Views:
A+
A-
স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা: একটি মানুষের সহজাত প্রকৃতি। এ ধরণের বিষয়ের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না যে, শরিয়তে এটি ওয়াজিব। কিংবা শরিয়ত এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছে। বরং এ ধরণের বিষয়ের ক্ষেত্রে নতুন কোন শরয়ি নির্দেশ সন্ধানের বদলে প্রকৃতিগত কারণই যথেষ্ট।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা থাকা কি আবশ্যকীয়
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা থাকা কি আবশ্যকীয়
প্রশ্ন: ইসলামে এমন কোন দলিল আছে কি যা স্বামী-স্ত্রীর একে অপরকে ভালোবাসা আবশ্যক করে? যদি উত্তর হয়: ভালোবাসা থাকা আবশ্যক, তাহলে একজন পুরুষ কিভাবে একাধিক নারীকে বিয়ে করতে পারে?
উত্তর:
স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা: একটি মানুষের সহজাত প্রকৃতি। এ ধরণের বিষয়ের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না যে, শরিয়তে এটি ওয়াজিব। কিংবা শরিয়ত এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছে। বরং এ ধরণের বিষয়ের ক্ষেত্রে নতুন কোন শরয়ি নির্দেশ সন্ধানের বদলে প্রকৃতিগত কারণই যথেষ্ট।
নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি দাম্পত্য জীবনকে শুধু রোমান্টিক উপন্যাস কিংবা গোলাপি স্বপ্ন কল্পনা করে বেড়ায় সে যেন এমন কিছুর সন্ধান করছে মানুষের এই দুনিয়াতে যার অস্তিত্ব অসম্ভব। যে দুনিয়াকে কষ্ট, ক্লেশ ও ক্লান্তির প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় আমি মানবজাতিকে কষ্ট-ক্লেশনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।”[সূরা বালাদ, আয়াত: ৪]
কবি বলেন:
প্রকৃতিগতভাবে জীবন হচ্ছে ক্লেশময়; অথচ তুমি জীবনকে পেতে চাও সমস্যা ও সংকটমুক্ত নির্মল।
যে ব্যক্তি জীবনকে তার সহজাত প্রকৃতি বিরুদ্ধ দায়িত্ব দিতে চায় সে যেন পানির ভেতরে আগুনের অঙ্গার সন্ধান করে বেড়াচ্ছে।
আমরা যদি এইটুকু বুঝে থাকি এবং যথাযথ দৃষ্টিতে জীবনকে দেখি তখন আমরা দেখব যে, কামালিয়াত তথা পূর্ণতায় পৌঁছা কিংবা সর্বদোষ মুক্ত হওয়ার কোন পথ নেই। আপনার জন্য এইটুকু যথেষ্ট যে, আপনি যে দোষ বা ঘাটতি দেখতে পাচ্ছেন সেটা যেন প্রশান্তি ও পথ চলা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয়। এক ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে তালাক দেয়া চিন্তা-ভাবনা করছিল তখন উমর (রাঃ) তাকে বললেন: আপনি কেন তাকে তালাক দিতে চাচ্ছেন? লোকটি বলল: আমি তাকে ভালবাসি না। তিনি বললেন: প্রত্যেক ঘর কি ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে উঠে? আদর-যত্ম ও লোক-নিন্দাবোধ কোথায়?!!
অর্থাৎ আপনার সঙ্গিনী, আপনার স্ত্রী থেকে প্রাপ্ত কষ্টে ধৈর্য ধরুন। আপনার যে অবস্থা সকল মানুষের তাদের স্ত্রী ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে একই অবস্থা। মানুষ একে অপরের প্রতি সন্তুষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও, একে অপরকে পছন্দ না করা সত্ত্বেও একত্রিত হয়। একের প্রতি অপরের প্রয়োজন তাদেরকে সমাবেত করে।!!
তাই পরিবারের সদস্যরা একে অপরের যত্ম নেয়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে উঠে এবং প্রত্যেকে একের প্রতি অন্যের কর্তব্য বুঝতে পারে। আর লোক-নিন্দাবোধ হচ্ছে প্রত্যেকে এমন আচরণ পরিহার করে চলা যাতে করে তার মাধ্যমে তাদের পথচলা আলাদা হয়ে যাওয়া বা বিচ্ছিন্নতা না ঘটে।
আপনি আল্লাহ্ তাআলার এ বাণীটি নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করুন:
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।”[সূরা রূম, আয়াত: ২১]
এখানে আল্লাহ্ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর মাঝের “ভালোবাসা” কে আল্লাহ্র সৃষ্টি ও তাঁর ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন; তাঁর নির্দেশিত আবশ্যক পালনীয় হিসেবে উল্লেখ করেননি। কারণ অন্তরের ভালোবাসা বান্দার মালিকানাধীন নয়। বরং বান্দা যেটার মালিক সেটা হচ্ছে– অনুগ্রহ ও সদাচরণ।
ইবনে কাছির (রহঃ) বলেন: “আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন”। এর অর্থ তোমাদের স্বজাতি থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করেছেন। “যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও”। যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, “তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।”[সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৮৯] এর দ্বারা আল্লাহ্ বুঝাতে চাচ্ছেন ‘হাওয়া’ কে। আদম (আঃ) এর বাম পাঁজরের ছোটতম হাড় থেকে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। যদি আল্লাহ্ সকল বনী আদমকে পুরুষ বানাতেন, আর তাদের নারীদেরকে অন্য জাতি থেকে বানাতেন, যেমন- জ্বিন কিংবা অন্য প্রাণী থেকে তাহলে তাদের মাঝে ও তাদের স্ত্রীদের মাঝে এ ধরণের মেল-বন্ধন তৈরী হত না। বরং স্ত্রীরা অন্য জাতির হলে তাদের পরস্পরের মাঝে বিরাগ ঘটত। বনী আদমের প্রতি আল্লাহ্র পরিপূর্ণ অনুগ্রহ হচ্ছে যে, তিনি তাদের স্ত্রীদেরকে তাদের জাতি থেকেই সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের পরস্পরের মাঝে অনুরাগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যেটা হচ্ছে- ভালোবাসা। এবং দয়া সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যেটা হচ্ছে- মায়া। তাই একজন স্বামী তার স্ত্রীকে ধরে রাখেন হয়তো তার প্রতি ভালোবাসার কারণে; কিংবা তার প্রতি মায়ার কারণে– সেই স্ত্রীর ঘরে তার সন্তান থাকলে কিংবা স্ত্রী তার ভরণপোষণের মুখাপেক্ষী হলে কিংবা তাদের দুইজনের মাঝে মেলবন্ধনের কারণে ইত্যাদি।[তাফসিরে ইবনে কাছির (৬/৩০৯) থেকে সমাপ্ত]
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন:
“আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন করবে। তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ্ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা সেটাকেই অপছন্দ করছ।”[সূরা নিসা, আয়াত: ১৯]
শাইখ সা’দী (রহঃ) বলেন: স্বামীর কর্তব্য হচ্ছে – স্ত্রীর সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করা; যেমন- ভাল সঙ্গ দেয়া, কষ্ট না দেয়া, অনুগ্রহ করা, সুন্দর ব্যবহার করা, এর মধ্যে ভরণ-পোষণ ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত হবে।
“তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ্ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।”
অর্থাৎ ওহে স্বামীগণ, তোমাদের উচিত অপছন্দ করলেও তোমাদের স্ত্রীদেরকে ধরে রাখা। কারণ এতে প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। সে কল্যাণের মধ্যে রয়েছে:
- আল্লাহ্র নির্দেশ পালন ও তাঁর ওসিয়ত গ্রহণ; যাতে নিহিত আছে দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ।
- অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীকে ধরে রাখতে নিজেকে বাধ্য করা। এতে করে প্রবৃত্তির দমন ও উত্তম চরিত্র অর্জিত হয়।
- হতে পারে স্ত্রীর প্রতি ঘৃণাবোধ দূর হয়ে সেখানে ভালোবাসা স্থান করে নিবে; বাস্তবে এটাই ঘটে।
- হতে পারে এ স্ত্রীর ঘরে কোন নেক সন্তান জন্ম নিবে। যে সন্তান তার পিতামাতার দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ করবে।
কোন গুনাহর কাজে লিপ্ত হওয়া ছাড়া বিবাহ-বন্ধন অটুট রাখতে পারলে এ কল্যাণগুলো ঘটতে পারে। আর যদি বিবাহ বিচ্ছেদ করতেই হয়; বিবাহ অটুট রাখার কোন সুযোগ না থাকে সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে ধলে রাখা আবশ্যক নয়।[তাফসিরে সা’দী (পৃষ্ঠা-১৭২) থেকে সমাপ্ত]
সহিহ মুসলিমে (১৪৬৯) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কোন মুমিন স্বামী যেন মুমিন স্ত্রীকে ঘৃণা না করে। যদি তার কোন একটি আচরণ অপছন্দনীয় হয় অন্য আরেকটি আচরণ সন্তোষজনক হবে।”
ইমাম নববী বলেন:
“অর্থাৎ স্বামীর উচিত স্ত্রীকে ঘৃণা না করা। কারণ স্বামী যদি স্ত্রীর মাঝে এমন কোন আচরণ পায় যা তার অপছন্দ হয়, তবে সে তার মাঝে এমন গুণও পায় যার প্রতি সে সন্তুষ্ট হয়। যেমন– বদমেজাজী কিন্তু দ্বীনদার কিংবা সুন্দরী কিংবা সতী কিংবা স্বামীর প্রতি কোমলপ্রাণ ইত্যাদি”।[সমাপ্ত]
দুই:
যদি আমরা ধরেও নিই যে, স্বামী-স্ত্রীর একের প্রতি অন্যের “ভালোবাসা” থাকা ওয়াজিব, স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে ভালোবাসা ও তার সাথে সম্পৃক্ত থাকা অনিবার্য; সেক্ষেত্রেও একজন পুরুষের দুইজন, তিনজন বা চারজন নারীকে বিয়ে করতে ও তাদের সকলকে ভালবাসতে সমস্যা কোথায়?!
এতে প্রতিবন্ধকতা কোথায়! কেবল স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা কিংবা দুই ব্যক্তির ভালোবাসার ক্ষেত্রে “রোমান্টিক” কিছু চিন্তাধারা ব্যতীত। যে সব চিন্তাধারায় মনে করা হয় যে, ভালোবাসায় “অংশীদারিত্ব” চলে না। তারা যেন ভালোবাসার মানুষকে রব্ব বা প্রতিপালকের মর্যাদায় চিত্রিত করতে চায়। প্রতিপালকের ইবাদতে যেমন অংশীদারিত্ব চলে না?!!
একই ব্যক্তি তার বাবাকে ভালোবাসে, তার মাকে ভালোবাসে, তার অমুক অমুককে ভালোবাসে; তাই নয় কী? এ সবই তো এক জাতীয় ভালোবাসা। কই এই ভালোবাসার অংশীদারিত্বে তো কোন বিঘ্ন ঘটছে না। তাহলে কোন কারণে একজন পুরুষ ও তার একাধিক স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা তৈরী হওয়াকে অসম্ভব জ্ঞান করা হবে?!
খাবারের ক্ষেত্রে একজন মানুষকে অমুক অমুক খাবার পছন্দ করেন। অমুক অমুক খাবার ভালোবাসে। সবগুলোই খাবার। স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন। ঘ্রাণ ভিন্ন ভিন্ন। সে ব্যক্তি সবগুলোকেই পছন্দ করে, খেতে ভালোবাসে। সুতরাং, কোন যুক্তি কিংবা কোন শরিয়ত একই সময়ে একাধিক স্ত্রীকে ভালবাসতে বাধা দিচ্ছে?!
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা কেন এমন খাস বিষয় যে, এতে অংশীদারিত্ব চলবে না?!
এমন ভালাবাসা কি জগৎসমূহের প্রতিপালকের প্রতি ইবাদতস্বরূপ ভালোবাসা ছাড়া আর কোন ভালোবাসা হতে পারে?!
যদি কেউ বলে যে, অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এটাই তো ঘটে আসছে যে, একজন পুরুষ শুধু একজন নারীর সাথেই সম্পৃক্ত হয় এবং একজন নারী শুধু একজন পুরুষকেই ভালোবাসে?
এর জবাব হল: তা ঠিক আছে। অধিকাংশ মানুষ একাধিক বিয়ে করে না। কিন্তু অন্য অনেক মানুষ তো একাধিক বিয়ে করছে এবং তারা একাধিক স্ত্রীকে ভালবেসে যাচ্ছে। এমন ঘটনা অতীতেও ঘটেছে এবং বর্তমানেও পুনঃপুনঃ ঘটে যাচ্ছে।
একাধিক বিয়ের গূঢ় রহস্য জানতে 14022 নং প্রশ্নোত্তর পড়ুন।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব ওয়েবসাইট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন