনা করা হল। কিন্তু এমন একটিও দলীল পাওয়া যায় না যে,মৃত মানুষের সওয়াবের জন্য কুরআন পড়াতে হবে,সূরা ইয়াসীন অথবা এ জাতীয় বিশেষ কোন সূরা পড়তে হবে। অনুরূপভাবে অন্য কোন ওযীফা যেমন,সূরা এখলাস এক লক্ষ বার,“‘‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ এক হাজার বার বা এ জাতীয় তাসবীহ পাঠেরও কোন ভিত্তি নাই।
কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য
আল্লাহ তায়ালা কী উদ্দেশ্যে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন? এ জন্য কি যে,এর দ্বারা তাবিজ বানিয়ে শিশু এবং রোগীদের গলায় ঝুলানো হবে?
নাকি এ জন্য যে,গোরস্থানে মৃতদের উদ্দেশ্যে পড়ে তার মাধ্যমে কাঠ মোল্লাদের অর্থ লুটের মাধ্যম বানানো হবে?
না এ উদ্দেশ্যে যে,ধান্দাবাজরা পাত্রের গায়ে লিখে তা ধুয়ে ধুয়ে রোগী এবং যাদুগ্রস্থদের পান করাবে?
না এ উদ্দেশ্যে যে,ফাঁকিবাজ এবং অলস লোকেরা কুরআনের মাধ্যমে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করবে?
না এ লক্ষ্যে যে,পুরো কুরআন এক পৃষ্ঠায় ছেপে শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে ঘরের দেয়ালে এবং বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তাবিজ বানিয়ে গলায় লটকিয়ে রাখা হবে?
না এ উদ্দেশ্যে যে,মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আয়াতুল কুরসী এবং সূরা নাস-ফালাকের তাবিজ পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করা হবে?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কি এ উদ্দেশ্যে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন যে,কাওয়ালী পাঠকারী এবং গায়করা শুধু সুললিত কন্ঠে তা পাঠ করবে আর শ্রোতারা তাদের বাদ্যযন্ত্র ও সুরের মূর্ছনায় পাগলপারা হয়ে নাচ-গানের বাজার বসাবে?
এ উদ্দেশ্যে কি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে যে,যার মাধ্যমে আমাদের পূর্বসুরীরা বিশ্ব জয় করেছিলেন সেই কুরআনকে ঘরের এক কোনে গিলাফবদ্ধ করে রেখে দেয়া হবে এবং ধুলো-বালি ও ময়লার আস্তরণের নিচে তা চাপা পড়ে থাকবে? হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর।
এই মহাগ্রন্থ তুমি এ সব উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ কর নি। অবতীর্ণ করেছো এ জন্যে যে, মানব জাতি এই কুরআনের আয়াত সমূহ গবেষণা করবে। এটা তো মানবতার জন্য উজ্জল আলোকবর্তীকা। তুমি এই গ্রন্থ নাযিল করেছ বিশ্ব মানবতার জন্যে সুসংবাদদাত এবং সতর্ককারী হিসেবে।
তুমি কুরআন অবতীর্ণ করেছ প্রাণস্পন্দিত জীবিত মানুষের জন্যে। নির্জীব মানুষের জন্যে নয়। তুমি কুরআন অবতীর্ণ করেছ এ উদ্দেশ্যে যে,মুসলিমরা একে তাদের পরিবার, সমাজ তথা জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করবে।
বাস্তব জীবনে আমরা কুরআন পরিত্যাগ করেছি। জীবনের পথ পরিক্রমায় কুরআনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী থেকে সরে গেছি অনেক দূরে। কুরআনের বিরুদ্ধে আমাদের আচরণ সীমালঙ্ঘণ করেছে। যার ফলে আমরা নিপতিত হয়েছি পশ্চাদপদতা,দূর্ভাগ্য ও লাঞ্চনা- গাঞ্চনার গহীন খাদে।
কুরআনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মর্মবাণীকে আমরা এমন বিস্ময়কর প্রক্রিয়ায় পাল্টে ফেলেছি যার নজীর পূর্ববর্তী জাতি সমূহে পাওয়া যায় না। পূর্ববর্তী উম্মতগণ আসমানী গ্রন্থসমূহকে অস্বীকার করেছিল বটে,কিন্তু কোন উম্মতের ব্যাপারে একথা শোনা যায় নি যে,তারা আসমানী গ্রন্থসমূহকে মৃত মানুষের পুঁজি হিসাবে গ্রহণ করেছিল।
আমরা কোটি কোটি মানুষকে লাগামহীন ভাবে ছেড়ে দিয়েছি যাদের দিক নির্দেশনা এবং তাবলীগের দায়িত্ব আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে তারা তৈরী করেছে যুদ্ধ এবং ধ্বংসের এমন অসংখ্য মরণাস্ত্র যা তাদের নিজেদের এবং আমাদের সকলের বিনাশ সাধন ও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় চৌদ্দ শতাব্দী পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের এই সুসংবাদ প্রদান করেছিলেনঃ
تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম যে দুটিকে তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে না। সে দুটি জিনিস হল আল্লাহর কিতাব এবং তার রাসূলের সুন্নত।”[69]
আমাদের পূর্ব পুরুষগণ কুরআনের প্রকৃত মর্মবাণীকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছিলেন এবং নিজেদের জীবন ও কর্মের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন বলেই তারা অতি অল্প সময়ে সারা বিশ্বের নেতৃত্ব ও বিশ্ব মানবতার পথ প্রদর্শকে পরিণত হয়েছিলেন। কুরআন তো আমরা প্রতিদিনই তেলওয়াত করি কিন্তু সে তেলাওয়াত আমাদের কন্ঠনালী অতিক্রম করে না। কুরআন পাঠ করি কিন্তু বুঝার চেষ্টা করি না গবেষণাও করি না এবং বাস্তব জীবনে আমরা কুরআনের শিক্ষাকে অনুসরণ করতে আগ্রীহ নই। আমাদের এই কুরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে জনৈক মনিষির এই উক্তিটিই প্রযোজ্যঃ
رُبَّ تَالٍ للقُرآنِ والقُرآنُ يَلعَنُه
“এমন অনেক কুরআন পাঠক রয়েছে কুরআন যাদের উপর অভিশম্পাত করে। ” উদাহরণ স্বরূপ,মুসলমানেরা কুরআনের এই আয়াতটি পড়ছেঃ
أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ
“সাবধান! আল্লাহর অভিশাপ জালিমদের উপর। ”[70]
অথচ সে কখনো কখনো নিজেই জালিমের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়। নিজের জবান দ্বারাই নিজের উপর আল্লাহর অভিশাপ পতিত হচ্ছে কিন্তু এ ব্যাপারে তার কোন অনুভূতি নেই!
হে মুসলিম জনগোষ্ঠী,এখনো কি তোমাদের গাফলাতির ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সময় হয় নি?সকল গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার পংকিলতা থেকে নিজেদের আঁচল মুক্ত করার সুযোগ আসে নি?আমাদের আলেম সমাজ এ সকল বিদয়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কখন করবে? এসব বিদয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সূচনার সাহস যদি তাদের না থাকে তাহলে তাদের মাথা থেকে দস্তারে ফযীলত নামিয়ে রাখা উচিত অথবা কমপক্ষে ঐ সকল মানুষের সমর্থন দেয়া কর্তব্য যারা বিদয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু আফসোস তো এখানেই যে,স্বয়ং ঐ সকল আলেমে দ্বীন নিজেরাই এ সব বিদয়াতকে নিজেদের রুটি-রুজির মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে বসেছে! বরং এসব কাজের বিরোধীতাকারীদেরকে বিভিন্ন অপমানজনক ও ঘৃণ্য অভিযোগে অভিযুক্ত করতেও তারা পিছুপা হন না।
এ নাজুক পরিস্থিতিতে যখন আমরা বংশীয়,সমাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদি চর্তুমূখী সমস্যা ও বিপদে পরিব্যাপ্ত তখন আমাদের কর্তব্য হবে আমাদের গভীর নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া। আল্লাহর কিতাবকে শক্ত হাতে ধারণ করা এবং গবেষণার মানষিকতা নিয়ে তা অধ্যয়ন করা সেই সাথে আল্লাহর এই কিতাবকে আমারদেরজ জীবন ও জগতের একমাত্র কর্মসূচী ও সংবিধান হিসাবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা।
এক ইসলামী চিন্তাবিদ বলেছেন:
“হে মুসলিম সম্প্রদায়! তোমরা আজ পর্যন্ত ধর্মের নামে কতিপয় নাম সর্বস্ব ঠিকাদার এবং স্বল্প বিদ্যার মোল্লাদের নিকট গোলাম হয়ে রয়েছ। তোমরা এখনো নিজেদের জীবন-দর্শন এবং জীবন পরিচালনার আইন-কানুনের ক্ষেত্রে কুরআনের হেকমত ও আদর্শ থেকে সাহায্য নিতে পার নি।
যদিও কুরআন তোমাদের জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্য,তোমাদের শক্তি ও সাহসের উৎসমূল,কিন্তু এখন তা তোমাদের চঞ্চলমুখর জীবনের জন্য নয় বরং তা হল মৃতদের জন্য! যখন জীবনের সকল কাজ শেষ হয়ে তোমরা মৃত্যুপুরীর সীমান্তে প্রবেশ কর,যখন প্রাণ বায়ু বের হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে তখন তোমাদের নিকট এই কুরআন পড়া হয় যেন তোমরা সহজে মরতে পার! কি বিস্ময়ের কথা! যে কুরআন এসেছিল মৃত দেহে আত্মার সঞ্চার ঘটাতে,দূর্বল ও অসাড় শরীরে শক্তির উন্মেষ ঘটাতে সেই কুরআন পড়া হচ্ছে যাতে শান্তিতে মৃত্যু বরণ করা য়ায!
ইসলাম বিমুখকারী সকল বস্তাপচা তাকলীদ ও অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা প্রয়োজন। আজ প্রয়োজন জাহেলী আরবের মুশরেকদের চেয়েও বড় মুশরিক কবর পূজারীদের সংশোধনের জন্যে শ্রম ব্যয় করা। যারা বিপদে পড়লে কবরের পচাঁ হাড্ডির দিকে ফরিয়াদের হাত বাড়ায়, নিজেদের আভাব মোচনের জন্য কবরের কাছে আবেদন-নিবেদন করে,কবরবাসীদেরকে বানায় আল্লাহ ও তাদের মাঝে ওসীলা বা মাধ্যম। তাদের নামে পশু জবাই করে এই আশায় যে,এ কবরবাসীরাই হয়তো ওদেরকে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের ব্যবস্থা করে দিবে।
মহান আল্লাহ অসংখ্য আয়াতে ঐ সকল কবর পুজারীকে তিরষ্কার করেছেন যারা মৃত মানুষের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করে নিজেদের বিবেকের বিলোপ সাধন করেছে এবং হত্যা করেছে নিজেদের চেতনাকে। তারা আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করায় শিরক তাদের অন্তঃকরণে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুকে ডাকে,যে কেয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না,তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? তারা তো তাদের ডাক থেকে বেখবর। ”[71]
তিনি আরও বলেনঃ
لَهُ دَعْوَةُ الْحَقِّ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُمْ بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ
“সত্যের আহবান একমাত্র তাঁরই এবং এরা তাঁকে ছাড়া যাদেরকে ডাকে,তারা তাদের কোন কাজে আসে না;ওদের দৃষ্টান্ত সেরূপ,যেমন কেউ দু হাত পানির দিকে প্রসারিত করে যাতে পানি তার মুখে পৌঁছে যায়। অথচ পানি কোন সময় পৌঁছবে না। কাফেরদের যত আহবান তার সবই পথভ্রষ্টতা।[72]
আজ প্রয়োজন শরীয়তে মুহাম্মদীকে বিদয়াতের আবর্জনা থেকে মুক্ত করে দ্বীনের মশাল হাতে উঠে দাঁড়ানো। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে দীনের উন্নয়ন ও অগ্রগতি। আলেম সমাজের নিকট উদাত্ত আহবান জানাই,আসুন, দীনের সংস্কার ও সংশোধনের জন্য আমরা আবারও উঠে দাঁড়াই।
♦ ♦ ♦
ইসালে সওয়াব
ইসালে সওয়াব বা সওয়াব দান করা কি শরীয়ত সম্মত?
প্রিয় পাঠক, ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি, মৃতের উদ্দেশ্যে দুয়া, বদলী হজ্জ বা ওমরা, দান-সদকা, মানতের রোযা ইত্যাদি পালন করা শরীয়ত সম্মত। কিন্তু অন্য কোন ইবাদতের সওয়াব কি মৃতের উদ্দেশ্যে বখশানো জায়েয? যা আমাদের সমাজে ইসালে সওয়াব হিসেবে পরিচিত।
এর উত্তর হল, ইসালে সওয়াব শরীয়ত সম্মত নয়। বরং এটি একটি বিদয়াতী রীতি। কারণ এর পক্ষে কুরআন-সুন্নায় কোন প্রমাণ নেই।
কিছু মানুষ ইসালে সওয়াবের প্রমাণ হিসেবে বদলী হজ্জ, বদলী রোযা এবং দান-সদকা করার হাদীসগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন,অথচ বদলী এবং ইসালে সওয়াব এর মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। যেমন:
বদলীর ক্ষেত্রে একজনের দায়িত্ব আরেকজন পালন করে থাকে। যেমন,বদলী হজ্জ করার সময় বলা হয় “লাব্বাইকা আন ফুলান” (হে আল্লাহ,আমি অমুকের পক্ষ থেকে হাজির) অথবা মনে মনে নিয়ত করা হয়, আমি অমুক ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ পালন করছি। কিন্তু ইসালে সওয়াব বা সওয়াব দানের ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ থেকে হজ্জ সম্পাদন করে সে বলে,হে আল্লাহ,আমার এ হজ্জের সওয়াব অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দাও।
প্রথম পদ্ধতি অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ-উমরা আদায় করা, দান-সদকা করা ইত্যাদি কুরআন-হাদীস দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত। কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিটি অর্থাৎ নিজ আমলের সওয়াব মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করা প্রকৃত বিদয়াত যেমনটি বলেছেন ইসমাঈল শহীদ রহ.।
মাওলানা ইসমাঈল শহীদ রহ. ‘ঈযাহুল হক’ কিতাবে লিখেছেন,“জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে সওয়াব বখশিয়ে দেয়া প্রকৃত বিদয়াত। পক্ষান্তরে আর্থিক ইবাদত (হজ্জ, উমরা, দান-সদকা ইত্যাদি) ক্ষেত্রে বদলী নিযুক্ত করা বৈধ। ”
এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
لم يكن من عادة السلف إهداء ذلك إلى موتى المسلمين ، بل كانوا يدعون لهم ، فلا ينبغي الخروج عنهم
“মৃত মুসলিমদের প্রতি সওয়াব দান করা আমাদের সালাফ তথা পূর্ববর্তী মনিষীদের নিয়ম ছিল না,বরং তাঁরা মৃতদের জন্য দু’আ করতেন। অতএব,তাদের এ নিয়মের বাইরে যাওয়া আমাদের সমীচীন নয়…। ”
‘মুয়াফাকাত’ কিতাবে আল্লামা আবু ইসহাক রহ.[73] অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেনঃ “ইসালে সওয়াব তিনটি কারণে জায়েয নয়। যথাঃ
(এক) ইসলামে সম্পদ দান করা বৈধ প্রমাণিত;সওয়াব দান করা প্রমাণিত নয়। সুতরাং সওয়াব দানের ব্যাপারে যেহেতু কোন প্রমাণ নেই তাই তাকে বৈধ বলাও অন্যায়।
(দুই) যে কোন আমলের পুরস্কার বা শাস্তি ইসলামে নির্ধারণ করা রয়েছে। তাছাড়া প্রতিদান পাওয়া কাজের উপর নির্ভরশীল। মানুষ যেমন কাজ করবে তেমন প্রতিদান লাভ করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“তাদের কর্ম অনুপাতে তাদের জন্যে রয়েছে প্রতিদান। ”[74]
সুতরাং এ ক্ষেত্রে কারো এখতিয়ার নেই যে,ইচ্ছা করলেই নিজের আমলের প্রতিদান আরেকজনকে দান করে দিবে।
(তিন) সওয়াব মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। এ ব্যাপারে আমলকারীর হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। অতএব,নিজের আমলের সওয়াব অন্য কাউকে দান করার অধিকারও তার নেই।
ইসালে সওয়াব সম্পর্কে কতিপয় সংশয় নিরসন:
১ম সংশয় ও তার জবাব: এ সংশয় রাখা যাবে না যে, সওয়াব যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ সম্পদও তো তেমনি তাঁরই অনুগ্রহ। সুতরাং সম্পদ দান করা যেমন বৈধ,সওয়াব দান করাও তেমনি বৈধ। কিন্তু এ ধারণা অবাস্তাব। কারণ,সম্পদ বাহ্যিকভাবে দেখা যায় বা হস্তান্তর যোগ্য জিনিস এবং তা একজনের মালিকানা থেকে অন্যের মালিকানায় দেয়া সম্ভব। পক্ষান্তরে,সওয়াব হল ইন্দ্রিয় বর্হিভূত জিনিস যা দেখা যায়না বা অনুভব করা যায়না। অন্তরের অবস্থা অনুযায়ী আমলকারী সওয়াব লাভ করে থাকে। ফলে তা এক হাত থেকে আরেক হাতে যাওয়াও অসম্ভব। অতএব,সম্পদ আর সওয়াবকে এক মনে করা অযৌক্তিক।
একথা সত্য যে,সওয়াব হল নেক আমলের অনুগামী বিষয়। যে আমল করবে সে তার সওয়াব থেকে উপকৃত হবে। তবে অন্যকে তা দান করার বা উৎসর্গ করার কোন অধিকার নেই। এ কথাগুলো সব সময় স্মরণ রাখা দরকার।
২য় সংশয় ও তার জবাব: অনুরূপভাবে এ যুক্তি পেশ করা যাবে না যে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন এবং তাঁর সওয়াব উম্মতের জন্যে বখশিয়েছেন। এ যুক্তি মোটেই ঠিক নয়। কারণঃ
১মত: কুরবানী আর্থিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত যা একজনের পরিবর্তে আরেকজন করতে পারে। তাছাড়া উম্মতের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কুরবানী করা ঠিক তেমন যেমন পরিবারের অবিভাবক পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য কুরবানী করে থাকেন ।
২য়ত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ পরিবার এবং উম্মতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার কারণ হল, তিনিই এ জন্য সবচেয়ে বেশি হকদার। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন:
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিনদের কাছে নিজেদের আত্মা থেকেও অধিক নিকটতম। ”[75]
তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কুরবানী করার উক্ত হাদীস দ্বারা ইসালে সওয়াব করার বৈধতা প্রমাণ করা ভুল ও অযৌক্তিক। কারণ,এর দ্বারা একজনের পক্ষ থেকে আরেকজন স্থলাভিষিক্ত হওয়া প্রমাণিত হয় অর্থাৎ একজনের পক্ষ থেকে অন্যজন কুরবানী করা জায়েয আছে। কিন্তু ইসালে সওয়াব বা সওয়াব দান করা আলাদা জিনিস। মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার বৈধতা বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রা. কে অসীয়ত করেছিলেন তিনি যেন তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানীর পশুগুলোকে জবেহ করেন। এ বিধানের উপরেই উম্মতের আমল চলে আসছে। ইসালে সওয়াব বা সওয়াব দানের সাথে এর নূন্যতম সম্পর্ক নেই।
৩য় সংশয়: নিম্নোক্ত হাদীসদ্বয় দ্বারাও ইসালে সওয়াবের পক্ষে প্রমাণ পেশ করা ঠিক নয়। হাদীস দুটি হল:
আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে,জনৈক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বললেন,আমার মা মারা গেছেন। আমি তার পক্ষ থেকে সদকা করলে তা কি আমার মায়ের উপকারে আসবে?নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“হ্যাঁ”। অতঃপর তিনি একটি খেজুর বাগান তার মায়ের উদ্দেশ্যে সদকা করে দিলেন।
অন্য বর্ণনায় এসেছে,উক্ত লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল,তার মা বাকহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন,এমনটি না হলে হয়ত তিনি সদকা করতেন। তাহলে এখন তার পক্ষ থেকে আমার সদকা যথেষ্ঠ হবে কি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ”। প্রথম বর্ণনায় এসেছে,যদি তিনি কথা বলতে পারতেন তবে সদকা করতেন।
উভয় হাদীসই মায়ের জন্য সন্তানের দান-সদকার কথা উল্লেখিত হয়েছে এবং উভয়টিতে মায়ের পক্ষ থেকে বদলী। উক্ত মহিলাদ্বয় সদকা করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন, সুযোগ পেলে বাস্তবায়ন করতেন। তাই তাদের মনের বাসনাকে তাদের সন্তানগণ পূর্ণ করেছেন এবং এ ধরণের স্থলাভিষিক্ত হওয়া শরীয়ত সম্মত এবং প্রমাণিত। ইসালে সোয়াবের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
মৃতের উদ্দেশ্যে ফাতেহাখানী করার ব্যাপারে একটি সংশয়ের জবাব
কতিপয় মানুষ তথাকথিত ফাতেহাখানী বৈধ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ’হেদায়াতুল হারামাইন’ গ্রন্থে সংকলিত একটি ফতোয়া এবং জুনদীর হাওলা দিয়ে একটি হাদীস পেশ করে থাকে। তা হল,“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পুত্র ইবরাহীম রা. মৃত্যু বরণ করার পর সাহাবী আবু যার রা. শুকনো খেজুর এবং শুকনো রুটি মেশানো দুধ নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি তার উপর সূরা ফাতেহা এবং সূরা ইখলাস তিনবার পাঠ করলেন। তারপর হাত উঠিয়ে দু’আ করে উভয় হাত মুখমণ্ডলে ফেরালেন। অত:পর আবু যার রা.কে বললেন,এগুলো মানুষের মাঝে বিতরণ করে দাও। এর সমস্ত সওয়াব আমি আমার পুত্র ইব্রাহীম এর রূহের উদ্দেশ্যে বখশিয়ে দিলাম। ”
উক্ত ঘটনা সম্পূর্ণ বানোয়াট। বরং সমাজে প্রচলিত ফাতেহাখানীর কুপ্রথাকে সামনে রেখে অত্যন্ত চালাকীর সাথে এটা সাজানো হয়েছে যার কোন ভিত্তি নেই। তাছাড়া “‘হেদায়াতুল হারামাইন’ কিতাবের লেখক উক্ত ঘটনার কোন তথ্যসূত্রও উল্লেখ করেন নি।
হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম আব্দুল হাই লাখনৌভী রহ. এর ফাতাওয়ার কিতাবে (২য় খণ্ড ৩৬ পৃষ্ঠায়) উক্ত ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে এবং তার জবাবও সেখানে বিদ্যমান রয়েছে। উক্ত আলোচনা নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলঃ
প্রশ্নঃ আমারা “‘হেদায়াতুল হারামাইন’ কিতাবে পেয়েছি যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সন্তান ইবরাহীম রা. মৃত্যু বরণ করার পর তিনি তৃতীয়,দশম,চল্লিশতম ইত্যাদি দিনে শুকনা খেজুর ইত্যাদিতে ফাতিহা পাঠ করে সাহাবীদেরকে খাইয়েছিলেন। তাহলে বর্তমানে ফাতেহাখানীর আয়োজন করলে তাতে বাধা কোথায়?
উত্তরঃ ‘হেদায়াতুল হারামাইন’ কিতাবে উল্লেখিত ঘটনা আদৌ সত্য নয়। গ্রহণযোগ্য কিতাব সমূহে এর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। আল্লাহ ভাল জানেন।
-আবুল হাসানাত মুহাম্মাদ আব্দুল হাই রহ.
কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াব সম্পর্কে জগদ্বিখ্যাত মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ এবং ইমামগণের অভিমত:
এ প্রসঙ্গে আমরা এখন ধারাবাকিভাবে তাফসীর বিশারদ, হাদীস বিশারদ,ফিকহের মূলনীতি বিশেষজ্ঞ এবং চার মাযহাবের মহামতি ইমামগণের মতামত এবং উক্তি সমূহ উপস্থাপন করব যা দ্বারা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হবে যে,বর্তমানে সমাজে মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে যে শোকসভা,স্মরণ সভা ও সবীনাখানী বা কোরআনখানীর আয়োজন হয়ে চলছে এর সাথে ইসলামী শরীয়ত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াব সম্পর্কে মুফাসসিরগণের অভিমত:
১) আল্লামা ইবনে কাসীর রহ.: আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. নিম্নোক্ত আয়াত সমূহ তুলে ধরে সেগুলোর ব্যাখ্যা পেশ করেন। আয়াতগুলো হল এইঃ
أَمْ لَمْ يُنَبَّأْ بِمَا فِي صُحُفِ مُوسَى– وَإِبْرَاهِيمَ الَّذِي وَفَّى – أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى – وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى – وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى– ثُمَّ يُجْزَاهُ الْجَزَاءَ الْأَوْفَى
“তার নিকট কি মূসা ও ইবরাহীম- যিনি (আনুগত্য ও রেসালাতের দায়িত্ব) যথাযথভাবে পূর্ণ করেছিলেন-এর সহীফাগুলোতে বর্ণিত মূলনীতি সম্পর্কিত তথ্যগুলো এসে পৌঁছেনি যে,একজনের পাপের ভার আরেকজন বহন করবে না? আর মানুষ শুধু তাই পায় যা সে কষ্ট করে উপার্জন করে। আর সে কী চেষ্টা-পরিশ্রম করেছে তা সে অচিরেই দেখতে পাবে। অতঃপর,পরিপূর্ণ রূপে তাকে পরিশ্রমের বিনিময় প্রদান করা হব। ”[76]
অর্থাৎ কেউ কুফুরী বা পাপাচার করে নিজের প্রতি অবিচার করলে তার দায়-দায়িত্ব তার নিজের উপরই বর্তাবে। অন্য কেউ তার দায়িত্ত কাঁধে নিবে না। যেমন,আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেনঃ
وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى وَإِنْ تَدْعُ مُثْقَلَةٌ إِلَى حِمْلِهَا لَا يُحْمَلْ مِنْهُ شَيْءٌ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى
“কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কেউ যদি তার গুরুভার বহন করতে অন্যকে আহবান করে তা কেউ বহন করবে না যদিও সে নিকটাত্মীয় হয়। ”[77]
গ) তিনি আরও বলেনঃ
وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى
“এবং মানুষ তাই পায়,যা সে করে। ”[78]
তার উপর যেমন অন্যের পাপের দায়-দায়িত্ব বর্তাবে না অনুরূপভাবে সে কেবল ঐ পরিমাণ প্রতিদানের অধিকারী হবে যতটুকু সে নিজে উপার্জন করেছে।
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন,“উক্ত আয়াত সমূহের ভিত্তিতে ইমাম শাফেঈ ও তাঁর অনুসারীরা এ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন যে,কুরআন পড়ার সওয়াব মৃত ব্যক্তিদের নিকট পৌঁছে না। কেননা,এটা তাদের নিজস্ব আমল ও উপার্জন নয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে কখনো এ কাজের প্রতি পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোন নির্দেশ, দিকনির্দেশনা,উৎসাহ কিংবা উপদেশ দিয়ে যান নি। কোন সাহাবীর পক্ষ থেকেও কখনো এ রকম কথা বলা হয় নি। কুরআনখানী করলে মৃত ব্যক্তি যদি উপকৃত হত তবে সর্ব প্রথম সাহাবীগণ তা বাস্তবায়ন করে এ সৌভাগ্য অর্জন করতেন।
যে কোন সৎ আমল নির্ভর করে প্রমাণের উপর। এখানে কারো ব্যক্তিগত মতামত,রায় বা কিয়াসের সুযোগ নেই। অবশ্য দু’আ ও দানের ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই। নবী মুহম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে যে,এ দুটি কাজের সওয়াব মৃত ব্যক্তির নিকট পৌঁছে।
আর ইমাম মুসলিম আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসটি। যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার আমলের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত। সদকায়ে জারিয়া,এমন শিক্ষা যার দ্বারা অন্য মানুষ উপকৃত হয় এবং এমন নেককার সন্তান যে তার জন্য দু’আ করে। ”(মুসলিম) এ হাদীসে বর্ণিত তিনটি জিনিসই প্রকৃতপক্ষে মৃত ব্যক্তির আমল এবং শ্রম ও সাধনার ফসল। যেমন, অন্য একটি হাদীস রয়েছেঃ
إِنَّ أَطْيَبَ مَا أَكَلَ الرَّجُلُ مِنْ كَسْبِهِ وَإِنَّ وَلَدَ الرَّجُلِ مِنْ كَسْبِه
“মানুষ সবচেয়ে পবিত্র যে খাবার খায় তা হল তার নিজস্ব উপার্জিত সম্পদ। আর সন্তান তার নিজস্ব উপার্জিত সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। [79]
সদকায়ে জারিয়া মানুষের নিজস্ব কর্ম ও বিনিয়োগেরই ফলাফল। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেনঃ
إِنَّا نَحْنُ نُحْيِي الْمَوْتَى وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآَثَارَهُمْ
“আমিই তো মৃতদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করি। ”[80]
তদ্রুপ মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায় মানুষের মাঝে যে জ্ঞানের প্রচার-প্রসার সে করে গেছে এবং মানুষ তদানুযায়ী আমল করে চলেছে সেটিও তার নিজ কর্মের ফসল। যেমনটি নিম্নোক্ত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রতিয়মান হয়। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنْ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا
“যে ব্যক্তি মানুষকে হেদায়াতের প্রতি আহবান করবে সে ব্যক্তি ঐ হেদায়াতের পথের অনুসারীদের সমপরিমাণ সোয়াবের অধিকারী হবে। অথচ এতে তাদের কোন সওয়াবের কমতি হবে না। ” [81]
২) ইমাম শাওকানী রহ.: ইমাম শাওকানী রহ. নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন:
وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى
“এবং মানুষ তাই পায়,যা সে করে। ”[82]
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়,মানুষ লাভ করবে কেবল তার নিজস্ব পরিশ্রমের প্রতিদান। একজনের আমল অন্যের কোনই উপকারে আসবে না। কিন্তু আয়াতের এই ’আম’ বা ব্যাপক অর্থটিকে অন্য একটি আয়াত কিছুটা সীমাবদ্ধ করেছে। আয়াতটি হলঃ
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়,মানুষ লাভ করবে কেবল তার নিজস্ব পরিশ্রমের প্রতিদান। একজনের আমল অন্যের কোনই উপকারে আসবে না। কিন্তু আয়াতের এই ’আম’ বা ব্যাপক অর্থটিকে অন্য একটি আয়াত কিছুটা সীমাবদ্ধ করেছে। আয়াতটি হলঃ
أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ
“তাদের স্তরে তাদের সন্তানদেরকে মিলিত করেছি। ”[83]
অর্থাৎ সন্তান-সন্তুদীগণ যদি নেক আমল করে তবে তাদের পিতা-মাতার আমলনামায় উক্ত সওয়াবের একটা অংশ লেখা হবে।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশক্রমে নবী ও ফেরেশতাগণ ইমানদারদের জন্য শুপারিশ করবেন,জীবিত মানুষ মৃত মানুষের জন্যে দু’আ করবে ইত্যাদি মাধ্যমেও উপরোক্ত আয়াতের ব্যাপকার্থকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
যারা মনে করেন যে,উল্লেখিত আয়াতটি পরের হাদীসগুলোর কারণে রহিত হয়ে গেছে তাদের ধারণা ঠিক নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে উক্ত আয়াতকে এ বিষয়গুলি সীমাবদ্ধ করেছে। ”
৩) আল্লামা রশীদ রেযা রহ.: তাফসীর আল মানারের লেখক আল্লামা রশীদ রেযা রহ. নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা পেশ করেন। নিম্নে সংক্ষেপে তা উপস্থাপন করা হলঃ
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلَّا عَلَيْهَا وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى
“কেউ অন্যায় করলে তার ক্ষতি নিজের উপরই বর্তাবে। একজনের বোঝা (দায়-দায়িত্ব) আরেকজন বহন করবে না। ” [84]
“কুরআনখানী এবং বিভিন্ন ধরণের ওযীফার সওয়াব মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে বখশানোর নিয়ম ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করেছে। অনুরূপভাবে পয়সার বিনিময়ে কুরআন পড়ানোর প্রথাও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু এগুলো সবই বিদয়াত এবং শরীয়ত বিরোধী কাজ।
অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি নামায না পড়ে মারা গেলে তার জন্য কাফ্ফার দেয়ার মাসআলাটিও একটি বিদআতী মাসআলা। আসলে এসবের যদি কোন শরঈ ভিত্তি থাকত তবে ইসলামের প্রাথমিক যুগের অনুসরণীয় ব্যক্তিগণ এ বিষয়ে অবশ্যই জানতেন এবং তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করে যেতেন। ”
তিনি আরও বলেন,“মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসীন পাঠের বর্ণনাও ছহীহ নয়। এ ব্যাপারে কোন ছহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। যেমনটি বিশ্ব বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম দারাকুতনী (রাহ:)ও বলেছেন”।
জানা দরকার যে,বর্তমানে শহরে,গ্রামে-গঞ্জে মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে কুরআনখানী ও ফতিহাখানী করার যে নিয়ম দেখা যাচ্ছে সে বিষয়ে না পাওয়া যায় কোন ছহীহ হাদীস,না যঈফ হাদীস। এমনকি এ ব্যাপারে কোন বানোয়াট হাদীসও পাওয়া যায়না। এটা এমনই বিদয়াত যা সুদৃঢ় প্রমাণাদীর সরাসরি বিরুদ্ধ। এ কুপ্রথা সমাজে এতটা ব্যাপকতা লাভ করার কারণ হল,পয়সালোভী,নাম সর্বস্ব লেবাসধারী আলেমগণ এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে আর জনসাধারণ এটাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছে। এমনকি এটাকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বরং ফরযের স্তরে নিয়ে পৌঁছিয়েছে।
মোট কথা,এটি একটি ইবাদতের বিষয়। যার ভিত্তি হতে হবে কুরআন ও সুন্নাহর দলীল। এর উপর সালাফে-সালেহীনগণ থেকে আমল পাওয়া অত্যন্ত জরুরী।
কুরআন ও সহীহ হাদীসের স্পষ্ট ও সুদৃঢ় প্রমাণাদির আলোকে এই মূলনীতি প্রমাণিত হল যে,পরকালে মানুষ কেবল নিজ আমলের প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا
“যে দিন কেউ কারো উপকার করতে পারবে না। ”[85]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আরও বলেন:
اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا
“তোমরা সেদিনকে ভয় কর যে দিন পিতা পুত্রের এবং পুত্র পিতার কোনই উপকারে আসবে না। ”[86]
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিকটাত্মীয়দের নিকট আল্লাহর এই হুকুম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন যে,“তোমরা আমল কর। আমি আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচাতে তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না”[87]
তাহলে বুঝা গেল,পরকালে নাজাত পেতে হলে নেক আমল করতে হবে। নেক আমল করার মাধম্যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। তাহলেই কেবল পরকালে মুক্তির আশা করা যাবে।
আল্লামা রশীদ রেযা রহ. জগদ্বিখ্যাত মনিষী হাফেয ইবনে হাজার রহ. এর কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন,তাঁকে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল,কোন ব্যক্তি যদি কুরআন পড়ার পর দু’আতে বলে, হে আল্লাহ,আমার কুরআন তেলাওয়াতের সওয়াবের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে দাও। তাহলে তার বিধান কী?
হাফেজ ইবনে হাজার রহ. উত্তরে বলেছেন,“এ ধরণের দু’আ পরবর্তী যুগের কারী সাহেবদের আবিষ্কার। পূর্ববর্তী যুগের মানুষের মধ্যে এ ধরণের কোন দুয়া প্রচলিত ছিল বলে আমার জানা নাই। কখনো শুনিও নি।
অতএব, আমরা একথাই বলব,সমাজের তথাকথিত এসব আলেম নামধারী ব্যক্তি যারা কুরআন সম্পর্কে মোটেও জ্ঞান রাখেনা তারা কিভাবে এই আয়াতের মর্ম বুঝবে?যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
“আর রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। ”[88]
তারা কি এ সহীহ হাদীস সম্পর্কে জ্ঞান রাখে যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে এমন কাজ করল যার ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশ নেই তা পরিত্যাজ্য। ”[89]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেনঃ
وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَة
“সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল,(দ্বীনের মধ্যে) নতুন উদ্ভাবিত বিষয় সমূহ। আর প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত জিনিসই বিদয়াত। আর প্রতিটি বিদয়াতই গুমরাহী। ”[90]
কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াব সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের অভিমত:
১) ইমাম নওয়াবী রহ.:
ইমাম নওয়াবী রহ. وُصُولُ ثَوابِ الصدقةِ عنٌ المَّيتِ তথা মৃতের নিকট সদকা’র সওয়াব পৌঁছা অধ্যায়ে আয়েশা রা.এর নিম্নোক্ত হাদীস উল্লেখ করেছেন: এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন:
إِنَّ أُمِّي اُفْتُلِتَتْ نَفْسهَا ، وَإِنِّي أَظُنّهَا لَوْ تَكَلَّمَتْ تَصَدَّقَتْ ، فَلِي أَجْر أَنْ أَتَصَدَّق عَنْهَا ؟ قَالَ : نَعَمْ
“হে আল্লাহর রাসূল,আমার মা হঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন, কিন্তু কোন ওসিয়ত করে যান নি। আমার ধারণা,তিনি যদি কথা বলতে সক্ষম হতেন তবে সদকা করতেন। তাই আমি যদি তার পক্ষ থেকে সাদকাহ করি তাহলে কি তিনি তার সওয়াব পাবেন? তিনি উত্তরে বললেন,“হ্যাঁ। ”[91]
ইমাম নওয়াবী রা. বলেনঃ “উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,মৃতের পক্ষ থেকে সাদকা করা হলে তার সওয়াব মৃত ব্যক্তি পেয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সমস্ত আলেম একমত। আবার এ ব্যাপারেও ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে,মৃতের জন্য দু’আ করা হলে তার নিকট পৌঁছে। অনুরূপভাবে মৃতের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করা যায় এবং তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করাও শরীয়ত সম্মত। এসব ব্যাপারে ছহীহ হাদীস এবং সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ বিদ্যামান রয়েছে।
আর এটাই আমাদের প্রসিদ্ধ অভিমত যে,কুরআন তেলাওয়াতের সওয়াব মৃতের নিকট পৌঁছে না”।
২) ইমাম সানআনী রহ.: তিনি বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ ‘বুলূগুল মারাম’ এর ব্যাখ্যা ‘সুবুলুস্ সালাম’ কিতাবে আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তা হল,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় একটি গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কবরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেনঃ
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالْأَثَرِ
“হে কবরবাসীগণ,তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ তোমাদেরকে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। তোমরা আমাদের আগে চলে গেছ। আমরা তোমাদের অনুগামী। ”[92]
ইমাম সান’আনী বলেন, “এ হাদীস প্রমাণ বহন করে যে, কেউ কারো জন্য দু’আ-ইস্তেগফার করলে যেন প্রথমে নিজের জন্যে করে। কুরআনে যে সমস্ত দু’আ আছে সেগুলোতেও আগে নিজের জন্য দুয়া করার কথাই উল্লেখিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ
“হে আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে এবং আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করে দাও যারা ঈমানের সাথে আমাদের আগে (দুনিয়া) থেকে চলে গেছে। ”[93]
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ
“ক্ষমা প্রার্থনা কর নিজের জন্য এবং মুমিনদের জন্য। ”[94]
এ হাদীস দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে,উপরোক্ত দু’আগুলো এবং এ জাতীয় যত দু’আ আছে মৃত লোকদের উপকারে আসে। এ ব্যাপারে কোন আলেমই দ্বিমত করেন নি। কিন্তু কুরআন পড়ার সওয়াব মৃতের নিকট পৌঁছে না যেমনটি ঈমাম শাফেঈ রাহ. বলেছেন।
৩) ইমাম শাওকানী রহ.: ইমাম শাওকানী রহ. ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত আল মুন্তাকা এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ নাইলুল আওতার কিতাবে বলেছেন,“ইমাম শাফেঈ এবং তাঁর একদল সহোচর আলেমের প্রসিদ্ধ মাযহাব হল,কুরআন তেলাওয়াতের সওয়াব মৃত মানুষের নিকট পৌঁছে না। আমাদেরও মত হল,কুরআন তেলাওয়াত করা হলে মৃতদের কোন উপকার হয় না এবং কবরের নিকট কুরআন পাঠ করা জায়েযও নয়। এ ব্যাপারে স্পষ্ট দলীল হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لاَ تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِى تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ
“তোমরা তোমাদের বাড়ীকে গোরস্থানে পরিণত করনা। যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় শয়তান সে ঘর থেকে পলায়ন করে। ”[95]
তিনি আরও বলেনঃ
صَلُّوا فِي بُيُوتِكُمْ وَلَا تَتَّخِذُوهَا قُبُورًا
“তোমরা তোমাদের ঘরে (নফল) নামায আদায় কর এবং তা কবরস্থানে পরিণত কর না। ”[96]
অর্থাৎ কবরে যেমন নামায পড়া হয় না কিংবা কুরআন তেলাওয়াত করা হয় না তদ্রুপ ঘরে নফল নামায এবং কুরআন পড়া বাদ দিয়ে ঘরকে গোরস্থানে পরিণত করনা।
কবরের পাশে কুরআন পড়লে যদি মৃতদের উপকার হত, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নফল নামায এবং কুরআন ঘরে পড়তে বলতেন না এবং নিজেদের ঘরকে গোরস্থানে পরিণত করতে নিষধ করতেন না। যদিও তিনি উম্মতের সব চেয়ে বেশী কল্যাণকামী এবং মুমিনদের প্রতি পরম করুনাময়। তার এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, গোরস্থান কুরআন তেলায়াত এবং নামায পড়ার স্থান নয়। আর এ কারণে তিনি কবরের নিকট কুরআন তেলাওয়াত করেছেন বা কুরআনের কোন সূরা পড়েছেন তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ তিনি অধিকহারে নফল নামায আদায় করতেন এবং কবর যিয়ারত করতেন, সেই সাথে মানুষকে কবর যিয়ারত করার নিয়ম-পদ্ধতিও শিক্ষা দিতেন। এখান থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে,গোরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা বা কুরআনের বিশেষ কোন সূরা পাঠ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ নয় বরং বিদ্আতের অন্তর্ভুক্ত যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
চার মাযহাবের সম্মানিত আলেমদের অভিমত:
১) হানাফী মাযহাবঃ
ক) মোল্লা আলী কারী হানাফী রহ. “শরহুল ফিকহিল আকবার” কিতাবের ১১০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন:
“ইমাম আবু হানীফা,ইমাম মালেক এবং ইমাম আহমদের একটি বর্ণনা অনুপাতে কবরের নিকট কুরআন পাঠ করা হারাম। কেননা,এটা একটা বিদয়াত যার ব্যপারে কোন হাদীস বর্ণিত হয়নি। ‘এহয়াউল উলূম’ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকারের বক্তব্যও তাই।
খ) ইমাম বারকুভী তার “আত ত্বারীকাহ আল মুহাম্মাদীয়া” গ্রন্থের ৩য় পরিচ্ছদে বিভিন্ন বিদয়াত এবং বাতিল কর্ম-কাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,মানুষ সওয়াবের কাজ ভেবে বিভিন্ন গুনাহের দিকে ধাবিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, মানুষ মারা গেলে পানাহারের আয়োজন করা,ইসালে সওয়াব উপলক্ষ্যে কুরআন পাঠকারীদের পয়সা দেয়া,বিভিন্ন তাসবীহ পাঠ করা-এগুলো সবই বিদয়াত। এমন কি মৃত ব্যক্তি যদি জীবিত থাকা অবস্থায় এসব করার ওসীয়তও করে যায় তবুও সেগুলো পালন করা বিদয়াত এবং বাতিল কাজ। এসব কাজের বিনিময় গ্রহণ করা হারাম এবং এসব যারা পাঠ করবে তারাও গুনাহগার হবে।
গ) ইমাম ইয বিন আব্দুস সালাম রাহ. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,কুরআন তেলাওয়াতের সওয়াব মৃত্যের উদ্দেশ্যে বখশানো হলে তা কি মৃতের নিকট পৌঁছে?
সম্মানিত ইমাম জবাবে বলেছেন,“তেলাওয়াতকারীর সওয়াব কেবল তেলায়াতকারীর জন্যই নির্ধারিত। সে ছাড়া কারও নিকট এ সওয়াব পৌঁছে না।” তিনি আরও বলেন,“আমি অবাক হই,কিছু লোক স্বপ্নের মাধ্যমে এর দলীল পেশ করে থাকেন অথচ স্বপ্ন কখনো দলীল হতে পারে না। ”
২) মালেকী মাযহাব:
মালেকী মাযহাবের আলেম শাইখ ইবনে আবি হামযা রহ. বলেন: “কবরের নিকট কুরআন পড়া সুন্নত নয় বরং বিদয়াত।” (আল মাদখাল)
মালেকী মাযহাবের আরেক আলেম শাইখ দারদীর তার প্রসিদ্ধ ‘শরহুস সগীর’ গ্রন্থের ১৮০ পৃষ্ঠায় লিখেন,“কারও মৃত্যু বরণ করার সময় তার পাশে কুরআনের কোন অংশ পাঠ করা এবং মৃত্যু বরণ করার পর কবরের নিকট কুরআন পাঠ করা মাকরূহ। কোননা,সালাফে-সালেহীন তথা সাহাবা-তাবেঈগণ এমনটি আদৌ করেন নি। তাদের নিয়ম ছিল,মৃতের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দু’আ করা এবং কবর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। ”
৩) শাফেঈ মাযহাব
কুরআনখানীর সওয়াব মৃতের নিকট না পৌঁছার ব্যাপারে ইমাম শাফেঈ রহ. কুরআনের এই আয়াত দ্বারা প্রমাণ গ্রহণ করেনঃ
وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى
“এবং মানুষ তাই পায় যা সে করে। ” (সূরা নজম: ৪৯)
এবং নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারাও প্রমাণ গ্রহণ করেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ…
“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ব্যতীত…। ” (সহীহ মুসলিম)
ইমাম নববী (রাহ:) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,“কুরআন পাঠ করে তার সওয়াব মৃতের উদ্দেশ্যে বখশানো,মৃতের পক্ষ থেকে নামায আদায় করা ইত্যাদি ব্যাপারে ইমাম শাফেঈ (রাহ:) সহ অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মত হল,এগুলোর সওয়াব মৃতের নিকট পৌঁছে না। ”ইমাম নববী সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে এ বিষয়টি একাধিক স্থানে উল্লেখ করেছেন।
’শরহুল মিনহাজ’গ্রন্থে ইব্ন নাহবী লিখেছেন,আমাদের মত হল,কুরআন পাঠের সওয়াব মৃত ব্যক্তির নিকট পৌঁছে না। ”
৪) হাম্বলী মাযহাব:
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. কাউকে কবরের নিকট কুরআন পড়তে দেখলে বলতেন,“হে লোক,কবরের নিকট কুরআন পড়া তো বিদয়াত। ”এটাই পূর্ববর্তী অধিকাংশ আলেমের অভিমত এবং ইমাম আহমদ রাহ. এর ফতোয়াও তাই। তিনি বলতেন: القراءةُ على المَيّتِ بعدَ مَوتِه بِدٌعَةٌ “মৃত্যু বরণের পর মৃতের উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করা বিদয়াত।”
তিনি আরও বলতেন,সালাফে-সালেহীন যখন নফল নামায পরতেন বা নফল হজ্জ আদায় করতেন অথবা কুরআন পাঠ করতেন তখন সেগুলোর সওয়াব মৃত মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বখশানো তাদের নিয়ম ছিল না। অতএব,পূর্ববর্তী মনিষীদের অনুসৃত পথ থেকে দূরে যাওয়া আমাদের উচিত নয়।
এখন অবশিষ্ট থাকল এই হাদীসটি: “তোমরা তোমাদের মৃতদের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসীন পাঠ কর। ”এ হাদীসটির বর্ণনাসূত্র مضطرب الإسناد (গোলযোগপূর্ণ) এবং তার বর্ণনাসূত্রে এমন বর্ণনাকারী রয়েছে যার পরিচয় জানা যায় না (مجهول السند)। সুতরাং হাদীসটি ছহীহ নয়।
সহীহ ধরে নেওয়া হলেও তার অর্থ এ নয় যে,মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসীন পাঠ কর বরং অর্থ হলো,তোমাদের যখন কেউ মৃত্যু শয্যায় শায়ীত হয় তখন তার নিকট সুরা ইয়াসীন পাঠ কর।
ইমাম আবুল হাসান বা’লী বর্ণনা করেন,মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তে অসহায় অবস্থায় কোন মানুষের পাশে কুরআন পড়া কিংবা কুরআন পড়ে তার সওয়াব বখশানো কোনটাই বৈধ নয়। কেননা,এ ব্যাপারে কুরআন-হাদীস থেকে কোন দলীল বা পূর্ববর্তী আলেমগণ থেকে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
কোন ব্যক্তি পয়সার বিনিময়ে কুরআন পাঠ করলে তার সওয়াব তো সে নিজেই পাবে না তাহলে মৃতের উদ্দেশ্যে সে কী উৎসর্গ করবে?মৃত ব্যক্তি কেবল পায় শুধু তার নিজস্ব আমলের সওয়াব। অধিকাংশ আলিমের ফতোয়া হচ্ছে, কুরআন পাঠ করার সওয়াব কেবল পাঠকই পাবে;মৃতের নিকট তা পৌঁছবে না।
কুরআন পড়ার সওয়াব মৃতের নিকট যদি পৌঁছতই তবে একজন মুসলিমও জাহান্নামে যেতনা। কেননা,আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ“
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে সে একটি নেকী লাভ করবে। আর একটি নেকী দশটি নেকীর সমান। আমি এ কথা বলব না যে, ‘‘আলীফ-লাম-মীম’ একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ,লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। ”[97]
কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমেই যদি কবরবাসীর শাস্তি লাঘব হয়ে যায়,তবে গোরস্থানে কুরআন তেলাওয়াতের টেপ রেকোর্ডার বসিয়ে রাখা হয় না কেন?রেকোর্ডকৃত তেলাওয়াত দিন-রাত গোরস্থানে বাজতে থাকবে আর তেলাওয়াতের আওয়াজে কবরবাসীদের সকল আজাব মাফ হয়ে যাবে! এরই মাধ্যমে বিবেকবানের বিবেকের উদয় হওয়া উচিত।
ফিকাহ শাস্ত্রের উসূলবীদগণের অভিমত
طَرِيْقُ الوُصُوْلِ إِلى إِبْطَالِ البِدَعِ بِعِلْمِ الأُصُوْلِ কিতাবের গ্রন্থকার বলেন,জনসাধারণ বর্তমানে যে সকল বিদ’আতী কাজ করছে তার কতিপয় উদাহরণ পেশ করা হলঃ
প্রথমত: কবরের নিকট কুরআন পড়া। উদ্দেশ্য হল,যাতে মায়্যেতের উপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করেন। আল্লাহ পাকের রহমত ও করুণার প্রতি মৃত ব্যক্তি মুখাপেক্ষি বটে; বিন্তু এই উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম তো কখনো গোরস্থানে মৃতদের উদ্দেশ্য কুরআন পড়েন নি। মৃতের প্রতি মানুষের সহানুভূতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহবায়ে কেরাম যেহেতু করেন নি তাই সেটা বিদয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, কবরের নিকট কুরআন পড়া বিদয়াত। কারণ,একথা কোনক্রমেই বোধগম্য নয় যে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু হওয়া সত্বেও এত উপকারী একটি কাজ সারা জীবনে একবারও করলেন না বা করতে বললেন না?!
দ্বিতীয়ঃ মৃত মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করা:
কুরআন পাঠ করা তো পাঠকারীর জন্য একটি ইবাদত। কুরআন নিজে পড়লে বা অন্য কারো পড়া মনোযোগ সহকারে শ্রবন করলে তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। কুরআন আল্লাহর কালাম। এতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কথা নেই। কুরআনের ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু মৃত মানুষকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান কি এটাই পর্যালোচনার বিষয়।
এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে,কুরআন মৃত মানুষের জন্যে অবতীর্ণ হয় নি;হয়েছে জীবিত মানুষের জন্য। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآَنٌ مُبِينٌ – لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ
“এতো এক উপদেশ বার্তা এবং সুস্পষ্ট কুরআন। যাতে তিনি জীবিতকে সতর্ক করেন এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ”[98]
– কুরআন নাযিল হওয়ার উদ্দেশ্য হল,কুরআন আনুগত্যশীল নেক বান্দাদের জন্য পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করবে এবং অবাধ্য ও নাফরমানদের জন্য শাস্তির বার্তা শোনাবে।
– এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এ জন্য যে,এর মাধ্যমে আমরা আমাদের মন-মানষিকতা,আচার-ব্যবহারকে সুন্দর করব এবং নিজেদের সার্বিক অবস্থাকে সংশোধন করব।
– অন্যান্য আসমানী কিতাবের মত আল কুরআন আল্লাহ তায়ালা এজন্য অবতীর্ণ করেছেন যে,এর দিক নির্দেশনা মোতাবেক মানুষ আমল করবে,খুঁজে নিবে নিজেদের জীবন চলার সঠিক পথ। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
إِنَّ هَذَا الْقُرْآَنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا – وَأَنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
“এই কুরআন অবশ্যই সর্বাধিক সরল পথ দেখায় এবং সৎকর্ম পরায়ন মুমিনদেরকে এই সুসংবাদ প্রদান করে যে,তাদের জন্যে রয়েছে মহাপুরস্কার,আর যারা পরকালকে বিশ্বাস করেনা তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। ”[99]
আপনি কখনো শুনেছেন কি যে পূর্ববর্তী জতি সমূহের মাঝে যতগুলো আসমানী কিতাব ছিল সেগুলোর কোন একটি মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে কিতাব পড়া হতো? অথবা তা পড়ার বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হত?
আল্লাহ তায়ালা তো স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দিলেনঃ
قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ – إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ – وَلَتَعْلَمُنَّ نَبَأَهُ بَعْدَ حِينٍ
“(হে নবী) আপনি বলে দিন,আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না। আর আমি তোমাদের কাছে কৃত্রিমতাও করি না। এ হল,জগত সমূহের জন্য উপদেশ বার্তা। তোমরা কিছুকাল পরে এর সংবাদ অবশ্যই জানতে পারবে। ”[100]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি কখনো মৃত সাহাবীদের উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছিলেন যেন তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়?অথচ তিনি তো ভাল করেই জানতেন যে, তারা তো নিস্পাপ নয়? গুনাহ মোচন এবং আল্লাহর দরবারে মর্যাদা বৃদ্ধির কত প্রয়োজন তাদের! তার কি এই আদর্শ ছিল না যে, কোন সাহাবী মারা গেলে তার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করতেন? কাফন-দাফন শেষ হলে সবাই চলে যেতেন নিজ নিজ কাজে আর মৃত ব্যক্তি নিজেই থাকত তার আমলের একমাত্র জিম্মাদার? এটাই তো ছিল তাঁর নিয়ম। অতএব,তার অনুসরণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য নয় কি?
মৃতের উদ্দেশ্য কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াব করা কেন শরীয়ত সম্মত নয়?
ভারতের বিখ্যাত ‘মুহাদ্দিস’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী রহ. কিতাবুল জানায়িয কিতাবে লিখেছেন,“ইমাম নববী তাঁর ‘কিতাবুল আযকার’এ উল্লেখ করেছেন যে,মুহাম্মদ বিন আহমাদ মারওয়াযী বলেছেন, তিনি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. কে বলতে শুনেছেন, “তোমরা কবরস্থানে গেলে সূরা ফাতিহা,সূরা ইখলাস,সুরা ফালাক,সুরা নাস পাঠ করে মৃতদের আত্মার উদ্দেশ্যে বখশাও। তাহলে মৃতদের কবরে এর সওয়াব পৌঁছবে। ”
কতিপয় আলেম ইমাম আহমাদ রহ. থেকে এ ধরণের বক্তব্য প্রমাণিত হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। ইমাম আহমদ ব্যতিরেকে আরও একাধিক বিদ্বান কবর যিয়ারতকালে এ সকল সূরা পাঠ করে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে বখশানোরা কথা লিখেছেন। কিন্তু হাদীসের গ্রন্থ সমূহে ব্যাপক অনুসন্ধান করেও এ ব্যাপারে কোন ছহীহ মারফু হাদীস চোখে পড়ে নি। এ প্রসঙ্গে যতগুলো মারফু হাদীস বর্ণনা করা হয়ে থাকে তার সবগুলিই দূর্বল।
কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াবের ব্যাপারে চারটি দূর্বল হাদীস পাওয়া যায় যেগুলো মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। সেগুলো হল নিম্নরূপঃ
১) আবু মুহাম্মাদ সামারকান্দী সূরা ইখলাসের ফযীলত প্রসঙ্গে লিখিত কিতাবে আলী রা. থেকে একটি মারফু হাদীস উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হল,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“যে ব্যক্তি কবরস্থানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় এগার বার কুলহু ওয়াল্লাহু পড়ে তার সওয়াব মৃতের উদ্দেশ্যে বখশিয়ে দিবে তাকে গোরস্থানের মৃতদের সংখ্যা সমপরিমাণ সওয়াব প্রদান করা হবে। ”
২) এছাড়া আবুল কাসেম যুনজানী তার ‘ফাওয়ায়েদ’ শীর্ষক কিতাবে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। সেটি হল,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,“যে ব্যক্তি গোরস্থান অতিক্রম কালে সূরা ফাতিহা এবং সূরা আত্ তাকাসুর পাঠ করে বলবে,হে আল্লাহ,আমি যতটুক তোমার কালাম পাঠ করলাম তার সবটুকু সওয়াব মুমিন-মুসলিম মৃতদেরকে প্রদান কর। তাহলে ঐ মৃতগণ তার জন্যে আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে। ”
৩) এছাড়া খাল্লাল এর শাগরেদ আব্দুল আযীয আনাস রা. থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন,“যে ব্যক্তি গোরস্থানে প্রবেশ করার পর সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে কবরবাসীরদের শাস্তি লাঘব করবেন। ”
৪) ইমাম কুরতুবী রহ. তার তাযকেরা নামক কিতাবে আনাস রা. থেকে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেন যে,“কোন মুমিন ব্যক্তি যদি আয়াতুল কুরসী পাঠ করে তার সওয়াব মৃতদের উদ্দেশ্যে বখশিয়ে দেয় তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার বিনিময়ে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত প্রতিটি কবরের মধ্যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবেন এবং প্রতিটি কবরকে প্রশস্ত করে দিবেন। আর যে পাঠ করবে তাকে ষাটজন নবীর সমপরিমাণ সওয়াব দান করবেন,সেই সাথে প্রতিটি লাশের বিনিময়ে একটি করে মর্যাদার স্তর সমুন্নত করবেন এবং দশটি করে নেকী তার আমলনামায় লিখে দিবেন। ”
এ ব্যাপারে উল্লেখিত চারটি হাদীস প্রসিদ্ধ এবং ইসালে সওয়াবপন্থী অধিকাংশ আলেম এগুলো খুব জোরে-শোরে জনসাধারণের মধ্যে বর্ণনা করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবগুলো হাদীসই দূর্বল। অধিকাংশ মুহাদ্দিস স্পষ্ট ভাষায় এ মতামতই ব্যক্ত করেছেন।
অবশ্য হাফেজ সুয়ূতী রহ. লিখেছেন,উল্লেখিত বর্ণনাগুলো দূর্বল হলেও সবগুলোর সমষ্টিগতরূপ ইঙ্গিত দেয় যে,এ সবের কিছু না কিছু ভিত্তি রয়েছে।[101]
পর্যালোচনা:
উল্লেখিত হাদীস সমূহে দুটি বিষয় আলোচিত হয়েছেঃ
একঃ কবরস্থানে কুরআন পাঠ করা।
দুইঃ মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করে সওয়াব রেসানী করা।
ইমাম আবু হানীফা রহ.গোরস্থানে কুরআন পাঠ করাকে মাকরূহ মনে করতেন। পূর্ববর্তী অধিকাংশ মনিষী এবং ইমাম আহমদ রহ. এর পূর্ববর্তী অনুসারীগণেরও একই অভিমত।
ইমাম আহমদ এর অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে,ইহা বিদয়াত। হাম্বলী মাযহাবের কতিপয় অনুসারী এটাকে মাকরূহ মনে করেন না।
ইমাম শাফেঈ রহ. তার মতের সমর্থনে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন। তাফসীরে ত্ববারীতে রয়েছে:
وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى “এবং মানুষ তাই পায়,যা সে করে।” এই আয়াতের তিনি বলেন: لَا يُثابُ أحَدٌ بفِعلِ غيرِه “একজন আরেক জনের আমলের সওয়াব পায় না।”
ইমাম শাফেঈ রহ. এখান থেকেই প্রমাণ গ্রহণ করে বলেছেন,কুরআন পাঠের সওয়াব মৃত মানুষ পায় না। তাছাড়া তিনি নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারাও প্রমাণ পেশ করেন। আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ الخ
“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার আমলের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতিত। সদকায়ে জারিয়া,এমন এলেম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং ঐ নেককার সন্তান যে তার জন্যে দুয়া করে। ” (সহীহ মুসলিম)
উপরোক্ত হাদীস এবং আয়াতের মর্মার্থ এটাই প্রমাণ করে যে, ইসালে সওয়াব করা নাজায়েয। ইমাম সুয়ূতী রহ. যে সকল হাদীস উল্লেখ করে তা যঈফ বলেছেন সেগুলো উপরোক্ত অকাট্য দলীল সমূহকে খণ্ডন করতে পারে না। অতএব সঠিক কথা হল, ইসালে সওয়াব বা সওয়াব বখশানোর পক্ষে কোন বিশুদ্ধ দলীল নাই।
এতক্ষণ যে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা উপস্থাপন করা হল তা মূলতঃ ভারতের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মাদ সাহেব গোঁদলানাওয়ালা কর্তৃক রচিত ’এহদায়ে সওয়াব’ নামক কিতাব থেকে সংকলিত।
উল্লেখিত প্রমাণপঞ্জীর আলোকে কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াবের ব্যাপারে আমাদের নিকট একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে,শারীরিক ইবাদত যথা,কুরআন তেলাওয়াত, নামায ইত্যাদির সওয়াব মৃতের কবরে পৌঁছার বিষয়টি কোন সহীহ এবং সুস্পষ্ট হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং এ ব্যাপারে যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তার সবগুলো যঈফ এবং প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য।
আফসোসের বিষয় হচ্ছে,আলেম সমাজের অবহেলা ও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে কুরআনখানীর এ বিদ্আত সমাজে এতটাই ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, জনসাধারণ এর বিপরীত কোন কথাই শুনতে নারাজ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ
“তোমার প্রতি যে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে তা তুমি প্রকাশ্যে ঘোষণা কর।”[102]
এই আয়াতের নির্দেশ অনুসারে এই বাতিল প্রথার বিরুদ্ধে সত্যের আওয়াজ উচ্চকিত করেছি। আশা করি এ কণ্ঠস্বর বাতাসে মিশে যাবে না। বরং এই লেখনী প্রয়াস ইনশাআল্লাহ ইতিবাচক এবং কার্যকর প্রভাব সৃষ্টিকারী হিসেবে প্রমাণিত হবে। যে ব্যক্তি গোঁড়ামী ও রিপু স্বার্থ পরিহার করে এই বইটি গভীরভাবে অধ্যয়ন করবে সত্যের প্রেরণা এবং স্বাধীন অন্তর অবশ্যই তাকে হক জিনিস গ্রহণ করতে আগ্রহী করবে।
وَمَا عَلَيْنَا إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
“আমাদের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া। ” (সূরা ইয়াসীন: ১৭)
কুরআনখানী ও ইসালে সওয়াব সম্পর্কে কাতার ইসলামী আদালতের মহামান্য বিচারপতি আল্লামা শায়খ আহমদ ইবনে হাজার রহ. এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য:
“…মৃতদের নিকট সওয়াব বখশানোর উদ্দেশ্যে কুরআনখানী করার প্রচলিত প্রথা বিদয়াত। যারা কুরআন ও সুন্নাহর সামান্য ঘ্রাণও পেয়েছেন তারা অবশ্যই জানেন যে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,সাহাবায়ে কেরাম এবং সম্মানিত ইমামগণ থেকে এর কোন প্রমাণ নেই। ইসালে সওয়াব কিংবা কবরের নিকট কুরআনখানীকে যারা জায়েয বলেন তারাও স্পষ্ট কোন প্রমাণ পেশ করতে পারেন নি। এরা কেবল ফকীহগণের এ একটি কথাকেই ধরে বসে আছে যে,“সকল প্রকার সৎ আমল ও নেক কাজের সওয়াব মৃতদের উদ্দেশ্যে দান করা জায়েয। ”
সর্বপ্রকার শব্দটি একটি আম বা ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ যা সর্বপ্রকার আমলকে শামিল করে। ব্যাস,একথার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীরা এটার পরিধী বাড়িয়ে দ্বীনের ভেতর এমন অনেক জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছে যা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমদিত নয়। তারা এ বিষয়টিকে মৃতের পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ আদায় করা এবং কোন কোন মাযহাব অনুসারে মৃতের পক্ষ থেকে রোযা কাযা করার উপর কিয়াস করে নিয়েছেন। (যেমন এটি ইমাম শাফেঈ রহ. এর পূর্বের মত আর ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর মাযহাব হল,কোন ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায় রোযা করার মান্নত করেছে কিন্তু তা পূরণ করার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে তাহলে তার পক্ষ থেকে রোযা আদায় করা যাবে)।
পরবর্তীকালের মানুষ কেউ অমুক শায়খের অভিমত,কেউ অমুক আলিমের বক্তব্য,কেউ অমুকের টিকাকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করে একথা একেবারে ভুলে গেছে যে,আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত সহীহ বা হাসান হাদীস ব্যতিরেকে অন্য কিছুই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
আর আলেমগণের মতামতের ব্যাপারে কথা হল,একজন আলেম যত বড়ই হোক না কেন এবং তিনি জ্ঞানের যত উচ্চ স্তরে আসীন হোক না কেন;তার কথা কেবল ততটুকুই গ্রহণীয় যা কিতাব ও সুন্নাহর অনুকুলে হয়। এ ছাড়া তার সকল মতামত এবং সিদ্ধান্ত ভুল ও সঠিক উভয়টি হওয়ার সম্ভবনা রাখে। অবশ্য তা নির্ভূল প্রমাণিত হলে তিনি দ্বিগুণ সওয়াব এবং ভুল প্রমাণিত হলে একগুণ সওয়াবের অধিকারী হবেন। তবে যে সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে,সে সকল ক্ষেত্রে অন্ধভাবে তার অনুসরণ করা কারও জন্য বৈধ নয়।
আর এ মূলনীতির প্রতি আমরা ইতোপূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছি যে, ইসালে সওয়াবের মাসআলাটি যে বা যারা চালু করেছে তারা নিঃসন্দেহে একটি ভুল বিষয় চালু করেছেন তিনি যত বড়ই পণ্ডিত হোন না কেন। কেননা কুরআন পাঠ একটি ইবাদত। আর কোন ইবাদত ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে না যতক্ষণ না তার স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ আমাদের নিজেদের একথা বলার কোন অধিকার নেই যে,অমুক কাজটি বৈধ,অমুক কাজটি মুস্তাহাব বা ওয়াজিব। আমরা শুধু এতটুকু বলতে পারি যা আল্লাহ বলেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত।
অতএব,যেহেতু মৃতের পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ সম্পাদন করার ব্যাপারে ছহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং রোযা পালনের বিষয়টি প্রমাণিত সেহেতু আমরা এদুটির বৈধতার কথা বলেছি।
আর যে সব বিষয়ে সহীহ হদীছ পাওয়া যায় না যেমন,মৃতের পক্ষ থেকে নামায পড়া,কুরআন পড়া,মৃতের জন্য মাতম করা,শোক দিবস পালন করা,চল্লিশা করা বা এ জাতীয় মনগড়া বিভিন্ন প্রথা ও অনুষ্ঠান পালনের আমরা পক্ষপাতি নই এবং তা বৈধ মনে করি না। সুতরাং কারো জন্য এ সকল দলীল বিহীন অনুষ্ঠানাদি পালন করা জায়েয নয়।
আবার এমনও হচ্ছে যে,হয়ত কোন আলেম সৎ নিয়তে বা অসতর্কতা বশতঃ কোন ভুল কাজ করে ফেলেছেন কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তার কোন ভক্ত বা অনুসারী হাদীস, তাফসির এবং পূর্ববর্তী মনীষীদের বক্তব্যকে যাচাই-বাছাই করার কষ্টসাধ্য কর্মে জড়িত না হয়ে ঐ আলেম বা বুযুর্গের উক্তি বা কাজকে অলংঘনীয় এবং চুড়ান্ত বলে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছে। উদাহরণ সরূপ বলা যায়,কতিপয় আলেম বিদয়াতকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথাঃ ১. ওয়াজিব (আবশ্যক) ২. মুস্তাহাব (উত্তম) ৩. হাসানা (ভাল) ৪. সায়্যেয়াহ (খারাপ) ৫. হারাম (নিষিদ্ধ) অথচ এ চিন্তা তাদের মস্তিস্কে উদিত হয়নি যে,বিদয়াতের প্রকারভেদ থেকে কত রকম যে বিভ্রান্তি ও গোমরাহী সৃষ্টি হয়ে সমাজে বিস্তার লাভ করবে! আর বাস্তবে হয়েছেও তাই। পরবর্তীতে মানুষ একথাই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে বেদ্আতে হাসানার নামে অসংখ্য বিদয়াত ও গুমরাহী দিয়ে তাদের বই-পুস্তক ভরে ফেলেছে। এসব বিদয়াতের মধ্যে মৃতদের উদ্দেশ্যে কুরআন খানীর বিদয়াত অন্যতম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে অসংখ্য মুসলিম ইহধাম ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন,অগণিত সাহাবা এবং তাবেঈগণের ওফাত হয়েছে কিন্তু এমন একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় না যে,কেউ কোন মৃতের উদ্দেশ্যে কবরে,মসজিদে কিংবা কোন মাহফিলে কুরআন পাঠের আয়োজন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যে সকল লোক নিজেদেরকে ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈ রহ. এর মাযহাবের অনুসারী বলে দাবি করেন,তারাই ইসালে সওয়াবকে বৈধ ভাবেন। অথচ উক্ত ইমামদ্বয় এটি বৈধতার বিপক্ষে ছিলেন যা কিনা এসব অনুসারীগণ আবার নিজেরা স্বীকারও করেন! ইমাম খাযেন রহ. এবং ইমাম ইবনে কাসীর রহ. প্রমুখ তাদের এ প্রসঙ্গটি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। এছাড়াও অন্য সকল তাফসীর এবং হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রমাণ করে যে,ইমাম শাফেঈ ও ইমাম মালেক এটাকে বৈধ মনে করতেন না।
পরবর্তী যুগের লোকেরা কিতাব, সুন্নাহ এবং সাহাবীগণের অনুসরণীয় রীতি ও কর্মপন্থাকে পাশ কাটিয়ে সম্পূর্ণ দলীল বিহীনভাবে ইসালে সওয়াবের পক্ষে বৈধতার সার্টিফিকেট দিয়েছেন। যেমনটি ইতোপূর্বে বলেছি,এরা নিজেদের আলেম ও বুযুর্গদের উক্তি এবং অভিমতকে দলীল হিসেবে ধরে এ কুপ্রথার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আর যখন কারও অভিমতকে সমর্থন করতে চায় তখন তারা নিজেদেরকে মুজতাহিদ হিসেবে জাহির করেন এবং কিছু আয়াত ও হাদীসের ভাবার্থকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করে সেগুলো যত দূর্বলই হোক না কেন। তাদেরকে যখন আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের দিকে আহবান জানিয়ে বলা হয়, এর কথা,ওর কথা বাদ দিয়ে কুরআন ও হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করুন তখন তারা বলে,আমাদের তো যোগ্যতা নাই.. আমাদের কাজ শুধু তাকলীদ করা,আমাদের জন্যে ইজতিহাদ (গবেষণা) করা জায়েয় নেই,ইজতিহাদের দরজা কয়েক শতাব্দী আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে.. ইত্যাদি ইত্যাদি কথা।
মোট কথা হল,সওয়াব রেসানী করা এবং মৃত মানুষের উদ্দেশ্যে কবরের নিকট গিয়ে অথবা মসজিদ ও মাহফিলে কুরআনখানীর আয়োজন করা সম্পূর্ণ বিদয়াত এবং গোমরাহী মূলক কাজ। এ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা অতি আবশ্যক। হাদীস শরীফে এসেছেঃ
يَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
“(দীনের ক্ষেত্রে) নতুন আবিস্কৃত বিষয়াদীর ব্যাপারে তোমরা সাবধান হও। কারণ,প্রতিটি নতুন জিনিসই বিদয়াত আর প্রতিটি বিদয়াতই গোমরাহী। [103]
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ঘোষণা করেছেনঃ
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدّ
“যে আমাদের এ ব্যাপারে তথা ইসলামী শরীয়তে এমন নতুন কিছু আবিস্কার করল যা এর অন্তর্ভুক্ত নয় তা পরিত্যাজ্য। ”[104]
♦ ♦ ♦
কবর যিয়ারত
কবর যিয়ারতের সঠিক পদ্ধতি:
কবর যিয়ারতের সুন্নত সম্মত নিয়ম হল,
১) মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্বরণ করার নিয়তে করব যিয়ারত করতে যাওয়া। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে,
زَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ ، ثُمَّ قَالَ : “ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِي ، وَاسْتَأْذَنْتُهُ أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথে যে সাহাবীগণ ছিলেন তারাও কাঁদলেন। অতঃপর তিনি বললেন,“আমি আমার মায়ের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে সে অনুমতি প্রদান করা হয়নি। তবে আমি মায়ের কবর যিয়ারতের জন্যে আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। অতএব, তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা কবর যিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। ”[105]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
أَلا فَزُورُوهَا ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ
“সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারত কর, কেননা এতে আখিরাতের কথা স্বরণ হয়।”
২) কবর যিয়ারতের দুয়া পাঠ করা। বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবীগণ কবর যিয়ারত করতে গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এই দুয়াটি পড়তে বলতেন:
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنْ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُونَ أَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةَ
“কবর গৃহের হে মুমিন-মুসলিম অধিবাসীগণ,আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ চাইলে আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হব। আমি আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করছি। ”[106]
অত:পর মৃতদের গুনাহ-খাতা ও ভুলত্রুটি মোচনের জন্য আল্লাহর নিকট দুয়া করা। যেমন কুরআনে যে আল্লাহ তায়ালা মৃতদের জন্য দুয়া শিখিয়েছেন। তিনি বলেন:
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ
“হে আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে এবং আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করে দাও যারা ঈমানের সাথে আমাদের আগে (দুনিয়া) থেকে চলে গেছে। ”[107]
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ
“ক্ষমা প্রার্থনা কর নিজের জন্য এবং মুমিনদের জন্য। ”[108]
সুনানে আবূ দাঊদে বর্ণিত হয়েছে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাফন ক্রিয়া শেষ করে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতেন,
اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ التَّثْبِيتَ فَإِنَّهُ الآنَ يُسْأَلُ
“তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা চাও। দুয়া কর যেন সে স্থির থাকতে পারে। কারণ, তাকে এখনই প্রশ্ন করা হবে।”[109]
মৃতদের জন্য হাত তুলে দুয়া করা:
দুয়া করার ক্ষেত্রে হাত তুলে দুয়া করা জায়েয রয়েছে। যেমন উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
أَنَّه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَارَ القُبُوْرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا لِأَهْلِهَا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকী গোরস্থান যিয়ারতে গিয়ে কবরবাসীদের জন্য দুহাত তুলে দুয়া করলেন।” [110]
মৃতদের জন্য সম্মিলিতভাবে দুয়া করার বিধান:
তবে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার ব্যাপারে দলীল নাই। তাই অনেক আলেম কবর যিয়ারত করার সময় একজন দুয়া করবে আর বাকি সবাই ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলবে এভাবে সম্মিলিত দুয়াকে বিদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
সউদী আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটির [111]ফতোয়া হল, “দুয়া একটি ইবাদত। আর ইবাদত দলীলের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আল্লাহর বিধানের বাইরে কারও জন্য ইবাদত করা জায়েজ নয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটি প্রমাণিত নয় যে, তিনি জানাযা শেষ করে সাহাবীদেরকে সাথে নিয়ে সম্মিলিতভাবে দুয়া করেছেন। এ ক্ষেত্রে যে জিনিসটি প্রমাণিত তা হল, মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়া সম্পন্ন হলে তিনি সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বলতেন, “তোমাদের ভাইকে এখনই প্রশ্ন করা হবে। অত:এব দুয়া কর যেন সে (প্রশ্নোত্তরের সময়) দৃঢ় থাকতে পারে।” তাহলে এ থেকে প্রমাণিত হল যে, জানাযার সালাত শেষ করে সম্মিলিতভাবে দুয়া করা জায়েয নয় এবং এটি একটি বিদয়াত।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: কবর যিয়ারতের দুয়া হিসেবে আমাদের সমাজে একটি দুয়া ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। সেটি হল,
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالْأَثَرِ
“হে কবরবাসীগণ,তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ তোমাদেরকে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। তোমরা আমাদের আগে চলে গেছ। আমরা তোমাদের অনুগামী।” (তিরমিযী)
কিন্তু এ হাদীসটি সনদগতভাবে দূর্বল-যেমনটি ইমাম আলবানী রাহ. যঈফ তিরমিযীতে উল্লেখ করেছেন। তাই সেটি না পড়ে পূর্বোল্লিখিত সহীহ মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সহীহ সনদে যে দুয়াগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পড়ার চেষ্টা করা উচিৎ। আল্লাহও তাওফীক দানকারী।
কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা:
কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা জায়েয নাই। চাই তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর হোক বা অন্য কোন কবর হোক। কারণ,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’বা শরীফ,মসজিদে নব্বী,মসজিদুল আকসা এই তিনটি মসজিদ ছাড়া কোন স্থান থেকে আলাদা সওয়াব লাভের নিয়তে সফর করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, এটি শিরকের মাধ্যম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا تَشُدُّوا الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِ الرَّسُولِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَسْجِدِ الْأَقْصَى
“তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের দিকে ভ্রমণ করা যাবে না। মসজিদুল হারাম,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদ এবং মাসজিদুল আকসা।”[112]
উক্ত হাদীসের আলোকে একদল আলেম কোন কবর, মাযার এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে নাজায়েয হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মদীনা যিয়ারতের উদ্দেশ্য হবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদে সালাত আদায় করা। কেননা সেখানে এক রাকায়াত সালাত কাবা শরীফ ছাড়া অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক হাজারগুণ বেশি সওয়াব হবে। মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করার পর তার জন্য করণীয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর যিয়ারত করা।
পরিশেষ, মহান আল্লাহর নিকট দুয়া করি, তিনি যেন আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান দান করেন এবং আমাদের সমাজ থেকে মৃত্যু, কবর ও মাযার সন্ত্রান্ত সহ সকল প্রকার শিরক বিদয়াত ও কুসংস্কাররের জমাটবদ্ধ কুহেলিকা বিদূরিত করে তা নির্ভেজাল তাওহীদ, নিখুত সুন্নাহ এবং ইলমে ওহীর বর্ণিল আলোয় উদ্ভাসিত করে দেন। সেই সাথে দুয়া করি, আমরা যেন খাঁটি মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ না করি। তিনি পরম করুণার আধার এবং সকল বিষয়ে অসীম ক্ষমতার অধিকারী।
هذا وصلى الله على نبينا محمد وعلي آله وصحبه أجمعين
_______________________________________________________________________________________
টিকা:
[1] সূরা আলে ইমরান/১৮৫
[2] সূরা বাকারা: ১৫৬ ও ১৫৭
[3] সহীহ মুসলিম: অনুচ্ছেদ: বিপদে কী পাঠ করবে?
[4] নাসাঈ ও দারেমী। আল্লামা আলবানী রাহ.উক্ত হাদীসটিকে সহীহ লি গাইরিহী বলেছেন। দেখুন: আহকামুল জানাইয
[5] বুখারী ও মুসলিম
[6] সূরা হাশর: ১০
[7] বুখারী,অধ্যায়: মৃতের পক্ষ থেকে হজ্জ এবং মানত পালন করা এবং পুরুষ মহিলার পক্ষ থেকে হজ্জ করতে পারে।
[8] সহীহ বুখারী,অনুচ্ছেদ: হঠাৎ মৃত্যু। হাদীস নং ১৩৮৮,মাকতাবা শামেলা
[9] সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: দানের সোওয়াব মৃত ব্যক্তির নিকট পৌঁছা প্রসঙ্গে
[10] সুনান আবু দাউদ, অনুচ্ছেদ: কোন ব্যক্তি যদি ওসীয়ত ছাড়াই মৃত্যু বরণ করে। তিরমিযী, মুসনাদ আহমাদ। আল্লামা আলবানী রহ. হাদীসটি সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ ও যঈফ আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮৮২, মাকতাবা শামেলা।
[11] বুখারী,অধ্যায়: মৃতের পক্ষ থেকে হজ্জ এবং মানত পালন করা এবং পুরুষ মহিলার পক্ষ থেকে হজ্জ করতে পারে।
[12] সুনান আবু দাউদ। অনুচ্ছেদ: বদলী হজ্জ সম্পাদন করা। হাদীসটি সহীহ
[13] মুসনাদ আহমাদ-(মুসনাদ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের অন্তর্ভূক্ত) আল্লামা আলবানী বলেন, বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীসটি সহীহ, দেখুন আহকামুল জানাইয
[14] সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ, কোন ব্যক্তি হঠাৎ মৃত্যু বরণ করলে তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করা এবং মানত পুরা করা মুস্তাহাব।
[15] সহীহ বুখারী ও মুসলিম।
[16] তাহাবী এবং ইবন হাযাম, ইবনুত তুরকুমানী বলেন, এ সনদটি সহীহ।
[17] এটি বর্ণনা করেন আবুদাউদ। এর সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ।
[18] আহকামুল জানায়িয, আলবানী রাহ.।
[19] সূরা নিসা: ১১
[20] বুখারী ও মুসলিম
[21] বুখারী ও মুসলিম
[22] সূরা বাকারা: ১৩৪
[23] সূরা তালাক: ৪
[24] সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: স্বামী ছাড়া অন্যের মৃত্যুতে মহিলার শোক পালন করা।
[25] সহীহ মুসলিম,অনুচ্ছেদ: শিশু ও পরিবারের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দয়া এবং তাঁর বিনয়।
[26] সহীহ বুখারী: অনুচ্ছেদ: সে আমাদের লোক নয় যে,গালে চপেটাঘাত করে। হাদীস নং ১২৯৭,মাকতাবা শামেলা
[27] ইবনে মাজাহ, অনুচ্ছেদ: মৃতকে কেন্দ্র করে চিৎকার করে বিলাপ করা নিষিদ্ধ। আল্লামা আলাবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন: দেখুন: সহীহ ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১২৮৬, মাকতাবা শামেলা
[28] আবুদাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী প্রমূখ, হাকেম বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ, ইমাম যাহাবী তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ইবনুল কাইয়েম ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম আহমদ হাদীসটির সনদ جيد (ভালো) ইমাম নব্বী বলেন, হাদীসটির সনদ হাসান।
[29] আহকামুল জানায়েজ, আলবানী রা.
[30] বুখারী ও মুসলিম
[31] সূরা তাওবা: ৩৪
[32] সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা।
[33] আবু দাউদ: অনুচ্ছেদ: মৃতের জন্য দুয়া করা। অনুচ্ছেদ নং ৬০
[34] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৭৩,
[35] বুখারী হা/১২৭৮ ও মুসলিম হা/৯৩৮
[36] সহীহ ইবনে হিব্বান, আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত।
[37] জামে তিরমিযী,হা/১৭১৭
[38] -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হা/১১৯৩৩
[39] মুসলিম, হা/ ২১২২
[40] মুসলিম হা/১০৭৯
[41] বুখারী ও মুসলিম
[42] ইবনে আবী শায়বা-আবু বকর সিদ্দীক রা. হতে বর্ণিত
[43] তাওহীদ (সিলেবাস), লেভেল-২ অনুবাদক, শাইখ আবদুল্লাহ আল কাফী
[44] সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬, মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, অধ্যায়: কিতাবুল জানায়েয, অনুচ্ছেদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করা। হা/১৪৩০
[45] জামে তিরমিযী, ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রহঃ) বলেন, হাদীসটি হাসান-সাহীহ, ইবনে হিব্বান হা/১৬২, সহীহ
[46] সউদী স্থায়ী ফতোয়া কমিটি
[47] সুনান আবু দাউদ,অনুচ্ছেদ: লোক সমাজের মাঝে অপ্রচলিত পোশাক পরিধান করা।
[48] আবু দাউদ ও বাইহাকী, সহীহ, আলবানী, আহকামুল জানায়েজ
[49] বুখারী ও মুসলিম।
[50] মুসলিম, অধ্যায়ঃ গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা হারাম
[51] সহীহ মুসলিম
[52] সুনান আবু দাউদ, অনুচ্ছেদ: লোক সমাজের মাঝে অপ্রচলিত পোশাক পরিধান করা।
[53] আবু দাউদ: অনুচ্ছেদ: মৃত্যুকে দাফন দেয়ার পর ফিরে আসার সময় দুয়া করা। আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
[54] সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তিকে ‘লাইলা ইল্লাল্লাহ’ এর তালকীন প্রদান।
[55] সুনান আবু দাউদ, অনুচ্ছেদ: তালকীন, মুআয বিন জাবাল (রা:) থেকে বর্ণিত, আল্লামা আলবানী বলেন: হাদীসটি সহীহ
[56] মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল জানায়েয, অনুচ্ছেদ:
[57] মুসলিম, হাদীস নং ১৬১৫
[58] সুত্রঃ জাল হাদীসের কবলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সালাত। অধ্যায়ঃ জানাযা, ৩৫০ পৃষ্ঠা। লেখকঃ মুযাফফর বিন মুহসিন (সামান্য পরিবর্তীত)
[59] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ গোরস্থানে প্রবেশকালে কী বলতে হয়। হাদীস নং ১৬২০
[60] সুনান আবূ দাঊদ, অধ্যায়ঃ কবরের নিকট মাইয়্যেতের জন্য দুয়া-এস্তেগফার করা। হাদীস নং ২৮০৪ ৯ম খণ্ড ২৪ পৃষ্ঠা,সহীহ আবূ দাঊদ, আলবানী।
[61] সুনান ইবনে মাজাহ,অধ্যায়ঃ মায়্যেতকে কবরে প্রবেশ করানোর ব্যপারে বর্ণনা। হাদীস নং ১৫৩৯,সহীহ, আলবানী) আফসোসের বিষয় হল,এই সুন্নাত ক্রমেই উঠে যাচ্ছে। খুব কম লোকই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ হয়ত জানাযা পড়েই চলে যায়। কেউ মাটি দিয়েই চলে যায়। কম লোক আছে যারা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মৃত ব্যক্তির সাওয়াল-জওয়াবের সময় তার দৃঢ়তার জন্য দুয়া করে।
[62] সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬, মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, অধ্যায়: কিতাবুল জানায়েয, অনুচ্ছেদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করা। হা/১৪৩০
[63] মুসলিম, অধ্যায়ঃ মানুষ মৃত্যের পর যে সব কাজের সাওয়াব লাভ করে। হাদীস নং ৩০৮৪
[64] মুসনাদে বাযযার,কিতাবুল হিলয়া, আবু নুওয়াইম। দেখুন: আল্লামা আলবানী (রাহ:) কর্তৃক রচিত সহীহুত তারগীব ওয়াত্ তারহীব। অনুচ্ছেদ: জ্ঞান ও জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত করণ। হাদীস নং ৭৩। হাসান লি গাইরিহী।
[65] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়,যে ব্যক্তি কোন ভালো নিয়ম অথবা খারাপ নিয়ম চালু করল। হাদীস নং ১০১৭
[66] সহীহ বুখারী। অধ্যায়: যে বলে আমার জমিন অথবা আমার বাগান আমার মায়ের উদ্দেশ্যে সদকা করলাম যদিও সে স্পষ্ট করে না বলে যে তা কাকে সদকা করা করা হল।
[67] সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহী, আলবানী রহ.। অনুচ্ছেদ: খাদ্য খাওয়ানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করণ। হাদীস নং ৯৬২। হাসান লি গাইরিহী।
[68] সূরা হাশর: ১০
[69] মুয়াত্তা মালেক। অধ্যায়: তাকদীর সম্পর্কে মন্তব্য করা নিষেধ। হাদীস নং ৩৩৩৮। আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। দেখুন: তাহকীক মিশকাত, হাদীস নং ১৮৬
[70] সূরা হুদ: ১১
[71] সূরা আহক্বাফঃ ৪৬
[72] সূরা রাদঃ ১৪
[73] ইবরাহীম বিন মূসা আবু ইসহাক আশ শাত্বেবী, গ্রানাডা। জন্ম: ৭২০ হিজরী। তার রচিত অন্যতম গ্রন্থ হল আল মুয়াফাকাত ফী উসূলিশ শারীয়াহ।
[74] সূরা সাজদাহঃ ১৭
[75] সূরা আহযাবঃ ৬
[76] সূরা নাজমঃ ৩৬-৪১
[77] সূরা ফাতিরঃ ১৮
[78] সূরা নজম: ৩৯
[79] সুনান নাসাঈ। অনুচ্ছেদঃ উপার্জনের প্রতি উৎসাহ প্রদান। হাদীস নং ৪৪৬১। সুনান ইবনে মাজাহ। অনুচ্ছেদঃ কামাই-রোযগারের প্রতি উৎসাহ প্রদান। হাদীস নং ২২২০। আল্লামা আলবানী রহ. বলেন: হাদীসটি সহীহ। দেখুন: সহীহ ওয়া যঈফ সুনান নাসাঈ। হাদীস নং ৪৪৪৯। ও সহীহ ওয়া যঈফ ইব্ন মাজাহ। হাদীস নং ২২৯০
[80] সূরা ইয়াসিনঃ ১২
[81] সহীহ মুসলিম। অধ্যায়ঃ যে ব্যক্তি কোন ভাল বা খারাপ পন্থা চালু করল আর যে ব্যক্তি হেদায়াত বা গোমরাহীর দিকে আহবান করল। হাদীস নং ৪৮৩১
[82] সূরা নজম: ৩৯
[83] সুরা তূরঃ ২১
[84] সূরা আনয়ামঃ ১৬৪
[85] ইনফিতারঃ ১৯
[86] সূরা লোকমানঃ ৩৩
[87] সহীহ বুখারী। অনুচ্ছেদ: স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুদী কি নিকটাত্মীয়ের অন্তর্ভুক্ত?
[88] সূরা হাশরঃ ৭
[89] মুত্তাফাকুন আলাইহ
[90] সুনান আবু দাউদ, সহীহ
[91] ইমাম নওয়াবী রহ. কর্তৃক সহীহ মুসলিমের ৩০৮২ নং হাদীসের ব্যাখ্যা। অধ্যায়: সদকার সওয়াব মৃত ব্যক্তির নিকট পৌঁছা প্রসঙ্গে।
[92] তিরমিযী। আল্লামা আলবানী রহ. হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন।
[93] সূরা হাশর: ৫৯
[94] সূরা মুহাম্মাদঃ ৪৭
[95] সহীহ মুসলিম। অনুচ্ছেদ: বাড়ীতে নফল নামায পড়া মুস্তাহাব তবে মসজিদেও পড়া জায়েয। হাদীস নং ১৮৬০ (আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত)
[96] তিরমিযী, ইব্ন উমর রা. থেকে। অনুচ্ছেদ: বাড়ীতে নফল নামায পড়া মুস্তাহাব। হাদীস নং ৪৫৩। ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।
[97] আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২/২৯৬
[98] সূরা ইয়াসীনঃ ৬৯-৭০
[99] সূরা বানী ইসরাইলঃ ৯-১০
[100] সূরা সোয়াদঃ ৮৬
[101] কিতাবুল জানাইয ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠা।
[102] সূরা হিজর/৯৪
[103] মুসনাদ আহমাদ (৩৫/৯) প্রখ্যাত সাহাবী ইরবায ইবনে সারিয়া রা. থেকে বর্ণিত।
[104] সহীহ বুখারী,অধ্যায়: কোন আমলকারী অথবা শাষক যদি ইজতেহাদ করে ফায়সালা দেয় এবং না জানার কারণে সেটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফয়সালার বিপরীত প্রমাণিত হয় তবে তা প্রত্যাখ্যাত। মুসলিম, অধ্যায়: অন্যায় বিধান ভেঙ্গে ফেলা।
[105] সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬, মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, অধ্যায়: কিতাবুল জানায়েয, অনুচ্ছেদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করা। হা/১৪৩০
[106] সহীহ মুসলিম,অধ্যায়ঃ গোরস্থানে প্রবেশকালে কী বলতে হয়? হাদীস নং ১৬২০
[107] সূরা হাশর: ৫৯
[108] সূরা মুহাম্মাদ: ৪৭
[109] সুনান আবূ দাঊদ,অধ্যায়ঃ কবরের নিকট মাইয়্যেতের জন্য দুয়া-এস্তিগফার করা। হাদীস নং ২৮০৪ ৯ম খণ্ড ২৪ পৃষ্ঠা,সহীহ আবু দাঊদ, আলবানী।
[110] সহীহ মুসলিম, জানাযা অধ্যায় হা/৯৭৪
[111] সউদী আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটি
[112] সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হজ্জ
_______________________________________________________________________________________
গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
সম্পাদনায়: শায়খ আবদুল্লাহ আল কাফী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন