Views:
A+
A-
শিক্ষা ও মাসায়েল:
শিক্ষা ও মাসায়েল:
শিক্ষা ও মাসায়েল:
রমযানের বিষয়ভিত্তিক হাদিস : শিক্ষা ও মাসায়েল (২য় পর্ব)
আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلا تَدَعُوهُ وَلَو أَنْ يَجرَعَ أحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ ومَلائِكتَهُ يُصَلُّونَ عَلى المُتسَحِّرينَ» رَوَاهُ أَحْمَد.
“সেহরি বরকতময় খানা, তোমরা তা ত্যাগ কর না, যদিও তোমাদের কেউ একঢোক পানি গলাধঃকরণ করে, কারণ আল্লাহ সেহির ভক্ষণকারীদের ওপর রহমত প্রেরণ করেন ও ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন”।[1]
আব্দুল্লাহ ইব্ন হারেস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক সাহাবি থেকে বর্ণনা করেন: “এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেন, তখন তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন, তিনি বললেন:
إِنَّ السَّحُورَ برَكَةٌ أَعْطَاكُمُوهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فَلا تَدَعُوهَا»
আবু সূআইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى المُتسَحِّرينَ»
“হে আল্লাহ সেহরি ভক্ষণকারীদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন”। উবাদা ইব্ন নাসি বলেন: মুখেমুখে প্রচলিত ছিল: “সেহরি খাও, যদিও পানি দ্বারা হয়। কারণ প্রসিদ্ধ ছিল: সেহির বরকতের খানা”।[3]
ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إنَّ اللهَ ومَلائِكتَهُ يُصَلُّونَ عَلى المُتسَحِّرِين» رواه ابن حبان.
“নিশ্চয় আল্লাহ সেহরি ভক্ষণকারীদের উপর রহমত প্রেরণ করেন ও তার ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন”।[4]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«نِعْمَ سَحُورُ المؤْمِنِ التَّمْر» رَوَاهُ أَبو دَاودَ.
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সেহরি ফযিলতপূর্ণ, সেহরি আল্লাহর পক্ষ থেকে রুখসত ও বরকত, এ জন্য আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করব।
দুই. সেহরির বরকত যেমন আল্লাহ সেহরি ভক্ষণকারীদের ওপর দরূদ প্রেরণ করেন ও তার ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন। আল্লাহর দরূদ প্রেরণ করার অর্থ হচ্ছে তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করা, তাদের কর্মের মন্তুষ্টি প্রকাশ করা ও তাদের প্রশংসা করা। ফেরেশতাদের দরূদ প্রেরণ করার অর্থ হচ্ছে তাদের জন্য ইস্তেগফার করা।[6]
তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরি ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন, যা সেহরির গুরুত্ব প্রমাণ করে।
চার. সামান্য বস্তু দ্বারা সেহরি হয়, যদিও তা একঢোক পানি, যেমন হাদিস থেকে স্পষ্ট।
পাঁচ. খেজুর সর্বোত্তম সেহরি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন।
ছয়. মুসলিমদের উচিত এ সুন্নত পালন করা।
আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«تَسَحَّرُوا فَإِنَّ في السَّحُور بَرَكَةً» رواه الشيخان.
আমর ইব্ন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«فَصْلُ مَا بَينَ صِيامِنَا وصِيَامِ أَهْلِ الكِتَابِ أَكَلَةُ السَّحَر» رواه مسلم.
ইরবায ইব্ন সারিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
«دَعَاني رَسُولُ الله ﷺ إلى السَّحُور في رَمَضَانَ فقَالَ: هَلُمَّ إلى الغَدَاءِ المُباركِ»
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানে সেহরিতে আহ্বান করে বলেন, বরকতপূর্ণ খানার জন্য আস”।[9]
মিকদাদ ইব্ন মা‘দি কারিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«عَلَيْكُمْ بِغَدَاءِ السَّحُور؛ فَإِنَّهُ هُوَ الغَدَاءُ المبَارَك» رواه النسائي.
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সেহরিতে বরকত বিদ্যমান। আল্লাহ যেখানে ইচ্ছা তার মাখলুকে বরকত রাখেন, তন্মধ্যে সেহরি।
তিন. সেহরির বরকতসমূহ:
(১). সেহরি খাওয়া শরিয়তের নির্দেশ বাস্তবায়ন করা। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ দিয়েছেন, এতে রয়েছে বান্দার ইহকাল ও পরকালের সফলতা।[12]
(২). সেহরিতে আহলে কিতাবের বিরোধিতা রয়েছে, তারা সেহরি খায় না।[13] আর তাদের বিরোধিতা আমাদের দ্বীনের মূল নীতি। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের সাথে মিল রাখা ও তাদের আখলাক, বৈশিষ্ট্য গ্রহণ হারাম।
(৪). সেহরি ভক্ষণকারী দো‘আ কবুলের মুহূর্তে ইস্তেগফার, যিকর ও দো‘আ করার সুযোগ লাভ করে, যা ঘুমন্ত ব্যক্তির নসিব হয় না। সেহরির সময় ইস্তেগফারকারীদের আল্লাহ প্রশংসা করেছেন।
(৫). সেহরি ভক্ষণকারী যথাসময়ে ফজর সালাতে হাজির হয়, অনেক সময় মসজিদে আগে এসে প্রথম কাতার ও ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়ানোর সাওয়াব লাভ করে, আযানের জওয়াব দেয় ও ফজরের দু’রাকাত সুন্নত আদায়ে সক্ষম হয়, হাদিসে এসেছে দুনিয়া ও তার মধ্যে বিদ্যমান সবকিছু থেকে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত উত্তম।
(৬). সেহরি ভক্ষণকারী ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান করে বা সেহরিতে কাউকে অংশীদার করে সদকার সওয়াব লাভ করতে পারে।[15]
(৭). সেহরিতে রয়েছে আল্লাহর নিয়ামতের শোকর ও তার রুখসতের প্রতি সমর্থন, কারণ আল্লাহ আমাদের জন্য সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত পানাহার বৈধ করেছেন, যা পূর্বে হারাম ছিল।[16]
চার. মুসলিমদের কর্তব্য সেহরিতে বাড়াবাড়ি না করা, বিশেষভাবে যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা তা ত্যাগ কর না”। নেক নিয়তে সওয়াবের আশায় সেহরি ভক্ষণ করা, শুধু অভ্যাসে পরিণত করা নয়।[17]
পাঁচ. সেহরির দাওয়াত দেয়া ও দাওয়াত গ্রহণ করা বৈধ। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরবায ইব্ন সারিয়াকে তার সাথে সেহরি খেতে ও একত্র হতে আহ্বান করেছেন। এক হাদিসে এরূপ এসেছে: “তোমরা বরকতপূর্ণ খানার জন্য আস”।[18]
ছয়. ইমাম খাত্তাবি রহ. বলেছেন: “এতে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন সহজ, তাতে কঠোরতা নেই। কিতাবিদের বিধান ছিল, তারা ইফতার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ফজর পর্যন্ত আর সেহরি খেতে পারত না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের থেকে তা রহিত করেছেন:
﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [البقرة: 187]
“আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়”[19]।[20] আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের জন্য আমরা তার শোকর আদায় করছি।
ইব্ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لا يَمْنَعَنَّ أَحَدَكُمْ أَذَانُ بِلالٍ مِنْ سُحُورِهِ فَإِنَّهُ يُؤَذِّنُ أَوْ قَالَ: يُنَادِي لِيَرْجِعَ قَائِمُكُمْ وَيُنَبِّهَ نَائِمَكُمْ وَلَيْسَ الفَجْرُ أَنْ يَقُولَ هَكَذا - وجَمَعَ يَحيَى بنُ سَعِيدٍ القَطَانُ كَفَّيْهِ - حَتَّى يَقُولَ هَكَذَا - ومَدَّ يَحيى إِصْبَعَيْهِ السَّبَابَتَينِ».
“বেলালের আযান যেন তোমাদের কাউকে সেহরি থেকে বিরত না রাখে। কারণ সে আযান দেয় অথবা তিনি বলেছেন: সে ডাকে যেন তোমাদের জাগ্রতরা ফিরে যায় ও ঘুমন্তরা জাগ্রত হয়। ফজর এটা নয় যে এরকম হবে, (ইয়াহইয়া ইব্ন সায়িদ আল-কাত্তান নিজ হাতের তালুদ্বয় জড়ো করলেন [অর্থাৎ লম্বালম্বি অবস্থায় আলো প্রকাশ পেলেই তা ফজর হিসেবে ধর্তব্য হবে না, বরং তা সুবহে কাযিব]) যতক্ষণ না এরকম হবে, (ইয়াহয়াহ তার তর্জনীদ্বয় প্রসারিত করলেন [অর্থাৎ আলো ডানে বাঁয়ে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করলেই কেবল ফজর হিসেবে ধর্তব্য হবে, তখন তা হবে সুবহে সাদিক])[21]
সাহল ইব্ন সা‘দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি আমার পরিবারে সেহরি খেতাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ফজর সালাতের জন্য দ্রুত ছুটতাম”।
বুখারির অপর বর্ণনায় আছে: “আমার দ্রুততার কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সিজদায় অংশ গ্রহণ করা”।[22]
যির ইব্ন হুবাইশ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি হুযায়ফার সঙ্গে সেহরি করলাম, অতঃপর আমরা সালাতের জন্য চললাম, মসজিদে এসে দু’রাকাত সালাত আদায় করলাম, আর ইকামত আরম্ভ হল, উভয়ের মাঝে সামান্য ব্যবধান ছিল”।[23]
“যেন তোমাদের ঘুমন্তরা ফিরে যায়” অর্থ: বেলাল রাতে আযান দেয়, তোমাদের জানানোর জন্য যে, ফজর বেশী দেরি নাই। সে তাহাজ্জুদে দণ্ডায়মানকারীদের আরামের জন্য ফিরিয়ে দেয়, যেন সামান্য ঘুমিয়ে উদ্যমতাসহ সকালে উঠতে পারে, অথবা বেতর পড়ে নেয়, যদি তা পড়ে না থাকে, অথবা ফজরের জন্য প্রস্তুতি নেয় যদি পবিত্রতার প্রয়োজন থাকে, বা অন্যান্য প্রয়োজন সেরে নেয়, যা ফজরের সময় জানলেই সম্ভব।[24]
“ঘুমন্তদের জাগ্রত করে” অর্থ: ঘুমন্তরা যেন ঘুম থেকে জেগে ফজরের প্রস্তুতি নেয়, সামান্য তাহাজ্জুদ আদায় করে, অথবা বেতর আদায় না করলে তা আদায় করে, অথবা সওমের ইচ্ছা থাকলে সেহরি খায়, অথবা গোসল বা ওযু সেরে নেয়, অথবা অন্যান্য প্রয়োজন সেরে নেয়।[25]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিগণ ফজরের শেষ সময় পর্যন্ত সেহরি বিলম্ব করতেন। তাদের কেউ সময় শেষ হওয়ার আশঙ্কায় সেহরি সংক্ষেপ করতেন। অতএব ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সেহরি বিলম্ব করা সুন্নত।[26]
দুই. প্রয়োজনের সময় দ্রুত আহার করা জায়েয। এ ব্যাপারে ইমাম বুখারি একটি অধ্যায় কায়েম করেছেন: “সেহরি দ্রুত করার অধ্যায়”, শিরোনামে। ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইব্ন আবি বকর থেকে, সে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন: “রমযানে আমরা সালাতুল লাইল শেষে এতো দেরিতে বাড়ি যেতাম যে, খাদেমদের দ্রুত খানা পেশ করার জন্য বলতাম, যেন ফজর ছুটে না যায়”।[27]
আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
«إِنَّ بِلالاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُنَادِيَ ابنُ أُمِّ مَكْتُومٍ ثُمَّ قَالَ: وَكَانَ رَجُلاً أَعْمَى لا يُنَادي حَتَّى يقَالَ لَهُ: أَصْبَحْتَ أَصْبَحْتَ» رواه الشيخان.
“নিশ্চয় বেলাল আযান দেয় রাতে, অতএব তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না আব্দুল্লাহ ইব্ন উম্মে মাকতুম আযান দেয়। অতঃপর তিনি বলেন: সে ছিল অন্ধ, যতক্ষণ না তাকে বলা হত ভোর করেছ, ভোর করেছ সে আযান দিত না”।
মুসলিমের অপর বর্ণনায় রয়েছে:
«كَانَ لِرَسُولِ الله ﷺ مُؤَذِّنانِ: بِلالٌ وابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ الأَعْمَى فَقَالَ رَسُولُ الله ﷺ: إِنَّ بِلالاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ فَكُلُوا واشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُوم قَالَ: وَلم يَكُنْ بَيْنَهُما إِلاّ أَنْ يَنْزِلَ هَذا ويَرْقَى هَذَا» .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’জন মুয়াজ্জিন ছিল: বেলাল ও অন্ধ আব্দুল্লাহ ইব্ন উম্মে মাকতুম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: বেলাল রাতে আযান দেয় সুতরাং তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ না ইব্ন উম্মে মাকতুম আযান দেয়। তিনি বলেন: তাদের দু’জনের সময়ের ব্যবধান ছিল একজন (আজানের স্থান থেকে) নামতেন অপরজন উঠতেন”।[28]
সামুরা ইব্ন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
«لا يَغُرَّنكُمْ مِنْ سُحُورِكُم أَذانُ بِلالٍ ولا بَياضُ الأُفِقِ المسْتَطِيلِ هَكَذا، حَتَّى يَسْتَطيرَ هَكَذا» وَحَكَاهُ حَمادُ بنُ زَيْدٍ بِيَدَيْهِ، قَالَ: يَعْنِي مُعْتَرِضاً. رواه مسلم
“বেলালের আযান বা দিগন্তের লম্বা সাদা রেখা যেন তোমাদেরকে সেহরি থেকে বিরত না রাখে, যতক্ষণ না তা এভাবে প্রলম্বিত হয়”। হাম্মাদ ইব্ন যায়েদ দু’হাতে ইশারা করে তার ব্যাখ্যা দেন। তিনি ইঙ্গিত করলেন: অর্থাৎ প্রস্থের দিক থেকে প্রসারিত হওয়া। মুসলিম।
নাসায়ির এক বর্ণনায় আছে:
«لا يَغُرَّنكُمْ أَذانُ بِلالٍ، ولا هَذَا البَيَاضُ حَتَّى يَنْفَجِرَ الفَجْرُ هَكذَا وَهَكَذا» يَعْني: مُعْتَرضاً. قَالَ أَبو دَاوُدَ الطَيالِسيُ: وَبَسَطَ بِيدَيْهِ يَمِيناً وشِمالاً مَادَّاً يَدَيْهِ.
“বেলালের আযান এবং এ শ্রুভ্রতা যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে, যতক্ষণ না ফজর এভাবে এভাবে ছড়িয়ে পড়ে”। অর্থাৎ প্রস্থেরদিকে। আবু দাউদ তায়ালিসি বলেন: তিনি তার দু’হাত ডানে-বামে লম্বাকরে প্রসারিত করলেন।[29]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
«إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمْ النِّدَاءَ والإِنَاءُ عَلى يَدِهِ فَلا يَضَعْهُ حَتَّى يَقْضِيَ حَاجَتَهُ مِنهُ»
“যখন তোমাদের কেউ আযান শ্রবণ করে, আর হাতে থাকে খানার প্লেট, সে তা রাখবে না যতক্ষণ না সেখান থেকে তার প্রয়োজন পূর্ণ করে”।[30]
ইমাম আহমদের এক বর্ণনায় অতিরিক্ত বলেছেন:
«وَكَانَ المؤَذِّنُ يُؤَذِّنُ إِذا بَزَغَ الفَجْرُ».
শিক্ষা ও মাসায়েল:[32]
এক. ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রীগমন বৈধ।
দুই. অন্ধ ব্যক্তির আযান দেয়া বৈধ, যদি সে সময় সম্পর্কে জানে বা তাকে জানানোর কেউ থাকে।
তিন. ফজরের জন্য দু’বার আযান দেয়া বৈধ: প্রথমবার ফজরের পূর্বে, দ্বিতীয়বার: ফজর উদয় হওয়ার পর।
চার. সওমের নিয়তের পর সেহরি খাওয়া বৈধ, পানাহারের কারণে পূর্বের নিয়ত নষ্ট হবে না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত পানাহার বৈধ করেছেন, অথচ ফজর উদয়ের পর নিয়ত বৈধ নয়, এ থেকে প্রমাণিত হয় নিয়তের স্থান খানার পূর্বে, তারপর পানাহারে সওম নষ্ট হবে না। অতএব কেউ মাঝরাতে আগামীকালের সওমের নিয়ত করে, শেষ রাত পর্যন্ত পানাহার করলে তার নিয়ত শুদ্ধ।
পাঁচ. ফজর উদয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলে পানাহার করা বৈধ, কারণ রাত অবশিষ্ট আছে এটাই স্বাভাবিক। দলিল নিম্নের আয়াত:
﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [البقرة: 187]
“তোমরা পানাহার করতে থাক যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা থেকে কালো রেখা সুস্পষ্ট আলাদা না হয়ে যায়।”[33] সন্দেহকারীর নিকট ফজরের সাদা রেখা সুস্পষ্ট হয়নি, তাই সে সেহরি খেতে পারবে। আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত:
«كُلْ مَا شَكَكَتَ حتى يَتَبَينَ لكَ» رواه البيهقي ،
এ বিধান তখন, যখন সে স্বচক্ষে ফজর দেখে নিশ্চিত হয়, কিন্তু সে যদি আযান অথবা ঘড়ির উপর নির্ভর করে, তাহলে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ তখন জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
ছয়. সেহরি খাওয়া ও তাতে বিলম্ব করা মোস্তাহাব।
সাত. “দুই মুয়াজ্জিনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান: একজন নামতেন, অপরজন উঠতেন”। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “এর অর্থ: বেলাল ফজরের পূর্বে আযান দিতেন, আযানের পর দো‘আ ইত্যাদির জন্য অপেক্ষা করতেন। অতঃপর ফজর পর্যবেক্ষণ করতেন, যখন ফজর ঘনিয়ে আসত, তিনি অবতরণ করে উম্মে মাকতুমকে খবর দিতেন। ইব্ন উম্মে মাকতুম ওযু, ইস্তেঞ্জা সেরে প্রস্তুতি নিতেন, অতঃপর উপরে উঠে ফজর উদিত হওয়ার সাথে সাথে আযান আরম্ভ করতেন”।[35]
নয়. ব্যক্তির জন্য মায়ের পরিচয় গ্রহণ করা বৈধ, যদি লোকেরা তার মায়ের পরিচয়ে তাকে চিনে, বা তার প্রয়োজন হয়।[37]
দশ. প্রথম ফজর ও দ্বিতীয় ফজরে পার্থক্য তিনটি:
প্রথম পার্থক্য: দিগন্তের উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বালম্বি সাদা রেখা দ্বিতীয় ফজরের আলামত। আর উর্ধ্ব আকাশে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সাদা লম্বা রেখা প্রথম ফজরের আলামত।
দ্বিতীয় পার্থক্য: দ্বিতীয় ফজরের পর অন্ধকার থাকে না, বরং সূর্যোদয় পর্যন্ত ফর্সা ক্রমান্বয়ে পায়। আর দ্বিতীয় ফজরে আলোর পর অন্ধকার মেনে আসে।
তৃতীয় পার্থক্য: দ্বিতীয় ফজরের সাদা রেখা দিগন্তের সাথে মিলিত থাকে। প্রথম ফজরে সাদা রেখা ও উর্ধ্ব আকাশের মাঝে অন্ধকার বিরাজ করে।[38]
এগার. মুয়াজ্জিন যখন ফজরের আযান দেয়, তখন যদি রোযাদারের হাতে খাবার প্লেট থাকে, সে পানাহার পূর্ণ করবে, বন্ধ করবে না, হাদিসের বাহ্যিক অর্থ তাই বলে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাড়। তাঁর জন্য সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা।[39]
আনাস ইব্ন মালিক রহ., যায়েদ ইব্ন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«تَسَحَّرْنَا مَعَ النَّبيِّ ﷺ ثُمَّ قَامَ إِلى الصَّلاةِ، قَلْتُ: كَمْ كَانَ بَينَ الأَذَانِ والسَّحُورِ؟ قَالَ: قَدْرُ خَمْسِينَ آيَةً» رواه الشيخان.
“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সেহরি খেলাম, অতঃপর তিনি সালাতের জন্য দাঁড়ালেন। আমি বললাম: আযান ও সেহরির মধ্যে ব্যবধান কি ছিল? তিনি বললেন: পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ”।[40]
বুখারির অপর বর্ণনায় আনাস ইব্ন মালিক থেকে বর্ণিত:
«أَنَّ النَّبيَّ ﷺ وَزَيْدَ بنَ ثَابِتٍ تَسَحَّرا فَلَما فَرَغَا مِنْ سَحُورِهِمَا قَامَ نَبيُّ الله ﷺ إِلى الصَّلاةِ فَصَلَّى، قُلْنَا لأَنَسٍ: كَمْ كَانَ بَيْنَ فَراغِهِما مِنْ سَحُورِهِمَا وَدُخُولهما في الصَّلاةِ؟ قَالَ: قَدْرُ مَا يَقْرَأُ الرَجُلُ خَمسينَ آيَةً».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জায়েদ ইব্ন সাবেত এক সঙ্গে সেহরি খান, যখন তারা সেহরি থেকে ফারেগ হলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের জন্য দাঁড়ালেন ও সালাত আদায় করলেন। আমরা আনাসকে বললাম: তাদের সেহরি ও সালাত আরম্ভের মধ্যে ব্যবধান কি ছিল? তিনি বললেন: যতটুকু সময়ে একজন ব্যক্তি পঞ্চাশ আয়াত পড়ে”।[41]
শিক্ষা ও মাসায়েল[42]:
এক. সেহরিতে বিলম্ব করা সুন্নত। এতে যেমন সওমের শক্তি অর্জন হয়, তেমন কিতাবিদের সুস্পষ্ট বিরোধিতা হয়।
দুই. সাহাবিদের সময় ইবাদতে পরিপূর্ণ ছিল, এ জন্য যায়েদ কুরআন তিলাওয়াতের পরিমাণ দ্বারা সময়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।
তিন. শারীরিক কর্ম দ্বারা সময় পরিমাপ করা বৈধ, যেমন আরবরা বলত: বকরির দুধ দোহনের পরিমাণ, উটের বাচ্চা নহর করার পরিমাণ ইত্যাদি।
পাঁচ. সেহরি বিলম্ব করা সুন্নত, তবে সেহরির শেষ পর্যন্ত স্ত্রীগমন তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তার দ্বারা সওমের শক্তি অর্জন হয় না, বরং তাতে কাফফারা ওয়াজিব ও সওম বিনষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ কখনো এমন হবে, ফজর উদিত হচ্ছে, কিন্তু সে উত্তেজনার কারণে রমন ক্রিয়া বন্ধ করতে পারছে না।
ছয়. ইলম অর্জন করা, মাসায়েল জানা, সুন্নত অনুসন্ধান করা, ইবাদতের সময় জানা ও তদনুরূপ আমল করা জরুরী। কারণ আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: “সেহরি ও আযানের ব্যবধান কি ছিল”। যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: “পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ”।
সাত. উম্মতের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া যে, সিয়ামের শক্তির জন্য সেহরির বিধান দেন, অতঃপর তিনি স্বেচ্ছায় তা বিলম্ব করেন, যেন সাহাবিরা এতে তার অনুসরণ করে। তিনি সেহরি না খেলে তার অনুসরণ করা তাদের জন্য কষ্টকর ছিল, আবার প্রথমরাত বা মধ্যরাতে সেহরি খেলে সেহরির অনেক উদ্দেশ্য বিফল হত।
আট. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে শিষ্টাচার ও আদব রক্ষা করা জরুরী। এখানে যেমন যায়েদ বলেছেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সেহরি খেয়েছি”। তিনি বলেননি: “আমরা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরি খেয়েছি”। কারণ সাথীত্ব আনুগত্যের প্রমাণ বহন করে।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«كَانَ رَسُولُ الله ﷺ يُقَبِّلُ وهوَ صَائِمٌ، ويُبَاشِرُ وَهُوَ صَائِمٌ، ولَكنَّهُ أَمْلَكُكُمْ لأَرَبِهِ» أَيْ: أَمْلَكُكُمْ لِحَاجَتِهِ.
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযাবস্থায় চুম্বন করতেন, আলিঙ্গন করতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের চেয়ে তার চাহিদা অধিক নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন। অর্থাৎ স্ত্রীগমনের চাহিদা।
অপর বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে রোযাবস্থায় চুম্বন করতেন”। মুসলিম।
মুসলিমের অপর বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
«وَأَيُّكُمْ يَمْلِكُ أَرَبَهُ كَما كَانَ رَسُولُ الله ﷺ يَمْلِكُ أَرَبَهُ».
“তোমাদের মধ্যে কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত নিজের প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে”।
আবু দাউদের এক বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«كَانَ رَسُولُ الله ﷺ يُقَبِّلُنِي وهُو صَائِمٌ وأَنا صَائِمَةٌ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে চুম্বন করতেন, অথচ তিনি ও আমি সওম অবস্থায় থাকতাম”।
ইব্ন হিব্বানের এক বর্ণনায় এসেছে, আবু সালমা ইব্ন আব্দুর রহমান আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:
«كَانَ رَسُولُ الله ﷺ يُقَبِّلُ بَعضَ نِسائِهِ وهوَ صَائِمٌ، قُلتُ لعائِشَةَ: في الفَريضَةِ والتَّطوُّعِ؟ قَالَتْ عَائِشَةُ: في كُلِّ ذَلكَ في الفَريضَةِ والتَّطَوُّع».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কতক স্ত্রীদের রোযাবস্থায় চুম্বন করতেন। আমি আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলাম: ফরয ও নফলে? তিনি বললেন: উভয়ে”।[44]
হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত:
«أَنَّ النَّبيَّ ﷺ كَانَ يُقبِّلُ وَهُوَ صَائِم» رَوَاهُ مُسْلمٌ.
ওমর ইব্ন আবু সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন: “রোযাদার কি চুম্বন করবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাকে -উম্মে সালমা- জিজ্ঞাসা কর। উম্মে সালমা তাকে বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করেন। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ আপনার অগ্র-পশ্চাতের সবগুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: জেনে রেখ, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক পরহেযগার ও আল্লাহভীরু”। মুসলিম।[46]
ওমর ইব্ন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রোযাবস্থায় বিনোদনের ছলে আমি চুম্বন করি। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আজ এক জঘন্য অপরাধ করে ফেলেছি, রোযাবস্থায় চুম্বন করেছি। তিনি বললেন: বল দেখি রোযাবস্থায় পানি দ্বারা কুলি করলে কি হয়? আমি বললাম: কিছু হয় না। তিনি বললেন: তাহলে কী অপরাধ করেছ”।[47]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. রোযাদারের চুম্বন ও আলিঙ্গন করা বৈধ, রোযা ফরয হোক বা নফল, রোযাদার বৃদ্ধ হোক বা যুবক, রমযান বা গায়রে রমযান সর্বাবস্থায়, যদি স্ত্রীগমন অথবা বীর্যপাত থেকে নিরাপদ থাকে ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
দুই. হাদিসে আলিঙ্গন দ্বারা উদ্দেশ্য শরীরের সাথে শরীরের স্পর্শ, স্ত্রী সহবাস নয়। কারণ স্ত্রী সহবাস রোযা ভঙ্গকারী।[48]
তিন. রোযাদারের স্ত্রী চুম্বন, অথবা স্পর্শ অথবা আলিঙ্গনের ফলে যদি বীর্যস্খলন হয়, রোযা ভেঙ্গে যাবে, তার অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা, তওবা, ইস্তেগফার ও পরবর্তীতে কাযা করা জরুরী। কারণ আল্লাহ তা‘আলা হাদিসে কুদসীতে বলেন:
«يَدَعُ شهْوَتَه وأَكْلَهُ وشُرْبَهُ مِنْ أَجْلي» وفي رِوايةٍ «ويَدَعُ لَذَّتَه مِنْ أَجْلي، ويَدَعُ زَوجَتَه مِنْ أَجْلي».
“সে আমার জন্য তার প্রবৃত্তি ও পানাহার ত্যাগ করে”।[49] অপর বর্ণনায় আছে: “সে আমার জন্য স্বাদ ও স্ত্রীগমন ত্যাগ করে”।[50]
রোযাদারের জন্য উচিত যৌন উত্তেজক আচরণ থেকে বিরত থাকা, যা হারাম পর্যন্ত নিয়ে যায়।
চার. হাদিস প্রমাণ করে যে, চুম্বন শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং সমগ্র উম্মতের জন্য তা বৈধ, যদি সহবাস বা বীর্যপাতের আশঙ্কা না থাকে।[52]
পাঁচ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে আল্লাহ ভীরু, কারণ তিনি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী জানতেন।[53]
ছয়. হাদিস প্রমাণ করে যে, দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা নিষেধ, অথবা এ বিশ্বাস করা যে, শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য স্ত্রী চুম্বন বৈধ, উম্মতের কারো জন্য তা বৈধ নয়। কারণ এ ব্যাপারে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি স্বাভাবিকভাবে তা নেননি, বরং তিনি বলেন:
«أمَا والله إنِّي لأَتْقَاكُم لله وأَخْشَاكُم له» وفي الحَدِيثِ الآخَرِ: «وَأَعْلَمُكُم بِحُدُودِ الله».
“জেনে রেখ, আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে পরহেযগার ও আল্লাহ ভীরু”।[54] অপর হাদিসে এসেছে: “আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহর বিধান অধিক জানি”।
সাত. হাদিস থেকে সাহাবিদের হালাল-হারাম জানার আগ্রহ ও আল্লাহ ভীতি প্রমাণ হয়, তারা ইবাদত বিনষ্টকারী বা সওয়াব হ্রাসকারী বস্তু থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতেন।
আট. এ হাদিসে সেসব সূফীদের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা বিশ্বাস করে যে, ঈমান ও আমলে যাদের পূর্ণতা অর্জন হয়েছে, তারা শরিয়তের বিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত! এখানে আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরিয়তের বিধানে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন, অথচ তার ঈমান ও আমল সবার চেয়ে কামেল ও পরিপূর্ণ ছিল। এতে তাদেরও প্রতিবাদ রয়েছে, যাদের ধারণা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বাপর পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তাই নিষিদ্ধ কতক কাজ তার জন্য বৈধ।[55]
নয়. ওমর ইব্ন খাত্তাবের হাদিসে এক বিধানের ক্ষেত্রে দু’টি বস্তুর তুলনা করা ও কিয়াসের বৈধতা প্রমাণিত হয়, যদি বস্তুদ্বয়ে সাদৃশ্য থাকে। যেমন পানি দ্বারা গড়গড়ার ফলে গলায় ও পেটে পানি প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে, যে কারণে সওম ভেঙ্গে যায়, অনুরূপ চুম্বনের ফলে স্ত্রীগমনের সম্ভাবনা থাকে, যে কারণে সওম ভেঙ্গে যায়, কিন্তু যেহেতু গড়গড়ার ফলে সওম ভাঙ্গে না, তাই চুম্বনের ফলে সওম ভাঙ্গবে না।[56]
আবু উমামা বাহেলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
«بينَا أنَا نَائِمٌ إذْ أَتَاني رَجُلانِ فأخَذَا بضَبْعِي - أي: عَضُدِي - فَأَتَيَا بي جَبَلاً وَعْراً فَقَالَا لي: اصْعَدْ، فقلت: إني لا أُطِيقُه، فقَالَا: إنا سَنُسَهِّلُه لك، فَصَعَدتُ حتى إذا كُنتُ في سَواءِ الجَبَل إذا أنا بِأصْواتٍ شدِيدَةٍ، فَقُلْتُ: مَا هَذهِ الأَصْواتُ؟ قَالَوا: هَذا عِوى أَهْلِ النَّارِ، ثمَّ انْطُلِقَ بي فَإِذا أَنا بِقَومٍ مُعَلَّقِين بِعَرَاقِيبهِم، مُشَقَّقَةٍ أَشْدَاقُهُم تَسِيلُ أشْداقُهُم دَماً، قَالَ: قُلتُ: مَن هَؤُلاءِ؟ قَالَ: هؤُلاءِ الَّذين يُفطِرُون قَبلَ تَحِلَّة صَوْمِهِم» رَوَاهُ النِّسَائي وَصَحَّحَهُ الحَاكِم.
“একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সহসা দু’জন লোক এসে আমার বাহু ধরে আমাকেসহ তারা এক দুর্গম পাহাড়ে আগমন করল। তারা আমাকে বলল: আরোহণ কর, আমি বললাম: আমি আরোহণ করতে পারি না। তারা বলল: আমরা তোমাকে সাহায্য করব। আমি ওপরে আরোহণ করলাম। যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলাম, বিভিন্ন বিকট শব্দের সম্মুখীন হলাম। আমি বললাম: এ আওয়াজ কিসের? তারা বলল: এগুলো জাহান্নামীদের ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ। অতঃপর তারা আমাকে নিয়ে রওনা করল, আমি এমন লোকদের সম্মুখীন হলাম, যাদেরকে হাঁটুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের চোয়াল ক্ষতবিক্ষত, অবিরত রক্ত ঝরছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি বললাম: এরা কারা? তারা বলল: এরা হচ্ছে সেসব লোক, যারা সওম পূর্ণ হওয়ার আগে ইফতার করত”।[57]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. এ হাদিসে কবরের আযাবের প্রমাণ রয়েছে। কবরের আযাব কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম আহমদ রহ. বলেন: কবরের আযাব সত্য, গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট ব্যতীত কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না”।[58]
দুই. কবরের আযাব শরীর ও রূহ উভয়ের ওপর ঘটে, যার স্বরূপ আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। ইব্ন কায়্যিম রহ. বলেন: “এ উম্মতের পূর্বসূরি ও ইমামদের অভিমত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি যখন মারা যায়, নেয়ামত বা আযাবে অবস্থান করে, যা তার শরীর ও রূহ উভয় ভোগ করে। শরীর থেকে আলাদা হওয়ার পর রূহ আরামে বা আযাবে অবস্থান করে। কখনো সে শরীরের সাথে মিলিত হয়, তখন সে তার সাথে আযাব বা নেয়ামত ভোগ করে। অতঃপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, তখন সব রূহ শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আর তারা সবাই কবর থেকে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত হবে”।[59]
তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে কবর আযাবের কতক নমুনা দেখানো হয়েছে। নবীদের স্বপ্ন সত্য ও ওহির অংশ।
চার. এতে কবর আযাবের কঠিন চিত্র ফুটে উঠেছে, মুসলিমদের উচিত কবর আযাব ভয় করা, তার উপকরণ থেকে বেচে থাকা ও তা থেকে সুরক্ষার আসবাব গ্রহণ করা।
পাঁচ. রমযানে যে ব্যক্তি জেনে ও ইচ্ছাকৃতভাবে, কোন কারণ ব্যতীত সময় হওয়ার পূর্বে ইফতার করে, তার জন্য কঠোর হুশিয়ারি রয়েছে এ হাদিসে। এটা কবিরা গুনাহ, যার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
ছয়. সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতারে যদি এ শাস্তি হয়, তাহলে যে রমযানে সওম রাখে না, অথবা কোন কারণ ব্যতীত কয়েক রমযান ইফতার করে, সে এরূপ বা তার চেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে সন্দেহ নেই। অতএব যার থেকে এরূপ ঘটে তার কর্তব্য দ্রুত তওবা করা, যেন তাকে কবরের এ আযাব স্পর্শ না করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ ١٨٧﴾ [البقرة: 187]
সাহাল ইব্ন সাদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلوا الفِطْرَ» رواه الشيخان .
ইব্ন মাজার এক বর্ণনায় আছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الفِطرَ، عَجِّلُوا الفِطرَ فَإِنَّ اليَهودَ يُؤَخِّرُونَ».
“লোকেরা কল্যাণে অবস্থান করবে, যাবত তারা দ্রুত ইফতার করবে। তোমরা দ্রুত ইফতার কর, কারণ ইহুদিরা বিলম্ব করে”।[62]
ইব্ন হিব্বান ও ইব্ন খুযাইমার বর্ণনায় আছে:
«ما يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِراً ما عَجَّلَ النَّاسُ الفطْرَ، إِنَّ اليَهودَ والنَّصارى يُؤَخِّرُونَ».
অপর এক বর্ণনায় আছে:
«لا تَزَالُ أُمَّتِي على سُنَّتِي مَا لم تَنتَظرْ بفِطْرِهَا النُّجوم» .
“আমার উম্মতেরা সুন্নতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, যতক্ষণ তারা ইফতারের জন্য নক্ষত্রের অপেক্ষা না করবে”।[64]
আবুল আতিয়াহ হামদানি রহ. বলেন: আমি ও মাসরুক আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করি: হে উম্মুল মুমেনিন, রাসূলের দু’জন সাহাবি: একজন দ্রুত ইফতার ও দ্রুত সালাত আদায় করেন, অপরজন দেরিতে ইফতার ও দেরিতে সালাত আদায় করেন। তিনি বললেন: কে দ্রুত ইফতার করে ও দ্রুত সালাত আদায় করে? তিনি বলেন: আমরা বললাম: আব্দুল্লাহ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ। তিনি বললেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করতেন। আবু কুরাইব বাড়িয়ে বলেছেন: দ্বিতীয় ব্যক্তি আবু মূসা”।[65]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “ইফতার না করে কখনো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের সালাত আদায় করতে দেখিনি, তা একঢোক পানি দ্বারাই হোক”।[66]
আমর ইব্ন মায়মুন আওদি রহ. বলেছেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ সবচেয়ে দ্রুত ইফতার করতেন ও সবচেয়ে বিলম্বে সেহরি খেতেন”।[67]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. চোখে দেখে, অথবা নির্ভরযোগ্য সংবাদ শুনে অথবা প্রবল ধারণা হয় যে, সূর্য ডুবেছে, তাহলে দ্রুত ইফতার করা মোস্তাহাব। হাদিস তাই প্রমাণ করে, সাহাবিদের আদর্শ এরূপ ছিল। হাফেয ইব্নু আব্দুল বার রহ. বলেছেন: “সকল আলেম একমত যে, মাগরিবের সালাতের সময় হলে রোযাদারের ইফতার হালাল হয়, কি ফরয কি নফল। মাগরিব সালাত রাতের সালাতের অন্তর্ভুক্ত, এতে কারো দ্বিমত নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:[68]
﴿ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ ١٨٧﴾ [البقرة: 187]
তিন. এ উম্মতের একটি কল্যাণ হচ্ছে তারা কিতাবি তথা ইহুদি ও নাসারাদের বিপরীতে দ্রুত ইফতার করে, তারা নক্ষত্র বিকশিত হওয়ার অপেক্ষা করে।[71] কিতাবিদের বিরোধিতা আমাদের দ্বীনের এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এটা এ উম্মতের বড় বৈশিষ্ট্য ও সকল উম্মতের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। এ জন্য কাফেরদের সাথে মিল রাখা হারাম।
চার. সূর্যাস্তের পর ইফতার বিলম্ব করা সুন্নত পরিহার ও বিদআত সৃষ্টির আলামত।
পাঁচ. এসব হাদিসে শিয়া-রাফেযা ও তাদের অনুসারীদের প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যারা সূর্যাস্তের পর ইফতারের জন্য স্পষ্টভাবে তারকা দেখার অপেক্ষা করে।[72]
ছয়. ইবাদতের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের পাবন্দ হলে, গোঁড়ামি, দ্বীন থেকে বিচ্যুতি ও শয়তানি প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত থাকা যায়, যেমন নিশ্চিত সূর্যাস্তের পর দ্রুত ইফতার করা।[73]
আট. এ হাদিস প্রমাণ করে লাগাতার সওম মাকরুহ। আরো প্রমাণ করে সালাতের পূর্বে ইফতার করা জরুরী, এতে ইফতার দ্রুত হয়।[75]
নয়. সুন্নতের অনুসরণ করা ও তার বিরোধিতা থেকে বিরত থাকা, সুন্নত ত্যাগ করার কারণে কর্মে ফ্যাসাদ ও বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়। সাহাবিরা কোন কর্মে সফলতা না পেলে পরখ করত, তাদের থেকে কোন সুন্নত ছুটে গেছে, কোন সুন্নত খুঁজে পেলে ধরে নিত, এ কারণে তাদের এ সমস্যা।[76]
দশ. এ উম্মতের সৌভাগ্য তারা সুন্নত লাভ করেছে, যা আল্লাহর মহব্বতকে জরুরী করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١﴾ [آل عمران: 31]
“বল, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”[77]।[78]
আনাস ইব্ন মালিক আল-কা‘বি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহিনী আমার কাওমের উপর আক্রমণ করেছিল। তখন আমি তার নিকট এলাম, তিনি খানা খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন: কাছে আস, খাও। আমি বললাম: আমি রোযাদার। তিনি বললেন: বস, আমি তোমাকে সওম অথবা সিয়াম সম্পর্কে বলছি। আল্লাহ তা‘আলা মুসাফির থেকে অর্ধেক সালাত হ্রাস করেছেন, মুসাফির, গর্ভবতী ও স্তন্য-দানকারী থেকে সওম অথবা সিয়াম স্থগিত করেছেন। হায় আফসোস! সেদিন যদি আমি রাসূলের খানা থেকে কিছু ভক্ষণ করতাম![79]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. বান্দার ওপর আল্লাহর দয়া যে, তিনি অক্ষম ব্যক্তিদের থেকে কতক আহকাম স্থগিত করে দিয়েছেন, যারা তা পালনে অপারগ বা তা আদায়ে কষ্ট ও ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুই. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদাচরণ যে তিনি আনাসকে খানার জন্য আহ্বান করেছেন। তিনি উম্মতের কল্যাণে ছিলেন অতি আগ্রহী, তাই প্রয়োজনীয় জিনিস তাদের বাতলে দিতেন।
তিন. মুসাফিরের জন্য ইফতার ও কসর করা বৈধ, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে রুখসত, আল্লাহ যেমন আজিমত পছন্দ করেন, তেমন তিনি রুখসত পছন্দ করেন।
চার. গর্ভবতীর জন্য আল্লাহ রমযানে সিয়াম সাধনা স্থগিত করে দিয়েছেন। কারণ গর্ভে বিদ্যমান বাচ্চা মায়ের খাদ্য থেকে খাবার গ্রহণ করে, যদি মা সিয়াম পালন করে, তবে তার কষ্ট হতে পারে বা তার ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, তাই আল্লাহ তার থেকে সিয়াম স্থগিত করে দিয়েছেন।
পাঁচ. স্তন্য-দানকারীর ওপর আল্লাহ সিয়াম স্থগিত করে দিয়েছেন, কারণ স্তন্য দানকারী মায়ের বারবার খাবার গ্রহণ করা জরুরী, অন্যথায় তার বা তার বাচ্চার ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
ছয়. জ্বলন্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো, পানিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা বা নিষ্পাপ শিশুকে মুক্ত করার জন্য যার সিয়াম ভঙ্গ করা জরুরী হয়, সে এর অন্তর্ভুক্ত।[80]
সাত. গর্ভবতী ও স্তন্য দানকারী যদি নিজের জানের ভয়, অথবা নিজের ও বাচ্চার ক্ষতির ভয়ে সিয়াম ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের শুধু কাযা করাই যথেষ্ট, এতে কারো দ্বিমত নেই। কারণ তারা অসুস্থ ব্যক্তিদের ন্যায়, অতএব তাদের মত তারা সুবিধা ভোগ করবে।[81] আর মায়েরা যদি শুধু বাচ্চার আশঙ্কায় সওম ভঙ্গ করে, তাহলে এতে আলেমদের দ্বিমত রয়েছে। তবে যার উপর ফতোয়া, ইনশাআল্লাহ তাই বিশুদ্ধ যে, তাদের শুধু কাযা করতে হবে, কারণ তারা অসুস্থ ব্যক্তিদের ন্যায়। দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওম স্থগিত করার ব্যাপারে মুসাফির ও তাদেরকে একসাথে উল্লেখ করেছেন, এটা সর্বজন বিদিত যে, মুসাফির কাযা করবে, তার উপর খাদ্যদান জরুরী নয়, অনুরূপ গর্ভবতী ও দুগ্ধ দানকারী।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত,
«أنَّ حَمزَةَ بنَ عَمْروٍ الأَسلَميِّ t قَالَ للنَّبيِّ ﷺ: أَأَصُومُ في السَّفَرِ؟ وَكَانَ كَثيرَ الصِّيامِ، فقَالَ: إنْ شِئْتَ فَصُمْ وإنْ شِئْتَ فَأَفْطِرْ» رواه الشيخان.
“হামজাহ ইব্ন আমর আসলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন: আমি কি সফরে রোযা রাখব? তার রোযার খুব অভ্যাস ছিল। তিনি বললেন: যদি চাও রাখ, অন্যথায় ইফতার কর”।[82]
ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«سَافَرَ رَسُولُ الله ﷺ في رَمَضَانَ فَصَامَ حَتَّى بَلَغَ عُسْفَانَ، ثُم دَعَا بإِناءٍ مِنْ مَاءٍ فَشَرِبَ نَهَاراً لِيرَاهُ النَّاسُ، فَأَفْطَرَ حَتَّى قَدِمَ مَكَّةَ، وَكَانَ ابنُ عَباسٍ يَقُولُ: صَامَ رَسُولُ الله ﷺ في السَّفَرِ وَأَفْطَر، فَمَنْ شَاءَ صَامَ ومَنْ شَاءَ أَفْطَر» رواه الشيخان.
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে সফর করে রোযাবস্থায় উসফান নামক স্থানে পৌঁছেন। অতঃপর পানির পাত্র ডেকে পাঠালেন ও দিনে পান করলেন, যেন লোকেরা তাকে দেখে। তিনি ইফতার করে মক্কায় আগমন করেন। ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে রোযা রেখেছেন ও ইফতার করেছেন। অতএব যার ইচ্ছা রোযা রাখ, যার ইচ্ছা ইফতার কর।[83]
আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
«كُنَّا نُسَافِرُ مَعَ النَّبيِّ ﷺ فَلَم يَعِبِ الصَّائِمُ على المُفْطِرِ ولا المُفْطِرُ عَلى الصَّائِمِ»
“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফর করতাম, রোযাদার রোযাভঙ্গকারীকে বা রোযাভঙ্গকারী রোযাদারকে কোন তিরস্কার করেনি”।[84]
আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন:
«كُنَّا نَغْزُو مَعَ رَسُولِ الله ﷺ في رَمَضَانَ فَمنَّا الصَّائِمُ ومنَّا المُفطِرُ، فلا يَجِدُ الصَّائمُ على المُفطِرِ، ولا المُفطِرُ على الصَّائِمِ، يَرونَ أنَّ مَنْ وَجَدَ قُوَّةً فصَامَ فَإِنَّ ذَلكَ حَسَنٌ، ويرَونَ أنَّ من وَجَدَ ضَعْفَاً فَأَفْطَرَ فَإِنَّ ذَلكَ حَسَن» رواه مسلم.
“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমযানে যুদ্ধ করতাম, আমাদের থেকে কেউ হত রোযাদার, কেউ হত রোযাভঙ্গকারী। রোযাদার রোযাভঙ্গকারীকে ও রোযাভঙ্গকারী রোযাদারকে তিরস্কার করত না। তারা মনে করত, যার শক্তি আছে সে রোযা রাখবে, এটা তার জন্য ভাল, আর যে দুর্বল সে রোযা ভাঙ্গবে, এটা তার জন্য ভাল”।[85]
তার থেকে আরো বর্ণিত, তিনি বলেন:
«سافَرْنا مَعَ رَسُولِ الله ﷺ إلى مكَّةَ ونَحْنُ صِيامٌ، فنَزَلْنَا مَنْزِلاً فَقَالَ رَسُولُ الله ﷺ: إنَّكُم قدْ دَنَوتُم من عَدُوِّكُم والفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ، فكانَتْ رُخصَةً، فمِنَّا مَنْ صَامَ، ومنَّا مَنْ أَفطَر، ثُم نَزَلْنَا مَنْزِلاً آخَرَ فقَالَ: إِنَّكُم مُصَبِّحُو عدُوِّكُم والفِطرُ أَقْوَى لكم فأفْطِرُوا، وكَانَت عَزْمَةً فَأَفْطَرنَا، ثم قَالَ: لقَد رَأَيْتُنَا نَصُومُ مَعَ رَسُولِ الله ﷺ بَعْدَ ذَلكَ في السَّفَرِ» رواه مسلم.
“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রোযাবস্থায় মক্কার দিকে সফর করেছি, আমরা একস্থানে অবতরণ করলাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা তোমাদের শত্রুদের নিকটবর্তী হয়েছ, পানাহার তোমাদের শক্তির জন্য সহায়ক। এটা ছিল রুখসত। আমাদের কেউ রোযা রাখল, কেউ ভেঙ্গে ফেলল। অতঃপর আমরা অপর স্থানে অবতরণ করলাম, তিনি বললেন: সকালে তোমরা তোমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হবে, ইফতার তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবে। এটা চূড়ান্ত নির্দেশ ছিল, আমরা সকলে ইফতার করলাম। অতঃপর তিনি বলেন: তারপর আমরা নিজেদের দেখেছি, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে রোযা রাখতাম”।[86]
শিক্ষা ও মাসায়েল[87]:
এক. ইসলামের উদারতা, ইসলামি শরিয়তের ছাড় ও তার অনুসারীদের ওপর সজাগ দৃষ্টির প্রমাণ রয়েছে এ হাদিসে।
দুই. মুসাফির রোযা রাখা ও ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে ইচ্ছাধীন, যা সহজ তার পক্ষে তাই সুন্নত। এসব হাদিস শিথিলতা গ্রহণ করার দীক্ষা দেয়।
তিন. যার পক্ষে রোযা কষ্টকর, তার জন্য রোযা না রাখা উত্তম। আর যার পক্ষে কাযা কষ্টকর, সফরে রোযা কষ্টকর নয়, তার পক্ষে সফরে রোযা রাখা উত্তম।
চার. লাগাতার যে সফর করে, অথবা অধিকাংশ সময় সফরে থাকে, চাকুরী বা পেশাদারী কাজের জন্য, তার পক্ষে সফরে রোযা রাখা উত্তম, যদি কষ্ট না হয়। আর যদি কাযার সময় না মিলে, যেমন যাদের সারা বছর অতিবাহিত হয় সফরে, তাদের পক্ষে সফরে রোযা রাখা ওয়াজিব।
পাঁচ. যতদ্রুত সম্ভব শরিয়তের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়া জরুরী।
ছয়. সফরে রোযা রাখা ও ইফতার করা উভয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত, যখন যার দাবি ছিল, তিনি তখন তিনি তাই করেছেন। মুসলিমদের উচিত এ ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করা।
সাত. হামজাহ আসলামি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিস প্রমাণ করে যে, প্রয়োজনীয় প্রত্যেক বিষয় জানা উত্তম। সাহাবায়ে কেরাম এরূপ করতেন।
আট. ইমাম যখন রুখসতের নির্দেশ দেন, তখন তা আযিমত হয়ে যায়, তার বিরোধিতা করা বৈধ নয়, কারণ তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। এ ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা আল্লাহর অবাধ্যতায় তার আনুগত্য করা নয়।
নয়. ইমামের কর্তব্য অধীনদের সাথে নরম আচরণ করা, তাদের দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টি রাখা, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে ইফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন, যেন শত্রুর মোকাবেলায় তারা শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয়। অথচ তাদের মধ্যে এমন লোক ছিল, রোযা যাদের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করত না, কারণ তাদের তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু এমনও লোক ছিল, রোযা যাদের দুর্বল করে দিত, তাই দুর্বলদের প্রতি লক্ষ্য রেখে সবাইকে ইফতারের নির্দেশ দেন।
দশ. দু’টি বিধানের একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা মূলত মুসলিমের উপর শরিয়তের উদারতা, যে কোন একটি গ্রহণে সে তিরস্কারের উপযুক্ত হবে না। তদনুরূপ ইখতিলাফি মাসাআলা, যেখানে কারো পক্ষে দলিল স্পষ্ট নেই, সেখানেও যে কোন একটি গ্রহণের প্রশস্ততা রয়েছে, ইনশাআল্লাহ।
এগার. রুখসত গ্রহণ বা দলিল বুঝার ক্ষেত্রে মুসলিমদের ইখতিলাফ যেন বিচ্ছেদ ও শত্রুতার কারণ না হয়।
বারো. এসব হাদিস প্রমাণ করে যে, সাহাবিদের মাঝে মহব্বত, ভ্রাতৃত্ব ও দ্বীনের গভীর জ্ঞান ছিল। যেমন রোযাদার ও রোযাভঙ্গকারী কেউ কাউকে দোষারোপ করে নি, যেহেতু সকলে শরিয়তের নির্দেশিত পন্থা অনুসরণ করেছে।
তের. রমযান মাসে সফর করা বৈধ, কারণ ফাতহে মক্কার বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে সফর করেছেন।[88]
চৌদ্দ. আগামীকাল সফরের যে নিয়ত করে, সে রাত থেকে ইফতারের নিয়ত করবে না, কারণ নিয়ত দ্বারা মুসাফির হয় না, যতক্ষণ না সে সফর আরম্ভ করে।[89]
পনের. সফরের নিয়তকারী ব্যক্তির মুকিম অবস্থায় ইফতার করা বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সফর আরম্ভ করে, বা যানবাহনে চড়ে।[90]
ইব্ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম, তিনি ইরশাদ করেন:
«مَنْ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْج، ومَنْ لم يَسْتَطِعْ فَعَلَيهِ بالصَّومِ فَإِنَّهُ له وِجَاء» متفق عليه.
“তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে, কারণ তা দৃষ্টি অবনতকারী ও লজ্জাস্থান হেফাজতকারী। আর যে সামর্থ্যবান নয়, সে যেন সওম আঁকড়ে ধরে, কারণ তা যৌন চাহিদার জন্য ভঙ্গুরতা”।[91]
জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: এক যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে নপুংসক হওয়ার অনুমতি চাইল। তিনি বললেন:
«صُمْ وسَلِ الله عَزَّ وجَلَّ مِنْ فَضْلِه» رواه أحمد.
আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে নপুংসক হওয়ার অনুমতি দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
«خِصَاءُ أُمَّتِي الصِّيامُ والقِيام» رواه أحمد.
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সাহাবিদের মধ্যে আল্লাহর ইবাদতের আগ্রহ, তার অবাধ্যতার ভয়, দীনের যাবতীয় বিষয় অকপটে জিজ্ঞেস করা ও আখিরাতের প্রতি গভীর মনোযোগের প্রমাণ রয়েছে এ হাদিসে।
দুই. যৌনা চাহিদা দমন করার জন্য খাসী করা বা নপুংসক হওয়া নিষিদ্ধ। এ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নপুংসক হওয়া বৈধ নয়।
তিন. যৌনাবেগ দমন করার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা বৈধ, যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়ামের মাধ্যমে তা দমন করতে বলেছেন।[94]
চার. সামর্থবান ব্যক্তির জন্য বিবাহ করা মর্যাদার, এটা বান্দার ইবাদত হিসেবে গণ্য ও তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ।
পাঁচ. যার বিবাহের সামর্থ্য নেই, তার উচিত আল্লাহর নিকট বিবাহের খরচ প্রার্থনা করা এবং সিয়াম পালন করা যতক্ষণ না আল্লাহ তার ব্যবস্থা করেন।
ছয়. খাদ্য, পানীয় ও স্ত্রীগমন উপভোগ করা নবীর আদর্শ। ইবাদত ও বুজুর্গি ভেবে এসব থেকে বিরত থাকা সুন্নতের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান কিংবা গায়রে রমযানে এগারো রাকাতের বেশী সালাত আদায় করতেন না। তিনি চার রাকাত সালাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘকরণ সম্পর্কে তোমাকে কি বলব! অতঃপর তিনি চার রাকাত পড়তেন, তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘকরণ সম্পর্কে তোমাকে কি বলব! অতঃপর তিনি তিন রাকাত আদায় করতেন। আয়েশা বলেন: আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি বেতর পড়ার আগে ঘুমান, তিনি বললেন: হে আয়েশা আমার দু’চোখ ঘুমায় কিন্তু আমার অন্তর ঘুমায় না”।[95]
অপর বর্ণনায় আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন, তার মধ্যে বেতর ও ফজরের দু’রাকাত বিদ্যমান”।[96]
মাসরুক রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি বলেন: সাত রাকাত, নয় রাকাত ও এগারো রাকাত, ফজরের দু’রাকাত ব্যতীত।[97]
ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন”।[98]
আব্দুর রহমান ইব্ন হুরমুয আল-আ‘রাজ রহ. বলেন: “আমি লোকদের দেখেছি তারা রমযানে কাফেরদের ওপর লানত করত। তিনি বলেন, কোন কোন ইমাম আট রাকাতে সূরা বাকারা খতম করতেন, আর যখন সূরা বাকারা দ্বারা বারো রাকাত পড়তেন, তখন লোকেরা মনে করত যে তিনি হাল্কা করেছেন”।[99]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
দুই. নবীদের চোখ ঘুমায়, কিন্তু তাদের অন্তর ঘুমায় না, এ জন্য তাদের স্বপ্ন সত্য, এটা নবীদের বৈশিষ্ট্য।[101]
তিন. সকল আলেম একমত যে, রমযান ও গায়রে রমযানে রাতের সালাত সুন্নত, এতে কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই, যার ইচ্ছা কিয়াম লম্বা করে রাকাত সংখ্যা কমাবে, যার ইচ্ছা কিয়াম সংক্ষেপ করে রাকাত সংখ্যা বৃদ্ধি করবে।[102]
চার. রাতের সালাতে কিরাত, রুকু ও সেজদা দীর্ঘ করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত, ছোট কিরাতে অধিক রাকাতের চেয়ে দীর্ঘ কিরাতে এগারো রাকাত অধিক উত্তম।[103]
পাঁচ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো এগারো রাকাতের অধিক তেরো রাকাত পড়েছেন, কখনো তিনি এগারো রাকাতের কম সাত বা নয় রাকাত পড়েছেন, যেমন অন্যান্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, তবে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সচরাচর সালাতের বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ এগারো রাকাত নিয়মিত পড়া।[104]
ছয়. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক দু’রাকাতের পর সালাম ফিরাতেন, একসাথে চার রাকাত বা তার অধিক পড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সচরাচর আমল ও সুন্নত পরিপন্থী। দলিল আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনা: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক দু’রাকাতের পর সালাম ফিরাতেন, এক রাকাত দ্বারা বেতর পড়তেন”।[105] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “রাতের সালাত দু’রাকাত, দু’রাকাত”।[106] এটা বেতর ব্যতীত। অতএব মুসলিম তিন অথবা পাঁচ রাকাত দ্বারা বেতর পড়বে, তবে শেষ রাকাত ব্যতীত বসবে না, যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদিসে এসেছে: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তেরো রাকাত সালাত পড়তেন, তন্মধ্যে পাঁচ রাকাত দ্বারা বেতর পড়তেন, শেষ রাকাত ব্যতীত বসতেন না”।[107]
সাত. সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের পরবর্তী তাবেয়িগণ মদিনায় সালাতে তারাবিহ খুব দীর্ঘ করতেন, যেমন বিশিষ্ট তাবেয়ি আব্দুর রহমান ইব্ন হুরমুয রহ. উল্লেখ করেছেন।
আট. সালাতে তারাবির ‘দো‘আয়ে কুনুতে’ কাফেরদের জন্য বদদো‘আ ও তাদের ওপর লানত করা বৈধ। তারা আমাদের চুক্তির অধীনে থাক বা না-থাক, কুফরের কারণে তারা লানতের উপযুক্ত, তবে এটা ওয়াজিব নয়। এ ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত হচ্ছে যুদ্ধবাজ কাফেরদের জন্য ধ্বংস ও শাস্তির বদদো‘আ করা। যাদের ইসলাম গ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের জন্য হিদায়েত লাভের দো‘আ করা।[108]
নয়. মদিনায় সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িদের রমযানের ‘দো‘আয়ে কুনুত’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘কুনুতে নাযেলা’ থেকে গৃহীত, যে কুনুতে নাযেলা তিনি রা‘ল, যাকওয়ান, বনু লিহইয়ান ও উসাইয়্যাহ সম্প্রদায়ের ওপর করেছেন, যারা কুরআনের কারীদের হত্যা করেছে।[109] মদিনাবাসী রমযানের শেষার্ধ থেকে শেষ পর্যন্ত এ বদদো‘আ করতেন।
দশ. মদিনার সাহাবিদের আমল থেকে জুমার দ্বিতীয় খুতবায় কাফেরদের ওপর বদদো‘আ করার সুন্নত গৃহীত। হাফেয ইব্ন আব্দুল বার রহ. এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে বলেছেন: “আ‘রাজ সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িদের বড় এক জমাতের সাক্ষাত পেয়েছেন, এটা মদিনার আমল ছিল”।[110]
জা‘ফর ইব্ন জাবর রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি আবু বসরা গিফারি সাহাবির সাথে রমযানে মিসরের ফুসতাত থেকে জাহাজে চড়েছিলাম, তাদেরকে যখন জাহাজে উঠানো হল, দুপুরের খানা পেশ করা হল। জা‘ফর তার হাদিসে বলেন: এখনো বাড়ি-ঘরগুলো ছাড়িয়ে যায়নি, তিনি দস্তরখান হাজির করতে বললেন। তিনি বললেন: নিকটে আস। আমি বললাম আপনি কি ঘরগুলো দেখছেন না। আবু বসরাহ বললেন: তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত থেকে বিরত থাকতে চাও? জাফর তার হাদিসে বলেন: অতঃপর তিনি খানা গ্রহণ করেন”।[111]
মুহাম্মদ ইব্ন কাব রহ. বলেন: “আমি রমযানে আনাস ইব্ন মালিকের নিকট আসি, তখন তিনি সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তার জন্য সওয়ারি প্রস্তুত করা হয়েছে, তিনি সফরের পোশাক পরিধান করেন, অতঃপর খানা আনতে বলেন, তিনি খানা ভক্ষণ করেন, আমি তাকে বললাম: এটা কি সুন্নত? তিনি বললেন: সুন্নত, অতঃপর সওয়ারীর ওপর উঠে বসলেন”।[112]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সফরে ইফতার করা নবীর সুন্নত। তার থেকে বর্ণিত: তিনি সফরে সওম পালন করেছেন, যেমন তিনি ইফতার করেছেন। অনুরূপ সাহাবিদের থেকে বর্ণিত: তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কতক সফরে সওম পালন করেছেন, কতক সফরে ইফতার করেছেন।
দুই. এসব হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, যদি কেউ সফর আরম্ভ করে, তার জন্য ইফতার করা বৈধ, সে নিজের শহর বা গ্রাম অতিক্রম করুক বা না-করুক। ইব্নুল কাইয়্যেম রহ. বলেন: “সাহাবায়ে কেরাম যখন সফর করতেন, তখন তারা বাড়ি ত্যাগ করার ভ্রুক্ষেপ না করে ইফতার করতেন, বলতেন এটা সুন্নত ও নবীর আদর্শ”।[113]
তিন. এসব হাদিস প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি দিনের মধ্যবর্তী সময়ে সওম অবস্থায় সফর করে, তার জন্য ইফতার করা বৈধ, যদিও কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে থাকে। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেছেন: “এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রমযানের দিনে যে সফর করবে, তার জন্য সেদিন ইফতার করা বৈধ”।[114]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসে ছিলাম, এমতাবস্থায় তার নিকট এক ব্যক্তি আগমন করল, সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন: কি হয়েছে? সে বলল: সওম অবস্থায় আমি আমার স্ত্রীর ওপর উপগত হয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার কি গোলাম আছে? সে বলল: না, তিনি বললেন: তুমি কি দু’মাস লাগাতার সওম রাখতে পারবে? সে বলল: না, তিনি বললেন: তুমি কি ষাটজন মিসকিনকে খাওয়াতে পারবে? সে বলল: না, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরতি নিলেন। আমরা আমাদের অবস্থানে ছিলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একপাত্র খেজুর নিয়ে হাজির হলেন, অতঃপর বললেন: প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল: আমি। বললেন: তুমি এটা গ্রহণ করে সদকা করে দাও। সে বলল: আমার চেয়ে গরিব কাউকে হে আল্লাহর রাসূল? আল্লাহর শপথ আমার পরিবারের চেয়ে অধিক গরিব মদিনার আশ-পাশে আর কোন পরিবার নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন, তার দাঁত পর্যন্ত দেখা গেল, অতঃপর বললেন: এটা তোমার পরিবারকে খাওয়াও”।[115]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. রমযানের দিনে ওজর ব্যতীত যে স্ত্রী সহবাস করল, যেমন সফর, ভুল ও বলপ্রয়োগ, সে পাপ ও গুনাহ করল, অবশিষ্ট দিন বিরত থাকাসহ তার তওবা করা ওয়াজিব, সে দিনের সওম নষ্ট হয়ে যাবে, তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব।[116]
দুই. কাফফারা ক্রমান্বয়ে ওয়াজিব হয়, প্রথমে গোলাম আযাদ, অতঃপর লাগাতার দু’মাস সওম পালন, যদি সামর্থ্য না থাকে তাহলে ষাটজন মিসকিনকে খাদ্য দান করা।
চার. পাপীর পাপ সম্পর্কে ফতোয়া তলব করা, পাপ প্রকাশ করার অপরাধ হবে না।[118]
পাঁচ. ছাত্রদের সাথে নরম ব্যবহার করা, শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনয়ী হওয়া, দ্বীনের প্রতি লোকদের আগ্রহী করা, পাপের অনুশোচনা ও আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা জরুরী।[119]
ছয়. এক পরিবারকে পুরো কাফফারা দেয়া বৈধ।[120]
সাত. এ হাদিসে সাহাবিদের অন্তরের পবিত্রতা ও অন্তরকে আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাকুলতা প্রমাণ হয়।[121]
আট. গরিব ব্যক্তি কাফফারার খানা নিজে খাওয়া ও নিজ পরিবারের ওপর সদকা করা বৈধ।[122]
নয়. স্বামীর ওপর পরিবারের খরচ ওয়াজিব, যদিও সে গরিব হয়। এ হাদিস দ্বারা ইমাম বুখারি একটি অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন।[123]
দশ. স্ত্রীগমন করে সওম ভঙ্গকারীর ওপর কাফফারা ওয়াজিব, পানাহার করে সওম ভঙ্গকরীর ওপর কাফফারা ওয়াজিব নয়, এটাই ফতোয়া।[124]
এগারো. অধীনদের দুনিয়াবি ও দ্বীনি প্রয়োজন পূরণ করে ইমামের খুশি প্রকাশ করা বৈধ।[125]
বারো. মানুষ নিজের অভাবের কথা এমন ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করতে পারে, যে তাকে সাহায্য করতে সক্ষম, যদি সে অভাব অভিযোগ আকারে পেশ না করে।
তেরো. যদি কাফফারা আদায় না করে একাধিকবার দিনে সহবাস করে, তাহলে তার ওপর এক কাফফারা ওয়াজিব হবে, এতে কারো দ্বিমত নেই।[126]
চৌদ্দ. যদি রমযানের দু’দিন অথবা তার চেয়ে অধিক সহবাস করে, তাহলে প্রত্যেক দিনের মোকাবেলায় একটি করে কাফফারা দিতে হবে।[127]
পনেরো. রমযানের কাযায় যদি সহবাস করে, তাহলে শুধু কাযা ওয়াজিব হবে কাফফারা নয়, কারণ বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী কাফফারা শুধু রমযানের সম্মান বিনষ্টের কারণে ওয়াজিব হয়।[128]
ষোল. সহবাস অবস্থায় যার উপর ফজর উদিত হয়, সে যদি সাথে সাথে উঠে যায়, তাহলে তার ওপর কিছু ওয়াজিব হবে না। আর যদি সে তাতে লিপ্ত থাকে, তাহলে সে গুনাহগার হবে, তার ওপর তওবা ও কাফফারাসহ অবশিষ্ট দিন বিরত থাকা ওয়াজিব।[129]
সতেরো. যদি কেউ স্ত্রীগমনের জন্য পানাহার করে সওম ভঙ্গ করে, তাহলে সে গুনাহগার হবে, কারণ সে বিনা কারণে ইফতার করেছে ও শরিয়তের বিপরীতে বাহানার আশ্রয় নিয়েছে, এ জন্য তার থেকে কাফফারা মওকুফ হবে না।[130]
আঠারো. উপরোক্ত ব্যক্তির ওপর ইসলামের উদারতা ও শিথিলতার প্রমাণ মিলে। সে রমযানে কবিরা গুনাহ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ভীতাবস্থায় এসে বলেছে: “আমি ধ্বংস হয়ে গেছি”, অন্য বর্ণনায় এসেছে: “আমি তো দেখছি আমি ধ্বংস হয়ে গেছি”। এটা তার অনুশোচনা ও তওবার প্রমাণ, ফলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কাফফারা প্রদান করেন, সে তা নিজের পরিবারে খরচ করে, তাদের অভাবের কারণে। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসেছেন।[131]
উনিশ. রমযান না জেনে যদি স্ত্রীগমন করে, তাহলে কাফফারা ওয়াজিব হবে না।[132]
বিশ. ভুলে যদি কেউ সহবাস করে, তার সওম বিশুদ্ধ, তার ওপর কাযা-কাফফারা কিছু ওয়াজিব হবে না।[133]
আবুযর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমযানের সওম পালন করলাম। তিনি মাসের কোন অংশে আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেননি, যখন সাত দিন বাকি, তিনি আমাদের নিয়ে দাঁড়ালেন, রাতের এক তৃতীয়াংশ চলে গেল। যখন ষষ্ঠ দিন বাকি, তিনি আমাদের সাথে দাঁড়ালেন না। যখন পাঁচ দিন বাকি, তিনি আমাদের নিয়ে দাঁড়ালেন রাতের অর্ধেক চলে গেল। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, যদি রাতের বাকি অংশ আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করতেন! তিনি বললেন:
إنَّ الرَّجُلَ إذا صَلَّى مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنصَرِفَ حُسِبَ له قِيَامُ لَيلَةٍ،
“ব্যক্তি যখন ইমামের প্রস্থান পর্যন্ত তার সাথে সালাত আদায় করে, তার জন্য পূর্ণ রাতের সওয়াব লেখা হয়”।
তিনি বললেন: যখন চতুর্থ রাত বাকি, তিনি দাঁড়ালেন না। যখন তৃতীয় রাত বাকি, তিনি নিজ পরিবার, নারী ও লোকদের জমা করে আমাদের সাথে দাঁড়ালেন, অবশেষে আমরা আশঙ্কা করলাম, আমাদের থেকে ‘ফালাহ’ না ছুটে যায়। তিনি বলেন: আমি জিজ্ঞাসা করলাম: ‘ফালাহ’ কি? তিনি বললেন: সেহরি। অতঃপর মাসের অবশিষ্ট দিনে তিনি আমাদের সাথে দাঁড়াননি”।[134]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. এ হাদিস প্রমাণ করে সালাতে তারাবি সুন্নত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূচনা ফরয হওয়ার শঙ্কায় তা ত্যাগ করেন।
দুই. মসজিদে মুসলিমদের সাথে নারীদের তারাবি পড়া বৈধ, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পরিবার, স্ত্রী ও লোকদের জমা করে তাদের সাথে সালাত আদায় করেছেন।
তিন. ইমামের সাথে যে কিয়াম করল তার প্রস্থানের পূর্ব পর্যন্ত, তার জন্য পূর্ণ রাতের কিয়াম লেখা হবে। সুতরাং মুসলিমদের উচিত এ কল্যাণে অলসতা না করা। রমযানের প্রত্যেক রাতে মুসলিমদের সাথে তারাবি পূর্ণ করা। ইমাম আহমদ রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “রমযানে জমাতের সাথে ব্যক্তির সালাত আপনার পছন্দ, না একাকী সালাত? তিনি বলেন: জামাতের সাথে সালাত আদায় করবে ও সুন্নত জীবিত করবে। তিনি আরো বলেন: আমার পছন্দ হচ্ছে ইমামের সাথে সালাত আদায় করা ও বেতর পড়া”।[135]
চার. রাতের প্রথমে তারাবিহ পড়া সুন্নত, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম করেছেন। ইমাম আহমদ রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “কিয়াম (তারাবি) কি শেষ রাত পর্যন্ত বিলম্ব করব? তিনি বললেন: না, মুসলিমদের সুন্নত আমার নিকট অধিক প্রিয়”।[136] শায়খ ইব্ন বায রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: যদি সবাই শেষ রাতে বেতর পড়তে রাজি হয়? তিনি বললেন: সবার সাথে প্রথম রাতে সালাত আদায় করা অধিক উত্তম।
পাঁচ. ব্যক্তি যদি নিজের মধ্যে ইবাদতের আগ্রহ ও শক্তি দেখে, তাহলে মুসলিমদের সাথে প্রথম রাতে সালাত পূর্ণ করবে, অতঃপর শেষ রাতে নিজের জন্য যত ইচ্ছা সালাত আদায় করবে। তাহলে সে দু’টি কল্যাণ জমা করল: ইমামের সাথে সালাতের কল্যাণ ও শেষ রাতে সালাতের কল্যাণ।
ওমর ইব্ন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِذا أَقْبَلَ الَّليْلُ مِنْ هَا هُنَا وَأَدْبَرَ النَّهَارُ مِنْ هَا هُنَا وَغَرَبَتِ الشَّمْسُ فَقَدَ أَفْطَرَ الصَّائِمُ» رَوَاهُ الشَّيْخَان.
“যখন রাত এখান থেকে আগমন করে ও দিন এখান থেকে পশ্চাত গমন করে এবং সূর্যাস্ত যায়, তাহলে সওম পালনকারী ইফতার হল”।[137] তিরমিযির এক বর্ণনায় আছে:
«وَغَابَتِ الشَّمْسُ فَقَدْ أَفْطَرْتَ».
«إِذا جَاءَ الَّليْلُ مِنْ هَا هُنَا، وَذَهَبَ النَّهَارُ مِنْ هَا هُنَا، وغَابَتِ الشَّمْسُ فَقَدَ أَفْطَرَ الصَّائِمُ».
“যখন রাত এখান থেকে আসে ও দিন এখান থেকে প্রস্থান করে এবং সূর্য অদৃশ্য হয়, তাহলে রোযাদার ইফতার করল”।[139]
আব্দুল্লাহ ইব্ন আবু আউফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “কোন এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, তিনি রোযাদার ছিলেন। যখন সূর্য ডুবে গেল তিনি কাউকে বললেন: হে অমুক, উঠ আমাদের জন্য ইফতার (পানীয় জাতীয়) তৈরি কর। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, যদি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে নিতেন। তিনি বললেন: আস আমাদের জন্য ইফতার তেরি কর। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, যদি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে নিতেন। তিনি বললেন: আস আমাদের জন্য ইফতার তৈরি কর। সে বলল: আপনার দিন এখনো বাকি। তিনি বললেন: আস আমাদের জন্য ইফতার তৈরি কর। সে এসে তাদের জন্য ইফতার তৈরি করল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করলেন। অতঃপর বললেন: যখন তোমরা দেখ রাত এখান থেকে আগমন করেছে, তখন রোযাদার ইফতার করল”।[140]
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে: “তিনি নিজ হাতে পূর্ব দিকে ইশারা করেছেন”। আহমদের এক বর্ণনায় আছে: “তখন ইফতার হালাল হল”। আবু দাউদের এক বর্ণনায় আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলালকে বলেছেন।[141]
শিক্ষা ও মাসায়েল[142]:
এক. সূর্যাস্ত হলেই ইফতার হালাল হয়। রাত আগমন ও দিন পশ্চাদগমন দ্বারা তাই উদ্দেশ্য, অর্থাৎ সূর্যের গোলক অদৃশ্য হওয়া, দিগন্ত বা সূর্যের কক্ষপথে আলো থাকলে তাতে সমস্যা নেই।[143]
দুই. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরয়ি বিধানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো গুরুত্বসহ বর্ণনা করেছেন ও স্পষ্ট বাক্যে তার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যেমন তিনি ইফতার আরম্ভের তিনটি আলামত বর্ণনা করেছেন: রাতের আগমন, দিনের পশ্চাৎ গমন ও সূর্যাস্ত। এ তিনটি আলমত একসাথে ঘটে, একটি প্রকাশ পেলে বাকি দু’টি অবশ্যই প্রকাশ পায়। কোন কারণে কেউ সূর্যাস্ত দেখতে পায় না, কিন্তু সে পুবের অন্ধকার দেখতে পায়, তখন তার জন্য ইফতার করা বৈধ। এ জন্য তিনি সবক’টি নিদর্শন বর্ণনা করেছেন।
তিন. যখন সূর্যের গোলক ডুবে গেল, রোযাদার ইফতার করল, দিগন্তে বিদ্যমান লাল আভা ধর্তব্য নয়। যখন সূর্যের গোলক ডুবে যায়, তখন পূর্ব দিক থেকে অন্ধকার প্রকাশ পায়।
চার. রাতের কোন অংশ রোযাবস্থায় থাকা ওয়াজিব নয়, এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত।[144] ইফতার দেরি করা মোস্তাহাব নয়, বরং হাদিস অনুসারে দ্রুত ইফতার করা মোস্তাহাব।
পাঁচ. মানুষ অজানা বিষয় দ্রুত অস্বীকার করে, যেমন বেলাল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পালনে বিলম্ব করেছে। কারণ ইফতারের সময় হয়েছে বেলালের জানা ছিল না।
ছয়. সাহাবায়ে কেরাম সতর্কতা অবলম্বন অথবা স্পষ্টভাবে জানা অথবা অধিক জানার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতেন, অতঃপর তৎক্ষণাৎ তার নির্দেশ পালনে তৎপর হতেন, যেমন বেলাল সূর্যাস্তের পর রক্তিম আভা ও উজ্জ্বলতা দেখে ভেবেছিল ইফতারের সময় হয়নি, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে জানিয়ে দিলেন, সে সাথে সাথে তা বস্তবায়ন করল।
সাত. আলেম অথবা দায়িত্বশীলকে স্মরণ করিয়ে দেয়া, যদি তার ভুলে যাওয়া বা অন্যমনস্ক হওয়ার আশঙ্কা হয়, তবে তৃতীয়বারের পর না বলা।
আট. কেউ যদি কোন বিধান না জানে, তার জিজ্ঞাসা করা ও জানতে চাওয়া দোষণীয় নয়।
নয়. এ হাদিসে কিতাবি তথা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের বিরোধিতার ইঙ্গিত রয়েছে, কারণ তারা সূর্যাস্তের পর ইফতারে বিলম্ব করে। আরো রয়েছে শিয়াদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ, যারা ইফতারের জন্য নক্ষত্র বিকশিত হওয়ার অপেক্ষা করে।
দশ. ক্ষতির আশঙ্কা না হলে সফরে সওম বৈধ।
এগারো. ইফতারের সময় মুয়াজ্জিনের জবাব দেয়া ও আযান পরবর্তী যিকর পাঠ করা রোযাদারের জন্য বৈধ। কারণ রোযাদার ও রোযাভঙ্গকারী সবাই দলিলের ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত।[145]
বারো. রোযা রাখা, ইফতার করা ও সালাতের সময় নিরূপণে মূল হচ্ছে যমিন, যেখানে সে অবস্থান করছে; অথবা যে শূন্যে সে বিচরণ করছে। অতএব বিমান বন্দরে থাকাবস্থায় যার সূর্যাস্ত গেল, অথবা সেখানে মাগরিবের সালাত আদায় করল, অতঃপর পশ্চিমের উদ্দেশ্যে বিমান উড্ডয়ন করল, ফলে সে পুনরায় সূর্য দেখল, তাহলে তার পানাহার থেকে বিরত থাকা জরুরী নয়, তার সালাত ও সিয়াম উভয় শুদ্ধ। কারণ সে যে জমিতে ছিল তার হিসেবে ইফতার ও সালাত সম্পন্ন করেছে, তাই পুনরায় তা আদায় করতে হবে না। আর যদি সূর্যাস্তের সামান্য আগে বিমান উড্ডয়ন করে, তার সাথে দিন চলতে থাকে, তাহলে তার জন্য ইফতার ও সালাত আদায় বৈধ নয়, যতক্ষণ না তার আকাশের সূর্যাস্ত যায়, যেখানে সে ভ্রমণ করছে। আর যদি সে এমন দেশের ওপর দিয়ে গমন করে, যার অধিবাসীরা ইফতার ও সালাত আদায় করেছে, কিন্তু সে ঐ দেশের আসমানে (শূন্যে) সূর্য দেখছে, তার সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার ও সালাত বৈধ হবে না।[146]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ ذَرَعَهُ قَيءٌ وهُو صَائمٌ فَليسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ وَإِن اسْتَقَاءَ فلْيَقض»
“রোযাবস্থায় যার বমি হল, তার ওপর কাযা জরুরী নয়। হ্যাঁ, যদি সে স্বেচ্ছায় বমি করে, তাহলে সে যেন কাযা করে”।[147]
মি‘দান ইব্ন তালহা রহ. থেকে বর্ণিত: “আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বমি করার পর রোযা ভঙ্গ করেছেন। পরবর্তীতে দিমাশকের এক মসজিদে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাস সাওবানের সঙ্গে সাক্ষাত করি, আমি বললাম: আবুদ দারদা আমাকে বলেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বমি করার পর রোযা ভঙ্গ করেছেন। তিনি বললেন: হ্যাঁ, তিনি ঠিক বলেছেন। আমি তার পানি ঢেলেছি”।[148]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া যে, তার অনিচ্ছায় যেসব কাজ সংঘটিত হয়, সে জন্য তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। হ্যাঁ, বান্দার ইচ্ছাধীন কাজের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যেমন বমি করা। অর্থাৎ আঙ্গুল ঢুকিয়ে বা গলায় কিছু প্রবেশ করিয়ে, অথবা দুর্গন্ধ শুকে, অথবা বিরক্তিকর কোন জিনিস দেখে বা কোন কারণে বমি করল। যদি সে ইচ্ছাকৃত এমন করে, তবে তার সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে, অনিচ্ছাকৃত হলে সিয়াম নষ্ট হবে না।
দুই. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে বর্ণিত আছে, তিনি বমি করেছেন, অতঃপর রোযা ভঙ্গ করেছেন, এর অর্থ তিনি বমির কারণে দুর্বল হয়েছিলেন বিধায় সিয়াম ভঙ্গ করেছেন। বমির কারণে তিনি সওম ভঙ্গ করেন নি। তাহাবির এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«ولَكني قِئْتُ فَضَعُفْتُ عن الصَّومِ فأَفطرتُ».
তিন. এসব হাদিস প্রমাণ করে, স্বেচ্ছায় যে বমি করবে, তার সওম ভেঙ্গে যাবে, হোক সে বমি তিক্ত পানি, খানা, কফ কিংবা রক্ত, কারণ এসব হাদিসের অর্থ ও ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত।[150]
চার. রমযানের দিনে রোযাদারের বমি করা বৈধ নয়, কারণ বমির কারণে তার রোযা ভেঙ্গে যাবে। হ্যাঁ, কেউ যদি অসুস্থ হয়, তাহলে রোগের কারণে অপারগ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ١٨٤﴾ [البقرة: 184]
“তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে”।[151] অর্থাৎ সে রমযানে পানাহার করে পরে কাযা করবে।[152]
পাঁচ. ইচ্ছাকৃতভাবে যে বমি করবে, তার সওম ভঙ্গের বিধান ইসলামি শরিয়তের ইনসাফকে প্রমাণ করে। আরো প্রমাণ করে যে, আল্লাহর প্রত্যেক বিধান বান্দার ওপর ইনসাফ ও রহমত। শায়খুল ইসলাম ইব্ন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন: “রোযাদারকে সেসব বস্তু থেকে বারণ করা হয়েছে, যা তার শক্তি বৃদ্ধি করে ও খাদ্যের যোগান দেয়, যেমন খাদ্য ও পানীয়, অতএব যা তাকে দুর্বল করে ও যার ফলে তার খাদ্য বের হয়, তা থেকে তাকে বারণ করা হয়েছে। যদি তাকে এর অনুমিত দেয়া হয়, সে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ও ইবাদতে সীমালঙ্গনকারী গণ্য হবে।[153]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلى أُمَّتي لأَمَرْتُهُمْ بالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلاةٍ» متفق عليه.
“যদি আমার উম্মতের ওপর কষ্ট না হত, তাহলে আমি প্রত্যেক সালাতের সময় তাদেরকে অবশ্যই মিসওয়াকের নির্দেশ দিতাম”।[154]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ عَزَّ وَجَلَّ»
“মিসওয়াক মুখ পবিত্র রাখা ও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার বস্তু”।[155]
তিনি আরো বলেছেন:
«لا بَأْسَ أَنْ يَسْتَاكَ الصَّائِمُ بِالسِّوَاكِ الرَّطْبِ وَاليَابِسِ».
মু‘আয রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি জানতেন মিসওয়াকের পর রোযাদারের মুখে খুলুফ থাকবে, তিনি তাদেরকে স্বেচ্ছায় মুখ দুর্গন্ধময় করতে নির্দেশ দেন নি, তাতে কোন কল্যাণ নেই, বরং তাতে রয়েছে অনিষ্ট, তবে যে রোগে আক্রান্ত, যার থেকে মুক্তির পথ নেই সে ব্যতীত।[158]
হাসান রহ. থেকে বর্ণিত: “তিনি রোযাদার ব্যক্তির সুরমা ব্যবহারে কোন সমস্যা মনে করতেন না”।[160]
যুহরি রহ. বলেন: “রোযাদারের সুরমা ব্যবহারে কোন সমস্যা নেই”।[161]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. মিসওয়াকের ফযিলত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সালাতের সময় তার নির্দেশ দেয়ার ইচ্ছা করেছেন।
দুই. উম্মতের ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া যে, তিনি তাদের ওপর কষ্টের বিধান চাপিয়ে দেননি।
তিন. দিনের শুরু ও শেষে রোযাদারের জন্য মিসওয়াক করা বৈধ। রোযাদার ও গায়রে রোযাদার সবার জন্য মিসওয়াক করা সুন্নত, সবাই হাদিসের হাদিসের ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত।
চার. কাঁচা ও শুষ্ক সব মিসওয়াক রোযাদারের জন্য বৈধ।[162]
পাঁচ. মিসওয়াকের সময় দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত বের হলে সমস্যা নেই, সওম নষ্ট হবে না, তবে রক্ত গলাধঃকরণ করবে না।[163]
ছয়. রোযাদার সুরমা ব্যবহার করতে পারবে, অনুরূপ কান ও চোখের ড্রপ ব্যবহার করতে পারবে, যদিও স্বাদ অনুভব হয়, এ ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা বা তার ইঙ্গিত নেই, দ্বিতীয়ত এগুলো খাদ্যনালী নয়।[164]
সাত. নাকের ড্রপ যদি পেটে যায়, তাহলে রোযা ভেঙে যাবে, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকে বেশী পানি দিতে নিষেধ করেছেন, যদি পেটে না পৌঁছে, কোন সমস্যা নেই।[165]
আট. ইনহেলার (হাঁপানির স্প্রে) ও এ জাতীয় বস্তু যা ফুসফুসে যায়, রোযাদার ব্যবহার করতে পারবে, এতে কোন সমস্যা হবে না।[166]
নয়. ইনজেকশনে রোযা ভাঙ্গবে না, মাংস বা রগ যেখানে গ্রহণ করা হোক, হ্যাঁ খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত ইনজেকশনে রোযা ভাঙ্গবে।[167]
দশ. রোযাদার যদি খাদ্য জাতীয় ইনজেকশন নিতে বাধ্য হয়, তাহলে অসুস্থতার জন্য সে তা নিবে ও পরে রোযাটি কাযা করবে।
এগারো. যদি রোযাদার কঠিন ঘ্রাণযুক্ত তেল ব্যবহার করে, রোযা ভঙ্গ হবে না, কারণ ঘ্রাণ যত শক্তিশালী হোক রোযা ভঙ্গের কারণ নয়।[168]
বারো. অসুস্থতার জন্য ডুশ (সাপোজিটর) ব্যবহার করলে সওম ভঙ্গ হবে না, অতএব সওম পালনকারী এটা ব্যবহার করতে পারে।[169]
তেরো. দাঁতের মাজন রোযা ভঙ্গকারী নয়, বরং তা মিসওয়াকের মতই, তবে পেটে যেন না যায় সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী, যদি অনিচ্ছায় পেটে যায়, তবে সমস্যা নেই।[170] মাজন দ্বারা রাতে দাঁত মাজাই উত্তম।
চৌদ্দ. গড়গড়ার ওষুধের কারণে সওম ভঙ্গ হবে না, যদি তা গলাধঃকরণ না করে, তবে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম।[171]
পনেরো. মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য স্প্রে ব্যবহার করা বৈধ, যদি তার মূল ধাতু গলায় না পৌঁছে।[172]
ষোল. রোযাদারের থু থু গলাধঃকরণে সমস্যা নেই, কিন্তু নাকের শ্লেষ্মা বা কপ গলাধঃকরণ বৈধ নয়, কারণ এগুলো থেকে বিরত থাকা সম্ভব।[173]
আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«أتيتُ رسُولَ الله ﷺ فَقُلْتُ: مُرْني بأَمْرٍ آخُذُهُ عَنْكَ، قَالَ: عَلَيْكَ بالصَّومِِ فَإِنَّهُ لا مِثْلَ لَه».
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করি, অতঃপর তাকে বলি: আপনি আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিন, যা আমি আপনার থেকে গ্রহণ করব, তিনি বললেন: তুমি সওম আঁকড়ে ধর, কারণ তার সমকক্ষ কিছু নেই”।
হাদিসটি অন্য শব্দে এভাবে এসেছে: আবু উমামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন:
«أَيُّ العَمَل أَفْضَلُ؟ قَالَ: عَلَيْكَ بالصَّومِِ فَإِنَّهُ لا عِدْلَ لَهُ».
“কোন আমল সর্বোত্তম? তিনি বলেন: তুমি সওম আঁকড়ে ধর, কারণ তার সমকক্ষ কিছু নেই”।
অপর বর্ণনায় এসেছে: আবু উমামা বলেছেন: “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি জিনিসের নির্দেশ দিন, যার মাধ্যমে আমি জান্নাতে প্রবেশ করব, তিনি বললেন: তুমি সওম আঁকড়ে ধর, কারণ সওমের কোন তুলনা নেই। বর্ণনাকারী বলেন: আবু উমামার বাড়িতে মেহমান আগমন ব্যতীত দিনে কখনো ধোঁয়া দেখা যেত না। যদি তারা ধোঁয়া দেখত, মনে করত আজ তার বাড়িতে মেহমান এসেছে”।
অপর বর্ণনায় এসেছে: আমি বললাম: “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি আমলের নির্দেশ দিন, তিনি বললেন: তুমি সওম আঁকড়ে ধর, কারণ তার কোন তুলনা নেই। বর্ণনাকারী বলেন: আবু উমামা, তার স্ত্রী ও খাদেমদের সওম ব্যতীত দেখা যেত না। তাদের বাড়িতে দিনে আগুন দেখলে বলা হত মেহমান এসেছে, কোন আগন্তুক এসেছে। বর্ণনাকারী বলেন: এভাবে সে এক দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে। অতঃপর আমি তার কাছে এসে বলি: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাদেরকে সওমের নির্দেশ দিয়েছেন, আশা করি আল্লাহ তাতে আমাদেরকে বরকত দান করেছেন। হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে আরেকটি আমলের নির্দেশ দেন, তিনি বলেন: জেনে রাখ, তোমার এমন কোন সেজদা নেই, যার দ্বারা আল্লাহ তোমার মর্তবা বৃদ্ধি করেন না ও তোমার পাপ মোচন করেন না”।[175]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সাহাবিদের আখেরাতের আমল জানার আগ্রহ।
দুই. সওম সর্বোত্তম আমল, এ হাদিস তাই প্রমাণ করে, অপর হাদিসে এসেছে যে, সালাত সর্বোত্তম ইবাদত, যেমন:
«واعلَمُوا أنَّ خيرَ أعمالِكُمُ الصَّلاة»،
“জেনে রেখ, তোমাদের সর্বোত্তম আমল সালাত”।
স্পষ্টত বুঝা যায় আমলের শ্রেষ্ঠত্ব মানুষের অবস্থার উপর নির্ভর করে, কতক মানুষের পক্ষে সওম উত্তম, কারণ সওম তাদেরকে হারাম প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখে, তাদের অন্তঃকরণকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য পরিশুদ্ধ করে। আবার কারো পক্ষে সালাত উত্তম, কারণ তাদের শরীর সওম পালনে সক্ষম নয়, বা সওমের কারণে অন্যান্য কর্তব্যে ত্রুটি হবে। ইব্নুল কাইয়্যিম রহ. বলেন: “নারীর প্রতি যার আগ্রহ বেশী, তার জন্য সওম উত্তম অন্যান্য ইবাদত থেকে”।
তিন. সওম মানুষের প্রবৃত্তিকে নষ্ট করে, যা অনেক পাপ সংঘটিত করে ও ইবাদত থেকে বিরত রাখে। যেসব যুবকরা বিবাহের সামর্থ্য রাখে না, কিন্তু তারা পাপের আশঙ্কা করে, তাদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এ দিক থেকে সওমের কোন তুলনা বা সমকক্ষ নেই”।
চার. আবু উমামা ও তার পরিবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওমের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, এখান থেকে বুঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম শরিয়তের আদেশ দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতেন।
পাঁচ. মেহমানের সম্মান করা ইসলামি বিধান, তার সম্মানে নফল সওম ত্যাগ করা বৈধ।
[1] আহমদ: (৩/১২), জামে সগির: (৪৮০১) গ্রন্থে সুয়ূতি হাদিসটি সহিহ বলেছেন, আলবানি সহিহুল জামে গ্রন্থে হাদিসটি হাসান বলেছেন।
[3] ইব্ন আবি আসেম ফিল আহাদ ওয়াল মাসানি: (২৭৫৮), বায্যার: (৯৭৪), তাবরানি ফিল কাবির: (২২/৩৩৭), হাদিস নং: (৮৪৫), হাফেয ইব্ন হাজার হাদিসটি হাসান বলেছেন, দেখুন: মুখতাসার যাওয়ায়েদে মুসনাদিল বায্যার: (৬৯১)
[4] সহিহ ইব্ন হিব্বান: (৩৪৬৭), আবু নায়িম ফিল হিলইয়াহ: (৮/৩২০), সহিহুল জামে: (১৮৪৪) গ্রন্থে আলবানি হাদিসটি হাসান বলেছেন। সিলসিলাতুস সাহিহাহ: (১৬৫৪)
[5] আবু দাউদ: (২৩৪৫), বায়হাকি: (৪/২৩৬), সহিহ ইব্ন হিব্বান: (৩৪৭৫), আলবানি সহিহ আবু দাউদে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[7] বুখারি: ১৮২৩), মুসলিম: (১০৯৫), অনুরূপ হাদিস বর্ণিত আছে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু সায়িদ, জাবের, আয়েশা. আমর ইব্ন আস, হুযায়ফা, ইরবায, আবু লাইলা, তালক, ইয়াশ ইব্ন তালক, ওমর, উতবা ইব্ন আব্দ, আবু দারদা ও সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখদের থেকে। দেখুন: শারহু ইব্ন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/১৮৯), মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/১৫৪)
[9] আবু দাউদ: (২৩৪৪), আহমদ: (৪/১২৬), নাসায়ি: (৪/১৪৫), সহিহ ইব্ন খুযাইমাহ: (১৯৩৮), ইব্ন হিব্বান: (৩৪৬৫), আলবানি সহিহ আবু দাউদে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[30] আবু দাউদ: (২৩৫০), আহমদ: (২/৫১০), দারা কুতনি: (২/১৬৫), বায়হাকি: (৪/২১৮), হাকেম: (১/৫৮৮), তিনি মুসলিমের শর্তে সহিহ বলেছেন, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন।
[34] ইমাম নববী বলেছেন: “যদি ফজর উদয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে তার জন্য পানাহার ও স্ত্রীগমন বৈধ, এতে কারো দ্বিমত নেই, যতক্ষণ না ফজর স্পষ্ট হয়”। মাজমু: (৬/৩১৩), দেখুন: যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৫৫)
[35] কুরতুবি এ ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেন, এটাই যুক্তিযুক্ত। আল-মুফহিম: (৩/১৫১), দেখুন: শারহুন নববী: (৭/২০৪), দিবায: (৩/১৯৪)
[39] “মুখতাসারে মুনযিরির” উপর শায়খ আহমদ শাকেরের টিকা: (৩/২৩৩), তামামুল মিন্নাহ লিল আলবানি: (৪১৭-৪১৮)
[42] শারহুন নববী আলা মুসলিম: (৭/২০৭-২০৮), ফাতহুল বারি: (৪/১৩৮-১৩৯), তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩১৭), শারহু ইব্ন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (১৯৩-১৯৪), ইযাহুল মাসালেক ইলা মুয়াত্তা ইমাম মালেক, লিল কান্দলভী: (৫/৫৮), যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৫৭-৩৭৭)
[44] বুখারি: (১৮২৬), মুসলিম: (১১০৬), আবু দাউদ: (২৩৮৪), আহমদ: (৬/৪৪), তৃতীয় বর্ণনা মুসলিমের, চতুর্থ বর্ণনা আবু দাউদ ও আহমদের, পঞ্চম বর্ণনা ইব্ন হিব্বানের: (৩৫৪৫)
[47] আবু দাউদ: (২৩৮৫), দারামি: (১৭২৪), আব্দ ইব্ন হুমাইদ: (২১), হাদিসটি সহিহ বলেছেন ইব্ন হিব্বান: (৩৫৪৪), হাকেম, তিনি বলেছেন বুখারি ও মসলিমের শর্ত মোতাবেক, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন: (১/৫৯৬) ও আলবানি, সহিহ আবু দাউদে।
[48] তাবারি তার তাফসির গ্রন্থে বলেছেন: “আরবদের ভাষায় মোবাশারা হচ্ছে চামড়ার সাথে চামড়া মিলানো, আর পুরুষের চামড়া হচ্ছে তার বাহ্যিক শরীর”: (২/১৬৮), দেখুন: ফাতহুল বারি: (৪/১৪৯)
[50] সহিহ ইব্ন খুযাইমাহ: (১৮৯৭), দেখুন: ফাতাওয়া ইব্ন বায: (২/১৬৪), এবং তার মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল: (১৫/৩১৫)
[51] ফাতাওয়া ইব্ন বায: (২/১৬৪), তার মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল: (১৫/২৬৮-৩১৫), ফাতাওয়াস সিয়াম লি ইব্ন জাবরিন: (৫৪)
[55] অনুরূপ আরও ভুল বুঝার সম্ভাবনা রয়েছে, তৃতীয়বার পাপ থেকে তওবাকারীর হাদিস ও আল্লাহর বাণী থেকে: اعمل ما شئت فقد غفرت لك “তুমি যা ইচ্ছা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি”। মূলত: এ ভুল বুঝার সম্ভাবনা বাতিল। এর দলিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “আমি তোমাদের মধ্যে অধিক পরহেযগার ও আল্লাহ ভীরু”। উপরন্তু এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা রয়েছে যে, ব্যক্তি বুযুর্গী ও মর্যাদার যে স্তরে উপনীত হোক, শরিয়াতের বিধান তার থেকে মওকুফ হবে না”। আল-মুফহিম: (৩/১৬৪-১৬৫)
[57] নাসায়ি ফিল কুবরা: (৩২৮৬), তাবরানি ফিল কাবির: (৮/১৫৭), হাদিস নং: (৭৬৬৭), মুসনাদে শামি: (৫৭৭), বায়হাকি: (৪/২১৬), এ হাদিস সহিহ বলেছেন ইব্ন খুযাইমাহ: (১৯৮৬), ইব্ন হিব্বান: (৭৪৬১) ও হাকেম: (১/৫৯৫), তিনি বলেছেন মুসলিমের শর্ত মোতাবেক, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন।
[58] আর-রূহ লি ইব্নিল কাইয়্যিম: (৫৭), দেখুন: আস-সুন্নাহ, লিল লালেকায়ি: (৬/১১২৭), ইসবাতু আযাবিল কাবর লিল বায়হাকি: (১/১১০)
[64] ইব্ন খুযাইমাহ: (২০৬১), সহিহ ইব্ন হিব্বান: (৩৫২০), হাকেম: (১/৫৯৯), তিনি বলেছেন বুখারি ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন।
[66] আবু ইয়ালা: (৩৭৯২), বায্যার: (৯৮৪), বায়হাকি: (৪/২৩৯), সহিহ ইব্ন খুযাইমাহ: (২০৬৩), ইব্ন হিব্বান: (৩৫০৪-৩৫০৫), হায়সামি মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/১৫৫) গ্রন্থে বলেছেন, আবু ইয়ালার বর্ণনাকারীগণ সহিহ গ্রন্থের বর্ণনাকারী।
[67] আব্দুর রায্যাক: (৭৫৯১), বায়হাকি: (৪/২৩৮), হাফেয ইব্ন হাজার ফাতহুল বারিতে : (৪/১৯৯), হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[79] আবুদাউদ: (২৪০৮) আহমদ: (৪/৩৪৭) তিরমিযি: (৭১৫) তিনি বলেছেন, হাদিসটি হাসান। ইব্ন মাজাহ: (১৬৬৭) তাবরানি ফিল কাবির: (১/২৬৩) হাদিস নং:(৭৬৫) বায়হাকি: (৪/২৩১) সহিহ আবু দাউদ লিল আলবানি। শায়খ ইব্ন বাযও তার ফাতাওয়ায় হাদিসটি সহিহ বলেছেন: (১৫/২২৪)
[92] আহমদ: (৩/৩৮২), ইব্ন মুবারক ফিয যুহদ: (১১০৭), তার বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, কিন্তু জাবের থেকে বর্ণনাকারী ব্যক্তি মাজহুল ও অপরিচিত, তবে এর দু’টি শাহেদ হাদিস আছে।
[93] আহমদ: (২/১৭৩), বগভি ফি শারহিস সুন্নাহ: (২২৩৮), হায়সামি: (৪/২৫৩), তিনি তাবরানির সূত্রে উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেছেন এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, কতিপয়ের ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে, শায়খ আহমদ শাকের: (৬৬১২) ও আলবানি: (১৮৩০), এ হাদিসটি সহিহ বলেছেন, তবে তাদের বিশুদ্ধ হাদিসে “কিয়াম” নেই, কারণ তা দুর্বল, যেমন আলবানি তা বর্ণনা করেছেন।
[99] মুয়াত্তা মালেক: ১/১১৫), আব্দুর রায্যাক: (৭৭৩৪), বায়হাকি: (২/৪৯৭), তার সনদ সহিহ, আব্দুর রহমান ইব্ন হুরমুয প্রখ্যাত তাবিয়ি, তিনি এ বর্ণনায় মদিনাবাসীদের আমল বর্ণনা করছেন। দেখুন তার জীবনী: সিয়ারে আলামিন নুবালা: (৫/৬৯)
[104] দেখুন: ফাতাওয়া: নং:(৯৩৫৩), ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ। ফাতহুল বারি লি ইব্ন হাজার: (৩/২০), শারহুন নববী: (৬/১৮), সুবুলুস সালাম: (২/১৩)
[108] আল-ইস্তেযকার: (২/৭৩), ইমাম বুখারি এ সংক্রান্ত (৫৮), (৯৮), (৫৯) ও (১০০) নং বাব/অধ্যায়সমূহ রচনা করেছেন।
[111] আবু দাউদ: (২৪১২), আহমদ: (৬/৩৯৮), দারামি: (১৭১৩), তাবরানি ফিল কাবির: (২/২৭৯-২৮০), হাদিস নং: (২১৬৯-২১৭০), শাওকানি বলেন: এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, নাইলুল আওতার: (৪/৩১১), দেখুন: তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৪৩০), আলবানি ইরওয়া: (৪/১৬৩) গ্রন্থে হাদিসটি সহিহ বলেছেন, হাদিস নং: (৯২৮)
[112] তিরমিযি: (৭৯৯-৮০০), তিনি হাদিসটি হাসান বলেছেন। দিয়া’ ফিল মুখতারাহ: (২৬০২), দারাকুতনি: (২/১৮৭), বায়হাকি: (৪/২৪৭), আলবানি ইরওয়া: (৪/৬৪) ও সহিহ তিরমিযিতে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[113] যাদুল মায়াদ: (২/৫৬), এ মাসআলাটি দ্বিমতপূর্ণ, ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত, ঘর থেকে বের হয়ে ইফতার করবে। ইসহাক বলেছেন: বরং যখন সে সফরে পা রাখবে তখন থেকে, যেমন আনাস করেছেন। দেখুন: মুগনি: (৪/৩৪৫-৩৪৮), ফাতহুল বারি: (৪/১৮০-১৮২)
[114] যাদুল মায়াদ: (২/৫২), তাহযিবুস সুনান: (৭/৩৯), এটাই শা’বি, আহমদ, ইসহাক, আবু দাউদ ও ইব্ন মুনযিরের ব্যক্তব্য। তবে তিন ইমাম ও ইমাম আওযায়ি এর বিপরীত মত প্রকাশ করেন, তাদের নিকট যে ব্যক্তি সওম অবস্থায় সফর আরম্ভ করে, সে ঐ দিন ইফতার করবে না। দেখুন: মুখতাসারুস সুনান লিল মুনযিরি: (৩/২৯১)
[116] ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম লি ইব্ন উসাইমিন: (৪৭৪), শারহুল মুমতি: (৬/৪০১), জমহুর ও অধিকাংশ আলেমগণ বলেন কাফ্ফারার সাথে কাযা করতে হবে। দেখুন: আল-মুফহিম: (৩/১৭২) শাইখুল ইব্ন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন তার কাযা করতে হবে না, যদি কাযা ওয়াজিব হত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তাকে তার নির্দেশ দিতেন।
[124] হানাফি ও মালেকি মাজহাবের আলেমগণ পানাহার করে সওম ভঙ্গকারীর ওপর কাফ্ফারা ওয়াজিব করেন। দেখুন: আল-মুফহিম: (৩/১৭৩)
[128] দেখুন: আল-উম্ম: (২/১০০), তাফসিরুল কুরতুবি: (২/২৮৪), আল-মুগনি: (৪/৩৭৮), লাজনায়ে দায়েমার ফাতাওয়া অনুরূপ। ফাতাওয়া নং: (১৩৪৭৫)
[129] দেখুন: মাজমুউল ফাতাওয়া: (৬/৩১৬), রওযাতুত তালেবিন: (২/৩৬৫), আল-মুগনি: (৪/৩৭৯), কাশ্শাফুল কানা: (২/৩২৫), ইমাম বায়হাকি তার সুনান গ্রন্থে ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন: “যদি সালাতের আযান দেয়া হয়, আর ব্যক্তি তার স্ত্রীর ওপর থাকে, তাকে সে দিনের সওম থেকে বিরত রাখা হবে না, যদি সে সওম রাখতে চায় উঠে গোসল করবে ও তার সওম পুর্ণ করবে”। ইনশাআল্লাহ এটা বিশুদ্ধ।
[133] দেখুন: আল-উম্ম: (২/৯৯), আল-ইস্তেযকার: (১০/১১১), আল-মুফহিম: (৩/১৬৯), শারহু ইব্ন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/২১৭)
[134] আবু দাউদ: (১৩৭৫), তিরমিযি: (৮০৬), তিনি বলেছেন হাদিসটি হাসান। নাসায়ি: (৩/৮৩), ইব্ন মাজাহ: (১৩২৭), আহমদ: (৫/১৬৩), ইব্ন খুযাইমাহ: (২২০৫) ও ইব্ন হিব্বান: (২৫৪৭) হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[143] ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন: “এ কথা বেলাল তাকে এ জন্য বলেছে, যেহেতু সে সূর্যের আলো উজ্জ্বল দেখছিল, যদিও গোলক অদৃশ্য ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যের আলো উপেক্ষা করে, সূর্যের শরীর অদৃশ্য হওয়াকে গ্রহণ করেন। অতঃপর যে সূর্যের শরীর দেখতে পায় না, তার ইফতারের আলামত বর্ণনা করেন, অর্থাৎ সে পুবদিক থেকে রাতের আগমন গণ্য করবে”। আল-মুফহিম: (৩/১৫৯)
[147] আবুদাউদ: (২৩৮০) আহমদ: (২/৪৯৮) সহিহ ইব্ন খুজাইমা: (১৯৬০) সহিহ ইব্ন হিব্বান: (৩৫১৮) সহিহ হাকেম: (১/৮৫৫-৫৮৯)
[148] আবুদাউদ: (২৩৮১) আহমদ: (৬/১৯) নাসায়ি ফিল কুবরা: (৩২১০-৩১২৯) সহিহ ইব্ন হিব্বান: (১০৯৭) হাকেম: (১/৫৮৮-৫৮৯)
[155] আহমদ: (৬/৬২), নাসায়ি: (১/১০), দারামি: (৬৮৪), আবু ইয়ালা: (৪৯৪৬), সহিহ ইব্ন খুযাইমাহ: (১৩৫), ও সহিহ ইব্ন হিব্বান: (১০৬৭)
[158] তাবরানি ফিল কাবির: (২০/৭০), হাদিস নং: (১৩৩), মুসনাদে শামি: (২২৫০), হাফেয ইব্ন হাজার এর সনদ জাইয়্যেদ বলেছেন: তালখিস: (২/২০২), কিন্তু হায়সামি বকর ইব্ন খুনাইস বর্ণনাকারীর কারণে হাদিসটি দুর্বল বলেছেন, তবে তিনি বলেছেন: ইব্ন মুয়িন তাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/১৬৫)
[159] আবু দাউদ: (২৩৭৮), ইব্ন আবি শায়বাহ: (২/৩০৪), এ হাদিস মওকুফ। তিরমিযি বলেছেন: এ অধ্যায়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফূ কোন হাদিস নেই। তিরমিযি: (৩/১০৫)
[160] ইব্ন আবি শায়বাহ: (২/৩০৪), যুহরি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “সওম পালনকারীর সুরমা ব্যবহারে কোন সমস্যা নেই”। ইব্ন আবি শায়বাহ: (২/৩০৪)
[164] মাজমু ফাতাওয়া ইব্ন বায: (১৫/২৬০-২৬১), শাইখুল ইসলাম ইব্ন তাইমিয়া রহ. এটা গ্রহণ করেছেন। দেখুন: ফিকহুল ইবাদাত লি ইব্ন উসাইমিন: (১৯১-১৯২)
[175] দেখুন: নাসায়ি: (৪/১৬৫), আহমদ: (৫/২৪৮), হাদিসটি সহিহ বলেছেন ইব্ন হিব্বান: (৩৪২৫), ইব্ন খুযাইমাহ: (১৮৯৩), হাকেম: (১/৫৮২), ও হাফেয ইব্ন হাজার ফিল ফাতহ: (৪/১০৪)। প্রথম দু’টি বর্ণনা নাসায়ি থেকে নেয়া, তৃতীয় বর্ণনা ইব্ন হিব্বান থেকে নেয়া, চতুর্থ বর্ণনা আহমদ থেকে নেয়া।
_________________________________________________________________________________
সংকলন: ইবরাহিম ইব্ন মুহাম্মাদ আল-হাকিল
অনুবাদক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন