Views:
A+
A-
প্রথম ঘটনা :
দ্বিতীয় ঘটনা :
সম্পদের মোহ দু'ধরনের :
প্রবৃত্তি পূজাই সকল ব্যাধির কারণ
প্রবৃত্তি পূজাই সকল ব্যাধির কারণ
আল্লাহ
তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা, তার সন্তুষ্টি কামনা করা এবং শুধু তাকে
পাওয়ার আশা করাই হচ্ছে তওহিদের মূল তত্ত্বকথা। আর এটাই হচ্ছে কালিমায়ে
শাহাদাত 'লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ'-র অর্থ ও দাবি।
শায়েখ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহহাব রহ. বলেন,
'ইলাহ' হচ্ছে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। যারা আল্লাহ সম্পর্কে
জানে না, তাদের কাছে হয়তো ব্যাপারটি সাধারণ হতে পারে, কিন্তু যারা আল্লাহ
সম্পর্কে জানে ও তার কুদরতের ধারণা রাখে, তাদের কাছে বিষয়টি মোটেও সাধারণ
নয়। বরং অসাধারণ ও খুব গুরুত্বপূর্ণ।' (দুরারে সানিয়্যাহ : ২ / ২১)
পক্ষান্তরে
যাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আল্লাহ নয়, তাদের অবশ্যই আল্লাহ ব্যতীত
অন্য সত্তা বা বস্তু রয়েছে, এবং তারা (জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে) সে সত্তা
বা বস্তুর দাসত্ব করছে। ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলেন,
'তথ্য তালাশ করে দেখা গেছে যে, যে যত বেশী আল্লাহর এবাদত থেকে নিজকে
গুটিয়ে নিয়েছে, সে তত বেশী শিরকে লিপ্ত হয়েছে। কারণ, আল্লাহর এবাদত,
আনুগত্য ও তার শরণাপন্ন হওয়া থেকে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত
অন্য কারো এবাদত ও আনুগত্য করা এবং তার শরণাপন্ন হওয়া।'
প্রত্যেকের
জন্যই একটি আশ্রয় কেন্দ্র বা ভরসাস্থল রয়েছে, যার তরে সে উৎসর্গ হয় এবং
যাকে সে অন্তরের ভক্তি-শ্রদ্ধা দিয়ে মহব্বত করে। অতএব যে ব্যক্তি নিজ
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আল্লাহকে স্থির না করে তাকে প্রত্যাখ্যান করল, সে
নিশ্চিত আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে লক্ষ্য স্থির করল এবং তার দাসে পরিণত হল।
হতে পারে তা বস্তু-ধন-সম্পদ-পদমর্যাদা-ভাষ্কর্য বা আল্লাহ ব্যতীত কোন
সত্তা।
বর্তমান
পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, মানুষ বিভিন্নভাবে ও
নানান পদ্ধতিতে প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে ও শয়তানের দাসত্বে লিপ্ত হচ্ছে।
কারো আছে নারীর প্রতি অবৈধ আসক্তি, কারো আছে সম্পদের মোহ, কারো আছে অভিজাত
পোশাক-আশাকের উচ্চাভিলাষ। কারো আছে বাড়ি-গাড়ি ও ঐশ্বর্যের সীমাহীন
আকাঙ্খা। কারো আছে ক্ষমতার লোভ। কারো আছে খেল-তামাশা ও গান-বাজনার অধীর
আগ্রহ ইত্যাদি।
হ্যাঁ,
মানুষের অন্তরে বিদ্যমান ও স্মায়ুতন্ত্রের অভ্যন্তরে বিরাজমান এমন কিছু
প্রবৃত্তির আচার ও কামনা বাসনার বিবরণ-বিশ্লেষণ নিয়েই আমাদের এ আয়োজন।
প্রবৃত্তি
বা বিষয়ে প্রধান প্রধান স্বভাবের আলোচনার পূর্বে, তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা
ও মোকাবিলা করার পদ্ধতির ওপর সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা আবশ্যক জ্ঞান করছি।
বর্তমান
বিশ্ব মানুষের জৈবিক ও দৈহিক চাহিদার পূরণের ক্ষেত্রে দুভাগে বিভক্ত হয়ে
গেছে। এক শ্রেণী দৈহিক ও জৈবিক চাহিদাকে মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে
এবং একেই তারা পার্থিব জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছে। ফলে তারা এ
চাহিদা পূরণ করার জন্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হচ্ছে, নিমজ্জিত হচ্ছে পাপাচারে,
ত্যাগ করেছে সালাত ও অন্যান্য এবাদত। এদের অধিকাংশ হচ্ছে পাশ্চাত্যের
অধিবাসী বা তাদের অনুসারী। দ্বিতীয় শ্রেণী দৈহিক ও জৈবিক চাহিদাকে
সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করে গ্রহণ করেছে বৈরাগ্যবাদ। ফলে এরা আল্লাহর হালাল
করা অনেক বস্তুকেই হারাম করে নিয়েছে। এদের অধিকাংশ হচ্ছে প্রাচ্যের
অধিবাসী বা তাদের অনুসারী। এর বিপরীতে ইসলাম দৈহিক ও জৈবিক চাহিদার
ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা গ্রহণ করেছে। আর এটাই হচ্ছে মানুষের জৈবিক ও আত্মিক
চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দীন, মানুষের
স্বভাবের ধর্ম। ইসলাম মানুষের সার্বিক চাহিদার জিম্মাদার, তাই সে মানুষের
সৃষ্টিগত স্বভাব ও প্রকৃতিগত চাহিদার বিরোধিতা করে না, বরং তার স্বীকৃতি
দেয় এবং সংগত কারণে তা নিয়ন্ত্রণও করে।
ইবনে কাইয়ূম রহ. ইসলামের এ মধ্যম পন্থার ব্যাখ্যায় বলেন,
'মানুষ কখনো প্রবৃত্তি থেকে আলাদা হতে পারবে না, যতদিন সে আছে ততদিন তার
প্রবৃত্তিও আছে, এর থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব, তাই ইসলাম তাকে প্রবৃত্তি
থেকে আলাদা হতে বলেনি বরং তা নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন তাকে
নারীর প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে বলেনি, বরং তাকে বিবাহের নিদের্শ দিয়েছে
এবং এর মাধ্যমে তার চাহিদা পূরণ করার বিধান দিয়েছে। ইসলাম এক থেকে চারটি
পর্যন্ত বিবাহের অনুমতি দিয়েছে। এভাবেই ইসলাম মানুষের প্রবৃত্তিকে
নিয়ন্ত্রণ করেছে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানব জাতিকে নৈতিক পদস্খলন,
বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করা।' (জাম্মুল হাওয়া : ৩৫ ইবনে জাওজি)
যে
ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার চাহিদা পূরণে মশগুল থাকে, সে কার্যত
প্রবৃত্তির দাস ও গোলামে পরিণত হয় এবং প্রবৃত্তি তাকে গ্রাস করে নেয়
সম্পূর্ণরূপে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, 'পানাহার, পোশাক-আশাক,
অবৈধ ভালবাসা ও গান-বাজনায় মগ্নতা মানুষকে উন্মাদ বানিয়ে দেয়। কারো
অন্তরে যখন তার ভালবাসার বস্তুটির চিত্র ফুটে উঠে, তখন সে তাতেই নিমজ্জিত
হয়ে পড়ে, এগুলো একাকার হয়ে যায় তার সত্তার সঙ্গে, যা থেকে উত্তরণ সম্ভব
হয় না তার পক্ষে। এমন হয় কখনো লোভের কারণে, যেমন সম্পদ, সম্মান ইত্যাদির
জন্য। কখনো হয় ভয়ের করণে, যেমন দুশমন বা অন্য কারো আতঙ্কে আতঙ্কিত
ব্যক্তির অন্তর। প্রবৃত্তির অনুসারীরা আরো অনেক কারণে পানিতে নিমজ্জিত
ব্যক্তির ন্যায় প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে আপাত-মস্তক নিমজ্জিত হয়ে থাকে।'
(মাজমুআতুল ফতওয়া : ১০ / ৫৯৪)
ইমাম শাফি রহ. বলেছেন, 'যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে, সে প্রকারন্তরে দুনিয়াদার লোকদের দাসে পরিণত হবে।' (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১০ / ৯৭)
নফসের নিয়ন্ত্রণহীন অনুসরণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও সুস্থ্য বিবেক উভয়ের আলোকেই নিন্দিত ও পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا ﴿مريم:৫৯﴾
'তাদের
পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ
করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।' (মারইয়াম :
৫৯)
তদ্রূপ
সুস্থ্য বিবেকের বিচারেও তা ঘৃণ্য ও নিন্দিত। কারণ, বিবেকবান কাজ হচ্ছে
কর্মের ভাল-মন্দ বিচার করা, অস্থায়ী স্বাদ ও আনন্দের বিপরীতে স্থায়ী দুঃখ
ও কষ্ট খরিদ না করা। কাজেকাজেই একজন বিবেকবান কোনভাবেই পার্থিব সুখ-দুঃখের
মোকাবিলায় আখেরাতের সুখ-দুঃখকে প্রধান্য দিতে পারে না।
ইবনে জাওজি রহ. বলেন, 'মনে
রেখো, নফসের প্রকৃতি হচ্ছে দূর ভবিষ্যৎ বা ভাল-মন্দ বিচার না করে বর্তমান
ভোগ ও আনন্দের প্রতি প্ররোচিত করা, তাকে প্রধান্য দেয়া এবং তার জন্যই
উদ্বুদ্ধ করা। যদিও এর পশ্চাতে থাকে দুঃখ আর লাঞ্ছনা, নিরানন্দ আর
যন্ত্রণা। পক্ষান্তরে বিবেকবানরা এমনসব ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-বিনোদন পরিত্যাগ
করে, যার পশ্চাতে রয়েছে দুঃখ-বিড়ম্বনা, অপমান ও লাঞ্ছনা। এর দ্বারাই
প্রমাণিত হয় নফস ও বিবেকের পার্থক্য, বুদ্ধিমান ও নির্বোধের মধ্যকার তফাৎ।
দুনিয়া
একটি পরীক্ষাগার, তাই এর সবর্ত্র প্রবৃত্তির বিচরণ থাকাই স্বাভাবিক। তবে
বিবেকবানের কর্তব্য হচ্ছে প্রতিটি বিষয় গ্রহণ ও বর্জনের জন্য বিবেকের
শরাণপন্ন হওয়া এবং বিচারের ভার তার ওপর ন্যস্ত করা। কারণ বিবেক তার
বিবেচনায় অস্থায়ী সুখের পরিবর্তে স্থায়ী সুখ গ্রহণ করার পরামর্শ দিবে,
এবং যার মাধ্যমে আখেরাতের স্থায়ী সুখ, শান্তি নিশ্চিত হবে তাই গ্রহণ করার
জন্য বারবার তাগিদ দিবে।' (জাম্মুল হাওয়া ৩৬, ইবনে জাওজি)
'একটি
কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, নফসের প্ররোচনা, উত্তেজনা, চাকচিক্য-প্রীতি ও
তার আসক্তিকে তখনই কঠোরভাবে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যখন নফসের
প্রায়শ্চিত্ত তথা আফসোস, পরিতাপ, হতাশা ও যন্ত্রণা সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি
রাখবে ও সে ব্যাপারে চিন্তা করবে। ইবনুল কাইয়ূম রহ. বলেন, 'প্রবৃত্তির
প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করার চেয়ে প্রবৃত্তি দমন করাই সহজ। কারণ, প্রবৃত্তির
প্রায়শ্চিত্ত খুবই নির্মম ও বেদনাদায়ক। হয়তো অফসোস, হয়তো হতাশা কিংবা
অসম্মান। কখনো সম্পদ বঞ্চিত হওয়া, কখনো পদচ্যুতি কিংবা মৃত্যুর মুখোমুখি
হওয়া। আবার অধস্তন ব্যক্তিদের তিরস্কার বা নিন্দার পাত্রে পরিণত হওয়াও কম
কিসের!? যা কল্পনাতেও স্থান পায়নি কখনো। অধিকন্তু অন্তরের
উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, বিষাদ-দুশ্চিন্তা আর ভয় ও শঙ্কা তো রয়েছেই। ন্যূনতম
পক্ষে প্রবৃত্তির ফলে তুলনামূলক বিনোদন থেকে মাহরুম হওয়া, শত্রুর খুশির
কারণ হওয়া, শুভাকাঙ্খীদের দুশ্চিন্তায় লিপ্ত হওয়া, অথবা কলঙ্গের চাপ
মাথায় নিয়ে বেচে থাকায় মঙ্গল কোথায়!? কারণ, কর্মের দ্বারাই মানুষ
সৎ-অসৎ ও ভাল-মন্দ হিসেবে বিবেচিত হয়, বরং কর্মই তার ফল নির্ধারণ করে
দেয়, তাই প্রবৃত্তি তাড়িত কর্মের ফলাফল চিন্তা করে প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া
না দেয়াই হচ্ছে বিবেকবান কাজ।' (আল ফাওয়ায়েদ : ১৩১)
নারী প্রীতি
নারী প্রীতি :
ব্যাপক অর্থে যৌনতা বা যৌনকামনা বুঝায়। শুধূ মুসলমানদের অবস্থা
পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যায় যে, কি পরিমাণ যৌন উন্মত্ততার বিস্তার ঘটেছে,
কি পরিমাণ প্রবৃত্তির উন্মাদনায় ডুবে আছে মুসলিম যুবকরা। তারা ডিশ আর
ইন্টারনেট নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত, রাতের পর রাত পার করে দিচ্ছে শুধু অশ্লীল
ও নগ্ন ছবি দেখে দেখে, আবার প্রবৃত্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে চলেছে
দূর-দূরান্তে তথা বেহায়া ও অশ্লীলতাপূর্ণ স্পটে। এদিকে মানুষ ও জ্বীন
জাতির কুচক্রি একটি দল আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমেছে মুসলমান যুবকদের চরিত্র ও
ইসলামি শিষ্টাচার ধ্বংস করার নিমিত্তে। তারা যে কোন মূল্যে মুসলমানদের
মধ্যে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার বিস্তার ঘটাতে চায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاللَّهُ يُرِيدُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَيُرِيدُ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الشَّهَوَاتِ أَنْ تَمِيلُوا مَيْلًا عَظِيمًا ﴿النساء:২৭﴾
'আর
আল্লাহ চান তোমাদের তওবা কবুল করতে। আর যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা
চায় যে, তোমরা প্রবলভাবে (সত্য পথ থেকে) বিচ্যুত হও।' (নিসা : ২৭)
একটি
বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, প্রবৃত্তির উন্মদনার কোন শেষ নেই। যে ব্যক্তি
দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত সে কোন দিন দুনিয়া দ্বারা পরিতৃপ্ত হবে না। হাদীসে
এসেছে, যদি কোন মানুষের স্বর্ণের দু'টি উপত্যকা থাকে, সে তৃতীয় আরেকটি
উপত্যকার অনুসন্ধানে প্রয়াসী হবে, মাটি ছাড়া অন্য কোন জিনিস তার উদর
পূর্ণ করতে পারবে না। তদ্রুপ যে ব্যক্তি হালাল-হারাম বিচার না করে কাম
লিপ্সায় মত্ত, সেও কোন দিন পরিতৃপ্ত হবে না, কখনো মিটবে না তার চাহিদা।
শায়খ আলী আত-তানতাবি বলেন,
'তুমি যদি কারুনের ন্যায় সম্পদের মালিক হও, বাদশাহ হিরাকলের মত বিশাল
দেহের অধিকারী হও আর তোমার অধীনে থাকে প্রত্যেক রঙ্গ, জাত-পাত ও সৌন্দর্যের
দশ হাজার রূপসী নারী, তবু তোমার অন্তর তাতে তৃপ্ত হবে না এবং সেসবকে তুমি
নিজের জন্য যথেষ্টও মনে করবে না। আমি এ কথা খুব জোড় গলায় বলতে পারি, বরং
স্বর্ণাক্ষরেও লিখে রাখতে পারি। তবে হালাল একজন নারীই তোমার জন্য যতেষ্ট
হবে, এ জন্য কোন দলিলের প্রয়োজন নেই, বরং তোমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার
চতুর্পাশ্বে-ই রয়েছে এর হাজারো নজির।' (ফতওয়া তান তাবি : ১৪৬)
ইবনুল মুকফে রচিত আদাবুল কাবিরে রয়েছে,
'স্মরণ রেখ, নারীপ্রেম ও নারীপ্রীতি দীন খতম করে, স্বাস্থ্য ও সম্পদ
বিনষ্ট করে, জীবনের ওপর কলঙ্কের ছাপ নিয়ে আসে, ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ ও
মর্যাদার পতন ঘটায়। কী অদ্ভুত! একজন সুস্থ্য বিবেকবান ব্যক্তি দূর থেকে
চাদরে লেপটানো এক নারীকে দেখে, অতঃপর হৃদয়ে তার রূপ ও সৌন্দর্যের ছবি
অঙ্কন করে, এক পর্যায়ে তার প্রেমে পড়ে যায়, অথচ তাকে সে দেখিনি, তার
সম্পর্কে কিছু শোনেনি! কখনো তার সঙ্গে অবৈধ বাসনা পূরণ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত
হয়, তবুও তার স্বাদ মিটে না, বিরত থাকে না সে অন্য নারীদের থেকে! অথচ
তারাও তো দৈহিক গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এ নারীর ন্যায়ই। বরং, অনাস্বাদিত
প্রতিটি নারীর জন্য তার অন্তর থাকে অস্থির, উদ্গ্রীব। এমনকি যদি পৃথিবীর
বুকে একটি নারীও অবশিষ্ট থাকে, তার ব্যাপারেও তার কৌতুহল শেষ হবে না। সে
আরো ভাবতে থাকে, এর ভেতর রয়েছে আলাদা স্বাদ, যা অন্য নারীদের মধ্যে ছিল
না। এখানেই তার নির্বুদ্ধিতা, মূর্খতা ও বোকামি। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয়
সে কপাল পোড়া, হতভাগা।'
এ পার্থিব জগতে পুরুষের জন্য সব চেয়ে ক্ষতিকর বস্তু ও পরীক্ষার জিনিস হচ্ছে নারী। রাসূল সা. বলেন,
'আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীরাই হবে পরীক্ষার বস্তু।' (মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
'আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীরাই হবে পরীক্ষার বস্তু।' (মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَخُلِقَ الْإِنْسَانُ ضَعِيفًا ﴿২৮﴾
'আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দূর্বল করে।' (নিসা : ২৮)
এর ব্যাখ্যায় ইমাম তাউস রহ. বলেন,
'নারীর প্রতি দৃষ্টি পড়লে পুরুষরা দূর্বল তথা ধৈর্য হারা হয়ে যায়।'
ইবনে আব্বাস রহ. বলেন, 'আগের যুগে মানুষ নারীদের কারণে কুফরে লিপ্ত হয়েছে,
পরবর্তী যুগেও নারীদের কারণে কুফরে লিপ্ত হবে।'(জাম্মুল হাওয়া : ১৭৯)
নিম্নে আমরা দু'টি ঘটনার উল্লেখ করছি, যার দ্বারা নারীর প্রেমে পড়ে
পুরুষদের কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার একটি চিত্র ফুটে উঠবে।
প্রথম ঘটনা :
আবুল ফারাজ ইবনে জাউজি রহ. বলেন,
আমি একটি ঘটনা শুনেছি, বাগদাদে একজন ব্যক্তি ছিল, যে মানুষের নিকট
'সালেহ-মুয়াজ্জিন' (নেককার-মুয়াজ্জিন) হিসেবে পরিচিত ছিল। চল্লিশ বৎসর সে
আজানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছে। চারিত্রগুনের কারণে জন-সমাজে সৎ, নীতিবান
ও ভাল লোক হিসেবে খুব প্রসিদ্ধি ছিল তার। একদা সে আজান দেয়ার জন্য
মসজিদের মিনারায় ওঠে, মসজিদের পাশেই ছিল এক খৃষ্টান ফ্যামিলি, সে বাড়ির
এক মেয়ের ওপর তার দৃষ্টি পড়ে, আর এতেই সে তার প্রেমে মগ্ন হয়ে যায়।
মিনারা থেকে নেমেই সে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দরজার কড়া নাড়া দিল। মেয়েটি
বলল, কে ? সে বলল, আমি সালেহ-মুয়াজ্জিন। দরজা খুলে দিল মেয়েটি। ঘরে
প্রবেশ করে সে তাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটি বলল, তোমরা না সৎ! চরিত্রবান!!
আমানতদার!!! তুমি একি করছ ?! সে বলল, যদি তুমি আমার কথায় সাড়া দাও, ভাল;
অন্যথায় আমি তোমাকে হত্যা করব। মেয়েটি বলল, তুমি নিজ ধর্ম ত্যাগ না করলে
আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারব না। তৎক্ষনাৎ সে বলল, আমি আমার ধর্ম ত্যাগ
করলাম, মুহাম্মদের আনীত সমস্ত বিধান থেকে মুক্ত হলাম। অতঃপর সে মেয়েটির
নিকটবর্তী হল। মেয়েটি বলল, তুমি ছলনা করছ, কার্যসিদ্ধির জন্য এ কথা বলছ,
পরে তুমি নিজ ধর্মে ফিরে যাবে, যদি সত্য বলে থাক, শূকরের গোস্ত ভক্ষণ কর,
সে তাতেও রাজি হল, শূকরের গোস্ত ভক্ষণ করল। মেয়েটি বলল, মদ পান কর, সে তাও
করল। যখন তার ভেতর মদের ক্রিয়া শুরু হল, সে মেয়েটির কাছে এল, মেয়েটি
একটি রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল। আরো বলল, তুমি ছাদে চড়, আমার
আব্বার আসার অপেক্ষা কর, সে এসে বিয়ে পড়িয়ে দেবে। সে ছাদে উঠে এবং সেখান
থেকে পড়ে মারা যায়। মেয়েটি বের হয়ে একটি কাপড় দিয়ে তার মরদেহ ডেকে
রাখে। মেয়েটির পিতা এসে এ ঘটনা অবহিত হলে, মৃত দেহটি রাস্তায় ফেলে রাখে।
পরদিন ঘটনা জানাজানি হয়, অতঃপর লোকেরা তার দেহ ডাষ্টবিনে ফেলে দেয়।'
(জাম্মুল হাওয়া : ৪০৯)
দ্বিতীয় ঘটনা :
হাফেজ ইবনে কাসির রহ. ইমাম জাউজির বরাত দিয়ে বলেন,
আবদাহ বিন আব্দুর রহিম নামে এক মুজাহিদ ২৭৮ হিজরি সনে মারা যায়। যার
সম্পর্কে শ্রুতি রয়েছে যে, সে অধিকাংশ সময় ইউরোপের বিরুদ্ধে জেহাদে
ব্যস্ত থাকত। একবারের ঘটনা, মুজাহিদগণ ইউরোপের একটি দেশ ঘেরাও করে রেখে
ছিল, দূর্গের ভেতর অবস্থানকারী এক নারীর প্রতি তার দৃষ্টি পড়ল, আর এতেই সে
তার প্রেমে পড়ে যায়। আরম্ভ হল চিঠির আদান-প্রদান, সে তাকে লিখল আমি
তোমাকে কীভাবে পেতে পারি ? সে বলল, তুমি খৃষ্টান হও আর দেয়াল টপকে আমার
কাছে চলে এসো, সে তাতে সাড়া দিল। বিষয়টি মুসলমানদের খুব ভাবিয়ে তুলল,
বরং, আতঙ্কিত করল। সকলেই মর্মাহত হল, অনেক আফসোস করল, কঠিন মনে হল তাদের
কাছে তার ঘটনাটি। কয়েক বৎসর পর তার সাথে একদল মুজাহিদের সাক্ষাত। তারা
দেখতে পেল, তখনও সে ঐ মহিলার সাথে সংসার করছে, তারা জিজ্ঞেস করল, কি
ব্যাপার ? কোথায় গেল তোমার কুরআন? আর তোমার আমল, রোজা, জেহাদ ও নামাজের
খবর কি ? সে বলল, আমি পূর্ণ কুরআন ভুলে গেছি, শুধু একটি আয়াত আমার মনে
আছে,
رُبَمَا
يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ. ذَرْهُمْ
يَأْكُلُوا وَيَتَمَتَّعُوا وَيُلْهِهِمُ الْأَمَلُ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
﴿الحجر:২-৩﴾
'যারা
কুফরি করেছে তারা একসময় কামনা করবে, যদি তারা মুসলমান হত! তাদেরকে ছেড়ে
দাও, আহারে ও ভোগে তারা মত্ত থাকুক এবং আশা তাদেরকে গাফেল করে রাখুক, আর
অচিরেই তারা জানতে পারবে।' (সূরা হিজর : ২-৩) সে আরো জানাল, এখন তো আমার তাদের মধ্যে অনেক সন্তান ও সম্পদ হয়েছে।' (আল বেদায়া : ১১ / ৬৪)
বিভিন্ন
কারণে মানুষ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় জড়িয়ে পড়ে, নিমজ্জিত হয় তাতে
আপাদ মস্তক। যার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে গান-বাদ্য। মূলত গান-বাদ্য হচ্ছে যেনা
ও অশ্লিলতার মন্ত্র।
ইয়াজিদ ইবনে ওলিদ বলেন,
'হে উমাইয়্যা সম্প্রদায়, গান-বাদ্য থেকে বিরত থাক। কারণ, গান-বাদ্য
লজ্জা খতম করে দেয়, প্রবৃত্তির উত্তেজনা বৃদ্ধি করে ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট
করে। এগুলো নেশার মত, নেশার মতই এর কাজ, যদি কখনো তোমাদের এগুলো করতে হয়,
তবে নারীদের দূরে রাখ। কারণ, গান যিনার প্রতি প্রলুব্দ করে।
ইবনে কাইয়ূম রহ. বলেন, একটি প্রবাদ রয়েছে :
মেয়েদের যখন ছেলেরা ফাঁদে ফেলতে না পারে, তখন তাদের গান শোনায়, যার ফলে
তাদের অন্তরে এক ধরণের দুর্বলতার সৃষ্টি হয়। কারণ, মেয়েরা আওয়াজ শোনে
খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল হয়, আর সে আওয়াজ গানের হলে তাদের অন্তরে
দু'ভাবে বিশেষ ক্রিয়ার সৃষ্টি করে : আওয়াজের দ্বারা, গানের অর্থের
দ্বারা। এ জন্যই রাসূল সা. আনজাসা হাদিয়াকে বলেছেন,
'হে আনজাসা, নারীদের সঙ্গে ধীরে চল নীতি গ্রহণ কর।' (বুখারী, মুসলিম)
এর সঙ্গে যদি ঢোল-তবলা, বাদ্যযন্ত্র ও সুন্দরী নারীদের নাচ-গান ইত্যাদি জমা হয়, তবে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীরা যদি কোন আওয়াজের মাধ্যমে গর্ভ ধারণ করতে সক্ষম হত, তবে সে আওয়াজ গানেরই হত।
'হে আনজাসা, নারীদের সঙ্গে ধীরে চল নীতি গ্রহণ কর।' (বুখারী, মুসলিম)
এর সঙ্গে যদি ঢোল-তবলা, বাদ্যযন্ত্র ও সুন্দরী নারীদের নাচ-গান ইত্যাদি জমা হয়, তবে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীরা যদি কোন আওয়াজের মাধ্যমে গর্ভ ধারণ করতে সক্ষম হত, তবে সে আওয়াজ গানেরই হত।
আল্লাহর
শপথ, কত শালীন নারী শুধু গানের কারণে ব্যভিচারীনি হয়েছে! কত ভদ্র ছেলে এ
গানের কারণে শিশু-কিশোরীদের দাসে পরিণত হয়েছে! কত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন
ব্যক্তি গানের কারণে রুচিহীন ও অপধার্থে পরিণত হয়েছে! কত নিষ্পাপ আদম
সন্তান গানের কারণে নানা মুসিবতের শিকার হয়েছে! যার কোন ইয়ত্তা নেই।
সব
চেয়ে ক্ষতিকর জিনিস হচ্ছে হারাম দৃষ্টি। বাজার, সিনেমা, টিভি, ইন্টারনেট,
ডিশলাইন ও অশ্লীল ম্যাগাজিনে এ দৃষ্টির ফলেই অন্তরে অনেক ফেৎনার সূচনা
হয়েছে, যা শেষ হয়েছে অফসোস, লাঞ্ছনা ও চরম অপমানের মাধ্যমে। ইমাম আহমদ
রহ. বলেন, যেখানে দৃষ্টি পড়লে ফেৎনার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে দৃষ্টি না
দেয়াই শ্রেয়, যেহেতু অনেক দৃষ্টিই ব্যক্তির অন্তরে ভূমিকম্পনের ঝড়
তুলেছে।' (জাম্মুল হাওয়া : ১১৬)
ইবনে জাওজি রহ. যথেচ্ছাচারী দৃষ্টি সম্পর্কে বলেন, 'জেনে
রেখ, চোখ অন্তরের বার্তাবাহক, সে বাইরে দেখা সকল জিনিসের সংবাদ দ্রুত
অন্তরের কাছে পৌঁছে দেয়, তুলে ধরে তার ছবি, আর অন্তর তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে
যায়, পরকাল নিয়ে চিন্তা করার সময় তখন আর থাকে না। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা
দৃষ্টি অবনত রাখার নিদের্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ ﴿النور:৩০﴾
'মুমিন পুরুষদের বল, তারা যেন তাদের নিজ দৃষ্টিকে সংযত রাখে।' (নূর : ৩০)
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنّ. َ﴿النور:৩১﴾
'আর মুমিন নারীদেরকে বল, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে।' (নূর : ৩১)
এর পরেই আল্লাহ তাআলা দৃষ্টির সর্বশেষ নতিজা উল্লেখ করে বলেন,
وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ. ﴿৩০﴾
'এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে।' (নূর : ৩০)
وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ. ﴿النور:৩১﴾
'এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।' (নূর : ৩১ )
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. কু-দৃষ্টি ও তার পশ্চাতের পরিণতির আলোচনায় বলেন,
কু-দৃষ্টি কখনো কখনো মানুষকে শিরকে লিপ্ত করে ঈমানহীন করে দেয়। তিনি
বলেন, 'কু-দৃষ্টি ও নারীসঙ্গের ফলে যে সগিরা গুনা হয়, কবিরা গুনাহ থেকে
বিরত থাকার ফলে তা মাফ হয়ে যায়। তবে, বারবার কু-দৃষ্টি ও নারী সঙ্গে
লিপ্ত থাকার ফলে সগিরা গুনাহগুলো কবিরা গুনাহে পরিণত হয়। বরং বারবার
সংঘটিত সগিরা গুনাহ হটাৎ ঘটে যাওয়া কবিরা গুনাহ থেকেও ক্ষতিকর। কারণ,
বারবার কু-দৃষ্টি ও নারী সঙ্গের ফলে অন্তরে পরস্পরের সম্পর্ক ও যৌন কামনার
সৃষ্টি হয়, যা হটাৎ ঘটে যাওয়া যেনার চেয়েও মারাত্বক। আর এ জন্যই
ফোকাহায়ে কেরাম সৎ সাক্ষ্য দাতাদের সম্পর্কে বলেছেন। তারাই সৎ সাক্ষ্য
দাতা যাদের থেকে কবিরা গুনাহ সংঘটিত হয় না এবং যারা বারবার সগিরা গুনাহ
করে না। কবিরা গুনাহ কখনো কখনো কুফরির কারণ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
'আর
মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে
গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে।' (বাকারা : ১৬৫)
মানুষের
প্রেম-ভালবাসা মূলত আল্লাহর প্রতি মহব্বত ও তার ওপর ঈমানের দুর্বলতার
প্রমাণ। এ ধরণের মহব্বত ও ভালবাসার কারণেই লূত আলাই হিস্সলামের কাফের
গোষ্ঠীর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাজিল করেন।' (মাজমুউল ফতওয়া : খ:
১৫, পৃ:২৯২-২৯)
ইবনুল কাইয়ূম রহ বলেন,
'চোখ অন্তরের আয়না স্বরূপ, চোখ বন্ধ করলে অন্তরও তার প্রবৃত্তির ওপর
পর্দা টেনে দেয়। আর চোখ উন্মুক্ত রাখলে অন্তরও তার প্রবৃত্তি উন্মুক্ত করে
রাখে।' তিনি আরো বলেন, অন্তরের মধ্যে কু-দৃষ্টির প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার পর,
ব্যক্তি যদি দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করে এবং সাথে সাথে তার মূল উপড়ে ফেলে,
তবে এর প্রতিকার করা খুব সহজ। এর বিপরীতে যদি সে বারবার তাকাতে থাকে, তার
ছবি অন্তরে বারবার স্মরণ করতে থাকে, তবে তার ভালবাসা অন্তরে প্রোথিত হয়ে
যাবে। কারণ, বারবার দৃষ্টি দেয়ার অর্থ হচ্ছে কু-প্রবৃত্তির গাছটি পানি
দ্বারা সিঞ্চন করা। আর এভাবেই প্রবৃত্তির গাছটি ক্রমশ বড় হয়ে একদিন তাকে
ক্ষতিগ্রস্ত করবে, ভুলিয়ে দিবে তাকে নিজ দায়িত্ব। অধিকন্তু সে এর কারণে
বিভিন্ন পরীক্ষা ও কষ্টের সম্মুখিন হবে, নানা অপকর্মে লিপ্ত হবে।' (রওজাতুল
মুহিব্বীন : পৃ : ৯২-৯৫)
অশান্তি
ও অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী নারী-পুরুষের অবাধ
মেলামেশা। এটাই হচ্ছে সে পথ, যার দ্বারা মানুষ খুব সহজেই নির্লজ্জ, বেহায়া
ও ব্যভিাচারে লিপ্ত হয়। জিন ও মানুষ প্রকৃতির শয়তানগুলো তাদের হাতিয়ার
হিসেবে এ অবাধ মেলামেশাকেই সর্বত্র ও সবখানে ব্যাপক করে চলেছে।
ইবনুল কাইয়ূম রহ. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষতি সম্পর্কে বলেন,
'নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সকল মুসিবত ও সর্বনাশের মূল। সর্বগ্রাসী মহা
বিপদের একটি অশনি সঙ্কেত। অধিকন্তু তা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলার
সৃষ্টি করে এবং অনেক হত্যা, অপমৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্ম দেয়। নবি মুসা
আ.-এর সৈন্যদের মাঝে কিছু বেশ্যা নারীর অনুপ্রবেশ ঘটলে তাদের মধ্যে
অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর মহামাড়ি
নাজিল করেন এবং একই দিনে সত্তুর হাজার লোকের মৃত্যু ঘটান। এটা বিভিন্ন
তাফসীর গ্রন্থের প্রসিদ্ধ ঘটনা। সুতরাং আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি যে,
মৃত্যুহার বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হচ্ছে যেনার বিস্তার ও তার প্রসার, যা
সাধারণত নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শন, নগ্ন ও
অর্ধনগ্নাবস্থায় নারীদের চলাফেরার কারণে হয়ে থাকে।' (আত্তুরুকুল
হিকমিয়্যাহ : ২৫৯)
প্রেম-ভালবাসা
মূলত ইমানের দুর্বলতার পরিচয়। কারণ, অন্তরে যখন ইমানের উপস্থিতি কম হয়,
তখনই প্রবৃত্তি ও কু-কামনা বৃদ্ধি পায়, বরং তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।'
(আল-ফাওয়ায়েদ : লি-ইবনিল কাইয়ূম-পৃ : ৭৫)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন, 'আল্লাহর
সঙ্গে যাদের ইখলাসপূর্ণ সম্পর্ক নেই, বরং তারা কোন না কোন শিরকে মগ্ন,
তারাই সাধারণত কামভাব ও কু-প্রবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তার বান্দা ইউসুফ
আ. সম্পর্কে বলেন,
'এভাবেই, যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয় সে আমার খালেস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।' (ইউসুফ : ২৪)
লক্ষ্যণীয়,
আজিজের স্ত্রী স্বধবা, তা সত্বেও সে কু-কর্মের প্রস্তাব দিয়েছে,
পক্ষান্তরে ইউসুফ আ. অবিবাহিত, তা সত্বেও সে তার প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান
করেছে। এদিকে আজিজের স্ত্রীর ফুসলানো, অন্য নারীদের দ্বারা প্ররোচিত করা,
প্রস্তাবে সাড়া না দিলে জেলখানায় নিক্ষেপের হুমকি তো রয়েছেই। এতো কিছুর
পরও আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক ও ইখলাসের বদৌলতে আল্লাহ তাকে হেফাজত করেছেন।
এভাবেই ইবলিসের বিপরীতে আল্লাহ তাআলা নিজ ওয়াদা পূরণ করে থাকেন। ইবলিস
বলেছিল,
'সে বলল, আপনার ইজ্জতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপদগামী করে ছাড়ব, তাদের মধ্য থেকে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া।' (সাদ : ৮২-৮৩) তার বিপরীতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
'নিশ্চয় আমার বান্দাদের ওপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই, তবে পথভ্রষ্টরা ছাড়া, যারা তোমাকে অনুসরণ করছে।' (হিজর : ৪২) বিপদগ্রস্ত ও পথভ্রষ্ট হওয়ার অর্থই হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা।' (মাজমূউল ফতওয়া : খ:১৫: পৃ:৪২১)
নারী প্রেম ও নারী আসক্তি ইহজাগতিক ও পরজাগতিক বহু বিপর্যয়ের কারণ
ইবনে জাওজী রহ. এসব বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন,
'নারী প্রেম ও নারী আসক্তির প্রায়শ্চিত্য বিভিন্ন প্রকার। কখনো ভোগ করতে
হয় সঙ্গে সঙ্গে কখনো দেরিতে, কখনো প্রকাশ পায় কখনো তা পায় না। আবার এর
কিছু শাস্তি রয়েছে যা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেও বুঝতে সক্ষম হয় না। তবে সব
চেয়ে বড় শাস্তি হচ্ছে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও ইমান বিলুপ্ত হওয়া। নারী
আসক্তি ও গুনাহের কারণে অন্তর মরে যায়, যার ফলে সে আল্লাহর সঙ্গে
মুনাজাতের স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হয় না, পবিত্র কুরআন তার অন্তরে
অবস্থান করে না। এস্তেগফারসহ অন্যান্য এবাদত তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। আরো
অনেক ধর্মীয় অবক্ষয় রয়েছে, যা তাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নেয়, যা সে
অনুধাবনও করতে পারে না। তার অন্তরের দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত হয় গুনাহের
অন্ধকার, নষ্ট হয়ে যায় তার অন্তর দৃষ্টি, যার প্রভাব পড়ে তার শরীরেও।
যেমন, চোখের দৃষ্টি চলে যায়, স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে ইত্যাদি। তাই অন্তরের
মধ্যে গুনাহের আসক্তি উপলব্দি করার সাথে সাথে তওবা করা, হয়তো এর দ্বারা
আসন্ন বিপদ দূরীভূত হয়ে যাবে।' (জাম্মুল হাওয়া : ২১৭)
অবৈধ ভালবাসা সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন,
'নারী কিংবা ছোট বাচ্চাদের আসক্তি ব্যক্তিকে এমন বিপর্যয়ে নিপতিত করতে
পারে, যার থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা কারো নেই। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ, তার
পূন্যের ভাণ্ডার একেবারে শূন্য হয়ে যায়। প্রথম পর্যায়ে কারো অন্তরে কোন
চেহারার আসক্তি সৃষ্টি হলে, দ্বিতীয় পর্যায়ে সে তার ভালবাসায় মগ্ন হয়ে
যায়। যার ফলশ্রুতিতে সে আস্তে আস্তে নানা অপকর্ম ও অপরাধে জড়িত হয়ে
পড়ে, যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে সব চেয়ে বড় মসিবত হচ্ছে
আল্লাহর রহমত থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়া। কারণ, বান্দা যখন আল্লাহর এবাদত ও
তার প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত থাকে, তখন তার কাছে আল্লাহর মহব্বতের চেয়ে মধুর ও
সুখকর কোন জিনিস হতে পারে না।' (মাজমুউল ফতওয়া : খ ১০, পৃ : ১৮৭)
তিনি আরো বলেছেন, গুনাহের প্রতি আসক্তি অন্তরের অন্যতম ব্যাধি, যা উন্মাদনার জন্ম দেয়। লুত আ.-এর জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
'তোমার জীবনের কসম, নিশ্চয় তারা তাদের নেশায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।' (হিজর : ৭২)
বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
'চোক্ষুদ্বয়ও যেনা করে, চক্ষুর যেনা হচ্ছে দৃষ্টি।'
অনেকেই প্রবৃত্তির তাড়নায় পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়, তাদের কথা শ্রবণ করে ও তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে চায়। আবার কেউ এর চেয়ে অগ্রগামী হয়ে র্স্পশ, চুম্মুন ও সংঘ লাভ করতে চায়। এসব কিছুই নিষিদ্ধ ও হারাম। এসব লোকদের ওপর শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাদের নমনীয় হতে ও দয়া দেখাতে নিষেধ করেছেন। (মুসলমানদের সরকার না থাকলে বা তাদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা না থাকলে) সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা, তাদেরকে এ থেকে নিষেধ করা ও তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। অতএব যেনার এসব প্রাথমিক কার্যাদি ও যেনার অন্যান্য সকল উপায়-উপকরণ ত্যাগ করা, তার থেকে দূরে থাকা সবার জন্য একান্ত জরুরি।' (মাজমুউল ফতওয়া : খ : ১৫ পৃ : ২৮৮, ২৮৯)
'চোক্ষুদ্বয়ও যেনা করে, চক্ষুর যেনা হচ্ছে দৃষ্টি।'
অনেকেই প্রবৃত্তির তাড়নায় পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়, তাদের কথা শ্রবণ করে ও তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে চায়। আবার কেউ এর চেয়ে অগ্রগামী হয়ে র্স্পশ, চুম্মুন ও সংঘ লাভ করতে চায়। এসব কিছুই নিষিদ্ধ ও হারাম। এসব লোকদের ওপর শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাদের নমনীয় হতে ও দয়া দেখাতে নিষেধ করেছেন। (মুসলমানদের সরকার না থাকলে বা তাদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা না থাকলে) সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা, তাদেরকে এ থেকে নিষেধ করা ও তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। অতএব যেনার এসব প্রাথমিক কার্যাদি ও যেনার অন্যান্য সকল উপায়-উপকরণ ত্যাগ করা, তার থেকে দূরে থাকা সবার জন্য একান্ত জরুরি।' (মাজমুউল ফতওয়া : খ : ১৫ পৃ : ২৮৮, ২৮৯)
ইবনুল
কাইয়ূম রহ. যেনা-ব্যভিচারের ক্ষতি, বিপর্যয় ও সর্বনাশ সম্পর্কে তার
লেখার অনেক জায়গায় আলোকপাত করেছেন। তিনি একজায়গায় বলেন,
'যেনা-ব্যভিচার সকল অপকর্ম ও অনিষ্টের মূল। ব্যক্তির দীনদারী, কৌলিণ্য,
সুস্থ রুচিবোধ ও আত্মমর্যাদা সব নিঃশেষ করে দেয় এ অপকর্মটি। ব্যভিচারীর
মধ্যে দীনদারী, ওয়াদা রক্ষা ও সততা থাকে-না বললেই চলে।
আরো কিছু ক্ষতিকর দিক হচ্ছে :
আল্লাহর নিদের্শ অমান্য করা ও তার সৃষ্ট প্রকৃতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি
করা। নিজ চেহারা কলুষিত করা এবং নিজকে চিন্তা ও পেরেশানীর ঘাটে উপস্থিত
করা। এর ফলে ব্যক্তির অন্তর কালো হয়, অন্তরদৃষ্টি লোপ পায়, সম্মানহানী
ঘটে, আল্লাহ ও মানুষের সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়, ভাল উপাধির পরিবর্তে খারাপ
উপাধিতে তাকে ডাকা হয়, তার অন্তর সংকীর্ণ ও কোনঠাসা হয়ে যায়, অনেকে সময়
সে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। সে আল্লাহর অবাধ্যতায়
লিপ্ত হয়ে জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে চায়, অথচ আল্লাহর নিকট হতে শান্তি
একমাত্র তার আনুগত্যের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব, তার অবাধ্যতা কখনো কোনো
কল্যান বয়ে আনতে পারে না।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৩৬০)
তিনি আরো বলেন,
'কর্ম অনুযায়ী ফলাফল দেয়া হয়। যে হারাম অশান্তির কারণ, সে হারামে লিপ্ত
ব্যক্তি অশান্তি থেকে মুক্ত হতে চাইলেও মুক্ত হতে পারবে না, বরং তার আরো
অশান্তি বৃদ্ধি পাবে। মৃত্যুর পরেও তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা হবে কবরে ও
আখেরাতে।
সহিহ বোখারিতে সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত হাদিসের কিছু অংশে বলা হয়েছে, রাসূল সা. বলেন,
'... রাতে দেখলাম দু'জন ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং আমাকে ঘর থেকে বের করে তাদের সাথে নিয়ে চলল, হটাৎ চুলোর আকৃতির মত একটি ঘর দেখলাম, ওপরের অংশ সরু মাঝখানের অংশ খুব প্রসস্ত, তার নিচে আগুন জ্বলছে, ভেতরে উলঙ্গ নারী ও উলঙ্গ পুরুষ। যখন আগুন প্রজ্বলিত হয়, তারা আগুনের সঙ্গে ওপরে উঠে যায়। মনে হয়, এই যেন তারা বাইরে ছিটকে পড়ল। আগুন নিস্তেজ হলে আবার তারা নিচে চলে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম : এরা কারা? উত্তর দিল, এরা ব্যভিচারী।' একটু চিন্তা করে দেখুন, দুনিয়ার অবস্থা ও পরকালের শাস্তির সাথে কি মিল! দুনিয়াতে তারা তওবা সত্বেও ফিরে আসতে পারত না, গুনা ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করেও তা রক্ষা করতে পারত না, প্রবৃত্তির লালসা মুক্ত হতে চেয়েও মুক্ত হতে পারত না, পুনরায় তাতে নিমজ্জিত হয়ে যেত, তাদের শাস্তিও সেরূপ হচ্ছে, দোজখ থেকে বের হওয়ার পথে এসেও বের হতে পারছে না। বরং পুনরায় তাতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৪৪২)
'... রাতে দেখলাম দু'জন ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং আমাকে ঘর থেকে বের করে তাদের সাথে নিয়ে চলল, হটাৎ চুলোর আকৃতির মত একটি ঘর দেখলাম, ওপরের অংশ সরু মাঝখানের অংশ খুব প্রসস্ত, তার নিচে আগুন জ্বলছে, ভেতরে উলঙ্গ নারী ও উলঙ্গ পুরুষ। যখন আগুন প্রজ্বলিত হয়, তারা আগুনের সঙ্গে ওপরে উঠে যায়। মনে হয়, এই যেন তারা বাইরে ছিটকে পড়ল। আগুন নিস্তেজ হলে আবার তারা নিচে চলে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম : এরা কারা? উত্তর দিল, এরা ব্যভিচারী।' একটু চিন্তা করে দেখুন, দুনিয়ার অবস্থা ও পরকালের শাস্তির সাথে কি মিল! দুনিয়াতে তারা তওবা সত্বেও ফিরে আসতে পারত না, গুনা ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করেও তা রক্ষা করতে পারত না, প্রবৃত্তির লালসা মুক্ত হতে চেয়েও মুক্ত হতে পারত না, পুনরায় তাতে নিমজ্জিত হয়ে যেত, তাদের শাস্তিও সেরূপ হচ্ছে, দোজখ থেকে বের হওয়ার পথে এসেও বের হতে পারছে না। বরং পুনরায় তাতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৪৪২)
আরেকটি
জায়গায় তিনি বলেছেন, 'জ্ঞানী ব্যক্তিদের জেনে নেয়া জরুরি,
প্রবৃত্তপূজারীগণ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, যেখানে কোনো স্বাদ তারা
পায় না, তা সত্বেও তারা তা ছাড়তে পারে না। কারণ, এটা তাদের জীবনের
অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ, যারা মাদকাসক্ত ও
যেনায় অভ্যস্ত তারা ঐ সব লোকদের ন্যায় সামান্য স্বাদও উপভোগ করতে পারে
না, যারা বিরতি দিয়ে, পর পর এসব অপরাধে লিপ্ত হয়।' (রওজাতুল মুহিব্বিন :
পৃ : ৪৭০)
শায়খ মুহাম্মদ খিজির হুসাইন লিখেছেন,
'ব্যভিচারের ক্ষতি অপরিসীম। এর অপকারিতা সুদূর প্রসারী : সম্মান নষ্ট হয়,
মর্যাদা নষ্ট হয়, নিরাপত্তার পরিবেশ বিঘ্ন হয়, পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট
হয় এবং নানা মরণ ব্যাধির জন্ম হয়। ব্যভিচারী অর্থাৎ যারা চরিত্রহীন,
সম্মানহীন, যাদের মধ্যে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই, যারা কাঁদা ছোড়াছুড়িতে
লিপ্ত, যাদের শরীর রোগা শোকা, তাদের আবার কিসের জীবন?' (রাসায়েলুল এসলাহ :
পৃ : ২৩)
নারী প্রীতির প্রতিকার
এ
পর্যন্ত আমরা প্রবৃত্তি প্রসংগ নিয়ে আলোচনা করলাম, যা অনেকটাই বিস্তারিত।
এখন আমরা এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ও মুক্ত হওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে
আলোচনা করব।
আবুলফারাজ
ইবনে জাওজি রহ. 'জাম্মুল হাওয়া' এবং ইবনুল কাইয়ূম রহ. 'রওজাতুল
মুহিব্বীন' নামক গ্রন্থে প্রবৃত্তির বিভিন্ন প্রকার ও প্রকৃতির ওপর
বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবনে জাওজি রহ. প্রবৃত্তির প্রত্যেক প্রকার আলাদা
আলাদা লিখে, আলাদা আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন : হারাম দৃষ্টি
প্রতিরোধের জন্য আলাদা চিকিৎসা, বেগানা নারীর সঙ্গ ত্যাগ করার আলাদা
চিকিৎসা ইত্যাদি। এভাবে ইবনে জাওজি রহ. প্রবৃত্তির প্রায় পঞ্চাশটি চিকিৎসা
পদ্ধতি সংক্ষেপে ও ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করেছেন।
এখানে
আমরা আবুলফারাজ রহ. এর পদ্ধতি অনুসরণ করে উল্লেখ করছি, তিনি বলেন, 'জেনে
রেখ! প্রেম ও মহব্বতের রোগ ভিন্ন ভিন্ন। সে হিসেবে তার চিকিৎসাও ভিন্ন
ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। সবেমাত্র প্রেমে-পড়া ব্যক্তি আর দীর্ঘ দিন থেকে
প্রেমে লিপ্ত ব্যক্তির চিকিৎসা এক নয়। তবে এটা ঠিক যে, প্রবৃত্তি ও প্রেম
যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ পর্যায়ে না পৌঁছুবে, ততক্ষণ তার চিকিৎসা সম্ভব। হ্যাঁ,
চুরান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে, তখন আর চিকিৎসা সম্ভব নয়। সেটা হচ্ছে পাগল ও
উন্মাদনার অবস্থা, যে অবস্থায় কোনো চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় না।' (জাম্মুল
হাওয়া : ৪৯৮)
তিনি
আরো বলেন, 'বার বার দৃষ্টির ফলে প্রেমিকার ছবি অন্তরে স্থীর হয়। যার
নিদর্শন : অন্তরে শুধু সে-ই সে বিদ্যমান থাকে, অন্তরে অন্তরে তাকে অবলোকন
করে, ঘুমে তাকে জড়িয়ে ধরে, একা একা তার সঙ্গে কথা বলে ইত্যাদি। জেনে রেখ!
এর কারণ হচ্ছে প্রেমিকাকে পাওয়ার বাসনা। আর এ পাওয়ার বাসনাই অন্তরের
একটি ব্যাধি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। লম্পট ও বখাটেরা সম্ভাব্য চাওয়া পাওয়ার
মধ্যেই লিপ্ত হয়, অসম্ভব নিয়ে তারা ব্যস্ত হয় না। কারণ, কেউ বাদশাহর
স্ত্রীকে দেখে তার সঙ্গে অন্তরের যোগসূত্র কায়েম করে না। কারণ, সে জানে এ
আশা কোনো দিন তার পুরণ হবে না, এখানে সে নিরাশ। সাধারণত যে যে জিনিসের
ব্যাপারে আশাবাদী হয়, সে ঐ জিনিস অর্জন করার জন্যই চেষ্টা করে। কোনভাবে তা
অর্জন করতে সক্ষম না হলে, আক্ষেপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরে।
এ
থেকে পরিত্রাণের উপায় : প্রেমিকা থেকে দূরে থাকার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা,
তার প্রতি দৃষ্টি না দেয়া, তাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়া, তার ব্যাপারে
নিরাশ হয়ে যাওয়া।' (জাম্মুল হাওয়া : ৫০১-৫০২)
আরেকটি
স্থানে তিনি বলেন : 'অন্তকরণ শুদ্ধ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, তুমি মনে কর
তোমার প্রেমিকা তোমার অন্তরের ধারণা অনুযায়ী বিদ্যমান নেই, তার ত্রুটিগুলো
নিয়ে তুমি চিন্তা কর। কারণ, মানুষের ভেতরটা নাপাকি ও বর্জ্যে ভরা। এর
মধ্যে প্রেমিক শুধু ভাল দিকটাই দেখে, তার প্রবৃত্ত তাকে প্রেমিকার খারাপ
বস্তুগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করতে দেয় না। দ্বিতীয়ত মানুষ স্বাভাবিক
অবস্থায় না থাকলে, প্রকৃত বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয় না। প্রবৃত্তি এমন
জিনিস যে, শ্রীহীন ও অসুন্দর প্রেমিকাকেও প্রেমিকের নিকট সজ্জিত করে পেশ
করে।
এ জন্যই ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন,
'তোমাদের কেউ যদি কোনো নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, সে যেন সঙ্গে সঙ্গে সে
নারীর বর্জ্য ও দুর্গন্ধ লাশের কথা চিন্তা করে।' (জাম্মুল হাওয়া : ৫৪৬-৫৪৭
সংক্ষিপ্ত)
ইবনে
কাইয়ূম রহ. এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ
করেছেন, তার কয়েকটি আমরা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, এ থেকে মুক্তি
পাওয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, যেমন 'এ কথা চিন্তা করা যে, আমাকে প্রবৃত্তির
গোলাম হওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, আমাকে আরো বড় কাজ ও দায়িত্বের জন্য
সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রবৃত্তির বিরোধিতা ভিন্ন সম্পাদন করা সম্ভব নয়।
যেমন কেউ বলেছে,
وقد هيؤوك لأمر لو فطنت له ু فاربأ بنفسك أن ترعى مع الهمل.
'সে
তোমাকে এমন এক মহৎ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছে, যদি তুমি জানতে! তুমি নিজের
ওপর রহম কর, অনর্থের পিছু নিয়ো না।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭২)
'প্রবৃত্তির
অনুসরণ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করা। কারণ, যে কেউ স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ
করেছে, সে নিজের মধ্যে অপমান বোধ করেছে। অতএব, প্রবৃত্তপূজারীদের দাপট ও
অহংকারের ধোঁকায় পতিত হওয়া সমীচিন নয়। তারা অন্তরের দিক হতে খুব নিচু,
তারা অপমাণিত। তারা দু'টি ঘৃণীত স্বভাবে অভিযুক্ত : অহংকার ও অপমান।'
(রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৩)
'
জেনে রাখা জরুরি যে, যে স্থানেই প্রবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সে স্থানেই
বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ইলমের সঙ্গে প্রবৃত্তির সংমিশ্রন হওয়ার ফলে
বেদআত ও গোমরাহীর জন্ম হয়েছে, এ প্রবৃত্তি দুনিয়ার মোহ ত্যাগকারীদের
মধ্যে প্রবেশ করে, তাদেরকে সুন্নতপরিপন্থী করে দিয়েছে, বাদশাদের দরবারে
প্রবেশ করে, তাদেরকে অত্যাচারী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বানিয়েছে, নিয়োগ
কমিটিতে প্রবেশ করে, তাদেরকে আল্লাহ ও মুসলমানদের সঙ্গে খেয়ানতকারী
বানিয়ে দিয়েছে, যার ফলে নিয়োগও প্রবৃত্তের জন্য বদলি-বাতিলও প্রবৃত্তের
জন্য।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৪)
'প্রবৃত্তির
সঙ্গে যুদ্ধ করা যদিও কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সমান নয়, তবু ছোটও নয়।
জনৈক ব্যক্তি হাসান বসরি রহ.-কে জিজ্ঞাসা করে ছিল, 'হে আবু সাইদের বাপ!
কোন্ জিহাদ সব চেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, প্রবৃত্তের সঙ্গে যুদ্ধ করা।
আমাদের উস্তাদ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-কে বলতে শুনেছি, 'কাফের,
মুনাফেকদের সাথে জেহাদ করার মূলেও প্রবৃত্তের সঙ্গে জেহাদ করা। কারণ, তাদের
সাথে জেহাদ করার আগে নিজের নফস ও প্রবৃত্তের সাথে জেহাদ না হলে, জেহাদের
জন্য বের হওয়াও সম্ভব হতো না।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৮)
'প্রবৃত্তের
অনুসরণ আল্লাহ প্রদত্ত্ব সাহায্যের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়, লাঞ্ছনার
দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়। প্রবৃত্তির অনুসারীরা বলে, যদি আল্লাহ তওফিক
দেয়, তবে এ করব, সে করব ইত্যাদি। অথচ সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে নিজের জন্য
তওফিকের দরজাসমূহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফুজায়েল ইবনে আয়াজ রহ. বলেন, যে
ব্যক্তির ওপর নফস্ ও প্রবৃত্তির অনুসরণ প্রবল হয়, তার জন্য তওফিকের
দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৯)
'প্রবৃত্ত
ও তওহিদ হচ্ছে দু'মেরুর দু'টি জিনিস। প্রবৃত্তি একটি মূর্তির ন্যায়, যার
অন্তরে প্রবৃত্তির পরিমাণ বেশী, তার অন্তরে এ মূর্তির অস্তিত্বও শক্তিশালী।
আল্লাহ তাআলা রাসূলদের মাটির তৈরি মূর্তি ভাঙ্গার জন্য ও এক আল্লাহর এবাদত
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরণ করেছেন। এর অর্থ এ নয় যে, মাটির তৈরী
মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলো আর অন্তরের মূর্তি গুলো রেখে দাও। বরং অন্তর থেকে
মূর্তি দূর করার নির্দেশই প্রথম। লক্ষ্য করুন ইবারিহমের বাণীর প্রতি।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
"যখন সে তার পিতা ও কওমকে বলল, 'এ মূর্তিগুলো কী, যেগুলোর পূজায় তোমরা রত রয়েছ'? (আম্বিয়া : ৫২) কি চমৎকার মিল! অন্তরে বিদ্যমান মূর্তি ও আল্লাহকে দিয়ে যেসব মূর্তির এবাদত করা হয় তার মাঝে।' (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ :৪৮১-৪৮২)
প্রত্যেক
ব্যক্তির একটি শুরু আছে, আরেকটি আছে শেষ। যার শুরু প্রবৃত্তি দিয়ে তার
শেষ হবে লাঞ্ছনা, অপমান, নৈরাশ্য ও মুসিবতের মাধ্যমে। প্রবৃত্তির অনুসরণ
অনুপাতে এর আকারও বেশী হতে থাকবে, অবশেষে এটি শাস্তিতে পরিণত হবে এবং তাকে
ভেতরে ভেতরে পুড়ে মারবে। যেমন কেউ বলেছেন,
'যৌবনে অনেক স্বপ্ন ও অনেক আশা ছিলো, যা বার্ধক্যে হতাশা ও অশান্তিতে পরিণত হয়েছে।'
মুসিবত
ও পতিত অবস্থার লোকদের পরখ করলে দেখা যাবে যে, তাদের শুরুটা হয়েছে
প্রবৃত্তির অনুসরণ ও বিবেককে বর্জন করার মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে যার শুরুটা
হবে প্রবৃত্তির বিরোধিতা ও বিবেকচালিত, তার শেষটাও হবে সম্মান ও মর্যাদার।
আল্লাহর নিকটে সে সম্মানিত, মানুষের নিকটও সে সম্মানিত। মাহলাব ইবনে আবু
সাকরকে প্রশ্ন করা হয়ে ছিলো, তুমি এ মর্যাদায় কিভাবে উন্নীত হয়েছ? তিনি
বলেন, বিবেকের অনুসরণ ও প্রবৃত্তের বিরুদ্ধাচারণ করে। এটা হচ্ছে দুনিয়ার
শুরু শেষ। পরকালের প্রতিদান হলো, যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ করবে,
তার স্থান জান্নাত আর যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুকরণ করবে, তার স্থান
জাহান্নাম।' (জাম্মুল হওয়া : ৪৮৩,৪৮৪)
মুদ্দা কথা : প্রত্যেক
রোগের ঔষধ রয়েছে, যে জানলো সে-তো জানলোই। আর যে জানলো না সে মুর্খই রয়ে
গেল। তবে, শেষ কথা হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ ধরনের প্রবৃত্তির জালে আবদ্ধ হয়ে
যায়, তার উচিত দেরি না করে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এর কিচিৎসায় লেগে
যাওয়া। ধৈর্যধারণ করা, ধৈর্যের আসবাব গ্রহণ করা এবং সম্মানজনক কাজে
ব্যাপৃত হওয়া, নোংরামি হতে দূরে থাকা, আল্লাহর সত্তাকে নিয়ে ধ্যানমগ্ন
হওয়া, নফস্কে প্রবৃত্তি, কু-বাসনা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাকা, নেককার
লোকদের সঙ্গ গ্রহণ করা, আল্লাহর দরবারে সর্বদা অবনত মস্তক হয়ে থাকা এবং
তার দরাবারে নিজেকে সর্বতোভাবে সোর্পদ করা।
সম্পদের লোভ
অনেকের
অন্তর সম্পদের মোহে মোহগ্রস্ত হয়ে আছে। সম্পদের মহব্বত তাদের অন্তরে
বদ্ধমূল হয়ে গেছে, টাকা-পয়সা তাদেরকে গোলামে পরিণত করেছে। তাদের উঠা-বসা,
ত্যাগ ও গ্রহণ সব কিছুতেই টাকা আর টাকা। তাদের সর্বদা একই ধ্যান, একই
চিন্তা, সম্পদ আর সম্পদ। সন্তুষ্ট হলেও সম্পদের জন্য, গোস্বা করলেও সম্পদের
জন্য, তাদের মহব্বতও সম্পদের জন্য, শত্রুতাও সম্পদের জন্য।
আল্লাহ তাআলা কুরআনের অনেক জায়গায় দুনিয়ার খারাপি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। যেমন, তিনি বলেন,
'আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।' (আল-হাদিদ : ২০)
'তোমরা জেনে রেখ যে, দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য।' (আল-হাদিদ : ২০)
দুনিয়ার
অসারতা ও খারাপি সম্পর্কে হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে। যেমন, আবু
সাইদ খুদরি রা. বলেন, রাসূল সা. একদিন মেম্বারে বসলেন, আমরা তার চার পাশে
বসলাম। তিনি বললেন,
'তোমাদের জন্য দুনিয়ার যে সম্পদ ও চাকচিক্যের ভান্ডার উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, আমি শুধু তার ভয় করি।' (বোখারি ও মুসলিম)
'তোমাদের জন্য দুনিয়ার যে সম্পদ ও চাকচিক্যের ভান্ডার উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, আমি শুধু তার ভয় করি।' (বোখারি ও মুসলিম)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সা. বলেন,
'টাকা-পয়সা ও পোশক-আশাকের বৃত্তরা নিপাত যাক। তারা পেলে খুশি হয়, না পেলে বেজার হয়।' (বোখারি)
'টাকা-পয়সা ও পোশক-আশাকের বৃত্তরা নিপাত যাক। তারা পেলে খুশি হয়, না পেলে বেজার হয়।' (বোখারি)
কাব ইবনে আয়াজ রা. বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি,
'প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফেত্না রয়েছে, আমার উম্মতের ফেত্না হচ্ছে সম্পদ।' (তিরমিজি)
'প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফেত্না রয়েছে, আমার উম্মতের ফেত্না হচ্ছে সম্পদ।' (তিরমিজি)
কাব ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,
'ক্ষুধার্ত দু'টি নেকড়ে বাঘ বকরির পালে ছেড়ে দেয়া যে পরিমাণ বিপদজনক, দীনের জন্য তার চেয়েও বেশী বিপদজনক সম্পদ ও সম্মানের মোহ।' (তিরমিজি)
'ক্ষুধার্ত দু'টি নেকড়ে বাঘ বকরির পালে ছেড়ে দেয়া যে পরিমাণ বিপদজনক, দীনের জন্য তার চেয়েও বেশী বিপদজনক সম্পদ ও সম্মানের মোহ।' (তিরমিজি)
হাসান বসরি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'তোমরা
দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে বিরত থাক। কারণ, দুনিয়ার ব্যস্ততার শেষ নেই। যে
ব্যক্তি দুনিয়ার ব্যস্ততার একটি দরজা উন্মুক্ত করবে, খুব সম্ভব তার এ একটি
দরজা আরো দশটি ব্যস্ততার দরজা উন্মুক্ত করবে।' (জুহুদের কিতাবে ইবনে
মুবারক বর্ণনা করেছেন।)
তিনি আরো বলতেন,
'দুনিয়াকে অবজ্ঞা কর, আল্লাহর কসম করে বলছি, তুমি যদি তাকে অবজ্ঞা করতে
পার, তবে তুমি পরিতৃপ্ত হয়ে যাবে।' (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৫৭৯) তিনি
শপথ করে বলতেন, 'যে ব্যক্তি অর্থকে বড় করে দেখেছে, আল্লাহ তাকে অপমান
করেছেন।' (আবু নাইম ফিল হিলইয়া : ২/১৫২ সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৫৭৬)
ইবনে
কাইয়ূম রহ. এর ওপর সুন্দর একটি আলোচনা করেছেন, যা দুনিয়ার প্রতি অনিহা ও
আখেরাতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য খুবই কার্যকর। এখানে আমরা তা
উপাস্থাপন করছি : 'দুনিয়া ত্যাগ করার ইচ্ছা ছাড়া আখেরাতের প্রতি আগ্রহ
সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। আবার দুনিয়ার প্রতি অনিহা সৃষ্টি করার জন্য দু'টি
বিষয়ের ওপর চিন্তা করা খুবই জরুরি।
প্রথম বিষয় : দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, ধ্বংশীল, অসম্পূর্ণ জ্ঞান করা এবং তার নিকৃষ্টতার দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করা। দুনিয়ার ব্যাপারে প্রতিযোগিতার ফলাফল ও তার প্রতি লোভের বিষাদ নিয়ে চিন্তা করা। এবং এর মধ্যে যে দুঃখ, যন্ত্রণা, প্রতিকুলতা ও পেরেশানী রয়েছে তা নিয়েও চিন্তা করা। আরো চিন্তা করা যে, দুনিয়ার চিরন্তন স্বভাব হচ্ছে দুঃখ, দুর্দশা রেখে পিছু হটা ও প্রস্থান কর। দুনিয়া অন্বেষণকারী দুনিয়া অর্জন করার আগে এক ধরণের দুশ্চিন্তায় ভোগে আর অর্জন করার পর আরেক ধরণের দুশ্চিন্তায় ভোগে, আবার হাত ছাড়া হয়ে গেলে তৃতীয় ধরণের দুশ্চিন্তায় ভোগে। এ হলো প্রথম বিষয়।
প্রথম বিষয় : দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, ধ্বংশীল, অসম্পূর্ণ জ্ঞান করা এবং তার নিকৃষ্টতার দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করা। দুনিয়ার ব্যাপারে প্রতিযোগিতার ফলাফল ও তার প্রতি লোভের বিষাদ নিয়ে চিন্তা করা। এবং এর মধ্যে যে দুঃখ, যন্ত্রণা, প্রতিকুলতা ও পেরেশানী রয়েছে তা নিয়েও চিন্তা করা। আরো চিন্তা করা যে, দুনিয়ার চিরন্তন স্বভাব হচ্ছে দুঃখ, দুর্দশা রেখে পিছু হটা ও প্রস্থান কর। দুনিয়া অন্বেষণকারী দুনিয়া অর্জন করার আগে এক ধরণের দুশ্চিন্তায় ভোগে আর অর্জন করার পর আরেক ধরণের দুশ্চিন্তায় ভোগে, আবার হাত ছাড়া হয়ে গেলে তৃতীয় ধরণের দুশ্চিন্তায় ভোগে। এ হলো প্রথম বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয় :
আখেরাতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া। আখেরাতের এগিয়ে আসা ও তার আবশ্যকতার নিয়ে
চিন্তা করা। আরো চিন্তা করা যে, আখেরাত স্থায়ী, তার সম্মান, ইজ্জতও
স্থায়ী। সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সুখ ও কল্যানের কথা চিন্তা করা এবং দুনিয়ার
সাথে তার পার্থক্যের ব্যবধান সম্পর্কে ফিকির করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
'অথচ আখেরাত সর্বোত্তম ও স্থায়ী।' (সুরায়ে আলা : ১৭)
মূলত আখেরাতের কল্যানই পরিপূর্ণ ও স্থায়ী, দুনিয়ার কল্যান ক্ষণস্থায়ী, অসম্পূর্ণ ও কাষ্টসাধ্য।
তিনি
আরো বলেন, 'অধিকন্তু আল্লাহ সে ব্যক্তির ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ
করেছেন যে, ব্যক্তি দুনিয়াকে নিয়ে সন্তুষ্ট, পরিতৃপ্ত ও আল্লাহর নিদর্শন
এবং তার সাক্ষাতের ব্যাপারে উদাসীন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
'নিশ্চয়
যারা আমার সাক্ষাতের আশা রাখে না এবং দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছে ও
তা নিয়ে পরিতৃপ্ত রয়েছে। আর যারা আমার নিদর্শনাবলী হতে গাফেল, তারা যা
উপার্জন করত, তার কারণে আগুনই হবে তাদের ঠিকানা।' (ইউনুস : ৭-৮)
যে সকল মুমিন পার্থিব জীবন নিয়ে পরিতৃপ্ত তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ বলেন,
'
হে ইমানদারগণ! তোমাদের কি হল, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায়
(যুদ্ধে) বের হও, তখন যমীনের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা
আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের
ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।' (তওবা : ৩৮)
দুনিয়ার
নিরাগ্রহের অনুপাতে আল্লাহর আনুগত্য ও আখেরাতের আগ্রহের সৃষ্টি হয়। যার
দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ কম, আখেরাতের প্রতি তার আগ্রহ বেশী।
দুনিয়া ত্যাগ করার জন্য উপদেশ হিসেবে আল্লাহর এ বাণীই যথেষ্ট :
'তুমি
কি লক্ষ্য করেছ, আমি যদি তাদেরকে দীর্ঘকাল ভোগ-বিলাসের সুযোগ দিতাম। অতঃপর
তাদেরকে যে বিষয়ে ওয়াদা করা হয়েছে, তা তাদের নিকট এসে পড়ত, তখন যা
তাদের ভোগ-বিলাসের জন্য দেয়া হয়েছিল, তা তাদের কোনই কাজে আসত না।' (শুআরা
: ২০৫-২০৭) (আল-ফাওয়ায়েদ : ৮৭-৮৯ সংক্ষিপ্ত)
উত্তাতুস্সাবিরীন নামক কিতাবে ইবনুল কাইয়ূম লিখেছেন :
'যে সকল উম্মত ও জাতি নবিদের প্রত্যাখ্যান করেছে ও তাদের মিথ্যারোপ করেছে,
তাদের মূল সমস্যা ছিল দুনিয়ার মোহ ও তার মহব্বত। কারণ, নবিগণ তাদেরকে
গুনাহ থেকে ও অবৈধ পন্থায় সম্পদউপার্জন থেকে বিরত থাকতে বলতেন। বলাবাহুল্য
পার্থিব সকল অনাচারের মূল হচ্ছে দুনিয়ার মহব্বত। সম্পদ ও পদের মহব্বতের
কারণেই জাহান্নামের হালে পানি পাবে। অর্থাৎ জাহান্নামীরা একারণেই
জাহান্নামী হবে। এর বিপরীতে দুনিয়ার প্রতি অনিহা ও পদের নির্মোহ জান্নাত
লাভের উপায় হবে। দুনিয়ার মোহ মাদকের চেয়েও মারাত্বক ও ক্ষতিকর। যে মোহ
থেকে চেতনা ফিরে পাওয়া, কবরের ঘোর অন্তকারের আগে প্রায় অসম্ভব। মালেক ইবনে দিনার বলতেন : 'ভেলকিবাজ যাদুকর থেকে নিরাপদ থাক, ভেলকিবাজ যাদুকর থেকে নিরাপদ থাক। কারণ, তা আলেমদের অন্তর মোহগ্রস্ত করে ফেলে।'
দুনিয়ার
মোহের সব চেয়ে কম ক্ষতির দিকটি হচ্ছে, আল্লাহর জিকির ও তার মহব্বত থেকে
দূরে সরে যাওয়া। যার সম্পদ তাকে আল্লাহর মহব্বত থেকে বিরত রাখলো সে
ক্ষতিগ্রস্ত। বান্দা যখন আল্লাহর জিকির হতে বিরত থাকে শয়তান তখন সেখানে
নিজ অবস্থান দৃঢ় করে এবং তাকে নিয়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানেই চলে যায়।'
(উত্তাতুস্সাবিরীন : পৃ : ১৮৫-১৮৬ সংক্ষিপ্ত)
হয়তো
এ জন্যই ওলামায়ে কেরাম পার্থিব জগতে মগ্ন হওয়া ও তার থেকে উপকৃত হওয়াকে
নিন্দার চোখে দেখেছেন। তারা এর প্রতি ভাল দৃষ্টি দেয়া এবং তাতে ঝুঁকে
পড়াকেও ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন : 'বৃক্ষ,
ঘোড়া ও পশুর দিকে দুনিয়া এবং তার নেতৃত্বের মোহ নিয়ে দৃষ্টি দেয়াও
খারাপ। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
'আর
তুমি কখনো প্রসারিত করো না তোমার দু'চোখ সে সবের প্রতি, যা আমি তাদের
বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের জাঁক-জমকস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে
দিয়েছি। যাতে আমি সে বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমার রবের
প্রদত্ত রিয্ক সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিকতর স্থায়ী।' (ত্বহা : ১৩১)
হ্যাঁ,
যদি সম্পদের প্রতি এমন ঝোঁক থাকে যাতে দীনের কোন ক্ষতি নেই, যেমন
আত্মতৃপ্তি বা বিনোদনের জন্য, এটাও খারাপ, বরং একটা বাতেল বস্তুর মাধ্যমে
স্বার্থ সিদ্ধির বাহানা বৈ আর কিছু নয় এটা। (মিসরে সংকলিত ফতওয়া হতে: পৃ :
২৯ সংক্ষিপ্ত) ইজ ইবনে আবদুসসালাম লিখিত শাজারাতুল মাআরেফ ও আল-আহওয়াল :
পৃ : ৭)
সম্পদের মোহ দু'ধরনের :
হাফেজ ইবনে রজব রহ. বলেন,
প্রথমত : বৈধ সকল উপায়ে সম্পদ উপার্জন করার মোহ। এতে যদিও অন্য কোন ক্ষতি
নেই, তবুও মূল্যবান সময় ও জীবনকে এমন জিনিসের পিছনে ক্ষয় করার আফসোসই কম
কিসের! যার কোন মূল্য নেই। অথচ সে এ জীবন দ্বারা সম্মান, নেয়ামত ও
স্থায়ী জান্নাত অর্জন করতে সক্ষম ছিল। তা-না-করে বরং, নির্ধারিত রিজিকের
জন্য, যা কম-বেশী হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই, তার পেছনে জীবন ক্ষয় করেছে।
উপরন্তু সে এর দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না, বরং অন্যদের জন্য রেখে যাবে। সে এ
সম্পদ পরিত্যাগ করে যাবে, আর অন্যরা এর সুফল ভোগ করবে, হিসাব দেবে সে আর
ভোগ করবে অন্যরা। যারা তার বদনাম রটাবে তাদের জন্য রেখে যাবে সে এ সম্পদ।
সম্পদের খারাবির জন্য এটাই যতেষ্ট।
মুদ্দাকথা : লোভীরা তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে, এমন সম্পদ উপার্জন করার জন্য, যার দ্বারা উপকৃত হবে তাদের ভিন্ন অন্য কেউ।
দ্বিতীয়ত :
উল্লেখিত মুসিবতের সঙ্গে সে এক সময় হারাম ও অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনে
মগ্ন হয়ে যাবে, প্রয়োজনের স্থানে অর্থ ব্যয়ে কার্পন্য করবে, আর এটাই
হচ্ছে ঘৃণিত একটি দোষ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
'আর যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়, তারাই মূলত সফলকাম।' (তাগাবুন : ১৬)
জাবের রা. থেকে সহিহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,
'তোমরা কার্পণ্য থেকে দূরে থাক, এ কার্পণ্যই তোমাদের পূর্ব পুরুষদের ধ্বংস করেছে। এর কারণে তারা আপোষে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়েছে, হারাম কাজকে বৈধ বানিয়েছে।' (মুসলিম)
'তোমরা কার্পণ্য থেকে দূরে থাক, এ কার্পণ্যই তোমাদের পূর্ব পুরুষদের ধ্বংস করেছে। এর কারণে তারা আপোষে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়েছে, হারাম কাজকে বৈধ বানিয়েছে।' (মুসলিম)
হ্যাঁ,
সম্পদের সে মোহ নিন্দনীয়, যার কারণে গুনাহে লিপ্ত হওয়ার বা ফরজ-ওয়াজিব
তরক করার সম্ভাবনা থাকে। এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবেন তাইমিয়া রহ. বলেন,
'সম্পদ ও পদের মোহ দীনদারী খতম করে দেয়, সম্পদের যে মোহ গুনাহ, জুলুম,
মিথ্যা ও অপরাধ প্রবণ করে তোলে, সে মোহ শাস্তিযোগ্য। সাধারণত সম্পদ ও পদের
অধিক মোহ এদিকেই নিয়ে যায়। এর বিপরীতে সম্পদের যে মোহ আল্লাহর আদেশ ও
নিষেধ পালনে সাহায্যকারী হয় এবং আল্লাহর ভয় সৃষ্টি ও প্রবৃত্তি মোকাবিলার
জন্য সহায়ক হয়, সম্পদের সে মোহ দোষণীয় নয়।
যে
ব্যক্তি সম্পদের হক আদায় করে হালাল পন্থায় সম্পদ উপার্জন করবে, আল্লাহ
তাকে শাস্তি দেবেন না। তবুও, অতিরিক্ত সম্পদ না রাখা এবং প্রয়োজন মোতাবেক
সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই নিরাপদ। এতে চিন্তা কম হয়, অন্তর প্রফুল্ল
থাকে, যা ইহজগত ও পরজগতের জন্য খুবই উপকারী। রাসূল সা. বলেছেন :
যে ব্যক্তি দুনিয়া দুনিয়া করে প্রত্যুষ করল, আল্লাহ তার সমস্ত কাজ বিক্ষিপ্ত করে দেবেন, তার চোখের সামনেই অভাব এনে দাঁড় করাবেন। তবে, রিজিক তার সে পরিমাণই জুটবে, যে পরিমাণ তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আখেরাতের চিন্তা নিয়ে প্রত্যুষ করবে, আল্লাহ তার অন্তর অভাব মুক্ত করে দেবেন, তার সমস্ত কাজ সুশৃঙ্খল করে দেবেন, তার অনিচ্ছ সত্বেও দুনিয়া তার কাছে ধরা দিবে।' (তিরমিজি)
(মিসরের সংকলিত ফতওয়া : পৃ : ৪৯৩ ও ৯৫ সংক্ষিপ্ত। মাজমুউল ফতওয়া : ১০/১৮৯-১৯০ এবং সংক্ষিপ্ত মিনহাজুল কাসেদিন : পৃ : ১৯৫)
যে ব্যক্তি দুনিয়া দুনিয়া করে প্রত্যুষ করল, আল্লাহ তার সমস্ত কাজ বিক্ষিপ্ত করে দেবেন, তার চোখের সামনেই অভাব এনে দাঁড় করাবেন। তবে, রিজিক তার সে পরিমাণই জুটবে, যে পরিমাণ তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আখেরাতের চিন্তা নিয়ে প্রত্যুষ করবে, আল্লাহ তার অন্তর অভাব মুক্ত করে দেবেন, তার সমস্ত কাজ সুশৃঙ্খল করে দেবেন, তার অনিচ্ছ সত্বেও দুনিয়া তার কাছে ধরা দিবে।' (তিরমিজি)
(মিসরের সংকলিত ফতওয়া : পৃ : ৪৯৩ ও ৯৫ সংক্ষিপ্ত। মাজমুউল ফতওয়া : ১০/১৮৯-১৯০ এবং সংক্ষিপ্ত মিনহাজুল কাসেদিন : পৃ : ১৯৫)
সম্পদের
ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাই উত্তম। অর্থাৎ সব সামর্থ্য দিয়ে সম্পদে
আপাদ-মস্তক মগ্ন না হওয়া, আবার নাক ছিটকানো ভাব নিয়ে অর্থ-বিত্ত একেবারে
পরিহার না করা। আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল সা. আমাদের
মাঝে দাঁড়িয়ে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, 'না, আমি
তোমাদের ওপর দুনিয়ার চাক্যচিক্য ও বিত্ত-বৈভব ছাড়া অন্য কিছুর আশংকা করি
না।' এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, 'হে আল্লাহর রাসূল! কল্যাণও কি অকল্যাণ
নিয়ে আসে? রাসূল সা. কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। অতঃপর বললেন, কি বললে? অতঃপর সে
বলল, আল্লাহর রাসূল! কল্যাণও কি অকল্যাণ নিয়ে আসে? রাসূল সা. বললেন,
'কল্যাণ অকল্যাণ নিয়ে আসে না। তবে, বসন্তে জন্মানো গুল্ম অতিভোজনের ফলে
অনেক পশুর পেট ফেটে মৃত্যু ঘটে, কোনটি আবার মৃত্যুর দোড়ঘোড়ায় পৌঁছে
যায়। হ্যাঁ, যে পশু উদ্ভীত ও লতা প্রয়োজন অনুপাতে ভক্ষণ করে, ভক্ষণ শেষে
তা হজম করার জন্য সূর্যের দিকে মুখ করে বসে পড়ে, অতঃপর পায়খানা-পেসাব করে
পেট খালী করে, আবার প্রয়োজন হলে ভক্ষণ করে, তার কথা ভিন্ন। সুতরাং যে
ব্যক্তি বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করবে, তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হবে। এর
বিপরীতে যে ব্যক্তি অন্যায় পন্থায় সম্পদ অর্জন করবে, তার উদাহরণ ঐ
ব্যক্তির ন্যায়, যে খায় কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না।' (বোখারি, মুসলিম)
এ
হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনুল কাইয়ূম রহ. সম্পদের মধ্যম পন্থার একটি সুন্দর
বক্তব্য পেশ করেছেন। 'বসন্তের গুল্ম খেয়ে কোন পশু মারা যায়, আবার কোনটা
মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে যায়।' এ থেকে তিনি বলেন, এটি প্রয়োজন মোতাবেক
দুনিয়া অর্জন ও ভারসাম্য রক্ষা করে তাতে আত্মনিয়োগ করার সুন্দর একটি
উদাহরণ। কতক পশু বসন্তের লতাগুল্ম দেখে চোখের ক্ষুধায় খেতে থাকে, এক সময়
অতিভোজনের ফলে পেট ফেটে বা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তদ্রূপ সম্পদের লোভ
কতক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় বা মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে যায়। সম্পদের
জন্য অনেক বিত্তবান যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, অন্যায় অত্যাচারও করেছে।
পক্ষান্তরে যে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ অর্জন করে, তার উদাহরণ হচ্ছে ঐ
বকরির ন্যায় যে তার পেট ভরা পর্যন্ত ভক্ষণ করে।
হাদিসের বাক্য, 'সূর্যের দিকে মুখ করে বসে পড়ে, পায়খানা করে ও পেসাব করে।' এখানে তিনটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে :
১. প্রয়োজন অনুযায়ী খানা শেষে গুল্ম ত্যাগ করা ও সূর্যের দিকে মুখ করে বসে পড়া এবং ভক্ষিত গুল্মের স্বাদ আস্বাদন করা।
২.
যে পরিমাণ লতা-গুল্ম উপকারী ছিল তা ভক্ষণ করে বিরত থাকা অতঃপর উপকারী কোন
জিনিসে মগ্ন হওয়া। অর্থাৎ পশুর সূর্যের দিকে মুখ করে বসে পড়া। কারণ,
সূর্যের তাপের ফলে তার খাদ্য হজম হয় ও সহজে পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের
হয়।
৩.
পশুর পায়খানা-পেসাবের মাধ্যমে হজম করা খাদ্য বের করে দেয়া। এটা আরামের
জন্য খুবই জরুরি। তদ্রুপ, যারা সম্পদ উপর্জনে মগ্ন তাদেরও এমন করা উচিত
যেমনটি করে থাকে পশু।
এ
হাদিস দ্বারা যেমন, অধিক সম্পদ জমা করা ও তার ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া
হয়েছে, তদ্রুপ সম্পদ ত্যাগ করা ও সম্পদ না থাকার ফলে সম্ভাব্য বিপদ
সম্পর্কেও ধারণা দেয়া হয়েছে। যে পরিমাণ সম্পদ শরীর-দেহ-মন সুস্থ রাখার
জন্য প্রয়োজন, সে পরিমাণ জমা করা এবং অতিরিক্ত সম্পদ সদকা বা প্রয়োজনে
খরচ করা। ক্ষতির কারণ হতে পারে এ পরিমাণ সম্পদ জমা না করা।'
(উত্তাতুস্সাবিরীন : পৃ : ১৯৮, ১৯৯ সংক্ষিপ্ত)
এ
আলোচনার মাধ্যমে সম্পদের ব্যাপারে মধ্যমপন্থা কোনটি তা নির্ণয় হয়েছে বলে
আমি আমার বিশ্বাস। তাই বলছি, দীনের দায়ী ও আলেমদের উচিত এ পরিমাণ সম্পদ
উর্পাজন করা, যা দ্বারা তাদের সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব হয় ও
পরমুখিতা দূর হয়। যেমন ছিলেন আমাদের আদর্শ পূর্বপুরুষগণ। তারা ছিলেন
প্রয়োজনীয় সম্পদ অর্জনে যত্নশীল, আরো ছিলেন দুনিয়াত্যাগী ও অল্পে তুষ্ট।
কারণ, আলেমদের জনসাধারণ হতে এবং বিশেষ করে আমীর ও নেতৃস্থানীয় লোকদের
থেকে অভাবমুক্ত থাকা খুব জরুরি। বরং এটা তাদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার
হাতিয়ার।
সুফিয়ান সওরি রহ. বলেন,
'আমার দশ হাজার দেরহাম এমন রেখে যাওয়া, যে সম্পর্কে আমাকে জবাবদিহি করতে
হবে, আমার কাছে পছন্দনীয়, মানুষের দারস্থ হওয়ার তুলনায়। আমাদের কাছে এ
টাকা পয়সা না থাকলে ঐ সমস্ত আমীর-উমারারা আমাদের হাতের রোমালে পরিণত
করতো।' (আল-হিলইয়া- আবু নাইম : ৬/৩৮১)
ইবনে
জওজি রহ. আলেমদের অভাবমুক্ত হওয়ার জন্য সম্পদ উপার্জনের প্রতি উৎসাহ
দিয়ে বলেন, 'আলেমদের মানুষ থেকে অভাবমুক্ত হওয়ার জন্য সম্পদ জমা করার কোন
বিকল্প নেই। কারণ, যখন সে ইলম শিখেছে তার মধ্যে পূর্ণতা এসেছে। তবে, এটাও
ঠিক যে, অনেক আলেমই ইলমের জন্য সম্পদ উপার্জন করতে পারেননি। অবশেষে বিশেষ
প্রয়োজনে সম্পদের অর্জন করতে গিয়েছেন, আর এখানেই তাদের অনেকের বিচ্যুতি
ঘটেছে। যদিও কেউ কেউ অনেক হিলা-বাহানার আশ্রয় নেয়।
আমরা
অনেক সূফি ও আলেমদের দেখেছি, যারা আমির-উমারাদের নিকট জড়ো হয়ে থাকতেন,
শুধু তাদের থেকে কিছু পাওয়ার আশায়। এ জন্য কেউ তোষামোদ ও লৌকিকতায় লিপ্ত
হয়েছেন, কেউ নাজায়েজ প্রসংশা করেছেন, কেউ বাদশাহর অন্যায় দেখেও নিশ্চুপ
থেকেছেন, যার একমাত্র কারণ ছিল অভাব। আমাদের নিজ অভিজ্ঞতার কথা বলছি,
জালেম বাদশাহ থেকে দূরে থাকার মধ্যেই প্রকৃত সম্মান অর্জন সম্ভব। আর এটা
দু'প্রকার লোকেরাই করতে পারে।
প্রথম প্রকার :
যাদের সম্পদ রয়েছে। যেমন, সাঈদ ইবেন মুসাইয়েব, তিনি তেল ইত্যাদির
ব্যাবসা করতেন। সুফিয়ান সওরি রহ., তিনি বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করতেন ও
ইবনে মুবারক।
দ্বিতীয় প্রকার : যারা সামান্য রিজিক সত্ত্বেও তুষ্ট থাকার ক্ষমতা রাখেন। যেমন, ছিলেন বিশির হাফি ও আহমদ ইবনে হাম্বল।
মানুষ
যখন ধৈর্য হারা হবে এবং তাদের মাঝে পরিপক্ক ইমান না থাকবে, তখন তারা অভাব
অনটনে বিভিন্ন পরীক্ষা, কষ্ট ও মুসিবতের সম্মুখিন হবে। অনেক সময় তারা দীনও
বরবাদ করে ফেলবে।
হে
তালেবে এলম ভাই! মানুষ থেকে অভাব মুক্ত হওয়ার জন্য তোমার সম্পদ জমা করা
একান্ত জরুরি, এ সম্পদ তোমার দীন হেফাজত করবে। কারণ, অনেক দীনদার ও দুনিয়া
বিমুখদের দেখেছি, তারা একমাত্র অভাবের কারণে কপটতার আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক
আলেম শুধু অর্থ লোভের কারণেই বিপদে পতিত হয়েছে, যার মূল হচ্ছে অভাব।
পক্ষান্তরে যে জরুরি সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অর্থ লোভের জন্য এ সব ঘৃণ্য পন্থা
অবলম্বন করে, সে আলেমদের দল থেকে খারিজ।' (মাজিবান হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ
: ৭ ও ১৩ পৃ.)
মুদ্দাকথা :
প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এ পরিমাণ সম্পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। অর্থাৎ যে
পরিমাণ সম্পদ হলে পানাহার, পরিচ্ছদ ও বাসস্থান ইত্যাদির প্রয়োজন পূরা হয়ে
যায়। এর জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা এবং তার নিকট রুজু করা। খবরদার!
কখনো মানুষের নিকট সম্পদ চাইবে না, উপায় না থাকলে ভিন্ন কথা, বা তাদের
কাছে আশা পোষণ করবে না।
তবে,
প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদের জন্য কষ্টক্লেশ করা অর্থহীন। অনেকে এ জন্য
সম্পদের গোলাম ও তার দাসে পরিণত হয়, অথচ রিজিক তাই অর্জন হয়, যা ভাগ্যে
লেখা রয়েছে। অনেকে আবার এ জন্য অবৈধ পন্থা ও অসুদুপায় অমলম্বন করে, অনেক
জরুরি খাতে ব্যায় করা থেকে বিরত থাকে।
ক্ষমতার মোহ
ক্ষমতা
ও পদের মোহ ঐ সব প্রবৃত্তের একটি যা মানব জাতির বড় একটি অংশকে দাসে পরিণত
করে রেখেছে। তাদের অন্তরসমূহ এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে গেছে।
ক্ষমতা, পদের মোহ, প্রসিদ্ধি লাভ ও খ্যাতি অর্জন ইত্যাদি তাদের উদ্দেশ্য ও
অভিষ্ট লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
ইতিপূর্বে কাব ইবনে মালেক রা. এর একটি হাদিসে জেনেছি, রাসূল সা. বলেছেন,
'দু'টি ক্ষুধার্ত বাঘ বকরির পালে ছেড়ে দেয়ার ফলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, সম্পদ ও পদের মোহের কারণে ব্যক্তির ধর্ম তার চেয়েও বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।' (তিরমিজি)
'দু'টি ক্ষুধার্ত বাঘ বকরির পালে ছেড়ে দেয়ার ফলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, সম্পদ ও পদের মোহের কারণে ব্যক্তির ধর্ম তার চেয়েও বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।' (তিরমিজি)
ইবনে রজব রহ. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,
'রাসূল সা. জানিয়ে দিয়েছেন যে, দু'টি ক্ষুধার্ত বাঘ বকরির পালে ছেড়ে
দিলে যে পরিমাণ ক্ষতি করবে, সম্পদ ও পদের মোহ ব্যক্তির ধর্মকে তার থেকে কম
ক্ষতি করবে না। ক্ষতির পরিমাণ হয়তো সমান কিংবা তার চেয়েও বেশী হতে পারে। এ
হাদিস দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সম্পদ ও পদের মোহের সঙ্গে ব্যক্তির ধর্ম
খুব ক্ষীণ অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। যেমন ক্ষুধার্ত বাঘ বকরির পালে ছেড়ে
দিলে মাত্র কয়েকটি বকরির বেচে যাওয়ার সম্ভাবনাই বিদ্যমান থাকে। সম্পদ ও
পদের মোহ ত্যাগ করার জন্য এ উদাহরণটি উপদেশমূলক।
ইবনে রজব রহ. আরো বলেন,
তবে ক্ষমতার মোহ সম্পদের মোহের চেয়েও বেশী ক্ষতিকর। কারণ, দুনিয়ার
সম্মান, তার বড়ত্ব, মানুষের ওপর প্রাধান্য বিস্তার এবং পৃথিবীর বুকে একক
ক্ষমতা অর্জনের বাসনা সম্পদের লোভের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এর ক্ষতি সব চেয়ে
বড়, এর থেকে বিরত থাকা সব চেয়ে বেশী কঠিন। অধিকন্তু সম্পদ অন্বেষণ করার
মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতা ও সম্মান।' (মাজিবান হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ :৭ ও
১৩ পৃ.)
অতঃপর তিনি সম্পদের মোহের বিভিন্ন প্রকার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, 'পদের মোহ দু'ধরনের।
প্রথম প্রকার মোহ :
রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও সম্পদের মাধ্যমে সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করার অভিলাষ।
এটাই সব চেয়ে বেশী ক্ষতিকর। এর কারণেই মানুষ আখেরাতের কল্যাণ, মর্যাদা,
সম্মান ও ইজ্জত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
'এই
হচ্ছে আখেরাতের নিবাস, যা আমি তাদের জন্য নির্ধারণ করি, যারা যমীনে
ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের
জন্য।' (আল-কাসাস : ৮৩) যারা রাজত্ব ও
সম্পদের মাধ্যমে দুনিয়ার কর্তৃত্ব অর্জন করতে চায়, তারা খুব সামান্যই
আল্লাহর তওফিক প্রাপ্ত হয়, বরং তাদেরকে নিজের ওপরই সোপর্দ করা হয়।
অতঃপর
তিনি বলেন, 'ক্ষমতা ও সম্মানের মোহের একটি সূক্ষ্ন ক্ষতি হচ্ছে, ক্ষমতা
চাওয়া ও তার ব্যাপারে আশা পোষণ করা। এটা খুব সূক্ষ্ন স্তর যা আল্লাহকে
মহব্বতকারী প্রকৃত আলেম ছাড়া বুঝা কঠিন।
আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যে ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ ও মানুষদের
সৎপরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সম্মান ও তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে চায়
এবং সাথে এও প্রকাশ করতে চায় যে, মানুষ তার মুখাপেক্ষি, এটা সরাসরি
আল্লাহর প্রভুত্ব ও রুবুবিয়াতের সঙ্গে সংঘর্ষ।
দ্বিতীয় প্রকার মোহ :
দীনি বিষয়াদির মাধ্যমে, যেমন এলম, আমল ও দুনিয়া ত্যাগ ইত্যাদি প্রকাশ
করে মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ ও তাদের কাছে মর্যাদা প্রত্যাশী হওয়া। এটা
প্রথম প্রকারের চেয়ে বেশী ক্ষতিকর, ঘৃণিত ও নিন্দনীয়। কারণ, এলম, আমল ও
দুনিয়া ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য, জান্নাত ও তার সুউচ্চ স্থানই
একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত।' (মাজিবান হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ : ১৩, ২০, ১৬ ও
১৫ নং পৃ.)
আরেকটি
জিনিস চিন্তা করার মাধ্যমেও ক্ষমতার মোহের ভয়াবহতার চিত্র ফুটে উঠে যে,
ক্ষমতা ও প্রসিদ্ধি পাওয়ার বাসনা মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। শায়খুল ইসলাম
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, 'মানুষ যদি নিজের প্রতি ও অপরের প্রতি দৃষ্টি
দেয়, তবে সহজেই বুঝতে পারবে যে, একজন চাচ্ছে সকলেই তার অনুসরণ করুক, সকলের
ওপর তার প্রধান্যের চিত্র ফুটে উঠুক। সব মানুষই আলাদা বৈশিষ্ট্য,
শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতার প্রত্যাশী। যার সঙ্গে তার প্রবৃত্তির মিল রয়েছে, তার
সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করছে, যার সঙ্গে তার প্রবৃত্তের মিল নেই, তার সঙ্গে সে
শত্রুতা পোষণ করছে। মানুষ তার প্রবৃত্তির গোলামে পরিণত।
তিনি
আরো বলেন, যদি এ নেতা মুসলমান হয়, আর সে চায় যে, মানুষ তার নফসের অনুসরণ
করুক, যদিও তা আল্লাহর বিধানের বিরোধী হয়। যে তার অনুসরণ করে সে তার নিকট
ঐ ব্যক্তির চেয়ে বেশী প্রিয়, যে আল্লাহর আনুগত্য করে ও তার নফসের
বিরোদ্ধাচারণ করে, তবে এটা ফেরআউন ও নবিদের ওপর মিথ্যারোপকারী অন্যান্য
কাফেরদের স্বভাব বা তাদের একটি শাখা।
এ
ব্যক্তি আলেম বা বড় কোন শায়খ হলেও একই কথা। যে তাকে সম্মান করে সেই তার
নিকট বড়। অনেক সময় সে সমকক্ষ ও সমর্যদার অন্যান্য আলেমদের হিংষা করে ও
তাদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে। (মাজমুউল ফতোয়া : ৮/২১৮ সংক্ষিপ্ত)
নিশ্চয়
ক্ষমতা ও ক্ষমতা অর্জনের মোহ অনেক ক্ষতি ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। ইবনে রজব
রহ. বলেন, 'মনে রেখ! ক্ষমতা ও পদের স্বাদ ভোগ করার পূর্বেই অনেকে তা অর্জন
করার জন্য অবৈধ পন্থা গ্রহণ করে ও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আবার তা
অর্জনে সক্ষম হলে দ্বিতীয় পর্যায়ের অপরাধে লিপ্ত হয়। যেমন, অহংকার,
জুলুম ও সত্য প্রত্যাখ্যান করা ইত্যাদি।' (মাজিবান হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ :
১৪)
তিনি আরো বলেন,
'সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ মানুষের দীনদারী খতম করে দেয়, আল্লাহর করুনার ফলে
যারা এর থেকে হেফাজত থাকে, তাদের সংখ্যা খুবই কম। মানুষের প্রকৃতি হচ্ছে
অন্যদের ওপর প্রধান্য বিস্তার করা, তাদের ওপর কর্তৃত্ব করা। আর সেখান থেকেই
অহংকার ও হিংসার জন্ম হয়।' (মাজিবান হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ : ২৯)
ইবনে
কইয়ূম রহ. সম্পদ ও ক্ষমতা লাভের বাসনার ক্ষতিসমূহ উল্লেখ করে বলেন,
'রাজনীতি ও ক্ষমতা লোভী ছাত্ররা পার্থিব স্বার্থ লাভের জন্য সকল প্রচেষ্ঠা ও
সব সামর্থ নিঃশেষ করে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য অন্যদের অধীন করা ও তাদের দলে
ভেড়াতে বাধ্য করা। তারা এ সব অপকর্ম ও অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সবার
সমর্থন ও সহযোগীতা চায়। আর এ থেকেই সকল ধরনের ফেত্না ও ফাসাদের সৃষ্টি
হয়। যেমন, অত্যাচার, হিংসা ও বাড়াবাড়িসহ আরো অনেক কিছু, যা আল্লাহ ছাড়া
কেউ জানে না। যেমন, অসৎ ব্যক্তিদের সম্মান করা, সম্মানীত ব্যক্তিদের
অসম্মান করা ইত্যাদি।
মুদ্দা কথা :
এ ছাড়া অন্য কোনো পন্থায় দুনিয়ার ক্ষমতা লাভ করা প্রায় অসম্ভব। বরং,
এসব অপরাধ ও এর চেয়ে আরো মারাত্বক অপরাধ না করে তা পাওয়া যায় না।
ক্ষমতায় অতিষ্ঠরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধ। তাদের চোখের ওপর থেকে পর্দা
উঠার পরই তারা নিজ ঝগড়াটে বিষয়ের অসারতা বুঝতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে যখন
তাদের পদদলিত করা হয়, ইতিপূর্বে যেমন তারা আল্লাহর আইন ও বিধানকে দলিত
করেছিলো।' (কিতাবুর রুহ : পৃ : ৪৩৩,৪৩৪)
আমাদের
এ সব আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতার মহব্বত ও তার মোহের ক্ষতিকর দিকসমূহ স্পষ্ট
হলো। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, এর বিপরীতে যদি কেউ আল্লাহর প্রতি আহ্বান ও
দীনের দাওয়াতের জন্য ক্ষমতা কামনা করে সেটা নিন্দনীয় নয়। কারণ, এর
উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বিধান ও তার নিদের্শ বাস্তবায়ন করা। পক্ষান্তরে
শুধু ক্ষমতার জন্য ক্ষমতার লোভ হচ্ছে নিজের স্বার্থ ও বড়ত্ব প্রমাণ করার
উদ্দেশ্যে। ইনসাফগার বাদশারা কখনো নিজের প্রতি মানুষদের আহ্বান করেন না।
বরং তারা আল্লাহর আনুগত্য ও একমাত্র তার এবাদতের জন্য আহ্বান করে। তবে, কেউ
যদি আল্লাহর দীনের দিকে আহ্বানের জন্য সহায়ক বলে ক্ষমতার বাসনা পোষণ করেন
এবং সৎ ও দীনদার লোকদের অনুকরণীয় হওয়ার ইচ্ছা রাখে, তাতে দোষ নেই, বরং
এটা প্রসংশার যোগ্য। কারণ, যারা আল্লাহর দিকে আহ্বান করে, তার এবাদত ও
আনুগত্য করে, তারা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সকল মাধ্যমকেই ভালবাসে।' (কিতাবুর
রুহ : পৃ: ৪৩২) (মাজিবান হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ : ১৯)
আহলে
এলম ও তাদের ছাত্রদের উচিত সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করা, এটা একটা
সর্বনাশা ব্যাধি। আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর নিকট তওবা ও আত্মসামালোচনার মাধ্যমে
খুব দ্রুত এর চিকিৎসা করা।
সুফিয়ান সওরি রহ. বলেন, 'কাফিরদের নিকট লাল লাল চাক্যচিক্য স্বর্ণের চেয়ে ক্ষমতা খুব বেশী প্রিয়।' (কিতাবুল অরা : ইমাম আহমদ : ১৯)
আবুলফারাজ
ইবনে জওজি রহ. ক্ষমতা ও প্রসিদ্ধি লাভে মোহগ্রস্ত আলেমদের ব্যাপারে
বলেছেন, 'সব খানেই ক্ষমতা আর ক্ষমতা বলে চিৎকার। অথচ, অন্তরে উদাসীনতা ও
আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ভিন্ন ক্ষমতার মোহ সৃষ্টি হয় না। আর যখনই অন্তরে
এগুলোর জন্ম হয়, তখনই দুনিয়ার লোকদের ওপর সে কর্তৃত্ব অর্জন ও ক্ষমতাবান
হতে চায়।
তিনি
আরো বলেন, আমি মানুষদের আশ্চর্য অবস্থা অবলোকন করেছি, এমনকি যারা আলেম
তাদেরকেও। তারা আমাকে একা হাটতে দেখে আমার ওপর নাখোশ হয়েছে, কোনো গরীব
লোককে দেখতে গেলে তারা আমার ব্যাপারে আশ্চর্য বোধ করেছে। তারা আমাকে হাসতে
দেখে আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম : কি
আশ্চর্য! এটাই তো রাসূলের সুন্নত ছিল। মানুষের স্বভাব ও চালচলন তাদের
ভাবমূর্তি ও প্রভাব সৃষ্টির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। নিশ্চিত করে বলছি,
আল্লাহর শপথ! তোমরা আল্লাহর দৃষ্টি থেকে ছিটকে পড়েছ, বিধায় মানুষের নজরেও
তোমরা হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছ।
প্রিয় পাঠক!
আসুন একটু নিয়তটা সহিহ করি, লৌকিকতা পরিহার করি। আমাদের জীবনের শপথ গ্রহণ
করি, আমরা হক ও সত্যের সাথে চলব। কারণ, এর দ্বারাই আমাদের পূর্ব ুরুষগণ
সফলতা ও মর্যাদার শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছেন।' (সায়দুল খাতের : পৃ :
২২৭, ৩৬০ এবং আখলাকুল উলামা : আজুরি : পৃ : ১৫৭)
পরিশেষে
আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে হেদায়েত, তাকওয়া ও
স্বচ্ছলতা দান করেন। এবং আমাদেরকে প্রবৃত্তি, ধোঁকা, নফসের ধোঁকা ও
বিচ্যুতি থেকে হেফাজত করেন। আমীন।
সমাপ্ত
সংকলন : ড. আব্দুল আজিজ আব্দুল লতিফ
অুনবাদক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন