ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) - ২য় পর্বসংকলন: ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিভিন্ন ছালাতের পরিচয়
১. বিতর ছালাত (صلاة الوتر)
বিতর ছালাত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ।[1] যা এশার ফরয ছালাতের পর হ’তে ফজর পর্যন্ত সুন্নাত ও নফল ছালাত সমূহের শেষে আদায় করতে হয়।[2] বিতর ছালাত খুবই ফযীলতপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ীতে বা সফরে কোন অবস্থায় বিতর ও ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত পরিত্যাগ করতেন না।[3]
‘বিতর’ অর্থ বেজোড়। যা মূলতঃ এক রাক‘আত। কেননা এক রাক‘আত যোগ না করলে কোন ছালাতই বেজোড় হয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘রাতের নফল ছালাত দুই দুই (مَثْنَى مَثْنَى)। অতঃপর যখন তোমাদের কেউ ফজর হয়ে যাবার আশংকা করবে, তখন সে যেন এক রাক‘আত পড়ে নেয়। যা তার পূর্বেকার সকল নফল ছালাতকে বিতরে পরিণত করবে’।[4] অন্য হাদীছে তিনি বলেন, اَلْوِتْرُ رَكْعَةٌ مِّنْ آخِرِ اللَّيْلِ ‘বিতর রাত্রির শেষে এক রাক‘আত মাত্র’।[5] আয়েশা (রাঃ) বলেন, وَكَانَ يُوْتِرُ بِوَاحِدَةٍ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক রাক‘আত দ্বারা বিতর করতেন’। [6]
রাতের নফল ছালাত সহ বিতর ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১৩ রাক‘আত পর্যন্ত (وَلاَ بِأَكْثَرَ مِنْ ثَلاَثَ عَشْرَةَ) পড়া যায় এবং তা প্রথম রাত্রি, মধ্য রাত্রি, ও শেষ রাত্রি সকল সময় পড়া চলে।[7] যদি কেউ বিতর পড়তে ভুলে যায় অথবা বিতর না পড়ে ঘুমিয়ে যায়, তবে স্মরণ হ’লে কিংবা রাতে বা সকালে ঘুম হ’তে জেগে উঠার পরে সুযোগ মত তা আদায় করবে।[8] অন্যান্য সুন্নাত-নফলের ন্যায় বিতরের ক্বাযাও আদায় করা যাবে।[9] তিন রাক‘আত বিতর একটানা ও এক সালামে পড়াই উত্তম।[10] ৫ রাক‘আত বিতরে একটানা পাঁচ রাক‘আত শেষে বৈঠক ও সালাম সহ বিতর করবে। [11] সাত ও নয় রাক‘আত বিতরে ছয় ও আট রাক‘আতে প্রথম বৈঠক করবে। অতঃপর সপ্তম ও নবম রাক‘আতে শেষ বৈঠক করে সালাম ফিরাবে।[12]
চার খলীফাসহ অধিকাংশ ছাহাবী, তাবেঈ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এক রাক‘আত বিতরে অভ্যস্ত ছিলেন।[13] অতএব ‘এক রাক‘আত বিতর সঠিক নয় এবং এক রাক‘আতে কোন ছালাত হয় না’। ‘বিতর তিন রাক‘আতে সীমাবদ্ধ’। ‘বিতর ছালাত মাগরিবের ছালাতের ন্যায়’। ‘তিন রাক‘আত বিতরের উপরে উম্মতের ইজমা হয়েছে’ বলে যেসব কথা সমাজে চালু আছে, শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই’।[14] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা মাগরিবের ছালাতের ন্যায় (মাঝখানে বৈঠক করে) বিতর আদায় করো না’।[15] উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতরের ১ম রাক‘আতে সূরা আ‘লা, ২য় রাক‘আতে সূরা কাফেরূণ ও ৩য় রাক‘আতে সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। ঐ সাথে ফালাক্ব ও নাস পড়ার কথাও এসেছে।[16] এসময় তিনি শেষ রাক‘আতে ব্যতীত সালাম ফিরাতেন না (وَلاَ يُسَلِّمُ إِلاَّ فِي آخِرِهِنَّ)। [17]
কুনূত (القنوت) :
‘ কুনূত’ অর্থ বিনম্র আনুগত্য। কুনূত দু’প্রকার। কুনূতে রাতেবাহ ও কুনূতে নাযেলাহ। প্রথমটি বিতর ছালাতের শেষ রাক‘আতে পড়তে হয়। দ্বিতীয়টি বিপদাপদ ও বিশেষ কোন যরূরী কারণে ফরয ছালাতের শেষ রাক‘আতে পড়তে হয়। বিতরের কুনূতের জন্য হাদীছে বিশেষ দো‘আ বর্ণিত হয়েছে।[18] বিতরের কুনূত সারা বছর পড়া চলে।[19] তবে মাঝে মধ্যে ছেড়ে দেওয়া ভাল। কেননা বিতরের জন্য কুনূত ওয়াজিব নয়। [20] দো‘আয়ে কুনূত রুকূর আগে ও পরে[21] দু’ভাবেই পড়া জায়েয আছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يَّدْعُوَ عَلَى أَحَدٍ أَوْ لِأَحَدٍ قَنَتَ بَعْدَ الرُّكُوْعِ، متفق عليه-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কারো বিরুদ্ধে বা কারো পক্ষে দো‘আ করতেন, তখন রুকূর পরে কুনূত পড়তেন...।[22] ইমাম বায়হাক্বী বলেন,
رُوَاةُ الْقُنُوْتِ بَعْدَ الرُّكُوْعِ أَكْثَرُ وَأَحْفَظُ وَعَلَيْهِ دَرَجَ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُوْنَ-
‘রুকূর পরে কুনূতের রাবীগণ সংখ্যায় অধিক ও অধিকতর স্মৃতিসম্পন্ন এবং এর উপরেই খুলাফায়ে রাশেদীন আমল করেছেন’। [23] হযরত ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ, আনাস, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী থেকে বিতরের কুনূতে বুক বরাবর হাত উঠিয়ে দো‘আ করা প্রমাণিত আছে।[24] কুনূত পড়ার জন্য রুকূর পূর্বে তাকবীরে তাহরীমার ন্যায় দু’হাত উঠানো ও পুনরায় বাঁধার প্রচলিত প্রথার কোন বিশুদ্ধ দলীল নেই।[25] ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, বিতরের কুনূত রুকূর পরে হবে, না পূর্বে হবে এবং এই সময় দো‘আ করার জন্য হাত উঠানো যাবে কি-না। তিনি বললেন, বিতরের কুনূত হবে রুকূর পরে এবং এই সময় হাত উঠিয়ে দো‘আ করবে।[26] ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) বলেন, বিতরের কুনূতের সময় দু’হাতের তালু আসমানের দিকে বুক বরাবর উঁচু থাকবে। ইমাম ত্বাহাবী ও ইমাম কার্খীও এটাকে পসন্দ করেছেন।[27] এই সময় মুক্তাদীগণ ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলবেন।[28]