Views:
A+
A-
=====
সহজ ফিকহ শিক্ষা (১ম পর্ব)
সূচিপত্র
ক্রম বিষয়
1. ভূমিকা
2. ফিকহী উত্তরাধিকারের মর্যাদা ও মুসলিমদের অন্তরে এর সম্মান সুদৃঢ়করণ
4. ইসলামের রুকনসমূহের প্রথম রুকন: ত্বহারাত
5. পানি
6. পাত্রসমূহ
7. ইস্তিঞ্জা ও পেশাব-পায়খানার আদবসমূহ
8. স্বভাবজাত সুন্নাতসমূহ
9. অযু
10. গোসল
11. নাজাসাতের বিধিবিধান ও তা দূর করার পদ্ধতি
12. তায়াম্মুম
13. ইসলামের দ্বিতীয় রুকন: সালাত
14. জামা‘আতে সালাত আদায়
15. সালাতুল কসর বা সফরের সালাত
16. দু’ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায়
17. সাহু সাজদাহ
18. নফল সালাত
19. বিতরের সালাত
20. সুন্নাতে রাতেবা বা ফরয সালাতের আগে পিছের নফলসমূহ
21. জুমু‘আর সালাত
22. দু’ঈদের সালাত
23. ইস্তিস্কা বা বৃষ্টিপ্রার্থনার সালাত
24. কুসূফ তথা সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সালাত
25. জানাযা
26. ইসলামের তৃতীয় রুকন: যাকাত
27. সোনা, রুপা ও কাগজের নোটের যাকাত
28. চতুষ্পদ প্রাণির যাকাত
29. জমিন থেকে উৎপাদিত ফসলের যাকাত
30. ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত
31. যাকাতুল ফিতর
32. ইসলামের চতুর্থ রুকন: রমযানের সাওম
33. ই‘তিকাফ ও এর বিধি-বিধান
34. ইসলামের পঞ্চম রুকন: হজ
35. উমরা
36. কুরবানী
37. আক্বীকা
38. জিহাদ
39. দ্বিতীয় অধ্যয়: মু‘আমালাত তথা লেনদেন
40. বাই‘ তথা বেচাকেনা
41. রিবা তথা সুদ-এর বিধান, প্রকারভেদ, সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থায় ইসলামের পদ্ধতিসমূহ
42. ইজারা তথা ভাড়ায় ধার
43. ওয়াকফ
44. অসিয়ত
45. তৃতীয় অধ্যয়: পরিবার সম্পর্কিত
46. বিবাহ
47. চতুর্থ অধ্যয়: মুসলিম নারী সম্পর্কিত কতিপয় বিধি-বিধান
ভূমিকা
ফিকহী উত্তরাধিকারের মর্যাদা ও মুসলিমদের অন্তরে এর সম্মান সুদৃঢ়করণ
ফিকহী উত্তরাধিকারের গুরুত্ব:
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহর, দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। অতঃপর....
এ কথা সকলেরই অবগত যে, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইলমে ফিকহের পরিপূর্ণ মর্যাদা ও গুরুত্ব রয়েছে। কেননা এটি এমন একটি মূলনীতি যার দ্বারা মুসলিম তার কাজটি হালাল নাকি হারাম, শুদ্ধ নাকি অশুদ্ধ পরিমাপ করে। সর্বযুগে মুসলিমরা তাদের কাজ-কর্মের হালাল, হারাম, সহীহ, ফাসিদ ইত্যাদি হুকুম জানতে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন, চাই তা আল্লাহর হক সম্পর্কিত হোক বা বান্দার হক সম্পর্কিত, হোক তা নিকটাত্মীয়ের হক বা দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের হক, শত্রু হোক আর মিত্র, শাসক হোক বা শাসিত, মুসলিম হোক বা অমুসলিম। এসব অধিকার ও এর বিধান ফিকহের জ্ঞান ছাড়া জানা সম্ভবপর নয়। আর সেটা হবে এমন ফিকহশাস্ত্র যা বান্দাকে তার কর্মকাণ্ডসমূহের বিধান জানায়, চাই তা কোনো কিছু করা কিংবা না করার চাহিদাজনিত বিষয় হোক, নয়তো কোনো কিছু করা কিংবা না করার সুযোগ সম্বলিত হোক, অথবা কোনো কিছুর কার্যকারণ নির্ধারণ সংক্রান্ত হোক।
যেহেতু অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতোই ফিকহ শাস্ত্রও বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে প্রসারিত ও বর্ধিত হয়, আর অবমূল্যায়ন ও অপ্রয়োগের কারণে নিস্তেজ ও হারিয়ে যায়; সেহেতু এ শাস্ত্রও যুগের পরিক্রমায় অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে লালিতপালিত ও বর্ধিত হয়েছে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্র ব্যাপ্ত করেছে। অতঃপর সময়ের আবর্তনে এ শাস্ত্রটির ওপর দিয়ে এক দুঃসময় বয়ে চলে। এক সময় শাস্ত্রটির বৃদ্ধি ও পথচলা থেমে যায় বা থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। হয়ত এটিকে ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যেতো বা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এটিকে অবহেলা করা হতো। কেননা তখন ইসলামী রাষ্ট্রে আকীদা, রীতিনীতি ও প্রথার ক্ষেত্রে মানব রচিত অন্যান্য আইন চর্চা ও প্রয়োগ করা হতো। ফলে তাদের জীবন দুর্বিষহ ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে এবং তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পরে। যদিও এ মহামূল্যবান জ্ঞানের (ফিকহ শাস্ত্রের) মৌলিক শক্তি ও বুনিয়াদী ভিত্তির কারণে যুগে যুগে স্বীয় মহিমায় উজ্জীবিত ও দৃঢ়প্রতিরোধক ছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের অসচেতনতা ও ঘুমের পরে পুনঃজাগরণ ও সচেতন করলেন এবং তাদেরকে ইসলামের আঙ্গিনায় শরী‘আত ও এর বাস্তবায়নে ফিরে আসতে উৎসাহিত ও তাওফিক দান করলেন।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ইসলামী বিশ্বের অনেকেই আল্লাহর শরী‘আতের দিকে ফিরে আসতে ও মানব রচিত আইনে বলবত না থাকতে আহ্বান করেছেন। তথাপিও কিছু লোক তাদের রচিত জীবন ব্যবস্থায় নিজেদেরকে পরিচালিত করছে এবং তাদের দেওয়া পথে চলছে; কিন্তু আল্লাহ অচিরেই তার এ দীনকে বিজয়ী করবেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।
তাহলে ফিকহ শাস্ত্র কখন শুরু হয়, এ শাস্ত্র আবির্ভাবের কারণ কী, এর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য কী, এ শাস্ত্রের প্রতি মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী ইত্যাদি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় থেকেই এবং সাহাবীগণের যুগে ফিকহ শাস্ত্র ধীরে ধীরে শুরু হয়। মানব জীবনের নতুন নতুন ঘটনার বিধি-বিধান জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভবই খুব শীঘ্র সাহাবীণেগর মধ্যে এ শাস্ত্র আবির্ভাবের অন্যতম কারণ। মানুষের সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে, একের ওপর অন্যের অধিকার জানতে, নতুন সুযোগ সুবিধার সমাধান অবগত হতে এবং হঠাৎ আপতিত সমস্যার সামাধান বের করতে সর্বযুগেই ফিকহের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান।
ফিকহী উত্তরাধিকারের মর্যাদা ও এর বৈশিষ্ট্য:
ইসলামী ফিকহ শাস্ত্র অন্যান্য শাস্ত্র থেকে বেশ কিছু অনন্য বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো:
১- ইসলামী ফিকহর মূল হলো আল্লাহ প্রদত্ত অহী:
হ্যাঁ, ইসলামী ফিকহ অন্যান্য শাস্ত্র থেকে আলাদা। কেননা এর মূল উৎস হলো আল্লাহর অহী, যা কুরআন ও সুন্নার মাধ্যমে এসেছে। অতএব, প্রত্যেক মুজতাহিদই আবদ্ধ ও আদিষ্ট হয়েছে এ দু’টি মূল উৎস থেকে শরী‘আতের বিধান উদ্ভাবন করতে। অথবা এ দু’টি থেকে সরাসরি উদ্ভাবিত শাখা উৎসসমূহ থেকে, অথবা শরী‘আতের রূহ মৌলিক দাবীর চাহিদা থেকে, অথবা শরী‘আতের সাধারণ মাকাসিদ বা উদ্দেশ্য থেকে, অথবা শরী‘আতের মৌলিক নীতিমালা থেকে। এভাবেই এ শাস্ত্রটি তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করতে, এর নিয়মনীতি ও মূলনীতি পূর্ণ করতে উৎপত্তিগত পূর্ণতা, ভিত্তিগত মজবুতি, দৃঢ় খুঁটিগত অবস্থানসহ অহী নাযিলের সময়কাল থেকেই স্বমহিমায় বিকশিত হয়ে আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗا﴾ [المائدة: ٣]
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩]
অতএব, এ ঘোষণার পরে মানুষের প্রয়োজন অনুসারে শরী‘আতের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবহার ও প্রয়োগ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট রইলো না।
২- ইসলামী ফিকহ জীবনের সর্বক্ষেত্র পরিব্যপ্ত:
ইসলামী ফিকহ মানব জীবনের তিনটি ক্ষেত্র শামিল করে। তা হলো: তার রবের সাথে তার সম্পর্ক, তার নিজের সাথে তার সম্পর্ক এবং সমাজের সাথে তার সম্পর্ক। কেননা ইসলামী ফিকহ দুনিয়া ও আখিরাতের, দীন ও রাষ্ট্রের, সকল মানব জাতির এবং কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী। অতএব, এর সমস্ত বিধান আকীদা, ইবাদাত, আখলাক ও লেনদেন ইত্যাদি সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রাখে; যাতে মানুষের অন্তরকে জাগ্রত করতে পারে, স্বীয় কর্তব্যের অনুভূতিকে সজাগ করতে পারে, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে আল্লাহর তত্ত্বাবধান অনুধাবন করতে পারে। সন্তুষ্ট ও প্রশান্তচিত্তে অন্যের অধিকারকে সম্মান করতে পারে। ঈমান, সৌভাগ্য, স্থিতিশীলতা, ব্যক্তিগত ও সাধারণ জীবন সুগঠিত করতে পারে এবং সমস্ত পৃথিবীকে সুখী ও সম্মৃদ্ধি করতে পারে।
এ সব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ইসলামের ব্যবহারিক বিধি-বিধান (ফিকহ) অর্থাৎ মানুষের কথা, কাজ, চুক্তি ও লেনদেনের সাথে সম্পৃক্ত বিধি-বিধানকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
প্রথমত: ইবাদত সম্পর্কিত বিধি-বিধান: যেমন, ত্বহারাত, সালাত, সিয়াম, হজ, যাকাত, মানত ইত্যাদি যা আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক সুসংগঠিত করে।
দ্বিতীয়ত: লেনদেন সম্পর্কিত বিধি-বিধান: যেমন, বেচাকেনা, লেনদেন, শাস্তি, অপরাধ, জমানত ইত্যাদি যা মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক সুবিন্যাস করে, চাই তারা ব্যক্তি হোক বা সমষ্টি। এ ধরণের বিধি-বিধান নিম্নোক্ত কয়েক প্রকারে বিভক্ত:
ক- ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন: সেগুলো হচ্ছে পারিবারিক আইন। মানুষের পারিবারিক জীবনের শুরু থেকে শেষ বিদায় পর্যন্ত যা কিছু দরকার যেমন, বিয়ে-শাদী, তালাক, বংশ, ভরণ-পোষণ ও মিরাস ইত্যাদি। এ আইনের উদ্দেশ্য হলো দাম্পত্য জীবন ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক গঠন।
খ- নাগরিক আইন: এ আইন মানুষের একজনের সাথে অন্যের লেনদেন ও আদান-প্রদানের সাথে সম্পর্কিত। যেমন, বেচাকেনা, ধার, বন্ধক, জামিন, অংশীদারিত্ব, ঋণ প্রদান ও গ্রহণ ও অঙ্গিকার পূরণ ইত্যাদি। এ আইনের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও অধিকার সংরক্ষণ।
গ- ফৌজদারি আইন: মানুষের অপরাধ এবং এর সাজা সম্পর্কিত আইন। এ আইনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবন, সম্পদ, সম্মান ও অধিকার সংরক্ষণ করা। এ ছাড়া অপরাধীকে অপরাধের শাস্তির ভীতি প্রদর্শন এবং এর দ্বারা সমস্ত মানুষকে অপরাধের শাস্তির পরিণতির ভীতি দেখানো, সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এ আইনের অন্যতম লক্ষ্য।
ঘ- নাগরিকের কাজ-কর্ম ও অপরাধ উপস্থাপন সম্পর্কিত আইন (বিচার): এটি বিচার ও আইন, বাদী বা বিবাদীর দাবী, সাক্ষ্য প্রমাণ, শপথ ও আলামত ইত্যাদির মাধ্যমে তা প্রমাণ প্রভৃতি সম্পর্কিত আইন-কানূন। এ আইনে লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মাঝে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
ঙ- সাংবিধানিক আইন: রাষ্ট্র পরিচালনা ও এর নিয়মনীতি সম্পর্কিত আইন। এ আইনের লক্ষ্য হচ্ছে শাসকের সাথে জনগণের সম্পর্ক, জনগণের অধিকার ও কর্তব্য এবং শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করা।
চ- আন্তর্জাতিক আইন: স্থিতিশীল ও যুদ্ধাবস্থায়ে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের কী ধরণের সম্পর্ক হবে, মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমের সাথে সম্পর্ক, জিহাদ, সন্ধি-চুক্তি ইত্যাদি সম্পর্ক সুবিন্যাস করা। এ আইনের লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার পরস্পর সম্পর্ক, সহযোগিতা ও সম্মানবোধ নির্ধারণ করা।
ছ- অর্থনীতি ও সম্পদ সম্পর্কিত আইন: এ আইনে মানুষের অর্থনৈতিক লেনদেন ও অধিকার, রাষ্ট্রের অধিকার ও এর সম্পদ নিয়ে করণীয়, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও এর বণ্টন নীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ আইনের উদ্দেশ্য হলো ধনী, গরীব, রাষ্ট্র ও এর জনগণের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুসংগঠিত করা।
এ আইন রাষ্ট্রের সাধারণ ও বিশেষ সব ধরণের সম্পদ শামিল করে। যেমন, গনীমত, আনফাল, পণ্যকর, (যেমন কাস্টমস), খাজনা (ভূমির ট্যাক্স), কঠিন ও তরল খনিজ, প্রাকৃতিক সম্পদ। এছাড়াও এতে রয়েছে সমাজের সমষ্টিগত সম্পদ। যেমন, যাকাত, সাদাকাহ, মান্নত, ঋণ। আরও শামিল করে পারিবারিক সম্পদ। যেমন, পরিবারের ভরণ-পোষণ, উত্তরাধিকারী সম্পদ, অসিয়ত। আরও একত্রিত করে ব্যক্তিগত সম্পদ। যেমন, ব্যবসায়ের লাভ, ভাড়া, অংশীদারী কারবার, সব ধরণের প্রকল্প ও উৎপাদনের ব্যয়সমূহ। আরও আছে অর্থনৈতিক দণ্ড (জরিমানার অর্থ), যেমন, কাফফারা, দিয়াত ও ফিদিয়া ইত্যাদি।
জ- শিষ্টাচার ও রীতিনীতি: এ আইন মানুষের খামখেয়ালিপনা সীমিত করে, ভালো গুণাবলী বিকশিত করে, মানুষের মাঝে পরস্পর সহযোগিতা ও দয়ার্দ্রতা ইত্যাদিকে উৎসাহিত করে।
ফিকহ শাস্ত্র এতো প্রশস্ত ও বিস্তৃত হওয়ার কারণ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নায় প্রতিটি অধ্যায় সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
৩- ইসলামী ফিকহের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো: এতে বৈধ অবৈধ নির্ধারণের বিষয়টি দীনী গুণে গুণান্বিত:
মানব রচিত অন্যান্য আইনের থেকে ইসলামী ফিকহের পার্থক্য হলো, এতে সব ধরণের কাজ-কর্ম, নাগরিকের লেনদেন ইত্যাদি সকল কাজেই হালাল হারামের নীতি বিদ্যমান যা লেনদেনকে দু’টি গুণে গুণান্বিত করে। সে দু’টি হচ্ছে:
প্রথমত: বাহ্যিক কাজ ও লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে দুনিয়াবী হুকুম প্রদান, যা অপ্রকাশ্য বা গোপনীয় কিছুর সাথে সম্পর্কিত হয় না। আর তা হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার বিধান। কেননা বিচারক ব্যক্তির বাহ্যিক ও স্পষ্ট রূপ দেখেই ফয়সালা করে থাকেন।
আর এ প্রকারের হুকুম প্রদান করার মাধ্যমে বাস্তবে যা বাতিল সেটাকে হক করা হয় না, অনুরূপ বাস্তবে যা হক তাকে বাতিল করা হয় না, বাস্তবে যা হালাল তাকে হারাম করা হয় না, আবার বাস্তবে যা হারাম তাকে হালাল করাও হয় না। (অর্থাৎ বিচারের কারণেই যে হক বাতিল হবে বা বাতিল হক হয়ে যাবে, হালাল হারাম হয়ে যাবে বা হারাম কাজটি হালাল হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়) তবে বিচারের ফয়সালা মান্য করা অত্যাবশ্যকীয়, যা ফতওয়ার বিধানের বিপরীত। কেননা ফতওয়ার হুকুম মান্য করা অত্যাবশ্যকীয় নয়।
দ্বিতীয়ত: জিনিসের প্রকৃত ও বাস্তবরূপের ওপর ভিত্তি করে আখিরাতের হুকুম দেওয়া, যদিও বিষয়টি অন্যের কাছে অস্পষ্ট। এটা হচ্ছে বান্দা ও আল্লাহর মাঝের ফয়সালা। এটি মহা-বিচারকের (আল্লাহর) হুকুম। এটি সাধারণত মুফতি তার ফতওয়ায় নির্ধারণ করেন।
৪- ইসলামী ফিকহের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো: এটি আখলাকের সাথে সম্পৃক্ত:
মানব রচিত অন্যান্য আইনের সাথে ইসলামী ফিকহের পার্থক্য হলো: এতে আখলাকী নিয়মরীতির প্রভাব বিদ্যমান। মানব রচিত আইনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা ঠিক রাখা ও সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এ কাজ করতে যদিও দীনি বা আখলাকী কোনো মূলনীতির সাথে সংঘর্ষ বাধে তবুও তাতে কোনো পরওয়া করা হয় না।
অন্যদিকে ইসলামী ফিকহ সর্বদা সৎ গুণাবলী, সর্বোচ্চ মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠিত আখলাকী নিয়ম কানুনের প্রতি খেয়াল রাখে। এ কারণে মানবাত্মাকে পবিত্রকরণ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে ইবাদাত নীতির প্রণয়ন করা হয়েছে। রিবা তথা সুদ হারাম করা হয়েছে যাতে মানুষের মাঝে পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতা ও দয়া বিদ্যমান থাকে, সম্পদের মালিকের থেকে অভাবীবের সম্পদ হিফাযত করা যায়। লেনদেনে ধোকা ও নকল করতে নিষেধ করা হয়েছে, অন্যের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অজ্ঞতা ও অসন্তুষ্টি ইত্যাদি এ জাতীয় দোষ-ত্রুটির কারণে লেনদেনকে বাতিল করা হয়েছে। সকলের মাঝে ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা সম্প্রসারণ, মানুষের মাঝে ঝগড়া-ঝাটি বারণ, নোংরা থেকে মুক্ত থাকা ও অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ইসলামী ফিকহ সর্বদা আদেশ দেয় ও উৎসাহিত করে।
লেনদেনের সাথে যখন উত্তম চরিত্র একত্র হয় তখন ব্যক্তি ও সমাজের সুখ-সৌভাগ্য বাস্তবায়িত হয় এবং এতে চিরস্থায়ী জান্নাতের পথ সুগম হয়। এভাবে ইসলামী ফিকহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো দুনিয়া ও আখিরাতে সত্যিকারের উত্তম মানুষ তৈরি করা ও উভয় জগতে সুখী করা। এ কারণেই ইসলামী ফিকহ সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য ও সবসময় বাস্তবায়নযোগ্য। ফিকহের কাওয়ায়েদ কুল্লিয়া (সর্বজনীন নীতিমালাসমূহ) কখনও পরিবর্তন হয় না। যেমন, বেচাকেনায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে সন্তুষ্ট থাকা, ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দেওয়া, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অন্যের অধিকার সংরক্ষণ ও ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা ইত্যাদি গুণাবলী কখনও পরিবর্তন হয় না। অন্যদিকে কিয়াস, মাসালিহ মুরসালা (জনস্বার্থ), রীতি ও প্রথার ওপর ভিত্তি করে যে ফিকহ গঠিত তা যুগের চাহিদা, মানব কল্যাণের সুবিধা মোতাবেক, বিভিন্ন স্থান ও কালের পরিবেশ অনুযায়ী পরিবর্তন ও সংযোজন-বিয়োজন গ্রহণ করে, যতক্ষণ ফিকহের হুকুমটি শরী‘আতের উদ্দেশ্য লক্ষ্যের খেয়াল রেখে ও এর সঠিক উসূলের ওপর ভিত্তি করে প্রদান করা হবে। এসব পরিবর্তন শুধু মু‘আমালাত তথা লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আকীদা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আর এটিই নিম্নোক্ত কায়েদা দ্বারা উদ্দেশ্য:
تتغير الأحكام بتغير الأزمان.
“সময়ের পরিবর্তনের কারণে বিধানও পরিবর্তন হয়।”
তাহলে নির্ধারিত হয়ে গেলো যে, ফিকহের বিধান অনুযায়ী আমল করা অত্যাবশ্যকীয় ওয়াজিব।
হ্যাঁ, ফিকহের ওপর আমল করা ওয়াজিব। কেননা মুজতাহিদের কাছে যেটি তার ইজতিহাদ অনুযায়ী অগ্রাধিকার পাবে সে অনুযায়ী আমল করা তার ওপর ওয়াজিব। এটি তার জন্য আল্লাহরই হুকুম। আর মুজতাহিদ ছাড়া অন্যদের জন্য মুজতাহিদের ফাতওয়া অনুযায়ী আমল করতে হবে। কেননা উক্ত বিষয় সম্পর্কে শর‘ঈ বিধান জানতে মুজতাহিদকে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿فَسَۡٔلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلذِّكۡرِ إِن كُنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ٧﴾ [الانبياء: ٧]
“সুতরাং তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর যদি তোমরা না জান। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৭]
আর তাই শরী‘আতের যেসব বিধান অকাট্য দলিল দ্বারা সাব্যস্ত সেগুলো অস্বীকার করা বা কোনো হুকুমকে নির্দয় ও অমানবিক বলে মনে করা, যেমন, অপরাধের শাস্তির বিধান অথবা ইসলামী শরী‘আত সর্বযুগে প্রযোজ্য নয় এ দাবী করা কুফুরী হিসেবে গণ্য হবে এবং সে মুরতাদ হয়ে যাবে। অন্যদিকে যেসব বিধান প্রবল ধারণার ওপর ভিত্তি করে ইজতিহাদের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে সেগুলোকে অস্বীকার করলে সে গুনাহগার ও যালিম হবে। কেননা মুজতাহিদ সঠিকটি জানতে ও আল্লাহর হুকুম বর্ণনা করতে তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। এতে তিনি তার ব্যক্তিগত খামখেয়ালী অথবা ব্যক্তি স্বার্থ বা নামডাক ও সুনাম-সুখ্যাতি থেকে দূরে থেকেছেন। তিনি শর‘ঈ দলিলের ওপর নির্ভর করেছেন, হক ছিলো তার পথের অগ্রদূত, আমানতদারিতা, সততা ও ইখলাস ছিলো তার শ্লোগান।
লেখক
ড. সালিহ ইবন গানিম আস-সাদলান
প্রথম অধ্যয়: ইবাদাত
এতে রয়েছে:
১. ত্বহারাত
২. সালাত
৩. যাকাত
৪. সাওম
৫. হজ
৬. কুরবানী ও আকীকা
৭. জিহাদ।
প্রথম অধ্যায়: ইবাদাত
ইসলামের রুকনসমূহের প্রথম রুকন ত্বহারাত
ক- ত্বহারাতের শাব্দিক ও পারিভাষিক পরিচয়:
ত্বহারাতের শাব্দিক অর্থ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অর্জন করা।
আর পরিভাষায় শরীরে বিদ্যমান যেসব অপবিত্রতার কারণে সালাত ও এ জাতীয় ইবাদাত পালন করা নিষিদ্ধ, তা দূর করাকে ত্বহারাত বলে।
পানি
খ- পানির প্রকারভেদ:
পানি তিন প্রকার।
প্রথম প্রকার পবিত্র পানি: আর তা হলো পানি তার সৃষ্টিগত স্বাভাবিক অবস্থায় বিদ্যমান থাকা। আর তা হলো যে পানি দ্বারা অপবিত্রতা ও শরীরের পবিত্র অঙ্গের আপতিত নাজাসাত দূর করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَيُنَزِّلُ عَلَيۡكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ لِّيُطَهِّرَكُم بِهِ﴾ [الانفال: ١١]
“এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর যাতে এর মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করেন।” [সূরা আনফাল, আয়াত: ১১]
দ্বিতীয় প্রকার পবিত্র পানি: যে পানি নাজাসাত ছাড়াই রঙ বা স্বাদ বা গন্ধ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ ধরণের পানি নিজে পবিত্র; তবে এর যে কোনো একটি গুণাবলী পরিবর্তন হওয়ার কারণে এর দ্বারা অপবিত্রতা দূর করা যাবে না।
তৃতীয় প্রকার অপবিত্র পানি: যে পানি অল্প বা বেশি নাজাসাতের কারণে এর যে কোনো একটি গুণ পরিবর্তন হয়ে গেছে।
v অপবিত্র পানি পবিত্র হয়ে যাবে, তার পরিবর্তনের কারণ নিজে নিজে দূর হলে বা উক্ত পানি শুকিয়ে ফেললে অথবা এর সাথে এতটুকু পরিমাণ পানি মিশানো; যাতে পরিবর্তনের কারণ দূরীভূত হয়ে যায়।
v যখন কোনো মুসলিম পানির অপবিত্রতা বা পবিত্রতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে তখন সে তার নিশ্চিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে পবিত্রতা অর্জন করবে। আর তা হলো, পবিত্র বস্তুসমূহের আসল হচ্ছে পবিত্র থাকা।
v যখন কোনো পানি, যা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায় আর যা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায় না এমন কোনো পানির সাথে সন্দেহে নিপতিত করবে তখন তা বাদ দিয়ে তায়াম্মুম করবে।
v যখন কোনো পবিত্র কাপড়, অপবিত্র বা হারাম কাপড়ে সাথে সন্দেহে নিপতিত করবে তখন ইয়াকীনের ওপর ভিত্তি করবে এবং সে কাপড় দ্বারা কেবল একটি সালাত আদায় করবে।
পবিত্রতার প্রকারভেদ:
শরী‘আতে পবিত্রতা দু’প্রকার। অপ্রকাশ্য বা আত্মিক এবং প্রকাশ্য বা বাহ্যিক পবিত্রতা। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছোট বড় নাপাকী ও নাজাসাত থেকে পবিত্র করাকে বাহ্যিক পবিত্রতা বলে। আর পাপ-পঙ্কিলতা থেকে অন্তর পবিত্র করাকে অপ্রকাশ্য বা অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা বলে।
প্রকাশ্য পবিত্রতাই ফিকহের বিষয়; যা সালাতে বাহ্যিকভাবে উদ্দেশ্য। এটি আবার দু’প্রকার: হাদাস (অদৃশ্যমান নাপাকী) থেকে পবিত্রতা ও খাবাস (দৃশ্যমান নাপাকী) থেকে পবিত্রতা। হাদাস থেকে পবিত্রতা তিনভাবে অর্জিত হয়: ১. বড় পবিত্রতা, তা গোসলের মাধ্যমে। ২. ছোট পবিত্রতা, তা অযুর মাধ্যমে। ৩. আর এ দু’টি ব্যবহার করতে অক্ষম তায়াম্মুম করে পবিত্রতা অর্জন করবে। অনুরূপভাবে খাবাস থেকে পবিত্রতাও তিনভাব অর্জিত হয়: গোসল, মাসেহ ও পানি ছিটানো।
পানির পাত্র সংক্রান্ত বিধি-বিধান
পানির পাত্রের পরিচয়:
ক. শাব্দিক পরিচিতি:
পানির পাত্রকে আরবীতে (الآنية) ‘আনিয়া’ বলা হয়। যে শব্দটি (إناء) ‘ইনা’ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ আহার কিংবা পান-পাত্র। শব্দটির বহুবচনের বহুবচন হলো (أوان)। আরবী ভাষায় এর কাছাকাছি শব্দ হচ্ছে, (ظرف) ‘যারফ’ ও (ماعون) মা‘উন।
ফকীহগণ শাব্দিক অর্থেই এটাকে ব্যবহার করেছেন।
খ- পাত্রের প্রকারভেদ:
সত্তাগত দিক থেকে পাত্র কয়েক প্রকার। যথাঃ
১- সোনা ও রূপার পাত্র।
২- রৌপ্যের প্রলেপযুক্ত পাত্র।
৩- কাঁচের পাত্র।
৪- মূল্যবান ধাতুর পাত্র।
৫- চামড়ার পাত্র।
৬- হাড়ের পাত্র।
৭- উপরে বর্ণিত পাত্র ব্যতীত অন্যান্য পাত্র। যেমন, চীনামাটির পাত্র, কাঠের পাত্র, পিতলের পাত্র ও সাধারণ পাত্র।
গ- পাত্রের শর‘ঈ হুকুম:
সোনা, রূপা ও রৌপ্যের প্রলেপযুক্ত পাত্র ব্যতীত অন্যান্য সব পাত্র ব্যবহার করা বৈধ; চাই তা মূল্যবান হোক বা অল্প মূল্যের হোক। কেননা হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«َلاَ تَشْرَبُوا فِي آنِيَةِ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ، وَلاَ تَأْكُلُوا فِي صِحَافِهَا، فَإِنَّهَا لَهُمْ فِي الدُّنْيَا وَلَنَا فِي الآخِرَةِ».
“তোমরা সোনা ও রুপা পাত্রে পান করবে না। আর এসব পাত্রে খানা খাবে না। এগুলো দুনিয়াতে তাদের (অমুসলিমের) জন্য আর আমাদের জন্য রয়েছে আখিরাতে।”[1]
যে সব পাত্র ব্যবহার করা হারাম তা অন্যান্য উদ্দেশ্যে গ্রহণ করাও হারাম। যেমন, বাদ্যযন্ত্র গানের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা। নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সবাই সমান। কেননা হাদীসটি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
তবে এটা জানা আবশ্যক যে, সন্দেহের কারণে কোনো পাত্র অপবিত্র হবে না; যতক্ষণ নিশ্চিতভাবে অপবিত্র হওয়া জানা না যাবে। কেননা মূল হলো পবিত্র হওয়া।
ঘ- অমুসলিমের পাত্র:
অমুসলিমদের পাত্র বলতে বুঝানো হচ্ছে:
১- আহলে কিতাবীদের পাত্র।
২- মুশরিকদের পাত্র।
এসব পাত্রের শর‘ঈ হুকুম হলো এগুলো অপবিত্র হওয়া নিশ্চিত না হলে তা ব্যবহার করা জায়েয। কেননা মূল হলো পবিত্র হওয়া।
· অমুসলিমের জামা কাপড় পবিত্র, যতক্ষণ তা অপবিত্র হওয়া নিশ্চিত না হয়।
· যেসব প্রাণীর গোশত খাওয়া বৈধ সেসব মারা গেলে সেসবের মৃত চামড়া দাবাগাত (প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার উপযোগী) করলে তা পবিত্র বলে গণ্য হবে।
· আর যেসব প্রাণীর জীবিত অবস্থায় কোনো অংশ বিচ্ছেদ করা হয়েছে তা মৃত-প্রাণীর মতোই অপবিত্র। তবে জীবিত অবস্থায় পশম, পালক, চুল ও লোম নেওয়া হলে তা পবিত্র।
· খাবার ও পানীয় পাত্র ঢেকে রাখা সুন্নত। জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
»وَأَوْكِ سِقَاءَكَ وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ، وَخَمِّرْ إِنَاءَكَ وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ، وَلَوْ تَعْرُضُ عَلَيْهِ شَيْئًا«.
“তোমার পানি রাখার পাত্রের মুখ বন্ধ রাখো এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করো। তোমার বাসনপত্র ঢেকে রাখো এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করো। সামান্য কিছু দিয়ে হলেও তার উপর দিয়ে রেখে দাও।”[2]
ইস্তিঞ্জা ও পেশাব পায়খানার আদবসমূহ
· ইস্তিঞ্জা: ইস্তিঞ্জা হলো পেশাব ও পায়খানার রাস্তা থেকে নির্গত অপবিত্রতা পানি দ্বারা দূর করা।
· ইস্তিজমার: আর ইস্তিজমার হলো পেশাব ও পায়খানার রাস্তা থেকে নির্গত অপবিত্রতা পাথর বা কাগজ বা অনুরূপ জিনিস দ্বারা দূর করা।
· পেশাব পায়খানায় প্রবেশের সময় বাম পা দিয়ে প্রবেশ করা এবং এ দো‘আ পড়া,
« بسم اللّه، أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الْخُبْثِ وَالْخَبَائِثِ»
“বিসমিল্লাহ, আমি মন্দকাজ ও শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাচ্ছি”।[3]
· আর বের হওয়ার সময় ডান পা আগে দিয়ে বের হওয়া এবং এ দো‘আ পড়া,
«غُفْرَانَكَ، الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنِّي الْأَذَى وَعَافَانِي»
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমার থেকে কষ্ট দূর করেছেন এবং স্বস্তি দান করেছেন”।[4]
· পেশাব-পায়খানার সময় বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে বসা মুস্তাহাব, তবে খালি জায়গায় পেশাব-পায়খানা করলে মানুষের দৃষ্টির বাহিরে নির্জন স্থানে বসা। পেশাব করার সময় নরম স্থান নির্বাচন করা, যাতে পেশাবের ছিটা থেকে পবিত্র থাকা যায়।
· অতি প্রয়োজন ছাড়া এমন কোনো কিছু সাথে নেওয়া মাকরূহ যাতে আল্লাহর নাম রয়েছে। তাছাড়া জমিনের কাছাকাছি না হওয়ার আগে কাপড় তোলা, কথা বলা, গর্তে পেশাব করা, ডান হাত দিয়ে লজ্জাস্থান স্পর্শ করা এবং ডান হাত দিয়ে ঢিলা ব্যবহার করা মাকরূহ।
· উন্মুক্ত স্থানে পেশাব-পায়খানার সময় কিবলার দিকে মুখ বা পিঠ ফিরিয়ে বসা হারাম, আর ঘরের মধ্যে বসা জায়েয, তবে না বসা উত্তম।
· চলাচলের রাস্তা, বসা ও বিশ্রামের জায়গায়, ফলদার ছায়াদার গাছ ইত্যাদির নিচে পেশাব-পায়খানা করা হারাম।
· পবিত্র পাথর দিয়ে তিনবার শৌচকর্ম করা মুস্তাহাব। এতে ভালোভাবে পবিত্র না হলে সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা যাবে। তবে বেজোড় সংখ্যা তিন বা পাঁচ বা ততোধিক বেজোড় সংখ্যা ব্যবহার করা দ্বারা কাজটি শেষ করা সুন্নাত।
· হাড়, গোবর, খাদ্য ও সম্মানিত জিনিস দ্বারা ঢিলা করা হারাম। পানি, টিস্যু ও পাতা ইত্যাদি দিয়ে ঢিলা করা জায়েয। তবে শুধু পানি ব্যবহার করার চেয়ে পাথর ও পানি একত্রে ব্যবহার করা উত্তম।
· কাপড়ে অপবিত্রতা লাগলে তা পানি দিয়ে ধৌত করা ফরয। আর যদি অপবিত্র স্থান অজ্ঞাত থাকে তবে পুরো কাপড় পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে।
· বসে পেশাব করা সুন্নাত, তবে পেশাবের ছিটা থেকে নিরাপদ থাকলে দাঁড়িয়ে পেশাব করা মাকরূহ নয়।
স্বভাবজাত সুন্নাতসমূহ
ক- পরিচিতি: সরল পথ, সৃষ্টিগত স্বভাব। যেসব গুণাবলী মানুষের জীবনে থাকা অত্যাবশ্যকীয় সেগুলোকে স্বভাবজাত সুন্নাত বলে।
খ- স্বভাবজাত সুন্নাতসমূহ:
১- মিসওয়াক করা: এটা সব সময় করা সুন্নাত। মুখের পবিত্রতা ও রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মিসওয়াক করা হয়। অযু, সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, মসজিদে ও গৃহে প্রবেশ, ঘুম থেকে জাগ্রত হলে ও মুখের গন্ধ পরিবর্তন হলে মিসওয়াক করার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
২- নাভির নিচের লোম কামানো, বগলের লোম উপড়ানো, নখ কাটা ও আঙ্গুলের গিরা ধৌত করা।
৩- মোচ কাটা, দাড়ি লম্বা করা ও ছেড়ে দেওয়া।
৪- মাথার চুলের সম্মান করা, এতে তেল দেওয়া এবং আঁচড়ানো। চুলে গোছা রাখা অথাৎ মাথার এক অংশ কামানো আর বাকী অংশ না কামানো মাকরূহে তাহরীমী; কেননা এতে স্বাভাবিক সৃষ্টিগত সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
৫- মেহেদী বা অনুরূপ উদ্ভিদ দিয়ে চুলের সাদা অংশ পরিবর্তন করা।
৬- মিসক বা অন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৭- খৎনা করা। পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের ঢেকে থাকা চামড়া কর্তন করা যাতে এতে ময়লা ও পেশাব জমে থাকতে না পারে।
আর মহিলাদের ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গের উপরিভাগে পুংলিঙ্গ প্রবেশদ্বারের চামড়ার কিছু অংশ কেটে ফেলা, এটা বিচির মতো বা মোরগের চূড়ার (বৌল) মতো। খৎনা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ এটি জানেন। খৎনা মূলত পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য করা হয়। এতে অনেক ফযীলত রয়েছে। পুরুষের জন্য খৎনা করা সুন্নাত আর নারীর জন্য এটা করা সম্মানজনক।
অযু
ক- অযুর পরিচিতি:
শরী‘আতের নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী পবিত্র পানি চার অঙ্গে ব্যবহার করা।
খ- অযুর ফযীলত:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীস অযুর ফযীলত প্রমাণ করে। তিনি বলেছেন,
«مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ يَتَوَضَّأُ فَيُسْبِغُ الْوَضُوءَ ثُمَّ يَقُولُ: أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ إِلَّا فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ الثَّمَانِيَةُ يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ».
“তোমাদের যে ব্যক্তি পূর্ণরূপে অযু করে এ দো‘আ পাঠ করবে, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল’ তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যাবে এবং যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।”[5]
অযুতে অপচয় না করে উত্তমরূপে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করলে কিয়ামতের দিন অযুকারীর হাত-পা ও মুখমণ্ডল উজ্জ্বল থাকা আবশ্যক করবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ أُمَّتِي يُدْعَوْنَ يَوْمَ القِيَامَةِ غُرًّا مُحَجَّلِينَ مِنْ آثَارِ الوُضُوءِ، فَمَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يُطِيلَ غُرَّتَهُ فَلْيَفْعَلْ»
“কিয়ামতের দিন আমার উম্মতকে এমন অবস্থায় ডাকা হবে যে, অযুর প্রভাবে তাদের হাত-পা ও মুখমণ্ডল থাকবে উজ্জ্বল। তাই তোমাদের মধ্যে যে এ উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে নিতে পারে, সে যেন তা করে।”[6]
গ- অযুর শর্তাবলী:
অযুর শর্তাবলী দশটি। সেগুলো হলো:
১- ইসলাম।
২- জ্ঞান বা বিবেক।
৩- ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী তথা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
৪- নিয়ত করা এবং পবিত্রতা অর্জন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিয়ত অবশিষ্ট থাকা।
৫- যেসব কারণে অযু ফরয হয় সেসব কারণ দূর হওয়া।
৬- ইস্তিঞ্জা করা (পেশাব ও পায়খানার রাস্তা থেকে নির্গত অপবিত্রতা পানি দ্বারা দূর করা) ও ইস্তিজমার করা (পেশাব ও পায়খানার রাস্তা থেকে নির্গত অপবিত্রতা পাথর বা পাতা বা অনুরূপ জিনিস দ্বারা দুর করা)।
৭- পানি পবিত্র হওয়া।
৮- পানি বৈধ হওয়া।
৯- চামড়ায় পানি পৌঁছতে বাধা থাকলে তা দূর করা।
১০- যে ব্যক্তির সর্বদা অপবিত্র হওয়ার সমস্যা থাকে তার ক্ষেত্রে ফরয সালাতের ওয়াক্ত হওয়া।
ঘ- অযু ফরয হওয়ার কারণ:
হাদাস বা সাধারণ অপবিত্রতা পাওয়া গেলে অযু ফরয হয়।
ঙ- অযুর ফরযসমূহ:
অযুর ফরয ছয়টি:
১- মুখমণ্ডল ধৌত করা আর মুখ ও নাক মুখমণ্ডলেরই অংশ।
২- কনুইসহ দুহাত ধৌত করা।
৩- মাথা মাসেহ করা আর দু’কানও মাথারই অংশ।
৪- দু’পা ধৌত করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا قُمۡتُمۡ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ فَٱغۡسِلُواْ وُجُوهَكُمۡ وَأَيۡدِيَكُمۡ إِلَى ٱلۡمَرَافِقِ وَٱمۡسَحُواْ بِرُءُوسِكُمۡ وَأَرۡجُلَكُمۡ إِلَى ٱلۡكَعۡبَيۡنِۚ٦﴾ [المائدة: ٦]
“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৬]
৫- ধৌত অঙ্গের মধ্যে পরস্পর ক্রমবিন্যাস বজায় রাখা। কেননা আল্লাহ ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন এবং দু অঙ্গ ধোয়ার মধ্যে একটি মাসেহ করার বিষয় উল্লেখ করেছেন। (যা ক্রমবিন্যাস আবশ্যক হওয়া বুঝায়)।
৬- অযু করার সময় এক অঙ্গ ধৌত করার সাথে সাথেই বিলম্ব না করে অন্য অঙ্গ ধৌত করা। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে করেছেন।
চ- অযুর সুন্নতসমূহ:
অযুর সুন্নতসমূহের অন্যতম হলো:
১- মিসওয়াক করা।
২- হাত কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করা।
৩- কুলি ও নাকে পানি দেওয়া।
৪- ঘন দাড়ি ও হাত-পায়ের আঙ্গুল খিলাল করা।
৫- ডান দিক থেকে শুরু করা।
৬- দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ধৌত করা।
৭- কান ধোয়ার জন্য নতুন পানি গ্রহণ করা।
৮- অযুর পরে দো‘আ পড়া।
৯- অযুর পরে দু’রাকাত সালাত আদায় করা।
ছ- অযুর মাকরূহসমূহ:
অযুর মাকরূহসমূহের অন্যতম হলো:
১- অপবিত্রতা ছিটে অযুকারীর দিকে আসতে পারে এমন অপবিত্র স্থানে অযু করা।
২- অযুতে তিনবারের অধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করা। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন তিনবার ধৌত করেছেন। তিনি বলেছেন,
«مَنْ زَادَ عَلَى هَذَا فَقَدْ أَسَاءَ وَظَلَمَ».
“অতঃপর যে ব্যক্তি এর অধিক করে সে অবশ্যই জুলুম ও অন্যায় করে।”[7]
৩- পানি ব্যবহারে অপচয় করা। যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুদ পানি দিয়ে অযু করেছেন। আর মুদ হলো এক মুঠো। তাছাড়া যেকোনো কিছুতে অপচয় করা নিষেধ।
৪- অযুতে এক বা একাধিক সুন্নত ছেড়ে দেওয়া; কেননা সুন্নত ছেড়ে দিলে সাওয়াব কমে যায়। তাই সুন্নতের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিৎ, ছেড়ে দেওয়া অনুচিত।
জ- অযু ভঙ্গের কারণসমূহ:
অযু ভঙ্গের কারণ সাতটি, সেগুলো হলো:
১- পায়খানা বা পেশাবের রাস্তা দিয়ে কোনো কিছু বের হওয়া।
২- শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ থেকে কোনো কিছু বের হওয়া।
৩- পাগল, বেহুশ বা মাতাল ইত্যাদি কারণে জ্ঞানশূণ্য হওয়া।
৪- পুরুষ বা নারী কর্তৃক তাদের লজ্জাস্থান পর্দা ব্যতীত সরাসরি স্পর্শ করা।
৫- পুরুষ নারীকে বা নারী পুরুষকে কামভাবের সাথে স্পর্শ করা।
৬- উটের গোশত খাওয়া।
৭- যেসব কারণে গোসল ফরয হয় সেসব কারণে অযুও ফরয হয়, যেমন ইসলাম গ্রহণ ও বীর্য বের হওয়া, তবে মারা গেলে শুধু গোসল ফরয হয়, অযু ফরয হয় না।
গোসল
ক- গোসলের শাব্দিক ও পারিভাষিক পরিচিতি:
দম্মা যোগে (الغُسل) গুসল অর্থ পানি, ফাতহা যোগে (الغَسل) গাসল অর্থ গোসল করা আর কাসরা যোগে (الغِسل) গেসল অর্থ পরিস্কার করার উপাদান।
শরী‘আতের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মাথার অগ্রভাগ থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত সারা শরীরে পবিত্র পানি প্রবাহিত করা। এতে নারী ও পুরুষ সবাই সমান, তবে হায়েয ও নিফাসের গোসলের সময় রক্তের চিহ্ন পরোপুরিভাবে দূর করতে হবে যাতে রক্তের দুর্গন্ধ দূর হয়।
খ- গোসল ফরয হওয়ার কারণসমূহ:
গোসল ফরয হওয়ার কারণ ছয়টি:
১- নারী বা পুরুষের কামভাবের সাথে সজোরে বীর্য বের হওয়া।
২- পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ স্ত্রীর যৌনাঙ্গের ভিতর প্রবেশ করলে।
৩- আল্লাহর রাস্তায় শহীদ ব্যতীত অন্যসব মুসলিম মারা গেলে গোসল ফরয।
৪- প্রকৃত কাফির বা মুরতাদ ইসলাম গ্রহণ করলে।
৫- হায়েয হলে।
৬- নিফাস হলে।
গ- ইসলামে মুস্তাহাব গোসলসমূহ:
১- জুমু‘আর দিনের গোসল।
২- ইহরামের গোসল।
৩- মাইয়্যেতকে গোসলকারী ব্যক্তির গোসল।
৪- দুই ‘ঈদের গোসল।
৫- কারো পাগল বা বেহুশ অবস্থা কেটে গেলে।
৬- মক্কায় প্রবেশের গোসল।
৭- সূর্যগ্রহণ ও বৃষ্টি প্রার্থনার সালাতের জন্য গোসল।
৮- মুস্তাহাযা তথা প্রদররোগগ্রস্তা নারীর প্রতি ওয়াক্ত সালাতের জন্য গোসল।
৯- সব ধরণের ভালো সম্মেলনের জন্য গোসল।
ঘ- গোসলের শর্তাবলী:
গোসলের শর্তাবলী সাতটি:
১- যে কারণে গোসল ফরয হয় তা শেষ হওয়া।
২- নিয়ত করা।
৩- ইসলাম।
৪- আকল বা বুদ্ধি-বিবেক।
৫- ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী তথা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
৬- পবিত্র ও বৈধ পানি।
৭- চামড়ায় পানি পৌঁছতে বাধা থাকলে তা দূর করা।
ঙ- গোসলের ওয়াজিবসমূহ:
গোসলের ওয়াজিব হলো বিসমিল্লাহ বলা, ভুলে গেলে এ ওয়াজিব রহিত হয়ে যায়, ইচ্ছাকৃত বাদ দিলে ওয়াজিব ছুটে যাবে।
চ- গোসলের ফরযসমুহ:
নিয়ত করা, সমস্ত শরীরে পানি প্রবাহিত করা, মুখ ও নাকে পানি প্রবেশ করানো। পানি পৌঁছল কিনা এ ব্যাপারে প্রবল ধারণা হলেই যথেষ্ট হবে।
কেউ সুন্নাত বা ফরয গোসলের নিয়ত করলে এক নিয়ত অন্য নিয়াতের জন্য যথেষ্ট হবে।
জানাবাত ও হায়েযের গোসল একই নিয়াতে যথেষ্ট হবে।
ছ- গোসলের সুন্নাতসমুহ:
১- বিসমিল্লাহ বলা।
২- গোসলের শুরুতে শরীরে বিদ্যমান অপবিত্রতা বা ময়লা দূর করা।
৩- পাত্র হাত ঢুকানোর পূর্বে দুহাতের কব্জি পর্যন্ত ধোয়া।
৪- গোসলের শুরুতে অযু করা।
৫- ডান দিক থেকে শুরু করা।
৬- ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
৭- সারা শরীরে হাত মর্দন করা।
৮- গোসল শেষে দুপা অন্য স্থানে সরে ধৌত করা।
জ- গোসলের মাকরূহসমূহ:
গোসলে নিম্নোক্ত কাজ করা মাকরূহ:
১- পানির অপব্যয় করা।
২- অপবিত্র স্থানে গোসল করা।
৩- দেয়াল বা পর্দা ছাড়া খোলা জায়গায় গোসল করা।
৪- স্থির পানিতে গোসল করা।
ঝ- জুনুবী বা বড় অপবিত্র ব্যক্তির জন্য যেসব কাজ করা হারাম:
১- সালাত আদায় করা।
২- বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা।
৩- গিলাফ ব্যতীত কুরআন ষ্পর্শ করা ও বহন করা।
৪- মসজিদে বসা।
৫- কুরআন পড়া।
=======
নাজাসাত তথা নাপাকীর বিধিবিধান ও তা দূর করার পদ্ধতি
ক- নাজাসাত (নাপাকী) এর শাব্দিক ও শর‘ঈ অর্থ:
নাজাসাতের শাব্দিক অর্থ ময়লা, যেমন বলা হয় نجس الشيء نجسا বস্তুটি ময়লা হয়েছে। আবার বলা হয়, تنجس الشيء: صار نجسا: تلطخ بالقذر অর্থাৎ ময়লা মাখিয়ে দেওয়া।
শরী‘আতের পরিভাষায় ‘নাজাসাত’ হলো, নির্দিষ্ট পরিমাণ ময়লা যা সালাত ও এ জাতীয় ইবাদাত করতে বাধা সৃষ্টি করে। যেমন, পেশাব, রক্ত ও মদ।
খ- নাজাসাতের ধরণ:
নাজাসাত দু’ধরণের:
১- সত্তাগত বা প্রকৃত নাজাসাত।
২- হুকমী তথা বিধানগত নাজাসাত।
সত্তাগত বা প্রকৃত নাজাসাত হলো কুকুর ও শূকর ইত্যাদি। এসব নাজাসাত ধৌত করা বা অন্য কোনো উপায়ে কখনো পবিত্র হয় না।
আর হুকমী তথা বিধানগত নাজাসাত হলো ঐ নাপাকী যা পবিত্র স্থানে পতিত হয়েছে।
গ- নাজাসাতের প্রকারভেদ:
নাজাসাত তিন প্রকার। যথা:
১- এক ধরনের নাপাকী (নাজাসাত) রয়েছে যা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত।
২- আরেক ধরনের নাপাকী (নাজাসাত) রয়েছে যা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন।
৩- আরেক ধরনের নাপাকী (নাজাসাত) রয়েছে যা অপবিত্র হওয়ার পরও ক্ষমার পর্যায়ে। অর্থাৎ কোনো ক্ষতি হয় না।
যার বিস্তারিত বর্ণনা নিম্নরূপ:
১- যেসব নাজাসাত অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত, সেগুলো হলো:
ক- সব স্থলচর মৃতপ্রাণী। জলচর মৃতপ্রাণী পবিত্র এবং খাওয়া হালাল।
খ- প্রবাহিত রক্ত, যা স্থলচর প্রাণী জবেহ করার সময় প্রবাহিত হয়।
৩- শূকরের মাংস।
৪- মানুষের পেশাব।
৫- মানুষের পায়খানা।
৬- মযী বা কামরস[8]।
৭- অদী[9]।
৮- যেসব প্রাণী খাওয়া হালাল নয় তার গোশত।
৯- জীবিত প্রাণীর কর্তিত অংশ। যেমন, জীবিত ছাগলের বাহু কেটে ফেললে।
১০- হায়েযের রক্ত।
১১- নিফাসের রক্ত।
১২- ইস্তেহাযা বা প্রদরগ্রস্ত নারীর রক্ত।
২- যেসব জিনিস অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন তা হলো:
১- যেসব প্রাণীর গোশত খাওয়া হালাল সেসব প্রাণীর প্রশাব।
২- যেসব প্রাণীর গোশত খাওয়া হালাল সেসব প্রাণীর গোবর।
৩- বীর্য।
৪- কুকুরের লালা।
৫- বমি।
৬- রক্তহীন মৃতপ্রাণী, যেমন মৌমাছি, তেলাপোকা, পাখাবিহীন ক্ষুদ্র কীট ইত্যাদি।
৩- যেসব নাজাসাত অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে মার্জনা করা হয়েছে, অর্থাৎ দোষমুক্ত। সেগুলো হলো:
১- রাস্তার মাটি।
২- সামান্য রক্ত।
৩- মানুষ বা গোশত খাওয়া যায় এমন হালাল প্রাণীর বমি ও পুঁজ।
নাজাসাত পবিত্র করার পদ্ধতি:
গোসল, পানি ছিটিয়ে দেওয়া, ঘর্ষণ ও মুছে ফেলার মাধ্যমে নাজাসাত পবিত্র করা যায়।
· অপবিত্র কাপড় পবিত্রকরণ: যদি নাজাসাত আকার ও আয়তন বিশিষ্ট দৃশ্যমান বস্তু হয় তবে প্রথমে তা ঘষে তুলে ফেলতে হবে অতঃপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। আর যদি নাজাসাত ভেজা হয় তবে তা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
· শিশুর পেশাব পবিত্রকরণ: যেসব শিশু আলাদা খাদ্য খায় না সেসব শিশুর পেশাব পানি ছিটিয়ে দিলে পবিত্র হয়ে যায়।
· জমিনে লেগে থাকা নাজাসাত আকার আয়তন বিশিষ্ট দৃশ্যমান নাজাসাত দূর করার মাধ্যমে পবিত্র করা হবে। আর যদি জমিনের সাথে থাকা নাজাসাত তরল বস্তু হয় তবে তাতে পানি ঢেলে পবিত্র করতে হবে। আর জুতা মাটিতে ঘর্ষণ বা পবিত্র জায়গায় হাটলে পবিত্র হয়ে যায়। মসৃণ জিনিস যেমন, কাঁচ, চাকু, প্রস্তরফলক ইত্যাদি মুছে ফেললে পবিত্র হয়ে যায়। কুকুর কোনো পাত্রে মুখ দিলে তা সাতবার ধৌত করতে হবে, তবে একটিবার মাটি দিয়ে ধৌত করতে হবে।
তায়াম্মুম
১- তায়াম্মুমেম শাব্দিক ও পারিভাষিক পরিচিতি:
ক- তায়াম্মুমেম শাব্দিক অর্থ: ইচ্ছা করা, কামনা করা, মনস্থ করা।
খ- তায়াম্মুমেম পারিভাষিক অর্থ: পবিত্র মাটি দ্বারা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মুখ ও দু হাত মাসাহ করা।
আল্লাহ এ উম্মতের জন্য যেসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা দান করেছেন তায়াম্মুম সেসব বৈশিষ্ট্যের অন্যতম। এটি পানির পরিবর্তে পবিত্র হওয়ার মাধ্যম।
২- কার জন্য তায়াম্মুম করা বৈধ:
ক- পানি পাওয়া না গেলে বা পানি দূরে থাকলে।
খ- কারো শরীরে ক্ষত থাকলে বা অসুস্থ হলে এবং সে পানি ব্যবহার করলে ক্ষত বা অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকলে।
গ- পানি অতি ঠাণ্ডা হলে এবং গরম করতে সক্ষম না হলে।
ঘ- যদি মজুদ পানি ব্যবহারের কারণে নিজে বা অন্য কেউ পিপাসায় নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা করে।
৩- তায়াম্মুম ফরয হওয়ার শর্তাবলী:
ক- বালেগ বা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া।
খ- মাটি ব্যবহারে সক্ষম হওয়া।
গ- অপবিত্রতা নষ্টকারী কোনো কিছু ঘটা।
৪- তায়াম্মুম শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী:
ক- ইসলাম।
খ- হায়েয বা নিফাসের রক্ত শেষ হওয়া।
গ- আকল বা বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া।
ঘ- পবিত্র মাটি পাওয়া।
৫- তায়াম্মুমের ফরযসমূহ:
ক- নিয়ত।
খ- পবিত্র মাটি।
গ- একবার মাটিতে হাত মারা।
ঘ- মুখমণ্ডল ও হাতের তালু মাসাহ করা।
৬- তায়াম্মুমের সুন্নাতসমূহ:
ক- বিসমিল্লাহ বলা।
খ- কিবলামুখী হওয়া।
গ- সালাতের আদায়ের ইচ্ছা করার আগে করা
ঘ- দ্বিতীয়বার মাটিতে হাত মারা।
ঙ- ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
চ- এক অঙ্গের সাথে বিরতিহীন অন্য অঙ্গ মাসাহ করা।
ছ- আঙ্গুল খিলাল করা।
৭- তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণসমূহ:
ক- পানি পাওয়া গেলে।
খ- উল্লিখিত অযু ও গোসল ভঙ্গের কারণসমূহ পাওয়া গেলে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে। কেননা তায়াম্মুম হলো অযু ও গোসলের স্থলাভিষিক্ত, আর মূল পাওয়া গেলে তার স্থলাভিষিক্তের কাজ শেষ হয়ে যায়।
৮- তায়াম্মুমের পদ্ধতি:
প্রথমে তায়াম্মুমের নিয়ত করবে, অতঃপর বিসমিল্লাহ বলে দুহাত মাটিতে মারবে, অতঃপর এর দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জি ধারাবাহিক ও বিরতিহীনভাবে মাসাহ করবে।
৯- ব্যান্ডেজ ও ক্ষতস্থানে তায়াম্মুম:
কারো হাড় ভেঙ্গে গেলে বা শরীরে ক্ষত বা জখম হলে পানি ব্যবহারে ক্ষতির আশংকা করলে ও কষ্ট হলে তবে ব্যান্ডেজ ও ক্ষতস্থানে তায়াম্মুম করবে এবং বাকী অংশ ধুয়ে ফেলবে।
কেউ পানি ও মাটি কোনটিই না পেলে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই সালাত আদায় করে নিবে। তাকে উক্ত সালাত পুনরায় আদায় করতে হবে না।
মোজা ও বন্ধ ফলকের উপর মাসাহ:
১- ইবন মুবারক বলেছেন, মোজার উপর মাসাহর ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই। ইমাম আহমাদ বলেছেন, মোজার উপর মাসাহর ব্যাপারে আমার অন্তরে কোনো সংশয় নেই। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে চল্লিশটি হাদীস বর্ণিত আছে। পা ধোয়ার চেয়ে মোজার উপর মাসাহ করা উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ উত্তমটিই তালাশ করতেন।
২- সময়সীমা:
মুকিমের জন্য একদিন ও একরাত এবং মুসাফিরের জন্য তিনদিন ও তিনরাত মাসাহ করা জায়েয। মোজা পরিধান করার পরে প্রথম বার অপবিত্র হওয়া থেকে সময়সীমা শুরু হয়।
৩- মোজার উপর মাসাহর শর্তাবলী:
পরিধেয় মোজা বৈধ ও পবিত্র হওয়া। ফরয পরিমাণ অংশ ঢেকে থাকা এবং মোজা পবিত্র অবস্থায় পরিধান করা।
৪- মোজার উপর মাসাহর পদ্ধতি:
পানিতে হাত ভিজিয়ে পায়ের উপরিভাগের আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে নলা পর্যন্ত একবার মাসাহ করা। পায়ের নিচে ও পিছনে মাসাহ নয়।
৫- মোজার উপর মাসাহ ভঙ্গের কারণসমূহ:
নিচের চারটির যে কোনো একটি কারণে মোজার উপর মাসাহ নষ্ট হয়ে যায়:
১- পায়ের থেকে মোজা খুলে ফেললে।
২- মোজা খুলে ফেলা অত্যাবশ্যকীয় হলে, যেমন গোসল ফরয হলে।
৩- পরিহিত মোজা বড় ছিদ্র বা ছিড়ে গেলে।
৪- মাসাহের মেয়াদ পূর্ণ হলে।
সব ধরণের পট্টি বা ব্যান্ডেজ খুলে না ফেলা পর্যন্ত তার উপর মাসাহ করা জায়েয, এতে মেয়াদ যতই দীর্ঘ হোক বা জানাবত তথা বড় নাপাকী লাগুক।
=====
সালাত
- সালাত সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহ
- জামা‘আতে সালাত আদায়।
- কসরের সালাত।
- ’সালাত একত্র আদায়।
- সাহু সাজদাহ।
- নফল সালাত।
- জুমু‘আর সালাত।
- দুই ঈদের সালাত।
- সালাতুল ইসতিস্কা বা বৃষ্টি প্রার্থনার সালাত।
- সালাতুল কুসূফ বা সূর্যগ্রহণের সালাত।
- জানাযার সালাত ও এর বিধিবিধান।
ইসলামের দ্বিতীয় রুকন সালাত
১- সালাতের শাব্দিক ও শর‘ঈ পরিচিতি:
সালাতের শাব্দিক অর্থ দো‘আ। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ٠٣﴾ [التوبة: ١٠٣]
“আর তাদের জন্য দো‘আ করুন, নিশ্চয় আপনার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিকর।”[10]
শর‘ঈ পরিভাষায় সালাত হলো, সুনির্দিষ্ট শর্তাবলীতে নির্দিষ্ট কিছু কথা ও কাজ, যা তাকবীরে তাহরীমা দ্বারা শুরু হয় এবং সালাম ফিরানোর দ্বারা শেষ হয়।
২- সালাত কখন ফরয হয়?
হিজরতের পূর্বে ইসরা তথা মি‘রাজের রাতে সালাত ফরয হয়। ইসলামে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাক্ষ্য প্রদানের পরের রুকন হলো সালাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওহীদের পরে সালাতের শর্ত দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«رَأْسُ الأَمْرِ الإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الجِهَادُ في سبيل اللّه »
“সব কিছুর মাথা হলো ইসলাম, বুনিয়াদ হলো সালাত আর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ”।[11]
৩- শরী‘আতে সালাত বিধিবদ্ধ হওয়ার হিকমত:
আল্লাহ তাঁর বান্দাহর ওপর অসংখ্য যেসব নি‘আমত দান করেছেন সালাত হলো সেসব নি‘আমতের শুকরিয়া। এছাড়া সালাত আল্লাহর দাসত্বের উৎকৃষ্ট নমুনা। যেহেতু সালাতে বান্দা আল্লাহর প্রতি মনোযোগ দেয়, নতশির হয়, একনিষ্ঠ হয়ে তারই কাছে তিলাওয়াত, যিকর ও দো‘আর মাধ্যমে মুনাজাত করে। এমনিভাবে এতে রয়েছে এমন সম্পর্ক যা বান্দা ও তার রবের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে এবং পার্থিব জগতের উর্ধ্বে উঠে পরিচ্ছন্ন অন্তর ও প্রশান্তির জগতে নিয়ে যায়। মানুষ যখনই পার্থিব জীবনের মোহে ডুবে যায় তখন সালাত সেসব মায়া মুক্ত করে এবং তাকে বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায় যার সম্পর্কে সে উদাসীন। সালাত তাকে স্মরণ করে দেয় যে, সে বাস্তবতা অনেক বড়। এ জীবন এত দৃঢ়ভাবে সৃষ্টি ও মানুষের জন্য সব কিছু অধিন্যস্ত করে দেওয়া শুধু জীবন যাপনের জন্য নয়; বরং এ জীবন থেকে অন্য জীবনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি।
৪- সালাতের হুকুম ও এর সংখ্যা:
সালাত দু’ধরণের: ফরয ও নফল সালাত। ফরয সালাত আবার দু’প্রকার: ফরযে আইন ও ফরযে কিফায়া। ফরযে আইন সালাত প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়ষ্ক মুসলিম নর-নারীর পর ফরয। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরযে আইন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ كَانَتۡ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ كِتَٰبٗا مَّوۡقُوتٗا ١٠٣﴾ [النساء : ١٠٣]
“নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩]
﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ٥﴾ [البينة: ٥]
“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হলো সঠিক দীন।” [সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ».
“ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর। আল্লাহ ব্যতীত কোনো (সত্য) ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, এ কথার সাক্ষ্য দান, সালাত কায়েম করা, যাকাত দেওয়া”।[12]
নাফে‘ ইবন আযরাক ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কুরআনে পেয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, পেয়েছি। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করলেন,
﴿فَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ حِينَ تُمۡسُونَ وَحِينَ تُصۡبِحُونَ ١٧ وَلَهُ ٱلۡحَمۡدُ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَعَشِيّٗا وَحِينَ تُظۡهِرُونَ ١٨﴾ [الروم: ١٧، ١٨]
“অতএব, তোমরা আল্লাহর তাসবীহ কর, যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে এবং সকালে উঠবে। আর অপরাহ্নে ও জোহরের সময়ে। আর আসমান ও যমীনে সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ১৭-১৮]
«جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ أَهْلِ نَجْدٍ ثَائِرَ الرَّأْسِ، يُسْمَعُ دَوِيُّ صَوْتِهِ وَلاَ يُفْقَهُ مَا يَقُولُ، حَتَّى دَنَا، فَإِذَا هُوَ يَسْأَلُ عَنِ الإِسْلاَمِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خَمْسُ صَلَوَاتٍ فِي اليَوْمِ وَاللَّيْلَةِ» . فَقَالَ: هَلْ عَلَيَّ غَيْرُهَا؟ قَالَ: «لاَ، إِلَّا أَنْ تَطَوَّعَ»
“নজদবাসী এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলো। তার মাথার চুল ছিল এলোমেলো। আমরা তার কথার মৃদু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু সে কী বলছিল, আমরা তা বুঝতে পারছিলাম না। এভাবে সে কাছে এসে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। সে বলল, আমার ওপর এ ছাড়া আরও সালাত আছে?’ তিনি বললেন, না; তবে নফল আদায় করতে পার।”[13]
৫- বাচ্চাদের সালাতের নির্দেশ:
বাচ্চাদের সাত বছর বয়স হলে সালাতের আদেশ দিতে হবে। দশ বছর হলে সালাত আদায় না করলে মৃদু প্রহার করতে হবে। কেননা হাদীসে এসেছে,
«مُرُوا أَبْنَاءَكُمْ بِالصَّلَاةِ لِسَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا لِعَشْرِ سِنِينَ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ».
“তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখন তাদেরকে সালাত পড়ার নির্দেশ দাও, যখন তাদের বয়স দশ বছর হবে তখন সালাত না পড়লে এ জন্য তাদের শাস্তি দাও এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও”।[14]
৬- সালাত অস্বীকারকারীর হুকুম:
কেউ জেনেশুনে সালাত ফরয হওয়া অস্বীকার করলে সে কাফির, যদিও সে সালাত আদায় করে। কেননা সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও উম্মতের ইজমায় মিথ্যারোপ করল। এমনিভাবে যে ব্যক্তি অবজ্ঞা, অলসতা ও অবহেলা করে সালাত ত্যাগ করে, যদিও সে সালাত ফরয হওয়া স্বীকার করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿فَٱقۡتُلُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ حَيۡثُ وَجَدتُّمُوهُمۡ وَخُذُوهُمۡ وَٱحۡصُرُوهُمۡ وَٱقۡعُدُواْ لَهُمۡ كُلَّ مَرۡصَدٖۚ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمۡۚ٥﴾ [التوبة: ٥]
“তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে অবরোধ কর এবং তাদের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিতে বসে থাক। তবে যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত কায়েম করে, আর যাকাত দেয়, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৫]
জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ».
“বান্দা এবং শির্ক-কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত পরিত্যাগ করা”।[15]
৭- সালাতের রুকনসমূহ:
সালাতে চৌদ্দটি রুকন বা ফরয রয়েছে। এগুলো ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে হোক বা অজ্ঞতাবশত হোক কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না। এগুলো নিম্নরূপ:
১- দাঁড়িয়ে সালাত আদায়ের সামর্থ থাকলে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা।
২- আল্লাহু আকবর বলে সালাতে প্রবেশ করা। এ তাকবীর ব্যতীত অন্য কিছু বললে সালাত হবে না।
৩- সূরা আল-ফাতিহা পাঠ করা।
৪- রুকু করা।
৫- রুকু থেকে সোজা হয়ে উঠা।
৬- সাজদাহ করা।
৭- সাজদাহ থেকে উঠে বসা।
৮- দু’সাজদাহর মাঝে বসা।
৯- ধীর স্থিরভাবে কাজ করা।
১০- শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়া।
১১- শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের জন্য বসা।
১২- তাশাহহুদের পরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করা।
১৩- সালাম ফিরানো। আর তা হলোالسلام عليكم ورحمة اللّه বলা। وبركاته শব্দ বৃদ্ধি না করা উত্তম। কেননা ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান দিকে সালাম ফিরিয়ে বলেছেন,
السلام عليكم ورحمة اللّه
আবার বাম দিকেও সালাম ফিরিয়ে বলতেন,
السلام عليكم ورحمة اللّه
১৪- রুকনসমূহের মাঝে তারতীব তথা ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
সালাতের ওয়াজিবসমূহ:
সালাতে আটটি ওয়াজিব রয়েছে। ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে, তবে ভুল ও অজ্ঞতাবশতঃ ছুটে গেলে এ ওয়াজিব রহিত হয়ে যাবে। এগুলো হলো,
১- তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া প্রত্যেক উঠা, নামা, বসা, ও দাঁড়ানোর সময় তাকবীর বলা।
২- ইমাম ও একাকী সালাত আদায়কারী রুকু থেকে উঠার সময় «سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ» ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলা।
৩- রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়ে «رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدَُ» ‘রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ’ পড়া।
৪- রুকুতে কমপক্ষে একবার «سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ» ‘সুবহানা রাব্বিয়াল ‘আযীম’ বলা।
৫- সাজদাহয় «سُبْحَانَ رَبِّيَ الْأَعْلَى» ‘সুবাহানা রাব্বিয়াল ‘আ‘লা’ কমপক্ষে একবার পড়া।
৬- দু’সাজদাহর মাঝে দো‘আ পড়া
«رَبِّ اغْفِرْ لِي، رَبِّ اغْفِرْ لِي»
‘‘রাব্বিগ ফিরলী, রাব্বিগ ফিরলী’’ (হে আমার রব! আমায় ক্ষমা করুন, হে আমার রব! আমায় ক্ষমা করুন)।[16]
৭- প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ পড়া।
৮- প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার জন্য বসা।
৯- সালাতের শর্তাবলী:
শর্তের শাব্দিক অর্থ নিদর্শন।
পরিভাষায়: শর্তকৃত বিষয়টি উক্ত শর্ত ছাড়া পাওয়া যাবে না, তবে শর্তটি পাওয়া গেলেই মাশরূত তথা শর্তকৃত জিনিসটি পাওয়া যাওয়া অত্যাবশ্যকীয় নয়।
সালাতের শর্তাবলী হলো: নিয়ত, ইসলাম, আকল বা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, ভালো-মন্দ পার্থক্য করার মতো বয়স হওয়া, সালাতের ওয়াক্ত হওয়া, পবিত্র হওয়া, কিবলামুখী হওয়া, সতর ঢাকা ও নাজাসাত থেকে মুক্ত হওয়া।
১০- পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা:
ওয়াক্ত শব্দটিالتوقيت তাওকীত থেকে নেওয়া হয়েছে, এর অর্থ নির্ধারিত। ওয়াক্ত হলো সালাত ফরয হওয়ার কারণ ও সালাত শুদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদীসে সালাতের ওয়াক্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أَمَّنِي جِبْرِيلُ عِنْدَ البَيْتِ مَرَّتَيْنِ».
“জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম কা‘বার চত্বরে দু’বার আমার সালাতের ইমামতি করেছেন।”[17]
অতঃপর তিনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা উল্লেখ করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
অতঃপর তিনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা উল্লেখ করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ثُمَّ التَفَتَ إِلَيَّ جِبْرِيلُ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، هَذَا وَقْتُ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِكَ، وَالوَقْتُ فِيمَا بَيْنَ هَذَيْنِ الوَقْتَيْنِ».
“অতঃপর জিবরীল (‘আলাইহিস সালাম) আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হে মুহাম্মাদ! এটাই হলো আপনার পূর্ববর্তী নবীদের (সালাতের) ওয়াক্ত। সালাতের ওয়াক্ত এ দুই সীমার মাঝখানে।”[18]
পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা দিন রাতে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কেননা মানুষ যখন রাতে ঘুমাবে তার বিশ্রাম শেষ হবে, প্রভাত ঘনিয়ে আসবে, পরিশ্রম ও কাজের সময় হবে তখন ফজরের সালাতের ওয়াক্ত হয়, তখন মানুষ অন্যান্য মাখলুক থেকে নিজেকে আলাদা হিসেবে ভাবতে থাকে, সালাতের মাধ্যমে সে দিনকে স্বাগত জানায় এবং এতে তার ঈমান বৃদ্ধি পায়।
আবার দিনের মধ্যভাগে যোহর সালাতে তার রবের সামনে দাড়িয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করে এবং তার দিনের কাজগুলো বিশুদ্ধ করে নেয়। অতঃপর আসে আসরের সময়। তখন দিনের বাকী অংশকে অভ্যর্থনা জানাতে আসরের সালাত আদায় করে। অতঃপর রাতকে অভ্যর্থনা জানাতে মাগরিবের সালাত ও ইশার সালাত, আর এ দু’টি তার মধ্যে বহন করে রহস্যের আধার, নূর ও হিদায়েতের পথের ভাণ্ডার। এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সালাত আদায় আল্লাহর সৃষ্টি ও সম্রাজ্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা ও রাত দিনে মানুষের সমস্ত কাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করার বিরাট সুযোগ।
যোহর সালাতের ওয়াক্ত:
সূর্য ঢলে পড়লে যোহর সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয়। অর্থাৎ আকাশের মাঝামাঝি থেকে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে যোহর সালাতের ওয়াক্ত আরম্ভ হয় এবং যোহর সালাতের ওয়াক্ত শেষ সময় হলো প্রতিটি জিনিসের ঢলে পড়া মূল ছায়া বাদে উক্ত জিনিসের ছায়া তার সমপরিমাণ হলে।[19]
আসর সালাতের ওয়াক্ত:
প্রতিটি জিনিসের ঢলে পড়া ছায়া বাদে উক্ত জিনিসের ছায়া তার সমপরিমাণ হলে আসরের ওয়াক্ত আরম্ভ হয়। অর্থাৎ যোহরের সময় শেষ হলে আসরের সময় শুরু হয়। আর নির্ভরযোগ্য মতে আসরের শেষ সময় হলো, ঢলে পড়ার পরে প্রতিটি জিনিসের ছায়া তার দ্বিগুণ পরিমাণ হলে। বিশেষ প্রয়োজনে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় বাকী থাকে।
মাগরিব সালাতের ওয়াক্ত:
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং মাগরিবের শেষ ওয়াক্ত হলো আকাশে যখন তারকা স্পষ্ট হয়। আর মাকরূহসহ মাগরিবের শেষ সময় হলো, পশ্চিমাকাশে লালিমা যখন দূরীভূত হয়।
ইশা সালাতের ওয়াক্ত:
পশ্চিমাকাশে লালিমা দূরীভূত হলে ইশার ওয়াক্ত শুরু হয়। আর ইশার শেষ সময় হলো মধ্যরাত।
ফজর সালাতের ওয়াক্ত:
পূর্বাকাশে ফজরে সানী (সুবহে সাদিক তথা শুভ্র আভা) উদিত হলে ফজরের সালাতের সময় শুরু হয়। আর ফজরের শেষ সময় হলো সূর্যোদয়।
১১- উচ্চ অক্ষরেখার দেশসমূহে সালাতের সময় নির্ধারণ:
উচ্চ অক্ষরেখার দেশসমূহকে তিনভাগে ভাগ করা যায়:
১- যেসব দেশ ৪৫ ও ৪৮ ডিগ্রী উত্তর-দক্ষিণ অক্ষাংশ রেখায় অবস্থিত সেসব দেশে রাত-দিন যতই দীর্ঘ বা ছোট হোক দিন-রাতের সময়ের বিভাজনকারী ভৌগলিক রেখা স্পষ্ট বুঝা যায়।
২- আর যেসব দেশ ৪৮ ও ৬৬ ডিগ্রী উত্তর-দক্ষিণ অক্ষাংশ রেখায় অবস্থিত সেসব দেশে বছরের কিছুদিন দিন-রাতের সময়ের বিভাজনকারী ভৌগলিক রেখা বুঝা যায় না। যেমন লালিমা দূরীভূত হতে না হতেই ফজরের সময় এসে যায়।
৩- অন্যদিকে যেসব দেশ ৬৬ ডিগ্রীরও বেশি উত্তর-দক্ষিণ অক্ষাংশ রেখায় অবস্থিত সেসব দেশে বছরের দীর্ঘ সময় ধরে দিন-রাতের সময়ের বিভাজনকারী ভৌগলিক রেখা স্পষ্ট বুঝা যায় না।
প্রত্যেক প্রকারের হুকুম:
প্রথম প্রকারের অঞ্চলের লোকেরা পূর্বোল্লিখিত সময় অনুযায়ী সালাত আদায় করবে।
আর তৃতীয় প্রকারের অঞ্চলের বাসীন্দারা সালাতের সময় নির্ধারণ করে নিবে। এতে কোনো মতানৈক্য নেই। দাজ্জাল সম্পর্কিত হাদীস থেকে এ ধরণের স্থানে সালাতের সময় নির্ধারণ করে নিতে বলা হয়েছে। এ হাদীসে এসেছে,
«قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا لَبْثُهُ فِي الْأَرْضِ؟ قَالَ: «أَرْبَعُونَ يَوْمًا، يَوْمٌ كَسَنَةٍ، وَيَوْمٌ كَشَهْرٍ، وَيَوْمٌ كَجُمُعَةٍ، وَسَائِرُ أَيَّامِهِ كَأَيَّامِكُمْ» قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ فَذَلِكَ الْيَوْمُ الَّذِي كَسَنَةٍ، أَتَكْفِينَا فِيهِ صَلَاةُ يَوْمٍ؟ قَالَ: «لَا، اقْدُرُوا لَهُ قَدْرَهُ».
“সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দিন অবস্থান করবে? তিনি বললেন, চল্লিশ দিন। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের সমান। দ্বিতীয় দিনটি হবে এক মাসের সমান। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের সমান। আর বাকী দিনগুলো হবে তোমাদের এদিনগুলোর মতো। তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যে দিনটি এক বছরের সমান হবে তাতে একদিনের সালাত পড়া কি আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে? তিনি বললেন, না। এদিনটিকে সাধারণ দিনের সমান অনুমান করে নিও।”[20]
সেসব স্থানের সময় কীভাবে নির্ধারিত করতে হবে সে ব্যাপারে আলেমগণ কয়েকটি মত ব্যক্ত করেছেন। কতিপয় আলেমের অভিমত হলো: ঐ স্থানে নিকটতম দেশে যেখানে দিন-রাত পার্থক্য করা যায় এবং শরী‘আত নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সালাতের সময় নির্ধারণ করা যায় সে স্থানের সময় অনুযায়ী সালাতের সময় নির্ধারণ করতে হবে। এ উক্তিটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, স্বাভাবিক সময় হিসেবে সালাতের সময় নির্ধারণ করতে হবে। বার ঘন্টা দিন ধরতে হবে। তেমনিভাবে বার ঘন্টা রাত ধরতে হবে। কেউ কেউ আবার মক্কা বা মদীনার সময় অনুযায়ী সালাতের সময় নির্ধারণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
দ্বিতীয় প্রকারের অঞ্চলে ইশা ও ফজরের সময় ব্যতীত অন্যান্য ওয়াক্তের সময় প্রথম প্রকারের সময় অনুযায়ী হবে। আর ফজর ও ইশা তৃতীয় প্রকার অঞ্চলের মতো নির্ধারণ করে নিতে হবে।
জামা‘আতে সালাত আদায়
ক- জামা‘আতে সালাত আদায়ের হিকমত:
জামা‘আতে সালাত আদায় করা আল্লাহর অনেক বড় অনুগত্য ও একটি শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। তাছাড়া এটি মুসলিমের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়ার্দ্রতা ও সমতার অন্যতম নিদর্শন। যেহেতু মুসলিমগণ দিনে রাতে পাঁচবার একটি মহান উদ্দেশ্যে একজন নেতার অধীনে একই দিকে ফিরে মসজিদে ছোটখাটো একটি সম্মেলনে সমবেত হয়। ফলে তাদের অন্তর একত্রিত ও পরিচ্ছন্ন হয়, পরস্পর দয়া ও সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় এবং মতানৈক্য দূরীভূত হয়।
খ- জামা‘আতে সালাত আদায়ের হুকুম:
নিজ এলাকায় অবস্থানরত হোক বা সফররত প্রত্যেক স্বাধীন, সক্ষম পুরুষের ওপর জামা‘আতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَإِذَا كُنتَ فِيهِمۡ فَأَقَمۡتَ لَهُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَلۡتَقُمۡ طَآئِفَةٞ مِّنۡهُم مَّعَكَ١٠٢﴾ [النساء : ١٠٢]
“আর যখন তুমি তাদের মধ্যে থাকবে। অতঃপর তাদের জন্য সালাত কায়েম করবে, তখন যেন তাদের মধ্য থেকে একদল তোমার সাথে দাঁড়ায়।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০২]
এখানে আল্লাহর আদেশটি ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যকীয় অর্থে। কঠিন ভয়ের সময় যেহেতু জামা‘আতে সালাত কায়েম আদেশ দিয়েছেন, সেহেতু নিরাপদ ও ভয়বিহীন সময় জামা‘আতে সালাত আদায় করা যে আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় তা ভালোভাবেই বুঝা যায়।
গ- সর্বনিম্ন কতজন দ্বারা জামা‘আত সংঘটিত হয়:
ইমামের সাথে একজন পুরুষ বা নারী যে কোনো একজন হলেই জামা‘আত সংঘটিত হয়। আবু মুসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«اثْنَانِ فَمَا فَوْقَهُمَا جَمَاعَةٌ»
“দুই বা ততোধিক ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি জামা‘আত হতে পারে।”[21]
ঘ- জামা‘আতে সালাত আদায়ের স্থান:
মসজিদে জামা‘আত করা সুন্নাত, তবে প্রয়োজন হলে মসজিদ ছাড়া অন্য জায়গাও জামা‘আত করা জায়েয। মহিলারা পুরুষ ছাড়াও নিজেরা জামা‘আত করতে পারবে। ইমাম দারা কুতনী রহ. বর্ণনা করেছেন, আয়েশা ও উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এভাবে জামা‘আত করেছেন।
«وَأَمَرَ أم ورقة أَنْ تَؤُمَّ أَهْلَ دَارِهَا».
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে ওয়ারাকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে তার গৃহে মহিলাদের সালাতের ইমামতি করার নির্দেশ দেন।”[22]
সালাতুল কসর বা সফরের সালাত
ক- কসরের সালাতের অর্থ:
সফরে সালাত কসর করার অর্থ হলো চার রাকাত বিশিষ্ট সালাতকে দুই রাকাত আদায় করা। মুসলিমের বিভিন্ন অবস্থা বিবেচনা করে ইসলামী শরী‘আত তাদের জন্য যেসব সহজতা করেছে এটা তারই অন্যতম বিধান। কুরআন, সুন্নাহ ও সমস্ত ইমামদের ঐক্যমতে কসরের সালাত শরী‘আতসিদ্ধ ও জায়েয।
খ- নিরাপত্তা ও ভয় উভয় অবস্থাতেই কসর করা যাবে:
সফরে নিরাপদ অবস্থায় হোক বা ভীত অবস্থায় উভয় অবস্থায়ই কসর করা যাবে। আয়াতে যে ভয়ের কথা বলা হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রের দিক বিবেচনা করে বলা হয়েছে। (কারণ হিসেবে নয়) কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রায় সফরই ভয়মুক্ত ছিল না। একবার ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন, আমরা নিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও আপনি আমাদের সালাত কসর করলেন। তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে বললেন, আপনি যে বিষয়ে আশ্চর্য হয়েছেন আমিও সে বিষয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম। তখন আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন,
«صَدَقَةٌ تَصَدَّقَ اللهُ بِهَا عَلَيْكُمْ، فَاقْبَلُوا صَدَقَتَهُ»
“এটি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি একটি সদকা। তোমরা তাঁর সদকাটি গ্রহণ করো।”[23]
গ- সালাতের কসর করার জন্য সফরের দূরত্ব:
প্রচলিত অর্থে যেটুকু দূরত্বকে সফর বলা হয় এবং এর জন্য পথের পাথেয় ও সামগ্রী বহন করা হয় সেটুকু দূরত্বের সফর করলেই সালাত কসর করে আদায় করা যাবে।
ঘ- কখন থেকে কসর শুরু করবে:
মুসাফির যখন তার বসবাসরত এলাকা ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হবে, যাকে প্রচলিত অর্থে বিচ্ছিন্ন বলা হয় তখন থেকেই কসর শুরু করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা জমিনে ভ্রমন করার সময় কসর করতে বলেছেন। আর নিজ এলাকার সীমা অতিক্রম না করলে জমিনে ভ্রমনকারী বলা হয় না।
দু’ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায়
প্রয়োজনের সময় দু’ওয়াক্ত সালাত একত্রে পড়ার অনুমতি রয়েছে। স্পষ্ট প্রয়োজন ব্যতীত দু ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায় না করা অনেক ‘আলেম মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব অল্প সংখ্যকবার ব্যতীত দু’ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায় করেন নি। যাদের জন্য কসর করা জায়েয তাদের জন্য দু’ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায়ও জায়েয, তবে যাদের জন্য দু’ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায় জায়েয তাদের সবার জন্য কসর করা জায়েয নয়।
পরের ওয়াক্ত সালাত আগের ওয়াক্তের সাথে পড়া এবং আগের সালাত পরের ওয়াক্তের সাথে পড়া। ব্যক্তির জন্য আগে ও পরে যেভাবে পড়লে অধিক সহজ হয় সেভাবে পড়া উত্তম। কেননা কসরের উদ্দেশ্য হলো সহজতা ও হালকা করা। আর আগে বা পরে আদায়ে উভয় ক্ষেত্রে যদি সমান হয় তাহলে পরের ওয়াক্তের সাথে একত্রে পড়া উত্তম। মুসাফির যখন কোথাও অবস্থান করার জন্য অবতরণ করবে তখন প্রত্যেক ওয়াক্ত সালাত নির্ধারিত সময় আদায় করা সুন্নাত।
সাহু সাজদাহ
সালাতেالسهو শব্দের অর্থ ভুলে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বীয় কাজ ও আদেশের কারণে সব আলিমের ঐকমত্যে সাহু সাজদাহ শরী‘আতসম্মত। সালাতে ভুলে বেশি বা কম করলে বা সন্দেহ হলে সাহু সাজদাহ দেওয়া শরী‘আতসম্মত। সালামের আগে বা পরে সাহু সাজদাহ দিতে হয়। তাশাহহুদ ছাড়া তাকবীর বলে পরপর দু’টি সাজদাহ দিতে হয়, এরপরে সালাম ফিরাবে।
নফল সালাত
ক- নফল সালাত শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:
বান্দার ওপর আল্লাহর অশেষ নি‘আমত হচ্ছে তিনি মানুষের স্বভাব উপযোগী নানা ধরণের ইবাদতের ব্যবস্থা করেছেন। এর দ্বারা তিনি সঠিকভাবে বান্দার থেকে আরোপিত কাজ বাস্তবায়ন করেন। যেহেতু মানুষ ভুল-ত্রুটি করে। তাই আল্লাহ এসব ভুলের ক্ষতিপূরণে বিকল্প আমলের ব্যবস্থা করেছেন। আর তা হলো নফল সালাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, নফল সালাত ফরয সালাতের পরিপূরক। মুসল্লি যদি ফরয সালাত পরিপূর্ণভাবে আদায় করতে না পারে তবে নফল সালাত তার পরিপূরক হয়।
খ- সর্বোত্তম নফল ইবাদত:
সর্বোত্তম নফল ইবাদত হলো আল্লাহর পথে জিহাদ। অতঃপর দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ١١﴾ [المجادلة: ١١]
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন।
অতঃপর নফল সালাত। এটি সর্বোত্তম শারীরিক ইবাদাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«اسْتَقِيمُوا، وَلَنْ تُحْصُوا، وَاعْلَمُوا أَنَّ خَيْرَ أَعْمَالِكُمُ الصَّلَاةَ»
“তোমরা (দীনের ওপর) অবিচল থাকো, আর তোমরা কখনও তা যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না। জেনে রাখো, তোমাদের আমালসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সালাত।”[24]
নফল সালাতের মধ্যে অন্যতম হলো:
ক- সালাতুল লাইল তথা তাহাজ্জুদের সালাত:
সালাতুল লাইল তথা রাতের সালাত দিনের সালাতের চেয়ে উত্তম, আবার রাতের শেষার্ধের সালাত প্রথমার্ধের চেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا إِذَا مَضَى شَطْرُ اللَّيْلِ».[25]
“যখন রাতের অর্ধেক অতিবাহিত হয় তখন আমাদের সুমহান রব প্রতি রাতে পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন।” [26][মুসলিম]
তাহাজ্জুদ হলো ঘুমের পরে যে সালাত পড়া হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেছেন, রাতের বেলায় ঘুম থেকে জেগে উঠে সালাত আদায় করা হলো নাশিয়াতুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ সালাত।
খ- সালাতুদ-দোহা:
মাঝে মাঝে সালাতুদ্দোহা আদায় করা সুন্নাত। আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي الضُّحَى حَتَّى نَقُولَ لاَ يَدَعُ، وَيَدَعُهَا حَتَّى نَقُولَ لاَ يُصَلِّي.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে সালাতুদ-দোহা আদায় করতেন যে, আমরা বলতাম তিনি হয়ত আর পরিত্যাগ করবেন না। আবার যখন তা আদায় করা থেকে বিরত থাকতেন তখন আমরা বলতাম যে, হয়ত তিনি আর তা আদায় করবেন না”।[27]
সালাতুদ-দোহার সর্বনিম্ন সংখ্যা দুরাক‘আত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার ও ছয় রাকাত আদায় করেছেন। আর সালাতুদ-দোহার সর্বোচ্চ সংখ্যা আট রাকাত। এ সালাত সর্বদা আদায় করা শর্ত নয়।
গ- তাহিয়্যাতুল মাসজিদ:
মসজিদে প্রবেশ করে তাহিয়্যাতুল মাসজিদের সালাত আদায় করা সুন্নাত। আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
«إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ المَسْجِدَ، فَلاَ يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ»
“তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সে যেন দু’ রাকাত সালাত না পড়া পর্যন্ত না বসে।”[28]
(বহু হাদীস প্রণেতারা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
(বহু হাদীস প্রণেতারা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
ঘ- তিলাওয়াতের সাজদাহ:
কুরআন তিলাওয়াতকারী ও শ্রবণকারী উভয়ের জন্য তিলাওয়াতের সাজদাহ দেওয়া সুন্নাত। তাকবীর বলে সাজদাহ দিবে এবং সাজদাহ থেকে উঠে সালাম ফিরাবে। সাজদায় সুবহানা রাব্বিআল ‘আলা বা সাজদায় যেসব দো‘আ পড়া হাদীসে এসেছে সেগুলো পড়া।
ঙ- শুকরিয়ার সাজদাহ:
কোন নি‘আমত প্রাপ্ত হলে বা বিপদাপদ কেটে গেলে শুকরিয়ার সাজদাহ দেওয়া সুন্নাত। কেননা আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
«كَانَ إِذَا أَتَاهُ أَمْرٌ يَسُرُّهُ أَوْ بُشِّرَ بِهِ، خَرَّ سَاجِدًا»
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনো খুশির খবর আসলে তিনি আল্লাহর সমীপে সাজদায় লুটিয়ে পড়তেন।
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খাওয়ারেজদের মধ্যে ‘যুসসুদাইয়্যা’ পেয়ে শুকরিয়ার সাজদাহ করেছেন। (মুসনাদ আহমাদ)
তাছাড়া কা‘ব ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর তাওবা কবুলের সুসংবাদ তার কাছে পৌঁছলে তিনি সাজদাহ করেন। তার এ ঘটনা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে। এ সাজদার নিয়ম ও বিধান তিলাওয়াতের সাজদার মতোই।
চ- তারাবীহর সালাত:
তারাবীহর সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সুন্নাত চালু করেছেন। রমযান মাসে ইশার সালাতের পরে মসজিদে জামা‘আতের সাথে এ সালাত আদায় করতে হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সালাতের জামা‘আত চালু করেছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর খিলাফাত কালে এ সুন্নাত পুনর্জীবিত করেছেন। উত্তম হলো এগারো রাকাত পড়া, তবে এর চেয়ে বেশি পড়লেও কোনো অসুবিধে নেই। রমযানের শেষ দশকে কিয়ামুল লাইল, যিকির ও দো‘আ বেশি পরিমাণে করার চেষ্টা করা।
ছ- বিতরের সালাত:
বিতরের সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সালাত পড়েছেন এবং তা আদায় করতে আদেশ করেছেন। বিতরের সালাত সর্বনিম্ন এক রাকাত। তিন রাকাত হলো পরিপূর্ণভাবে আদায় এবং সর্বোচ্চ এগারো রাকাত।
বিতরের সালাতের সময়:
ইশা ও ফজর সালাতের মধ্যবর্তী সময়। রুকু থেকে উঠে দো‘আ কুনূত পড়া মুস্তাহাব।
বিতরের সালাতের নিয়ম:
১- একসাথে সব রাকাত পড়বে, তাশাহহুদের জন্য বসবে না, শুধু শেষ রাকাতে তাশাহহুদ পড়বে।
২- যত রাকাত পড়বে তার শেষ রাকাতের আগের রাকাতে বসে তাশাহহুদ পড়বে, অতঃপর সালাম না ফিরিয়ে দাঁড়াবে, অতঃপর এক রাকাত পড়বে, তারপরে তাশাহহুদ ও সালাম ফিরাবে।
৩- প্রত্যেক দুই রাকাতে সালাম ফিরাবে, অতঃপর এক রাকাত পড়বে ও এতে তাশাহহুদ ও সালাম ফিরাবে। এ পদ্ধতিটি সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পদ্ধতিতে বিতরের সালাত আদায় করেছেন এবং সর্বদা এভাবেই আদায় করেছেন।
জ- সুন্নাতে রাতেবা বা ফরয সালাতের আগে পিছের নফলসমূহ:
সুন্নাতে রাতেবা বা ফরযের আগে পরের সালাতের মধ্যে সর্বোত্তমটি হচ্ছে, ফজরের পূর্বে দুই রাকাত সুন্নাত। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত হাদীসে,
«رَكْعَتَا الْفَجْرِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا»
“ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত দুনিয়া এবং তদস্থিত সমুদয় বস্তু থেকেও উত্তম।”[29] (ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
সুন্নাতে রাতেবা মুয়াক্কাদাহ বা ফরযের আগে পরে মোট বারো রাকাত তাকীদ দেওয়া সুন্নাত রয়েছে, সেগুলো হলো, যোহরের আগে চার রাকাত ও পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পরে দুই রাকাত, ইশার পরে দুই রাকাত ও ফজরের আগে দুই রাকাত।
কারো সুন্নাতে রাতেবা বা ফরযের আগে পরের সুন্নাত ছুটে গেলে কাযা করা সুন্নাত। আর বিতরের কাযা জোড় সংখ্যায় করতে হবে, তবে একাধিক ফরয কাযা হলে তখন কষ্টকর হওয়ার কারণে বিতর কাযা করতে হবে না, তবে ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত কাযা করবে, যেহেতু এ ব্যাপারে তাগিদ এসেছে। ফরয ও জামা‘আতে পড়া যায় এমন সালাত ব্যতীত সব নফল সালাত ঘরে পড়া উত্তম।
জুমু‘আর সালাত
ক- জুমু‘আর সালাতের ফযীলত:
জুমু‘আর দিন সপ্তাহের সর্বোত্তম ও সম্মানিত দিন। আল্লাহ তা‘আলা এ দিনটিকে এ উম্মতের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন এবং এতে তাদের জন্য জমায়েত হওয়া শরী‘আতসম্মত করেছেন। এ সমাবেশের হিকমত হলো মুসলিমের মধ্যে পরস্পর পরিচিতি, ভালোবাসা, দয়াশীলতা ও সাহায্য-সহযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়া। জুমু‘আর দিন মুসলিমের সাপ্তাহিক ঈদের দিন এবং সূর্য উদিত দিনের মধ্যে সর্বোত্তম দিন।
খ- জুমু‘আর সালাতের হুকুম:
জুমু‘আর সালাত ফরয। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَوٰةِ مِن يَوۡمِ ٱلۡجُمُعَةِ فَٱسۡعَوۡاْ إِلَىٰ ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَذَرُواْ ٱلۡبَيۡعَۚ ٩﴾ [الجمعة: ٩]
“হে মুমিনগণ, যখন জুমু‘আর দিনে সালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও। আর বেচা-কেনা বর্জন কর”। [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ৯]
জুমু‘আর সালাত দুই রাকাত। এ সালাতের জন্য গোসল করা ও তাড়াতাড়ি মসজিদে যাওয়া সুন্নাত।
গ- কার ওপর জুমু‘আর সালাত ফরয:
প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ, প্রাপ্তবয়ষ্ক, স্বাধীন ও শর‘ঈ ওযর ব্যতীত সক্ষম ব্যক্তির ওপর জুমু‘আর সালাত ফরয।
ঘ- জুমু‘আর সালাতের ওয়াক্ত:
সূর্য ঢলে পড়ার আগে জুমু‘আর সালাত পড়া সহীহ হবে, তবে সূর্য ঢলে পড়ার পরে পড়া উত্তম। কেননা সূর্য ঢলে পড়ার পরেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময় জুমু‘আর সালাত আদায় করেছেন।
ঙ- কতজনের সমন্বয় জুমু‘আর জামা‘আত সংঘটিত হয়:
‘উরফ তথা প্রথাগতভাবে যতজন লোক হলে জামা‘আত হয় ততজন লোক হলেই জুমু‘আর সালাতের জামা‘আত সংঘটিত হয়।
চ- জুমু‘আর সালাত শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী:
জুমু‘আর সালাত শুদ্ধ হওয়ার শর্ত পাঁচটি। যথা:
১- ওয়াক্ত।
২- নিয়াত।
৩- মুকিম হওয়া।
৪- ‘উরফ তথা প্রথাগতভাবে যতজন লোক জমায়েত হলে জামা‘আত হয় ততজন লোক একত্রিত হওয়া।
৫- জুমু‘আর সালাতের পূর্বে দু’টি খুৎবা দেওয়া। এতে আল্লাহর প্রশংসা, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরূদ ও সালাম, কুরআনের কিছু আয়াত পাঠ ও আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের অসিয়ত করা। জুমু‘আর সালাতে কিরাত এমন উচ্চস্বরে পড়া যাতে এ সালাতের জন্য শর্তানুযায়ী সংখ্যক লোক শুনতে পায়। ইমাম খুৎবা দেওয়ার সময় কথা বলা ও মানুষের ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে যাওয়া হারাম। জুমু‘আর সালাত যোহর সালাতের স্থলাভিষিক্ত। কেউ ইমামের সাথে জুমু‘আর সালাতের এক রাকাত পেলে সে জুমু‘আর সালাত পেয়েছে বলে গণ্য হবে। আর যদি এক রাকাতের কম পায় তাহলে যোহর সালাতের নিয়ত করবে এবং চার রাকাত সালাত আদায় করবে।
দুই ’ঈদের সালাত
দু’ঈদের সালাত শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:
ঈদের সালাত দীন ইসলামের অন্যতম বাহ্যিক নিদর্শন এবং উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এতে রমযান মাসের সাওম পালন ও আল্লাহর ঘরের হজ আদায়ের মাধ্যমে মহান মালিক আল্লাহর শুকরিয়া আদায় হয়। এছাড়াও ঈদে রয়েছে মুসলিমের মধ্যে পরস্পর ভালোবাসা, সহমর্মিতা, দয়াশীলতা, বহু লোকের সমাবেশ ও আত্মার পবিত্রতার আহ্বান।
ঈদের সালাতের হুকুম:
ঈদের সালাত ফরযে কিফায়া, অর্থাৎ কিছু সংখ্যক লোক আদায় করলে এলাকার সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর খলিফাগণ এ সালাত সর্বদা আদায় করেছেন। আর সব মুসলিম নারী-পুরুষের ওপর ঈদের সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। শরী‘আত মুকিম লোকদের জন্য এ সালাত বিধিবদ্ধ করেছেন; মুসাফিরের জন্য নয়।
ঈদের সালাতের শর্তাবলী:
জুমু‘আর সালাতে যেসব শর্ত রয়েছে ঈদের সালাতেও সেসব শর্ত প্রযোজ্য। তবে ঈদের দুই খুৎবা সুন্নাত এবং এ খুৎবাদ্বয় সালাতের পরে দিতে হয়।
ঈদের সালাতের ওয়াক্ত:
প্রত্যুষে সূর্য এক বর্শা পরিমাণ উপরে উঠলে ঈদের সালাতের সময় শুরু হয় এবং সূর্য ঢলে যাওয়া পর্যন্ত এ সালাত পড়া যায়। ঈদের দিনে সূর্য ঢলে যাওয়ার পরে যদি ঈদের দিন সম্পর্কে জানা যায় তাহলে পরের দিন এ সালাত যথাসময় কাযা করবে।
ঈদের সালাতের পদ্ধতি:
ঈদের সালাত দুই রাকাত। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
«صلاة الفطر والأضحى ركعتان، ركعتان، تمام غير قصر على لسان نبيكم، وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَى»
“ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাত দুই রাকাত, দুই রাকাত। তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্য মতে সে দুই রাকাতই পূর্ণ সালাত; সংক্ষেপ নয়। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে নতুন কিছু রটনা করলো সে বিফল হলো”।[30] এ সালাত খুৎবার আগে পড়তে হয়। প্রথম রাকাতে তাকবীরে তাহরীমার পরে ও আউযুবিল্লাহ এর আগে ছয় তাকবীর দিবে এবং দ্বিতীয় রাকাতে কিরাত পড়ার আগে পাঁচ তাকবীর বলবে।
ঈদের সালাত আদায়ের স্থান:
ঈদের সালাত মাঠে আদায় করতে হয়, তবে প্রয়োজনে মসজিদে আদায় করাও জায়েয।
দু’ঈদের সালাতের সুন্নাতসমূহ:
সালাতের আগে পরে বেশি করে তাকবীর দেওয়া ও দু’ ঈদের রাতে উচ্চস্বরে তাকবীর বলা সুন্নাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ١٨٥﴾ [البقرة: ١٨٥]
“আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করো।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫]
ইমাম আহমাদ রহ. বলেছেন, ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উভয় ঈদে তাকবীর দিতেন।
তাছাড়া আরও সুন্নাত হচ্ছে, যুলহজ মাসের দশ দিন তাকবীর দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ٢٨﴾ [الحج : ٢٨]
“আর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ২৮]
আর আইয়্যামুত তাশরীকের নির্ধারিত তাকবীর সালাতের পরে দিতে হয়। এ তাকবীর ঈদুল আযহার দিনের সাথে নির্দিষ্ট। ইহরাম থেকে মুক্ত ব্যক্তি আরাফাতের দিন ফজর সালাতের পর থেকে আইয়্যামুত তাশরীকের শেষ দিন পর্যন্ত এ তাকবীর বলবে।
ঈদের দিনে মুসল্লিগণের জন্য তাড়াতাড়ি ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত; কিন্তু ইমাম সালাতের সময় হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করবে। ঈদগাহে গমনকারী পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া ও সুন্দর কাপড় পরিধান করা সুন্নাত, তবে মহিলারা তাদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ করবে না।
ঈদের সালাতের সুন্নাতসমূহ:
ঈদুল আযহার সালাত আগে আগে পড়া আর ঈদুল ফিতরের সালাত দেরি করে পড়া সুন্নাত। ঈদুল ফিতরের সালাতে যাওয়ার আগে বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া আর ঈদুল আযহার সালাতের আগে কিছু না খেয়ে কুরবানীর গোশত দিয়ে খাওয়া সুন্নাত।
ইস্তিস্কা বা বৃষ্টিপ্রার্থনার সালাত
ক- ইস্তিস্কা বা বৃষ্টিপ্রার্থনার সালাত শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং অভাব-অনটনে, বিপদে-আপদে তাকে সর্বদা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন ও তাঁর কাছে আকুতি-মিনতি করার স্বভাবজাত করেই সৃষ্টি করেছেন। ইস্তিস্কা বা বৃষ্টিপ্রার্থনার সালাত মানুষের সে স্বভাবের এক বহিঃপ্রকাশ। মুসলিমগণ এ সালাতের মাধ্যমে অনাবৃষ্টি দেখা দিলে তার মহান রব আল্লাহর কাছে বৃষ্টিপ্রার্থনা করে।
খ- ইস্তিস্কা বা বৃষ্টিপ্রার্থনার সালাতের অর্থ:
সালাত, দো‘আ, ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে কোনো দেশ ও জাতির জন্য মহান আল্লাহর কাছে পানি প্রার্থনা করা।
গ- ইস্তিস্কা বা বৃষ্টিপ্রার্থনার সালাতের হুকুম:
ইস্তিস্কা বা বৃষ্টিপ্রার্থনার সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ সালাত আদায় করেছেন ও মানুষের মাঝে ঘোষণা দিয়েছেন এবং এ সালাতের জন্য তিনি মুসল্লা তথা মাঠে গিয়েছেন।
ঘ- ইস্তিস্কা সালাতের সময়, পদ্ধতি ও বিধি-বিধান:
ইস্তিস্কার সালাত ঈদের সালাতের মতোই।
ঙ- ইস্তিস্কা সালাতের ঘোষণা:
ইস্তিস্কা সালাতের কিছুদিন আগেই ইমাম লোকজনকে এ সালাতের ঘোষণা দেওয়া মুস্তাহাব। মানুষকে গুনাহ ও যুলুম- অত্যাচার থেকে তাওবা করার আহ্বান করা, সাওম পালন, দান-সদকা করা ও ঝগড়া-ঝাটি পরিহার করার আহ্বান করা। কেননা গুনাহ অনুর্বরতা ও অনুৎপাদনের কারণ যেমনিভাবে আল্লাহর আনুগত্য কল্যাণ ও বরকতের কারণ।
কুসূফ তথা সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সালাত
ক- সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সালাতের পরিচিতি, হুকুম ও শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:
কুসূফ অর্থ সূর্য বা চন্দ্রের আলো চলে যাওয়া, নিভে যাওয়া। এটা মহান আল্লাহ তা‘আলার একটি মহা নিদর্শন। এ সালাত মানুষকে এ জীবনের পরিবর্তনের তথা কিয়ামতের ভয়াবহ দিবসের জন্য প্রস্তুতি, আল্লাহর কাছে বিনীত হওয়া ও মহাবিশ্বের মহাপরিচালনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে আহ্বান করে। মহান আল্লাহই যে একমাত্র ইবাদতের হকদার এ সালাত তাঁরই অন্যতম আহ্বান। সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হলে জামা‘আতের সাথে এ সালাত পড়া সুন্নাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِ ٱلَّيۡلُ وَٱلنَّهَارُ وَٱلشَّمۡسُ وَٱلۡقَمَرُۚ لَا تَسۡجُدُواْ لِلشَّمۡسِ وَلَا لِلۡقَمَرِ وَٱسۡجُدُواْۤ لِلَّهِۤ ٱلَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ٣٧﴾ [فصلت: ٣٧]
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ। তোমরা না সূর্যকে সাজদাহ করবে, না চাঁদকে। আর তোমরা আল্লাহকে সাজদাহ কর যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদাত কর”। [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৭]
খ- সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সালাতের ওয়াক্ত:
সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত এর সময় অবশিষ্ট থাকে। সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ শেষ হয়ে গেলে এ সালাতের কাযা নেই এবং আলোকিত হয়ে গেলেও এ সালাত পড়ার নির্দেশ নেই, কেননা তখন এ সালাতের ওয়াক্ত চলে যায়।
গ- সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সালাতের বর্ণনা:
দু’রাকাত সালাত পড়তে হয়। প্রথম রাকাতে উচ্চস্বরে সূরা আল-ফাতিহা ও দীর্ঘ সূরা পড়তে হয়, অতঃপর দীর্ঘ রুকু করে মাথা উঠিয়ে সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদা ও রাব্বানা লাকাল হামদ পড়বে। অতঃপর সূরা ফাতিহা পড়ে দীর্ঘ সূরা পড়বে। অতঃপর রুকু করবে, অতঃপর রুকু থেকে মাথা উঠাবে। অতঃপর দু’টি দীর্ঘ সাজদাহ দিবে। অতঃপর প্রথম রাকাতের মতো দ্বিতীয় রাকাত পড়বে, তবে কিরাত, রুকু, সাজদাহ ইত্যাদি প্রথম রাকাতের চেয়ে তুলনামূলক কম দীর্ঘ করবে। এ সালাতের অন্য পদ্ধতিও আছে। তবে এটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ পদ্ধতি। যদি তিন বা চার বা পাঁচ বার রুকু করা হয় তবে প্রয়োজন হলে তাতে কোনো অসুবিধে নেই।
জানাযা
ক- মানুষ যতই দীর্ঘ হায়াতপ্রাপ্ত হোক তাকে মরতে হবেই:
মানুষকে কর্মক্ষেত্র দুনিয়া থেকে ফলাফল প্রাপ্তির স্থান আখিরাতে যেতেই হবে। এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের অধিকার হলো সে অসুস্থ হলে তার সেবা-শুশ্রূষা করবে এবং সে মারা গেলে তার জানাযায় উপস্থিত হবে।
· অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-শুশ্রূষা করতে যাওয়া, তাকে তাওবা ও অসিয়াতের উপদেশ দেওয়া সুন্নাত।
· কারো মৃত্যু নিকটবর্তী হলে তাকে ডান কাতে কিবলামুখী করে শোয়ানো সুন্নাত, যদি এতে তার কষ্ট না হয়। কষ্ট হলে চিৎ হয়ে কিবলার দিকে পা দিয়ে শোয়াবে। মাথা সামান্য উচুঁ করে রাখবে। তাকে কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” তালকীন দিবে। পানি বা শরবত দিয়ে গলা ভিজাবে। তার কাছে সূরা ইয়াসীন পড়বে।
· মুসলিম ব্যক্তি মারা গেলে সুন্নাত হলো তার চোখ বন্ধ করে দেওয়া, মাথা ও থুতনি বন্ধনি দ্বারা বেধে দেওয়া, শরীরের জোড়াগুলো আলতোভাবে নরম করে দেওয়া, মাইয়্যেতকে মাটি থেকে কোনো কিছুর উপর রাখা, তার পরনের কাপড় খুলে আলাদা কাপড় দ্বারা সতর ঢেকে দেওয়া, খাটের উপর রাখা সম্ভব হলে ডান দিক কিবলামুখী করে অথবা চিৎ করে শুয়ে কিবলার দিকে পা বিছিয়ে দিবে।
খ- মাইয়্যেতকে গোসল দেওয়া:
পুরুষ মাইয়্যেতের অসিয়তকৃত ব্যক্তি তাকে গোসল দেওয়ার ব্যাপারে বেশি হকদার, অতঃপর তার বাবা, অতঃপর তার দাদা, অতঃপর তার নিকটাত্মীয়। মহিলা মাইয়্যেতের অসিয়তকৃত মহিলা ব্যক্তি তাকে গোসল দেওয়ার ব্যাপারে বেশি হকদার, অতঃপর তার মা, অতঃপর তার দাদী, অতঃপর তার নিকটাত্মীয় মহিলারা তাকে গোসল দিবে। মুসলিম স্বামী-স্ত্রী একজন অন্যজনকে গোসল দিতে পারবে।
গোসলদানকারী বিবেকসম্পন্ন, ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী, বিশ্বস্ত ও গোসলদানে পারদর্শী হতে হবে।
মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক কাফিরকে গোসল দেওয়া বা দাফন কাপন পরানো হারাম, বরং মাটিতে পুতে রাখার মতো কাউকে পাওয়া না গেলে মুসলিম ব্যক্তি তাকে মাটিতে পুতে রাখবে।
গ- মাইয়্যেতকে গোসলের সুন্নাত পদ্ধতি:
প্রথমে তার লজ্জাস্থান ঢেকে দেবে, অতঃপর তার মাথাটা বসার মতো করে উপরের দিকে উঠাবে এবং আস্তে করে পেটে চাপ দিবে, যাতে করে পেটের ময়লা বেরিয়ে যায়। এরপর বেশি করে পানি ঢেলে তা পরিস্কার করে নিবে। তারপর হাতে কাপড় জড়িয়ে বা হাত মোজা পরে তা দিয়ে উভয় লজ্জাস্থানকে (দৃষ্টি না দিয়ে) ধৌত করবে। তারপর আরেকটি নেকড়া হাতে নিয়ে তাকে অযু করিয়ে নিবে, যা মুস্তাহাব। তারপর গোসলের নিয়ত করবে এবং ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। পানি, বরই পাতা বা সাবান দিয়ে গোসল করাবে। প্রথমে মাথা ও দাড়ি ধৌত করবে। অতঃপর ডানপাশ, অতঃপর বামপাশ ধৌত করবে। অতঃপর প্রথমবারের মতো করে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ধৌত করবে। এতে যদি পূর্ণরূপে পরিস্কার না হয় তবে পরিস্কার হওয়া পর্যন্ত ধৌত করতে হবে। শেষবারের সময় পানির সাথে কাফুর বা সুগন্ধি মিশাবে। মাইয়্যেতের মোচ বা নখ বড় হলে তা কেটে দিবে অতঃপর কাপড় দিয়ে মুছে দিবে। মহিলাদের চুল তিনটি বেনী করে দিবে এবং পিছনের দিক থেকে মুড়িয়ে ঢেকে দিবে।
ঘ- মাইয়্যেতের কাফন:
পুরুষকে তিনটি সাদা লেফাফা বা কাপড়ে কাফন পরানো সুন্নাত। কাফনের কাপড়ে সুগন্ধি মিশ্রিত করবে, অতঃপর কাপড় তিনটি একটির ওপর অন্যটি বিছাবে। এতে হানূত তথা সুগন্ধি মিশাবে। অতঃপর মৃতব্যক্তিকে এসব লিফাফার উপর সোজা করে চিৎ করে শোয়াবে। তার দুই নিতম্বের মাঝে তুলা দিবে এবং পাজামার রশির মতো রশি দিয়ে নেকড়া বা তুলা বেধে দিবে। তার সতর ঢেকে দিবে এবং সমস্ত শরীরে সুগন্ধি মাখবে। অতঃপর সবচেয়ে নিচের বামপাশের কাপড় ভাজ করে ডান দিকে দিবে এবং ডানপাশের কাপড় ভাজ করে বাম দিকে দিবে। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাপড় ভাজ করে দিবে। মাথার দিকে একটু বেশি রাখবে এবং কাফন আড়াআড়ি মুড়িয়ে ভাজ করে দিবে, তবে কবরে নামানোর পরে মোড়ানো বাঁধ খুলে দিবে। শিশুকে একটি কাফন পরাবে, তাকে তিনটি কাফন পরানোও জায়েয।
মহিলাকে প্রথমে লুঙ্গি (যা নিচে থাকবে) পড়াবে, অতঃপর কামীছ (জামা), অতঃপর খেমার বা ওড়না (যা দিয়ে মাথা ঢাকবে), অতঃপর কামীছ (জামা) এবং দু’টি বড় লেফাফা বা কাপড়, অতঃপর কামীছ (জামা), অতঃপর ওড়না দিয়ে ঢেকে দিবে, অতঃপর দু’টি বড় লেফাফা দিয়ে পেচিয়ে দিবে। ছোট মেয়েকে একটি কামিজ ও দু’টি লেফাফা দিবে।
পুরুষ হোক বা নারী, মাইয়্যেতকে একবার গোসল দিলেই যথেষ্ট হবে। এমনিভাবে সমস্ত শরীর ঢেকে যায় এমন কাপড় হলে নারী বা পুরুষ উভয়কেই এক কাপড়ে কাফন পরানো যথেষ্ট।
অকালপ্রসূত ভ্রূণ যদি চার মাস অতিক্রান্ত করে মারা যায় তবে তাকে মৃত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাকে গোসল দিবে ও জানাযা পড়বে।
ঙ- জানাযার সালাতের বর্ণনা:
সুন্নাত হলো, ইমাম পুরুষের মাথা বরাবর দাঁড়াবে। আর মহিলার মধ্যবর্তী স্থান বরাবর দাঁড়াবে। চার তাকবীরের সাথে জানাযা আদায় করবে এবং প্রতি তাকবীরে হাত উত্তোলন করবে। প্রথম তাকবীর দিয়ে আঊযুবিল্লাহ্… বিসমিল্লাহ পাঠ করে নিরবে সূরা আল-ফাতিহা পড়বে, তবে সানা পড়বে না। দ্বিতীয় তাকবীর দিয়ে পড়বে:
«اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ»
“হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধরদের ওপর সালাত পেশ করুন, যেরূপ আপনি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর বংশধরদের ওপর সালাত পেশ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি অতিপ্রশংসিত, অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী। হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধরদের ওপর তেমনি বরকত দান করুন যেমনি আপনি বরকত দান করেছেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই আপনি অতিপ্রশংসিত, অতি মর্যাদায় অধিকারী”।[31]
এরপর তৃতীয় তাকবীর দিয়ে এ দু‘আ পাঠ করবে:
«اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا، وَمَيِّتِنَا، وَصَغِيرِنَا، وَكَبِيرِنَا، وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا، وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا، اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الْإِيمَانِ، وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِسْلَامِ»
“ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদের জীবিত ও মৃতদের ক্ষমা করুন। আমাদের ছোট ও বড়, পুরুষ ও স্ত্রী, উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলকে ক্ষমা করুন। ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে যাকে জীবিত রাখেন, তাকে ঈমানের উপর জীবিত রাখুন এবং যাকে মৃত্যু দেন, তাকে ইসলামের ওপর মৃত্যু দান করুন”।[32]
«اللهُمَّ، اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ، وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ، وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ، وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ، وَنَقِّهِ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الْأَبْيَضَ مِنَ الدَّنَسِ، وَأَبْدِلْهُ دَارًا خَيْرًا مِنْ دَارِهِ، وَأَهْلًا خَيْرًا مِنْ أَهْلِهِ وَزَوْجًا خَيْرًا مِنْ زَوْجِهِ، وَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ وَأَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وعَذَابِ النَّارِ، وأفسح له في قبره ونور له فيه».
“হে আল্লাহ! তাকে মাফ করে দাও ও তার প্রতি দয়া কর। তাকে নিরাপদ রাখ ও তার ত্রুটি মার্জনা কর। তাকে উত্তম সামগ্রী দান কর ও তার প্রবেশস্থলকে প্রশস্ত করে দাও। তাকে পানি, বরফ ও শিশির দ্বারা ধুয়ে মুছে দাও এবং গুনাহ থেকে এরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দাও যেরূপ সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়। তার ঘরকে উত্তম ঘর পরিণত করে দাও, তাকে তার পরিবার থেকে উত্তম পরিবার দান কর, তার জোড়ার তুলনায় উত্তম জোড়া প্রদান কর। তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও এবং কবর ও জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর। তার জন্য কবরকে প্রশস্ত করে দাও এবং তার কবরকে আলোকময় করে দাও”।[33]
মাইয়্যেত শিশু হলে (من توفيته منا فتوفه عليهما) এর পরে বলবে:
«اللهم اجعله ذخرا لوالديه، وفرطا وشفيعا مجابا، اللهم ثقل به موازينهما وأعظم به أجورهما وألحقه بصالح سلف المؤمنين، واجعله في كفالة إبراهيم، وقه برحمتك عذاب الجحيم».
“হে আল্লাহ আপনি এ শিশুকে তার পিতামাতার জন্য ধন-ভাণ্ডার, অগ্রগামী সম্পদ (আমল) ও শাফা‘আতকারী করে দিন। হে আল্লাহ এর দ্বারা তার পিতামাতার আমলের পাল্লা ভারী করুন, তাদের প্রতিদান বাড়িয়ে দিন, তাকে সৎপূর্বসূরী মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত করুন, তাকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভরণ-পোষণ দায়িত্বে রাখুন, আপনার রহমাতে তাকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।”[34]
এরপর চতুর্থ তাকবীর দিয়ে সামান্য একটু চুপ থেকে ডান দিকে সালাম ফিরাবে।
চ- জানাযার সালাতের ফযীলত:
জানাযার সালাত আদায়কারীর জন্য রয়েছে এক কিরাত সাওয়াব। আর কিরাত হলো অহুদ পাহাড় পরিমাণ। আর কেউ জানাযার সালাত আদায় করে দাফন পর্যন্ত মাইয়্যেতের সাথে থাকলে তার জন্য রয়েছে দুই কিরাত।
মাইয়্যেতকে চারজন বহন করা সুন্নাত। একই ব্যক্তি পরিবর্তন করে খাটের চারপাশ বহন করা সুন্নাত। জানাযা নিয়ে দ্রুত চলা সুন্নাত। পায়ে হাটা ব্যক্তিরা জানাযার সামনে চলবে এবং আরোহীরা জানাযার পিছনে চলবে।
ছ- কবর, দাফন ও কবরে যেসব কাজ করা নিষিদ্ধ:
কবর গভীর হওয়া ওয়াজিব। কবরের নিম্নভাগে একটি গর্ত করা যা কিবলামুখী করে মাইয়্যেতকে রাখার জন্য করা হয়, একে ‘লাহাদ’ কবর বলে। এ কবর ‘শাক্ক’ বা সরাসরি খাদ করে দেওয়া কবরের চেয়ে উত্তম। কবরে মাইয়্যেতকে নামানো ব্যক্তি বলবে:
«بِسْمِ اللَّهِ، وَعَلَى مِلَّةِ رَسُولِ اللَّهِ»
‘‘আল্লাহর নামে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিল্লাতের অর্ন্তভুক্ত করে রাখলাম”।
ডান কাতে শোয়ায়ে কিবলামুখী করে রাখবে। অতঃপর কবরে মাটি দিবে, অতঃপর দাফন করবে। কবর জমিন থেকে এক বিঘত পরিমাণ উঁচু করবে এবং এতে পানি ছিটিয়ে দিবে।
কবরের উপর গৃহ নির্মাণ, চুনকাম করা, হাটা, সালাত পড়া, কবরের উপর মসজিদ তৈরি করা, কবরকে বরকতের স্থান মনে করা, বাতি জ্বালানো, গোলাপ ফুল ছড়ানো ও কবরে তাওয়াফ ইত্যাদি করা হারাম।
মাইয়্যেতের পরিবার পরিজনের জন্য খাবার তৈরি করে পাঠানো সুন্নাত। পক্ষান্তরে মাইয়্যেতের পরিবার পরিজন আগত মানুষের জন্য খাবার তৈরি করা মাকরূহ।
কবর যিয়ারতের সময় এ দো‘আ পড়া সুন্নাত:
«السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَاحِقُونَ، وَيَرْحَمُ اللهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِينَ، نسأل اللّه لنا ولكم العافية، اللهم لا تحرمنا أجرهم، ولا تفتنا بعدهم، واغفر لنا ولهم »
“হে কবরের অধিবাসী মুমিনগণ! আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। নিশ্চয় আমরাও আপনাদের সাথে এসে মিলিত হব ইনশাআল্লাহ। আমাদের অগ্রবর্তী ও পরবর্তীদের উপরে আল্লাহ রহম করুন। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের ও আপনাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের বিনিময় হতে বঞ্চিত করবেন না এবং এরপর আর আমাদেরকে ফিতনায় পতিত করবেন না এবং আমাদের ও তাদেরকে ক্ষমা করে দিন।”[35]
মৃতব্যক্তির পরিবার পরিজনকে দাফনের আগে ও পরের তিনদিন সমবেদনা জানানো সুন্নাত। তবে অনুপস্থিত ব্যক্তিকে এর পরেও সমবেদনা জানানো যাবে।
কারো কোনো মুসীবত আসলে নিম্নোক্ত দো‘আ বলা সুন্নাত:
«إنا للّه وإنا إليه راجعون، اللهم أجرني في مصيبتي، واخلف لي خيرا منها»
“নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। হে আল্লাহ! আমাকে বিপদে ধৈর্য ধারণের সাওয়াব দান করুন এবং এর চেয়ে উত্তম প্রতিদান দিয়ে ধন্য করুন”।[36]
মাইয়্যেতের জন্য কাঁদা জায়েয, তবে মাতম করে জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা, গালে চড় বা আঘাত করা, উচ্চস্বরে কাঁদা ইত্যাদি হারাম।
=====
লেখক: ড. সালিহ ইবন গানিম আস-সাদলান
অনুবাদক: আব্দুল্লাহ আল মামুন আল-আযহারী
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলামহাউজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন