Views:
A+
A-
👉 👤ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
স্পষ্টত, মনে আছে তাঁর নামটি প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে হাদিসের নামে জালিয়াতি নামের অসাধারণ একটি বইয়ের মাধ্যমে। এই বইটিই বুঝিয়ে দিয়েছিল তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের ইসলামিক পণ্ডিত আর হাদিস বিশারদ। এরপর নানাভাবে আবিষ্কার করি ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের বিনয় আর উদারতার দৃষ্টান্ত। একজন বড় মনের মানুষ ছিলেন। ‘আলেম কিংবা স্কলার বলতে আসলেই যাদের বোঝায় তাঁদের চমৎকার উদাহরণ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন মতবাদে মুসলিম উম্মাহ যখন নানাভাবে বিভক্ত, যখন সংকীর্ণতা গ্রাস করে দলকেন্দ্রিক বানিয়েছে অনেককেই, যখন কাঁদা ছোড়াছুড়ি খুব আয়েশের ব্যাপার, তখন এই ব্যক্তিটা দূরত্ব ঘুচাতে এগিয়ে এসেছিলেন, প্রান্তিকতা মোছাতে এসেছিলেন।
তাঁর কথাতে আল্লাহ্ কিছু একটা দিয়েছিলেন। তা যে-ই শুনেছে, মুগ্ধ হয়েছে। খুঁটিনাটি বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে উম্মাহর কঠিন সমস্যাগুলো নিয়ে মানুষটি বেশি বেশি বলে গিয়েছেন, কাজ করেছেন। মতবাদের বিষয় নিয়ে মানুষকে দূরে ঠেলে না দিয়ে কিভাবে কাছে টেনে বোঝাতে হয় সেই উদাহরণ রেখে গিয়েছেন আমাদের সামনে। দেশের যেকোনো অঞ্চলে কাজ করার জন্য মানুষটি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। বিভিন্ন জেলায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অহরহ ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষকে দ্বীন ইসলামের সঠিক দাওয়াত পৌঁছে দিতে।
জাহিলিয়াতকে তুচ্ছজ্ঞান করে ইসলামকে সিরিয়াসলি নিয়ে দ্বীনের পথে আসা অনেক ভাইয়ের কাছেই কথা বলে জেনেছি- যিনিই এই মানুষটার বই-লেকচার যতবার পড়েছেন-শুনেছেন ততবারই মুগ্ধ হয়েছেন। কাউকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়, আমাদের কাজ সকল ইসলামিক ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসা। কারও মধ্যে সামান্য ভুল যদি থেকে থাকে তার মানে এই নয় যে ঐ ব্যক্তির সব কাজকে আমরা তুচ্ছ বানিয়ে নেব। ব্যক্তিটাকে ধুলিস্যাত করে দিব। এই কথাগুলোই শিখিয়ে গেছেন তিনি। ঐক্য বলতে অনেকেই যখন নিজের মতের সাথে অন্যের একমত হওয়াই বুঝতে চাইলেন, নিজে যা বোঝেন অন্যেরই তা বুঝতে হবে এই মানসিকতা যখন ধারণ করলেন, তখন ড: আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর এসে বোঝালেন ঐক্য মানে মতপার্থক্য উপড়ে ফেলা নয়, মতপার্থক্যগুলো সামাল দেওয়া। ইখতেলাফী বিষয়ের প্রশ্নে তাঁর দেওয়া উত্তরগুলোই বলে দেয় কীভাবে আমরা একে অন্যকে বুঝতে পারি। পরস্পরকে কাছে টানতে পারি।
শাইখের পুরো নাম ডঃ খোন্দকার আ. ন. ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর। তিনি ছিলেন একাধারে ইসলামী চিন্তাবিদ, টিভি আলোচক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট ‘আলেমে দ্বীন, গবেষক ও লেখক। তিনি পিস টিভি, ইসলামিক টিভি, এটিএন ও এনটিভি, চ্যানেল নাইন সহ বিভিন্ন টিভিতে ইসলামের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেল আইটিভি ইউএস-এর উপদেষ্টা ছিলেন। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, মসজিদের খুতবায় ও টিভি আলোচনায় খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে দেশের সহজ-সরল মুসলমানদের ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়গুলো আলোচনা করে জনসচেতনতা তৈরি করে আসছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বিস্তারিত উত্তর প্রদানে পারদর্শীতাই তাঁর জ্ঞানের গভীরতা প্রমাণ করে।
এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহের ধোপাঘাট গোবিন্দপুর গ্রামে। তার পিতা খোন্দকার আনওয়ারুজ্জামান ও মা বেগম লুৎফুন্নাহার। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৭৫ সালে আলিম এবং ১৯৭৭ সালে ফাজিল ও ১৯৭৯ সালে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল পাস করার উচ্চতর শিক্ষার জন্যে সৌদি আরব গমন করেন। রিয়াদে অবস্থিত ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাঊদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৮৬ সালে অনার্স, ১৯৯২ সালে মাস্টার্স ও ১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে দেওয়া ডঃ আব্দুস সালাম আযাদীর ভাষ্যমতে, “বিদেশিদের মাঝে তিনি ইসলামের দাওয়াত ছড়াতেন। ইংরেজিতে খুব ভালো ছিলেন বলে আমেরিকান সেনা ছাউনিতে তিনি ইসলাম পৌঁছানোর কাজ করতেন। … ড. জগলুল নাজ্জার ও জাহাঙ্গীর ভাইদের দাওয়াতে তিন শতাধিক সৈন্য মুসলিম হয়ে যায়।”
ছাত্র জীবনে তুখোড় মেধাবী হিসেবে পরিচত ছিলেন তিনি। রিয়াদের মুহাম্মাদ বিন সাউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বর্তমান সৌদি বাদশা ও তৎকালীন রিয়াদের গভর্নর সালমান বিন আব্দুল আজিজের হাত থেকে পর পর দু’বার সেরা ছাত্রের পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায, বিন উসায়মিন, আল জিবরিন ও আল ফাউজানের মতো বিশ্ববরেণ্য স্কলারদের সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর রিয়াদ ইসলামি সেন্টারে দাঈ ও অনুবাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
লেখাপড়া শেষ করে ১৯৯৮ সালে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়া থেকে ইসলামি উন্নয়ন ও আরবি ভাষা বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকার দারুস সালাম মাদ্রাসায় খণ্ডকালীন শায়খুল হাদিস হিসেবেও পাঠদান করতেন। বাংলা ইংরেজি ও আরবি ভাষায় সমাজ সংস্কার, গবেষণা ও শিক্ষামূলক প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি ভাষায় A Woman From Desert(1995), Guidance For Fasting Muslims (1997), A Summary of Three Fundamentals of Islam (1997); আরবি ভাষায় লিখিত আদাবুল হাদিস’ (২০০৭); বাংলায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো হাদিসের নামে জালিয়াতি, এহইয়াউস সুনান ও কুর’আন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, রাহে বেলায়েত, রোযা, ইসলামের তিন মূলনীতি, একজন জাপানি নারীর দৃষ্টিতে হিজাব, কোরআন সুন্নাহর আলোকে পোশাক ও সাজসজ্জা সহ অনেক মুল্যবান গ্রন্থ। তাছাড়া তিনি মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আবু হানিফা রাহঃ রচিতআল-ফিকহুল আকবার এবং ইযহারুল হকসহ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন।
ড. আবদুল্লাহ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, যুগ সচেতন এবং উম্মাহর ঐক্যবিধানে তৎপর একজন মানুষ। “তাঁর কাছেই শিখেছি ভিন্নমতের কাউকে কীভাবে শ্রদ্ধা করতে হয়। বিনয়ের এক অমর শিক্ষক শায়েখ (রা.)কে দেখেই অনুভব করেছি প্রকৃত আলেমের চরিত্র!” ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে এভাবেই স্মৃতিচারণ করে কথাগুলো বলছিলেন শায়খ হাসান জামিল (হফেজাহুল্লাহ)। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। ছেলে ওসামা খন্দকার সৌদি আরবের রিয়াদ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত।
ঝিনাইদহ শহরের গোবিন্দপুরে আল ফারুক একাডেমি ও আস সুন্নাহ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন বরেণ্য এই ইসলামী ব্যক্তিত্ব। সেখানে ছেলেমেয়েদের হেফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব হিসেবে কাজ করেছেন শিক্ষা ও ঝিনাইদহের চ্যারিটি ফাউন্ডেশনে, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইনস্টিটিউটের। আমৃত্যু তিনি ঝিনাইদহ জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
শাইখের কিছু কথা উল্লেখ না করে পারছি না। একটি সাক্ষাৎকারে শাইখ দাওয়াতের ক্ষেত্রে বলছিলেন-
❝দা’ওয়াতের ক্ষেত্রে একটা হলো “প্রায়োরিটি নির্ধারণ” – কোন বিষয়টার দা’ওয়াত আগে দেবো? – এটা আমরা ভুলে যাচ্ছি, বা ভুল করছি। এজন্য আমাদের ওয়াজ-মাহফিলে অগণিত দা’ওয়াত হচ্ছে, কিন্তু ঈমান, তাওহীদ, শির্ক, বান্দার হক – এ বিষয়গুলো দা’ওয়াতে আসছে না। মানুষের সেবা এটাও …
অথচ, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর নববী দা’ওয়াতের – নবীওয়ালা দা’ওয়াতের মূল অংশ ছিল কিন্তু এগুলো। দ্বিতীয়ত, যেটা বলছিলাম সেটা হলো – “ভাষা” – দা’ওয়াতের পদ্ধতি। আমরা যত কাজ করছি রাজনীতি বলেন, মাদ্রাসা বলেন, ওয়াজ-মাহফিল বলেন, কাফেলার দা’ওয়াত বলেন, সবাই আমরা দা’ওয়াত করছি। অর্থাৎ, নিজের জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার পরে অন্যদেরকে জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার করতে আহ্বান করছি। এ আহ্বানকারীর সিফাত কী হবে? – যাকে ডাকছি তাকে ভালোবাসা। … মক্কায় দা’ওয়াত দিতে দিচ্ছে না। তাঁর চাচা মারা গিয়েছেন। অত্যাচার! দৌহিক অত্যাচার … তায়েফে গেলেন। সারা দেহ রক্তাক্ত করে ছেড়েছে। তায়েফে অত্যাচার, মক্কায় অত্যাচার। ফিরে আসছেন মক্কার পথে, কোন সহায় নেই! জিবরীল (আলায়হিস আলাম) পাহাড়ে ফেরেশতা নিয়ে চলে এসেছেন – “ইয়া রসূলাল্লাহ, আপনি অনুমতি দিলে পাহাড় উল্টিয়ে দিয়ে জনপদ ধ্বংস করে দেয়া হবে …”
চিন্তা করেন, আমার যদি এ রকম হতো, তাহলে – “আল্লাহ, এক্ষুণি দাও! বুঝুক! আমার গায়ে হাত দেয়া উচিত না।” অথচ, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কী বলেছেন? “নাহ, হতে পারে এরা কাফের হয়ে চলে যাবে, কিন্তু এদের বংশ, প্রজন্ম, পরের প্রজন্ম কেউ হয়তো আল্লাহর ইবাদত করবে। তাওহীদ মানবে। কাজেই এদের ধ্বংস করার দরকার নেই।“(আল্লাহু আকবার) এই ভালোবাসা নিয়ে বিনম্রতার সাথে দা’ওয়াত দিতে হবে। আল্লাহ কুরআনুল কারীমে বলছেন, মূসা (আলায়হিস সালাম)-কে দা’ওয়াতের জন্য পাঠালেন ফিরাউনের কাছে। সবচেয়ে অন্যতম ভাল নবীদের শ্রেষ্ঠ একজনকে পাঠালেন সবচেয়ে বড় তাগুতের কাছে এবং বলেও দিলেন যে, এ তোমাদের কখনও ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু … فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ
“তাদেরকে নরম করে বলো, তোমার ভাষার বিনম্রতায় … হয়তো ভাল (অনুধাবন করবে ও ভীত) হয়ে যেতেও পারে।” [সূরা তাহা, আয়াত ৪৪]
“তাদেরকে নরম করে বলো, তোমার ভাষার বিনম্রতায় … হয়তো ভাল (অনুধাবন করবে ও ভীত) হয়ে যেতেও পারে।” [সূরা তাহা, আয়াত ৪৪]
তাহলে দুনিয়াতে আমরা যাকে দা’ওয়াত দিচ্ছি – রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ, বিরোধি দল, অন্য দল, অন্য শত্রু – “অন্য মতের লোক” … তারা কি ফেরাউনের চেয়ে খারাপ? না, আমরা মূসার চেয়ে ভালো? তাহলে আমাদের কত বিনম্র হওয়ার দরকার? মূল সমস্যা হচ্ছে, আমরা আমাদের “ব্যবসার” চেতনাটা ভুলে গেছি। আমরা তো আল্লাহর সাথে ব্যবসা করছি। আমরা আল্লাহর সাথে ব্যবসা করছি যদি আমরা এই ব্যবসায় ওই ব্যক্তিকে হিদায়াত করতে পারি।
আল্লাহর সাথে ব্যবসা মানে কোন রকমে এই লোকটাকে আল্লাহর পথে আনলে আজীবন আমি এর কমিশনটা পাবো। কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব পাবো …❞
গত ১১ই মে ২০১৬ তে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজি’উন। (আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি। আর তাঁর কাছেই ফিরে যাবো)। তাঁর মৃত্যুতে যেভাবে শোকের ছায়া নেমে এসেছে দেশজুড়ে তা কেবল এই অসাধারণ মানুষটির প্রতি সবার অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাকেই জানান দেয়। আল্লাহ তার গুনাহ সমূহ মাফ করে দিক। তাঁকে শহীদের মর্যাদায় জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুক। আমাদেরকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফীক দান করুক।
খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
খোন্দকার আবু নাসর মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর | |
জন্ম | |
মৃত্যু | ১১ মে ২০১৬ মাগুরা |
জাতীয়তা | |
পেশা | |
লক্ষণীয় কাজ | ওয়াজ নসিহত, রাহে বেলায়য়েত, হাদীসের নামে জালিয়াতি, এহয়ায়ুস সুনান, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, আল-ফিকহুল আকবরঃ অনুবাদ |
ওয়েবসাইট | আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট |
খোন্দকার আ. ন. ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের একজন ইসলামী ব্যক্তি, লেখক ও গবেষক। তিনি ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, টিভি আলোচক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আল হাদীস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত, গবেষক ও লেখক। তিনি পিস টিভি, ইসলামিক টিভি, এটিএন বাংলা, এনটিভি, চ্যানেল নাইন সহ বিভিন্ন টিভিতে ইসলামের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন এবং মার্কিন ইসলামী টেলিভিশন চ্যানেল আইটিভি ইউএস-এর উপদেষ্টা ছিলেন। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সহজ ও নম্র ভাষায় বিস্তারিত উত্তর প্রদানে তিনি সমাদৃত ছিলেন।
পরিচ্ছেদসমূহ
প্রাথমিক জীবন, শিক্ষা ও কর্মজীবন
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের জন্ম হয় ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহের ধোপাঘাট গোবিন্দপুর গ্রামে। তার পিতা খোন্দকার আনওয়ারুজ্জামান এবং মাতা বেগম লুৎফুন্নাহার। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৭৫ সালে আলিম এবং ১৯৭৭ সালে ফাজিল ও ১৯৭৯ সালে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল পাস করার উচ্চতর শিক্ষার জন্যে সৌদি আরব গমন করেন। রিয়াদে অবস্থিত আল ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৮৬ সালে অনার্স, ১৯৯২ সালে মাস্টার্স ও ১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। রিয়াদের মুহাম্মাদ বিন সাউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি তৎকালীন রিয়াদের গভর্নর সালমান বিন আব্দুল আজিজের হাত থেকে পর পর দু’বার সেরা ছাত্রের পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায, মুহাম্মদ বিন উসায়মিন, আল জিবরিন ও সালিহ আল-ফাউজান-সহ স্কলারদের সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর রিয়াদ ইসলামি সেন্টারে দাঈ ও অনুবাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে ১৯৯৮ সালে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়া থেকে ইসলামি উন্নয়ন ও আরবি ভাষা বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকার দারুস সালাম মাদ্রাসায় খণ্ডকালীন শায়খুল হাদিস হিসেবেও পাঠদান করতেন।
কর্মকান্ড
তিনি সর্বদা মানুষকে ইসলামমুখী করার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। মানুষের ইসলামী উন্নতির চিন্তা করতেন। এজন্য তিনি এলাকার মুসলামানদের ইসলামী শিক্ষাকে সহজ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলাম-শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন। এক্ষেত্রে তিনি ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই পৃথকভাবে পর্দার সাথে কুরআন হিফয করা ও অন্যান্য ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের ইসলামী জ্ঞান লাভ সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাভাষায় ধর্মীয় বই-পুস্তক রচনা করেছেন। তার মধ্যে একটি চিন্তা ছিলো সমাজের মানুষের পরিবর্তন দরকার, মহিলাদের পরিবর্তন দরকার। তাদেরকে খারাপ পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে ভালো কাজে সম্পৃক্ত করা দরকার। এজন্য এলাকাবাসীদের নিয়ে তার মসজিদে নিয়মিত মাসিক মাহফিলের পাশাপাশি বার্ষিক মাহফিলের আয়োজন করতেন। এলাকার অন্যান্য মসজিদেও মাসিক মাহফিল আয়োজনের চেষ্টা করেছেন এবং তিনি নিজে বা তার প্রতিনিধি পাঠিয়ে মাহফিলগুলোর মাধ্যমে মানুষের মাঝে ইসলামী সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশে খ্রিস্টান ধর্মান্তকরণ ও খ্রিস্টান মিশনারীদের তৎপরতার প্রতিরোধে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। ওয়াজ-মাহফিল ও বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে তিনি তাদের সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এছাড়াও স্থানীয় আলেম ও ইমামগণকে নিয়ে ইলমী ইজতিমার আয়োজন করেন। ইসলাম প্রচারে তার বহুমুখী পদক্ষেপসমূহ নিম্নরূপ :
ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
ঝিনাইদহ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কওমী ও আলিয়া ধারার ছাত্রদেরকে যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৪৩৩ হিজরীতে ‘উচ্চতর হাদীস গবেষণা বিভাগ ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও মুসলিম-অমুসলিম সকলের মাঝে দাওয়াতী কাজের যোগ্য লোক তৈরি করা , খ্রিস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতা ও অপপ্রচার প্রতিরোধে যোগ্য দাঈ তৈরি করা এবং সাধারণ মুসলিমদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে ১৪৩৪ হিজরীতে ‘ উচ্চতর দাওয়াহ ও তুলনামূলক ধর্মবিজ্ঞান বিভাগ ’ প্রতিষ্ঠা করেন। আগে ‘আল ফারুক একাডেমী’ নামে আলিয়া মাদরাসার আদলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান ও একটি হিফয খানা চালু ছিলো। এই প্রতিষ্ঠানের শিশু ও কেজি শ্রেণিতে বিভিন্ন কিন্ডার গার্টেনের জন্য রচিত অপেক্ষাকৃত ভালো বই পড়ানো হতো। ইতঃপূর্বে প্রতিষ্ঠানটি দাখিল বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছিলো এবং আলিয়া ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের দ্বারা পাঠদান করানো হতো। তিনি যখন দেখলেন, আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ছেলেদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের যোগ্যতা তৈরি হচ্ছে না, এছাড়াও আনুষঙ্গিক নানা কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ধর্মীয় সচেতনতা ও ধার্মিকতার অভাবও প্রকট, তখন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ইসলামের কাজে সহযোগী শামসুল আরেফিনের পরামর্শে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে কওমী মাদরাসা কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। হিফজ বিভাগসহ সকল বিভাগে কওমী ধারার উলামাকে সম্পৃক্ত করেন। পরবর্তীতে ১৪৩৪ হিজরী শাওয়াল থেকে তিনি কিতাব বিভাগ চালু করেন। এছাড়াও এলাকার শিশুদের ইসলামের মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে প্রাইমারী শিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্ডার গার্টেন বাদ দিয়ে জানুয়ারী ২০১৫ থেকে যোগ্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে হাটহাজারী নূরানী বোর্ডের অধীনে চার বছর মেয়াদী আবাসিক-অনাবাসিক নূরানী মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি ঝিানাইদহ জেলার হরিশঙ্করপুর ইউনিয়নের ভোজঘাট গ্রামে ও চুয়াডাঙ্গা জেলার পদ্মবিলা ইউনিয়নের সুবদিয়া গ্রামে ‘ মারকাযুস সুন্নাহ ’ নামে দুটি নূরানী মক্তব পরিচালনা করতেন। ঝিনাইদহ জেলায় তেমন কোনো কওমী মাদরাসা নেই, সহশিক্ষাযুক্ত কিছু আলিয়া মাদরাসা আছে, তবে বর্তমানে ঝিনাইদহ শহরে কিছু মক্তব ও হিফয খানা গড়ে উঠেছে, তিনি এসকল মাদরাসার সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক রাখতেন। এ সকল মাদরাসার অনুষ্ঠানে উপস্থিত লোকদের মাঝে খুব জোরালোভাবে প্রচলিত শিক্ষার বিপরীতে ইসলামী শিক্ষার্জনের অপরিহার্যতার বিষয়ে যৌক্তিক ও তথ্যপূর্ণ আলোচনা করতেন।ঝিনাইদহ এলাকায় ইসলামী জ্ঞানে অভিজ্ঞ এবং তাকওয়া, আখলাক, আদব ও সমাজ সচেতন নারী তৈরি করার লক্ষ্যে ১৪৩৫ হিজরীতে পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থাপনায় বালিকা হিফজ বিভাগ ও কিতাব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।
ধর্মপ্রচার কার্যক্রম
প্রতি ইংরেজি মাসের প্রথম শুক্রবার আস-সুন্নাহ জামে মসজিদে মাসিক মাহফিলের আয়োজন করতেন। উক্ত মাহফিলে তিনি নিজেই মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত আলোচনা করতেন এবং এশার নামাযের পর মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। উক্ত মসজিদের নীচ তলায় মাহফিলের আয়োজন করা হতো আর দ্বিতীয় তলায় মহিলাদের জন্য পৃথকভাবে বসে ওয়াজ শোনার ব্যবস্থা থাকত। মহিলাদের মাঝে ইসলামী চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে তার নেয়া প্রথম পদক্ষেপ ছিলো পরিপূর্ণ পর্দার সাথে মহিলাদের ওয়াজ শোনার ব্যবস্থা করা। পর্দা রক্ষার্থে মহিলাদের আসা-যাওয়ার রাস্তাও পৃথক ছিলো। তিনি সাধারণত মহিলাদেরকে ওয়াক্তিয়া নামায মসজিদে না এসে ঘরে আদায় করার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু বাজার , স্টেশন বা জনসমাগমপূর্ণ রাস্তার পার্শ্ববর্তী মসজিদসমূহে মহিলাদের পৃথকভাবে নামাযের ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেন, যেন মহিলাদের নামায কাযা না হয়ে যায়। তবে জুমার বয়ান শোনার উদ্দেশ্যে কেবল শুক্রবারে মহিলাদেরকে তার মসজিদে আসার কথা বলতেন। তিনি ঝিনাইদহ জেলার সকল থানার বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মুয়াযযিনদের নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানস্থ মসজিদে প্রায় মাসেই ‘ ইলমী ইজতিমা ’-এর আয়োজন করতেন। এখানে নির্দিষ্ট দিন আসরের পর থেকে পরবর্তী দিন সকাল আটটা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও প্রশিক্ষণ, কুরআন মশক, প্রশ্নোত্তর পর্ব ও ইমামগণের প্রশিক্ষণমূলক আলোচনার মাধ্যমে মজলিসটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো। উল্লেখ্য, প্রতি ‘ ইলমী ইজতিমা ’য় একটি বই নির্ধারণ করে দেয়া হতো যে বইটি পাঠ করার পর পরবর্তী ‘ ইলমী ইজতিমা ’য় সে বিষয়ক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ইমাম ও মুয়াযযিনগণের ইলমী জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চালানো হতো। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকলকে পুরস্কৃত করা হতো এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীগণকে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান করা হতো। উক্ত অনুষ্ঠানে তিনি নিজে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠানের যোগ্য উলামায়ে কেরামগণ দ্বারা বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ব্যবস্থা করতেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ইসলামী অনুষ্ঠানে ‘ আলোচক’ হিসেবে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। জাতি ও সমাজ-গঠনমূলক অনুষ্ঠানের তুলনায় টিভি চ্যানেলগুলো যেহেতু অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার প্রচার-প্রসারে বেশি ব্যবহৃত হয় তাই এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন, যেন ইসলামী অনুষ্ঠান দেখার নামে কেউ অশ্লীলতার কবলে পড়ে না যায়। এজন্য তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ও মাহফিলে তার রচিত ধর্মীয় গ্রন্থগুলো পড়তে মানুষকে উৎসাহিত করলেও ‘ টিভি প্রোগ্রামগুলো ’ দেখতে কাউকে উৎসাহিত করতেন না। তার সমাজ-গঠনমূলক অনুষ্ঠানগুলো পরিবারস্থ লোকজনকে দেখানোর জন্য নিজের বাসায়ও কোনো টিভি ছিলো না। তিনি প্রায়ই বলতেন, যারা টিভিতে সারাক্ষণ নাচ-গান দেখে তারা যেন এর ফাঁকে ভালো কিছু দেখে বা দেখতে চাইলে দেখতে পারে সে জন্যই সেখানে যাওয়া, যদি এর মাধ্যমে কেউ সঠিক পথ লাভ করে। লেখালেখির সকল কাজ তিনি নিজেই করতেন। তিনি কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রোগ্রাম সম্পর্কে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং নির্ভুলভাবে খুব দ্রুত লিখতে পারতেন। ইন্টারনেট , অনলাইনভিত্তিক টিভি চ্যানেল, ওয়েবসাইট , ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তিকে ইসলামী দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতেন; যেন এসবের মাধ্যমে মানুষ হেদায়েত লাভ করতে পারে[২]।
সামাজিক কর্মকান্ড
মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী ইসলানী চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদেরকে ইসলাম শেখানোর ব্যবস্থা করেন। এ লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষিত ও দুঃস্থ মহিলাদের মাঝে ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী চেতনার প্রসারে ছয় মাস ব্যাপী কুরআন তিলাওয়াত সহীহ করা ও ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানোর পাশাপাশি স্থানীয় সমাজ-সেবা অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিকার মাধ্যমে সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেখানে প্রতিদিন দুই ঘন্টাব্যাপী ক্লাসের অর্ধেক সময় ধর্মীয় বিষয়াদির জন্য বরাদ্দ থাকতো। প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে সনদপত্র দেয়ার ক্ষেত্রেও ইসলামী ক্লাসে নিয়মিত অংশগ্রহণ শর্ত ছিলো। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কয়েকজনকে পুরস্কার স্বরূপ সেলাই মেশিন ও সেলাই উপকরণ প্রদান করা হয়।আর্ত মানবতার সেবা ও মানুষদেরকে ইসলামী পরিবেশের সাথে পরিচিত করার মাধ্যমে ইসলামমুখী করার লক্ষ্যে প্রতি শুক্রবার মাদরাসায় স্থানীয় সরকারী হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক দ্বারা রোগী দেখার ব্যবস্থা করেন। সেখানে রোগীদেরকে বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র ও জরুরি ঔষধ প্রদান করা হয়। তিনি নওমুসলিমদের প্রতি সবিশেষ খেয়াল রাখতেন এবং বেশ কয়েকজন নওমুসলিমকে তার তত্ত্বাবধানে রেখে পড়াশোনা ও অন্যান্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
দৃষ্টিভঙ্গি
আমলের চেয়ে আকীদাকে অধিক গুরুত্বদান
আচরণের নম্রতা ও অহংকারহীনতার গুরুত্ব
সুফিবাদ ও সালাফিবাদের সাধারণ বিষয়সমূহঃ তাজকিয়া-আন-নাফস
মাযহাবসহ সকল বিষয়ে মধ্যমপন্থা
কুরআন হাদীস সহ সকল ইলমি বিষয় সরাসরি অধ্যয়নে উৎসাহদান
আল্লাহ ও বান্দার মাঝে অন্য কারও দ্বারা মধ্যস্ততাকে শিরক বলে গণ্য করা
ইসলামী রাজনীতিকে গনতন্ত্র বলে উল্লেখ করা
লেখনী , আলোচনা ও ওয়াজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
তিনি খুব সহজ-সরল ভাষায় আলোচনা ও ওয়াজ করতেন। আলোচনা ও লেখনীতে অনেক কঠিন ও জটিল বিষয়কে সহজ সরল বাংলায় সর্বসাধারণের বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করতেন। ইংরেজি বলা ও লেখায় যথেষ্ট পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও আলোচনায় ইচ্ছাকৃতভাবে ইংরেজি শব্দ পরিহার করতেন যেন সাধারণের বুঝতে অসুবিধা না হয়। র্শিক , বিদআত , সুন্নাতের গুরুত্ব ও সুন্নাহ অনুসরণ , বান্দার হক্ব , আত্মীয়তার হক্ব , সমকালীন প্রসঙ্গ, সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়সহ অন্যান্য সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ প্রয়োজনীয় বিষয় সহজ ও সাবলীলভাবে আলোচনা করতেন। সাধারণত আলোচনায় আকীদা ও ফিকহী জটিল বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে যুবকদেরকে সম্বোধন করে আলোচনা করতেন। তাদের আবেগ-অনুভূতি ও বিভ্রান্তির বিষয়গুলো তুলে ধরে দরদমাখা ভাষায় সংশোধনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। এ কারণে যুবকদের বড় একটি শ্রেণি তার ভক্ত ছিলো। তার আলোচনার শেষে সাধারণত একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকতো। তিনি মানুষের লিখিত বিভিন্ন প্রশ্নের দলিলভিত্তিক উত্তর দিতেন। কোনো বিষয়ে জানা না থাকলে উত্তর দিতেন না। টিভিতে বা মাহফিলের প্রশ্নোত্তর পর্বে তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে উত্তর না দিয়ে স্থানীয় আলেমদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিতেন। এছাড়াও তিনি তার ওয়াজ-মাহফিল এবং সেমিনারগুলোর আলোচনায় আধুনিক শিক্ষিত সালাফী ব্যক্তিবর্গকে প্রান্তিকতা পরিহার করে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।
মৃত্যু
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ২০১৬ সালের ১১ই মে মাগুরায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে নিজ মাইক্রোবাস ও কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষে গাড়িচাপার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে নিহত হন।[৩][৪] কিছু স্থানীয় আলেম দাবি করেন যে, খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর প্রচারনার বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করার কারণে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে[৫]। ১৮ মে ২০১৬ তারিখে, তার নিজ কর্মস্থল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্মরণে বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়[৬]। ৪ জুন ২০১৬ তারিখে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের স্মরণে বাংলাদেশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদ কর্তৃক আয়জিত আলোচনা সভায় বক্তারা তাকে "নিরহংকারী আলেম" অভিহিত করে বলেন, "তিনি বড় মাপের একজন জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও কখনই অহংকার আসতে পারে এমন কোন কথা বলতে ও কাজ করতে আমরা দেখিনি। কঠিন ও জটিল মাসয়ালাকে সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। তিনি নির্মল হদয়ের একজন মানুষ ছিলেন।"[৭]।
রচিত গ্রন্থাবলি
তিনি ছোট-বড় ত্রিশের অধিক অনুবাদ , ব্যাখ্যা ও গবেষণামূলক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার মৌলিক গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ এহইয়াউস সুনান’, ‘ রাহে বেলায়াত ’, ‘ খুতবাতুল ইসলাম’ এবং সর্বশেষ রচনা ‘ পবিত্র বাইবেল : পরিচিতি ও পর্যালোচনা ’; যেটি ছাপানোর কাজে ঢাকায় যাওয়ার পথে তিনি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হন। তিনি তার রচনাসমূহে যে কোনো বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মৌলিক ও প্রাচীন গ্রন্থসমূহের ওপর নির্ভর করতেন। সালাফী দাওয়াত দ্বারা প্রভাবিত অনেক যুবকের মাঝে তার বইপত্রগুলো বেশ সমাদৃত হয়। তিনি বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় সমাজ সংস্কার, গবেষণা ও শিক্ষামূলক প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি ভাষায় :
A Woman From Desert (1995)
Guidance For Fasting Muslims (1997)
A Summary of Three Fundamentals of Islam (1997)
আরবি ভাষায় লিখিত :
بُحُوثٌ في عُلُومِ الْحَدِيْث
বাংলায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো :
হাদীসের নামে জালিয়াতি[৮]
এহইয়াউস সুনান
কুর’আন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা
রাহে বেলায়াত
ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ[৯]
খুতবাতুল ইসলাম
একজন জাপানি নারীর দৃষ্টিতে হিজাব
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে পোশাক, পর্দা ও দেহ-সজ্জা সহ অনেক মুল্যবান গ্রন্থ। তাছাড়া তিনি :
মুসনাদে আহমাদ
ইমাম আবু হানিফা রচিত :
আল-ফিকহুল আকবার
এবং রাহমাতুল্লাহ কিরানবী (রাহিঃ) রচিত :
ইযহারুল হক্ব সহ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন।
তথ্যসূত্র
↑ [১]
↑ "পদদলনের ঘটনায় অধ্যাপক এবং গবেষক ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের মন্তব্য"। Voice of America Bangla। ১১ জুলাই ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "সড়ক দুর্ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিহত"। প্রথম আলো। ১২ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "IU professor among 5 killed in road crashes"। The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ১১ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৩ এপ্রিল ২০১৯।
↑ "ইসলামী চিন্তাবিদ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত"। দৈনিক ইনকিলাব। ১২ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০১৯।
↑ "ইবিতে ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্মরনে দোয়া ও আলোচনা সভা || দেশের খবর"। দৈনিক জনকন্ঠ (ইংরেজি ভাষায়)। ১৮ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "'ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর ছিলেন নিরহংকারী আলেম'"। নিউজনেক্সটবিডি ডটকম। ৫ জুন ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "জাল হাদিস : যার পীর নেই তার পীর শয়তান"। Odhikar।
↑ "কোন পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটায় | কালের কণ্ঠ"। Kalerkantho। কালের কন্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
বহিঃসংযোগ
আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট ওয়েবসাইট
↑ [১]
↑ "পদদলনের ঘটনায় অধ্যাপক এবং গবেষক ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের মন্তব্য"। Voice of America Bangla। ১১ জুলাই ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "সড়ক দুর্ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিহত"। প্রথম আলো। ১২ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "IU professor among 5 killed in road crashes"। The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ১১ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৩ এপ্রিল ২০১৯।
↑ "ইসলামী চিন্তাবিদ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত"। দৈনিক ইনকিলাব। ১২ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০১৯।
↑ "ইবিতে ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্মরনে দোয়া ও আলোচনা সভা || দেশের খবর"। দৈনিক জনকন্ঠ (ইংরেজি ভাষায়)। ১৮ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "'ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর ছিলেন নিরহংকারী আলেম'"। নিউজনেক্সটবিডি ডটকম। ৫ জুন ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
↑ "জাল হাদিস : যার পীর নেই তার পীর শয়তান"। Odhikar।
↑ "কোন পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটায় | কালের কণ্ঠ"। Kalerkantho। কালের কন্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৯।
বহিঃসংযোগ
আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট ওয়েবসাইট
আপনি চাইলে -Whatapps-Facebook-Twitter-ব্লগ- আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking-ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন-মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]-
সম্পর্কযুক্ত আরো পোষ্ট পড়ুন: অন্যান্য পোষ্ট,
আখলাক ব্যাক্তিত্ব,
Bangla Waz Download Now
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন