Views:
A+
A-
কুফরীর সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
কুফরীর সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
কুফরীর সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
কুফরীর সংজ্ঞা : কুফরীর আভিধানিক অর্থ আবৃত করা ও গোপন করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় ঈমানের বিপরীত অবস্থানকে কুফরী বলা হয়। কেননা কুফরী হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান না রাখা, চাই তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক কিংবা না হোক। বরং তাদের ব্যাাপারে কোন প্রকার সংশয় ও সন্দেহ, উপেক্ষা কিংবা ঈর্ষা, অহংকার কিংবা রাসূলের অনুসরণের প্রতিবন্ধক কোন প্রবৃত্তির অনুসরণ কুফরীর হুকুমে কোন পরিবর্তন আনয়ন করবেনা। যদিও তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী বড় কাফির হিসাবে বিবেচিত। অনুরূপভাবে ঐ অস্বীকারকারী ও বড় কাফির, যে অন্তরে রাসূলগণের সত্যতার প্রতি বিশ্বাস রাখা সত্ত্বেও হিংসাবশতঃ মিথ্যা সাব্যস্ত করে থাকে। [১]
কুফরীর প্রকারভেদ :
কুফুরী দুই প্রকার:
প্রথম প্রকার : বড় কুফরী
এ প্রকারের কুফুরী মুসলমান ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত:
১. মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কুফরী:
এর দলীল আল্লাহর বাণী:
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ ﴿৬৮﴾ سورة العنكبوت
'যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা কথা রচনা করে, অথবা তার কাছে সত্য আসার পর তাকে অস্বীকার করে, তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে? জাহান্নামই কি এইসব কাফিরের আবাস নয়? [২]
২. মনে বিশ্বাস রেখেও অস্বীকার অহংকারশতঃ কুফরী:এর দলীল আল্লাহর বাণী:
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآَدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ ﴿৩৪﴾ سورة البقرة
'যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সেজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।[৩]
৩. সংশয়জনিত কুফুরী:
একে ধারণাজনিত কুফরী ও বলা হয়। এর দলীল আল্লাহ তাআলার বাণী:
وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا ﴿৩৫﴾ وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا ﴿৩৬﴾ قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا ﴿৩৭﴾ لَكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِرَبِّي أَحَدًا ﴿৩৮﴾ سورة الكهف
'নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমার মনে হয়না যে, এ বাগান কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমি মনে করিনা যে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। আর যদি আমার পালনকর্তার কাছে আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়ই, তবে তো আমি নিশ্চয়ই এর চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান পাব। তদুত্তরে তার সাথী তাকে বলল, তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন তোমাকে মানবাকৃতিতে? কিন্তু আল্লাহই আমার পালনকর্তা এবং আমি কাউকে আমার পালনকর্তার সাথে শরীক করিনা।[৪]
৪. উপেক্ষা প্রদর্শন ও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কুফরী:
এর দলীল আল্লাহর বাণী:
وَالَّذِينَ كَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ ﴿৩﴾ سورة الأحقاف
'আর কাফিররা যে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।[৫]
৫. নিফাকী ও কপটতার কুফরী:
এর দলীল হল:
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا فَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ ﴿৩﴾ سورة المنافقون
এটা এজন্যে যে, তারা ঈমান আনবার পর কুফরী করেছে। ফলে তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। অতএব তারা বুঝে না।[৬]
দ্বিতীয় প্রকার: ছোট কুফরী
এ প্রকারের কুফরী মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিস্কৃত করেনা। একে 'আমলী কুফরী' ও বলা হয়। ছোট কুফরী দ্বারা সে সব গোনাহের কাজকেই বুঝানো হয়েছে, কুরআন ও সুন্নায় যাকে কুফরী নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের কুফুরী বড় কুফরীর সমপর্যায়ের নামে। যেমন আল্লাহর নিয়ামতের কুফরী করা যা নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آَمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ ﴿১১২﴾ سورة النحل
'আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এমন এক জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। তথায় প্রত্যেক স্থান হতে আসত প্রচুর রিযিক ও জীবিকা। অতঃপর সে জনপদের লোকেরা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞা প্রকাশ করল।'[৭]
এক মুসলমান অপর মুসলমানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াও এ ধরনের কুফরীর অন্তর্গত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
سِبَابُ المُسْلمِ فُسُوْقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ.
'কোন মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী কাজ। আর তার সাথে যুদ্ধ করা কুফুরী। [৮]
তিনি আরো বলেন:
لَا تَرْجِعُوْا بَعْدِيْ كُفَّاراً, يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ.
'আমার পর তোমরা পুনরায় কাফির হয়ে যেওনা, যাতে তোমরা একে অপরের গর্দান উড়িয়ে দেবে।[৯]
গায়রুল্লাহর নামে কসম ও এ কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ كَفَرَ أوْ أشْرَكَ.
'যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর নামে কসম করল। সে কুফরী কিংবা শিরক করল। [১০]
কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ মুমিন হিসাবে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى ﴿১৭৮﴾ سورة البقرة
'হে ঈমানদার গণ! তোমাদের উপর নিহতদের ব্যাপারে ক্বিসাস গ্রহণ করা ফরয করা হয়েছে।'[১১]
এখানে হত্যাকারীকে ঈমানদারদের দল থেকে বের করে দেয়া হয়নি। বরং তাকে ক্বিসাসের অলী তথা ক্বিসাস গ্রহণকারীর ভাই হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
....فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ.... ﴿১৭৮﴾ سورة البقرة
'অত:পর হত্যাকারীকে তার(নিহত) ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তবে (নিহতের ওয়ারিসগণ) প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং (হত্যাকারী) উত্তমভাবে তাকে তা প্রদান করবে। '[১২]
নিঃসন্দেহে ভাইদ্বারা এখানে দ্বীনী ভাই বুঝানো উদ্দেশ্য। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ﴿৯﴾
'মুমিনদরে দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।[১৩]
এর পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন:
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ﴿১০﴾
'মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই, অতএব তোমরা তোমাদের দু'ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা কর'[১৪]
সার কথা:
১. বড় কুফরী ইসলামী মিল্লাত থেকে বের করে দেয় এবং আমলসমূহ নষ্ট করে দেয়। পক্ষান্তরে ছোট কুফরী ইসলামী মিল্লাত থেকে বের করেনা এবং আমল ও নষ্ট করে না। তবে তা তদনুযায়ী আমলে ত্রুটি সৃষ্টি করে এবং লিপ্ত ব্যক্তিকে শাস্তির মুখোমুখি করে।
২. বড় কুফরীতে লিপ্ত ব্যক্তি চিরস্থায়ী ভাবে জাহান্নামে অবস্থান করবে। কিন্তু ছোট কুফরীর কাজে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করলেও তাতে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবেনা। বরং কখনো আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। ফলে সে মোটেই জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা।
৩. বড় কুফরীতে লিপ্ত হলে ব্যক্তির জান-মাল মুসলমানদের জন্য বৈধ হয়ে যায়। অথচ ছোট কুফরীতে লিপ্ত হলে জান-মাল বৈধ হয়না।
৪. বড় কুফরীর ফলে মুমিন ও অত্র কুফরীতে লিপ্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রকৃত শত্রুতা সৃষ্টি হওয়া অপরিহার্য হয়ে যায়। তাই সে ব্যাক্তি যত নিকটাত্বীয়ই হোক না কেন, তাকে ভালবাসা ও তার সাথে বন্ধত্ব স্থাপন করা মুমিনদের জন্য কখনোই বৈধ নয়। পক্ষান্তরে ছোট কুফরীতে লিপ্ত ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে কোন বাধা নেই। বরং তার মধ্যে যতটুকু ঈমান রয়েছে সে পরিমান তাকে ভালবাসা ও তার সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত এবং যতটুকু নাফরমানী তার মধ্যে আছে, তার প্রতি ততটুকু পরিমান ঘৃণা ও বিদ্বেষভাব পোষণ করা যেতে পারে।
সমাপ্ত
তথ্যসূত্রঃ
[১] মাজমু আল ফাতওয়া, ৩৩৫।
[২] সূরা আনকাবুত, ৬৮।
[৩] সূরা বাকারা,।
[৪] সূরা কাহাফ,৩৫-৩৮।
[৫] সূরা আহক্বাফ,০৩।
[৬] সূরা মুনাফিকুন, ০৩।
[৭] সূরা নাহল, ১১২।
[৮] বুখারী, মুসলিম।
[৯] বুখারী, মুসলিম।
[১০] তিরমিযী, হাকেম।
[১১] সূরা বাকারা, ১৭৮।
[১২] সূরা বাকারা, ১৭৮।
[১৩] সূরা হুজরাত, ০৯।
[১৪] সূরা হুজরাত, ১০
_________________________________________________________________________________
লেখক : সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান
تأليف: صالح بن فوزان الفوزان
অনুবাদক : মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
مراجعة : محمد منظور إلهي
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন