Views:
A+
A-
দুই. অমুসলিম দেশে অবস্থান করা, দ্বীনের হেফাজতের জন্য অমুসলিম দেশ থেকে মুসলিম দেশে হিজরত করা হতে বিরত থাকা:
চার. মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা, তাদের প্রশংসা করা ও তাদের হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করা:
পাঁচ. অমুসলিমদের থেকে সাহায্য কামনা করা, তাদের কথার উপর ভরসা করা, তাদেরকে মুসলিমদের গোপন বিষয়াদি সম্বলিত বিভিন্ন বড় বড় পোষ্টে চাকুরী দেয়া, তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু নির্বাচন করা, তাদেরকে পরামর্শক হিসেবে গ্রহণ করা[13]
ছয়. অমুসলিমদের ক্যালেন্ডার অনুসারে তাদের তারিখ নির্ধারণ করা, বিশেষ করে যে ক্যালেন্ডার অমুসলিমদের নিজস্ব ধর্মীয় ইবাদত-ঐতিহ্য ও পর্বের হিসাব অনুসারে নির্ধারিত। যেমন জিওগ্রেরিয়ান ক্যালেন্ডার (ইংরেজি বা ঈসায়ী ক্যালেন্ডার হিসেবে যা আমাদের কাছে পরিচিত)।
সাত. অমুসলিমদের উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা, তাদেরকে তাদের অনুষ্ঠান পালনে সহযোগিতা করা, তাদের অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাদের সম্ভাষণ জানানো, ধন্যবাদ দেয়া ও তাদের অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হওয়া:
আট. অমুসলিমদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস ও বাতিল দ্বীনের প্রতি লক্ষ্য না করে, তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও আচার- আচরণ, তাদের চরিত্র ও ব্যবহারের প্রশংসা ও খুশি প্রকাশ করা এবং তাদের কর্ম দক্ষতা ও নিত্য নতুন আবিষ্কার ও তাদের কর্মে অভিভূত হওয়া।
নয়. অমুসলিমদের নামে মুসলিম বাচ্চাদের নাম রাখা:
দশ. অমুসলিমদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রার্থনা করা:
দুই. মুসলিমদের সাহায্য করা এবং জান, মাল ও জবান দ্বারা তাদের দীনি ও দুনিয়াবি বিষয়ে সহযোগিতা করা[21]:
তিন. ঈমানদার ব্যথায় ব্যথিত হওয়া এবং তাদের সুখে খুশি হওয়া[22]:
চার. ঈমানদারদের হিতাকাঙ্খি হওয়া, তাদের কল্যাণকামী হওয়া, তাদের সাথে কোন প্রকার প্রতারণা না করা এবং তাদের কোন প্রকার ধোঁকা না দেওয়া:
পাঁচ. মুসলিম ভাইদের ইজ্জত ও সম্মান করা, তাদের কোন প্রকার খাটো না করা[28] এবং তাদের কোন দোষ-ত্রুটি প্রকাশ না করা:
ছয়. বিপদ-আপদ, সুখে-দুঃখে মুমিনদের সাথে থাকা:
সাত. মুমিনদের সাথে সাক্ষাত করা, তাদের সাক্ষাতকে পছন্দ করা এবং তাদের সাথে মিলে-মিশে থাকা [30]:
আট. মুমিনদের অধিকারের প্রতি সম্মান পদর্শন করা:
নয়. দুর্বল মুমিনদের প্রতি দয়াবান হওয়া:
দশ. মুমিনদের জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা:
দ্বিতীয় প্রকার: যাদের সাথে খালেস দুশমনি ও শত্রুতা করতে হবে
তৃতীয় শ্রেণীর লোক:
ইসলামে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা
অনুবাদকের কথা
আল্লাহর বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর দুশমনদের সাথে শত্রুতা থাকা একজন মুমিনের ঈমানের পরিচয় এবং এটি ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর উদাসীনতা এতই প্রকট যে, বর্তমানে তারা অমুসলিমদের সাথে এমনভাবে সম্পর্ক রাখছে, তারা তাদের আসল ঐতিহ্য, শিক্ষা সংস্কৃতিকে ভুলে বিজাতিদের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মুসলিম জাতিকে তাদের করুণ পরিণতি হতে বাঁচানো ও তাদের সজাগ করে তোলার জন্য শাইখ সালেহ ইবন ফাউযান আল-ফাউযান এর রিসালা-ইসলামে শত্রুতা ও বন্ধুত্ব টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা ভাষা-ভাষি মুসলিমদের জন্য রিসালাটি অনুবাদ করা ও তাদেরকে বিষয়টি সম্পর্কে জানানোর তীব্রতার প্রতি লক্ষ্য করে তা অনুবাদ করে ইসলাম হাউসের বাংলা ভাষার পাঠকদের পাঠকদের জন্য পেশ করি। আশা করি আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা পাঠকদের দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করবেন।
রিসালাটি খুব সংক্ষিপ্ত ও আরবীতে হওয়ায়, পাঠকদের নিকট বিষয় বস্তুটি অধিক স্পষ্ট করা জন্য রিসালাটির অনুবাদের সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে ব্যাখা বিশ্লেষণ সংযোজন করা হয়েছে, যাতে পাঠক বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে ও বুঝতে পারে।
রিসালাটির অনুবাদ কর্ম ও ব্যাখা বিশ্লেষণ সংযোজন করতে গিয়ে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কোন বিজ্ঞ পাঠকের নিকট কোন ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ার পর সংশোধন করে দিলে, কৃতজ্ঞ থাকব।
ভূমিকা
যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক, আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের প্রাণ-প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, তার পরিবার-পরিজন ও সাথী-সঙ্গীদের উপর এবং তাদের উপর যারা তার প্রদর্শিত পথের অনুসারী।
একজন ঈমানদারের উপর ওয়াজিব হল, আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বতের সাথে সাথে আল্লাহর বন্ধুদের মহব্বত করা ও তার শত্রুদের সাথে দুশমনি করা।
আল্লাহর বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব থাকা এবং আল্লাহর দুশমনদের সাথে শত্রুতা থাকা একজন মুমিনের ঈমানের পরিচয় এবং এটি ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন। যার মধ্যে এ গুণ থাকবে না সে সত্যিকার ঈমানদার হতে পারে না। ঈমানদার হতে হলে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শত্রুতা তার মধ্যে থাকতে হবে, অন্যথায় ঈমানদার হওয়া যাবে না। আর এটি ঈমানের একটি অন্যতম অংশ এবং ঈমানের সাথে আঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যাদের মধ্যে ঈমানের এ মান-দণ্ড থাকবে না, তাদের ঈমান থাকবে না।
ইসলামী আক্বীদার অন্যতম ভিত্তি হল, দ্বীনের উপর বিশ্বাসী সব ঈমানদার মুমিনের সাথে বন্ধুত্ব রাখা। আর যারা এ দ্বীন-ইসলামকে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনে না এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনে না, সে সব মুশরিক ও কাফেরদের সাথে দুশমনি রাখা এবং তাদের ঘৃণার চোখে দেখা। সুতরাং মনে রাখতে হবে, যারা তাওহীদে বিশ্বাসী-মুখলিস ঈমানদার তাদের মহব্বত করা এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা হল ঈমানের বহি:প্রকাশ। আর যারা মুশরিক- গাইরুল্লাহর ইবাদত করে- তাদের অপছন্দ ও ঘৃণা করা ঈমানদার হওয়ার প্রমাণ স্বরূপ। আর এটিই হল ইব্রাহীম আ. ও তার অনুসারীদের জন্য আল্লাহর রাব্বুল আলামীন কর্তৃক মনোনীত দ্বীন, যে দ্বীনের আনুগত্য করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করে বলেন,
﴿قَدۡ كَانَتۡ لَكُمۡ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ فِيٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ إِذۡ قَالُواْ لِقَوۡمِهِمۡ إِنَّا بُرَءَٰٓؤُاْ مِنكُمۡ وَمِمَّا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ كَفَرۡنَا بِكُمۡ وَبَدَا بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمُ ٱلۡعَدَٰوَةُ وَٱلۡبَغۡضَآءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ وَحۡدَهُۥٓ إِلَّا قَوۡلَ إِبۡرَٰهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسۡتَغۡفِرَنَّ لَكَ وَمَآ أَمۡلِكُ لَكَ مِنَ ٱللَّهِ مِن شَيۡءٖۖ رَّبَّنَا عَلَيۡكَ تَوَكَّلۡنَا وَإِلَيۡكَ أَنَبۡنَا وَإِلَيۡكَ ٱلۡمَصِيرُ ٤﴾ ]سورة الممتحنة: 4[.
“ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা কর তা হতে আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি; এবং উদ্রেক হল আমাদের- তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন। তবে স্বীয় পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তিটি ব্যতিক্রম: ‘আমি অবশ্যই তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোন অধিকার রাখি না।’ হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা আপনার ওপরই ভরসা করি, আপনারই অভিমুখী হই আর প্রত্যাবর্তন তো আপনারই কাছে”। [সূরা মুমতাহিনা, আয়াত: ৪]
আর এটা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দ্বীনের অনুকরণের নামান্তর। এখানে কোন ভিন্নতা ও পার্থক্য নাই[1]। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ ٱلۡيَهُودَ وَٱلنَّصَٰرَىٰٓ أَوۡلِيَآءَۘ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَإِنَّهُۥ مِنۡهُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥١﴾ ]سورة المائدة:51]
“হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়েত দেন না”। [সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৫১]
এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিতাবিদের সাথে বন্ধুত্ব করার বিধান কি তার বর্ণনা দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিতাবিদের সাথে বন্ধুত্ব করতে এবং তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন[2]। অপর এক আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফেরদেরও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা হারাম হওয়া বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمۡ أَوۡلِيَآءَ تُلۡقُونَ إِلَيۡهِم بِٱلۡمَوَدَّةِ وَقَدۡ كَفَرُواْ بِمَا جَآءَكُم مِّنَ ٱلۡحَقِّ يُخۡرِجُونَ ٱلرَّسُولَ وَإِيَّاكُمۡ أَن تُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ رَبِّكُمۡ﴾ [سورة الممتحنة:1]
“হে ঈমান-দারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না”[3]। [সূরা মুমতাহানাহ, আয়াত: ১]
এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, কাফেররা যদি মুমিনদের আত্মীয়-স্বজন বা রক্ত সম্পর্কীয় ও গোত্রীয় লোকও হয়, তাদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব এবং তাদের খালেস মহব্বত করতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنْ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الظَّالِمُونَ.﴾ [سورة التوبة:23].
“হে ঈমান-দারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। [সূরা তাওবাহ, আয়াত: ২৩]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٖ مِّنۡهُۖ وَيُدۡخِلُهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُۚ أُوْلَٰٓئِكَ حِزۡبُ ٱللَّهِۚ أَلَآ إِنَّ حِزۡبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٢٢﴾ ]سورة المجادلة:22[
“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম”। [সূরা মুজাদালাহ, আয়াত: ২২][4]
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ দ্বীনের এ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিকে একেবারেই ভুলে গেছে[5]।
এমনকি আমি আরবি একটি টিভি চ্যানেলে একজন বিশিষ্ট আলেম ও দা‘য়ীকে বলতে শুনেছি, তিনি খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলেন, তারা আমাদের ভাই। এটি একটি মারাত্মক কথা যার সমর্থনে কোন দলীল-প্রমাণ নাই[6]।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেভাবে ইসলামী আকীদায় অবিশ্বাসী কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে হারাম করেছেন এবং তাদের ঘৃণা করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদের মহব্বত করাকেও ওয়াজিব করেছেন।[7] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُمۡ رَٰكِعُونَ ٥٥ وَمَن يَتَوَلَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَإِنَّ حِزۡبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلۡغَٰلِبُونَ ٥٦﴾ [سورة المائدة: 55].
“তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে। আর যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী”। [সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৫৫]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ﴾ [سورة الفتح:29].
“মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়”[8]। [সূরা ফাতহ, আয়াত: ২৯]
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ﴾ [سورة الحجرات:10].
“নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। [সূরা হুজরাত, আয়াত: ১০]
সুতরাং মুমিনগণ পরস্পর ভাই, এ ভ্রাতৃত্ব দ্বীন ও আকীদার ভিত্তিতে; যদিও দেশ, বংশ ও সময়ের দিক থেকে তাদের মধ্যে দুরত্ব থাকুক।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন করীমে এরশাদ করে বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [سورة الحشر:10].
“যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু”। [সূরা হাসর, আয়াত: ১০]
মোট কথা, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মুমিনরা একে অপরের ভাই। তাদের ঘর-বাড়ী, স্থান-কাল ও সীমা-রেখা যতই দূরে থাকুক না কেন, তা বিবেচনার বিষয় নয়, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলে বিশ্বাসী কিনা তা হল মুল বিবেচনার বিষয়। ঈমানের দিক দিয়ে তাদের একের সাথে অপরের সম্পর্ক খুবই গভীর। পরবর্তী যুগের মুমিনরা তাদের পূর্ববর্তীদের অনুকরণ করবে, তাদের জন্য দো‘আ করবে, ক্ষমা চাইবে।
শত্রুতা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন
প্রথমত: কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন:
এক. কথা-বার্তা লেবাস-পোশাক ইত্যাদিতে অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা:
লেবাস-পোশাক, চাল-চলন ও কথা-বার্তা ইত্যাদিতে অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা, তাদের সাথে বন্ধুত্বকেই প্রমাণ করে[9]। সে কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ»
যে সব আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, আখলাক-চরিত্র ইত্যাদি কাফেরদের বৈশিষ্ট্য, সে সব বিষয়ে তাদের অনুকরণ করা সম্পূর্ণ হারাম। যেমন- দাড়ি মুণ্ডন, গোফ বড় করা, প্রয়োজন ছাড়া তাদের সংস্কৃতিতে কথা বলা, তারা যে সব পোশাক পরিধান করে, তা পরিধান করা, তারা যে সব খাদ্য গ্রহণ করে, তা গ্রহণ করা, ইত্যাদি[11]।
দুই. অমুসলিম দেশে অবস্থান করা, দ্বীনের হেফাজতের জন্য অমুসলিম দেশ থেকে মুসলিম দেশে হিজরত করা হতে বিরত থাকা:
যখন একজন মুসলিম ব্যক্তি কোন অমুসলিম দেশে তার দ্বীনের বিষয়ে আশঙ্কা করবে, তাকে অবশ্যই দ্বীনের হেফাজতের জন্য কাফেরদের দেশ ত্যাগ করে কোন মুসলিম দেশে হিজরত করতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিটি মুসলিমের উপর তার দ্বীনের হেফাজতের জন্য হিজরত করা ওয়াজিব। কারণ, দ্বীনের বিষয়ে আশঙ্কা করার পরও কাফের দেশে অবস্থান করা, কাফেরদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার প্রমাণ বহন করে। এ কারণেই হিজরত করতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির জন্য কোন কাফেরদের মাঝে অবস্থান করা আল্লাহ হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَفَّىٰهُمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ ظَالِمِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَالُواْ فِيمَ كُنتُمۡۖ قَالُواْ كُنَّا مُسۡتَضۡعَفِينَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ قَالُوٓاْ أَلَمۡ تَكُنۡ أَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٗ فَتُهَاجِرُواْ فِيهَاۚ فَأُوْلَٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ٩٧ إِلَّا ٱلۡمُسۡتَضۡعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلۡوِلۡدَٰنِ لَا يَسۡتَطِيعُونَ حِيلَةٗ وَلَا يَهۡتَدُونَ سَبِيلٗا ٩٨ فَأُوْلَٰٓئِكَ عَسَى ٱللَّهُ أَن يَعۡفُوَ عَنۡهُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَفُوًّا غَفُورٗا٩٩﴾ [سورة النساء:97-99].
“নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা জমিনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তন-স্থল। তবে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশু যারা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন রাস্তা খুঁজে পায় না। অতঃপর আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল। [সূরা আন-নিসা: ৯৭-৯৯]
আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের জন্য হিজরত করাকে ফরয করে দিয়েছেন। একমাত্র দুর্বল যারা হিজরত করতে অক্ষম তাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অমুসলিম দেশে অবস্থান করার অনুমতি দিয়েছেন[12]।
অনুরূপভাবে যাদের কাফেরদের দেশে থাকার দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমের কোন উপকার ও কল্যাণ রয়েছে, তাদের জন্য কাফেরদের দেশে থাকার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। যেমন- কাফেরদের দেশে কাফেরদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে পারে, তাদের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে পারে এবং ইসলামের প্রচার করতে পারে। এ ধরনের লোকের জন্য কাফের দেশে অবস্থান করাতে কোন অসুবিধা বা গুনাহ নাই। তারা সেখানে অবস্থান করে মুসলিমদের পক্ষে কাজ করবে।
তিন- বিনোদন ও পর্যটনের উদ্দেশ্যে তাদের দেশে ভ্রমণ করা:
প্রয়োজন ব্যতীত কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে প্রয়োজনীয় কাজে ভ্রমণ করাতে কোন অসুবিধা নাই। যেমন, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চ শিক্ষা লাভ, বিশেষত: এমন কোন ডিগ্রি হাসিল, যা তাদের দেশে যাওয়া ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়, এ ধরনের কোন প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ভ্রমণ করা বৈধ। তখন এ সব প্রয়োজনের খাতিরে তাদের দেশে সফর করা ও সেখানে সাময়িক অবস্থান করাতে কোন গুনাহ হবে না। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে, যে সব প্রয়োজনের তাগিদে তাদের দেশে ভ্রমণ করা যেতে পারে, প্রয়োজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার জন্য মুসলিমদের দেশে ফিরে আসা ওয়াজিব। সেখানে কাল ক্ষেপণ করা বা বিনোদনের উদ্দেশ্যে ঘুরা-ফেরা করা কোন ক্রমেই উচিত না।
এ ধরনের সফর বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত হল, সে সেখানে নিজের দ্বীন প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকতে হবে, মুসলিম হওয়ার কারণে তার মধ্যে কোন প্রকার সংকোচ ও হীনমন্যতা থাকতে পারবে না। মুসলিম হওয়ার কারণে তার সম্মানবোধ থাকতে হবে। অমুসলিমের দেশে যে সব অন্যায়, অনাচার ও কু-সংস্কার সংঘটিত হয়, তার থেকে দূরে থাকতে হবে। শত্রুদের ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে। অনুরূপভাবে যদি কারো জন্য অমুসলিম দেশে ইসলামের দাওয়াত দেয়া ও ইসলাম প্রচারের কাজ করার সুযোগ হয়, তখন তার জন্য অমুসলিম দেশে অবস্থান করা বৈধ, আবার কখনও কখনও ওয়াজিব।
চার. মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা, তাদের প্রশংসা করা ও তাদের হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করা:
মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের সহযোগিতা করা মারাত্মক অপরাধ ও বড় গুনাহ। যারা এ ধরনের কাজ করে, তারা কোন ক্রমেই মুসলিম হতে পারে না। এ কাজটি হল, ইসলাম বিনষ্টকারী ও ঈমান হারা হওয়ার অন্যতম উপকরণ। এ ধরনের কাজ করলে সে মুরতাদ বা বেঈমান বলে গণ্য হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের এ ধরনের কাজ করা হতে নাজাত দান করুন।
পাঁচ. অমুসলিমদের থেকে সাহায্য কামনা করা, তাদের কথার উপর ভরসা করা, তাদেরকে মুসলিমদের গোপন বিষয়াদি সম্বলিত বিভিন্ন বড় বড় পোষ্টে চাকুরী দেয়া, তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু নির্বাচন করা, তাদেরকে পরামর্শক হিসেবে গ্রহণ করা[13]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ بِطَانَةٗ مِّن دُونِكُمۡ لَا يَأۡلُونَكُمۡ خَبَالٗا وَدُّواْ مَا عَنِتُّمۡ قَدۡ بَدَتِ ٱلۡبَغۡضَآءُ مِنۡ أَفۡوَٰهِهِمۡ وَمَا تُخۡفِي صُدُورُهُمۡ أَكۡبَرُۚ قَدۡ بَيَّنَّا لَكُمُ ٱلۡأٓيَٰتِۖ إِن كُنتُمۡ تَعۡقِلُونَ ١١٨ هَٰٓأَنتُمۡ أُوْلَآءِ تُحِبُّونَهُمۡ وَلَا يُحِبُّونَكُمۡ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱلۡكِتَٰبِ كُلِّهِۦ وَإِذَا لَقُوكُمۡ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ عَضُّواْ عَلَيۡكُمُ ٱلۡأَنَامِلَ مِنَ ٱلۡغَيۡظِۚ قُلۡ مُوتُواْ بِغَيۡظِكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمُۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ١١٩ إِن تَمۡسَسۡكُمۡ حَسَنَةٞ تَسُؤۡهُمۡ وَإِن تُصِبۡكُمۡ سَيِّئَةٞ يَفۡرَحُواْ بِهَاۖ وَإِن تَصۡبِرُواْ وَتَتَّقُواْ لَا يَضُرُّكُمۡ كَيۡدُهُمۡ شَيًۡٔاۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ١٢٠﴾] سورة آل عمران: 118-120].
“হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। শোন, তোমরাই তো তাদেরকে ভালবাসা এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সব কিতাবের প্রতি ঈমান রাখ। আর যখন তারা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। আর যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তোমাদের উপর রাগে আঙ্গুল কামড়ায়। বল, ‘তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর’! নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী”[14]। যদি তোমাদেরকে কোন ভালো কিছু স্পর্শ করে তখন তাদেরকে কষ্ট দেয়, আর যদি তোমাদের উপর কোন বিপদ-কষ্ট আপতিত হয়, তখন তারা তাতে খুশি হয়। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১৮-১২০]
এ সব আয়াতগুলো কাফেরদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেয় এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে তারা যে সব দুশমনি, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও ধোঁকা দেয়ার মানসিকতা গোপন করে, তা উম্মোচণ করে দেয়। এ ছাড়াও এ সব আয়াত কাফেররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে সব খিয়ানত, ধোঁকাবাজি ও মিথ্যাচার করত, তার বর্ণনাকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছ। যখন মুসলিমরা তাদের প্রতি বিশ্বাস করবে, তখন তারা এটিকে সুযোগ মনে করে তা তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে। তাদের কাজই ছিল, কীভাবে মুসলিমদের ক্ষতি করা যায়, তার চক আঁকা এবং তাদের থেকে উদ্দেশ্যে হাসিল করার পন্থা আবিষ্কার করা।
ইমাম আহমদ রহ. বলেন, আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«قلتُ لعمرَ رضى الله عنه لي كاتبٌ نصرانيٌ، قال: مالَكَ قاتلَكَ اللهُ ، أما سمعتَ قولَه تعالى ﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾ [ سورة المائدة:51]. ألا اتخذتَ حنيفاً ! قلتُ: يا أميرَ المؤمنينَ لي كتابتُه وله دينُه ، قال:لا أُكرمُهم إذ أهانَهم اللهُ ، ولا أُعزُهم إذ أَذلَهم اللهُ ، ولا أُدينهم وقد أقصاهم اللهُ»
অর্থ, একদিন আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলি, আমার একজন সচিব আছে, সে খৃষ্টান। এ কথা শুনে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুন! তুমি খৃষ্টানকে কেন তোমার সচিব বানালে? তুমি কি আল্লাহ তা’আলার বাণী শুনোনি? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾ [سورة المائدة:51].
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইয়াহুদি ও খৃষ্টানদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। তারা নিজেরা পরস্পর বন্ধু”। [সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৫১] তুমি একজন খাটি মুসলিমকে কেন তোমার কাতেব বানালে না। তার কথা শুনে আমি বললাম, হে আমীরুল মুমীনিন! আমি তার থেকে কিতাবত আদায় করব, আর সে তার দ্বীন আদায় করবে। উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ যাদের অপমান করে আমি তাদের সম্মান করব না। আর আল্লাহ যাদের বে-ইজ্জত করে আমি তাদের ইজ্জত দেবো না এবং আমি তাদেরকে কাছে টানবো না, যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন।
وروى الإمام أحمد ومسلم أن النبي صلى الله عليه وسلم خَرَج إلى بَدْرٍ فَتَبِعَهُ رَجُلٌ مِنْ المشركين فَلحِقَه عند الحَرةِ فقال: إِني أَردتُ أنْ ِأَتَّبِعَكَ وَأُصِيبَ مَعَكَ، قَالَ« تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ » قَالَ لا ، قَالَ: «ارْجِعْ فَلَنْ أَسْتَعِينَ بِمُشْرِكٍ »
অর্থ, ইমাম আহমদ রহ. ও ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের যুদ্ধে বের হলে, একজন মুশরিক তার সাথে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ‘হাররাহ’ নামক স্থানে এসে মিলিত হয়। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলে, আমি তোমার সাথে যুদ্ধে যেতে চাই এবং তোমার সাথে যুদ্ধ অংশ গ্রহণ করব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি কি আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ঈমান আনয়ন কর? সে বলল, না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি ফেরৎ যাও! আমরা কোন মুশরিক হতে সাহায্য গ্রহণ করব না[15]।
উল্লেখিত আয়াত ও হাদিসসমূহ দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয়, মুসলিমদের কর্মের দায়িত্ব বা নেতৃত্ব যদ্বারা সে মুসলিমদের যাবতীয় সব কার্য-কলাপ বিষয়ে অবগত হয়, তা কখনোই কোন অমুসলিমদের হাতে দেয়া উচিত নয়। মুসলিমদের কোন গোপন তথ্য তাদের নিকট প্রকাশ পায় এবং তাদের ক্ষতির কারণ হয়, এ ধরনের কোন কাজে তাদের সম্পৃক্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ, তারা যখন মুসলিমদের গোপনীয় বিষয়গুলো জানতে পারবে এবং তাদের দুর্বলতাগুলো তাদের নিকট প্রকাশ পাবে, তখন তারা মুসলিমদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাবে। এ ধরনের ঘটনা বর্তমান যুগে অহরহ সংঘটিত হচ্ছে এবং যার পরিণতি মুসলিমদের ভোগ করতে হচ্ছে। অমুসলিমরা তাদের দেশের নাগরিকদের মুসলিম দেশসমূহে বিভিন্ন কাজের অজুহাতে প্রেরণ করছে, যাতে তারা মুসলিমদের সাথে মিশে তাদের ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে সৌদি আরব- যেখানে হারা-মাইন শরিফাইন- আছে সেখানে অসংখ্য অমুসলিমদের বিভিন্ন কাজের অজুহাতে পাঠানো হচ্ছে। তাদেরকে সেখানে ড্রাইভার, বাড়ীর পাহারাদার, ঘরের কর্মচারী ইত্যাদি বানানো হচ্ছে। এ ছাড়াও তাদেরকে পরিবারের সাথে অবাধে মেলা-মেশা করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।
ছয়. অমুসলিমদের ক্যালেন্ডার অনুসারে তাদের তারিখ নির্ধারণ করা, বিশেষ করে যে ক্যালেন্ডার অমুসলিমদের নিজস্ব ধর্মীয় ইবাদত-ঐতিহ্য ও পর্বের হিসাব অনুসারে নির্ধারিত। যেমন জিওগ্রেরিয়ান ক্যালেন্ডার (ইংরেজি বা ঈসায়ী ক্যালেন্ডার হিসেবে যা আমাদের কাছে পরিচিত)।
ইংরেজী বর্ষপঞ্জী বস্তুত: ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের স্মরনিকা হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। মূলত: ঈসা আ. এর জন্মদিন পালন খৃষ্টানরা তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে আবিষ্কার করেছে। বাস্তবে এটি ঈসা আ. এর ধর্মের কোন রীতিনীতিতে পড়ে না। সুতরাং এ বর্ষপঞ্জী ব্যবহার খৃষ্টানদের সাথে তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতি ও পর্বে মুসলিমদের অংশ গ্রহনেরই নামান্তর।
অমুসলিমদের বর্ষপঞ্জীর অনুসরণ-অনুকরণ থেকে বিরত থাকার জন্যই মুসলিমদের ইচ্ছা ও তাদের দাবির প্রেক্ষাপটে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর খেলাফত আমলে মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র ইতিহাস ও হিজরি সনের প্রবর্তন করা হয়। তারপর থেকে মুসলিমরা অমুসলিমদের সন গণনা করা হতে বিরত থাকে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরতের বছর থেকে হিজরি সন গণনা করা হয়। এ ঘটনা দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয়, সন গণনার ক্ষেত্রে মুসলিমদের জন্য অমুসলিমদের বিরোধিতা করা ও যে সব বিষয়গুলো তাদের বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত সে সব বিষয়ে তাদের বিরোধিতা করা ওয়াজিব। আল্লাহ আমাদের সহযোগিতা করুন।
সাত. অমুসলিমদের উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা, তাদেরকে তাদের অনুষ্ঠান পালনে সহযোগিতা করা, তাদের অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাদের সম্ভাষণ জানানো, ধন্যবাদ দেয়া ও তাদের অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হওয়া:
এ আয়াতের ﴿وَٱلَّذِينَ لَا يَشۡهَدُونَ ٱلزُّورَ وَإِذَا مَرُّواْ بِٱللَّغۡوِ مَرُّواْ كِرَامٗا ٧٢﴾ [سورة الفرقان:72]. তাফসীরে বলা হয়ে থাকে- রহমানের বান্দাদের গুণ হল, তারা কাফের, মুশরিকদের অনুষ্ঠান ও উৎসবে হাজির হয় না।
আট. অমুসলিমদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস ও বাতিল দ্বীনের প্রতি লক্ষ্য না করে, তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও আচার- আচরণ, তাদের চরিত্র ও ব্যবহারের প্রশংসা ও খুশি প্রকাশ করা এবং তাদের কর্ম দক্ষতা ও নিত্য নতুন আবিষ্কার ও তাদের কর্মে অভিভূত হওয়া।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের বিষয়ে বলেন,
﴿وَلَا تَمُدَّنَّ عَيۡنَيۡكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعۡنَا بِهِۦٓ أَزۡوَٰجٗا مِّنۡهُمۡ زَهۡرَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا لِنَفۡتِنَهُمۡ فِيهِۚ وَرِزۡقُ رَبِّكَ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰ﴾ [سورة طه :131 ].
“আর তুমি কখনো প্রসারিত করো না তোমার দু’চোখ সে সবের প্রতি, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের জাঁক-জমকস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি। যাতে আমি সে বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমার রবের প্রদত্ত রিযক সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিকতর স্থায়ী”[16]। [সূরা ত্বাহা. আয়াত: ১৩১]
আয়াতের অর্থ এ নয়, মুসলিমরা দুনিয়ার বিষয়ে কোন প্রকার মাথা ঘামাবে না এবং জাগতিক বা দুনিয়াবি কোন শক্তি সামর্থ্য তারা অর্জন করবে না, বা তারা বিভিন্ন ধরনের আবিষ্কার ও কারিগরি শিক্ষা অর্জন বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে না এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামরিক শক্তি অর্জন করা হতে বিরত থাকবে। বরং মুসলিমরা এ ধরনের কাজগুলো অবশ্যই উদ্দেশ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ ﴾ [سورة الأنفال60].
“আর তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত কর”। [সূরা আনফাল, আয়াত: ৬০]
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ সব উপকরণ ও বর্তমান দুনিয়ার নব্য আবিষ্কারগুলোর ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবদানই বেশি। তাদের এ অবদানের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ বিষয়ে কুরআনে করীমে এরশাদ করে বলেন,
﴿قُلۡ مَنۡ حَرَّمَ زِينَةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِيٓ أَخۡرَجَ لِعِبَادِهِۦ وَٱلطَّيِّبَٰتِ مِنَ ٱلرِّزۡقِۚ قُلۡ هِيَ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا خَالِصَةٗ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ٣٢ ﴾ [سورة الأعراف:32].
“বল, ‘কে হারাম করেছে আল্লাহর সৌন্দর্য উপকরণ, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র রিয্ক’? বল, ‘তা দুনিয়ার জীবনে মুমিনদের জন্য, বিশেষভাবে কিয়ামত দিবসে’। এভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি এমন কওমের জন্য, যারা জানে”। [সূরা আরাফ. আয়াত: ৩২][17]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿وَسَخَّرَ لَكُم مَّا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا مِّنۡهُۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ١٣﴾ [سورة الجاثية:13].
“আর যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু রয়েছে জমিনে, তার সবই তিনি তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। চিন্তাশীল কওমের জন্য নিশ্চয় এতে নিদর্শনা-বলী রয়েছে”[18]। [সূরা আল-জাসিয়া. আয়াত: ১৩]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا﴾ [سورة البقرة:29].
“তিনিই জমিনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন”। [সূরা বাকারাহ, আয়াত: ২৯]
সুতরাং মুসলিমদের উপর কর্তব্য হবে এ সমস্ত উপকারী বিষয় ও শক্তিসমূহের প্রতি সর্বাগ্রে মনোযোগী হবে। তারা নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অমুসলিমদের তুলনায় অগ্রগামী থাকবে। অমুসলিমরা যাতে এ ধরনের কাজের কোন সুযোগ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। আর মুসলিমরা যাতে তাদের মুখাপেক্ষী না হতে হয়, সে বিষেয়ে সতর্ক থাকবে। বরং যাবতীয় কারখানা ও কারিগরী জ্ঞান মুসলিমদেরই থাকবে।
নয়. অমুসলিমদের নামে মুসলিম বাচ্চাদের নাম রাখা:
বিজাতিদের অনুকরণ করতে করতে আমাদের অবনতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, আমরা এখন আমাদের বাচ্চাদের নামও অমুসলিমদের নামের সাথে মিলিয়ে রাখি। অথচ মুসলিম মনীষীদের অনেক সুন্দর সুন্দর নাম আছে, যা আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য বাচাই করতে পারি। কিন্তু তা আমরা করি না। বর্তমানে অনেক মুসলিমকে দেখা যায়, তারা তাদের নিজেদের বাচ্চাদের নাম অমুসলিমদের নামের সাথে মিলিয়ে রাখে। মুসলিম মনীষীদের সাথে তাদের বাচ্চাদের নাম মিলিয়ে রাখা হতে তারা বিরত থাকে। তারা তাদের নিজেদের বাপ-দাদা ও পূর্ব-পুরুষদের যে সব সুন্দর নাম আছে, বা মুসলিমদের যে সব পরিচিত নাম আছে সেগুলো দ্বারা তাদের বাচ্চাদের নাম করণ হতে বিরত থাকে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« خَيْرُ الْأَسْمَاءِ عَبْدُ اللَّهِ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ »
মুসলিমদের নামের মধ্যে বিকৃতির কারণে দেখা যায়, বর্তমানে একটি প্রজন্ম এমন তৈরি হয়েছে, যারা পশ্চিমাদের নামে তাদের নিজেদের বাচ্চাদের নাম রাখা আরম্ভ করছে। এ কারণে বর্তমান প্রজন্ম ও অতীত প্রজন্মের সাথে একটি ফাটল তৈরী হয়েছে। আগের মানুষদের নাম দ্বারাই জানা যেত যে, এরা মুসলিম। তাদের নামের একটি ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে নাম শুনলে বোঝা যায় না, তারা মুসলিম নাকি অমুসলিম।
দশ. অমুসলিমদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রার্থনা করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অমুসলিমদের জন্য দো‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করাকে হারাম করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ١١٣﴾ [ سورة التوبة: 113].
“নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা আত্মীয় হয়। তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে, নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী”। [সূরা তাওবা, আয়াত: ১১৩]
আয়াত দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয়, কাফির, মুশরিক ও বেঈমানরা অবশ্যই চির জাহান্নামী। তারা কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যখন কোন মানুষের নিকট এ কথা স্পষ্ট হয়, লোকটি কাফের বা মুশরিক তখন তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং তার দো‘আ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদিও সে তার নিকটাত্মীয় বা মাতা-পিতা হোক। কারণ, তাদের জন্য দো‘আ করা বা ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, মুসলিমরা তাদের মহব্বত করে এবং তারা যে ভ্রান্ত ও বাতিল দ্বীনের উপর আছে তা সঠিক। অন্যথায় তাদের জন্য কেন ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং দো‘আ করবে?।
দ্বিতীয়ত: মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন
এক. কাফের দেশ ছেড়ে মুসলিম দেশে হিজরত করা:
হিজরত হল, দ্বীনকে রক্ষার তাগিদে কাফের দেশ থেকে মুসলিম দেশে চলে আসা।
এখানে হিজরতের যে অর্থ ও উদ্দেশ্য আলোচনা করা হয়েছে, সে অর্থ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হিজরত করা প্রতিটি মুসলিমের উপর ওয়াজিব এবং এ অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী হিজরত করার বিধান কিয়ামত পর্যন্ত বাকী থাকবে। যারা হিজরত করতে সক্ষম তারপরও মুশরিকদের মাঝে অবস্থান করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। তবে যদি এমন হয় যে হিজরত করতে সক্ষম নয়, বা সেখানে অবস্থানের পিছনে কোন দীনি উদ্দেশ্য থাকে যেমন- আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া, ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য কাজ করা ইত্যাদি তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَفَّىٰهُمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ ظَالِمِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَالُواْ فِيمَ كُنتُمۡۖ قَالُواْ كُنَّا مُسۡتَضۡعَفِينَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ قَالُوٓاْ أَلَمۡ تَكُنۡ أَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٗ فَتُهَاجِرُواْ فِيهَاۚ فَأُوْلَٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ٩٧ إِلَّا ٱلۡمُسۡتَضۡعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلۡوِلۡدَٰنِ لَا يَسۡتَطِيعُونَ حِيلَةٗ وَلَا يَهۡتَدُونَ سَبِيلٗا ٩٨ فَأُوْلَٰٓئِكَ عَسَى ٱللَّهُ أَن يَعۡفُوَ عَنۡهُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَفُوًّا غَفُورٗا ٩٩﴾ ] سورة النساء:97-98].
“নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা জমিনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তন স্থল। তবে যে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন রাস্তা খুঁজে পায় না। অতঃপর আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মার্জনা-কারী, ক্ষমাশীল”[20]। [সূরা নিসা, আয়াত: ৯৭, ৯৮]
দুই. মুসলিমদের সাহায্য করা এবং জান, মাল ও জবান দ্বারা তাদের দীনি ও দুনিয়াবি বিষয়ে সহযোগিতা করা[21]:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖ﴾ [سورة التوبة: 71]
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু”। [সূরা তাওবা, আয়াত: ৭১]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ﴾ [سورة الأنفال :72]
“আর যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এমন কওমের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের একে অপরের চুক্তি রয়েছে”। [সূরা আনফাল, আয়াত: ৭২]
তিন. ঈমানদার ব্যথায় ব্যথিত হওয়া এবং তাদের সুখে খুশি হওয়া[22]:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بالْحُمَّى والسَّهَرِ »
“মুমিনদের দৃষ্টান্ত পরস্পর মহব্বত, দয়া ও সহানুভূতির দিক দিক দিয়ে, একই দেহের মত, তার দেহের একটি অঙ্গ যদি আক্রান্ত হয়, তখন তার সারা শরীর আক্রান্ত হয়। সে সারা শরীরে জ্বর অনুভব করে এবং অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়”[23]।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضاً وَشَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ »
“মুমিনরা মুমিনের জন্য একটি দেয়ালের মত; তার এক অংশ অপর অংশকে শক্তি জোগান দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা কলে উভয় হাতের আঙ্গুলগুলোকে একত্র করে দেখান”।
চার. ঈমানদারদের হিতাকাঙ্খি হওয়া, তাদের কল্যাণকামী হওয়া, তাদের সাথে কোন প্রকার প্রতারণা না করা এবং তাদের কোন প্রকার ধোঁকা না দেওয়া:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ».
“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার নিজের জন্য যা পছন্দ কর তা তোমার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ কর”[24]। [বুখারি কিতাবুল মাযালিম: পরিচ্ছেদ: মজলুমকে সাহায্য করা বিষয়ে আলোচনা।]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَحْقِرُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ ولايُسْلِمُهُ ، بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنْ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ »
“একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই স্বরূপ। মুসলিম হিসেবে সে তার অপর ভাইকে অপমান করতে পারে না, তিরস্কার করতে পারে না এবং তাকে দুশমনের হাতে সোপর্দ করতে পারে না। একজন মানুষ খারাপ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট, সে তার মুসলিম ভাইকে অপমান করে। আর প্রতিটি মুসলিমের জন্য তার অপর মুসলিম ভাইয়ের জান, মাল ও ইজ্জত-সম্মান হরণ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে”[25]।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«لا تَبَاغَضُوا وَلا تَدَابَرُوا وَلا تَنَاجَشُوا ولايَبعْ بَعضُكُمْ عَلى بَيعِ بعضٍ وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إخوانَاً ».
“তোমরা একে অপরকে ঘৃণা করো না, দালালি করো না, তোমাদের কেউ অন্য কারো কেনা-বেচার উপর কেনা-বেচা করবে না। আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও”[26]।[27]
পাঁচ. মুসলিম ভাইদের ইজ্জত ও সম্মান করা, তাদের কোন প্রকার খাটো না করা[28] এবং তাদের কোন দোষ-ত্রুটি প্রকাশ না করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَسۡخَرۡ قَوۡمٞ مِّن قَوۡمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُواْ خَيۡرٗا مِّنۡهُمۡ وَلَا نِسَآءٞ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهُنَّۖ وَلَا تَلۡمِزُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَلَا تَنَابَزُواْ بِٱلۡأَلۡقَٰبِۖ بِئۡسَ ٱلِٱسۡمُ ٱلۡفُسُوقُ بَعۡدَ ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن لَّمۡ يَتُبۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ١١ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱجۡتَنِبُواْ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعۡضَ ٱلظَّنِّ إِثۡمٞۖ وَ لَا تَجَسَّسُواْ وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٞ رَّحِيمٞ ١٢﴾ [سورة الحجرات : 11-12].
“হে ঈমান-দারগণ, কোন সম্প্রদায় যেন অপর কোন সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপ কারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোন নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপ কারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতনা নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো যালিম। হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোস্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুল কারী, অসীম দয়ালু”[29]। [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১১-১২]
ছয়. বিপদ-আপদ, সুখে-দুঃখে মুমিনদের সাথে থাকা:
মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের পরিচয় হল, সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ ও মসিবতের সময় মুমিনদের সাথে থাকা। তাদের কোনো বিপদে এগিয়ে আসা। কিন্তু যারা মুনাফেক তারা মুমিনদের অবস্থা যখন ভালো দেখে, তখন তাদের সাথে থাকে। আর যখন দেখে মুমিনদের উপর কোন বিপর্যয় বা বিপদ নেমে আসছে, তখন তারা তাদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুনাফেকদের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمۡ فَإِن كَانَ لَكُمۡ فَتۡحٞ مِّنَ ٱللَّهِ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَكُن مَّعَكُمۡ وَإِن كَانَ لِلۡكَٰفِرِينَ نَصِيبٞ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَسۡتَحۡوِذۡ عَلَيۡكُمۡ وَنَمۡنَعۡكُم مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ وَلَن يَجۡعَلَ ٱللَّهُ لِلۡكَٰفِرِينَ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ سَبِيلًا ١٤١﴾ [سورة النساء :141].
“যারা তোমাদের ব্যাপারে [অকল্যাণের] অপেক্ষায় থাকে, অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি তোমাদের বিজয় হয় তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না’? আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করিনি এবং মুমিনদের কবল থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করিনি’? সুতরাং, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার করবেন। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কখনো মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদের জন্য পথ রাখবেন না”। [সূরা, আয়াত: ১৪১]
সাত. মুমিনদের সাথে সাক্ষাত করা, তাদের সাক্ষাতকে পছন্দ করা এবং তাদের সাথে মিলে-মিশে থাকা [30]:
হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
« وَجَبَتْ مَحَبَّتِي للْمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ ».
“আমার উপর ঐ সব লোকদের জন্য মহব্বত করা ওয়াজিব, যারা একমাত্র আমি আল্লাহর মহব্বতের কারণে পরস্পর পরস্পরকে দেখতে যায়”[31]।
যে ব্যক্তি তার কোন মুমিন ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত করে, তাকেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহব্বত করেন। অপর এক হাদিসে বর্ণিত,
«أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخاً لَهُ فِي اللهِ فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكاً فسأله أَيْنَ تُرِيدُ ؟ قَالَ: أزورُ أَخاً لِي فِي اللهِ، قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ: لَا ، غَيْرَ أَنِّي أَحْبَبْتُهُ فِي اللَّهِ قَالَ: فَإِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ »
“এক ব্যক্তি তার একজন ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তার চলার পথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একজন ফেরেশতাকে পাঠান। ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যান? জওয়াবে সে বলল, আমি আমার একজন দীনি ভাইকে দেখতে যাই। ফেরেশতা বলল, তার উপর তোমার কোন অনুদান আছে কিনা যা তুমি ভোগ কর? বলল না। আমি তাকে একমাত্র আল্লাহর জন্য মহব্বত করি। তখন ফেরেশতা তাকে ডেকে বলল, আমি তোমার নিকট আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে বিশেষ দূত হিসেবে সু-সংবাদ দিতে এসেছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাকে মহব্বত করে, যেমনটি তুমি তোমার ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত কর[32]।
আট. মুমিনদের অধিকারের প্রতি সম্মান পদর্শন করা:
মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন হল, তাদের হক ও অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এবং তাদের অধিকারের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করা[33]। সুতরাং কোনো মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করবে না, তাদের দরাদরির উপর দরাদরি করবে না, তাদের বিবাহের প্রস্তাবের উপর নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিবে না, তারা মুবাহ বা জায়েয যে সব কাজে রত হয়েছে সে সব কাজে তাদের উপর নিজেকে প্রাধান্য দিবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ألالايَبعْ الرَّجُلُ عَلَى بَيْعِ أَخِيهِ وَلَا يَخْطُبُ عَلَى خِطبَتِهِ »
“সাবধান! কেউ যেন তার ভাইয়ের বিক্রির উপর বিক্রি না করে, আর কারো প্রস্তাবের উপর কোন প্রস্তাব না দেয়”[34]। অপর বর্ণনায় এসেছে,
« ولايَسُمْ على سَوْمِهِ »
নয়. দুর্বল মুমিনদের প্রতি দয়াবান হওয়া:
যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يُوَقِّرْ كَبِيرَنَا وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا »
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
« هل تُنْصَرُونَ وتُرْزَقُونَ إلابِضُعَفَائِكُمْ »
“তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, অকর্মা ও অসহায়, তাদের বরকতেই তোমাদের রিজিক দেয়া হয় এবং সহযোগিতা করা হয়[37]। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا﴾ [سورة الكهف:28]
“আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে। তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ২৮]
দশ. মুমিনদের জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ﴾ [سورة محمد: 19].
“আর তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য।”।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ ﴾ [سورة الحشر: 10].
“হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন”।
সতর্কতা
এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিম্নবর্ণিত বাণীটি নিয়ে একটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়ে থাকে, তার ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মতামত ও আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হল।
﴿لَّا يَنۡهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ وَلَمۡ يُخۡرِجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ أَن تَبَرُّوهُمۡ وَتُقۡسِطُوٓاْ إِلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ ٨﴾ [سورة الممتحنة:8].
“দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় পরায়ণদেরকে ভালবাসেন”। [সূরা আল-মুমতাহানা, আয়াত: ৮]
আয়াতের অর্থ হল, যে সব কাফেররা মুমিনদের কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাথী হয়ে যুদ্ধ করে না এবং মুসলিমদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি হতে বের করে দেয় না, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। মুসলিমরা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে দুনিয়াবি যে সব মুয়ামালা বা লেনদেন আছে তাতে তারা তাদের সাথে ইনসাফ ভিত্তিক আচরণ করবে, তাদের সাথে কোন প্রকার অনৈতিক আচরণ করবে না। কিন্তু তাদের অন্তর দিয়ে মহব্বত করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এখানে ( أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ) “তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে” বলেছেন, এ কথা বলেননি ‘তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে এবং মহব্বত করবে’।
একই কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফের মাতা-পিতা সম্পর্কেও বলেন,
﴿وَإِن جَٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشۡرِكَ بِي مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٞ فَلَا تُطِعۡهُمَاۖ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا مَعۡرُوفٗاۖ وَٱتَّبِعۡ سَبِيلَ مَنۡ أَنَابَ إِلَيَّۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ١٥﴾ [سورة لقمان:15].
“আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শির্ক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে। আর অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৫]
«وقد جاءَتْ أُمُ أَسْمَاءَ إليها تطلُبُ صِلَتَها وهيَ كافِرةٌ فَاستَأذَنتْ أسماءُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم في ذلك فَقَالَ لها: صِلِي أُمَّكِ »
হাদিসে বর্ণিত, আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মাতা কাফের অবস্থায় তার নিকট এসে সহযোগিতা চাইল এবং সহানুভূতি কামনা করল। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে সহযোগিতা করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অনুমতি চাইলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সহযোগিতা করার অনুমতি দেন এবং তিনি তাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি তোমার মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার কর[38] অপর এক আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ﴾ [ سورة المجادلة:22].
“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র--- হয় তবুও।” [সূরা মুজাদালাহ্, আয়াত: ২২]
মোটকথা, অমুসলিম, কাফের ও মুশরিকদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও দুনিয়াবি কোন লেন-দেনে তাদের সাথে ভালো ও উত্তম ব্যবহার করা আর তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদেরকে অন্তর থেকে মহব্বত করা, দুটি জিনিস এক নয়, দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। তাদের মহব্বত করা এক বিষয় আর দুনিয়াবি মুয়ামেলা করা ভিন্ন বিষয়।
কারণ, অমুসলিমদের সাথে ইনসাফ ভিত্তিক আচরণ করা তাদেরকে পরোক্ষভাবে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেয়া হয়ে যায়। তাদের সাথে ভালো লেন-দেন করা এবং আত্মীয়তা বজায় রাখার ফলে তাদের মধ্যে ইসলামের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বেড়ে যায়[39]। কিন্তু তাদের অন্তর থেকে মহব্বত করা এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা দ্বারা তাদের কুফরের প্রতি সন্তুষ্টি ও স্বীকৃতি বুঝায়। আর এটি কারণ হয় তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত না দেয়ার।
এখানে আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, তা হল, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা হারাম হওয়ার অর্থ এ নয়, কাফেরদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি কেনা-বেচা ইত্যাদি সবই নিষিদ্ধ। তাদের আবিষ্কৃত কোন বস্তু দ্বারা আমরা কোন উপকার হাসিল করতে পারব না এবং তাদের অভিজ্ঞতা ও টেকনোলজিকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে কোন কাজে লাগাতে পারব না এমনটিও নয়। বরং তাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, দুনিয়াবি কোন লেন-দেন ইত্যাদিতে কোন অসুবিধা নাই। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কাফেরদের সাথে লেন-দেন করেছেন। অমুসলিমদের থেকে তিনি ঋণ গ্রহণ করেছেন, বেচা-কেনা করেছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম [আব্দুল্লাহ্] ইব্ন উরাইকিত আল-লাইসী নামক একজন কাফেরকে টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেন, যাতে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাস্তা দেখায়। অনুরূপভাবে একজন ইয়াহূদী থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। সুতরাং এ সব হাদিস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, অমুসলিমদের সাথে দুনিয়াবি লেন-দেন করাতে কোন অসুবিধা নাই। মুসলিমদের সাথে যেভাবে লেন-দেন করা হয়, অনুরূপভাবে অমুসলিমদের সাথেও একইভাবে লেন-দেন করতে হবে। মুসলিমরা এ যাবত কাল পর্যন্ত কাফেরদের থেকে মালামাল ক্রয় করে আসছে, অমুসলিম দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র-পাতি আমদানি করছে, এগুলো সবই হল, তাদের থেকে টাকার বিনিময়ে কোন কিছু ক্রয় করা। এতে তারা আমাদের উপর কোন প্রকার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে না এবং এর কারণে তারা আমাদের উপর কোন প্রকার ফযিলত লাভ করতে পারবে না। অমুসলিমদের সাথে এ ধরনের লেন-দেন করা, তাদের মহব্বত করা বা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার প্রমাণ বা কারণ নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের মহব্বত করা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে ওয়াজিব করেছেন, পক্ষান্তরে কাফেরদের ঘৃণা করা তাদের বিরোধিতা করাকেও ওয়াজিব করেছেন। [কিন্তু তাদের সাথে লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দুনিয়াবি কোন মুয়ামালাকে হারাম বা নিষেধ করেন নি।] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ ءَاوَواْ وَّنَصَرُوٓاْ أُوْلَٰٓئِكَ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يُهَاجِرُواْ مَا لَكُم مِّن وَلَٰيَتِهِم مِّن شَيۡءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُواْۚ وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٧٢ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٍۚ إِلَّا تَفۡعَلُوهُ تَكُن فِتۡنَةٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَفَسَادٞ كَبِيرٞ ٧٣﴾ [سورة الأنفال:73].
“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং নিজদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে আর যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সহায়তা করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু হিজরত করেনি, তাদেরকে সাহায্যের কোন দায়িত্ব তোমাদের নেই, যতক্ষণ না তারা হিজরত করে। আর যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এমন কওমের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের একে অপরের চুক্তি রয়েছে এবং তোমরা যে আমল কর, তার ব্যাপারে আল্লাহ পূর্ণ দৃষ্টিমান। আর যারা কুফরি করে, তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে জমিনে ফিতনা ও বড় ফ্যাসাদ হবে”। [সূরা আনফাল, আয়াত: ৭২,৭৩]
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বাণী- ﴿إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ﴾ “যদি তোমরা মুশরিকদের থেকে আলাদা না থাক এবং মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব না কর, তখন মানুষের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি হবে”। আর তা হল, বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি হবে, [সমাজের নিয়ম কানুন ঠিক থাকবে না], মুমিনরা কাফেরদের সাথে মিশে যাবে। ফলে মুমিনদের স্বকীয়তা বজায় থাকবে না। তখন সমাজে অনেক ফিতনা ফ্যাসাদ দেখা দেবে, সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে---”। বর্তমানে সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আল্লাহ আমাদের সহযোগিতা করুক।
বন্ধুত্ব ও দুশমনির বিবেচনায় মানুষের প্রকারভেদ
বন্ধুত্ব ও শত্রুতার বিবেচনায় মানুষ তিন প্রকার:
প্রথম প্রকার: [যাদেরকে খালেসভাবে ভালোবাসতে হবে]
ঐ সব ঈমানদার যাদেরকে অন্তরের অন্তঃস্থল হতে মহব্বত করতে হবে এবং খালেস মহব্বত করতে হবে। তাদের প্রতি কোনো প্রকার দুশমনি করা যাবে না এবং ঘৃণা করা যাবে না।
তারা হচ্ছে, খালেস মুমিন, যাদের ঈমানের মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি নাই। প্রকৃত পক্ষে এরা হল, নবী, রাসূল, সিদ্দিকীন, সালে-হীন ও শহীদগণ।
এদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সবোর্চ্চ স্থানের অধিকারী হলেন, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাকে দুনিয়ার সব মানুষ থেকে অধিক মহব্বত করতে হবে। এমনকি মাতা-পিতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও দুনিয়ার সব মানুষ থেকে বেশি মহব্বত করতে হবে[40]। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর সর্বাধিক বেশি মহব্বত করতে হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রীগণ যারা মুমিনদের মাতা। তারপর তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবী তথা সাথী-সঙ্গীদের বেশি মহব্বত করতে হবে। বিশেষ করে, খুলাফায়ে রাশেদীন এবং দশ জনের বাকী সাহাবীগণের প্রতি, যাদের দুনিয়াতে জান্নাতের সু-সংবাদ দেয়া হয়েছে। আরও ভালোবাসতে হবে, অপরাপর মুহাজির ও আনছারগণকে। তারপর যারা বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং বাইয়াতে রেদওয়ানে শরিক হন, তারপর বাকী সাহাবীগণের মহব্বত অন্তরে থাকতে হবে।
সাহাবীদের পর মুমিনদের অন্তরে তাবে‘য়ীদের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা থাকতে হবে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে যুগকে উত্তম যুগ বলে আখ্যায়িত করেন, তাদের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। আর এ উম্মতের সালাফে সালে-হীন ও চার ইমামের প্রতি মহব্বত থাকতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [سورة الحشر :10].
“যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু”। [সূরা হাশর, আয়াত: ১০]
যার অন্তরে সামান্য পরিমাণ ঈমান আছে, সে কখনোই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী ও উম্মতের সালাফদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী ও তার উম্মতের মহা মনিষীদের প্রতি তারাই বিদ্বেষ পোষণ করতে পারে, যারা মুনাফেক ও যাদের অন্তরে কপটতা আছে[41]। যেমন, শিয়া-রাফেযী সম্প্রদায়, খারেজী সম্প্রদায় ইত্যাদি। আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের হেফাজত করেন।
দ্বিতীয় প্রকার: যাদের সাথে খালেস দুশমনি ও শত্রুতা করতে হবে
দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক খাটি কাফের, মুনাফেক, মুশরিক, নাস্তিক, মুরতাদ ও অনুরূপ লোক, যাদের সাথে দুশমনি করার কোন বিকল্প নাই[42]। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করে বলেন,
﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ ﴾ [سورة المجادلة :22 ].
“যারা আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। [সুরা মুজাদালাহ্, আয়াত: ২২]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বনী ইসরাইলদের বিভিন্ন অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿ تَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنۡهُمۡ يَتَوَلَّوۡنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْۚ لَبِئۡسَ مَا قَدَّمَتۡ لَهُمۡ أَنفُسُهُمۡ أَن سَخِطَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡ وَفِي ٱلۡعَذَابِ هُمۡ خَٰلِدُونَ ٨٠ وَلَوۡ كَانُواْ يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلنَّبِيِّ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيۡهِ مَا ٱتَّخَذُوهُمۡ أَوۡلِيَآءَ وَلَٰكِنَّ كَثِيرٗا مِّنۡهُمۡ فَٰسِقُونَ ٨١﴾ [سورة المائدة :79-80].
“তাদের মধ্যে অনেককে তুমি দেখতে পাবে, যারা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা যা নিজদের জন্য পেশ করেছে, তা কত মন্দ যে, আল্লাহ তাদের উপর ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা আযাবেই স্থায়ী হবে। আর যদি তারা আল্লাহ ও নবীর প্রতি এবং যা তার নিকট নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকে ফাসিক”। [সূরা আল-মায়েদাহ্, আয়াত: ৭৯-৮০]
তৃতীয় শ্রেণীর লোক:
এ প্রকারের লোককে একদিক বিবেচনায় মহব্বত করা হবে এবং অপর দিক বিবেচনায় তাদের ঘৃণা করা হবে। তাদের মধ্যে মহব্বত ও ঘৃণা বা দুশমনি দুটিই একত্র হবে। এ প্রকারের লোক, গুনাহগার মুমিনরা। যারা ঈমানের সাথে গুনাহের কাজে জড়িত। তাদের মধ্যে ঈমান থাকার কারণে তাদের মহব্বত করা হবে আর গুনাহগার বা অপরাধী হওয়ার কারণে তাদের ঘৃণা করা হবে[43]। তবে তাদের গুনাহ শির্কের নিচে হতে হবে, যদি তাদের গুনাহ শির্কের পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তাদের বিধান কাফের ও মুশরিকদের বিধানেরই মত।
মুমিনদের মহব্বত করার দাবি হল, তাদের জন্য কল্যাণকামী ও তাদের হিতাকাংখী হতে হবে। মুমিনদেরকে সব সময় সৎ পথে চলা ও ভালো কাজ করার প্রতি উৎসাহ দিতে হবে, যাতে তারা কোন প্রকার অন্যায় ও অশ্লীল কাজের প্রতি ঝুঁকে না পড়ে। আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে হবে এবং তাদের অন্যায় অপরাধের প্রতিবাদ করতে হবে। কোন মুমিন থেকে কোন অন্যায় সংঘটিত হতে দেখলে, তার উপর চুপ থাকা যাবে না। বরং তাদের গুনাহের বিরোধিতা করতে হবে এবং তাদেরকে গুনাহ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। মুমিনরা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ হতে ফিরিয়ে রাখবে। আর তারা যাতে অন্যায়, অশ্লীল ও অসামাজিক কাজ হতে বিরত থাকে, সে জন্য তাদের সতর্ক করবে। মুমিনরা যদি কোন অন্যায় করে ফেলে, তখন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করবে, যাতে তারা অন্যায় হতে বিরত থাকে এবং গুনাহ হতে আল্লাহর দরবারে তওবা করে।
গুনাহগার মুমিন বা অপরাধী মুমিনদেরকে কাফের মুশরিকদের মত পরিপূর্ণ ঘৃণা করবে না এবং তাদের সাথে কাফের মুশরিকদের মত এমন খালেস দুশমনি ও শত্রুতা দেখাবে না যে তাদের সাথে সম্পর্কত্যাগ করে থাকবে। যেমন খারেজিরা শির্কের নিম্ন পর্যায়ের কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে থাকে।
তবে কবিরা গুনাহে লিপ্ত লোকদের খালেস মহব্বত ও বন্ধুত্ব করা যাবে না, যেমনটি করে থাকে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা[44]; বরং তাদের [অপরাধী মুমিনদের] বিষয়ে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আর এটিই হল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মাযহাব[45]।
আর আল্লাহর জন্য মহব্বত এবং আল্লাহর জন্য দুশমনি করা ঈমানের মজবুত রশি। আর হাদিসে বর্ণিত আছে, কিয়ামতের দিন মানুষ তার সাথে থাকবে, যাকে সে মহব্বত করে।[46]
বর্তমান যুগে মানুষের অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বর্তমানে মানুষের অধিকাংশ মহব্বত ও বন্ধুত্ব দুনিয়ার কারণেই হয়ে থাকে। যখন কোন মানুষের নিকট দুনিয়ার ধন-সম্পদ থাকে, তার হাতে ক্ষমতা থাকে বা তার শক্তি থাকে, তখন মানুষ তাকে মহব্বত করতে থাকে এবং তার সাথে বন্ধুত্ব করে, যদিও সে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং দ্বীন ইসলামের অনেক বড় দুশমন[47]। আর যখন কারো নিকট দুনিয়ার ধন সম্পদ না থাকে তখন সে যত বড় আল্লাহর অলি বা আল্লাহর রাসূলের অনুসারী হোক না কেন, তাকে কেউ মহব্বত করে না এবং তার সাথে বন্ধুত্ব করে না। কারণ, তার দ্বারা তার পার্থিব স্বার্থ হাসিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ফলে তাকে পদে পদে অপমান করে এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করে, যখন তখন তাকে অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করে[48]। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
«مَنْ أَحَبَ فِي اللهِ وأبغضَ في اللهِ ووالى في اللهِ وعادى في اللهِ فإنما تُنالُ وَلايةُ اللهِ بذلك ، وقدْ صارتْ عامةُ مُؤاخاةُ الناسِ على أمرِ الدُنيا وذلك لا يُجدي على أهلِهِ شَيئاً » رواه ابن جرير
“যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মহব্বত করে এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আর আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব করে এবং আল্লাহর জন্য দুশমনি করে, অবশ্যই এর মাধ্যমে সে আল্লাহর সান্নিধ্য ও বন্ধুত্ব লাভ করবে। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের বন্ধুত্বের ভিত হল, দুনিয়ার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। এ কারণেই এ ধরনের বন্ধুত্ব দ্বারা তারা কিছুই লাভ করতে পারে না”। [ইবনে জারির]
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
« مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ » الحديث رواه البخاري .
“যে ব্যক্তি আমার কোন অলি বা বন্ধুর বিরোধিতা করে এবং তার সাথে দুশমনি রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম”।[49]
মানুষের মধ্য হতে আল্লাহর সবচেয়ে বিরুদ্ধবাদী বা বিরোধী ব্যক্তি হল, যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণের সাথে দুশমনি করে, তাদের সমালোচনা করে এবং তাদেরকে খাটো বা হেয় প্রতিপন্ন করে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করে বলেন,
«اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضاً ، فمَنْ آذَاهُمْ فَقَدْ آذَانِي وَمَنْ آذَانِي فَقَدْ آذَى اللَّهَ وَمَنْ آذَى اللَّهَ يُوشِكُ أَنْ يَأْخُذَهُ » . أخرجه الترمذيُ وغيرُه
আল্লাহর দোহাই, আল্লাহর দোহাই, তোমরা আমার সাহাবীদের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন কর। তোমরা আমার সাহাবীদেরকে তোমাদের সমালোচনা ও বিতর্কের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করো না। যারা তাদের কষ্ট দেয়, তারা আমাকেই কষ্ট দিল, আর যে ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দেয়, সে আল্লাহকে কষ্ট দিল, আর যে আল্লাহকে কষ্ট দেয়, তাকে অবশ্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাকড়াও করবে[50]। [তিরমিযি ও অন্যান্য হাদিসের কিতাবসমূহ]
কোন কোন ভ্রষ্ট-গোমরাহ ফের্কা ও দল এমন আছে, তারা মনে করে সাহাবীগণকে গালি দেয়া, তাদের বিরোধিতা করা ও তাদের সমালোচনা করা দ্বীনের একটি অংশ বা দীনি দায়িত্ব। তাই তারা সব সময় তাদের সমালোচনা ও বিরোধিতায় লিপ্ত থাকে এবং মানুষের মধ্যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রাণ প্রিয় সাহাবীদের সমালোচনা করতে থাকে। এর কারণে তাদের অবশ্যই কঠিন আযাবের মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তার কঠিন ও বেদনা দায়ক আযাব ও গজব থেকে হেফাজত করুন এবং আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের ক্ষমা করেন এবং মাফ করেন।
[1] আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ কথা স্পষ্ট করেন, মুশরিকদের সাথে কোন আপোষ নাই। মুসলিমরা কখনোই মুশরিকদের সাথে একত্র হতে পারে না। ইব্রাহীম আ. তার কাওকে জানিয়ে দেন, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যে সব দেব-দেবী ও উপাস্যের উপাসনা কর, তার থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত। আমার সাথে তোমাদের উপাস্যদের কোন সম্পর্ক নাই। ইব্রাহীম আ. তার কওমের মুশরিকদের আরও জানিয়ে দেন, তোমাদের সাথে আমার শত্রুতা কোন ক্ষণিকের জন্য নয়, বরং তা চিরকালের জন্য; যতদিন পর্যন্ত তোমরা আল্লাহর উপর ঈমান আনবে না, ততদিন পর্যন্ত তোমাদের সাথে আমার শত্রুতা বহাল থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইব্রাহীম আ. এর দৃঢ়তাকে কুরআনে তুলে ধরেন এবং তিনি উম্মতে মুসলিমাকে বলেন, তোমাদের জন্য ইব্রাহীম আ. এর মধ্যে রয়েছে, উত্তম আদর্শ। সুতরাং, মনে রাখতে হবে মুসলিমদের জন্য অমুসলিমদের সাথে আপোষহীন হতে হবে, যতদিন পর্যন্ত তারা ঈমান না আনবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের সাথে কোন আপোস নাই। [অনুবাদক]।
[2] ব্যাখ্যা: আয়াতে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে জানিয়ে দিয়ে বলেন, আমি যাদের কিতাব দিয়েছি, অর্থাৎ ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদেরকে কখনোই তোমাদের বন্ধু বানাবে না। কারণ, তারা কখনোই তোমাদেরকে তাদের নিজেদের আপন মনে করে না, তারা সব সময় তোমাদেরকে তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করে। আর তারা সব সময় মুসলিমদের ক্ষতির অনুসন্ধান করে। তারপরও যারা কিতাবিদের সাথে বন্ধুত্ব করবে আল্লাহ তাদের বিষয়ে বলেন, তারা সে সব জাতিরই অন্তর্ভুক্ত হবে, তারা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। [অনুবাদক]।
[3] ব্যখ্যা: আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের কাফেরদের নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অর্থাৎ, তোমরা তাদের কিভাবে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে? তারা তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে যে হেদায়েতের মিশন এসেছে, তা অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করছে এবং তোমাদেরকে কোন প্রকার অপরাধ ছাড়া তোমাদের বাড়ি-ঘর হতে বের করে দিয়েছে, তোমাদের ভিটা-বাড়ি ছাড়া করেছে। সুতরাং, তোমরা তাদেরকে কখনোই বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।
[4] অর্থাৎ যারা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলে বিরোধিতা করে, তারা যদি তোমাদের নিকটাত্মীয়ও হয়ে থাকে; তোমাদের মাতা-পিতাও হয়ে থাকে, তারপরও তাদের সাথে কোন প্রকার বন্ধুত্ব চলে না।
[5] তারা অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে তাদের উদারতা, উগ্রবাদ বিরোধিতা ও অসাম্প্রদায়িকতা বলে চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা উদারপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রমাণ। মনে রাখতে হবে, যে সব মুসলিম এ ধরনের মন-মানসিকতা পোষণ করে তারা কখনোই ঈমানদার হতে পারে না। তারা ইয়াহুদী খৃষ্টানদের দোষর এবং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের দুশমন। আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘাতকের অভাব নাই। [অনুবাদক]।
[6] এ ধরনের কথা শুধু মারাত্মকই নয়, বরং ঈমানের জন্য হুমকি। যারা এ ধরনের কথা বলে, তাদের ঈমান প্রশ্নবিদ্ধ। আল্লাহ আমাদের এ ধরনের কথা-বার্তা থেকে হেফাজত করুক।
[7] একজন ঈমানদারের প্রতি অপর ঈমানদারের ভালোবাসা ও মহব্বত থাকতে হবে এবং তাদের বিপদ-আপদে এগিয়ে আসতে হবে।
[8] ব্যাখ্যা: আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাফেরদের বিপক্ষে তাদের অবস্থানের একটি চিত্র তুলে ধরেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, মুমিনরা পরস্পরের প্রতি অতীব সদয় ও দয়া পরবশ। তারা তাদের ছোটদের স্নেহ করে বড়দের সম্মান করে। তাদের মধ্যে কোন প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ নাই। কিন্তু দুশমনদের বিরুদ্ধে তারা অত্যন্ত কঠিন। তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার আপোষ নাই। দুশমনদের মোকাবেলায় তারা এক। [অনুবাদক]।
[9] মুমিনরা কখনোই অমুসলিমদের অনুকরণ করতে পারে না। তারা সব সময় তাদের নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখবে। নিজেরা মানব জাতির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। তাদের আদর্শের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হবে। তারা কেন বিজাতিদের আদর্শের অনুকরণ করবে? তারা সব সময় বিজাতিদের কৃষ্টি-কালচার ও সংস্কৃতির বিরোধিতা করবে এবং তাদের অন্ধানুকরণ হতে দূরে থাকবে। [অনুবাদক]।
বস্তুত মুসলিমদের জন্য তাদের আলাদা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের ঐতিহ্যকে মানুষ অনুসরণ করবে, এটাই হল চিরন্তন সত্য। তারা কেন বিজাতিদের কালচারের অনুকরণ করবে? কিন্তু বর্তমানে মুসলিমরা তাদের আসল ঐহিত্য ও সংস্কৃতি হতে দূরে সরে যাওয়াতে বিজাতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। তারা নিজেদের চাল-চলন ও ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে বিজাতি ও অমুসলিমদের চাল-চলন ঐতিহ্যে অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ আল্লাহর মুসলিম উম্মতকে বিজাতিদের অনুকরণ করতে নিষেধ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, « صوموا يوم عاشوراء وخالفوا فيه اليهود صوموا يوما قبله ويوما بعده »رواه أحمد وفيه محمد بن أبي ليلى وفيه كلام، ضعفه يحيى بن سعيد তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ! তোমরা ইয়াহূদীদের বিরোধিতা কর। আশুরাদের দিনের আগে একটি রোজা রাখ এবং পরের দিন একটি রোজা রাখ। [বর্ণনায় আহমদ]
عن أبي سعيد الخدري عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : « لتتبعن سنن من كان قبلكم شبرا شبرا وذراعا بذراع حتى لو دخلوا جحر ضب تبعتموهم قلنا يا رسول الله اليهود والنصارى؟ قال: فمن ؟!!»
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, তোমরা তোমাদের পূর্বের উম্মতদের গজ ও ইঞ্চি শুদ্ধ অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি কোন গুই শাপের গর্তে প্রবেশ করে, তোমরাও তাদের অনুকরণে তাতে প্রবেশ করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কি ইয়াহু-দি ও খৃষ্টান? বলল, তারা ছাড়া আর কারা? !!
[11] আমাদের দেশে ধুতি পরিধান হিন্দুদের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং, মুসলিমদের জন্য ধুতি পরিধান করা বৈধ নয়। অনুরূপভাবে হিন্দুরা গরুর গোস্ত খায় না। তাদের অনুকরণ করে গরুর গোস্ত খাওয়া হতে বিরত থাকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হিন্দুরা পানিকে জল বলে, তাদের অনুকরণ করে পানিকে জল বলা হতে বিরত থাকতে হবে। [অনুবাদক]।
[12] কিন্তু হিজরত করতে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য অমুসলিম দেশে বসবাস করার অনুমতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোন মুসলিমকে দেননি। কারণ হিজরতে বিধান অদ্যবধি বাকী আছে। তা বন্ধ হয়নি। রাসূল সা. বলেন,
« لا تنقطع الهجرة حتى تنقطع التوبة ولا تنقطع التوبة حتى تطلع الشمس من مغربها »
“যত দিন পর্যন্ত তাওবার দরজা খোলা থাকবে, ততদিন পর্যন্ত হিজরতের বিধান চালু থাকবে। আর তাওবার দরজা তখন বন্ধ হবে যখন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদয় হয়”। [অনুবাদক]।
[13] উল্লেখিত প্রতিটি কাজ মুসলিমদের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তারা এ সবের মাধ্যমে কাফেরদেরকে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে সুযোগ করে দেয়। আমরা তাদের যত সাহায্য সহযোগিতা করি না কেন, তারা আমাদের কোন উপকারে আসবে না। তারা যখনই সুযোগ পাবে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করবে। তারা সব সময় তাদের অন্তরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে। আর তোমরা যদি তাদের মহব্বত ও ভালো বাস, তারা কিন্তু তোমাদের মহব্বত করবে এবং তোমাদের ভালো বাসবে না। তারা প্রকাশ্যে তোমাদের সাথে মিশবে এবং দেখাবে যে, তারা তোমাদের বন্ধু, কিন্তু গোপনে তারা তোমাদের ক্ষতি করবে এবং তোমাদের বিরোধিতা করবে। [অনুবাদক]।
[14] আয়াতে একটি কথা স্পষ্ট হয়, তা হল কাফের, মুশরিক ও বেঈমানরা কখনোই মুসলিমদের বন্ধু হতে পারে না। তারা সব সময় মুসলিমদের শত্রু। প্রকাশ্যে তারা যদি তোমাদের বন্ধুত্ব দাবিও করে, তাদের কথার উপর আস্থা রাখা কোন মুমিনের কাজ নয়। তাদের প্রতিটি কাজকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। তাদের সেবা, খেদমত, চিকিৎসা ও বাসস্থান বানানো সবকিছু আড়ালে অসৎ উদ্দেশ্য অর্থাৎ ধর্মান্তরিত করা লুকিয়ে আছে। [অনুবাদক]।
[15] মুসলিম শরীফে হাদীসের ইবারতটি এভাবে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রী আয়েশা রা. হতে বর্ণিন তিনি বলেন,
خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قِبَلَ بَدْرٍ فَلَمَّا كَانَ بِحَرَّةِ الْوَبَرَةِ أَدْرَكَهُ رَجُلٌ قَدْ كَانَ يُذْكَرُ مِنْهُ جُرْأَةٌ وَنَجْدَةٌ فَفَرِحَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حِينَ رَأَوْهُ فَلَمَّا أَدْرَكَهُ قَالَ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : جِئْتُ لِأَتَّبِعَكَ وَأُصِيبَ مَعَكَ قَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ قَالَ لَا قَالَ فَارْجِعْ فَلَنْ أَسْتَعِينَ بِمُشْرِكٍ قَالَتْ ثُمَّ مَضَى حَتَّى إِذَا كُنَّا بِالشَّجَرَةِ أَدْرَكَهُ الرَّجُلُ فَقَالَ لَهُ كَمَا قَالَ أَوَّلَ مَرَّةٍ فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم كَمَا قَالَ أَوَّلَ مَرَّةٍ قَالَ فَارْجِعْ فَلَنْ أَسْتَعِينَ بِمُشْرِكٍ قَالَ ثُمَّ رَجَعَ فَأَدْرَكَهُ بِالْبَيْدَاءِ فَقَالَ لَهُ كَمَا قَالَ أَوَّلَ مَرَّةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ قَالَ نَعَمْ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَانْطَلِقْ.
অর্থ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের যুদ্ধে যখন যুদ্ধ করার জন্য বের হন, তখন তিনি যখন ‘হাররাতুল ওবারাহ’ নামক স্থানে পৌছেন, তখন সাহসিকতা ও বাহাদুরীতে প্রসিদ্ধ একে লোক তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য মিলিত হল। তাকে দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীরা খুব খুশি হল। তারপর যখন লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত করল, তখন সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, আমি আপনার অনুসরণ করতে আসছি এবং আপনার সাথে যুদ্ধ করতে আসছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, তুমি আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান আন কি? সে বলল, না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি চলে যাও আমরা কোন মুশরিক হতে সাহায্য গ্রহণ করি না। আয়েশা রা. বললেন, তারপর সে চলে গেল, তারপর যখন আমরা ‘সাজারাহ’ নামক স্থানে পৌছলাম লোকটি আবারো আমাদের সাথে মিলিত হল, তারপর সে এমন কথাই বলল, যা আগে সে বলছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথে সে কথাই বললেন, যা পূর্বে তিনি তাকে বলেছিলেন। অর্থাৎ তুমি চলে যাও আমরা কোন মুশরিক থেকে সহযোগিতা গ্রহণ করব না। তারপর লোকটি চলে যায় এবং বাইদা নামক স্থানে এসে আবার মুসলিমদের সাথে মিলিত হয়। তারপর সে আগে যেভাবে কথা বলছিল ঠিক একই কথা আবার বলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখ? এবার উত্তরে সে বলল, হ্যা। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তাহলে চল তুমি আমাদের সাথে যুদ্ধ কর। হাদিসটি ইমাম তিরমিযি সিয়ার অধ্যায়ে যিম্মিদের মুসলিমদের সাথে জিহাদ করার বিধান আলোচনায় বর্ণনা করেন। আর ইমাম আহমদ রহ. মুসনাদে আনসারের অবশিষ্ট অংশে আলোচনা করেন।
[16] দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী এর কোন স্থায়িত্ব নাই, এ দুনিয়ার সৌন্দর্য, ধন সম্পদ ও মালিকানা এগুলো সবই সাময়িক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এগুলো মানুষকে উপভোগ করা ও উপকৃত হওয়ার জন্য দিয়েছেন। আর যারা আল্লাহর এ সব নিয়ামতসমূহ উপভোগ করবে তাদেরকে অবশ্যই একদিন আল্লাহর নিকট জবাব দিতে হবে; আল্লাহ তাদের পরীক্ষা নিবেন। পরীক্ষা নেয়ার জন্য আল্লাহ দুনিয়াতে এ সব নেয়ামত দিয়েছেন। সুতরাং, এ সব নিয়ামতের বিনিময়ে আখিরাতকে ভুলে গেলে চলবে না। আল্লাহর দরবারে মুমিনদের জন্য যে রিযিক রাখা হয়েছে, তা অতি উত্তম ও স্থায়ী।
[17] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার সৌন্দর্য উপকরণ গ্রহণ করতে নিষেধ করেননি, বরং তিনি বলেছেন এগুলো ঈমানদার লোকদেরই কাজ। তারা মানুষকে উন্নত সেবা দেবে, মানুষকে তারা পবিত্র রিয্ক উপার্জনের পথ দেখাবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জমিনের উপের ও নিচে তার কুদরতের যে সব নিদর্শন, ধন-সম্পত্তি, খনি ও উপকরণ রেখেছে, তা মুমিনরাই মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবে।
[18] আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সবকিছুকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন। মানুষ সবকিছুকে জয় করতে পারে এবং তারা সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, বুদ্ধি ও কৌশল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে দিয়েছেন।
[20] যারা দুর্বল হিজরত করতে সক্ষম নয়, তারা যদি তাদের অপারগতার কারণে হিজরত করতে না পারে, তাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফের মুলুকে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। তবে যখন তারা সামর্থ্য লাভ করবে, তখন তাদের অবশ্যই হিজরত করতে হবে এবং হিজরত করার সৌভাগ্য লাভ করতে হবে। তবে হিজরত করা কোন কাপুরুষতা কিংবা দুশমনের ভয়ে পলায়ন নয়, হিজরত হল, আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ করার লক্ষে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করে কাফেরদের বিপক্ষে শক্তি অর্জন করা ও দ্বীনের উপর অটল অবিচল থাকার উন্নত কৌশল। [অনুবাদক]।
[21] একজন মুমিন তার অপর মুমিন ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসবে, তাদের কল্যাণ কামনা করবে এবং তাদের বিপদে এগিয়ে আসবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের মধ্যে বন্ধুত্ব কায়েম করে দিয়েছেন। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, তাদের ঈমানী বন্ধন অটুট।
[22] একজন ঈমানদার ব্যক্তি তার অপর ঈমানদার ভাইয়ের আনন্দে আনন্দিত হবে। ঈমানদার মুমিনের সফলতাকে তার নিজের সফলতা মনে করবে। পক্ষান্তরে তাদের কোন বিপদকে তার নিজের বিপদ বলে মনে করবে। জান-মাল দিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। মুমিন পৃথিবীর যে প্রান্তে হোক না কেন, সে তার ভাই। তার কোন সমস্যায় আমাকে অবশ্যই অশ্রু জরাতে হবে। তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে।
[23] মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াসসিলা, পরিচ্ছেদ: মুমিনদের প্রতি দয়া করা, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা। মুসনাদে আহমতে ইমাম আহমদ রহ. নুমান ইব্ন বাশির থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন।
[24] তুমি তোমার নিজের জন্য যা অপছন্দ করবে, তোমার অপর ভাইয়ের জন্যও তা অপছন্দ করবে। আর তুমি তোমার নিজের জন্য যা মহব্বত করবে, তুমি তোমার নিজের জন্যও তা মহব্বত করবে। তখনই তুমি সত্যিকার ঈমানদার হতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। আমরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে পারি। কিন্তু আমার অপর ভাইয়ের উপকারের জন্য একটু মাথাও ঘামাতে পারি না।
[25] .বুখারি, কিতাবুল মাজালিম, পরিচ্ছেদ: একজন মুসলিম অপর মুসলিমের উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে দুশমনের হাদে তুলে দেবে না। মুসলিম, কিতাবুল বির ওয়াসসিলা ওয়াল আদাব। পরিচ্ছেদ: মুসলিমের উপর জুলুম অত্যাচার করা হারাম হওয়া বিষয়ে।
[26] বুখারি কিতাবুল আদব। পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তাআলার বাণী: ياأيها الذين آمنوا اجتنبوا كثيراً من الظن মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াস সিলা, পরিচ্ছেদ: খারাপ ধারণা করা, চোগলখোরি করা ও ধোকা দেয়া হারাম হওয়া বিষয়ে আলোচনা। আর তানাযুশ বলা হয়, পণ্যের দাম বেশি হেঁকে বাড়িয়ে দিয়ে অপরকে ধোকায় ফেলা।
[27] ইসলাম এমন এক দ্বীন যা কোন মানুষের ন্যূনতম অধিকার লঙ্ঘন করাকে বরদাশত করে না। উল্লেখিত হাদীসদ্বয় তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এখানে বলা হয়েছে, কারো বেচা-কেনার উপর বেচা-কেনার উপর বেচা-বিক্রি করা যাবে না। কারো অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। শুধু তাই নয়, ইসলামের আদর্শ হল, তোমার নিজের অধিকারের উপর তোমার অপর ভাইয়ের অধিকারকে প্রাধান্য দেবে।
[28] ইসলামের অন্যতম আদর্শ হল, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা হতে বিরত থাকা। কাউকে ছোট মনে করা যাবে না। হতে পারে তুমি যাকে ছোট মনে করছ, সে তোমার থেকে বড়। কারণ, কে বড় আর কে ছোট তা মানুষের নিকট স্পষ্ট নয়, এ তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই জানেন। [অনুবাদক]।
[29] আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ও সামগ্রিক জীবনের কিছু দিক নির্দেশনা তুলে ধরেন। এসব দিক নির্দেশনাগুলো সমাজে অনুপস্থিত থাকার কারণেই বর্তমানে আমরা সামাজিক অবক্ষয় দেখতে পাই। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে এ সব দিক নির্দেশনার কোন বিকল্প নাই। প্রথমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঈমানদারদের সম্বোধন করে এরশাদ করে বলেন, হে ঈমানদারগণ, কোন সম্প্রদায় যেন অপর কোন সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ না করে কাউকে নিকৃষ্ট না করে। হতে পারে তুমি যাকে ছোট মনে করছ, সে তোমার থেকে বড়, আর তুমি যাকে বড় মনে করছ, সত্যিকার অর্থে সে বড় নয়। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নারীদের কথা উল্লেখ করে বলেন, আর কোন নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপ কারীদের চেয়ে উত্তম। সুতরাং, বিদ্রূপ করা বড় অন্যায়। বিদ্রূপ করার ফলে সামাজিক অবকাঠামো ভঙ্গ হয়, সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আয়াতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরেন, তা হল, আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতনা নিকৃষ্ট!
একজন মুসলিমকে যদি খারাপ নামে ডাকা হয়, তাহলে তাতে সে মনে কষ্ট পাবে, তার অন্তরে আঘাত আসবে। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোন মানুষকে তার মন্দ নামে ডাকা থেকে না করেন। বর্তমানে আমরা নামে বে-নামে মানুষকে ডাকি। এটা করা হতে আমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
আদেশ দেন এবং বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। বর্তমানে আমাদের মধ্যে এ দুরারোগ্যটি মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা অনেক সময় কোন কিছু না জেনে না শোনে মানুষের প্রতি খারাপ ধারণা ও অনুমান করি। বর্তমান সমাজে অধিকাংশ বিশৃঙ্খলার কারণই হল, অনুমান করা এবং অনুমান নির্ভর কথা বলা। মানুষের প্রতি খারাপ ধারণা করা হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে।
আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। কারো গোপন বিষয় অনুসন্ধান করার অধিকার কারো নাই। বরং তুমি যখন কারো কোন দোষ সম্পর্কে জানতে পারবে, তা গোপন রাখতে চেষ্টা করবে। মানুষের সামনে তা প্রকাশ করা হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। আর গীবত একটি মারাত্মক ব্যাধি, এ ব্যাধি সামগ্রিক জীবনকে ধ্বংস করে। মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। গীবত সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোস্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক”। সুতরাং, গীবত থেকে নিজেদের বিরত রাখবে। তাহলে তোমাদের সামগ্রিক জীবন নিরাপদ থাকবে। [অনুবাদক]
[30] একজন মুমিন তার অপর মুমিন ভাইকে দেখতে যাবে, তাদের খোজ-খবর নিবে এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তাতে মুমিনদের পরস্পর সম্পর্ক মজবুত হবে এবং তাদের সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হবে। [অনুবাদক]
[31] .হাদিসটি ইমাম আহমদ মসনাদুল আনছারে বর্ণনা করেন। ইমাম মালেক কিতাবুল জামেতে বর্ণনা করেন, পরিচ্ছেদ: আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালো বাসে তাদের বিষয়ে আলোচনা।
[33] একজন মুমিন তার মুমিন ভাইয়ের অধিকার রক্ষা এবং তাদের হক যাতে কোনভাবে নষ্ট না হয়, তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এ বিষয়ে ইসলাম বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পারিবারিক ও সামাজিক সব বিষয়ে মুমিনদের অধিকারকে সমুন্নত রাখতে ইসলাম সর্বদা সচেতনতা অবলম্বন করে। সুতরাং, কারো বিক্রির উপর বিক্রি করবে না, কারো মুলা-মূলীর উপর মুলা-মূলী করবে না এবং কারো প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব দেবে না। যদি কোন মুমিন ভাই কোন বিষয়ে অগ্রগামী হয় থাকে, তাকে প্রাধান্য দেবে। তার উপর কোন প্রকার বাড়া-বাড়ি করা যাবে না। ইসলাম মানবতার ধর্ম, অধিকার প্রতিষ্ঠার ধর্ম এবং ইজ্জত সম্মান ও মানবাধিকার সংরক্ষণের ধর্ম। [অনুবাদক]।
[34] বুখারি বেচা-বিক্রি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: অপর ভাইয়ের বিক্রির উপর বিক্রি করবে না। আর মুসলিম বিবাহ অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: কোন ভাইয়ের প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব দেয়া নিষিদ্ধ হওয়া।
[35] মুসলিম বিবাহ অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: পুপি ও খালাকে একত্রে বিবাহ করা নিষিদ্ধ বিষয়ে আলোচনা। ইবনে মাযা, কিতাবুত তিজারত, কোন ব্যক্তি তার ভাইয়ের বিক্রির উপর বিক্রি করবে না।
[36] তিরমিযি কিতাবুল বির ওয়াসসেলা, পরিচ্ছেদ: বাচ্চাদের দয়া করা প্রসঙ্গে। তিরমিযি কিতাবুল জিহাদ, পরিচ্ছেদ: দুর্বল মুসলিমদের দ্বারা বিজয় অর্জন করা বিষয়ে আলোচনা।
[37] হাদিসটি ইমাম তিরমিযি কিতাবুল জিহাদে আলোচনা করেছেন। পরিচ্ছেদ: দুর্বল মুসলিমদের দ্বারা বিজয় লাভের প্রসঙ্গে। নাসায়ী কিতাবুল জিহাদে হাদিসটি আলোচনা করেন। পরিচ্ছেদ: দুর্বল দ্বারা সাহায্য লাভ। আবু দাউদ কিতাবুল জিহাদ। পরিচ্ছেদ: দুর্বল ও অসহায় ঘোড়া দ্বারা বিজয় লাভ। আর ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদের মুসনাদুল আনসারে হাদিসটি বর্ণনা করেন।
[38] বুখারি কিতাবুল হিবা, পরিচ্ছেদ: মুশরিকদের হাদিয়া দেয়া। আর মুসলিম যাকাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ছেলে সন্তান, স্ত্রী ও আত্মীয় স্বজনদের সাদকা দেয়ার ফযীলত।
[39] এখানে আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, অমুসলিমদের সাথে উত্তম আচরণ, ইসলামের দিকে তাদের দাওয়াত দেয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম। আমরা ইসলামের ইতিহাসের দিকে চোখ ভুলাইলে দেখতে পাই, যুগে যুগে ইসলাম আখলাকের দ্বারাই বিস্তার লাভ করে।
[40] যখন একজন মানুষ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়ার সবকিছু হতে বেশি মহব্বত করবে, তখন সে প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে।
[41] এ ছাড়া ইসলামের দুশমন যারা ইসলামের মূলোৎপাটনে যুগে যুগে ভূমিকা রাখে, তারাই ইসলামের প্রাণ পুরুষদের কলঙ্কিত করে ইসলামের সৌন্দর্য, গ্রহণযোগ্যতা ও সার্বজনীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। [অনুবাদক]।
[42] এদেরকে অবশ্যই ঘৃণা করতে হবে এবং এদের বিরোধিতা করতে হবে। তাদের সাথে কোন প্রকার বন্ধুত্ব করা যাবে না এবং তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। এ সব লোকের সাথে খালেস দুশমনি এবং এদের খুব ঘৃণা করতে হবে। তাদেরকে কোন প্রকার মহব্বত ও বন্ধুত্ব করা জঘন্য অপরাধ। এরা মানবতার দুশমন এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের দুশমন।
[43] অপরাধি মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ আর কাফেরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ দুটি এক হতে পারে না। কাফেরদের প্রতি বিদ্বেষ বা শত্রুতা চিরন্তন। পক্ষান্তরে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ তার গুণাহের কারণে হয়ে থাকে। যেমনটি শাইখ বর্ণনা করেছেন। এর প্রমাণ হল ঐ হাদীস যেটিকে ইমাম বুখারি স্বীয় সনদে বর্ণনা করেন।
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رضي الله عنه أَنَّ رَجُلًا عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم كَانَ اسْمُهُ عَبْدَاللَّهِ وَكَانَ يُلَقَّبُ حِمَارًا وَكَانَ يُضْحِكُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَكَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم قَدْ جَلَدَهُ فِي الشَّرَابِ فَأُتِيَ بِهِ يَوْمًا فَأَمَرَ بِهِ فَجُلِدَ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ اللَّهُمَّ الْعَنْهُ مَا أَكْثَرَ مَا يُؤْتَى بِهِ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم : « لَا تَلْعَنُوهُ فَوَاللَّهِ مَا عَلِمْتُ إِنَّهُ يُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ »
অর্থ, ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে আব্দুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি যাকে সবাই জামার বলে ডাকতো এবং সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাসাতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মদ পান করার কারণে তাকে একবার শাস্তি দেয়। তাকে একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত করা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দুররা মারার নির্দেশ দিলে তাকে দুররা মারা হল। তার অবস্থা দেখে উপস্থিত এক লোক বলল, হে আল্লাহ তুমি তাকে রহমত থেকে দূর করে দাও। কারণ, লোকটিকে কতবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরাবারে আনা হয়ে থাকে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলল, “তোমরা তাকে অভিশাপ করো না। কারণ, আল্লাহর শপথ, আমি তো জানি লোকটি আল্লাহ ও তার রাসূলকে মহব্বত করে।
[44] কারণ, তারা বলে ঈমানের সাথে গুনাহ কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। সুতরাং গুনাহ কোন সমস্যা নয়। এটা নিঃসন্দেহে খারেজীদের বিপরীতমুখী অবস্থান। এ দুয়ের মাঝখানে হচ্ছে হকপন্থা। [সম্পাদক]
[45] এখানে খারেজি ও মুরজিয়া উভয় পক্ষই বাড়াবাড়ি করে থাকে। এক পক্ষ বলে, গুনাহের কারণে তাকে একেবারে কাফেরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তাদের সাথে কাফেরের মত আচরণ করতে হবে। আবার অপর পক্ষ বলে না, গুনাহের কারণে তাদের ঈমানের কোন ক্ষতি হয় না। সুতরাং, তাদের সাথে কোন খারাপ আচরণ করা যাবে না, বরং তাদের সাথে সে আচরণ করতে হবে, যে আচরণ মুমিনদের সাথে করা হবে। উভয় পক্ষই ভ্রান্তিতে আছে, একমাত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাত ছাড়া; তারা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেছে। তারা বলে, তাদের গুনাহের জন্য ঘৃণা করা হবে, আর ঈমানের কারণে মহব্বত করা হবে।
[46]হাদীসটি বুখারিতে বর্ণিত। কিতাবুল আদব, পরিচ্ছেদ: আল্লাহর মহব্বতের নিদর্শন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ تَقُولُ فِي رَجُلٍ أَحَبَّ قَوْماً وَلَمْ يَلْحَقْ بِهِمْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : « الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ » وأخرجه مسلم ، كتاب الصلة ، باب المرء مع من أحب .
অর্থ, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল! এক ব্যক্তি সে কোন সম্প্রদায়ের লোককে মহব্বত করে অথচ সে তাদের সাথে সম্পৃক্ত নয়, আপনি তার সম্পর্কে কি বলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মানুষ তার সাথে হবে যাকে সে মহব্বত করে। আর মুসলিম হাদীসটি কিতাবুস সেলা-তে আলোচনা করেন। পরিচ্ছেদ: মানুষ যাকে মহব্বত করে তার সাথে হবে।
[47] যার কারণে তাদের বন্ধুত্ব ও মহব্বত কখনো স্থায়ী হয় না, একেবারেই সাময়িক হয়। যখন স্বার্থ হাসিল না হয় বা স্বার্থের বিঘ্ন ঘটে, তখন তাদের বন্ধুত্ব আর টিক না, একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। এ হল, বর্তমান যুগে আমাদের অবস্থা ও পরিণতি। আমরা মানুষের সাথে স্বার্থের বন্ধুত্ব করি এবং স্বার্থে কারণে আবার শত্রুতা করি। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
[48] এ ধরনের বন্ধুত্ব ও শত্রুতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে কোন কাজে আসবে না। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে কাজে আসবে।
[50] ইমাম তিরমিযি মানাকেব অধ্যায়ে যারা রাসূলের সাহাবীদের গালি দেন তাদের আলোচনা হাদিসটি বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযির নিকট হাদিসটির বর্ণনা এভাবে, আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضاً بَعْدِي فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ وَمَنْ آذَاهُمْ فَقَدْ آذَانِي وَمَنْ آذَانِي فَقَدْ آذَى اللَّهَ وَمَنْ آذَى اللَّهَ يُوشِكُ أَنْ يَأْخُذَهُ»
অর্থ, আমার সাহাবীদের বিষয়ে তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিচ্ছি, আমার সাহাবীদের বিষয়ে তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিচ্ছি, তোমরা আমার সাহাবীদের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন কর। তোমরা আমাদের সাহাবীদেরকে তোমাদের সমালোচনা ও বিতর্কের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করো না। যারা তাদের তাদের মহব্বত করে আমাকে মহব্বত করার কারণে মহব্বত করে আর যারা তাদের ঘৃণা করে তারা আমাকে ঘৃণা করার কারণে ঘৃণা করল। আর যারা তাদের কষ্ট দেয়, তারা আমাকেই কষ্ট দিল, আর যে ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দেয়, সে আল্লাহকে কষ্ট দিল, আর যে আল্লাহকে কষ্ট দেয়, তাকে অবশ্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাকড়াও করবে।
হাদিসের সূত্র ও টীকা সংযোজন: আদেল নাস্সার
অনুবাদক : জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন