Views:
A+
A-
১। দোয়ার মধ্যে শিরক :
১। মৃত ব্যক্তির মাধ্যমে অসিলা খোঁজা
আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে মিলাদের নাম করে নানা পাপ কাজ, বিদআত ও শরিয়ত পরিপন্থি বিভিন্ন না জায়েয কাজ মহা ধুমধামে সম্পাদন করা হচ্ছে। অথচ মিলাদের এ উৎসব না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন, না তাঁর সাহাবিরা, না তাবেয়ীরা না নির্ভরযোগ্য অন্য কেউ। এ বিষয়ে শরিয়তের কোনো দলীলও নেই।
অনেক সহিহ হাদিস ও সাহাবিদের আমল দ্বারা প্রমাণিত যে, আগমণকারীর অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়ানো জায়েয। আসুন আমরা সে হাদিসগুলো বুঝতে চেষ্টা করি এবং সেমতে আমল করারও ।
সহিহ হাদিসের উপর আমলের হুকুম
হাসান হাদিসের উপর আমলের হুকুম
২। কবরের উপর বসা নিষেধ এবং তার উপর দিয়ে চলাফেরা করার রাস্তা বানানোও নিষেধ।
কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
৪। কবরস্থানে কোরআন তেলাওয়াত করা নিষেধ।
কারণ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
৫। মৃতদের কাছ থেকে মদদ বা সাহায্য চাওয়া বড় শিরক। যদিও সে নবী কিংবা ওলী হয়।
এ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :
৬। কবরের উপর ফুলের তোড়া দেয়া কিংবা কবরস্থানে তা স্থাপন না করা নাজায়েয।
৭। কবরের উপর কোনো সৌধ বানানো বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য দেয়াল দেয়া জায়েয নেই। তাতে কোরআনের আয়াত কিংবা কবিতা লেখাও নিষেধ।
তবে ইট, পাথর কিংবা মাটি দিয়ে এক বিঘত পরিমাণ উঁচু করা জায়েয, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে এটি কবর।
মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পাথেয় (২য় পর্ব)
মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পাথেয়
আকীদা আগে না হুকুমত আগে ?
মক্কা মোকাররমার প্রসিদ্ধ দারুল হাদিসে এক আলোচনায় বিশ্ব বরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ প্রখ্যাত শায়খ মুহাম্মাদ কুতুব অতি গুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নটির জবাব দিয়েছিলেন, আমরা এখানে সে উত্তরটি সম্মনীত পাঠক সমীপে উপস্থাপন করছি।
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: বর্তমানে কিছুলোক বলে থাকেন, ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হত। আবার অন্যেরা বলেন: ইসলাম আবারো তাজা হবে যদি আকীদাকে সহিহ করার মেহনত করা হয় এবং জামাআত সুসংগঠিত করা হয়। এর কোনটা সত্য ?
উত্তরে তিনি উল্টা প্রশ্ন করে বলেছিলেন: দুনিয়ার বুকে ইসলামি হুকুমত কায়েম হবে কোত্থেকে যদি না দায়ীরা মানুষের আকীদা সংশোধন করেন, সত্যিকারের ঈমানের প্রশিক্ষণ দান করেন, দ্বীনের ব্যাপারে পরীক্ষা করা হলে সবর করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেন ? উপরোক্ত বিষয়গুলোর পূর্ণতার পরই দুনিয়ায় দ্বীন মোতাবেক শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। এটাতো খুবই পরিস্কার ব্যাপার। হুকুমত কখনই আকাশ থেকে অবতীর্ণ হবে না, কেউ তা অবতীর্ণ করাতেও পারবে না। হ্যাঁ সকল জিনিসই আকাস থেকে আসে, কিন্তু তা আসে ত্যাগ তিতিক্ষা ও কষ্ট-মেহনতের মাধ্যমে। এর জন্য আল্লাহ বান্দাদের উপর মেহনত ফরয করে দিয়েছেন।
وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانْتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِنْ لِيَبْلُوَ بَعْضَكُمْ بِبَعْضٍ ﴿4﴾
অর্থাৎ, আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতেন, কিন্তু তোমাদের একজনকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। (সূরা মুহাম্মাদ: আয়াত ৪)
তাই আমাদের শুরু করতে হবে আকীদা সহিহ করার মাধ্যমে। এবং এ সমাজকে গঠন করে তুলতে হবে সত্যিকারের আকীদার উপর। যারা মেহনত শুরু করবে তারা অবশ্যই পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, তাদেরকে সে পরীক্ষার উপর সবর করতে হবে। যেমনটি সবর করেছিলেন প্রথম যামানায় সাহাবায়ে কেরাম।
বড় শিরক ও তার শ্রেণী বিভাগ
বড় শিরকের অর্থ হচ্ছে, আকীদা-বিশ্বাস, কথা-বক্তব্য কিংবা আমল-আচরণের মাধ্যমে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানানো। আল্লাহকে যেভাবে ডাকা হয় তাকে তেমনিভাবে ডাকা। তার জন্য কোনো ইবাদত নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন, সাহায্য প্রার্থনা, জবেহ, নজর-নেয়াজ, মানত প্রভৃতি।
সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
سَأَلتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلَّمَ اىُّ الذَّنْبِ أعْظَمُ؟ قَالَ : انْ تَجْعَلَ للهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ ) رواه البخاري ومسلم )
আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করলাম : সবচেয়ে বড় গুনাহ কি ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পক্ষে আল্লাহর কোনো সমকক্ষ নির্ধারণ করা, অথচ তিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন। (বুখারি ও মুসলিম)
বড় শিরকের বিশেষ বিশেষ প্রকাশ
অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দোয়া করা, কোনো কিছু ঝাঞ্ছা করা। যেমন, নবী কিংবা আউলিয়াদের কাছে, রিযিক বৃদ্ধি, রোগ মুক্তি, অভাব দূরীকরণ ইত্যাদির জন্য দোয়া করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ ﴿106﴾
অর্থাৎ, আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। যদি তুমি (এমনটি) কর, তাহলে নিশ্চয় তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা ইউনুস : আয়াত ১০৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللهِ نِدًّا دَخَلَ النَّار (رواه البخاري)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যাবে যে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সমকক্ষ হিসাবে ডেকেছে, তাহলে সে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করবে। (বুখারি)
আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দোয়া করা শিরক। যেমন মৃত ও আউলিয়াদের কাছে দোয়া করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِنْ قِطْمِيرٍ ﴿13﴾ إِنْ تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ ﴿14فاطر﴾
অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকছ তারা খেজুরের আটির আবরণেরও মালিক নয়। যদি তোমরা তাদেরকে ডাকো, তারা তোমাদের ডাক শুনবে না; আর শুনতে পেলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর কেয়ামতের দিন তারা তোমাদের শরিক করাকে অস্বীকার করবে। আর সর্বজ্ঞ আল্লাহর ন্যায় কেউ তোমাকে অবহিত করবে না। (সূরা ফাতির : আয়াত ১৩ ও ১৪)
২। আল্লাহর গুণের ক্ষেত্রে শিরক:
যেমন, আম্বিয়া কিংবা আওলিয়াগণ গায়েব জানেন মর্মে বিশ্বাস করা।
আল্লাহ বলেন,
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ (الانعام 59)
অর্থাৎ, এবং তাঁর নিকটেই গায়েবের চাবিকাঠিসমূহ, তিনি ছাড়া কেউই তা জানে না।
(সূরা আনআম : আয়াত ৫৯)
৩। মহব্বতের ক্ষেত্রে শিরক :
আল্লাহকে ভালবাসার মত কোনো ওলীকে ভালবাসা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ (البقرة 165)
আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লঅহর জন্য ভালবাসায় দৃঢ়তর। (সূরা বাকারা: আয়াত ১৬৫)
৪। আনুগত্যের ক্ষেত্রে শিরক :
যেমন, পাপের ক্ষেত্রে কোনো আলেম অথবা কোনো পীরের আনুগত্য করা , এই ধারণায় যে তারা ঠিকই করছে।
আল্লাহ বলেন :
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ (التوبة 31)
অর্থাৎ, তারা (খৃষ্টানরা) আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেম ও আবেদদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। (সূরা তাওবা: আয়াত ৩১)
এ আনুগত্যের ব্যাখ্যা হল, তারা পাপের ক্ষেত্রেও তাদের আনুগত্য করত, যেমন আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল জ্ঞান করত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لا طَاعَةَ لمَخْلُوقٍ فى مَعْصِيَةِ الخالِقِ (صحيح رواه أحمد )
স্রষ্টার অবাধ্যতার কাজে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। (আহমদ, সহিহ )
৫। হুলুলের ক্ষেত্রে শিরক :
অর্থাৎ এমন ধারণা পোষণ করা যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করছেন। তাদের মাঝে দ্রবীভূত হয়ে গেছেন। এটা অনেক সূফি-পীরদের ধারণা। যেমন ইবনে আরাবী বলেন, রবই দাস আর দাসই রব। হায়... তাহলে সালাত, সিয়ামের দ্বারা কি লাভ হবে? অন্য একজন বলেছেন : কুকুর শুকরও আল্লাহ ছাড়া কিছু না। মন্দিরের ঋষিও আল্লাহ। (নাউযুবিল্লাহ )।
৬। দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনার ক্ষেত্রে শিরক :
এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহর এমন অনেক ওলী আছেন যারা এ সৃষ্টিজগতকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তাদেরকে কুতুব বলা হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা পূর্বেকার মুশরিকদের প্রশ্ন করেছিলেন :
وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ ﴿31يونس﴾
অর্থাৎ, (যদি প্রশ্ন কর) কে সব বিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। (সূরা ইউনুস : আয়াত ৩১)
৭। শাসন ও বিচার- ফয়সালার ক্ষেত্রে শিরক :
যেমন, ইসলাম বিরোধী আইন প্রনয়ণ ও তাকে জায়েয মনে করা। অথবা এমন ধারণা পোষণ করা যে, বর্তমান যুগে ইসলামী আইন চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইন প্রণেতা-রাজা এবং গ্রহীতা-প্রজা উভয়েই অন্তর্ভুক্ত।
বড় শিরক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পূর্বেকৃত সকল নেক আমল নষ্ট করে দেয়
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ ﴿الزمر65﴾
অর্থাৎ, অবশ্যই আমি তোমার কাছে এবং যারা (নবীরা) তোমার পূর্বে ছিল তাদের কাছে এ মর্মে ওহী পাঠিয়েছি যে, যদি শিরক কর তাহলে অবশ্যই তোমার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। (সূরা যুমার, আয়াত ৬৫)
বড় শিরক আল্লাহ তাআলা তওবা ছাড়া মাফ করেন না
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا ﴿116النساء﴾
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শিরক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হল। (সূরা নিসা: আয়াত ১১৬)
শিরকের অনেক শ্রেণী বিভাগ আছে। তার মাঝে কোনোটা বড় আবার কোনোটা ছোট। সকলের উপর ওয়াজিব হল, সর্ব প্রকার শিরক হতে সাবধান থাকা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এই দোয়া শিখিয়েছেনঃ
اللهمَّ إنَّا نَعُوذُبِكَ مِنْ أنْ نُشْرِكَ بِكَ شيْئاً نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لا نَعْلمُ (رواه احمد)
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে জেনে- বুঝে শিরক করা হতে পানাহ চাই। এবং অজানা শিরক হতে ক্ষমা চাই। (আহমদ, হাসান)।
আল্লাহকে ছেড়ে যারা অন্যকে ডাকে তাদের দৃষ্টান্ত
يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَنْ يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ وَإِنْ يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لَا يَسْتَنْقِذُوهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ ﴿الحج73﴾
হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তাও উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হয় উভয়েই দুর্বল। (সূরা হজ : আয়াত ৭৩)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সমস্ত মানুষদের সম্বোধন করে বলেছেন, যে সব ওলীআল্লাহ বা নেককার ব্যক্তিদেরকে তোমরা তাদের মৃত্যুর পর তোমাদের সাহায্য করার জন্য ডাকছো, কক্ষণোই তারা তা করতে সমর্থ হবে না। আর যদি কোনো মাছি তাদের খাদ্য দ্রব্য বা পানীয় ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা তা তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এটা তাদের দুর্বলতার প্রমাণ এবং মাছিরও দুর্বলতা । তাহলে কেমন করে-কোন যুক্তিতে তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে তাদেরকে ডাক? যারা আল্লাহকে কোনো নবী বা ওলীদের ডাকে এ উপমা তাদের জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে এ অসার কাজ হতে প্রচন্ডভাবে নিষেধ করেছেন।
২। আল্লাহ রাববুল ইযযত বলেন :
لَهُ دَعْوَةُ الْحَقِّ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُمْ بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ ﴿الرعد14﴾
সত্যের আহ্বান তাঁরই, আর যারা তাকে ছাড়া অন্যদেরকে ডাকে, তারা তাদের ডাকে সামান্যও সাড়া দিতে পারে না, বরং (তাদের দৃষ্টান্ত) ঐ ব্যক্তির মত, যে পানির দিকে তার দু’হাত বাড়িয়ে দেয় যেন তা তার মুখে পৌঁছে অথচ তা তার কাছে পৌঁছবার নয়। আর কাফেরদের ডাক তো শুধু ভ্রষ্টতায় পর্যবসিত হয়।(সূরা রাদ : আয়াত ১৪)
উপরোক্ত আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে, দোয়া হল ইবাদত। তা কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে ডাকছে, তাদের কাছ থেকে তারা কোনো উপকার পায় না এবং কোনো ব্যাপারেই তারা তাদের উত্তর দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। এ উদাহরণ হুবহু সে ব্যক্তির মত, যে হাত দিয়ে পানি পান করার জন্য কূপের পাড়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ হাত দ্বারা কখনই তার নাগাল পাওয়া যাবে না।
মুজাহিদ রহ. বলেন, মুখের সাহায্যে পানিকে ডাকছে ও তার দিকে ইশারা করছে, কিন্তু তা কখনোই তার কাছে আসবে না। (ইবনে কাসীর )।
যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে ডাকে তিনি তাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন। এবং বলেছেন যে, তাদের দোয়া ও ডাকা ডাকি ব্যর্থতায় পর্যবসিত।
সুতরাং হে আমার মুসলিম ভাই! আল্লহকে ছেড়ে অন্যের কাছে দোয়া করা হতে সাবধান হোন। এর ফলে কাফের ও পথভ্রষ্ট হয়ে যাবেন। একমাত্র আল্লাহকে ডাকুন, যিনি সর্বময় কর্তা ও সকল ক্ষমতার মালিক। এতে করে আপনি খাঁটি মুমিন ও একত্ববাদীদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবেন।
আল্লাহর সাথে শিরক করা-এ মহা ক্ষতিকর পাপ হতে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি কিভাবে:
তিন প্রকারের শিরক হতে মুক্ত হওয়া অবধি আল্লাহর সাথে শিরক করা হতে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই।
১। রুবুবিয়াতের ক্ষেত্রে শিরক :
অর্থাৎ, পৃথিবী পরিচালানার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার সাথে অন্য স্রষ্টা ও পরিচালক আছে মর্মে বিশ্বাস পোষণ করা। যেমন, কতিপয় পীর মনে করে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর কিছু কাজ বিভিন্ন ওলীদের দায়িত্বে ন্যাস্ত করে থাকেন। সে সব কাজ তারাই নির্বাহ করে। এমন অবান্তর ধারণা ইসলামের পূর্বের মুশরিকরা পর্যন্ত করেনি। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ (يونس 31)
অর্থাৎ, (যদি প্রশ্ন কর) কে সব বিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। (সূরা ইউনুস : আয়াত ৩১)
লেখক বলেন, আমি এক সূফি সম্পর্কে শুনেছি সে বলে যে, আল্লাহর এমন বান্দাও আছে যদি সে বলে, হও সাথে সাথে তা হয়ে যায়।
অথচ পবিত্র কোরআন বলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ গুণ কেবল তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ ﴿82يس﴾
তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, কোন কিছুকে তিনি যদি হও বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়। (সূরা ইয়াসিন : আয়াত ৮২ )
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ (الاعراف 54)
অর্থাৎ, শুনে রাখ! সৃষ্টি এবং হুকুম তাঁরই (জন্য নির্ধারিত)। (সূরা আরাফ ৭ : ৫৪ আয়াত)।
২। ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক :
অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদত-আনুগত্য করা। যেমন, নবী ও নেককার বান্দাদের ইবাদত করা। তাদের ওসিলায় বিপদমুক্তি প্রার্থনা করা। বিপদের সময় তাদের কাছে দোয়া করা এবং এ জাতীয় বিভিন্ন কাজ। যেমন এভাবে বলা যে, হে আল্লাহর রাসূল! সাহায্য করুন, হে আব্দুল কাদের জিলানী! সাহায্য করুন। আর এ সাহায্য প্রার্থনাটাই ইবাদত। কারণ, এটি সরাসরি দোয়া। আর হাদিসে এসেছে, দোয়াই ইবাদত। বড়ই অনুতাপের বিষয়, বর্তমানে এ সব বিষয় এ উম্মতের মধ্যে নানাভাবে বিরাজমান। এক ধরনের বাতেল পীর সমাজে এ সব বিষয়ের প্রচলন ঘটিয়েছে এবং নানা কৌশলে এর ব্যাপক প্রসার ঘটাচ্ছে। দিন দিন নানা মানুষ এ বিভ্রান্তি ও শিরকি কাজে নীপতিত হচ্ছে নতুন করে। যে সব ভন্ড পীর শরিয়ত পরিপন্থী এসব শিরকি কাজ সমাজে ছড়িয়েছে, বলার অপেক্ষা রাখে না, সাধারণ বিভ্রান্ত মানুষের পাপের বোঝাও তাদেরকে বহন করতে হবে। ওসিলা খোঁজার নাম করে এ সব শিরকি প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অথচ ওসিলার অর্থ হল কোনো মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করা। নেক আমলকে ওসিলা করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার বিষয়টি শরিয়ত অনুমোদিত। কিন্তু কোনো মৃত ব্যক্তিকে ওসিলা হিসাবে দাঁড় করানো অবৈধ।
৩। আল্লাহর গুণের ক্ষেত্রে শিরক :
অর্থাৎ আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে সে সব গুণে ভূষিত করা যা শুধু তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট। যেমন গায়েব এর ইলম। অদৃশ্য বা গায়েব-এর ইলম শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। এ সম্বন্ধে কোরআনে বহু আয়াত বিদ্যমান। কিন্তু অনেক লোক প্রচার করে থাকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গায়েব জানেন। এসব প্রচারণার কাজে অনেক বাতেল পীর ও তাদের ভক্তবৃন্দ জড়িত।
যেমন বুছাইরি, সে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসায় বলেছে : হে নবী (সা.) তোমার দয়াতেই এই দুনিয়ার ভাল, আর মন্দও তোমা হতে। তোমার ইলম হতেই কলম ও লওহে মাহফুজের ইলম।
এ প্রচারণা থেকেই পথভ্রষ্ট চরম মিথ্যাবাদীদের কথা সম্মুখে এসেছে, যারা ধারণা পোষণ করে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পায় এবং তাদের অজানা নানা গোপন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করে। যাদের তারা ভালবাসে তাঁর কাছে তাদের গোপন বিষয়ে জানতে চায়। এবং তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চায়। এমনকি এমন সব কথাও, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত অবস্থায়ও জানতেন না।
অথচ পবিত্র কোরআন বলে :
وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ (الاعراف 188)
অর্থাৎ, যদি আমি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করত না। (সূরা আরাফ: আয়াত ১৮৮)
আর এটি কিভাবে সম্ভব যে, তিনি তাঁর মৃত্যুর পর যখন উপরের বন্ধুর কাছে চলে গেছেন সেসব গায়েব সম্বন্ধে জানেন?
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন একটা বাচ্চা মেয়েকে শুনতে পেলেন, সে বলছে, আমাদের মধ্যে এমন নবী আছেন যিনি আগামীকালের কথা জানেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: না, এ কথা বলো না। সেগুলোই বলো, যা এতক্ষণ বলছিলে । (বুখারি )।
প্রকৃত একত্ববাদী কে?
যে ব্যক্তি আল্লাহর একত্ববাদের মধ্যে উপরোক্ত তিন ধরণের শিরককে মিশ্রিত করে না। তাঁর সত্তা, ইবাদত, দোয়া এবং যাবতীয় গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাঁকে একক বলে মান্য করে, সেই হচ্ছে প্রকৃত একত্ববাদী। যে ব্যক্তি এ শিরকত্রয়ীর কোনোটিকে স্বীকার করে, সে আর একত্ববাদী থাকে না, বরং তার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী প্রযোজ্য হবে,
لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ ﴿الزمر65﴾
অর্থাৎ, যদি তুমি শিরক কর তাহলে তোমার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা যুমার: আয়াত ৬৫)
ছোট শিরক ও তার শ্রেণী বিভাগ
ছোট শিরক বলতে সে সব কাজ ও পদ্ধতিকে বলা হয় যা মানুষকে বড় শিরকের নিকটবর্তী করে দেয়। তবে ইবাদতের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে না। তাই সেগুলো সম্পাদনকারীকে দ্বীন-ইসলাম থেকে বের করে না। তবে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত।
যেমন,
১-রিয়া যা লোক দেখানো আমল।
প্রতিটি ইবাদতকারী যাবতীয় নেক কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই সম্পাদন করে থাকে। তাঁর জন্যই সালাত, সিয়াম, হজ্জ প্রভৃতি আদায় করে থাকে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির চিন্তা বাদ দিয়ে মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে এসব নেক আমল সম্পাদন করাকে রিয়া বলে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا ﴿الكهف110﴾
সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে। (সূরা কাহাফ: আয়াত ১১০)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إنَّ أخْوَفَ مَا أخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الاصْغَرُ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللهُ يَومَ الْقٍيامَةِ إذَا جُزِيَ النَّاسُ بأعْمَالِهِمْ: اذهَبُوا إلى الَّذِيْنَ تَرَؤُونَ فى الدنياَ فانْظُرُوا هًلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً. (رواه احمد)
অর্থাৎ, তোমাদের জন্য যে জিনিসকে আমি সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা করি তা হল ছোট শিরক, রিয়া। কিয়ামত দিবসে যখন মানুষকে তাদের আমলের বদলা দেওয়া হবে তখন আল্লাহ বলবেন : সে সব লোকদের নিকট যাও যাদেরকে দেখিয়ে আমল করেছিলে, দেখ তাদের কাছে কোনো বদলা পাও কি না। (আহমদ, সহিহ)
২। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে কসম খাওয়া
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَنْ حَلَفَ بِغَيْر اللهِ فَقَدْ أشْرَكَ . (رواه احمد)
অর্থাৎ, যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে শপথ করল, সে শিরক করল। (আহমদ, সহিহ)
৩। গোপন শিরক,
ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কোনো ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা যে, -আল্লাহ যা চান এবং তুমি যা চাও- অথবা -যদি আল্লাহ না থকত এবং অমুক না থাকত- আল্লাহর চাওয়া ও সাথিত্বকে মানুষের চাওয়া ও সাথিত্বের সাথে মিলিয়ে দেওয়া। তবে এসব ক্ষেত্রে এভাবে বলা যায় যে,-যদি আল্লাহ না থাকত তারপর তুমি না থাকতে।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لا تَقُولُوْا مَا شَاءَ اللهُ وَشَاءَ فُلانٌ وَلَكِنْ قُوْلُوا مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ شَاءَ فُلانٌ (رواه احمد وغيره)
অর্থাৎ, তোমরা এভাবে বল না, যা আল্লাহ চান এবং অমুকে চায়। বরং এভাবে বল : যা আল্লাহ চান তারপর অমুকে চায়। (আহমদ)
শিরকের বাহ্যিক প্রকাশ :
ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে মুসলিমরা আজ যে কষ্ট ও মুসিবতে জর্জরিত তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, তাদের মধ্যে প্রকাশ্যভাবে ও ব্যাপকহারে শিরক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যে আজ ফিৎনা- ফাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে, তা আল্লাহ তাআলাই তাদের উপর গজব হিসাবে নাযিল করেছেন। তার কারণ, তারা তাওহিদ বিমুখ হয়ে পড়েছে। তাদের আকিদাহ ও কাজে-কর্মে শিরক প্রকাশ পাচ্ছে। অধিকাংশ মুসলিম দেশেই এ অবস্থা বিরাজ করছে। শিরককে উৎখাত করার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব এ কথা মুসলিম সমাজ জানলেও কোনটি শিরক তা না জানার কারণে সেসব শিরকি কাজকেই সাওয়াবের কাজ মনে করে আমল করে যাচ্ছে। তাই তারা এসব প্রচলিত শিরকের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করে না।
শিরকের বিশেষ বিশেষ প্রকাশ
১। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে প্রার্থনা করা
এ বিষয়টি সাধারণত: মীলাদুন্নবী ও এ জাতীয় অনুষ্ঠানাদিতে নৃত্য-গীত ও কবিতা- কাওয়ালির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। (লেখক বলেন) আমি একবার কাউকে বলতে শুনেছিলাম, হে রাসূলদের ইমাম! হে আমার নেতা! আপনি আল্লাহ তাআলার দরজা এবং দুনিয়া ও আখিরাতে আমার ভরসাস্থল। হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে নিজ হাতে ধরে নিন। আমার বিপদ দুর করে সু-দিন আনতে আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না। আবার কেউ কেউ বলে, হে সমস্ত হযরতদের মাথার মুকুট, ইত্যাদি। যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব কথা নিজে শুনতেন, তাহলে অবশ্যই নিজেকে তা থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করতেন। কারণ, দুর্দিনকে সু-দিনে পরিণত করতে আল্লাহ ছাড়া কেউ পারে না। দৈনিক সংবাদপত্র, মাসিক ম্যাগাজিন, এমনকি বই-পুস্তকেও এ জাতীয় অনেক কবিতা-গজল-কাওয়ালি লিখে প্রচার করা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে প্রার্থনা করার বিষয়টি যেমন, রাসূলুল্লাহ, বিভিন্ন ওলী-আওলিয়া ও নেককার লোকদের কাছে সাহায্য চাওয়া, তাদের কাছে বিপদাপদ হতে মুক্তি প্রার্থনা করা ও শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় কামনা করা ইত্যাদি।
২। আওলিয়া ও নেককার লোকদের মসজিদে কবর দেয়া
বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে এমন অনেক মসজিদ দেখা যায়, যাতে কবর আছে। তার উপর গম্বুজ, কুব্বা ইত্যাদি তৈরী করা হয়েছে। অনেক লোক আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রার্থনার জন্য সেসব কবরস্থ ব্যক্তি বর্গের কাছে যেতে চায়।
এ ব্যাপারে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেন :
لَعَنَ اللهُ اليَهُودَ والنَّصَارى اتَّخَذُوا قُبُوْرَ أنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ. (متفق عليه)
অর্থাৎ, ইয়াহুদি ও খ্রীষ্টানদের উপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ, তারা তাদের নবীদের কবরকে (সেজদার জায়গা) মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। ( বুখারি ও মুসলিম)
নবীদেরকে মসজিদে দাফন করা যদি ইসলামি রীতি বিরুদ্ধ, কাফেরদের অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে। তাহলে সেখানে আওলিয়া ও পীরদের দাফন করা জায়েয হয় কিভাবে ? বিশেষ করে আল্লাহ ব্যতীত এ সব লোকদের নিকট প্রার্থনা করা হলে শিরক হবে মর্মে জানা থাকার পরও।
৩। আওলিয়াদের নামে মান্নত করা, নযর-নেয়ায দেয়া
কোনো কোনো ব্যক্তি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, টাকা-পয়সা ইত্যাদি নির্দিষ্ট ওলীকে নযর দেয়। তার নামে মান্নত করে। এই নযর দেয়া শিরক। কারণ, নযর দেয়া ইবাদত। যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই হতে হবে। সুতরাং এ ব্যাধি থেকে বিরত হওয়া অতীব জরুরী।
৪। নবী ও আওলিয়াদের কবরের কাছে জবেহ করা
যদিও জবেহ আল্লাহর নামেই করা হয়। কারণ, এটি মূলত: মুশরিকদের কাজ। তারা তাদের যেসব ওলীদের মূর্তি বানিয়ে পূজা করত, তাদের মাজারে পশু নিয়ে জবেহ করত। আর যদি আল্লাহ ব্যতীত তাদের নামে জবেহ করা হয় তাহলেতো শিরক হবার ব্যাপারে কোনো সন্দেহই থাকে না।
৫। নবী ও ওলীদের কবরের তাওয়াফ করা
যেমন আব্দুল কাদের জিলানী রহ. মাঈনুদ্দিন চিশতী রহ. প্রমুখ। কারণ, তাওয়াফ হচ্ছে নির্দিষ্ট ইবাদত, যা কাবার চারপার্শ্বে ছাড়া অন্যত্র জায়েয নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ ﴿29الحج﴾
অর্থাৎ, তারা যেন প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করে। (সূরা হজ্জ : আয়াত ২৯)
৬। কবরের উপর সালাত আদায় করা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لا تَجْلِسُوا عَلى القُبُوْرِ وَلا تُصَلُّوْا عَلَيْهَا. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, তোমরা কবরের উপর বস না এবং তার উপর সালাত আদায় কর না। (মুসলিম)।
৭। বরকত লাভের আশায় কবর ও মাজারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা, কিংবা সেখানে গিয়ে সালাত আদায় করা
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا تُشَدُّ الرِّحَالُ إلاَّ إلى ثَلاثَةِ مَسَاجِدَ : المَسْجِدِ الحَرَامِ وَ مَسْجِدِيْ هَذَا وَالْمَسْجِدِ الأقصى. (متفق عليه)
অর্থাৎ, তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো দিকে ভ্রমণ করা যায় না, মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ এবং মসজিদুল আকসা। (বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং মদীনা শরীফ যিয়ারতের ইচ্ছা হলে আমরা নিয়ত করবো এ বলে, মসজিদে নববী যিয়ারতের জন্য যাচ্ছি ।
৮। আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত আইন ছাড়া ভিন্ন আইনে শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করা :
যেমন, জায়েয জ্ঞান করে কোরআন ও সহিহ হাদিসের মর্ম পরিপন্থী মানুষের বানানো আইন দ্বারা বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনা করা। অনুরূপভাবে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, অনেক আলেম নামধারী ব্যক্তিবর্গ কোরআন ও হাদিসের বিপরীতে ফতোয়া দিয়ে থাকে। যেমন, অনেক স্থানে স্থানীয় আলেমরা সূদকে হালাল বলে ফতোয়া দিয়েছে, অথচ আল্লাহ সূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
৯। কোরআন ও সহিহ হাদিসের বিপরীতে নেতৃবর্গ, আলেম-ওলামা বা পীর-বুজর্গদের আনুগত্য করা।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
لا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِى مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ. (رواه أحمد)
অর্থাৎ, স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা চলবে না। (আহমদ)।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ ﴿التوبة31﴾
তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।(সূরা তাওবা: আয়াত ৩১)
হুযাইফা রা. তাদের ইবাদতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তাদের আলেমরা যা হালাল করত তারাও তা হালাল বলে মেনে নিত অনুরূপভাবে যা হারাম করত, তারাও তাকে হারাম জ্ঞান করত। ব্যাপারটি আল্লাহর হুকুমের বিপরীত হলেও তারা তা-ই করত।
মাজার ও দর্শনীয় বস্তুর বিধান
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের নানা দেশ যেমন, সিরিয়া, ইরাক, মিশর, হিন্দুস্থান ও বাংলাদেশে যে সব মাজার (সংষ্কৃতি) দেখা যাচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে ইসলামি শিক্ষা ও আদর্শ বিরুদ্ধ। কারণ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের উপর ঘর বা সৌধ নির্মাণ, কবরে ঘটা করে উপস্থিত হওয়া এবং সেখানে উৎসব আয়োজন করতে পরিস্কার নিষেধ করেছেন।
نَهى رَسُولُ اللهِ صلى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأنْ يَّقْعُدَ عَلَيْهِ وَأنْ يُّبْنى عَلَيْهِ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর চুনকাম বা প্লাষ্টার করা, করবের উপর বসা এবং তার উপর ঘর (বা সৌধ) নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছেন। (মুসলিম)
তিরমিযিতে আছে : তিনি আরো নিষিদ্ধ করেছেন, তার উপর কোনো কিছু লিখতে- সেটি কোরআনের আয়াতই হোক কিংবা কবিতাই হোক।
১। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এ সব মাজারের নামকরণই ভুল ও বিভ্রান্তি মূলক। যেমন, হোসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেন ইরাকের কারবালায়, তাঁকে মিশরে নেয়া হয়নি। (বরং কারবালাতেই সমাহিত করা হয়েছে এটিই সাভাবিক)। সুতরাং মিশরে তাঁর কবর ও সমাধি আবিষ্কার করা মিথ্যা বৈ নয়। এর চেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, মুসলিমদেরকে মসজিদে দাফন করা হয় না। কারণ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিস্পাত করে বলেছেন :
قَاتَلَ اللهُ الْيَهُوْدَ اتَّخَذُوْا قُبُورَ أنْبِيائهِمْ مَسَاجِدَ (متفق عليه)
অর্থাৎ, আল্লাহ ইহুদিদের ধ্বংস করুন। কারণ, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে (সেজদার স্থান) মসজিদে রূপান্তরিত করেছে। (বুখারি ও মুসলিম)।
এ কড়াকড়ি আরোপের তাৎপর্য হচ্ছে, মসজিদগুলোকে শিরক হতে সংরক্ষিত রাখা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا ﴿18الجن﴾
আর নিশ্চয় মসজিদগুলো আল্লাহরই জন্য। কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না। (সূরা জিন: আয়াত ১৮)
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদে দাফন করা হল কিভাবে ? জবাবে বলব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাফন করা হয়েছিল মূলত: আয়েশা রা.-এর ঘরে। মসাজিদে নয়। উমাইয়া শাসকরা মসাজদকে প্রশস্ত করার সময় তাঁর কবরকেও এর মধ্যে প্রবেশ করায়।
হোসাইন রা.-এর কবর এখন মসজিদের মধ্যে অবস্থিত। কিছু কিছু লোক তার চতুরপার্শ্বে তাওয়াফ করে। রোগ ও বিপদমুক্তির মত বিষয় তার কাছে প্রার্থনা করে যা কেবল আল্লাহ তাআলার ক্ষমতাধীন। (আমাদের বক্তব্য হচ্ছে) আমাদের দ্বীন আমাদেরকে অনুমোদন দেয় কেবল আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে। আর নিষেধ করে কাবা ছাড়া অন্য কোনো ঘর তাওয়াফ করতে।
২। ইসলাম কবরের উপর গম্বুজ-সৌধ ইত্যাদি নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে । এগুলো কেবল মসজিদের জন্য নির্মাণের অনুমোদন দেয়। বর্তমানে হোসাইন রা. ও আব্দুল কাদের জিলানীসহ বিভিন্ন লোকের কবর ও মাজারের উপর যেসব গম্বুজ ও সৌধ দেখা যায় তা ইসলামে সরাসরি নিষিদ্ধ। (লেখক বলেন) আমার এক বন্ধু বলেছেন : আমি এক ব্যক্তিকে কেবলা ত্যাগ করে আব্দুল কাদের জিলানী রহ.-এর কবরের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করতে দেখি। এ বিষয়ে তাকে উপদেশ দিলে সে তা পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করে। আর আমাকে আক্রমণ করে বলে, আপনি একজন ওহাবি। হয়ত সে কবরের উপর বসা ও কবরের দিকে মুখ করে সালাত আদায় যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ সে সংক্রান্ত হাদিসগুলো শুনেনি।
৩। অধিকাংশ মাজার ও স্মৃতি:সৌধগুলো ফাতেমীদের সময় নির্মিত হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. তাদের সম্বন্ধে বলেছেন, কাফের, ফাসেক, পাপিষ্ঠ ধর্মত্যাগী, মুনাফিক, আল্লাহর সিফাত অস্বীকারকারী ও ইসলাম অস্বীকারকারী অগ্নি পূজকদের মত তারা ছিল কাফের। তারা সালাত ও হজ্জ আদায় করত না। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখল মসজিদগুলো মুসল্লিতে পরিপূর্ণ। তারা মুসলিমদের হিংসা করত। তাই তাদেরকে মসজিদ হতে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করল। তারই অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা মাজার ও তাতে কুব্বা-গম্বুজ ও সৌধ নির্মাণ করল। সাধারণ লোকদের মাঝে প্রচারণা চালালো যে এগুলো হচ্ছে হোসাইন রা. ও জয়নাবের রা. কবর। লোকদের আকৃষ্ট করতে সেগুলোতে নানা উৎসবের ব্যবস্থা করল। এবং নিজেদের আসল পরিচয় আড়াল করার উদ্দেশ্যে নিজেদেরকে ফাতেমি নামে আখ্যায়িত করল। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিমরা তাদের কাছ থেকে শিরকে নিক্ষেপকারী এ বিদআত গ্রহণ করেছে। এর পেছনে প্রচুর টাকা-পয়সা অপচয় করছে। অথচ এ মুহূর্তে নিজেদের দ্বীন ও সম্মান রক্ষার্থে সামরিক প্রস্তুতি, অস্ত্রপাতি কেনা ও তৈরির জন্য অর্থ-কড়ি সঞ্চয়ের দরকার ছিল বেশি।
৪। কিছু কিছু মুসলিম নিজেদের টাকা পয়সা অহেতুক কবরের পেছনে ব্যয় করছে। কবরের উপর ঘর নির্মাণ করছে, করবকে মাজারে পরিণত করছে, দেয়াল দিয়ে তা ঘিরে রাখছে এবং তার উপর নানা নিদর্শন তৈরী করছে। অথচ এগুলো মৃতুদের কোনোই উপকারে আসে না। যদি এ সব টাকা-পয়সা গরীব-অসহায়-বিত্তহীনদের পিছনে ব্যয় করত, তাহলে এর মাধ্যমে জীবিত ও মৃত উভয় শ্রেণীর লোকেরাই উপকৃত হত। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে কবরের পেছনে অহেতুক অর্থ ব্যয় করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা. -কে বলেছেন :
لا تَدْعُ تِمْثَالاً إلا طَمَسْتَهٌ وَلا قَبْرًا مُشْرِفًا إلا سَوَّيْتَهُ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, কোনো সৌধ পেলে অবশ্যই তা নি:শ্চিহ্ন করে দেবে, এবং কোনো উঁচু কবর পেলে তা ভেঙ্গে মাটির সাথে সমান করে দেবে। (সহিহ মুসলিম)
হ্যাঁ, ইসলাম কবরকে এক বিঘত পরিমাণ উঁচু করতে অনুমতি দিয়েছে।
৫। মৃতুদের জন্য নযর পেশ করা বড় শিরকের অন্তর্ভূক্ত। এসব পেশকৃত বস্তু মূলত: তাদের খাদেমদের হারামভাবে উপার্জিত সম্পদ। তারা তা পাপ ও ভোগ-লালসার কাজে ব্যয় করে। ফলে, নযর দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই সমানভাবে এই পাপের অংশীদার হবে। যদি এই টাকাগুলো সহায় সম্বলহীন গরীবদের দান করা হত তাহলে তারা উপকৃত হতে পারত। আর দানকারীরাও যে নিয়তে দান করছে তার ফল পেত।
শিরকের ক্ষতিকর দিক ও তার বিপদসমূহ
ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে শিরকের অনেক অনিষ্টকর দিক আছে। তার মাঝে বিশেষ বিশেষ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো,
১। শিরক মানবতার জন্য অবমাননাকর,
শিরক মানুষের সম্মানকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়, তার সামর্থ ও মর্যাদা নীচু করে দেয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাঁর খলীফা হিসাবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তাদেরকে সম্মানিত করেছেন। তাঁর সমস্ত নাম শিখিয়েছেন। আসমান ও যমীনস্থ সব কিছু তাদের অনুগত করে দিয়েছেন। এই জগতের সকলের উপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু শিরক করে তারা প্রমাণ করেছে যে তারা তাদের সে অবস্থা ও অবস্থানকে ভুলে গেছে। ফলে, তাদের অধীনস্থ ও মর্যায় তাদের থেকে নীচু কোনো জিনিসকে নিজেদের ইলাহ ও মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। এবং এরই মাধ্যমে নিজেদেরকে ছোট ও অপমানিত করেছে। এর থেকে অসম্মানের বিষয় আর কি হতে পারে, যে গাভীকে আল্লাহ মানুষের খেদমতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যাকে জবাই করে খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন সে গাভীকে আজ হিন্দুস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পূজা করা হয়। তাদের কাছে আরাধণা করা হয়। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, অনেক মুসলিম ব্যক্তিবর্গ মৃত মানুষের কবরের চারপাশে ঝাঁক ধরে বসে থাকে। তাদের কাছে নিজেদের প্রয়োজন নিবেদন করে। অথচ এসব মৃত ব্যক্তি তাদের মতই আল্লাহর দাস। তারা নিজেদেরই কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। লক্ষ্য করে দেখুন, হোসাইন রা.-এর কবরের চতুর্পাশ্বে বর্তমানে লোকেরা ভিড় জমায়। নিজেদের কষ্ট দূর করার জন্য তাঁর নিকট প্রার্থনা করে। অথচ তিনি জীবত অবস্থায়ই নিজেকে শহীদ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। নিজের মুসিবত দূর করতে পারেননি। তাহলে মৃত্যুর পর কেমন করে অপরের কষ্ট দূর করবেন? মানুষের ভাল ডেকে আনবেন? বরং সত্য কথা হলো মৃত ব্যক্তিরাই জীবিত মানুষের দোয়ার মূখাপেক্ষী। তাই আমাদের উচিত আমরা যেন তাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহকে ছেড়ে কোনো অবস্থাতেই যেন তাদের কাছে দোয়া না চাই ।
এ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ ﴿20﴾ أَمْوَاتٌ غَيْرُ أَحْيَاءٍ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ ﴿21﴾
অর্থাৎ, আর তারা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ডাকে, তারা কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়। (তারা) মৃত, জীবিত নয় এবং তারা জানে না কখন তাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে। (সূরা নাহল: আয়াত ২০-২১)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ ﴿الحج:31﴾
অর্থাৎ, আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অত:পর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোনো জায়গায় নিক্ষেপ করল। ( সূরা হজ্জ: আয়াত, ৩১)
২। শিরকের কারণে আজেবাজে কুসংস্কার ও বাতিল রসম-রেওয়াজ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে।
কারণ, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে এই জগতে আল্লাহ ছাড়াও অন্যের প্রভাব আছে, যেমন : গ্রহ-নক্ষত্র, জিন, নশ্বর আত্মা ইত্যাদি তার বোধ-বুদ্ধি এমন হয়ে যায় যে, নানা কুসংস্কারকে সে গ্রহণ করতে তৈরী হয়ে যায় এবং সকল মিথ্যাবাদী-দাজ্জালদের বিশ্বাস করতে শুরু করে। আর এইভাবেই জিন বশকারী, গণক, যাদুকর, জ্যোতিষী এবং এ জাতীয় লোকদের মাধ্যমে সমাজের মধ্যে শিরক প্রবেশ করে থাকে। তারা মিথ্যা দাবী করে বলে যে, আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে পারি, সামনে কি হবে আমাদের সব জানা আছে। অথচ এসব বিষয় আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। এসব কারণে সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে আসবাব সংগ্রহের প্রচেষ্টা দূর্বল হয়ে যায় এবং জগতের নিয়ম পাল্টে যেতে থাকে।
৩। শিরক সবচেয়ে বড় যুলুম :
বাস্তবিকই এটা যুলম। কারণ, সবচেয়ে বড় সত্য হল আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং অন্য কোনো প্রতিপালকও নেই। তিনি ছাড়া আইন প্রণেতা আর কেউ নেই। কিন্তু মুশরিকরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে মাবূদ স্থির করে নেয়। অন্যের কাছ থেকে আইন ও বিধান গ্রহণ করে। তাছাড়া মুশরিকরা নিজেদের উপরও অবিচার ও যুলুম করে। কারণ তারা তাদেরই মত অন্য একজন দাশের গোলাম হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে স্বাধীন বানিয়ে সৃষ্টি করেছেন। শিরক অপরের উপরও অবিচার বা যুলুম। কারণ যে, আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করল, সে তো মহা অত্যাচার করল। কারণ এর মাধ্যমে সে এমন কাউকে সে হক দিল যার সেই অধিকার নেই।
৪। শিরক হচ্ছে সমস্ত কল্পনা ও ভয়-ভীতির মূল:
কারণ, তার মাথায় নানা কুসংস্কার বাসা বাঁধতে শুরু করে। এবং দলীল প্রমাণ বিহীন নানা আজে বাজে কথা ও কাজকে গ্রহণ করতে থাকে। ফলে সমস্ত দিক হতেই নানা ভীতি তাকে গ্রাস করে ফেলে। কারণ, সে এমন সব মাবূদের উপর ভরসা করতে শিখেছে। যাদের অক্ষমতা স্বীকৃত। তারা প্রত্যেকেই নিজ বা অন্যের কল্যাণ বা ক্ষতি করতে অপারগ। এমনকি নিজেদের থেকেও তারা কষ্ট-মুসিবত দূর করতে পারে না। ফলে, যেখানে শিরক চলে সেখানে কোনো বাহ্যিক কারণ ছাড়াই নানা ধরণের কুসংস্কার ও ভীতি প্রকাশ পেয়ে থাকে।
আল্লাহ তাআলা এ সম্বন্ধে বলেন :
سَنُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ بِمَا أَشْرَكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ وَبِئْسَ مَثْوَى الظَّالِمِينَ ﴿151ال عمران﴾
অর্থাৎ, অচিরেই আমি কাফেরদের অন্তরসমূহে আতঙ্ক ঢেলে দেব। কারণ তারা আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, যে সম্পর্কে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। আর তাদের আশ্রয়স্থল হল আগুন এবং যালিমদের ঠিকানা কতই না নিকৃষ্ট। (সূরা আল এমরান, ৩ : ১৫১ আয়াত)।
৫। শিরকের কারণে সম্পাদিত সকল নেক আমল নষ্ট হয়ে যায়
কারণ, শিরক তার অনুগামীদেরকে মাধ্যম ও শাফায়াতকারীর উপর ভরসা করতে শেখায়। ফলে, নেক আমল ত্যাগ করতে শুরু করে এবং এ ধারণার বশবর্তী হয়ে গুনাহ করতে শুরু করে, সমস্ত অলীরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। এমনটিই ছিল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবদের বিশ্বাস।
এদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন :
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ ﴿يونس18﴾
অর্থাৎ, আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’। বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও যমীনে থাকা এমন বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছ যা তিনি অবগত নন? তিনি পবিত্র মহান এবং তারা যা শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। ( সূরা ইউনুস : আয়াত ১৮)
খৃষ্টানদের বিশ্বাসের প্রতি লক্ষ্য করে দেখুন, যারা একটার পর একটা অন্যায় কাজ করে যাচ্ছে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, ঈসা আ. যখন শূলে চড়েছেন তখন তাদের সমস্ত গুণাহ মুছে দিয়ে গেছেন। সম্ভবত তারই অনুকরণে আজ অনেক মুসলিম ফরয, ওয়াজিব ত্যাগ করছে ও নানা হারাম কাজে জড়িত হচ্ছে। এবং এ বিশ্বাস করে বসে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জান্নাতে প্রবেশের জন্য অবশ্যই শাফাআত করবেন। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আদরের কন্যা ফাতেমা রা.-কে বলেছেন,
يا فاطمة بنت محمدٍ سَلِيْنى مِن مالي مَا شئتِ لا أُغْني عَنكِ مِنَ الله شيئاً . (رواه البخاري)
অর্থাৎ, হে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ! তুমি আমার সম্পদ হতে যা ইচ্ছা চেয়ে নাও। আখিরাতে আল্লাহর হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর ব্যাপারে আমার কোনো ক্ষমতা নেই। (বুখারি)।
৬। শিরকের কারণে মানুষ চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে
শিরকের কারণে মানুষ পৃথিবীতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং আখিরাতের চিরস্থায়ী আযাব ভোগ করবে। আল্লাহ বলেন :
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ ﴿72المائدة﴾
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, তার ঠিকানা আগুন এবং যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়িদা: আয়াত ৭২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَدعُو منْ دونِ الله ندًّا دخلَ النّار (رواه البخاري) ( الند: المثيلُ والشريكُ)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা গেল যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সমকক্ষ ডাকত, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (বুখারি)।
৭। শিরক উম্মতের ঐক্য বিনষ্ট করে তাদেরকে টুকরা টুকরা করে দেয়।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿31﴾ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ﴿32الروم﴾
অর্থাৎ, তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। ( তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত। (সূরা রূম: আয়াত ৩১-৩২)
মূল কথা:
আলোচনা থেকে পরিস্কারভাবে এটাই ফুটে উঠেছে যে, শিরক খুবই মন্দ ও নিকৃষ্ট কাজ। তাই তা থেকে বেঁচে থাকা ফরয। তাতে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে যার পর নাই সতর্ক থাকা এবং যতদূর সম্ভব তা হতে দূরে অবস্থান করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কারণ, এটি সবচেয়ে বড় গুনাহ। যা বান্দার সমস্ত নেক আমল নিষ্ফল ও বিনষ্ট করে দেয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا ﴿الفرقان23﴾
অর্থাৎ, আর তারা যে কাজ করেছে আমি সেদিকে অগ্রসর হব। অত:পর তাকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে দেব। (সূরা ফুরকান: আয়াত ২৩)
শরীয়ত সম্মত অসিলা তালাশ করা
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ(المائدة 35)
অর্থাৎ, হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর কাছে অসিলা তালাশ কর (অর্থাৎ তার নৈকট্যের অনুসন্ধান কর)। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩৫)।
এ আয়াতের তাফসিরে কাতাদাহ রহ. বলেছেন: তাঁর আনুগত্য ও সে সব আমলের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন কর যে সব আমল তিনি পছন্দ করেন এবং সন্তুষ্ট হন। শরীয়ত সম্মত অসিলা তালাশ করার ব্যাপারে আল কোরআন আমাদেরকে হুকুম করেছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাগিদ দিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম রা. সে নির্দেশ মোতাবেক আমল করেছেন। অসিলা তালাশের বিষয়টি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। বিশেষ কয়টি এখানে উল্লেখ করা হলঃ
১। ঈমানকে অসিলা বানান :
অর্থাৎ ঈমানের অসিলা দিয়ে কিছু প্রার্থনা করা। বান্দারা ঈমানের সাহায্যে কিভাবে অসিলা তালাশ করবে- সে সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :
رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آَمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآَمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ ﴿193ال عمران﴾
অর্থাৎ, ‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা শুনেছিলাম একজন আহ্বানকারীকে, যে ঈমানের দিকে আহবান করে যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন’। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং বিদূরিত করুন আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর আমাদেরকে মৃত্যু দিন নেককারদের সাথে। (সূরা আল ইমরান: আয়াত ১৯৩)
২। আল্লাহর একত্ববাদকে অসিলা বানান :
যেমন ইউনুস আ.-কে যখন মাছে গিলে ফেলেছিল তিনি দোয়া করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেন :
فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ ﴿الانبياء87﴾ فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِينَ ﴿88﴾
অর্থাৎ, তারপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, ‘আপনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই’। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম’ ।অতঃপর আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং দুশ্চিন্তা থেকে তাকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ও ৮৮)
৩। আল্লাহর পবিত্র নাম দ্বারা অসিলা খোঁজা :
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا (الاعراف 180)
অর্থাৎ, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা তোমরা তাঁকে ডাকো। (সূরা আরাফ : আয়াত ১০০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নামের মাধ্যমে তাঁর নিকট সাহায্য চাইতেন : বলতেন,
اسألك بكل اسم هو لك ... (رواه الترمذى)
অর্থাৎ, আমি তোমার কাছে তোমার সমস্ত নামের অসিলায় প্রার্থনা করছি...। (তিরমিযি, হাসান, সহিহ)
৪। আল্লাহ তাআলার গুণাবলির দ্বারা অসিলা তালাশ করা
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন :
يا حَيُّ يا قَيُّومُ برَحْمَتِكَ أسْتَغِيْثُ . رواه الترمذي
অর্থাৎ, হে চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী! তোমার দয়া (র অসিলা)য় সাহায্য প্রার্থনা করছি। (তিরমিযি)
৫। নেক আমলের দ্বারা অসিলা খোঁজা
যেমন, সালাত, মাতা-পিতার খেদমত, অন্যের হক আদায়, আমানত দারী ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করা।
সহিহ মুসলিমে পাহাড়ী গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির কথা বর্ণিত হয়েছে, যারা নিজ নিজ নেক আমলের অসিলায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাদেরকে সেখান থেকে নাজাত দান করেন। তারা মাতা-পিতার খিদমত, শ্রমিকের হক ও আল্লাহর তাকওয়া-র অসিলায় দোয়া করেছিল, ফলে আল্লাহ তাদের হিফাযত করেন।
৬। পাপকার্য ত্যাগ করার দ্বারা অসিলা তালাশ করাঃ
যেমন আল্লাহ তাআলার নিষিদ্ধকৃত যিনা, মদ ও এরূপ অন্যান্য হারাম কাজ। উপরোল্লেখিত হাদীসে তিন ব্যক্তির একজন আপন চাচাত বোনের সাথে যিনা করার সুযোগ পেয়েও আল্লাহর ভয়ে তা ত্যাগ করেন, পরবর্তীতে গুহায় আটকে পড়লে সে যিনা ত্যাগের অসিলায় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আর আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে হেফাযত করেন।
৭। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ, তিনি ও তাঁর সাহাবাদের প্রতি ভালবাসাকে অসিলা বানান। এগুলো সেই সব নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত যা সম্পাদনকারীকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।
৮। যাকাত আদায়, দান-সদকা, ভাল ভাল কথা, যিকর-আযকার, কোরআন তিলাওয়াত, একত্ববাদীদের প্রতি ভালবাসা ও মুশরিকদের সাথে শত্রুতা পোষণকে অসিলা বানানো।
৯। জীবিত নেককার লোকদের কাছে দোয়া চাওয়া
যেমন জনৈক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাহাবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন, যাতে আল্লাহ তার চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দোয়া করেন এবং তাকেও তাঁর সাথে দোয়া করতে বলেন। ফলে আল্লাহ তার চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দোয়া কবুল হবে এবং সেটা তাঁর মুজিযা। জনৈক ব্যক্তি যাতে ব্যক্তি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফায়াত পান, তার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করেন আর আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন।
নিষিদ্ধ ও অর্থহীন অসিলা তালাশ ও তার শ্রেণী বিভাগ
১। মৃত ব্যক্তির মাধ্যমে অসিলা খোঁজা
মৃতদের কাছে প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস প্রার্থনা করা কিংবা তাদের নিকট সাহায্য চাওয়া। কতিপয় মানুষ একে অসিলা মনে করে, মূলে কিন্তু তা নয়। কারণ, অসিলার অর্থ হল আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া (বা অনুমোদিত পন্থায় তাঁর নৈকট্য অর্জন করা); যা কেবল ঈমান ও নেক আমলের দ্বারা সম্ভব। আর মৃত্যুদের কাছে দোয়া করা, তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা প্রকারান্তরে আল্লাহ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। যা বড় শিরকের অন্তর্ভূক্ত। কারণ আল্লাহ বলেন :
وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ ﴿106يونس﴾
অর্থাৎ, আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। আর যদি তা কর তাহলে নিশ্চয়ই তুমি যালিম (মুশরিক)-দের অন্তর্ভূক্ত হবে। (সূরা ইউনুস: আয়াত ১০৬)
২। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জাত বা সম্মানের অসিলা খোঁজা :
যেমন বলা, হে আমার রব! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসিলায় আমাকে রোগমুক্ত কর। এটা নিষিদ্ধ ও দীন বহির্ভূত বিদআত। কারণ, সাহাবিদের কেউ এমনটি কখনো করেননি। খলীফা উমর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহতারাম চাচা আব্বাস রা.-এর জীবিত অবস্থায় তাঁর অসিলায় বৃষ্টির জন্য দোয়া করিয়েছিলেন। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসিলায় দোয়া করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি, কারণ নবীজী তখন জীবিত ছিলেন না। -আমাকে অসিলা করে দোয়া কর- মর্মে যে হাদিসটি উদ্ধৃত করা হয়, সেটি আসলে কোনো হাদিসই নয়। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. সে হাদিসকে জাল হিসাবে প্রমাণ করেছেন। এই নিষিদ্ধ ও বিদআতী অসিলা সংশ্লিষ্ট মানুষকে শিরক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। কারণ এসব অসিলা গ্রহণকারীরা কখনো কখনো এমন ধারণা করে বসে যে, আল্লাহ কোনো মাধ্যম ছাড়া করতে পারেন না। এর মাধ্যমে আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। তাইতো এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছেন : আমি আল্লাহ ছাড়া অন্যকে অসিলা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করাকে অপছন্দ করি।
৩। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর পর তাঁকে সম্বোধন করে বলা যে, হে রাসূল ! আমার জন্য দোয়া করুন। এটা জায়েয নয়। কারণ, সাহাবিরা কেউ এমনটি করেননি। তাছাড়া নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إذا مات الإنسان انقطع عنه عملُهُ إلا مِنْ ثَلاثَةٍ: من صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ او عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ او وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُولهُ (رواه مسلم)
অর্থাৎ, মানুষ মারা গেলে তিনটি ব্যতীত তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়, (সে তিনটি আমল হচ্ছে) সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়, এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম)।
এ আমলগুলোর সাওয়াব সম্পাদনকারী ব্যক্তিরা কবরেও পেতে থাকে।
আল্লাহ হতে সাহায্য পাওয়ার শর্তাবলী
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিরাত, তাঁর কর্মপন্থা, জিহাদ ও মুজাহাদা সম্বন্ধে ব্যাপক পড়াশুনা করলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলিই প্রথমে সামনে আসে,
১। তাওহীদের দাওয়াত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিসালাতের দায়িত্ব প্রাপ্তির পর পবিত্র মক্কাতে দীর্ঘ ১৩ বছর পর্যন্ত মানুষকে তাওহিদ ও একত্ববাদের প্রতি আহ্বান করেছেন। যাবতীয় ইবাদত, দোয়া ও হুকুমে তাওহিদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বিভিন্নভাবে তিনি লোকদের তাওহিদ গ্রহণ ও শিরক বর্জনের তাগিদ দিয়েছেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় এই আকীদা তাঁর সাহবীদের অন্তরে দৃঢ়ভাবে বসে যায়। তাই তাঁরা প্রত্যয়ী ও সাহসী হয়ে উঠেন। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতেন না। শত বাধা বিপত্তি সত্বেও তাওহিদের উপর অবিচল থাকেন। এবং ঘৃণাভরে যাবতীয় শিরককে অস্বীকার করেন। সুতরাং দীনের পথের দায়ীদের উপর তাই ওয়াজিব হচ্ছে, তাওহিদ দিয়েই দাওয়াত শুরু করা এবং শিরকের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করা। আর এর মাধ্যমেই তারা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুগামী হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে।
২। জাত, বর্ণ, গোত্র ভুলে দীনী ভ্রাতৃত্ব বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন
মক্কায় তের বছর অতিবাহিত করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করেন। উদ্দেশ্য, বর্ণ গোত্রের সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মুসলিমদের নিয়ে এমন এক সমাজ গঠন করা যা কেবল ভালবাসার সূত্রে গঠিত হবে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তিনি সেখানে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ কাজে হাত দিলেন। যাতে মুসলিমরা আপন রবের ইবাদতের জন্য প্রত্যহ পাঁচবার মিলিত হবে। এবং নিজেদের মাঝে হৃদ্যতা ও ভালবাসার সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে। পাশাপাশি তিনি মদিনার আদি অধিবাসী আনসার এবং মক্কা হতে গৃহ ও ধন-সম্পদ ত্যাগ করে আগমনকারী মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে মর্মে তিনি তাদের বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেন। নবীজীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় তাদের মাঝে এমন এক বন্ধনের সৃষ্টি হয় যা বিশ্ব ইতিহাস ইত:পূর্বে আর দেখেনি। আনসাররা নিজ ধন-সম্পদ মুহাজির ভাইদের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়ছিলেন। এমনকি জনৈক সাহাবি তাঁর দু’স্ত্রীর একজনকে মুহাজির ভাইকে বেছে নিতে প্রস্তাব করেছিলেন। তারা মুহাজিরদের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের উপর প্রাধান্য দিতেন। মদিনায় আগমন করার পর নবীজী লক্ষ্য করলেন সেখানের প্রসিদ্ধ গোত্র আউস ও খাজরায পরস্পর শত্রুতায় লিপ্ত। এ শত্রুতা তাদের মাঝে বহুদিন থেকে চলে আসছে। তিনি তাদের মধ্যকার যুগ যুগ ধরে বিরাজমান শত্রুতার স্থায়ীভাবে অবসান ঘটাতে সক্ষম হন। এবং এমন এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করতে সচেষ্ট হন যা ইতিহাসে বিরল। এ ভালবাসার সেতুবন্ধনের নাম হচ্ছে ঈমান ও তাওহিদ।
৩। নিজেদের প্রস্তুত করণ :
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মুসলিমদেরকে নিজ শত্রুদের বিরুদ্ধে তৈরী হতে নির্দেশ দিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ (الانفال 60)
অর্থাৎ, আর তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত কর, তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে... (সূরা আনফাল: আয়াত ৬০)
এই আয়াত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
ألا إن القوة الرمي
তিনি বলেন, শোন! নিশ্চয়ই নিক্ষেপের মধ্যেই শক্তি । (সহিহ মুসলিম)
তীর নিক্ষেপ ও সামর্থ্য অনুযায়ী তার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা সমস্ত মুসলিমের উপর ওয়াজিব। অনুরূপভাবে কামান, ট্যাঙ্ক ও উড়োজাহাজ চালনাসহ অন্যান্য সামরিক অস্ত্রপাতির ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নেওয়া তার অন্তর্ভুক্ত। আজ যদি স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এসব অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত। এবং এ ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করত। তাহলে তারা নিজ ব্যক্তি, দেশ ও দীন সংরক্ষণের কাজে ফল দিত। বড়ই পরিতাপের বিষয় আজ মুসলিম ছেলেরা তাদের সময় নষ্ট করছে ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলার পিছনে। উরু বের করে খেলায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অথচ ইসলাম আমাদেরকে উরু ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এসব খেলাধুলায় জড়িত হতে গিয়ে তারা ইসলামের বুনিয়াদি ফরজ সালাতকে নষ্ট করে এমন গুরুতর অপরাধ করছে যা কুফরের শামিল।
৪। আমাদের পূর্ববর্তীদের অনুবর্তিতায় আমরা যখন একই আকীদাহর উপর প্রত্যাবর্তন করব এবং আমল করতে থাকব তখন আমরাও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাব। আমাদের মাঝে অটুট এক বন্ধন সৃষ্টি হবে। সেই একতার মাধ্যমে অন্যতম এক শক্তি তৈরী হবে। সেই শক্তিকে অবলম্বন করে আমরা যদি দ্বীনের জন্য আমাদের শত্রুদের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে আমাদের কাছে মওজুদ আরো সব অবলম্বন ও অস্ত্রপাতিসহ তৈরী হই, ইনশাআল্লাহ তখনই আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্য সাহায্য আসবে। যেমনিভাবে সাহায্য এসেছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথীদের উপর।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ ﴿محمد7﴾
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহলে আল্লাহও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদসমূহকে সুদৃঢ় করবেন।(সূরা মুহাম্মাদ : আয়াত ৭)
৫। এসব কথার অর্থ এই নয় যে, এ অবস্থা আলাদাভাবে পরিলক্ষিত হবে। অর্থাৎ, ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব তাওহীদের সাথে সাথে না এসে আলাদাভাবে আসবে। বরং এগুলি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।
আল্লাহ বলেন :
وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ ﴿47الروم﴾
অর্থাৎ, আর মুমিনদের সাহায্য করাতো আমার কর্তব্য। (সূরা রূম: আয়াত ৪৭)
উপরোক্ত আয়াতসহ বহু আয়াতে আল্লাহ রাহমানুর রাহীম মুমিনদের সাহায্য করার ব্যাপারে পরিস্কার অঙ্গীকার করেছেন। আর এ প্রতিশ্রুতি এমন এক সত্ত্বার যার পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বদর, উহুদ, খন্দকসহ সব জিহাদে জয়যুক্ত করেছেন। আর এ বিজয় একমাত্র তাঁর সাহায্যের কারণেই সূচিত হয়েছে। তাঁর বিদায়ের পরও আল্লাহ তাআলা এ ধারা অব্যহত রেখেছেন। তাঁর সাহাবিদেরকে অসংখ্য বার তিনি শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করেছেন। একইভাবে পৃথিবী ব্যাপী মুসলিমগণ আল্লাহর সাহায্য পেয়ে একর পর এক দেশ জয় করেছিলেন এবং ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল। যদিও বিভিন্ন সময় তাদেরকে নানা ধরণের বিপদ-আপদ, বালা-মসিবত গ্রাস করেছিল। কিন্তু তারা সুখে দুঃখে- সর্বাবস্থায় ঈমান, তাওহিদ ও ইবাদতের ক্ষেত্রে নিজ রবের প্রতি আস্থা ও ভক্তিতে দৃঢ় ছিলেন বলে আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেছেন। পরিণামে তারাই হয়েছিলেন জয়যুক্ত দল।
কোরআনুল কারীমে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আমরা দেখতে পাই, বদরের যুদ্ধে মুসলিমরা সংখ্যায়, অস্ত্র ও সমর উপকরণে প্রতিপক্ষের তুলনায় ছিলেন খুবই নগণ্য। আল্লাহ তাদেরকে বললেন :
إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ ﴿الانفال9﴾
অর্থাৎ, আর স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট ফরিয়াদ করছিলে, তখন তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যে, নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পর পর আগমনকারী এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করছি। (সূরা আনফাল : আয়াত ৯)
আল্লাহ রাব্বুল ইযযত তাদের দোয়া কবুল করেন। ফেরেশতারা তাদের সাথে একত্রে যুদ্ধ করে তাঁদেরকে সাহায্য করেছিলেন। কাফিরদের গর্দান উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গ কর্তন করেছিলেন। এ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ ﴿الانفال12﴾
অর্থাৎ, অতএব তোমরা আঘাত কর ঘাড়ের উপরে এবং আঘাত কর তাদের প্রত্যেক আঙুলের অগ্রভাগে। (সূরা আনফাল : আয়াত ১২)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :
وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴿123آل عمران﴾
অর্থাৎ, আর অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে বদরে সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে হীনবল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায়, তোমরা শোকরগুজার হবে। (সূরা আলে-ইমরান: আয়াত ১২৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরে এ বলে দোয়া করেছিলেন :
اللّهمَّ آتنى مَا وَعَدْتَنى به اللَّهُمَّ إن تَهْلِكْ هذه الْعِصَابَةَ مِنْ أهْلِ الاسْلامِ لا تُعْبَدْ فى الارضِ . (رواه مسلم)
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাকে যে প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়েছ তা দান কর। হে আল্লাহ! ইসলাম অনুসারীদের এই ছোট দলকে যদি ধ্বংস করে দাও তাহলে পৃথিবীর বুকে আর তোমার ইবাদত থাকবে না। (মুসলিম)
আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিমগণ তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, কিন্তু কোথাও জয়যুক্ত হচ্ছে না। এর কারণ কি? আল্লাহ তাআলা কি মুসলিমদের ব্যাপারে তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করছেন? না... কখনই না। তাহলে সে মুমিন কারা যাদেরকে তিনি সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? আমরা জিহাদরত মুজাহিদ ভাইদেরকে বলছি, নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করুন,
১। যে মূলমন্ত্র দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার জীবনে, জিহাদে অবতীর্ণ হবার পূর্বেই সাহাবিদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তারা কি সেই ঈমান ও তাওহীদের শক্তিতে নিজেদেরকে শক্তিমান করেছেন?
২। তারা কি সেসব সমরোপকরণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন যাদের ব্যাপারে তাদের রব নির্দেশ দিয়েছেন? আল্লাহ রাব্বুল ইযযত বলেন :
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ (الانفال 60)
অর্থাৎ, এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যতটা পার শক্তি সঞ্চয় করতে থাক। (সূরা আনফাল : আয়াত ৬০)
এই শক্তি বলতে বুঝিয়েছেন, তীর নিক্ষেপ (অনুরূপভাবে সামরিক শক্তি সঞ্চয়) করা।
৩। তারা কি আপন রবকে সর্বাবস্থায় ডাকেন ? যুদ্ধের সময় এককভাবে একমাত্র তাঁর নিকটই দোয়া করেন ? নাকি এই দোয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে অন্যদেরও শরীক করেন? তারা যাদের ওলী বলে ধারণা করেন সেই সব মৃত ব্যক্তিদের কাছেও কি তারা দোয়া করেন? তারাতো মূলত: আল্লাহ তাআলার বান্দা ও দাস। তারা নিজেদেরও ভাল কিংবা মন্দ কিছুই করতে পারে না। কেন তারা দোয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করেন না? যিনি সর্বাবস্থায় একমাত্র তাঁর রবের নিকটই দোয়া করতেন।
আল্লাহ রাহমানুর রাহীম বলেন :
أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ (الزمر 36)
অর্থাৎ, আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন। (সূরা যুমার : আয়াত ৩৬)
৪। সর্বশেষ তাদের প্রতি আরজি করছি, আপনারা নিজ বিবেককে প্রশ্ন করুন, আপনারা কি একতাবদ্ধ এবং একে অপরকে সর্বাবস্থায় ভালবাসেন ?
আসলে সেসব মুজাহিদদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীই প্রযোজ্য ।
وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ (الانفال 46)
অর্থাৎ, এবং তোমরা পরস্পর বিবাদ করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নি:শেষ হয়ে যাবে। ( সূরা আনফাল : আয়াত ৪৬)
যদি মুজাহিদরা ঈমানের সে পর্যায়ে উঠতে পারে, তাহলে শীঘ্রই আল্লাহর প্রতিশ্রুত সাহায্য আসবে। কারণ, তিনি বলেছেন :
وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ ﴿47الروم﴾
অর্থাৎ, আর মুমিনদের সাহায্য করাতো আমার কর্তব্য। (সূরা রূম: আয়াত ৪৭)
বড় কুফর ও তার শ্রেণী বিভাগ
বড় কুফর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। আর এটি হচ্ছে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কুফরী। তার অনেক শ্রেণী বিভাগ রয়েছে। যেমন,
১। মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার কুফরি :
কোরআন ও হাদিসকে অথবা তাদের কোনো অংশকে অস্বীকার করা।
কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ ﴿العنكبوت68﴾
অর্থাৎ, আর সে ব্যক্তির চেয়ে যালিম আর কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে অথবা তার নিকট সত্য আসার পর তা অস্বীকার করে? জাহান্নামের মধ্যেই কি কাফেরদের আবাস নয়? (সূরা আনকাবুত : আয়াত ৬৮)
অন্যত্র বলেন,
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ (البقرة85)
অর্থাৎ, তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? (সূরা বাকারা : আয়াত ৮৫)
২। অহঙ্কার প্রদর্শন ও অস্বীকার করার কুফরি :
আর তা হল সত্যকে জেনেও গ্রহণ না করা,তার অনুসরণ না করা। যেমনটি করেছিল ইবলিস। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে উদ্ধৃত হয়েছে,
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآَدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ ﴿البقرة34﴾
অর্থাৎ, আর যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সেজদা কর। তখন তারা সেজদা করল, ইবলিস ছাড়া। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার করল। আর সে হল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। ( সূরা বাকারা ২ : আয়াত ৩৪)
৩। কিয়ামত সম্বন্ধে সন্দেহ বা মিথ্যা ধারণা পোষণ করা কিংবা অস্বীকার করা
এদের সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا ﴿36﴾ قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا ﴿37﴾
অর্থাৎ, আর আমি মনে করি না যে, কেয়ামত সংঘটিত হবে। আর আমাকে যদি ফিরিয়ে নেয়া হয় আমার রবের কাছে, তবে নিশ্চয় আমি এর চেয়ে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল পাব। কথায় কথায় তার সঙ্গী বলল, তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অত:পর বীর্য থেকে, তারপর তোমাকে অবয়ব দিয়েছেন পুরুষের? (সূরা কাহাফ : আয়াত ৩৬ ও ৩৭)
৪। অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও বিমুখতা প্রদর্শন করার কুফরি
অর্থাৎ, ইসলাম যা দাবী করে ও নির্দেশ দেয় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন না করা। আল্লাহ বলেন :
وَالَّذِينَ كَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ ﴿3الاحقاف﴾
অর্থাৎ, আর যারা কুফরি করে, তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা থেকে তারা বিমুখ। (সূরা আহকাফ : আয়াত, ৩)
৫। নিফাকির কুফরি
আর তা হল মুখে ইসলাম প্রকাশ করা, অন্তরে ও কাজে তার বিরোধিতা করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا فَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ ﴿المنافقون3﴾
অর্থাৎ, তা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছিল তারপর কুফরি করেছিল। ফলে তাদের অন্তরসমূহে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারছে না। (সূরা মুনাফিকুন: আয়াত, ৩)
অন্যত্র বলেন :
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آَمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ ﴿8البقرة﴾
অর্থাৎ, আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি, অথচ তারা মুমিন নয়।(সূরা বাকারা: আয়াত ৮)
৬। অস্বীকার করার কুফরি
যেমন, কেউ ইসলাম কিংবা ঈমানের রুকনসমূহ, সালাত ইত্যাদির মত দ্বীনের প্রমাণিত কোনো বিষয়কে অস্বীকার করল, সালাত ত্যাগ করল। অনুরূপভাবে কোনো বিচারক কিংবা শাসনকর্তা আল্লাহর বিধানে বিচার ও শাসনকে অস্বীকার করল।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴿المائدة44﴾
অর্থাৎ, আর যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সেই মতে বিচার করে না তারা কাফির। (সূরা মায়েদা: আয়াত ৪৪)
ইবনে আব্বাস রা. বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অস্বীকার করল সে কুফরি করল।
ছোট কুফর ও তার শ্রেণী বিভাগ
ছোট কুফর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। যেমন,
১। নিয়ামতের কুফরি করা
আল্লাহ তাআলা মুসা আ.-এর কওমের মুমিনদের উদ্দেশ্য করে বলেন :
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ﴿ابراهيم7﴾
অর্থাৎ, আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব আর যদি তোমরা (কুফরি করে) অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন। (সূরা ইব্রাহিম : আয়াত ৭)
২। আমলের ক্ষেত্রে কুফরি
আর তা হচ্ছে সে সব পাপকাজ যাকে কোরআন কিংবা হাদিসে কুফরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু সম্পাদনকারীকে ঈমানদার বলেই বিবেচনা করা হয়।
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
سِبَابُ المسلمِ فُسُوقٌ وَ قِتَالُهُ كُفْرٌ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকি আর হত্যা করা কুফরি। (সহিহ বুখারি)
অন্যত্র বলেছেন :
لا يَزْنى الزَّانى خِيْنَ يَزْنى وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلاَيَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ (رواه مسلم)
অর্থাৎ, যেনাকারী যখন যেনা করে তখন সে আর মুমিন থাকে না এবং মদ্যপ যখন মদ পান করে তখন সে আর মুমিন থাকে না। ( সহিহ মুসলিম)।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন :
বান্দা ও শিরক-কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত ছেড়ে দেয়া। (সহিহ মুসলিম)
বান্দা ও শিরক-কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত ছেড়ে দেয়া। (সহিহ মুসলিম)
কতিপয় শরিয়তবিদ অস্বীকার না করে অলসতা বশত: সালাত ত্যাগ করাকেও কুফরি বলে মন্তব্য করেছেন। তবে সর্বসম্মত মতে সালাত ত্যাগ করা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।
৩। বিচার ও শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে কুফরি,
যে বিচারক বা শাসনকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত আইনে বিচার করে না, কিন্তু আল্লাহর আইনকে অস্বীকারও করে না, বরং সঠিক বলেই বিশ্বাস করে।
(তাদের এ বিচারকে কুফর বলা হয় কিন্তু এটি ছোট কুফর, যার কারণে পাপ হয় ঠিক কিন্তু ঈমান বিনষ্ট হয় না।)
ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন : যে আল্লাহর আইনকে অস্বীকার করে সে অত্যাচারী ফাসিক। আতা রা. বলেছেন : এই কুফর বড় কুফর নয়।
তাগুত পরিহার করা অতীব জরুরি
মহান আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ইবাদত করা হয় এবং তাতে তারা সন্তুষ্ট ও খুশী থাকে ইসলামি পরিভাষায় তাদেরকেই তাগুত বলা হয় । আল্লাহ তাআলা প্রতিটি যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এ নির্দেশ দিয়ে যে, তারা যেন লোকদের এক আল্লাহর ইবাদত ও তাগুত পরিহার করার প্রতি দাওয়াত দেয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ(النحل 36)
অর্থাৎ, আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে পরিহার কর। (সূরা নাহল : আয়াত ৩৬)
( ইসলামি পরিভাষায় নিম্নোক্ত ব্যক্তিদেরকেও তাগুতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে)
১। শয়তান, যে মানুষকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদতের দিকে ডাকে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آَدَمَ أَنْ لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ ﴿يس60﴾
অর্থাৎ, হে বনি আদম! আমি কি তেমাদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের উপাসনা করো না। নি:সন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । ( সূরা ইয়াসীন: আয়াত ৬০)
২। অত্যাচারী বিচারক, যে আল্লাহর হুকুম-আহকামকে বদলে ফেলে। ইসলামি চেতনা বিরোধী আইন প্রণয়ন করে।
২। অত্যাচারী বিচারক, যে আল্লাহর হুকুম-আহকামকে বদলে ফেলে। ইসলামি চেতনা বিরোধী আইন প্রণয়ন করে।
নতুন শরিয়ত প্রবর্তণকারী মুশরিকদে ধিক্কার দিয়ে আল্লাহ বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ (الشوري 21)
অর্থাৎ, তাদের জন্য কি এমন কিছু শরিক আছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা : আয়াত ২১)
৩। যে সব বিচারক-শাসনকর্তা মহান আল্লাহ প্রবর্তিত আইনকে বর্তমান যুগে প্রযোজ্য নয় মর্মে ধারণা করে সেসব আইনে বিচার-শাসন পরিচালনা করে না, এবং যারা কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইনকে বৈধ জ্ঞান করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴿المائدة44﴾
অর্থাৎ, আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন যারা সেই মতে বিচার-ফায়সালা করে না তারাই কাফির। (সূরা মায়েদা : আয়াত, ৪৪)
৪। ভবিষ্যৎ বা অদৃশ্য সম্বন্ধে জানে বলে যারা দাবী করে।
কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ (النمل 65)
অর্থাৎ, বল, আল্লাহ ছাড়া আসমানসমূহে ও জমিনে যারা আছে তারা গায়েব জানে না। (সূরা নামল : আয়াত ৬৫)
৫। আল্লাহকে ছেড়ে লোকেরা যার ইবাদত করে, বিপদাপদে ডাকাডাকি করে, আর এতে সে সন্তুষ্ট ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَهٌ مِنْ دُونِهِ فَذَلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ ﴿الانبياء29﴾
অর্থাৎ, আর তাদের মধ্যে যে-ই বলবে, তিনি ছাড়া আমি ইলাহ, তাকেই আমি প্রতিদান হিসেবে জাহান্নাব দেব; এভাবেই আমি জালিমদের আযাব দিয়ে থাকি। ( সূরা আম্বিয়া : আয়াত, ২৯)
সুতরাং প্রতিটি মুমিনের উপর জরুরি হল, যাবতীয় তাগুতকে অস্বীকার ও পরিহার করা। যাতে পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারে।
কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿البقرة256﴾
সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৬)
উপরোক্ত আয়াত এটাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহর ইবাদত ততক্ষণ পর্যন্ত উপকার দিবে না যতক্ষণ না তাঁকে ছেড়ে অন্যের ইবাদত করা হতে বিরত হবে। এ সম্বন্ধে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ قَالَ لاَ إلهَ إلا اللهُ وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُوْنِ اللهِ حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, যে বলবে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং তিনি ব্যতীত যাদের ইবাদত করা হয় তাদেরকে অস্বীকার করবে, তার সম্পদ ও জীবন হারাম (নিরাপদ) বলে বিবেচিত হবে। (মুসলিম)।
নিফাকে আকবর বা বড় নিফাক
মুখে মুখে বা বাহ্য ভাষায় ইসলাম প্রকাশ আর অন্তরে কুফরি পোষণ করাকে ইসলামি পরিভাষায় নিফাক বলে। আর এটি হচ্ছে বড় নিফাক। এর কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে, যেমন:
(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা জ্ঞান করা (২) তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার যে কোন একটিকে মিথ্যা জ্ঞান করা বা মন্তব্য করা (৩) রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে শত্রুতা পোষণ করা (৪) তাঁর আনীত যে কোনো বিষয়ের সাথে শত্রুতা পোষণ করা (৫) ইসলামের ক্ষতি ও পরাজয়ে আনন্দিত হওয়া এবং (৬) ইসলামের বিজয়কে অপছন্দ ও ঘৃণা করা।
মুনাফিকদের শাস্তি কাফেরদের শাস্তি হতেও মারাত্মক হবে বলে পবিত্র কোরআন সতর্ক করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ (النساء 145)
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্ব নিম্নস্তরে থাকবে। ( সূরা নিসা : আয়াত ১৪৫)
নিফাক ইসলামের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, নিফাকের ক্ষতি কুফরের ক্ষতির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাইতো আমরা দেখতে পাই আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার প্রথম দিকে দুটি আয়াতের মাধ্যমে কাফিরদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। আর মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন ১৩টি আয়াতের মাধ্যমে। ঈমানের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর এ মারাত্মক ব্যাধিতে মানুষ বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতি নিয়ত। লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব, শয়তানের ধোসর, সঠিক পথ হতে বিভ্রান্ত, সাধু-সূফী নামধারী বিভিন্ন ব্যক্তিরা ইসলামের লেবাস পরে মুসলমানদের ঈমান হরণ করছে নানা কায়দায়। তারা বাহ্যত: সালাত আদায় করে, সওম পালন করে কিন্তু নানা কৌশলে মুসলিমদের আকীদা নষ্ট করে । বিপদাবদে তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে ডাকাডাকি করে এবং নিজ নিজ অনুসারীদেরকেও ডাকতে উৎসাহীত করে। তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা, তাদের কবরে সেজদা দেওয়াকে পুণ্যের কাজ বলে প্রচার করে অথচ এসব কাজ ইসলামি আকীদা বহির্ভূত ও বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আবার কেউ কেউ প্রচার করে যে, মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। অথচ পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় বলা হয়েছে তিনি আরশের উপর আছেন। কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে। এছাড়াও তারা কোরআনের বহু আয়াত ও সহিহ হাদিসকে পর্যন্ত নানাভাবে অস্বীকার করে।
নিফাকে আসগর বা ছোট নিফাক
অর্থাৎ, বিশ্বাস ঠিক রেখে আমলের মাধ্যমে মুনাফিকী করা তথা মুনাফেকদের সদৃশ কোনো আমলে জড়িয়ে পড়া। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاثٌ : إذا حَدَّثَ كَذِبَ وَإذا وَعَدَ أخْلَفَ وَإذا اؤْتُمِنَ خَانَ (متفق عليه)
অর্থাৎ, মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে ভঙ্গ করে, আর আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। ( বুখারি ও মুসলিম )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেছেন :
اربعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةُ مِنْهُنَّ كَانَتْ فيْهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حتَّى يَدَعَهَا: إذا حَدَّثَ كَذِبَ وَإذا وَعَدَ أخْلَفَ وَإذا عَاهَدَ غَدَرَ وَإذا خَاصَمَ فَجَرَ. (متفق عليه)
অর্থাৎ, চারটি দোষ যার মধ্যে চারটিই বিদ্যমান হবে সে নির্ভেজাল মুনাফিক বলে গণ্য হবে। আর যার মাঝে উক্ত চারটির একটি সভাব থাকবে তাহলে এটি পরিত্যাগ করা অবধি তার মধ্যে নিফাকের একটি সভাব আছে বলে ধরা হবে। যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে, বিতর্ক করলে গালমন্দ করে। (বুখারি ও মুসলিম)
এই নিফাক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে না, কিন্তু তা কবীরা গুনাহ’র অন্তর্ভূক্ত। ইমাম তিরমিযি রহ. বলেছেন : বিজ্ঞ আলেমদের মতে এটি আমলী নিফাক। এটাই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মিথ্যার নিফাক।
আল্লাহর আউলিয়া ও শয়তানের আউলিয়া
আল্লাহ তাআলা বলেন :
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿62﴾ الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ ﴿63﴾﴿يونس﴾
অর্থাৎ, শুনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর অলীদের কোনো ভয় নেই, আর তারা পেরেশানও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করত। ( সূরা ইউনুস: আয়াত ৬২,৬৩)উপরোক্ত আয়াত আমাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে, মুমিন-মুত্তাকি ও নিজেকে যাবতীয় পাপকাজ হতে বিরত রাখেন এমন প্রতিটি ব্যক্তিই হচ্ছেন আল্লাহর অলী। যিনি সর্বদা আপন রবকে এককভাবে ডাকেন এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরিক করেন না। প্রয়োজন হলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন কারামত প্রকাশ করে থাকেন। যেমন, ঈসা আ:-এর মাতা মারইয়ামের জন্য সর্বদা গায়েব হতে রিযক আসত।
সুতরাং বেলায়াত বা অলীত্ব সত্য । কিন্তু অলী হবার জন্য শর্ত হচ্ছে তাঁকে মুমিন, আল্লাহর একান্ত অনুগত ও তাঁর একত্ববাদে বিশ্বাসী হতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের পূর্ণ অনুবর্তন তার মাঝে থাকতে হবে। শরয়ি বিধি-বিধান মান্যতার দিক থেকে অলস ও পাপকর্মে জড়িত কোনো ফাসেক কিংবা মুশরিক ব্যক্তির মধ্যে অলীত্ব প্রকাশ পাবে, এমনটি কোনোভাবেই সত্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। যে ব্যক্তি মুশরিকদের মত আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের নিকট দোয়া করে, সে কেমন করে আল্লাহর সম্মানিত অলী হতে পারে? আর কারামত বাপ-দাদার নিকট থেকে ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়ার কোনো বস্তু নয়। বরং এর সাথে ঈমান ও নেক আমল সম্পর্কযুক্ত। অনেক সময় দেখা যায়, বিদআতীরা তাদের শরীরে লোহা ইত্যাদি প্রবেশ করায়,আগুন গিলে খায় এবং এ জাতীয় নানা অলৌকিক কাজ প্রদর্শন করে। সেসব আসলে শয়তানের কাজ। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা ঐ ধরণের উদ্ভট কার্যকলাপ প্রদর্শন করে কারামত বলে চালিয়ে দেয়। এসব কাজের মাধ্যমে বরং তারা ক্রমান্নয়ে গোমরাহীর অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
قُلْ مَنْ كَانَ فِي الضَّلَالَةِ فَلْيَمْدُدْ لَهُ الرَّحْمَنُ مَدًّا (مريم 75)
অর্থাৎ, বল : যে বিভ্রান্তিতে রয়েছে তাকে পরম করুণাময় প্রচুর অবকাশ দেবেন। ( সূরা মারইয়াম: আয়াত ৭৫)
যারা ভারতে গিয়েছেন তারা অগ্নি উপাসকদের নিকট এর চেয়েও ভয়ানক বিষয় দেখতে পেয়েছেন। যেমন, তারা তলোয়ার দিয়ে একে অপরকে আঘাত করে, তবুও তাদের কোনো ক্ষতি হয় না, অথচ তারা কাফির ও মুশরিক। ইসলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিরা করেননি এমন কার্যাবলীর কোনো স্বীকৃতি দেয় না। এ জাতীয় কাজের মধ্যে যদি কোনো ফায়দা থাকত তাহলে অবশ্যই তারা এতে অগ্রগামী থাকতেন। অনেক লোকের ধারণা, আল্লাহর অলীরা গায়েবের খবর জানেন। কিন্ত সত্যিকার্থে গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহর হাতে। তবে কখনও কখনও তিনি গায়েবের কোনো কোনো বিষয় তাঁর রাসূলদের জানিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন :
عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا ﴿26﴾ إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ (الجن 26)
অর্থাৎ, তিনি গায়েবের জ্ঞানের অধিকারী, আর তিনি তাঁর গায়েবের খবর কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তাঁর মনোনীত রাসূল ছাড়া। ( সূরা জিন, ৭২: ২৬ আয়াত)।
এই আয়াতে শুধু রাসূলদের কথা বলা হয়েছে। অন্য কারও কথা বলা হয়নি।
কবরের উপর গম্বুজ ইত্যাদি দেখলেই কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে, এটি কোনো অলীর কবর। অথচ খোজ নিলে দেখা যায় তা হয়তো কোনো ফসিকের কবর। অথবা আদৌ ওখানে কাউকে কবরই দেয়া হয়নি। কবরের উপর গম্বুজ, সৌধ ইত্যাদি নির্মাণ করা ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে।
কবরের উপর গম্বুজ ইত্যাদি দেখলেই কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে, এটি কোনো অলীর কবর। অথচ খোজ নিলে দেখা যায় তা হয়তো কোনো ফসিকের কবর। অথবা আদৌ ওখানে কাউকে কবরই দেয়া হয়নি। কবরের উপর গম্বুজ, সৌধ ইত্যাদি নির্মাণ করা ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে।
হাদীসে আছে :
نَهى رَسُولُ اللهِ صلى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأنْ يَّقْعُدَ عَلَيْهِ وَأنْ يُّبْنى عَلَيْهِ. (رواه مسلم)
(رواه مسلم)
অর্থাৎ, অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর চুনকাম বা প্লাষ্টার করা, করবের উপর বসা এবং তার উপর ঘর (বা সৌধ) নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছেন। (সহিহ মুসলিম)
মসজিদে দাফন করা হয়েছে (আর সে তা জানার পরও নিষেধ করে যায়নি) এমন ব্যক্তি কখনই অলী হতে পারে না। কারো জন্য মাজার বানানো কিংবা কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা অলীদের কাজ হতে পারে না। কারণ, এগুলো ইসলামি শিক্ষার পরিপন্থী। মৃত ব্যক্তিদের স্বপ্নে দেখতে পাওয়াও শরিয়তের দৃষ্টিতে অলী হবার মাপকাঠি নয়, বরং তা অনেক সময় শয়তানের ধোকাও হতে পারে।
ঈমানের শাখাসমূহ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
الايمَانُ بضْعُ وَّ سِتُّونَ شُعْبَةً فَاَفْضَلُهَا قَوْلُ لا إلَهَ إلا اللهُ وَأدْنَاهَا إمَاطَةُ الأذى عَنِ الطَّرِيْقِ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, ঈমানের ৬৩ হতে ৬৯ শাখা রয়েছে। তার মধ্যে সর্বোত্তম হল কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা। আর সর্বনিম্ন হল, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা। (সহিহ মুসলিম)
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন : ইবনে হিব্বান যা বলেছেন তার সারমর্ম হল- এই শাখাগুলোর শ্রেণীবিভাগ মানুষের অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমল।
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন : ইবনে হিব্বান যা বলেছেন তার সারমর্ম হল- এই শাখাগুলোর শ্রেণীবিভাগ মানুষের অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমল।
১। অন্তরের আমল হল বিশ্বাস ও নিয়ত। এটি ২৪ ভাগে বিভক্ত।
আল্লাহর উপর ঈমান: এর মধ্যে রয়েছে, তাঁর জাত, সিফাত ও তাওহীদের উপর ঈমান। তিনি ছাড়া আর যা কিছু আছে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং তাদের ইবাদত না করা। যেমন : দোয়া, সাহয্য প্রার্থনা ও এ জাতীয় অন্যান্য কাজ।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ﴿الشورى11﴾
অর্থাৎ, তাঁর মত কিছু নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। ( সূরা শুরা : আয়াত ১১)
তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ, কিতাবসমূহ, রাসূলবৃন্দ, তাকদিরের ভাল-মন্দ, এবং আখিরাতের উপর ঈমান আনা:
আখিরাতের উপর ঈমানের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, কবরের সওয়াল জওয়াব, পূনরুত্থান, কবর থেকে উঠানো, হিসাব-নিকাশ, মীযান, পুলছিরাত, ও জান্নাত-জাহান্নাম।
আল্লাহর জন্য ভালবাসা এবং শত্রুতা তাঁর কারণেই।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মহব্বত এবং তাঁকে সম্মান করা।
এর মধ্যে রয়েছে তাঁর উপর দরূদ পাঠ করা এবং তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা।
ইখলাস : এর মধ্যে রয়েছে, রিয়া ও নিফাক ত্যাগ করা। তাওবা করা। ভয় ও আশা করা। শুকরিয়া আদায় করা, সততা, সবর, আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট থাকা এবং তাওয়াক্কুল।
রহমত ও বিনয় নম্রতা: এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হল বড়দের সম্মান করা, ছোটদেরকে ভালবাসা, অহংকার ও আত্মগর্ব ত্যাগ করা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ক্রোধ ত্যাগ করা।
২। জিহবার আমল : এর মধ্যে সাতটি ভাগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কালেমা শাহদাত পাঠ করা। কুরআন তেলাওয়াত করা, ইলম শেখা ও অন্যকে শেখানো। দোয়া, যিকর, এর মধ্যে আছে ইস্তেগফার করা ও মন্দ কথা থেকে বিরত থাকা।
৩। শরীরের আমল : এতে ৩৮ টি ভাগ রয়েছে।
ক) এর কতগুলি চোখের সাথে জড়িত, তা মোট ১৫ টি । এর মধ্যে আছে পবিত্রতা। অন্যকে খাওয়ানো। মেহমানদের একরাম করা। ফরজ ও নফল সিয়াম পালন করা। ইতিকাফ করা। লাইলাতুল কদর তালাশ করা। হজ উমরা পালন করা। বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা।
দীনকে জিন্দা রাখার জন্য অন্যত্র হিজরত করা, এর মধ্যে রয়েছে ঈমান বাঁচানোর তাগিদে শিরকাচ্ছন্ন দেশ থেকে হিজরত করা। নযর ও মান্নত পূর্ণ করা। কসম পূর্ণ করা, এর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নামে সত্য কসম করা। কাফফারা আদায় করা, যেমন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলে কিংবা রমযান মাসে রোজা অবস্থায় সহবাস করলে শরিয়ত নির্ধারিত কাফ্ফারা আদায় করা ইত্যাদি।
খ) এর মধ্যে যা অনুসরনের সাথে জড়িত : তা ছয়টি । বিবাহ-শাদির মাধ্যমে নিজের পবিত্রতা রক্ষা করা ও পরিবারের হক আদায় করা। মাতা-পিতার খিদমত করা। ( এর মধ্যে রয়েছে তাদের কষ্ট না দেয়া এবং বাচ্চাদের ইসলামি বিধি মত প্রতিপালন করা)। আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। ( আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপের কাজ ব্যতীত) নেতৃবর্গ ও শাসকদের মান্য করা। দাস-দাসী ও অধিনস্তদের সাথে সদ্ব্যবহার করা।
গ) আরো কিছু আছে যা সাধারণভাবে সকলের সাথে জড়িত : এর মধ্যে ১৭ টি ভাগ আছে। যথা, ন্যায় বিচারের সাথে আমিরের দায়িত্ব পালন করা । মুসলিমদের দলের সাথে একিভূত থাকা। হাকিমদের (রাজাদের) মান্য করা। (তবে তারা আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপের হুকুম দিলে তা মান্য করা জরুরি নয়)। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে মিলমিশ ঘটানো, (তার মধ্যে রয়েছে খারিজি ও বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ করা)। নেক ও তাকওয়ার কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা করা, (এর মধ্যে সৎ কাজের প্রতি আদেশ ও অন্যায় কাজে বাধা প্রদান অন্তর্ভুক্ত)। হজ পালন করা। জিহাদ করা ( এর মধ্যে যুদ্ধের জন্য তৈরী হওয়াও অন্তর্ভুক্ত) আমানত আদায় করা (তার মধ্যে গণিমতের এক পঞ্চমাংশ বাইতুল মালে জমা দেয়াও অন্তর্ভুক্ত)। কর্জ আদায় করা। প্রতিবেশীর হক আদায় করা, তাকে সম্মান করা। সৎ ভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করা (হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জন এর অন্তর্ভুক্ত)। উপার্জিত অর্থ সৎ ও বৈধ পথে ব্যয় করা (বাহুল্য পথে খরচ না করা)। সালামের উত্তর দেয়া । হাঁচির জবাব দেয়া। মানুষদের কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা । খেল-তামাশা হতে বিরত থাকা। এবং রাস্তা হতে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা।
এ হাদিস এটাই শেখাচ্ছে যে, তাওহিদ হচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম স্তর। সুতরাং দীনের দায়ীদের প্রথম ও প্রদান দায়িত্ব হচ্ছে, সর্বোচ্চ আমল দিয়ে দাওয়াত কর্ম শুরু করবে অত:পর তা নিজে আমল করবে। প্রথমে ভিত্তি প্রস্তর, তারপর দেয়াল, এরপর যেটা যত জরুরি। কারণ তাওহিদই আরব ও আজমকে এক করেছে এবং ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের রাস্তা তৈরি করেছে।
বিপদ দূর হয় কিভাবে
১। মুসিবত কেন আপতিত হয় এবং আল্লাহ তা বান্দাদের থেকে উঠিয়ে নেন কিভাবে সে বিষয়ে পবিত্র কোরআন বর্ণনা করছে :
ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَى قَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ (الانفال 53)
অর্থাৎ, তা এ জন্য যে, আল্লাহ কোনো নিয়ামতের পরিবর্তনকারী নন, যা তিনি কোনো কওমকে দিয়েছেন, যতক্ষণ না তারা পরিবর্তন করে তাদের নিজদের মধ্যে যা আছে। ( সূরা আনফাল : আয়াত ৫৩)
২। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ ﴿30الشورى﴾
অর্থাৎ, আর তোমাদের প্রতি যে মুসিবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন। ( সূরা শুরা : আয়াত ৩০)
৩। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :
৩। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ﴿الروم41﴾
অর্থাৎ, মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। ( সূরা রূম : আয়াত, ৪১)
৪। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آَمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ ﴿112النحل﴾
অর্থাৎ, আর আল্লাহ উপমা পেশ করছেন, একটি জনপদ, যা ছিল নিরাপদ ও শান্ত। সবদিক থেকে তার রিয্ক তাতে বিপুলভাবে আসত। অতঃপর সে (জনপদ) আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করল। তখন তারা যা করত তার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষুধা ও ভয়ের পোশাক পরালেন। ( সূরা নাহল : আয়াত ১১২)
৫। উপরোক্ত আয়াতসমূহ আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে যে, আল্লাহ সবচেয়ে বড় ন্যায় বিচারক। তিনি কখনই কোনো জনপদের উপর বালা-মুসিবত আপতিত করেন না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও পাপ করে। বিশেষ করে তাওহিদ হতে দূরে সরে যায়।
বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশে নানা পাপাচার ও শিরকি আমলের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, যার কারণে আল্লাহর পক্ষ হতে একটার পর একটা পরীক্ষা আসছে, নানা বিপদাপদে পতিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত । মুসলিম সমাজ শিরক ও পাপাচার ছেড়ে আবারো আল্লাহর দিকে ফিরে এসে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে শরয়ি বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী না হলে মুসিবত আবর্তণের এ ধারা কখনই বন্ধ হবে না।
৬। পবিত্র কোরআন অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করছে, যখন তাদের উপর বিপদ আপতিত হয় তখন কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে ডাকে। বিপদ কেটে গেলে আবারো পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তণ করে। অর্থাৎ ভাল সময়ে আল্লাহকে ছাড়া অন্যকে ডাকে। আল্লাহ তাদের সম্বন্ধে বলছেন :
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ ﴿العنكبوت65﴾
অর্থাৎ, তারা যখন নৌযানে আরোহন করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অত:পর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শিরকে লিপ্ত হয়। ( সূরা আনকাবুত : আয়াত ৬৫)
৭। আজকাল বহু মুসলিমকে দেখা যায়, বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য গাইরুল্লাহকে ডাকাডাকি করে। বলে থাকে, (হে খাজা বাবা! হে বড়পীর সাহেব!)। সুসময় ও দুঃসময় উভয় অবস্থায়ই আপন রব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশের বিরোধিতা করে শিরকে প্রবৃত্ত হচ্ছে। (নাউযুবিল্লাহ)
৮। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের তীরন্দাজ বাহিনী আপন নেতার (রাসূলুল্লাহ সা.) নির্দেশ অনুপুঙ্খভাবে মান্য না করার কারণে (প্রাথমিক) পরাজয়ের শিকার হয়ে বিস্মিত হয়ে পড়েন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে তাদের সম্বন্ধে বলেন :
قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ (آل عمران 165)
অর্থাৎ, বল, এটা তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ হতে। (সূরা আলে ইমরান: আয়াত, ১৬৫)
হুনাইনের যুদ্ধে কিছু সংখাক মুসলিম বললেন : আমরা অল্প হলেও হারব না। তখনই সূচিত হল শোচনীয় পরাজয়। তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
হুনাইনের যুদ্ধে কিছু সংখাক মুসলিম বললেন : আমরা অল্প হলেও হারব না। তখনই সূচিত হল শোচনীয় পরাজয়। তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا (التوبة 25)
অর্থাৎ, এবং হুনাইনের দিন যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল, অথচ তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি। ( সূরা তাওবা ৯: আয়াত ২৫)
৯। উমর রা. সেনাপতি সা’দ রা.-কে ইরাকে লিখলেন : তোমরা এমনটি বল না যে, আমাদের শত্রুরা যেহেতু আমাদের থেকে নিকৃষ্ট তাই কখনই তারা আমাদের উপর জয়যুক্ত হতে পারবে না; বরং তারা হয়ত তাদের থেকে কোনো খারাপ জাতির উপর জয়যুক্ত হবে। যেমনিভাবে বনী ইসরাঈলরা পাপাচারে লিপ্ত হলে কাফির অগ্নি উপাসকরা তাদের উপর জয়যুক্ত হয়েছিল। তাই তোমরা নিজেদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও পাপ হতে বেঁচে থাকার জন্য, যেমনি করে সাহায্য চাও নিজ শত্রুদের বিরুদ্ধে।
মিলাদুন্নবী
১। মিলাদ উদযাপনকারী বহু লোকই শিরকে পতিত হয়। কারণ এ অনুষ্ঠানে তারা বলে যে, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদ হতে উদ্ধার করুন, সাহায্য করুন। হে আল্লাহর প্রিয় নবী সা.! আপনারই উপর ভরসা, হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমাদের দুঃখ কষ্ট দূর করুন, যখনই আপনাকে দেখি তখনই দুঃখ দুর হয়ে যায়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি এ সব কথা শুনতেন, তাহলে অবশ্যই একে বড় শিরক বলে আখ্যায়িত করতেন। কারণ, বিপদ মুক্তি, ভরসা ও কষ্ট-মুসিবত দূর করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনেরই আছে। এ অধিকার অন্য কারো নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا ﴿الجن21﴾
অর্থাৎ, বল, নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য না কোনো অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখি এবং না কোনো কল্যাণ করার। ( সূরা জিন, ৭২ : আয়াত ২১)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إذا سألتَ فاسأل الله واذا استعنتَ فاستعن باللهِ ( رواه الترمذي )
অর্থাৎ, যখন চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে। ( তিরমিযি)
২। মিলাদের মধ্যে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করা হয়ে থাকে। যেমন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসার ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে এমন সব কথা বলা হয় যা তিনি এই বলে নিষেধ করেছেন :
لا تُطْرُوْنِي كَمَا أطْرَتِ النَّصَارى اِبْنَ مرْيَمَ فَإنَّمَا أنَا عَبْدٌ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ (رواه البخاري)
অর্থাৎ, তোমরা আমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন কর না যেমন সীমালঙ্ঘন করেছে খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্বন্ধে। আমি একজন বান্দা বৈ নই। সুতরাং তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (বুখারি)
৩। মিলাদে বলা হয়, আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজ নূর হতে সৃষ্টি করেছেন এবং বাকী সব জিনিস সৃষ্টি করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর হতে।
এসব আকীদা পোষণকারীদেরকে পবিত্র কোরআন মিথ্যাবাদী বলেছে।
ইরশাদ হচ্ছে,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ (الكهف 110).
অর্থাৎ, বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহই এক ইলাহ। আমিত তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার কাছে ওহী পাঠান হয় এই বলে যে, তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন।( সূরা কাহাফ, ১৮ : আয়াত ১১০)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা-মাতার মাধ্যমে জন্ম গ্রহণ করেছেন, বিষয়টি সকলেরই জানা। সুতরাং তিনিও মানুষ, কিন্তু তাঁর বিশেষত্ব হল তাঁর কাছে ওহী পাঠান হয়েছে।
মিলাদে আরও বলা হয়ে থাকে যে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কারণে দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন।
পবিত্র কোরআন তাদের দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করে বলছে,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ﴿الذريات56﴾
অর্থাৎ. আমি মানুষ ও জিনকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা জারিয়াত : আয়াত ৫৬)
৪। খ্রীষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামেরর জন্মবার্ষিকী পালন করে এবং একই ধারায় নিজেদের ব্যক্তিগত জন্ম বার্ষিকীও পালন করে থাকে। তাদের থেকেই মুসলিমরা এ বিদআত গ্রহণ করেছে। ফলে, তারা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বর্ষিকী পালন করার প্রচলন ঘটিয়েছে। এবং সে খ্রীষ্টানদের অনুকরণে কেউ কেউ নিজের জন্মবার্ষিকীও পালন করে ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সাবধান করে বলেছেন :
( مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ منْهُمْ ) (رواه أبو داود)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে। (হাদিসটি সহিহ, বর্ণনায় আবু দাউদ)।
৫। মিলাদের সময় নারী পুরুষদের একত্রে মিলিত হতে দেখা যায়, অথচ ইসলাম এরূপ সম্মেলনকে হারাম বলে ঘোষনা করেছে।
৬। মিলাদের উৎসব আয়োজন উপলক্ষ্যে সাজ সরঞ্জামের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়। অথচ তা কোনো উপকার ছাড়াই নষ্ট হয়ে যায়। লাভ হয় শুধু অমুসলিমদের, যাদের কাছ থেকে উৎসবের রঙ্গিন কাগজ, মোমবাতি ও নানা সরঞ্জামাদি খরিদ করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযথা টাকা পয়সা নষ্ট করতে নিষেধ করেছেন।
৭। মানুষ এসব আনন্দ ফুর্তির মধ্যে অনেক সময় অহেতুক নষ্ট করে। এমনকি প্রায়ই তারা এ কারণে সময়মত সালাত আদায় করতে পারে না। বরং সালাত একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছে, এরূপ দৃশ্যও বহু দেখা গেছে।
৮। মিলাদের শেষের দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন ধারণা করে লোকেরা দাঁড়িয়ে যায়। শরিয়তের সুষ্পষ্ট দলিলের আলোকে এ ধারণা সর্বৈবভাবে মিথ্যা। বরং নবীজী জীবিত থাকা অবস্থায় কেউ তাঁকে দাড়িয়ে সম্মান করুক এমনটি পছন্দ করতেন না।
আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَا كَانَ شَخْصٌ أحَبَّ إلَيْهِمْ مِّنْ رَسُوْلٍ وَكَانُوا إذا رأوهُ (الصحابة) لَمْ يَقُومُوا لَهُ لِمَا يَعْلَمُوْنَ مِنْ كَرَاهِيَّتِهِ لِذلِكَ (رواه أحمد و الترمذي)
অর্থাৎ, সাহাবায়ে কিরামের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অধিক প্রিয় আর কেউ ছিলেন না। তারা তাঁকে দেখতে পেলে সম্মানার্থে দাড়াতেন না, কারণ তারা জানতেন এমনটি তিনি অপছন্দ করেন। ( আহমদ ও তিরমিযি)
৯। তাদের কেউ কেউ বলে থাকে, মিলাদ মাহফিলে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী আলোচনা করি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা এমন সব কাজ করে যা তাঁর আদর্শের বিপরীত এবং জীবনীরও বিপরীত। তাছাড়া তাঁকে যারা ভালবাসে তারাতো তাঁর জীবনী প্রতিটি দিনই পাঠ করে থাকে, বছরে মাত্র একবার নয়। ভালবাসার দাবীদারদেরতো এ বিষয়টিও স্মরণে রাখা দরকার ছিল, যে রবিউল আউয়াল মাসে তাঁর জন্ম হয়, সে রবিউল আউয়াল মাসে তাঁর মৃত্যুও হয়। সুতরাং এ মাসে খুশি হওয়ার চেয়ে দুঃখিত হওয়াই কি অধিক বাঞ্ছনীয় নয়? এ ক্ষেত্রে ভালবাসার দাবী কি?
১০। মিলাদ উদযাপনকারীদের দেখা যায়, এ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রায়ই অধিক রাত পর্যন্ত তাদের জাগ্রত থাকতে হয়। ফলে, ফজরের জামাত ছুটে যায় এমনকি কখনো কখনো সালাতই ছুটে যায়।
১১। কেউ কেউ যুক্তি প্রদর্শন করে বলে যে, মিলাদ যদি নাজায়েযই হবে তাহলে এত অধিক লোক তা উদযাপন করে কিভাবে? জবাবে আমরা বলব, অধিকাংশ লোক মিলাদ উদযাপন করলেই যে তা শরিয়ত সিদ্ধ হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। শরিয়তে জায়েয নাজায়েয নির্ধারিত হবে কোরআন বা সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে, পালনকারী সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ (الانعام 116)
অর্থাৎ, যদি তুমি দুনিয়ার বেশীর ভাগ লোকের অনুসরণ কর, তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর রাস্তা হতে বিপথগামী করে দিবে। ( সূরা আনআম : আয়াত,১১৬)
হুযাইফা রা. বলেছেন : প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী, মানুষ তাকে যতই উত্তম বলুক না কেন।
১২। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে সিরিয়ার বাদশাহ মোজাফফর সর্বপ্রথম এ মিলাদের প্রবর্তন করে। মিশরে এর প্রচলন শুরু করে ফাতেমীরা। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এদেরকে কাফির ও ফাসিক বলে মন্তব্য করেছেন। মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে এ বিদআত হতে হেফাজত কর। (আমীন)।
১২। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে সিরিয়ার বাদশাহ মোজাফফর সর্বপ্রথম এ মিলাদের প্রবর্তন করে। মিশরে এর প্রচলন শুরু করে ফাতেমীরা। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এদেরকে কাফির ও ফাসিক বলে মন্তব্য করেছেন। মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে এ বিদআত হতে হেফাজত কর। (আমীন)।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত
১। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন :
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ﴿31آل عمران﴾
অর্থাৎ, বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ( সূরা আলে ইমরান : আয়াত ৩১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لاَ يُؤْمِنُ أحَدُكُمْ حَتَّى أكُونَ أحَبَّ إلَيْهِ مِنْ وِالِدِهِ وَوَلَدِِِهِ وَ النَّاسِ أجْمَعِيْنَ . (رواه البخاري)
অর্থাৎ, তেমাদের কেউ মুমিন বলে বিবেচিত হবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও অপরাপর সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হব। (বুখারি)
২। এ আয়াত আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলার মহববতের সত্যায়ন একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য-অনুসরণের মাধ্যমে হবে। তিনি যা হুকুম করেছেন তা মান্য করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা ত্যাগের মাধ্যমেই সে মুহাব্বত প্রকৃত মুহাব্বত বলে স্বীকৃতি পাবে। তাঁর নির্দেশ মান্য করণ, নিষেধ পরিহার ও তাঁর সার্বিক আদর্শের অনুবর্তন ব্যতীত কেবল মুখের দাবি ভালবাসার সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট নয়।
৩। উল্লেখিত সহিহ হাদিসটি আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে যে, একজন মুসলিমের ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজ সন্তান, মাতা-পিতা ও অন্যান্য সকল মানুষ হতে বেশী ভালবাসবে। এমনকি -অন্য একটি হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী- নিজ জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসবে।
অন্য সকলের চেয়ে তাঁকে বেশী ভালবাসা হচ্ছে কি না তার প্রমাণ পাওয়া যাবে, যখন তাঁর আদেশ-নিষেধ আর নিজ নফসের চাহিদা পরস্পর বিরোধী হয় এবং সে তাঁর আদেশ-নিষেধের কাছে নিজ চাহিদাকে কোরবানি করতে পারছে, তাহলে প্রমাণ হবে যে সত্যিই সে নবীজীকে নিজ থেকেও অধিক ভালবাসে। অনুরূপভাবে স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা, অপরাপর সকল মানুষের চাহিদার বিপক্ষে যদি সে নবীজীর আদর্শের অনুবর্তনের উপর অবিচল থাকতে পারে প্রমাণ হবে সে অন্য সকলের চেয়ে নবীজীকেই অধিক ভালবেসেছে। এর মাধ্যমেই প্রকৃত আশেকে নবীর পরিচয় পাওয়া যাবে। যে ব্যক্তি সকল প্রতিকুলতা ডিঙ্গিয়ে নবীজীর আদেশ-নিষেধকে অগ্রাধিকার দিবে সেই প্রকৃত নবী প্রেমী। অন্যথা হলে প্রেমের নামে ভন্ডামী করছে বলেই প্রমাণিত হবে।
৪। কোনো মুসলিমকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাস? সাথে সাথে বলবে : হ্যাঁ,অবশ্যই, তাঁর জন্য আমার জান ও মাল কুরবান হোক। তখন যদি বলা হয় : তাহলে দাঁড়ি কাটো কেন? তাঁর হুকুমের বাইরে চল কেন? তোমার বাহ্যিক অবস্থাকে তাঁর অবস্থার সাথে মিলিয়ে নাওনা কেন? উত্তর দিবে: আরে... ভালবাসা হচ্ছে অন্তরের মধ্যে। আলহামদু লিল্লাহ আমার অন্তর অত্যান্ত পাক পবিত্র। এসব লোকদের প্রতি আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, তোমার অন্তর সত্যই যদি পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়, তাহলে অবশ্যই তা তোমার চেহারা ও পোষাকে প্রকাশ পাবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
ألاَ وَ إنَّ فيِ الْجَسَدِ مُضْغَةً إذا صَلُحَتْ صَلُحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإذا فسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ ألاَ وَهِىَ القَلْبُ . (رواه البخاري و مسلم)
শোন, শরীরের ভেতরে একটি গোশত পিন্ড আছে, যদি তা শুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে পূর্ণ শরীর শুদ্ধ হয়ে যায়। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে পূর্ণ শরীরই নষ্ট হয়ে যায়। শোন, সে গোশত পিন্ড হচ্ছে কলব। ( বুখারি ও মুসলিম)।
৫। (লেখক বলছেন) আমি একবার জনৈক মুসলিম ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে দেয়ালে পুরুষ ও মেয়েদের ছবি সাটানো দেখতে পেলাম। তাকে বললাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছবি ঝুলাতে নিষেধ করেছেন। তখন সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এ যুক্তি দেখিয়ে, এরা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথী । অথচ তার অবশ্যই জানা ছিল যে, এদের অধিকাংশই অমুসলিম-কাফের। সেসব ছবিতে এমন সব নারীর ছবিও ছিল, যাদের চুল ছিল উন্মুক্ত ও ছড়ানো। নিজ রূপ-লাবণ্যকে তারা প্রকাশ করে রেখেছিল। এবং তারা প্রত্যেকেই কম্যুনিষ্ট দেশের নাগরিক। এই ডাক্তার দাড়ি কাটতো। আমি তাকে উপদেশ দিয়ে বললামঃ এতে গুনাহ হয়। সে বলল : মৃত্যু পর্যন্তও আমি দাঁড়ি রাখব না। তবে বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সে ডাক্তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসার দাবী করে বলছে, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার সীমার মধ্যে প্রবেম করেছি। মনে মনে বললাম : তুমি তাঁর হুকুম অমান্য করছ তারপর বলছ তাঁর সীমার মধ্যে প্রবেশ করেছ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি এ জাতীয় শিরকে খুশি হন?
আমরা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর হিফাযতে।
৬। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসার বহি:প্রকাশ মিলাদ এবং শরিয়তের চেতনা বিরোধী বাড়াবাড়ি ও মিথ্যা সর্বস্ব না’ত পড়ার মধ্যেই সীমিত নয়। বরং ভালবাসার প্রকৃত প্রমাণ হচ্ছে তাঁর দিক নির্দেশনা মত চলা, তাঁল সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা এবং তাঁর শিক্ষা জীবনের সর্ব অংশে ফুটিয়ে তোলা।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদের ফযীলত
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴿الاحزاب56﴾
অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ (ঊর্ধ্ব জগতে ফেরেশতাদের মধ্যে) নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোআ করে। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবীর উপর দরূদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। ( সূরা আহযাব, ৩৩ : আয়াত ৫৬)
ইমাম বুখারি রহ. আবুল আলীয়া হতে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলার সালাত হচ্ছে মালাইকাদের কাছে তাঁর প্রশংসা করা আর মালাইকাদের দরূদ হচ্ছে দোয়া।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন : দরূদ পাঠ করার অর্থ হল বরকত পাঠান।
এই আয়াতের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার নিকটতম মালাইকাদের কাছে তাঁর বান্দার সম্মান ও নবী সম্বন্ধে জানাচ্ছেন। এই বলে যে, তিনি তার প্রশংসা করেন মালাইকাদের কাছে। আর মালাইকারাও তার জন্য দোয়া করেন। এরপর আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের হুকুম করেছেন তাঁর উপর দরূদ পাঠ করার জন্য, যাতে তাঁর উপর সমস্ত বিশ্ববাসীর প্রশংসা একত্রিত হয়।
১। এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের হুকুম করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য দোয়া করতে এবং তাঁর উপর সালাম পাঠ করতে। তিনি আল্লাহকে ছেড়ে তাঁর কাছে দোয়া চাইতে, অথবা তাঁর উপর সূরা ফাতিহা পাঠ করতে বলেননি। অথচ অনেকে তা-ই করে থাকে।
২। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ সাহবীদেরকে শেখানো দরূদই সর্ব শ্রেষ্ঠ দরূদ, তারা তাঁর নিকট কিভাবে দরূদ পড়ব মর্মে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
قُوْلُوا اللهمَّ صلِّ عَلى محَمَّدٍ وَعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إبْراهِيمَ وَعَلى آلِ إبْراهِيْمَ إنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيْدٌ اللهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَرَكْتَ عَلى إبْراهِيْمَ وَعَلى آلِ إبْراهِيمَ إنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ. (رواه البخاري و مسلم)
অর্থাৎ, বল : হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের উপর শান্তি বর্ষণ কর এবং তার আহালের উপর যেমন তুমি ইবরাহিম এবং তার বংশধরদের উপর শান্তি বর্ষণ করেছিলে। নিশ্চয়ই তুমি উত্তম প্রশংসিত, সম্মানিত । হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ এবং তার বংশধরদের উপর বরকত পাঠাও, যেমন ইবরাহিম এবং তার বংশধরদের উপর বরকত পাঠিয়েছিলে। নিশ্চয়ই তুমি উত্তম প্রশংসিত ও সম্মানিত। ( বুখারি ও মুসলিম)।
৩। এখানে একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করা প্রয়োজন যে, উল্লেখিত এ দরূদ অনুরূপ অন্যান্য হাদিসে যেসব দরূদ বর্ণিত হয়েছে তার কোনোটিতেই সাইয়্যেদ শব্দটি নেই। সুতরাং দরূদ পড়ার সময় সাইয়্যেদ যুক্ত না করে পড়াই উত্তম। তবে হ্যাঁ তিনি অবশ্যই আমাদের সাইয়্যেদ বা নেতা। কিন্তু দরূদ পাঠ একটি ইবাদত আর ইবাদতের ক্ষেত্রে কোরআন ও হাদিসের অনুপুঙ্খ অনুবর্তন জরুরি এবং কোরআন সুন্নাহর উপরই ইবাদত প্রতিষ্ঠিত। নিজ রায়ের উপর নয়।
৪। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إذا سَمِعْتُمُ الْمُؤَذِّنَ فَقُولوا مِثْلَ مَا يَقُولُ ثُمَّ صَلُّوا عَلَيَّ فَاِنَّهُ مَنْ صَلّى عَلَيَّ صَلاَةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ بِهاَ عَشْراً ثُمَّ سَلُوا اللهَ لِي الْوَسِيْلَةَ فَإنَّهاَ مَنْزِلَةٌ فِي الْجَنَّةِ لا تَنْبَغِي إلاَّ لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِ اللهِ وَ أرْجُو أنْ أكُونَ أناَ هُوَ فَمَنْ سألَ لِى الْوَسِيْلَةَ حَلَّتْ لَهُ الشَّفَاعَةُ . (رواه مسلم)
অর্থাৎ, যখন তোমরা মোয়াজ্জিনকে আযান দিতে শোন, সে যা বলে তোমরাও তাই বল। তারপর আমার উপর দরূদ পাঠ কর। কারণ, যে আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত প্রেরণ করবেন। অত:পর আল্লাহর কাছে আমার জন্য অসিলা প্রার্থনা কর। এটি জান্নাতের একটি বিশেষ সম্মানিত স্থান যা কেবল আল্লাহর বিশেষ বান্দার জন্য প্রযোজ্য, আমি আশা করছি আমিই যেন সেই বিশেষ বান্দা হই। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্য অসিলা প্রার্থনা করবে তার জন্য শাফায়াত অবধারিত হয়ে যাবে। (সহিহ মুসলিম)
আযানের পর অসিলা প্রার্থনার যে দোয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে, তা হল,
اللَّهُمَّ ربَّ هذه الدعوة التَّامَّةِ والصَّلاَةِ الْقَائِمَةِ آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيْلَةَ وَالْفَضِيْلَةَ وَابْعَثْهُ مَقَامًا مَحْمُودًا الَّذِي وَعَدْتَهُ. (رواه البخاري)
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমিই এই পরিপূর্ণ দাওয়াতের এবং প্রতিষ্ঠিত সালাতের রব। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান কর অসিলা ও ফযীলাত। এবং অধিষ্ঠিত কর প্রশংসিত স্থানে যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাঁকে দিয়েছ। (বুখারি)।
৫। প্রতিটি দোয়ার ক্ষেত্রেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করা জরুরি। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
كُلُّ دُعَاءٍ مَحْجُوْبٌ حتّى يُصَلَّ عَلى النَّبِيِّ ( رواه البيهقي)
অর্থাৎ, প্রত্যেক দোয়াই বাধাগ্রস্ত থাকে, যতক্ষণ না আমার উপর দরূদ পাঠ করা হয়। (বায়হাকী )।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন :
إنَّ للهِ مَلائِكَةً سَيّاحِيْنَ فِى الارضِ يَبَلِّغُونيِ عَنْ أمَّتي السلامَ ( رواه أحمد)
অর্থাৎ, পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়ানো আল্লাহর একদল ফেরেশতা রয়েছে। তারা আমার কাছে প্রেরিত আমার উম্মতের সালাম পৌঁছে দেয়। (আহমাদ)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতের কাজ, বিশেষ করে জুমুআর দিন। দরূদ আল্লাহর নিকটবর্তীকারী আমলের একটি। দুরূদকে অসিলা বানানো শরীয়ত অনুমোদিত। কারণ, দরূদ নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। দরূদকে অসিলা বানানোর পদ্ধতি যেমন এরূপ বলা যে, হে আল্লাহ! তোমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদের অসিলায় আমার বিপদ দূর কর।
বিদআতী দরূদ
আজকাল লোক মুখে নানা ধরণের দরূদ শুনতে পাওয়া যায়। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা তাঁর সাহাবিগণ হতে বর্ণিত হয়নি। না তাবেয়ীনগণ এর সমর্থন করেছেন না প্রসিদ্ধ ইমাম চতুষ্ট। বরং এসব দরূদ নির্ভরযোগ্য তিন যুগের পরবর্তী যুগের কিছু লোকের বানানো। এগুলো সর্ব সাধারণ ও কতিপয় আলেমদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। তারা এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত দরূদের চেয়েও অধিক হারে পাঠ করে। আমার ধারণায় অনেকেই সহিহ দরূদকে ছেড়ে দিয়েছে এবং বুজুর্গানের নামে তৈরী এ দরূদগুলোকে প্রচার করছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে খুব সুক্ষ্মভাবে এ সমস্ত দুরূদের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, এগুলো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত রাস্তার বিপরীত। যেমন, হে আল্লাহ! সে নবীর উপর শান্তি বর্ষণ কর, যিনি অন্তরের শান্তি ও তার ঔষধ, শরীরের সুস্থতা ও তার শেফা, চোখের নূর ও তার আলো। অথচ শরীর, অন্তর ও চোখের রোগ উপশমকারী ও সুস্থতা দানকারী কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতো তাঁর নিজের ভাল-মন্দ করার ক্ষমতাই পর্যন্ত রাখতেন না। আল কোরআনে বর্ণিত আছে :
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ (الاعراف 188)
অর্থাৎ, বল, আমিতো আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের ভাল ও মন্দ করার ক্ষমতাও রাখি না। (সূরা আরাফ : আয়াত ১৮৮)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لا تُطْرُوْنِي كَمَا أطْرَتِ النَّصَارى اِبْنَ مِرْيَمَ فَإنَّمَا أنَا عَبْدٌ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ (رواه البخاري)
অর্থাৎ, তোমরা আমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন কর না যেমন সীমালঙ্ঘন করেছে খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্বন্ধে। আমি একজন বান্দা বৈ নই। সুতরাং তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (বুখারি)
২। অন্য একটি পাওয়া যায় যাতে বলা হয়েছে : সালাত ও সালাম আপনার উপর হে আল্লাহর রাসূল! আমার অবস্থা সংকীর্ণ হয়ে গেছে তাই আমাকে উদ্ধার করুন হে আল্লাহর দোস্ত। এর প্রথম অংশে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু শেষ অংশ শিরকযুক্ত।
কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন :
أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ (النمل 62)
অর্থাৎ, অথবা কে বিপদগ্রস্তের ডাকে সাড়া দেয়- যখন সে তাকে ডাকে এবং বিপদ হতে উদ্ধার করে । (সূরা নামল ২৭ : আয়াত ৬২)
অন্যত্র বলেন :
وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ (الانعام 17)
অর্থাৎ, আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো দুর্দশা দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। ( সূরা আনআম, ৬ : আয়াত ১৭)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে দুঃখ, দুশ্চিন্তায় আপতিত হলে বলতেন :
ياَ حَيُّ ياَ قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أسْتَغِيْثُ . (رواه الترمذي)
অর্থাৎ, হে চিরঞ্জীব, হে সু প্রতিষ্ঠিত ধারক! তোমার করুণার অসিলায় সাহায্য প্রার্থনা করছি। (তিরমিযি)
সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদে আমাদের উদ্ধার করেন ও বাঁচান, এমন সব অসাড় কথা আমরা কিভাবে বলি? এটি রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত বাণীর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তিনি বলেছেন :
إذا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَاذا اسْتَعَنْتَ فاسْتَعِنْ باللهِ (رواه الترمذى وقال حسن صحيح)
অর্থাৎ, যখন চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে। (তিরমিযি, হাসান সহিহ)।
আস সালাতুন্নারিয়া (দরূদে নারিয়া)
এ ধরণের দরূদ বহু মানুষের নিকট অতি পরিচিত। এর ফযিলত সম্পর্কে বলা হয়, যে ব্যক্তি এ দরূদ ৪৪৪৪ বার পাঠ করবে সে সব রকম বালা-মুসিবত থেকে নিরাপদে থাকবে এবং তার যে কোনো ধরণের অভাব-অভিযোগ পুরণ হবে। কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে এ সব বাতিল ধারণা। এর পক্ষে কোনো সহিহ দলীল-প্রমাণ নেই।
এ দরূদের প্রতি ভালভাবে লক্ষ্য করলে কিংবা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব যে, এটি শিরকি কথা-বার্তায় পূর্ণ। যেমন,
اَللًّهُمَّ صلِّ صَلاةً كَامِلَةً وَسَلِمْ سَلامَا تَامًّا عَلى سَيِّدِناَ مُحًمَّدٍ الَّذِي تَنْحَلُّ بِهِ الْعُقَدُ وَتَنْفَرِجُ بِهِ الْكُرَبُ وَتَقْضىِ بِهِ الْحَوَائِجُ وَتَنَالُ بِهِ الرَّغَائِبُ وَحَسُنَ الْخَواتِيْمٌ وَيُسْتَسقَي الغَمَامُ بِوَجْهِهِ الْكَرِيْمُ وَعَلى آلِهِ وَصَحْبِهِ عَدَدَ كُلِّ مَعْلُومٍ لَكَ.
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর পরিপূর্ণ দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন, যার মাধ্যমে কঠিন বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় এবং সব ধরণের বালা-মুসিবত দূর হয়ে যায়। যার মাধ্যমে সব ধরণের হাজত পূর্ণ হয়। তার মাধ্যমেই সমস্ত আশা আকাংখা বাস্তবায়িত হয়। তার কারণেই (ঈমান অবস্থায় মানুষের) শুভমৃত্যু নসিব হয়। তাঁর সম্মানিত চেহারার অসিলায় বৃষ্টিপাত হয়। তাঁর পরিজন ও সাহাবিদের উপর সে পরিমাণ দরূদ ও সালাম প্রেরণ করুন যে পরিমাণ আপনার জানা আছে । (নাউযুবিল্লাহ)।
১। পবিত্র কোরআন থেকে আমরা যে তাওহিদের শিক্ষা পেয়েছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যে আকিদাহ শিক্ষা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিমের এমন বিশ্বাসই পেষণ করা জরুরি যে, মানুষের উপর আপতিত বিপদাপদ, বালা-মুসিবত দূর করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সর্ব প্রকার প্রয়োজন পুরণ করার মালিকও তিনিই। দোয়া কবুল করার এখতিয়ারও তাঁরই হাতে। কোনো মুসলিমের পক্ষেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দুঃখ পেরেশানী অথবা অসুস্থতা দূর করার জন্য দোয়া করার অনুমতি নেই। হোন না তিনি আল্লাহর নিকটবর্তী কোনো ফেরেশতা কিংবা সম্মানিত কোনো রাসূল। মহা গ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দোয়া করতে নিষেধ করা হয়েছে।
তার প্রমাণ নিম্ন বর্ণিত আয়াতঃ
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلَا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنْكُمْ وَلَا تَحْوِيلًا ﴿56﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا ﴿الاسراء57﴾
বল, ‘তাদেরকে ডাক, আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে (উপাস্য) মনে কর। তারা তো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। তারা যাদেরকে ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের রবের কাছে নৈকট্যের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে তাঁর নিকটতর? আর তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার রবের আযাব ভীতিকর। (সূরা ইসরা, ১৭ : আয়াত ৫৬ ও ৫৭)
বিখ্যাত তাফসির বেত্তাগণ বলেছেন : এ আয়াত সেসব ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে, যারা মসিহ ইবনে মারইয়াম-ঈসা আ.-এর নিকট অথবা ফেরেশতা কিংবা নেককার জিনদের নিকট দোয়া করত।
২।
তিনিই কঠিন কাজ ও বিপদ হতে উদ্ধার করতে পারেন’ এসব কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে গ্রহণ করতে পারেন। কিভাবেই বা এসবের উপর সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ﴿الاعراف188﴾
অর্থাৎ, বল, আমি আমার নিজের ভাল কিংবা মন্দের মালিক নই, তবে আল্লাহ যা চান। আমি যদি গায়েবের খবর জানতামই, তাহলে কল্যাণ অনেক বেশী অর্জন করতে পারতাম আর কোনো অনিষ্টই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি তো কেবল একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা সে কওমের জন্য যারা ঈমান এনেছে। ( সূরা আরাফ, ৭: আয়াত ১৮৮)
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদা এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদা এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,
ماَ شاَءَ اللهُ وَشِئْتَ فَقاَلَ: أجَعَلْتَنى للهِ نداً؟ قُلْ ماَشاَءَاللهُ وَحْدَهُ. (رواه النسائى)
অর্থাৎ, আল্লাহ যা চান ও আপনি যা চান। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেলছ? বরং বল, এককভাবে আল্লাহ যা চান। (নাসাঈ)
৩। মানুষের বানানো ভুলে ভরা এসব দরূদ আমরা কেন পাঠ করব? রাসূলুল্লাহ হতে বর্ণিত (যা আমরা সালাতে পাঠ করে থাকি) অধিক সওয়াব যোগ্য দরূদ পাঠ করতে আমাদের বাধা কোথায়?
কোরআন জীবিতদের জন্য- মৃতদের জন্য নয়
আল্লাহ তাআলা এ সম্বন্ধে বলেন :
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آَيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿ص29﴾
অর্থাৎ, আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা সোয়াদ ৩৮: আয়াত ২৯)
সাহাবাগণ কোরআনের হুকুম ও নিষেধের উপর আমল করতেন। একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন। ফলে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে সৌভাগ্যশালী হয়েছিলেন। যখন থেকে মুসলিমরা এই কোরআনের শিক্ষা ও আমলকে ত্যাগ করে তাকে মৃতদের জন্য ও দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করল, তখন থেকেই তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনা স্পর্শ করল এবং তাদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি শুরু হল। তাদের ক্ষেত্রে সত্যিই আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী প্রযোজ্য,
وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا ﴿30الفرقان﴾
অর্থাৎ, আর রাসূল বলবে, হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমার জাতি এ কোরআনকে পরিত্যাজ্য জ্ঞান করেছে। ( সূরা ফুরকান, ২৫: আয়াত ৩০)
আল্লাহ তাআলা একে অবতীর্ণ করেছেন জীবিতদের জন্যই। যাতে তারা তাদের জীবদ্দশায় তার উপর আমল করতে পারে। তা মৃতদের জন্য নয়। কারণ, তাদের আমলের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা আর তা পাঠ করতেও পারে না, আমলও করতে পারে না। কোরআন পাঠ করার কোনো সওয়াবও তাদের কাছে পৌঁছায় না। একমাত্র তার নেক সন্তানদের পাঠ করা ব্যতীত। কারণ সে তার ঔরসজাত সন্তান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
إذا ماَتَ الانْساَنُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إلاَّ مِنْ ثَلاثٍ: صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أو ولَدٍ صَالِحٍ يَدْعُولَهُ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, মানুষ যখন মারা যায় তখন তিনটি ব্যতীত তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, (১) সাদকায়ে জারিয়া, (২) এলম যার দ্বারা অন্যের উপকার হয় এবং (৩) নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى ﴿النجم39﴾
অর্থাৎ, আর মানুষ যা চেষ্টা করে তাই সে পায়। (সূরা নাজম, ৫৩: ৩৯ আয়াত)।
ইবনে কাসীর রহ. তার তাফসীরে বলেন : তার উপর অন্যের পাপ যেমন অর্পিত হবে না, তেমনি অপরের সাওয়াবও সে পাবে না।
এই আয়াত থেকে ইমাম শাফেয়ী রহ. প্রমাণ বের করেন যে, কোরআন তেলাওয়াত করে তার সওয়াব মৃত্যুদের নামে উৎসর্গ করলে তা তাদের নিকট পৌঁছে না। কারণ, উহা তাদের আমল নয় অথবা উপার্জনও নয়। এই কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে উম্মতের জন্য সুন্নত বানিয়ে যাননি, কিংবা তাদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিতও করেন নি। অথবা সাহাবিরা কেউ এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। যদি এটা ভাল কাজ হত তাহলে অবশ্যই তারা তা করতেন।
দোয়া, সদকা বা দান খয়রাতের সাওয়াব পৌঁছবে, এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই এবং এর দলীলও আছে।
১। আজ মৃত ব্যক্তির নিকট বসে কোরআন তেলাওয়াত করা একটা রসমে পরিণত হয়েছে। এমনকি কোনো বাড়ি থেকে কয়েকজনের মিলিত তেলাওয়াত শুনলে বুঝা যায় যে কেউ সেখানে মারা গেছে। যদি রেডিওতে সারাদিন কোরআন তেলাওয়াত শুনা যায় তাহলে বুঝতে হবে যে, কোনো নেতা মারা গেছে। (লেখক বলেন) একবার কোনো এক ব্যক্তি এক অসুস্থ বাচ্চাকে দেখতে যেয়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন। তা শোনামাত্র বাচ্চার মা চেঁচিয়ে উঠে বলে : আমার বাচ্চাত এখনো মারা যায়নি, তাহলে তুমি কোরআন তেলাওয়াত করছ কেন?
২। যে ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় সালাত ত্যাগ করেছে, তার জন্য মৃত্যুর পর কোরআন পাঠ করলে তার কি লাভ হবে? কারণ, তাকে তো আগেই আযাবের খবর দেয়া হয়েছে।
২। যে ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় সালাত ত্যাগ করেছে, তার জন্য মৃত্যুর পর কোরআন পাঠ করলে তার কি লাভ হবে? কারণ, তাকে তো আগেই আযাবের খবর দেয়া হয়েছে।
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ﴿4﴾ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ ﴿الماعون5﴾
অর্থাৎ, অতএব সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজেদের সালাতে অমনোযোগী। ( সূরা মাউন, ১১৪: আয়াত ৪ও ৫)
৩। তোমরা মৃতদের উপর সূরা ইয়াসিন পাঠ কর’ মর্মে যে হাদিস বর্ণনা করা হয়, সেটি সহিহ নয় বরং মওজু বা জাল।
মুহাদ্দিস দারা কুতনী বলেছেনঃ এর সনদ দুর্বল এবং মূল বক্তব্যও দুর্বল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর সাহাবিদের কেউ মৃতের উপর কোরআন পাঠ করেছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। তারা না সূরা ইয়াসিন পাঠ করেছেন না সূরা ফাতেহা কিংবা কোরআনের অন্য কোনো অংশ। বরং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের বলতেনঃ
اسْتَغْفِرُوا لأخِيْكُمْ وَسَلُوا لَهُ التَّثْبِيْتَ فَإنَّهُ الآنَ يُسْأَلُ. (ابو داود وغيره)
অর্থাৎ, (দাফনের পর) তোমরা আপন ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য দৃঢ় ও অবিচলতার জন্য দোয়া কর। কারণ, তাকে এখন প্রশ্ন করা হবে। (আবু দাউদ)।
৪। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে প্রবেশ করার সময় সূরা ফতিহা পাঠ করার শিক্ষা কাউকে দেননি। বরং তিনি এ দোয়া শিখায়েছেন :
السَّلامُ عَلَيْكُم أهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَ إنَّا إنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لاحِقُونَ أسْألُ اللهَ لنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةَ مِنَ الْعَذَابِ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, হে ঘরের মুমিন-মুসলিম বাসিন্দাগণ! তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। আমরাও আল্লাহ চাহে তো তোমাদের সাথে মিলিত হব। আল্লাহর কাছে আমাদের এবং তোমাদের জন্য তাঁর আযাব হতে ক্ষমা চাই। (সহিহ মুসলিম)।
এ হাদিস আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিচ্ছে যে, মৃতদের জন্য আমরা দোয়া ও প্রার্থনা করব, তাদের কাছে দোয়া কিংবা সাহায্য প্রার্থনা করব না।
৫। জীবিতরা আমল করতে পারে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন এ জন্যই নাযিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ ﴿يس70﴾
অর্থাৎ, যাতে তা সতর্ক করতে পারে ঐ ব্যক্তিকে যে জীবিত এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগবাণী প্রমাণিত হয়। ( সূরা ইয়াসীন ৩৬: আয়াত, ৭০)
নিষিদ্ধ কিয়াম বা দাঁড়ানো
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ أحًبَّ أنْ يَتَمَثَّلَ النَّاسُ لَهُ قِيَاماً فَلْيَتَبَوَّأ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. (رواه أحمد)
অর্থাৎ, যে লোক কামনা করে যে, মানুষ তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যাক সে যেন তার ঠিকানা আগুনে করে নেয়। (আহমাদ)
আনাস রা. বলেছেনঃ
ماَ كَانَ شَخْصٌ أحَبَّ إلَيْهِم مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكاَنُوا إذا رأوْهُ لَمْ يَقُوْمُوْا لَهُ لماَ يَعْلَمُونَ مِنْ كراهِيَّتِهِ لِذَالِكَ. (رواه الترمذي)
অর্থাৎ, সাহাবায়ে কিরামের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অধিক প্রিয় আর কেউ ছিলেন না। তথাপি তারা তাঁকে দেখতে পেলে সম্মানার্থে দাড়াতেন না, কারণ তারা জানতেন এমনটি তিনি অপছন্দ করেন। ( আহমদ ও তিরমিযি)
১। হাদিস দুটি হতে এটা পরিস্কার বুঝা যায় যে, যে মুসলিম তার সম্মানার্থে মানুষের দাঁড়ানোকে কামনা করে, তাহলে এ কাজ তাকে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করাবে। সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। এতদসত্ত্বেও, তাঁকে তাদের সম্মুখে আসতে দেখলে দাঁড়াতেন না। কারণ, সে দাঁড়ানোকে তিনি খুব অপছন্দ করতেন।
২। বর্তমানে মানুষ একে অপরের জন্য দাঁড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে উস্তাদ যখন শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করেন অথবা ছাত্ররা তাকে কোথাও দেখতে পায় তখন তার সম্মানার্থে সকলে দাড়িয়ে যায়। কোনো ছাত্র না দাড়ালে তাকে তিরস্কার ও ধিক্কার দেয়া হয়। দাড়ানো কালে শিক্ষকের নীরবতা অথবা না দাড়ানো ছাত্রকে তিরস্কার করা এটাই প্রমাণ করে যে, তারা নিজেদের জন্য দাঁড়ানোকে পছন্দ করেন। যদি অপছন্দ করতেন তাহলে এসব হাদিস বলে দাড়ানোকে নিরুৎসাহিত করতেন। এবং যারা দাড়ায় তাদের নসীহত করতেন। এভাবে তার জন্য বারে বারে দাঁড়ানোর ফলে তার অন্তরে আকাঙ্খা সৃষ্টি হয় যে, ছাত্ররা তার জন্য উঠে দাঁড়াক। কেউ না দাঁড়ালে তার প্রতি অন্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
উল্লেখিত হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী যারা দাড়িয়ে অপরকে সম্মান জানাচ্ছে তারা মূলত: সেসব মানুষ শয়তানের সাহায্যকারী, যারা নিজের জন্য এভাবে দাঁড়ানো পছন্দ করে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে নিষেধ করে বলেছেন :
وَلاَ تَكُوْنُوا عَوْنَ الشَّيْطان عَلى أخِيْكُم. (رواه البخاري)
অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের বিরুদ্ধে শয়তানের সাহায্যকারী হয়ো না। (বুখারি)।
৩। অনেকে বলেন : আমরা শিক্ষক বা বুজুর্গদের সম্মানে দাড়াইনা বরং তাদের ইলমের সম্মানে দাঁড়াই। আমরা বলব : আপনাদের কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইলম এবং তাঁর সাহাবিদের আদব সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আছে? সাবারাতো নবীজীর সম্মানে দাঁড়াতেন না। ইসলাম এভাবে দাঁড়ানোকে সম্মান প্রদর্শন বলে মনে করে না। বরং হুকুম মান্য করা ও আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সম্মান। সালাম করা ও হাত মিলানই ইসলাম সম্মত সম্মান।
৩। অনেকে বলেন : আমরা শিক্ষক বা বুজুর্গদের সম্মানে দাড়াইনা বরং তাদের ইলমের সম্মানে দাঁড়াই। আমরা বলব : আপনাদের কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইলম এবং তাঁর সাহাবিদের আদব সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আছে? সাবারাতো নবীজীর সম্মানে দাঁড়াতেন না। ইসলাম এভাবে দাঁড়ানোকে সম্মান প্রদর্শন বলে মনে করে না। বরং হুকুম মান্য করা ও আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সম্মান। সালাম করা ও হাত মিলানই ইসলাম সম্মত সম্মান।
৪। অনেক সময় দেখা যায়, মজলিসে কোনো ধনী লোক প্রবেশ করলে মানুষ তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু দরিদ্র ব্যক্তির জন্য কেউ দাঁড়ায় না। এমনও হতে পারে, আল্লাহ তাআলার কাছে ঐ দরিদ্রের সম্মান সে ধনী ব্যক্তির চেয়ে বেশী। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (الحجرات 13)
অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। ( সূরা হুজুরাত, ৪৯: আয়াত ১৩)
অনেকে ভাবে যদি আমরা না দাঁড়াই তাহলে আগমনকারী মনে ব্যাথা পাবেন । তাদের এই বলে বুঝান দরকার যে, দাঁড়ানটাই সুন্নতের বিপরীত। বরং হাত মিলান, সালাম করাই সুন্নাত।
শরিয়ত সম্মত কিয়াম বা দাঁড়ান
অনেক সহিহ হাদিস ও সাহাবিদের আমল দ্বারা প্রমাণিত যে, আগমণকারীর অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়ানো জায়েয। আসুন আমরা সে হাদিসগুলো বুঝতে চেষ্টা করি এবং সেমতে আমল করারও ।
১। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আদরের মেয়ে ফাতিমা রা. আপন পিতার খিদমতে আসলে নবীজী তার জন্য দাঁড়াতেন। অনুরূপভাবে যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে যেতেন, তখন তিনিও উঠে দাঁড়াতেন। এটা জায়েয এবং জরুরি। কারণ, এটি অতিথির সাথে সাক্ষাত ও তার একরামের জন্য।
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ كاَنَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فاَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ (متفق عليه)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার অতিথিকে সম্মান করে। (বুখারি ও মুসলিম)
তবে এটা শুধুমাত্র বাড়ীর মালিকের জন্য প্রযোজ্য অন্য কারো জন্য নয়।
তবে এটা শুধুমাত্র বাড়ীর মালিকের জন্য প্রযোজ্য অন্য কারো জন্য নয়।
২। অন্য হাদীসে আছে :
قُوْمُوْا إلى سيِّدِكُمْ وَفِى رواية (فانزلوه) (متفق عليه)
অর্থাৎ, তোমাদের সর্দারের জন্য দাঁড়াও। ( বুখারি ও মুসলিম)। অন্য রিওয়ায়েতে আছে : (এবং তাকে নামিয়ে আন)
এই হাদিসের কারণ হল : সা’দ রা. আহত ছিলেন। তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদিদের বিচার করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি গাধার উপর উঠলেন। যখন তিনি পৌঁছলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের বললেন : তোমরা তোমাদের সর্দারের জন্য উঠে দাঁড়াও এবং তাকে নামিয়ে আন। তাই তারা দাঁড়ালেন এবং নামিয়ে আনলেন। এখানে আনসারদের সর্দার সা’দ রা.-কে সাহায্য করার জন্য দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল, কারণ তিনি ছিলেন আহত। তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং আনসাররা ব্যতীত অন্য কোনো সাহাবি দাঁড়াননি।
৩। সাহাবি কা’ব ইবনে মালেক রা. সম্বন্ধে বর্ণিত আছে, তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন, সাহাবাগণ সকলে বসা ছিলেন। তিনি প্রবেশ করলে তালহা রা. তার তাওবা কবুল হয়েছে মর্মে সুসংবাদটি প্রদানের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাবুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করার কারণে কা’ব রা. ও তার দুই সাথীর সাথে বয়কট করা হয়েছিল। পরে তাদের তাওবা কবুল হয়। এখানে দৃশ্যত: দেখা যাচ্ছে তালহা রা. কা’ব রা.-এর উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছেন, প্রেক্ষাপটের বিচারে এ দাঁড়ানোতে দোষের কিছু নেই এবং এটা জায়েয। কারণ, এতে বিমর্ষ ব্যক্তিকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত প্রাপ্তিতে আনন্দ প্রকাশ করা
জয়িফ ও মওজু হাদিস
ইসলামি সমাজে প্রচলিত হাদিসের মাঝে সব হাদিসের মান একই স্তরের নয়। বর্ণনাকারীর অবস্থা ও প্রাসঙ্গিক আরো কিছু কারণে হাদিসের মানের মাঝে তারতম্যের সৃষ্টি হয়েছে। হাদিসবেত্তাগণ সে মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে হাদিসকে অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন, সহিহ, হাসান, জয়িফ ও মওজু।
ইমাম মুসলিম তাঁর সহিহ মুসলিমের ভূমিকায় " শ্রুত হাদিস পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই বর্ণনা করা নিষিদ্ধ " নামক একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করেছেন। তাতে তিনি জয়িফ তথা দুর্বল হাদিস বর্ণনা সম্বন্ধে সতর্ক করেছেন। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত হাদিসটি উল্লেখ করেছেন,
كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, একজন ব্যক্তির জন্য মিথ্যা হিসাবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে। (সহিহ মুসলিম)
ইমাম নববি রহ. মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে "দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে হাদিস বর্ণনা করা নিষিদ্ধ" নামক একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করেছেন। বক্তব্যের সমর্থনে নিম্নোক্ত হাদিস পেশ করেছেন।
سَيَكُوْنُ في آخِرِ الزَّمَانِ أُنَاسٌ مِنْ أمَّتِىْ يُحَدِّثُوْنًكُمْ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أنْتُمْ وَلاَ أبَاؤُكُمْ فإيّاكُمْ وَ إيَّاهُمْ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, শেষ যামানায় আমার উম্মতের মধ্যে এমন একদল লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা তোমাদেরকে এমন সব হাদিস বর্ণনা করবে যা তোমরা কখনও শোননি, এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শোনেনি। সুতরাং তাদের থেকে সতর্ক থেকো। (মুসলিম)
ইবনে হিব্বান রহ. তার সহিহ হাদিস গ্রন্থে বলেছেন : সে ব্যক্তির জন্য জাহান্নামে প্রবেশ করা অবধারিত যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে এমন কথা বর্ণনা করল যার সত্যতা সম্পর্কে সে অজ্ঞ।
তার সমর্থনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন :
مَنْ قَالَ عَلَيَّ مَا لَمْ أقُلْ فَلْيَتَبَوَّأَ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. (رواه أحمد)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আমার উপর এমন কথা চাপিয়ে দিল যা আমি বলিনি, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে করে নেয়। (আহমাদ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে মউজু হাদিস সম্বন্ধে সাবধান করে বলেছেন :
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأَ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. (متفق عليه)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার উপর মিথ্যা বলবে, সে যেন তার ঠিকানা (জাহান্নামের) আগুনে বানিয়ে নেয়। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
বড়ই দুঃখের বিষয়, বহু আলেম এই জাতীয় (জাল ও দুর্বল) হাদিস নিয়ে আলোচনা করেন নিজস্ব মাজহাবি চিন্তা-ভাবনা কে মজবুত করার জন্য।
যেমন নিম্নোক্ত বক্তব্যটি হাদিস বলে বর্ণনা করে থাকেন,
(اخْتِلافُ أمَّتي رحْمَةٌ.رواه أحمد)
আমার উম্মতের মতবিরোধ রহমত স্বরূপ।
আল্লামা ইবনে হাজম রহ. এ সম্বন্ধে বলেছেন, এটা কোনো হাদিসই নয়, বরং তা বাতিল, মিথ্যা ও বানোয়াট। মতবিরোধ যদি রহমত হয় তাহলে মতৈক্য কি? অভিশাপ? ইসলাম ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও মতবিরোধ থেকে বাঁচার জন্য কতভাবেই না উৎসাহিত করেছে।
আরেকটি জাল হাদিস, যাদু বিদ্যা শিখ, কিন্তু তার আমল কর না।
আরো একটি হাদিস লোক মুখে খুব শুনা যায়,
جَنِّبُوا مَسَاجِدَكُمْ صِبْيَانَكُمْ وَمَجَانِيْنَكُمْ.
অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের বাচ্চা ও পাগলদের মসজিদ থেকে দুরে রাখ।
ইবনে হাজার আসকালানী রহ.-এর মতে এটি দুর্বল। ইবনুল জাওযির মতে সহিহ না। আল্লামা আব্দুল হকের মতে ভিত্তিহীন।
কারণ এটি সহিহ হাদিস ও ইসলমি চেতনা বিরুদ্ধ বক্তব্য, সহিহ হাদীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
عَلِّموا أَوْلاَدَكُمْ الصَّلاةَ وَهُمْ أبْنَاءُ سَبْعٍ وَاضْرِبُوْهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أبْنَاءُ عَشْرٍ. (رواه أحمد)
অর্থাৎ, তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলেই সালাত শিক্ষা দাও আর তা আদায় না করলে দশ বছর বয়স হতে প্রহার কর। ( আহমাদ)
সালাতের তালিমতো মসজিদেই হবে, যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের সালাত শিখিয়েছেন মসজিদের মিম্বারে বসে। তখন বালকরাও মসজিদে ছিল, এমনকি ছোট ছোট শিশুরাও।
১। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট নয় যে, ইমাম তিরমিযি বা আবু দাউদ প্রমুখ বর্ণনা করেছেন। কারণ, তাদের বর্ণনাকৃত হাদিসের মধ্যে দুর্বল হাদিসও রয়েছে। তাই সাথে সাথে হাদিসের স্তরও উল্লেখ করতে হবে। যেমন : সহিহ হাসান অথবা দুর্বল। আর বুখারি ও মুসলিমের হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু নাম বললেই চলবে । কারণ, তাদের কিতাবে বর্ণিত সব হাদিসই সহিহ।
২। দুর্বল হাদিস সম্বন্ধে এমন ধারণা করতেই আলেমগণ বলেছেন যে এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত নয়। সনদ কিংবা মূল হাদিসে সমস্যা থাকার কারণেই এসব হাদিসকে পরিহার করতে হবে।
আচ্ছা... আমাদের কেউ যদি গোশত কেনার জন্য বাজারে গিয়ে চর্বি ও হাড্ডিযুক্ত দু’ধরণের গোশত দেখতে পায় তাহলে সে কোনটি কিনবে? অবশ্যই ভালটি। আর দোষযুক্তটি বাদ দিবে।
কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম আমাদেরকে মোটা ও সুস্থ পশু নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়েছে আর অসুস্থ পশু পরিহার করতে বলেছে।
দুনিয়াবি বিষয়ে যদি আমরা এমন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলি, ভালটি গ্রহণ করি মন্দটি এড়িয়ে যাই। তাহলে দীনের বিষয়াদি সম্বন্ধে আমাদের কেমন সচেতন ও সতর্ক হওয়া উচিত। যাতে আমাদের ঈমান ও আকিদার প্রশ্ন জড়িত? সুতরাং এসব দীনি ব্যাপারে কিভাবে দুর্বল হাদিস গ্রহণযোগ্য হতে পারে? বিশেয়ত: যখন সহিস হাদিস পাওয়া যায়?
দুর্বল হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে আলেমগণ মূলনীতি নির্ধারণ করে বলেন : দুর্বল হাদীস বর্ণনার সময় এমনটি বলা যাবে না যে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। বরং বলতে হবে বর্ণিত আছে বা এ জাতীয় কিছু, যাতে সহিহ ও দুর্বলের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়।
৩। পরবর্তী যুগের কতিপয় আলেম দুর্বল হাদিস গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ করেছেন।
(ক) দুর্বলতা খুব বেশি হওয়া যাবে না।
(খ) হাদিসটি শুধু কোনো আমলের ফজিলত সম্পর্কিত হবে।
(গ) বর্ণিত হাদিসের মূল বক্তব্য কোনো সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে।
(ঘ) আমলের সময় একে নবীজীর সুন্নত জ্ঞান করা যাবে না।
কিন্তু বর্তমানে লোকেরা দুর্বল হাদিসের ব্যাপারে উপরোক্ত শর্তগুলো মেনে চলছে না।
কিছু মওজু বা বানোয়াট হাদিস
১। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নূর হতে একমুষ্ঠি নূর নিয়ে বললেন : মুহাম্মাদ হয়ে যাও, (আর তিনি হয়ে গেলেন)।
২। হে জাবের! আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম সৃষ্টি করেন তোমার নবীর নূর।
৩। যে হজ করল কিন্তু আমার যিয়ারত করল না, সে আমার উপর জুলুম করল।
এ পর্যায়ে আমরা সহিহ, হাসান ও দুর্বল হাদিস সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব।
সহিহ : হাদিস সহিহ হবার জন্য পাঁচটি শর্ত আছে :
১। সনদের পরম্পরা নিরবচ্ছিন্ন হতে হবে, অর্থাৎ প্রত্যেক রেওয়ায়াতকারী তার উপরের রিওয়ায়াতকারী হতে সরাসরি শুনতে হবে।
২। প্রত্যেক বর্ণনাকারীকে আদেল অর্থাৎ মুসলিম, বালেগ, ন্যায় পরায়ন ও জ্ঞানী হতে হবে, ফাসেক এবং চরিত্রহীন হলে চলবে না।
৩। প্রতিটি রেওয়ায়াতকারীর মেধা ও স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর হতে হবে। মেধা ও স্মরণশক্তিতে কোনরূপ দুর্বলতা থাকলে বর্ণিত হাদিস আর সহিহ বলে বিবেচিত হবে না।
৪। হাদিসে এমন কথা থাকবে না, যা তার থেকে বেশী নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের বিরোধিতা করে।
৫। এমন কোনো বিষয় থাকবে না যা হাদিসের মধ্যে কোনো দোষ বের করে দেয়।
সংক্ষেপে : উক্ত হাদিস, যার সনদ যুক্ত থাকবে ন্যায় পরায়ন, সম্পূর্ণ মুখস্থকারী বর্ণনাকারীদের দ্বারা (প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত) এবং তাতে কোনো ব্যতিক্রম কিংবা দোষ থাকবে না।
সহিহ হাদিসের উপর আমলের হুকুম
১। এর উপর আমল করা ওয়াজিব ।
২। এটি শরিয়তের দলীল হিসাবে গণ্য হবে।
৩। কোনো আমলের ক্ষেত্রে সহিহ হাদিস পাওয়া গেলে তা বাদ দিয়ে দুর্বল হাদিসের উপর আমল করা অবৈধ।
হাসান হাদিস
ঐ হাদিস যার সনদের পরম্পরা সম্পর্কযুক্ত আদেল তথা ন্যায় পরায়ন বর্ণনাকারীদের সাথে যাদের স্মরণশক্তি একটু কম থাকতে পারে, কিন্তু কোনো ব্যতিক্রম বা দোষ থাকবে না। অর্থাৎ তাতে সহিহ হাদীসে বর্ণিত শব্দসমূহ সরাসরি ব্যবহার না করে হয়ত কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
হাসান হাদিসের উপর আমলের হুকুম
১। এর হুকুম সহিহ হাদিসের মতই।
২। এটি দলীল হিসাবে গণ্য হবে যদিও তা সহিহ থেকে একটু দুর্বল।
৩। এর উপর আমল করাও ওয়াজিব।
দুর্বল হাদিস
যে হাদিসের মধ্যে হাসান হাদিসের কোনো শর্ত বাদ পড়ে গেছে তাকে দুর্বল হাদিস বলে।
এর শ্রেণীভেদ হল :
(১) দুর্বল (২) বেশী দুর্বল, (৩) ওয়াহী বা ক্ষণভঙ্গুর, (৪) মুনকার, এবং (৫) মওজু বা বানোয়াট । এটিই সবচে নিকৃষ্ট।
আমরা কবর যিয়ারাত করব কিভাবে ?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إنِّي كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُوْرِ فَزُوْرُوْهَا لِتُذَكِّرَكُمْ زِيَارَتَهَا خَيْرًا. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, আমি তোমাদের কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু এখন যিয়ারত কর, যাতে ইহা তোমাদেরকে ভাল কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (সহিহ মুসলিম)।
১। কবরস্থানে প্রবেশ কিংবা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুন্নত হচ্ছে তাদের সালাম করা এবং তাদের জন্য দোয়া করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের শিখিয়েছেন :
১। কবরস্থানে প্রবেশ কিংবা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুন্নত হচ্ছে তাদের সালাম করা এবং তাদের জন্য দোয়া করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের শিখিয়েছেন :
السَّلامُ عَلَيْكُمْ أهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَإنَّا إنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لاَحِقُوْنَ أسْأَلُ اللهَ لَناَ وَلَكُمْ الْعَافِيَةَ. (أي من العذاب) (رواه مسلم)
অর্থাৎ, হে ঘরের মুমিন-মুসলিম বাসিন্দাগণ! তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। আমরাও আল্লাহ চাহে তো তোমাদের সাথে মিলিত হব। আল্লাহর কাছে আমাদের এবং তোমাদের জন্য তাঁর আযাব হতে ক্ষমা চাই। (সহিহ মুসলিম)।
২। কবরের উপর বসা নিষেধ এবং তার উপর দিয়ে চলাফেরা করার রাস্তা বানানোও নিষেধ।
কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لاَ تُصَلُّوْا إلى الْقُبُوْرِ وَلاَ تَجْلِسُوا عَلَيْهاَ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, তোমরা কবরের দিকে সালাত আদায় কর না এবং কবরের বসবে না। (মুসলিম)।
৩। নৈকট্য লাভের আশায় কবরের চারপাশে তাওয়াফ করা নিষেধ।
৩। নৈকট্য লাভের আশায় কবরের চারপাশে তাওয়াফ করা নিষেধ।
কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ ﴿الحج29﴾
অর্থাৎ, তারা যেন প্রাচীন ঘরের (কাবার) চার পার্শ্বে তাওয়াফ করে। ( সূরা হজ ২২: আয়াত, ২৯)
৪। কবরস্থানে কোরআন তেলাওয়াত করা নিষেধ।
কারণ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لاَ تَجْعَلُوا بُيُوْتَكُمْ مَقَابِرَ فَإنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِي تَقْرَأُ فِيْهِ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ, তোমরা বাসস্থানসমূহকে কবরস্থান বানাবে না। কারণ, শয়তান সেসব বাড়ী হতে পলায়ন করে যেখানে সূরা বাকারা পাঠ করা হয়। ( মুসলিম)।
এ হাদিস দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, কবরস্থান কোরআন পাঠের স্থান নয়, বরং কোরআন তেলাওয়াতের স্থান হচ্ছে নিজ নিজ বাসস্থান। যে সব হাদিসে কবরস্থানে কোরআন পাঠের কথা বলা হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়।
৫। মৃতদের কাছ থেকে মদদ বা সাহায্য চাওয়া বড় শিরক। যদিও সে নবী কিংবা ওলী হয়।
এ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ ﴿106يونس﴾
অর্থাৎ, আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। যদি তুমি কর, তাহলে নিশ্চয় তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। ( সূরা ইউনুস: আয়াত, ১০৬)
৬। কবরের উপর ফুলের তোড়া দেয়া কিংবা কবরস্থানে তা স্থাপন না করা নাজায়েয।
কারণ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা সাহাবিরা কেউ এমনটি করেননি। তাছাড়া এতে খ্রীষ্টানদের অনুকরণ হয়। এবং এটি অপচয় অপব্যয়ের রাস্তা। এসব টাকা-পয়সা যদি অনাথ-গরীবদেরকে দেয়া হত তবে তারা উপকৃত হত। এবং অনুমোদিত জায়গায় ব্যয় নিশ্চিত হত।
৭। কবরের উপর কোনো সৌধ বানানো বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য দেয়াল দেয়া জায়েয নেই। তাতে কোরআনের আয়াত কিংবা কবিতা লেখাও নিষেধ।
তবে ইট, পাথর কিংবা মাটি দিয়ে এক বিঘত পরিমাণ উঁচু করা জায়েয, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে এটি কবর।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান ইবনে মাজউনের কবরকে এরূপ করেছিলেন, যাতে মানুষ কবর বলে বুঝতে পারে।
অন্ধ অনুসরণ
আলালাহ তাআলা বলেন :
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آَبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ ﴿المائدة104﴾
অর্থাৎ,আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে ও রাসূলের দিকে আস, তারা বলে, ‘আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যার উপর পেয়েছি তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পিতৃপুরুষরা কিছুই জানত না এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না তবুও?(সূরা মায়িদা, ৫: আয়াত, ১০৪)
১। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কোরআন, আল্লাহর একত্ববাদ ও একমাত্র আল্লাহর নিকট দোয়ার প্রতি ডেকেছিলেন, তখন তারা বলেছিল, আমাদের জন্য আমাদের বাপ-দাদাদের আকিদাই যথেষ্ট। পবিত্র কোরআন তাদের প্রতিবাদ করে বলছে : তোমাদের বাপ দাদারা ছিল জাহেল বা অজ্ঞ।
২। বর্তমান যুগে বহু মুসলিমই এই ধরণের অন্ধ অনুসরণের শিকারে পরিণত হয়েছে। লেখক বলেছেন :
একবার এক দায়ীকে আল্লাহর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই মর্মে দলিল উপস্থাপন করতে দেখেছি, সে ঘোষণা করছে, তোমাদের বাপ-দাদারা কি জানতেন যে, আল্লাহর হাত আছে? বাপ-দাদার প্রসঙ্গ টেনে সে অস্বীকার করতে চাচ্ছে যে আল্লাহর হাত নেই। কিন্তু পবিত্র কোরআন তা প্রমাণ করেছে।
আল্লাহ তাআলা আদম আ.-এর সৃষ্টি সম্বন্ধে শয়তানকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ (ص75)
অর্থাৎ, যাকে আমি নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি তাকে সেজদা করতে তোমাকে কোন জিনিস নিষেধ করল। ( সূরা সোয়াদ, ৩৮: ৭৫ আয়াত)।
কিন্তু আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাত হতে ভিন্ন। একটির সাথে আরেকটির তুলনা চলে না। তাঁর হাত সম্বন্ধে তিনিই জানেন। যেমনটি তার সাথে প্রযোজ্য সেটি তেমনই।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ﴿11الشوري﴾
অর্থাৎ, তাঁর মত কিছুই নেই আর তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। ( সূরা শুরা, ৪২ : আয়াত ১১)
৩। আরো একটি মন্দ ও ক্ষতিকর অনুসরণ হচ্ছে পাপ কাজে কাফেরদের অনুসরণ।
যেমন মুসলিম রমণীরা আজ তাদের অনুসরণে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারে সংকীর্ণ পোষাক পরে খোলা মেলা ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাল-চলন, পোষাক-আষাক, কথা-বার্তা ইত্যাদিতে আজ মুসলিমরা কাফেরদেরকে আদর্শ জ্ঞান করে তাদের অনুসরণ করছে। হায়! যদি তারা উপকারী সামগ্রী আবিষ্কার ও নির্মাণ যেমন বিমান তৈরী ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করত তাহলে তা তাদের উপকারে আসত।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (الحجرات 1)
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না। (সূরা হুজুরাত, আয়াত, ১)
সত্যকে প্রত্যাখান কর না
১। নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য পাঠিয়েছেন। তাদের হুকুম করেছেন তার ইবাদত ও একত্ববাদের দিকে লোকদের আহবান করতে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তাঁদের কথা অমান্য করেছে এবং তাঁরা যে সত্য তথা তাওহিদের দিকে ডেকেছেন তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই তাদের পরিণতি হয়েছিল ধ্বংস।
২। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْر.ثُمَّ قَالَ: الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمَطُ النَّاسِ. (رواه مسلم)
অর্থাৎ. যার অন্তরে অণু পরিমাণও অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তারপর বলেছেন : অহঙ্কার হচ্ছে সত্যকে প্রত্যাখান করা ও মানুষকে নিকৃষ্ট চোখে দেখা। (মুসলিম)।
৩। সত্য গ্রহণ করা ওয়াজিব। তা যে কেউ বলুক না কেন। এমনকি শয়তান বললেও।
৩। সত্য গ্রহণ করা ওয়াজিব। তা যে কেউ বলুক না কেন। এমনকি শয়তান বললেও।
হাদিস শরিফে আছে :
إنَّ الرَّسُولَ صلى اللهُ عليه وسلَّمَ وَضَعَ أبَا هُرَيْرَةَ حَارِسًا عَلي بَيْتِ الْمَالِ فَجَاءَهُ سَارِقٌ لِيَسْرقَ فَقَبَضَ عَلَيْهِ أبُوهُرَيْرَةَ فَجَعَلَ السّارِقُ يَرْجُوْه وَيَشْكُوْ ضُعْفَهُ فَتَرَكَهُ ثُمَّ عَادَ مَرَّةً ثّانِيّةً وَثَالِثَةً فَقَبَضَ عَلَيْهِ وَقَالَ لَهُ: لأَرْفَعَنَّكَ إلى رَسُولِ اللهِ فَقَالَ دَعْنِيْ فَإنّي أعَلِمُكَ آيَةً مِنَ الْقُرْآنِ إذَا قَرَأتَهَا لاَ يَقْرُبُكَ شَيْطَانٌ قَال: مَا هِيَ؟ قَال آيَةُ الْكُرْسِي فَتَرَكَهُ وَقصَّ أبُوهُرَيْرَةَ عَلي رَسُولِ اللهِ مَا رأَي فَقَالَ لَهُ الرَّسُولُ: أَتَدْرِي مَنْ تَكَلَّمَ؟ إنَّهُ شَيْطَانٌ صَدَقَكَ وَهُوَكَذُوْبٌ. (رواه البخاري)
অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু হুরায়রা রা.-কে বায়তুল মালের পাহারাদার বানিয়েছিলেন। রাতে চুরির উদ্দেশ্যে এক চোর আসে। তিনি তাকে ধরে ফেলেন। তখন চোর তার কাছে দয়া ভিক্ষা করতে শুরু করল এবং নিজ দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করতে লাগল। তাই তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। তারপর দ্বিতীয় দিন এবং তৃতীয় দিনও সে আসল। শেষের দিন তিনি তাকে ধরে বললেন : অবশ্যই আমি তোমাকে নবীজীর কাছে সোপর্দ করব। সে বলল : আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে এমন একটি আয়াত শেখাব, যা পাঠ করলে শয়তান আর তোমার কাছে আসতে পারবে না। তিনি বললেন : সে আয়াত কোনটি? সে বলল : আয়াতুল কুরসি। যখন আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘটনাটি শুনালেন, তখন তিনি বললেন : তুমি কি জান সে ব্যক্তি কে ? সে শয়তান, তোমাকে সত্য বলেছে, যদিও সে চরম মিথ্যাবাদী। (বুখারি)
সমাপ্ত
সংকলন: শাইখ মুহাম্মদ বিন জামীল যাইনূ
অনুবাদক: ইকবাল হোছাইন মাছুম
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
অনুবাদক: ইকবাল হোছাইন মাছুম
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন