Views:
A+
A-
২- দানশীলতা :
৩- সহনশীলতা:
৪- ক্ষমা প্রদর্শন :
নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র ও গুণাবলি
নবীজির চারিত্রিক গুণাবলি:
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুন্দর আকৃতিবিশিষ্ট, সৌরভে
সুবাসিত, গঠনে মধ্যম, দেহে সবল, মস্তক ছিল বড়, দাড়ি ছিল ঘন, হস্ত ও পদ-দ্বয়
ছিল মাংসল, উভয় কাঁধ ছিল বড়, চেহারায় ছিল রক্তিম ছাপ, নেত্র দ্বয় ছিল
কালো, চুল ছিল সরল, গণ্ড দ্বয় কোমল। চলার সময় ঝুঁকে চলতেন, মনে হত যেন উঁচু
স্থান হতে নিচুতে অবতরণ করছেন। যদি কোন দিকে ফিরতেন, পূর্ণ ফিরতেন।
মুখমণ্ডলের ঘাম সুঘ্রাণের কারণে মনে হত সিক্ত তাজা মুক্তো। তার উভয় কাঁধের
মাঝখানে নবুয়তের মোহর ছিল্তঅর্থাৎ সুন্দর চুল ঘেরা গোশতের একটি বাড়তি অংশ।
নবীজীর চরিত্র:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুমহান, পূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতর চরিত্রে সুসজ্জিত, সবদিকে অতুলনীয়। মহান আল্লাহ বলেন :
وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ (سورة القلم:৪)
"এবং নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত"। (সূরা কালাম :৪)
আমরা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উৎকৃষ্ট চরিত্রের কতিপয়
দিক্তবিশেষত: তাঁর শিষ্টাচার সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করছি, যাতে আমরা তা
অনুকরণ করতে পারি, আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি, মুসলিম ভাইদেরকে এর
প্রতি আহ্বান করতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন:
لَقَدْ
كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو
اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا (سورة الأحزاب : ২১)
"যারা
আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য
রাসূলুল্লাহর মাঝে উত্তম নমুনা রয়েছে।" (সূরা আহযাব: ২১)।
সহীহ হাদিসে আছে -
أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم أخلاقا. رواه الترمذى :(২৫৩৭ )
"সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা পূর্ণ ঈমানদার"।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম আরো বলেন :
إن من أحبكم إلي و أقربكم مني مجلسا يوم القيامة: أحسنكم أخلاقا . رواه الترمذى :(১৯৪১)
"তোমাদের মাঝ থেকে সবচেয়ে বেশি চরিত্রবান ব্যক্তিই আমার নিকট অধিক প্রিয় এবং কেয়ামত দিবসে সর্বাপেক্ষা আমার অধিক নিকটে উপবেশনকারী।" (তিরমিজী)
নবীর কতিপয় চরিত্র নিম্নে উল্লেখ করা হল
১- তাকওয়া ও আল্লাহর ভীতি :
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাপেক্ষা তাকওয়া অবলম্বনকারী ছিলেন।
গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
إني لأعلمكم بالله، وأشدكم له خشية
"আল্লাহ সম্পর্কে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি অবগত এবং আল্লাহকে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি।"
স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম একথার সমর্থনে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা:) বলেন :
আমরা গণনা করে দেখতাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মজলিসে একশত বার নিম্নের দুআটি পড়তেন:
(رب اغفر لي،وتب علي، إنك انت التواب الرحيم)
"হে আমার রব, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, এবং আমার তাওবা কবুল কর, নিশ্চয় তুমি তাওবা কবুলকারী, দয়াশীল।"
নবী
আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় রবের অনুগত ছিলেন। তিনি মেনে
চলতেন তার আদেশ-নিষেধ। আমলে সালেহ বেশি করতেন। আয়েশা (রা:) নবী আকরাম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থার বিবরণ দিয়ে বলেন :
كان
عمل النبي صلى الله عليه وسلم ديمة، أيكم يطيق ما يطيق؟،كان يصوم حتى نقول
لايفطر، ويفطرحتى نقول لا يصوم، وكنت لاتشاء أن تراه من الليل مصليا إلا
رأيته مصليا، ولانائما إلا رأيته نائما) رواه الترمذى :(৭০০)
"নবী
আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল ছিল ধারাবাহিক। তিনি যা
পারতেন তোমাদের কেউ কি তা পারবে ? তিনি সিয়াম পালন করতেন এমনকি আমরা বলতাম
তিনি এর ধারাবাহিকতা আর পরিত্যাগ করবেন না। তিনি সিয়াম পালন বাদ দিতেন
এমনকি আমরা বলতাম তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। তুমি তাঁকে রাত্রে সালাতরত
অবস্থায় দেখতে না চাইলেও সালাতরত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পাবে। তুমি তাঁকে
রাত্রে ঘুমন্তাবস্থায় দেখতে না চাইলেও ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পাবে।"
আউফ বিন মালেক (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
(كنت
مع رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة، فاستاك ثم توضأ، ثم قام يصلي، فقمت
معه، فبدأ فاستفتح البقرة، فلايمربآية رحمة إلا وقف فسأل، ولايمربآية عذاب
إلا وقف فتعوذ، ثم ركع فمكث بقدر قيامه يقول: سبحان ذي الجبروت والملك
والملكوت والعظمة، ثم سجد وقال مثل ذلك، ثم قرأ آل عمران ثم سورة سورة يفصل
مثل ذلك). رواه النسائى :(১১২০)
"এক
রজনিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম, তিনি মিসওয়াক
করলেন, অতঃপর ওজু করলেন, এরপর দাঁড়িয়ে সালাত আরম্ভ করলেন, আমি ও তাঁর সাথে
দাঁড়ালাম, তিনি সূরা বাকারা পড়া শুরু করলেন, দয়া সংবলিত আয়াত পড়া মাত্র
থেমে প্রার্থনা করলেন। শাস্তির অর্থ সংবলিত আয়াত পড়া মাত্র থেমে মহান
আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইলেন। অতঃপর দাঁড়ানোর পরিমাণ রুকুতে অবস্থান করলেন,
এবং পড়তে লাগলেন : "মহা প্রতাপশালী, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, রাজত্ব ও
মহত্ত্বের অধিকারী সত্তার পবিত্রতা ও মহিমা ও ঘোষণা করছি।" অতঃপর সেজদা
করলেন, এবং অনুরূপ পড়লেন, এরপর আলে-ইমরান পড়লেন। অতঃপর একেকটি সূরা পড়তেন
থেমে।
আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
كان
رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا صلى قام حتى تفطررجلاه، فقلت يارسول
الله أتصنع هذا، وقد غفر لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر ؟ فقال :(يا عائشة،
أفلا أكون عبدا شكورا). رواه أحمد:(২৩৭০০)
"রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত আদায় করতেন দাঁড়িয়ে আদায় করতেন
এমনকি তাঁর উভয় পা ফেটে যেত, আমি বললাম্তহে রাসূলুল্লাহ ! কেন আপনি এমন
করছেন অথচ আপনার পূর্বের ও পশ্চাতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে ?
জওয়াবে তিনি বললেন,"হে আয়েশা আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না ?"
২- দানশীলতা :
নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দানশীলতা, উদারতা ও বদান্যতায় ছিলেন
সর্বোচ্চ উদাহরণ। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন
ما سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم شيئا قط فقال: لا
"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কিছু চাওয়া হলে তিনি না বলতেন না।"
আনাছ বিন মালেক (রা:) বলেন
ما
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم شيئا إلا أعطاه، فسأله رجل فأعطاه غنما
بين جبلين، فأتى الرجل قومه، فقال لهم: يا قوم أسلموا، فإن محمدا يعطي عطاء
من لا يخاف الفاقة (الفقر) رواه مسلم:(৪২৭৫)
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কিছু চাওয়া হলে তিনি দিয়ে দিতেন।
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট চাইল, তিনি তাকে
দুই পাল ছাগলের মধ্য থেকে এক পাল দিয়ে দিলেন, সে লোক নিজ গোত্রে এসে বলল,
হে গোত্রের লোকেরা! তোমরা মুসলমান হয়ে যাও, কেননা "মোহাম্মদ এমন ব্যক্তির
ন্যায় দান করে যে দারিদ্র্যের ভয় করে না"
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বদান্যতার ব্যাপারে আব্বাস (রা:) উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বদান্যতার ব্যাপারে আব্বাস (রা:) উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন
كان
رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس، وكان أجود ما يكون في رمضان،
حين يلقاه جبريل بالوحي، فيدارسه القرآن، فلرسول الله صلى الله عليه وسلم
أجود بالخير من الريح المرسلة . رواه البخاري:(৩২৯০)
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে অধিকতর দানশীল। তিনি
রমজান মাসে অধিক দান করতেন যখন জিবরাইল তাঁর নিকট ওহি নিয়ে আসতেন, তাঁকে
কোরআন শিক্ষা দিতেন। নিঃসন্দেহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
মুক্ত বায়ুর চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন।
(মুক্ত বায়ুর তুলনায় রাসূলের দানশীলতা অধিক এ তুলনার মর্মার্থ হচ্ছে, বায়ু মুক্ত হলেও তার যেমন কিছু কিছু দৌর্বল্য থাক্তেযেমন সে পৌঁছতে পারে না আবদ্ধ ঘওে রাসূলের দানশীলতার তেমন কোন দৌর্বল্য নেই। তার দানশীলতা পৌঁছে যেত সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে।)
(মুক্ত বায়ুর তুলনায় রাসূলের দানশীলতা অধিক এ তুলনার মর্মার্থ হচ্ছে, বায়ু মুক্ত হলেও তার যেমন কিছু কিছু দৌর্বল্য থাক্তেযেমন সে পৌঁছতে পারে না আবদ্ধ ঘওে রাসূলের দানশীলতার তেমন কোন দৌর্বল্য নেই। তার দানশীলতা পৌঁছে যেত সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে।)
৩- সহনশীলতা:
সহনশীলতায়
ও ক্রোধ-সংবরণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোচ্চ
আদর্শ। কখনো তাঁর পক্ষ হতে মন্দ কথন ও কর্ম প্রকাশ পায়নি,
নির্যাতন-অবিচারের শিকার হলেও কখনো প্রতিশোধ নেননি। কখনো কোন সেবক বা
স্ত্রীকে প্রহার করেননি। আয়েশা (রা:) বলেন
ما
رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم منتصرا لمظلمة ظلمها قط، ما لم تكن
حرمة من محارم الله، وماضرب بيده شيئا قط إلا أن يجاهد في سبيل الله،
وماضرب خادما قط ولا امرأة . رواه مسلم:(৪২৯৬)
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামক্তেআল্লাহর নিষিদ্ধ সীমা-রেখা লঙ্ঘন না
হল্তেকখনো নিজের প্রতি জুলুম-নির্যাতনের কোন প্রতিশোধ নিতে আমি দেখিনি।
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ব্যতীত তিনি কখনো কোন কিছুকে স্বীয় হস্ত দ্বারা
প্রহার করেননি। এবং তিনি কখনো কোন সেবক বা স্ত্রীকে প্রহার করেননি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহনশীলতার সমর্থনে কয়েকটি ঘটনা নিম্নে উল্লেখ করা হল
উহুদ
যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখমণ্ডল আঘাত প্রাপ্ত
হল, কয়েকটি দাঁত ভেঙে গেল, মাথায় পরিধেয় শিরস্ত্রাণ খণ্ড-বিখণ্ড হল,
তারপরেও তিনি কোরাইশদের বিরুদ্ধে বদ-দোআ করেননি। বরং তিনি বলেছেন
اللهم اغفر لقومي فإنهم لايعلمون . رواه مسلم:(৩২১৮)
হে আল্লাহ ! আমার জাতিকে ক্ষমা কর, কেননা তারা জানে না।
জনৈক বেদুইন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাদর শক্তভাবে টান দিলে তাঁর গলায় দাগ হয়ে গেল। তিনি বললেন:
احمل لي على بعيريّ هذين من مال الله الذي عندك، فإنك لاتحمل من مالك ومال أبيك
"আল্লাহর
যে সব মাল তোমার কাছে আছে আমার এই দু'উটের উপর আমার জন্য তা তুলে দাও।
কেননা তুমি আমার জন্য তোমার সম্পদ ও তোমার পিতা-মাতার সম্পদ তুলে দেবে না।"
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে আচরণে সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি শুধু বললেন:
المال مال الله، وأنا عبده، ويقاد منك يا أعرابي ما فعلت بي
"মাল
হচ্ছে আল্লাহর, আমি তাঁর বান্দা। হে বেদুইন ! তোমার কাছ থেকে আমার সাথে
কৃত অনাচারের কেসাস নেয়া হবে।" বেদুইন বলল: নানবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্ল্লাম বললেন : কেন ? সে বলল:
لأنك لا تكافئ السيئة بالسيئة . أبوداود:(৪১৪৫)
'কেননা,
তুমি তো খারাপের প্রতিশোধ খারাপ দিয়ে নাও না।' একথা শুনে রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন, এবং এক উটের উপর গম অন্য উটের উপর
খেজুর বহন করে দেয়ার আদেশ প্রদান করলেন।'
৪- ক্ষমা প্রদর্শন :
প্রতিশোধ নেয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সীমা-লঙ্ঘন কারীকে মার্জনা করা একটি উদার ও মহৎ গুণ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত আল্লাহর আদেশ মান্য করত: এ-গুণে সর্বাপেক্ষা গুণান্বিত ছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ ﴿১৯৯﴾ الأعراف
"তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎ কর্মের আদেশ দাও অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলো। (সুরা আ'রাফ: ১১৯)
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের অনেক ঘটনাবলির
বিবরণ বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত আছে, নীচে দু'টি উল্লেখ করা হল।্ততিনি যখন
মক্কা বিজয় করলেন, কোরাইশের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে তাঁর চূড়ান্ত
সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় নতশীরে উপবিষ্ট পেলেন। তিনি তাদেরকে বললেন:
يا معشر قريش: ما تظنون أني فاعل بكم ؟ قالوا أخ كريم، ابن أخ كريم، قال: فاذهبوا فأنتم الطلقاء،
হে
কোরাইশগণ ! তোমাদের সাথে এখন আমার আচরণের ধরন সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি ?
তারা বলল : আপনি উদার মনস্ক ভাই ও উদার মনস্ক ভাইয়ের ছেলে। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: 'যাও, তোমরা মুক্ত।' তিনি তাঁর ও সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে ঘটানো সমস্ত অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিলেন।
্তরাসূলকে
হত্যার উদ্দেশ্যে এক লোক আসল, কিন্তু তা ফাঁস হয়ে গেল। সাহাবিগণ বললেন :
হে আল্লাহর রাসূল ! এই লোক আপনাকে হত্যা করার মনস্থ করেছে, এ-কথা শুনে
লোকটি ভীত হয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন
لن تراع، لن تراع، ولو أردت ذلك ু أي قتلي ু لم تسلط علي.
ভয় করো না, ভয় করো না, যদিও তুমি আমাকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছ কিন্তু তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না।
কেননা
আল্লাহ তাআলা তাঁকে অবহিত করেছেন যে, তিনি তাঁকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা
করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিলেন্তঅথচ সে
তাঁকে হত্যা করার মনস্থ করেছিল।
সাহসিকতা:
সাহসিকতা,
নির্ভীকতা, যথা-সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এর বিশেষ গুণ ছিল। তাঁর সাহিসকতা বড় বড় বীরদের নিকট অবিসংবাদিতভাবে
স্বীকৃত। আলি ইবনে আবুতালিব (র:) বলতেন:
كنا إذا حمى البأس، واحمرت الحدق ما تحت الأجفان من شدة الغضب نتقي برسول الله
যুদ্ধ
যখন প্রচণ্ড রূপ নিত, প্রবলভাবে ক্রোধান্বিত হওয়ার ফলে চোখ রক্তিম বর্ণ
ধারণ করত তখন আমরা (তীর-তরবারির আঘাত থেকে বাঁচার জন্য)রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা-কবচ হিসেবে গ্রহণ করতাম।
ইমরান ইবনে হাছিন (র:) বলেন:
ما لقي رسول الله صلى الله عليه وسلم كتيبة ، إلا كان أول من يضرب
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন বাহিনীর মুখোমুখী হলে প্রথম আঘাতকারী হতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহসিকতার একটি নমুনা নীচে উল্লেখ করা হল।
এক
রাত্রে মদিনার এক প্রান্ত কারো চিৎকারের আওয়ায শুনা গেল। কিছু মানুষ
আওয়াজের দিকে অগ্রসর হলো, কিন্তু দেখা গেল রাসূলুল্লাহ (সা.) একাই আওয়াজের
উৎসস্থলে তাদের আগে গিয়ে পৌঁছলেন বরঞ্চ তিনি যখন অবস্থা দেখে ফিরছিলেন তখন
তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তিনি ছিলেন আবু তালহার অসজ্জিত ঘোড়ার উপরে।
তরবারি ছিল তাঁর স্কন্ধে। আবু তালহা বলতে লাগলেন :
كان النبي صلى الله عليه وسلم أحسن الناس ، وأجود الناس، وأشجع الناس، رواه البخارى:(২৬০৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাপেক্ষা সুন্দর, সর্বাপেক্ষা দানশীল, সর্বাপেক্ষা সাহসী।
ধৈর্যধারণ:
আল্লাহর
সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করা ও
আত্মঃসংবরণশীল হওয়া এক মহৎ গুণ। ধৈর্যের মহত্ত্বতার দিকে লক্ষ্য রেখে
আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ প্রদান করে
বলেন্ত
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ َ ﴿৩৫﴾ الأحقاف
অতএব, তুমি ধৈর্যধারণ কর, যেমন ধৈর্যধারণ করেছেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। (সুরা আহকাফ:৩৫)
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন,
এমনকি ধৈর্যধারণ তাঁর অনন্য ও সুমহান চরিত্রে মূর্ত-মান হয়েছে। তিনি
রেসালতের দায়িত্ব পালনের স্বার্থে দাওয়াতের কণ্টকাকীর্ণ পথে দীর্ঘ তেইশ বছর
ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতার মুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি
বিচলিত কিংবা রাগের বশবর্তী হননি। যেমন কোরাইশ কর্তৃক তাঁকে প্রহার, তাঁর
পিঠের উপর উটের নাড়িভুঁড়ি তুলে দেয়া, আবু তালেব উপত্যকায় তিন বছর পর্যন্ত
তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা ; তাঁর প্রতি অধিকাংশ লোকের বৈরী আচরণ ; জাদুকর,
গণক ও পাগল্তইত্যাদি অবমাননামূলক উপাধি দ্বারা আখ্যা দেয়া, হিজরতের রাতে
হত্যার প্রয়াস, মদিনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর
সাহাবিদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে কোরাইশের সৈন্য-প্রস্তুতি,
মদিনায় তাঁর বিরুদ্ধে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, পরস্পর সম্পাদিত চুক্তি ইহুদি
কর্তৃক ভঙ্গ, রাসূলকে হত্যার জন্য ইহুদিদের চেষ্টা ও তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন
স্তরের মানুষকে সংগঠিত করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং তাঁর সাহাবিগণ, ও পরিবার-বর্গ আহারের ক্ষেত্রেও ধৈর্যধারণ করেছেন। এমনকি রাসুলصلى الله عليه وسلم
কখনো একদিনে দু'বেলা যবের রুটি পেট ভরে খেতে পারেননি। এমন হত যে, দুই তিন
মাস অতিবাহিত হত, অথচ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরে চুলায় আগুন
জ্বলত না। অধিকাংশ সময় তাদের খাবার থাকতো খেজুর আর পানি।
ন্যায় পরায়ণতা:
ন্যায়
পরায়ণতা এক উৎকৃষ্ট মানবীয় চরিত্র ও অত্যবশ্যকীয় বিশেষ গুণ। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ-গুণে গুণান্বিত ছিলেন। এ-সম্পর্কে অনেক
ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে। নীচে প্রসিদ্ধ কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
মাখযুমিয়্যাহ
যখন চুরি করল, সে অভিজাত পরিবারের সদস্য হওয়ায় কিছু সাহাবায়ে কেরামের নিকট
তার উপর হাত কর্তনের মত দণ্ড-বিধি বাস্তবায়ন করা কঠিন মনে হল। এমনকি উসামা
বিন যায়েদ তাদের প্রতিনিধি হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
কাছে এসে তার ব্যাপারে সুপারিশ করলেন। জওয়াবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বললেন:
أفي حد من حدود الله تشفع يا أسامة ؟ والله لوسرقت فاطمة بنت محمد لقطعت يدها. رواه :مسلم:(৩১৯৬)
হে
উসামা ! তুমি কি আল্লাহ কর্তৃক অবধারিত দণ্ড-বিধি মওকুফের ব্যাপারে
সুপারিশ করছ ? আল্লাহর কসম ! মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে অবশ্যই
আমি তার হাত কেটে দেব।
্তবদর
প্রান্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় হস্তে বিদ্যমান লাঠি
দ্বারা সৈন্যদের কাতার সুবিন্যস্ত করেন, এ-সময়, ছাওয়াদ বিন গাজিয়াহ
কাতারের বাহিরে থাকার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পেটে
লাঠি দ্বারা খোঁচা মেরে বললেন:
استقم
يا سواد، فقال: يا رسول الله أوجعتني، وقد بعثك بالحق والعدل فأقدني ু
يعني اجعلني أقتص منك ু فكشف رسول الله صلى الله عليه وسلم راضيا، وقال:(
استقد يا سواد)، فاعتنقه سواد وقبل بطنه، فقال النبي صلى الله عليه وسلم :(
ما حملك على هذا يا سواد ؟) قال: يا رسول الله حضر ما ترى ু يعني القتال ু
فأردت أن يكون آخر العهد بك أن يمس جلدي جلدك، فدعا له بخير.
হে
ছাওয়াদ, সোজা হয়ে দাঁড়াও। সে বলল : হে আল্লাহর রাসূল আপনি আমাকে কষ্ট
দিয়েছেন অথচ আল্লাহ আপনাকে হক ও ইনসাফ সহকারে প্রেরণ করেছেন। আপনি আমাকে
আপনার কাছ থেকে কিসাস্ (প্রতিশোধ) নেয়ার সুযোগ করে দিন। এ-কথা শুনে রাসূল
সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তুষ্ট চিত্তে নিজের পেট খুলে দিলেন এবং
বললেন : হে ছাওয়াদ ! তুমি আমার কাছ থেকে কিসাস্ নিয়ে নাও। কিন্তু ছাওয়াদ
তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁর পেটে চুমু খেলেন। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বললেন : হে ছাওয়াদ তুমি এ-রকম কেন করলে ? উত্তরে বললেন : হে
আল্লাহর রাসূল ! আপনি যা দেখছেন (যুদ্ধ) তা একেবারে সন্নিকটে, অতএব, আমার
ইচ্ছা হচ্ছে, আমার চামড়া আপনার চামড়ার সাথে স্পর্শ হওয়া যেন আপনার সাথে শেষ
মিলন হয়। এ কথা শ্রবণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কল্যাণের
দোয়া করলেন।
আব্বাস
বিন আব্দুল মুত্তালিব বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচা হওয়ার সুবাদে আনসারগণ বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে
দেওয়ার আবেদন করলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :
لا والله لاتذرون له درهما
"না, তার জন্য এক দিরহামও ছাড় দিয়ো না।"
এ-দ্বারা রাসূলের লক্ষ্য হচ্ছে, যাতে সবার সাথে সমান আচরণ হয়, কোনভাবেই স্বজনপ্রীতি প্রকাশ না পায়।
দুনিয়া বিমুখতা:
প্রয়োজনের
অধিক পার্থিব বস্তু ভোগ পরিহার করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। একদা উমর (রা:) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলেন, তখন তাঁকে খেজুর-আঁশ-ভর্তি চামড়ার বিছানায় দেখে
বললেন:
إن
كسرى وقيصر ينامان على كذاو كذا، وأنت رسول الله تنام على كذا وكذا، فقال
النبي صلى الله عليه وسلم: ( مالي وللدنيا يا عمر، وإنما أنا فيها كراكب
استظل بظل شجرة، ثم راح وتركها). رواه الترمذى:(২২৯৯)
কায়সার
ও কিসরা (রোম ও পারস্যের সম্রাটরা) এমন এমন(অনেক আরামদায়ক) স্থানে ঘুমায়,
অথচ আপনি আল্লাহর রাসূল, তবুও আপনি ঘুমান এরকম বিছানায়। রাসূল সাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমার সাথে দুনিয়ার:ভোগ-বিলাসের সাথে কীসের
সম্পর্ক ? আমি তো এখানে পথিকের মত, যে গাছের ছায়া গ্রহণ করে, অতঃপর তা ছেড়ে
চলে যায়।" তিরমিজী
রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করতেন
(اللهم اجعل رزق آل محمد قوتا ). رواه البخارى:(৫৯৭৯)
"হে আল্লাহ মুহাম্মদের পরিবারের জীবিকা পরিমিত মাত্রায় দান কর।"
তাঁর
দুনিয়া বিমুখতার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে, তিনি যখন ইহকাল ত্যাগ করেন, তখন
তাঁর ঘরে কেবল আয়েশার আলমারিতে স্বল্প পরিমাণে গম ছাড়া কিছুই ছিল না। একটি
লৌহ বর্ম ছিল ; সেটিও ত্রিশ সা' (প্রাচীন আরবে প্রচলিত পরিমাপের নির্দিষ্ট
একটি ওজন) খেজুরের বিনিময়ে এক ইহুদির নিকট বন্দক ছিল।
লজ্জা:
লাজুকতা
অন্যতম উৎকৃষ্ট গুণ, এ-গুণেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
গুণান্বিত ছিলেন। এ-বিষয়ে আল্লাহ তাআলা নিজেই সাক্ষী দিয়ে বলেন:
إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنْكُمْ وَاللَّهُ لَا يَسْتَحْيِي مِنَ الْحَقِّ ﴿৫৩﴾ الأحزاب
নিশ্চয়
তোমাদের এ আচরণ নবীকে পীড়া দেয়, সে তোমাদেরকে উঠিয়ে দিতে সংকোচ বোধ করে,
কিন্তু আল্ল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ বোধ করেন না। (সূরা আহযাব ৫৩)
বিশিষ্ট সাহাবি আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন:
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أشد حياء من البكر في خدرها، وكان إذا كره شيئا عرفناه في وجهه. رواه البخارى:(৫৬৩৭)
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরদায় অবস্থানকারী কুমারী মেয়ের চেয়েও
অধিক লাজুক ছিলেন। তিনি যখন কোন কাজ অপছন্দ করতেন তাঁর চেহারায় আমরা তা
চিনতে পারতাম।
উত্তম সঙ্গ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহচরদের সাথে উত্তম ও সুন্দরভাবে মেলামেশা করতেন। আলী রা. বলেন্ত
كان الرسول صلى الله عليه وسلم أوسع الناس صدرا، وأصدق الناس لهجة، وأكرمهم عشرة . رواه الترمذى:(৩৫৭১)
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত হৃদয়ের
অধিকারী, সর্বাপেক্ষা সত্যভাষী, সর্বাপেক্ষা সম্মান জনক লেনদেনকারী।
ইবনে আবু হারাহ বলেন :
كان
دائم البشر، سهل الخلق، لين الجانب، ليس بفظ ولا غليظ ولاسخاب ولافحاش ولا
عياب ولا مداح، يتغافل عما لايشتهي ولا يؤيس منه، وكان يجيب من دعاه،
ويقبل الهدية ممن أهداه، ولو كانت كراع شاة، ويكافئ عليها، وكان صلى الله
عليه وسلم إذا دعاه أحد من أصحابه وأهل بيته قال: لبيك، وكان يمازح أصحابه
ويحادثهم ويداعب صبيانهم، ويجلسهم في حجره، ويعود المرضى في أقصى المدينة
ويقبل عذر المعتذر، ويكني أصحابه،ويدعوهم بأحب الأسماء إليهم تكريما لهم،
ولا يقطع على أحد حديثه حتى يتجوز.
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সদা প্রফুল্লচিত্ত, কোমল চরিত্রের
অধিকারী, সরল হৃদয়বান। রূঢ় স্বভাবের ছিলেন না, নির্দয় প্রকৃতির ও ছিলেন না,
নির্লজ্জ, গিবতকারী ও বিদ্রূপকারী ছিলেন না। অতিরিক্ত গুণকীর্তনকারীও
ছিলেন না, মনে চায় ন্তাএমন বস্তু থেকে বিমুখ থাকতেন, কিন্তু কাউকে তা থেকে
নিরাশ করতেন না। কেউ ডাকলে সাড়া দিতেন, কেউ উপহার দিলে গ্রহণ করতেন, যদিও
তা ছাগলের খুর হত, এবং তার উত্তম প্রতিদান দিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন কোন সাহাবি বা পরিবারের কোন সদস্য ডাকতেন তিনি
লাব্বাইক বলে সাড়া দিতেন। তিনি সাহাবাদের সাথে রসিকতা করতেন। গল্প করতেন
তাদের সাথে। তাদের সন্তানদের সাথে খেলা করতেন এবং নিজের কোলে বসাতেন।
মদিনার দূর প্রান্তে বসবাসকারী কেউ অসুস্থ হলে তারও খোঁজখবর নিতেন।
আবেদনকারীর আবেদন গ্রহণ করতেন। সাহাবাদেরকে উপনামে ডাকতেন। তিনি তাদের
সম্মান করে তাদের প্রিয় নাম দ্বারা ডাকতেন। সীমা-লঙ্ঘন না করলে কাউকে কথা
বলা থেকে বারণ করতেন না।
বিনয়:
বিনয়
উঁচু মাপের চারিত্রিক গুণ। এ-গুণের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোচ্চ উদাহরণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
নিজের কাপড় নিজে সেলাই করতেন। নিজ হাতে ছাগলের দুগ্ধ দোহন করতেন। নিজের
জুতা নিজে সেলাই করতেন। নিজের সেবা নিজে করতেন, নিজের ঘর নিজে পরিষ্কার
করতেন। নিজের উট নিজে বাঁধতেন। নিজের উটকে নিজে ঘাস ভক্ষণ করাতেন। গোলামের
সাথে খেতেন, প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিজে বহন করে বাজারে নিতেন। একদা এক লোক
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসল, কিন্তু সে তাঁর ভয়ে
শিহরিত হল, তিনি তাকে বললেন :
هون على نفسك، فإني لست ملكا، وإنما أنا ابن امرأة من قريش تأكل القديد. رواه ابن ماجة:(৩৩০৩)
তুমি নিজকে হালকা (স্বাভাবিক) করে নাও, কেননা আমি রাজা বাদশা নই। নিশ্চয় আমি কোরাইশের এমন এক মহিলার সন্তান, যে শুকনো গোশত খায়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যধিক প্রশংসা থেকে বারণ করে বলেছেন:
لا تطروني كما أطرت النصارى ابن مريم، وإنما عبد الله، فقولوا عبد الله ورسوله. رواه البخارى:(৩১৮৯)
তোমরা
আমার অত্যধিক প্রশংসা করো না, যে-রকম খ্রিস্টানরা মরিয়ম তনয়ের ক্ষেত্রে
করেছে। নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা। অতএব তোমরা (আমাকে) বল্তআল্লাহর বান্দা ও
তাঁর রাসূল।
সাহাবিদেরকে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়ানো থেকে বারণ করে বলেছেন:
إنما عبد، آكل كما يأكل العبد، وأجلس كما يجلس العبد .
নিশ্চয় আমি আল্লাহর গোলাম। আমি খাদ্য গ্রহণ করি, যে রকম গোলাম খাদ্য গ্রহণ করে। আমি উপবেশন করি, যে রকম গোলাম উপবেশন করে।
দয়া:
দয়া আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এক বিশেষ গুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ ﴿১২৮﴾التوبة
নিশ্চয়
তোমাদের মধ্যে হতে তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছেন, তোমাদেরকে যা বিপন্ন
করে, তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের প্রতি সে
দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (সূরা তাওবা ১২৮ )
তিনি আরো বলেন :
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ﴿১০৭﴾ الأنبياء
আমি তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি রহমত রূপে প্রেরণ করেছি।
রাসূল স. এর কতক উক্তি থেকেও তা প্রমাণিত হয়। (সূরা আম্বিয়া ১০৭)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
من لا يرحم لا يرحم. رواه البخارى:(৫৫৩৭)
যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না।
الراحمون يرحمهم الله. رواه الترمذى:(৮৪৭১)
দয়াশীলদেরকে আল্লাহ দয়া করেন।
في كل ذات كبد رطبة أجر. رواه البخارى:(২২৮২
প্রত্যেক প্রাণীর সেবায় রয়েছে পুণ্যের ছোঁয়া।
لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك مع كل صلاة. رواه البخارى:(১৪৪৭)
প্রত্যেক নামাজের সময় মিসওয়াক করা যদি আমার উম্মতের উপর পীড়াদায়ক না হত তবে তা বাধ্যতামূলক করে দিতাম।
বিশ্বস্ততা:
বিশ্বস্ততা ছিল রাসূলের অন্যতম গুণ, নীচে রাসূলের বিশ্বস্ততার নমুনা উল্লেখ করা হল।
যেমন খাদিজা রা. এর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সত্য-নিষ্ঠ আচরণ : আয়েশা রা. বর্ণনা করে বলেন :
ما
غرت من امرأة ما غرت من خديجة، لما كنت أسمعه يذكرها، وإن كان ليذبح شاة
فيهديها إلى خلائلها، واستأذنت عليه أختها فارتاح إليها، ودخلت عليه امرأة
فهش لها وأحسن السؤال عنها، فلما خرجت، قال: إنها تأتينا أيام خديجة ، وإن
حسن العهد من الإيمان .
"আমি
কোন মহিলার ব্যাপারে ঈর্ষা করতাম না, যা খাদিজার ব্যাপারে করতাম। কেননা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর কথা স্মরণ করতে শুনতাম। এমনকি
তিনি কোন ছাগল জবাই করলে তাঁর বান্ধবীদের নিকট তা থেকে হাদিয়া প্রেরণ
করতেন। একদা তাঁর বোন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরে
প্রবেশের অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন এবং স্বস্তি বোধ করলেন।
অন্য একজন মহিলা প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎফুল্ল
হলেন, সুন্দরভাবে তার খোঁজখবর নিলেন। যখন তিনি বের হয়ে গেলেন রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন্তএ মহিলা খাদিজার জীবদ্দশায় আমার
কাছে আসতো। নিশ্চয় সু-সম্পর্ক রক্ষা ঈমানের পরিচায়ক।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতিপয় চারিত্রিক গুণাবলি ও শিষ্টাচার:
১)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টি অবনত রাখতেন। কোন জিনিসের
প্রতি পুনরায় দৃষ্টি দিতেন না, স্থির দৃষ্টিতেও তাকাতেন না। আকাশের চেয়ে
জমির দিকে বেশি তাকাতেন।
২) সাহাবাদের সঙ্গে হাঁটার সময় তাদেরকে আগে দিতেন। তিনি তাদের আগে বাড়তেন না। কারো সাথে দেখা হলে সালাম দিতেন।
৩)
তাঁর কথা ছিল সংক্ষিপ্ত, অথচ ব্যাপক অর্থবোধক ও সুস্পষ্ট। প্রয়োজন অনুসারে
কথা বলতেন্তবেশিও বলতেন না কমও বলতেন না। রাসূলের সব কথা ছিল ভাল ও
কল্যাণধর্মী। কিন্তু তিনি দীর্ঘ নীরবতা অবলম্বনকারী ছিলেন।
৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক কোরআন তেলাওয়াতকারী,
এস্তেগফার ও জিকিরকারী এবং প্রার্থনাকারী। সারাটি জীবন সত্যের আহ্বানে ও
সৎকাজে ব্যয় করেছেন। তিনি ইসলামের আগে ও পরে অর্থাৎ সদা সত্যবাদী ও
আমানতদার ছিলেন।
৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বুদ্ধিমান, গাম্ভীর্যপূর্ণ, ও
সঠিক সিদ্ধান্তের অধিকারী, প্রজ্ঞাময় মহান নেতা, ক্রোধ সংবরণকারী, নম্র।
সব কিছুতে নম্রতা পছন্দ করতেন, এবং বলতেন:
من حرم الرفق يحرم الخير رواه مسلم:(৪৬৯৬)
"যে নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।"
৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সদা চিন্তাশীল, কোমল, শান্ত ও
ভদ্র চরিত্রের অধিকারী, রূঢ় স্বভাবের ও হীন চরিত্রের অধিকারী ছিলেন না।
নিয়ামত কম হলেও বেশি মনে করতেন। ব্যক্তিগত বা পার্থিব স্বার্থে আঘাত হলে
রাগ করতেন না। আল্লাহর বিধান লঙ্ঘিত হলে প্রতিবিধান না করা পর্যন্ত ক্রোধ
থামতেন না এবং ক্ষান্ত হতেন না।
৭)
হাসির সময় প্রায় মুচকি হাসতেন। এক কথা তিন বার বলতেন। তিন বার সালাম
দিতেন। তিন বার অনুমতি চাইতেন। যাতে তার কথা ও কর্ম, আচার-আচরণ সহজে
বোধগম্য হয়, অনায়াসে মানুষের হৃদয়ে আসন করে নেয়।
সমাপ্ত
লেখক: নুমান বিন আবুল বাশার
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন