Views:
A+
A-
(১) আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে অবৈধ ও হারাম পন্থায় প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা এবং ঐ সমস্ত ভূমিকা থেকে দূরে থেকে সতীত্ব সংরক্ষণের নিদের্শ দিয়ছেন, যা পরিণতিতে ব্যভিচার সংঘটিত হওয়ার সকায়ক হয়।
(ক) ইসলামের সবোর্ত্তম যুগের সাহাবায়ে কেরাম যারা আল্লাহ তাআলার নিকট শিষ্টাচারী, সদাচারী এবং ঈমানি পরাকাষ্ঠাসহ সৎকর্মের আদর্শ প্রতীক ছিলেন। তাদের স্ত্রীগণ, পরিপূর্ণ পর্দা করে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে অভ্যস্ত ছিলেন। তারাই আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ। অনুরূপভাবে তারাও অনুসরণীয় যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছেন।
(খ) উম্মত জননী আয়েশা রা: ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. যারা ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী ও সূক্ষ্ম তত্ত্ববিদ ছিলেন তারা আল্লাহর বান্দাদের একান্ত হিতাকাঙ্খী হওয়ার ব্যাপারে কোনো সংশয় থাকতে পারে না। এ দুই মহান ব্যক্তিত্ব এ অভিমত পেশ করেন যে, আমরা এ যুগে মহিলাদের যে আচরণ পর্যবেক্ষণ করছি এ দৃশ্য যদি আল্লাহর রাসূল দেখতেন তাহলে মহিলা সম্প্রদায়কে মসজিদে গমনাগমন থেকে পূর্ণভাবে নিষেধ করতেন, অথচ তা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ যুগের অন্তর্ভুক্ত। সে সময় মহিলাদের এ ধরনের আচরণের ফলে মসজিদে আগমন না করার নির্দেশ প্রদানের উপক্রম হল। এবার চিন্তা করে দেখুন আমাদের যুগ যে যুগে সর্বক্ষেত্রে চরিত্রহীনতা, নির্লজ্জতা, উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা এবং ঈমানী দূর্বলতার ব্যাপক পরিস্থিতিতে মহিলাদের জন্যে পর্দার কি ধরনের নির্দেশ হতে পারে?
পর্দাহীনতার কতিপয় অনিষ্টতা:
হাম্বলী মাজহাব অবলম্বনকারী পরবর্তী ফেকাহ শাস্ত্রবিদগণের দৃষ্টিতে পর্দার অপরিহার্যতা:
শাফেয়ী মতাবলম্বী ফেকাহ শাস্ত্রবিদগণের পর্দা সম্পর্কিত অভিমত।
(২) ইমাম আবু-দাউদ তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সুনানে আবু-দাউদ-এ উম্মত জননী আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, একদা আবু-বকর (রা.) তনয়া আসমা রা: পাতলা কাপড় পরিধান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সমীপে উপস্থিত হলে নবীজী চেহারা মুবারক অপর দিকে ফিরিয়ে হাত ও মুখমন্ডলের প্রতি ইংগিত করে আসমাকে বললেন, হে আসমা! মেয়ে মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তার মুখমন্ডল ও হাত ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অংশই দৃষ্টি গোচর হওয়া উচিত নয়।
(৩) বুখারি শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, বিদায় হজের সময় তার ভ্রাতা ফজল বিন আব্বাস রা: রাসূলের সাথে সওয়ারীর পিছনে উপবিষ্ট ছিলেন, ইতিমধ্যে খুসআম গোত্রের জনৈকা মহিলা রাসূলের সমীপে উপস্থিত হলে ফজল মহিলার প্রতি তাকাচ্ছিলেন এবং মহিলাও ফজলের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজল ইবনে আব্বাসের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মহিলাটির মূখমন্ডল খোলা ছিল।
(৪) সহীহ বুখারি ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে জাবের (রা:) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক লোকদের নিয়ে ঈদের নামাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাজ শেষ করে লোকদেরকে আখেরাত সংক্রান্ত উপদেশ প্রদান করে বললেন,
উল্লেখিত দলীলগুলোর জওয়াব
নারীর হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখার বৈধতা প্রমাণকারী এই দলীল চতুষ্টয় পূর্বে বর্ণিত হাত ও মুখমন্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত করে তা আবৃত রাখা অপরিহার্যতার প্রমাণপঞ্জীর পরিপন্থী নয়, আর তা দুই কারণে,
(ক) নারীর চেহারা আবৃত রাখার প্রমাণাদিতে একটি স্বতন্ত্র ও নতুন নির্দেশ নিহিত আছে পক্ষান্তরে চেহারা অনাবৃত রাখার দলীল পেশ করার মৌলিক নির্দেশ রয়েছে, তা হচ্ছে পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেকার ব্যাপক প্রচলন।
(খ) আমরা যখন নারীর চেহারা খোলা রাখার বৈধতার দলীলাদি নিয়ে গভীর গবেষণা করি তখন এই বাস্তবতা ফুটে উঠে যে, এই বৈধতার দলীলাদির সমতুল্য নয়। বিস্তারিত বিবরণ প্রতিটি দলীলের পৃথক পৃথক জওয়াবের মাধ্যমে জানা যাবে ইনশাআল্লাহ।
(১) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের অবস্থা বণর্না করেছেন। যেমন শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার উক্তি বর্ণনার স্থলে উল্লেখ হয়েছে।
(২) হতে পারে তার উদ্দেশ্য হল, ঐ সৌন্দর্য বর্ণনা করা যা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। যেমন- আল্লামা ইবনে কাসীর (র:) উক্ত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কিত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা:) যেই তাফসীর উল্লেখ করেছেন তাতেও আমাদের পক্ষ হতে উপরোক্ত জওয়াবদ্বয়ের সমর্থন পাওয়া যায়, যা কোরআন ভিত্তিক তৃতীয় প্রমাণের পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
(৩) যদি আমাদের উল্লেখিত দুই জবাব মানতে তাদের আপত্তি থাকে। তাহলে তৃতীয় জওয়াব হচ্ছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীর কেবলমাত্র তখনই দলীল হতে পারে যখন তার তাফসীরের প্রতিকূলে অন্য সাহাবির কোন বক্তব্য বিদ্যমান না থাকে। নতুবা পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলীলাদির যেটি অন্য দলীলের সমর্থনে প্রবল এবং প্রাধান্যযোগ্য সাব্যস্থ হবে, সে দলীল দ্বারা প্রমাণিত উক্তির উপরই আমল করা হবে। আমাদের বিতর্কিত মাসআলায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীরের প্রতিকূলে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীর ও বিদ্যমান। তিনি বলেন: (ততটুকু ভিন্ন যতটুকু এমনিই প্রকাশ পায়) বাক্যে উপরের কাপড় যেমন- বোরকা, চাদর ইত্যাদিকে পর্দার বিধানের ব্যতিক্রমের অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে যা সর্বাবস্থায় প্রকাশিত হয়ে যায়, যা আবৃত করা সম্ভবপর নয়।
(২) উম্মত জননী আয়েশা (রা:) এর বর্ণিত হাদীসটি দুই কারণে দুর্বল।
(ক) খালেদ বিন দুরাই যে হাদীস বণর্নাকারীর মধ্যস্থতায় আয়েশা (রা:)-এর হাদিসটি বর্ণনা করেছেন , খালেদ সেই বর্ণনাকরীর নাম উল্লেখ করেননি, কাজেই হাদীসটি মুনকাতে প্রমাণিত হল। তাছাড়া ইমাম আবু দাউদ (র:) হাদীসটিকে দুর্বল বলে চিহ্নিত করে বলেন যে, খালেদ ইবনে দুরাই আয়েশা (রা:) হতে সরাসরি হাদীসটি শুনেছেন বলে এরূপ কোনো প্রমাণ নেই। হাদীসটি দুর্বল হওয়ার এ কারণটি আবু হাতেম রাজী (রহ.)ও বর্ণনা করেছেন।
(খ) এই হাদীসের সনদ তথা হাদীস বর্ণনা কারীদের ধারাবাহিক তালিকায় সাঈদ বিন বশীর আল-বসরী (পরবর্তীতে সিরিয়ার রাজধানী দামেশকের অধিবাসী।) নামের এক ব্যক্তি পাওয়া যায়। ইবনে মাহদী তাকে অনুপযুক্ত মনে করে পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনে মাঈন ইবনে মাদীনী এবং ইমাম নাসায়ী প্রমুখ অনুসরণযোগ্য মুহাদ্দেসীনে কেরাম তাকে দুর্বল বর্ণনাকারী সাব্যস্ত করেছেন। কাজেই হাদীসটি দূর্বল এবং তা আমাদের বর্ণিত পর্দার অপরিহার্যতা সম্পর্কিত বিশুদ্ধ হাদীসের মোকাবেলা করতে পারবে না। তাছাড়া আসমা বিনতে আবু-বকর (রা:)-এর বয়স হিজরতের সময় সাতাশ বৎসর ছিল, এই বয়স্কা নারী রাসূলের সমীপে এমন পাতলা বস্ত্র পরিধান করে যাবেন, যাতে তার হাত ও চেহারা ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকৃতিও প্রকাশ পাবে এটা সুস্থ্ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
(৩) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের জওয়াব, এই হাদীসে পরনারীর মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা জায়েয হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজল ইবনে আব্বাসের এই কর্ম অর্থাৎ তার নিকট আগমন কারী নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করার উপর সম্মতি প্রকাশ করেননি বরং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজলের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই ইমাম নববী (র:) সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন যে, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত মাসআলা সমূহের মধ্যে এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা যে, পর নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম।
(৪) জাবের (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের জওয়াব হল,
(ক) ঐ নারী কালো চেহারা বিশিষ্ট ও বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। আর বৃদ্ধা নারীর চেহারা খোলা রাখা নাজায়েয নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন:
(খ) অথবা, হয়ত নারীর ওড়না চেহারা থেকে পড়ে গিয়েছিল আর তখনই হাদীস বর্ণনাকারীর দৃষ্টি তার প্রতি পতিত হয়। কিংবা তিনি চিরসত্য রাসূলের মুখে জাহান্নামের জ্বালানীতে পরিণত হওয়ার কথা শুনে জ্ঞানহারা হয়ে গিয়েছিলেন। এমনটি হওয়া আল্লাহভীরু সাহাবিদের পক্ষে বিচিত্র কোনো ঘটনা নয়। অনন্তর সন্বিত ফিরে পেয়েই ওড়নাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে এনে মুখমন্ডল আবৃত করে ফেলেছিলেন।
(গ) হয়ত এটি একটি বিশেষ ঘটনা, যার কারণে তাতে চেহারা খোলা থাকার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিন্তু পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরও চেহারা খোলা রাখার এমন ঘটনা সুস্পষ্ট হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যেমন জনৈকা নারী বিদায় হজ্জের দিন মুজদালিফা হতে মিনা যাওয়ার পথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন আব্বাস (রা:) তনয় ফজল রাসূলের সওয়ারীর পেছনে উপবিষ্ট ছিলেন, ফজল তার দিকে তাকাচ্ছিলেন অনুরূপ সেই নারীও, আর রাসূল হাত দিয়ে ফজলের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন... (আল-হাদীস)
(১) আল-ঈমান: ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি সন্নিবেশিত বিধি-বিধানে আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন করা, যার সাথে সাথে মানব অন্তরে বিদ্যুৎ শক্তির উৎপত্তি হয়। যে শক্তি মানবের সর্বাঙ্গকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল প্রদর্শিত আনুগত্যের বিধানানুসারে পরিচালিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। সোজা কথায় আল্লাহ ও রাসূলের মনোনীত আইন কানুন মেনে নেয়া।
(২) আল-ইফ্ফাত: সতীত্ব সংরক্ষণ, নৈতিক পবিত্রতা বজায় রাখা।
(৩)আল-ফিতরাত: সৃষ্টিগত স্বভাব ও প্রকৃতি।
(৪) আল-হায়া: লজ্জাশীলতা।
(৫) আত-তাহারাত: আত্মার পবিত্রতা।
(৬) আল- গাইরাত: শালীনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ।
• আল-ঈমান: পর্দার স্তর ও অবস্থান হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল প্রদর্শিত আইন কানুনের আনুগত্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দাদের প্রতি তার আনুগত্যকে আবশ্যিক ও বাঞ্চনীয় করে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আনুগত্যের অপরিহার্যতা ঘোষণা করে বলেন:
কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পর্দা
بسم الله الرحمن الرحيم
পরম করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে শুরু করছি।
الحمد لله نحمده و نستعينه و نستغفره و نعوذ به من شرورأنفسنا وسيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادى له ونشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له و أن محمدا عبده و رسوله صلى الله عليه وعلى آله وأصحابه ومن تبعهم بإحسان وسلم تسليما كثيرا،
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবীকুল শিরমনী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে হিদায়াত (পথ নির্দেশ) ও সত্য ধর্ম, (আনুগত্যের একমাত্র সত্য বিধান) সহ প্রেরণ করেছেন। যাতে তিনি রাব্বুল আলামীনের আদেশানুসারে মানব মন্ডলীকে কুফরের অন্ধকার থেকে ঈমানের আলোর দিকে বের করে নিয়ে আসেন। আল্লাহ তাআলা তাকে ইবাদতের মর্মার্থ বাস্তবায়িত করার জন্য পাঠিয়েছেন। এবং তা আল্লাহর বিধি-বিধানকে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও শয়তানি খেয়ালখুশি চরিতার্থ করার উপর অগ্রাধিকার দিয়ে একান্ত বিনয়, নম্রতা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর আদেশাবলী পালন করা এবং নিষেধাবলী থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে ।
মহান রাব্বুল আলামীন ইসলামি মতে নৈতিক চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে প্রেরণ করেছেন। তিনি যেন উত্তম সদাচারের দিকে মানবগোষ্ঠীকে আহ্বান করেন এবং অশালীন-অশোভন রীতি-নীতি, কার্যকলাপ ও নৈতিকতা বিধ্বংসী উপায় উপকরণাদি থেকে ভীতি প্রদর্শন করেন। তিনি মানবজাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণের জন্যে সার্বজনীন, সর্ব যুগে প্রযোজ্য, সর্বদিক দিয়ে সুসম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম (জীবন বিধান) নিয়ে এই ভূমন্ডলে আবির্ভূত হয়েছেন। সুতরাং, এখন দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা বা শুদ্ধতার জন্যে কোনো সৃষ্টি বা মানব প্রচেষ্টার কোনোই প্রয়োজন নেই। কেননা, এটি মহাবিজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা মহান স্রষ্টার পক্ষ হতে অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যিনি বান্দার উপযোগী প্রত্যেক ব্যাপারে সর্বজ্ঞাতা ও তাদের প্রতি চির স্নেহশীল, মহাকরুণাময়।
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে মহান চরিত্রাবলীর অধিকারী হয়ে প্রেরিত হয়েছেন। তন্মধ্যে লজ্জাশীলতা অন্যতম। এটি ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, নারীর পক্ষে স্বীয় মান মর্যদা রক্ষা কল্পে নিজেকে ফেতনা, অশ্লীলতা ও অমর্যাদাকর যাবতীয় আচরণ থেকে দূরে রাখা, তার লজ্জাশীলতারই বহি:প্রকাশ। যা ইসলামি শরিয়ত ও সামাজিকতার দৃষ্টিকোণে প্রতিটি নারীর জন্যে অপরিহার্য । মুখমন্ডলসহ শরীরের আর্কষনীয় অঙ্গসমূহ আবৃত করত: পর্দা পালন করা নারীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার মূল উপাদান নি:সন্দেহে । কারণ এটি নির্লজ্জতা পরিহার ও সতীত্ব সংরক্ষণের সর্বোত্তম উপায়। আমাদের এই দেশ (সাউদি আরব) ওহী, রিসালাত, লজ্জাবোধ ও শালীনতার (অনুশীলনের) দেশ, এখানে কিছুকাল পর্যন্ত লোকেরা এসব বিষয়ে সঠিক পদ্ধতির উপর অবিচল ছিল। রমণীকুল বড় চাদর, বোরখা ইত্যাদি দ্বারা আবৃত হয়ে যথার্থভাবে পর্দা অবলম্বন করে ঘর থেকে বের হত। পর পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা থেকে দূরে থাকত । এখনো সাউদি আরবের অনেক শহরে সেই অবস্থা বহাল রয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
কিন্তু কিছু সংখ্যক লোকের পর্দা সম্পর্কিত ভিত্তিহীন ও অশোভনীয় কথা বার্তা এবং পর্দ প্রথার বিরোধিতাকারী ও চেহারা অনাবৃত রাখার পক্ষপাতী লোকদের পর্দা বিষয়ক নানা প্রশ্ন যেমন, পর্দা ফরজ না মুস্তাহাব? নাকি এটি সামাজিক বা গোষ্ঠীয় কোনো প্রথা? ইত্যকার বিষয়গুলো সামনে আসলে এ সম্বন্ধে একটি প্রামাণ্য লেখা উপস্থাপনার চেষ্টা করেছি। এর মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর সব উক্তি ও সন্দেহ নিরসন করে সুস্পষ্ট প্রমাণাদির দ্বারা বিষয়টির প্রকৃত হুকুম অবগত করার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। মহান আল্লাহর রহমতে আশান্বিত হয়ে যে, এর দ্বারা প্রকৃত সত্য প্রকাশ পাবে। আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে প্রকৃত সত্যের অনুসারী, হিদায়াতপ্রাপ্ত ও তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহই আমাদের তাওফীক দাতা।
হে মুসলিম সম্প্রদায়! জেনে রাখুন, নারীর জন্যে পর পুরুষের সামানে পর্দা করা এবং মুখমন্ডল আবৃত রাখা। আপনার রবের পবিত্র কোরআন, নবীর সহীহ হাদীসসমূহ এবং শরিয়তজ্ঞদের অনন্য চেষ্টা সাধনালব্ধ সঠিক ও নির্ভুল কিয়াস তা প্রমাণ করে।
প্রথমত: পবিত্র কোরআনের আলোকে পর্দার অপরিহার্যতা
প্রথম প্রমাণ:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آَبَائِهِنَّ أَوْ آَبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴿31﴾
আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই-এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা আন-নূর:৩১)
(১) আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে অবৈধ ও হারাম পন্থায় প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা এবং ঐ সমস্ত ভূমিকা থেকে দূরে থেকে সতীত্ব সংরক্ষণের নিদের্শ দিয়ছেন, যা পরিণতিতে ব্যভিচার সংঘটিত হওয়ার সকায়ক হয়।
সর্ব শ্রেণীর লোকই জানে যে, নারীর জন্য চেহারা ঢাকা তার সতীত্ব সংরক্ষণের অন্যতম মাধ্যম। কারণ নারীর চেহারা অনাবৃত রাখা হলে, পরপুরুষেরা তার দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকায় এবং তার অঙ্গশ্রী দেখে চোখের দ্বারা যৌনানন্দ উপভোগ করার সুযোগ পায়। পরিণামে সেই নারীর সাথে বাক্যালাপ, পত্রালাপ ও সাক্ষাত ইত্যাদি অবৈধ পন্থা অবলম্বনের কারণ হয়ে দাড়ায়।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
العينان تزنيان و زناهما النظر
(মানুষের) চক্ষু দুটিও যেনা করে, আর চক্ষুদ্বয়ের যেনা হল দৃষ্টিপাত করা।
নবীজী পরিশেষে বলেন: যেনার সকল স্তর পর্যায়ক্রমে অতিক্রম করত: সর্বশেষে গুপ্তাঙ্গ যেনার অতিক্রান্ত স্তরসমূহকে সত্যায়ন করে। অর্থাৎ, যৌন মিলনের মাধ্যেমে যেনার পরিসমাপ্তি ঘটে। অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, অর্থাৎ- গুপ্তাঙ্গের যেনা সংঘটিত হয় না। সুতরাং, যখন মুখমন্ডল আবৃত রাখা যৌনাঙ্গ হেফাযতের মাধ্যম সাব্যস্ত হল, তখন প্রতীয়মান হয় যে, মুখমন্ডল আবৃত রাখা শরিয়তের নির্দেশিত। কেননা উদ্দেশ্যের যা হুকুম মাধ্যমেরও সেই হুকুম।
দ্বিতীয় প্রমাণ
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ
“তারা যেন বক্ষদেশে নিজদের ওড়না ফেলে রাখে” ।
‘খুমুরুন’ শব্দটি ‘খিমার’ শব্দের বহুবচন। ‘খিমার’ ঐ কাপড়কে বলা হয় যা নারীরা মাথায় ব্যবহার করে এবং তাদ্বারা গলা ও বক্ষ পানি ভরা কুপের ন্যায় আবৃত হয়ে যায়। সুতরাং, গলা আবৃত করার নির্দেশের দ্বারা চেহারা আবৃত করার র্নিদেশ প্রমাণিত হয়। কেননা, যখন গলা ও বক্ষ পর্দার আওতাধীন, তাহলে মুখমন্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত হওয়া অধিক যুক্তিযোগ্য। কারণ, নারীর মুখমন্ডল তার যাবতীয় রূপ ও সৃষ্টিগত সৌন্দর্যের মূল উৎস ও আকর্ষণ। এ কারণেই একজন নারীর সমগ্র দেহ অপেক্ষায় তার মুখমন্ডল দেখলে নৈতিক বিপর্যয় ঘটার আশংকা বেশি থাকে। তাছাড়া লোক সমাজে নারীর সৌন্দর্য তার চেহারার সৌন্দর্যের উপরেই নির্ভর করে, অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রতি মানুষ তেমন খেয়াল করে না। আলোচনার সময় যদি কেউ বলে, অমুক মহিলা রূপবতী-সুন্দরী, তখন শ্রোতা বিনা দ্বিধায় সে মহিলার চেহারার সৌন্দর্যই বুঝে নেয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় নারীর চেহারার সৌন্দর্যই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এরপর একটু চিন্তা করলে উপলব্ধি করা যাবে যে, প্রজ্ঞা ভিত্তিক ইসলামি শরিয়ত গলা ও বক্ষদেশকে পর্দার অন্তর্ভুক্ত করে মুখমন্ডলের ন্যায় ফিৎনা ও বিপর্যয়ের উৎসকে কেমন করে পর্দা বহির্ভূত করে খোলা রাখার অনুমতি দিতে পারে? (না তা কখনও হতে পারে না বরং মুখমন্ডল খোলা রেখে পুরোপুরী পর্দা পালন হতেই পারে না।)
৩- আল্লাহ তাআলা সৌন্দর্য প্রকাশ করার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেন:
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
“এবং তারা যেন প্রকাশ না করে তাদের সৌন্দর্য ততটুকু ভিন্ন যতটুকু স্বভাবত:ই প্রকাশ হয়ে পড়ে”।
অর্থাৎ নারীর কোন সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য পুরুষের সামনে প্রকাশ করা বৈধ নয়। অবশ্য যে সব সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য আপনা আপনিই প্রকাশ হয়ে পড়ে তার কথা ভিন্ন, যেমন বোরকা, লম্বা চাদর ইত্যাদি। এগুলো প্রকাশ করাতে গুণাহ নেই। এ জন্য মহান আল্লাহ বলেছেন: ততটুকু ভিন্ন যতটুকু স্বভাবতই প্রকাশ হয়ে পড়ে। তিনি বলেননি যতটুকু তারা প্রকাশ করে। আবার এ আয়াতেই আল্লাহ তাআলা সৌন্দর্য প্রদর্শন করার নিষিদ্ধতা ঘোষণা করেছেন:
এবং তারা যেন তাদের স্বামী (আয়াতে উল্লেখিত মোট বারজন ব্যতিক্রমভুক্ত লোকদের) ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে”।
উক্ত আয়াতে দুই জায়গায় যীনাত’ শব্দ ব্যবহার করে ব্যতিক্রম ব্যক্তিদের বিধান বণর্না দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, যীনাত (সাজ-পোষাক) দুই প্রকার, দ্বিতীয়টি প্রথমটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যথা- প্রথম: যীনাত যা প্রকাশ করা ব্যতিরেকে এমনিই প্রকাশ হয়ে পড়ে। যেমন- উপরের কাপড়, বোরকা ইত্যাদি ওগুলো ঢেকে রাখা অসম্ভব (তাই তা দেখা ইসলামি শরিয়তে অনুমোদিত) দ্বিতীয়: যা অপ্রকাশমান (গোপনীয়) অর্থাৎ, যে সাজের মাধ্যমে নারী নিজেকে সুসজ্জিত করে, যা অনিচ্ছাকৃতভাবে-স্বভাবতই প্রকাশ পায় না। এ দ্বিতীয় প্রকার যীনাত দর্শন করা সকলের জন্য জায়েয এবং দ্বিতীয়টার বেলায় ব্যতিক্রম করার মধ্যে কোন ফায়েদা থাকে না।
৪-আল্লাহ তাআলা নারীর আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য এমনসব পুরুষদের কাছে প্রদর্শন করার অনুমতি প্রদান করেন, যারা নির্বোধ যাদের প্রবৃত্তিগত কোনো আগ্রহ ও উৎসুক্যই নেই। আর তারা হল দাস, কাম প্রবণতাহীন বৃদ্ধ এবং এমন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক, এখনও সাবালকত্বে পৌঁছেনি এবং নারীদের গোপনীয় বিষয়াদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
উপরোক্ত বণর্না থেকে দুটি মাসআলা জানা যায় :
(ক) রমণীর আভ্যন্তরীণ সাজ-সজ্জা উল্লেখিত দুই প্রকারের (দাস ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক) পুরুষ ব্যতীত কারো সামনে প্রকাশ করা জায়েয নয়।
(খ) পুরুষ পরনারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে ফিৎনায় লিপ্ত হওয়ার আশংকায় পর্দা সম্পর্কিত নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, নারীর মুখমন্ডল যাবতীয় সৌন্দর্যের প্রতীক এবং ফিৎনা ও ফাসাদের উৎস। তাই মুখমন্ডল ঢাকা ওয়াজিব, যাতে কোনো পুরুষ তার প্রতি তাকিয়ে আসক্ত হয়ে ফেতনায় লিপ্ত না হয়।
৫- আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ
নারীরা যেন সজোরে পদচারণ না করে যার ফলে অলংকারাদির আওয়াজ ভেসে উঠে এবং তাদের বিশেষ সাজ-সজ্জা (পুরুষের কাছে) প্রকাশ হয়ে পড়ে।
অত্র আয়াতে নারীকে সজোরে পদচারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যাতে তাদের পায়ের অলংকার, বেড়ী, ঝুমুর ইত্যদি সম্বন্ধে বেগানা পুরুষ অবহিত হতে না পারে। সুতরাং, ফেৎনা সংঘটিত হওয়ার আশংকায় মহিলাকে যখন এ ভাবে চলাফেরা না করতে বলা হয়েছে, তখন চেহারার ন্যায় বিপদ সংকুলস্থান খোলা রাখা কিভাবে জায়েয হতে পারে?
লক্ষনীয় যে, এ দুটির মধ্যে কোনটি অধিক ফেৎনা সৃষ্টিকারী ও ধ্বংসাত্মক। রমণীর পায়ের অলংকারের শব্দ? যদ্বারা রমণী যুবতী না বৃদ্ধ, সুশ্রী না কুশ্রী কিছুই অনুভব করা যায় না, নাকি তার সৌন্দযের্র প্রতীক উম্মুক্ত চেহারা? বিবেক-বুদ্ধি ও অনুভূতি সম্পন্ন ব্যক্তি বর্গের অজানা নয় যে, এ দুটির কোনটি ফেৎনা সৃষ্টির কারণ হতে পারে এবং কোনটি খোলা না রেখে সম্পূর্ণ আবৃত রাখার অগ্রাধিকার রাখে। নি:সন্দেহে বলা যায়, এটি হবে চেহারা। কারণ, উক্ত আয়াতে পায়ের সাজ-সজ্জা প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। নারীর চেহারা প্রদর্শন করানোতো আরও কঠোর এবং সন্দেহাতীতভাবে হারাম হবে।
দ্বিতীয় প্রমাণ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ وَأَنْ يَسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ لَهُنَّ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“বৃদ্ধা নারী যারা বিবাহের আশা রাখে না, যদি তারা সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের বস্ত্র খুলে রাখে, তাদের জন্য দোষ নেই।.... তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা”। (সূরা নূর-৬০)
আলোচ্য আয়াতে পর্দার অপরিহার্যতা এভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহ বলেন বৃদ্ধনারী বার্ধক্যের কারণে) যার প্রতি কেউ আকর্ষণ বোধ করে না, তারা সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের বস্ত্র খুলে রাখতে পারে। এখানে বস্ত্র খুলে রাখা মানে উলঙ্গ বা নিরাবরণ হওয়া নয়, বরং যেসব বস্ত্র দ্বারা হাত, মুখমন্ডল ইত্যাদি আবৃত রাখা হয়- যথা- চাদর, বোরকা ইত্যাদি। এ আয়াতে বস্ত্র খুলে রাখার অনুমতি শুধুমাত্র বৃদ্ধা নারীদের জন্যেই নির্দিষ্ট। যুবতী নারীর মুখ-মন্ডল বিপদ সংকুলস্থান হওয়ায় তা ঢেকে রাখা জরুরি। যদি বস্ত্র খুলে রাখার হুকুম (নির্দেশ) বৃদ্ধা, যুবতী, তরুণী সকলের জন্যে অভিন্ন হত, তা হলে বৃদ্ধাকে যুবতী থেকে পৃথক করে উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
আয়াতে বলা হয়েছে:
غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ
অর্থাৎ যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, বস্ত্র খুলে রাখে, তবে তাদের কোনো দোষ নেই।
কিন্তু যুবতী ও তরুণী নিজ নিজ লাবণ্যময় মুখমন্ডল প্রদর্শন করে পুরুষের সামনে নেচে বেড়ানোর উদ্দেশ্য কেবলমাত্র পরপুরুষকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করাই হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে তা কদাচিত হয়ে থাকে যার উপর কোন হুকুম হয় না। এতে প্রমাণিত হল যে, বিবাহের যোগ্য যুবতী তরুণীর জন্যে মুখমন্ডল সহকারে পরিপূর্ণ পর্দা করা অপরিহার্য।
কিন্তু যুবতী ও তরুণী নিজ নিজ লাবণ্যময় মুখমন্ডল প্রদর্শন করে পুরুষের সামনে নেচে বেড়ানোর উদ্দেশ্য কেবলমাত্র পরপুরুষকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করাই হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে তা কদাচিত হয়ে থাকে যার উপর কোন হুকুম হয় না। এতে প্রমাণিত হল যে, বিবাহের যোগ্য যুবতী তরুণীর জন্যে মুখমন্ডল সহকারে পরিপূর্ণ পর্দা করা অপরিহার্য।
তৃতীয় প্রমাণ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব-৫৯)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহ তাআলা মুমিনদের মহিলাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে যেন জিলবাব তথা চাদর দ্বারা মাথার উপর দিক থেকে নিজেদের মুখমন্ডল ঢেকে বের হয়, তবে একটি চোখ খোলা রাখবে। সাহাবির তাফসীর নি:সন্দেহে শরয়ি দলীল । এমনকি কোনো কোনো আলেম সাহাবির তাফসীরকে হাদীসে মারুফের (উচ্চ ও ক্রটিমুক্ত হাদীস) সমতুল্য মনে করেন। সাহাবির তাফসীরে রাস্তা দেখার জন্যেই একটি চোখ খোলা রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। নিষ্প্রয়োজনে চক্ষু উম্মুক্ত রাখা বৈধ হবে না।
আরবি পরিভাষায় জিলবাব বলতে বড় চাদরকে বুঝানো হয়, যা ওড়নার উপর বোরকার পরিবর্তে পরিধান করা হয়।
নবী পত্নী উম্মে সালামা (রা:) বলেন, আলোচ্য আয়াত নাযিল হওয়ার পর থেকে আনসারি মহিলাগণ (মদীনা শরীফের স্থায়ী অধিবাসিনী) কালো চাদর পরে অতি ধীরস্থিরতার সাথে ঘর হতে বের হতেন। মনে হত যেন তাদের মাথার উপর কাক বসে আছে। সাহাবি আলী (রা:) এর শিষ্য আবু উবাইদাহ আস-সালমানী, কাতাদাহ প্রমুখ বলেন, মুমিন লোকদের স্ত্রীগণ মাথার উপর থেকে চাদর এভাবে পরিধান করত, চলার পথে রাস্তা দেখার জন্যে চক্ষু ব্যতীত শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকাশ পেত না।
চতুর্থ প্রমাণ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا جُنَاحَ عَلَيْهِنَّ فِي آَبَائِهِنَّ وَلَا أَبْنَائِهِنَّ وَلَا إِخْوَانِهِنَّ وَلَا أَبْنَاءِ إِخْوَانِهِنَّ وَلَا أَبْنَاءِ أَخَوَاتِهِنَّ وَلَا نِسَائِهِنَّ وَلَا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ وَاتَّقِينَ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدًا
নবীর স্ত্রীদের জন্য তাদের পিতাদের, তাদের পুত্রদের, তাদের ভাইদের, তাদের ভাইয়ের ছেলেদের, তাদের বোনের ছেলেদের, তাদের নারীদের ও তাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের বেলায় (হিজাব না করায়) কোন অপরাধ নেই। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সকল কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। (সুরা আহযাব-৫৫)
ইবনে কাসীর (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে গাইরে মাহরাম (ইসলামি শরিয়তে যাদের সাথে বিবাহ অনুমোদিত)-এর সাথে পর্দা করার নির্দেশ দানের পর এটিও বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, আত্মীয় মাহরামদের সাথে পর্দা করা ওয়াজিব নয়। যেমন, সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে বর্ণিত আছে:
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ
“তারা যেন তাদের স্বামী ছাড়া অন্যের সামনে তাদের সাজ-সজ্জা প্রকাশ না করে”।
পরপুরুষের সামনে পর্দার অপরিহার্যতার উপর পবিত্র কোরআন থেকে এই চারটি দলীল পেশ করা হল শুধু প্রথম আয়াতেই এ বিষয়ের উপর পাঁচটি প্রণালীতে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। (যা আমাদের জন্যে যথেষ্ট।)
দ্বিতীয়ত:
সুন্নাহর আলোকে পর্দার অপরিহার্যতা
প্রথম দলীল,
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
إذا خطب أحدكم امرأة فلا جناح عليه أن ينظر منها إذا كان إنما ينظر إليها لخطبة و إن كانت لا تعلم ( رواه أحمد)
“তোমাদের কেউ কোনো নারীর প্রতি বিয়ের প্রস্তাব প্রদানের পর তাকে দেখলে কোন গুণাহ হবে না”। (মুসানদে আহমাদ)
মাজমাউজ্জাওয়ায়েদ গ্রন্থে উক্ত হাদীসকে ত্রুটিমুক্ত ও বিশুদ্ধ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
উল্লেখিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম) বলেন, বিয়ের প্রস্তাব দাতা যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে পাত্রীকে দেখে, তাহলে গুণাহ হবে না। এতে প্রতীয়মান হলো যে, যারা বিয়ের উদ্যোগ না নিয়ে, এমনিই দেখে তারা গুনাহগার হবে। অনুরূপ যারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বিয়ের উদ্দেশ্যে নয় বরং মহিলার রূপ লাবণ্য দর্শনের স্বাদ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে দেখে থাকে, তারাও পাপাচারীদের দলভুক্ত হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, হাদীসে মহিলার কোন অঙ্গটি দর্শনীয় তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। বক্ষদেশ, হাত, পা ইত্যাদি যে কোনো একটি অঙ্গের দর্শনওতো উদ্দেশ্য হতে পারে।
উত্তর: সৌন্দর্য ও রূপ উপলব্ধিকারী প্রস্তাব দাতার পক্ষে পাত্রীর চেহারার সৌন্দর্য দেখাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। কারণ, চেহারাই হল, নারী সৌন্দর্যের প্রতীক। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৌন্দর্য অন্বেষনকারী প্রস্তাবদাতা নারীর চেহারাই দেখে থাকে, এতে কোন সন্দেহ নেই। (নারীর দর্শনীয় অঙ্গটি চেহারাই হয়ে থাকে)
২য় দলীল,
রাসূলল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদেরকে ঈদগাহে ঈদের নামায আদায় করার আদেশ প্রদান করলে জনৈকা নারী বলে উঠলেন। হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের করো কারো পরিধান করার মত চাদর-কাপড় নেই (আমরা কিভাবে জনসমাবেশে ঈদের নামায আদায় করতে যাব।) প্রত্যুত্তেরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন যার চাদর নাই তাকে যেন অন্য বোন পরার জন্যে চাদর দিয়ে দেয়। (বুখারী-মুসলিম)
উক্ত হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হল যে, সাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীরা কোন অবস্থাতেই চাদর পরিধান না করে গৃহ থেকে বের হতেন না, এমনকি চাদর ব্যতীত ঘর হতে বের হওয়াকে অসম্ভব মনে করতেন। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ঈদগাহে যাওয়ার নির্দেশ দানের পরও তারা চাদর ছাড়া ঈদগাহে যাওয়াকে সমীচীন মনে করেননি। তাইতো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে এরশাদ করেন, সে যেন তার অন্য বোন হতে ধার নিয়ে হলেও চাদর পরিধান করে ঘর থেকে বের হয়। লক্ষনীয় যে, রাসূল বিনা চাদরে বের হওয়ার অনুমতি প্রদান করেননি। অথচ ঈদ গাহে গিয়ে নামায আদায় করা নারী পুরুষ উভয়ের জন্য ইসলামি শরিয়ত সম্মত বিধান। যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) শরিয়ত সম্মত কাজের জন্যেও চাদর ব্যতীত (পুরাপুরী পর্দা করা ব্যতীত) ঈদগাহে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেননি, তাহলে অনৈসলামিক, অহেতুক, শরিয়ত অসম্মত কাজে চাদর ব্যতীত বেপর্দায় যাওয়ার অনুমতি কিভাবে দেওয়া যেতে পারে? নি:সন্দেহে তা অবৈধ হবে। বরং নারীর পক্ষে বাজারে মার্কেটে চলাফেরা করা এবং পরপুরুষের সাথে খোলা-মেলা ভাবে ঘুরে বেড়ানো অহেতুক কাজ যা প্রকৃত পক্ষে তাদের জন্যে অকল্যাণকর।
বস্তুত: আয়াতে ও হাদীসে চাদর পরিধান করার নির্দেশ এ কথাই প্রমাণ করে যে, নারীর জন্যে মুখমন্ডলসহ পরিপূর্ণ পর্দা করা অপরিহার্য। মহান আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞাত।
তৃতীয় দলীল,
সহিহ বুখারি ও মুসলিমে উম্মত জননী আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত আছে:
كان رسول الله يصلي الفجر معه نساء من المؤمنات متلفعات بمروطهن ثم يرجعن إلى بيوتهن ما يعرفهن أحد من الناس.
রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাম) ফজরের সালাতে কিছু সংখ্যক মহিলা চাদর পরিহিত অবস্থায় পরিপূর্ণ পর্দা করত: তাঁর পিছনে সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে আসতেন। সালাত শেষে আপন আপন গৃহে ফেরার পথে তাদেরকে চেনা যেত না।
আয়েশা (রা:) আরো বলেন : আজ মহিলাদের আচরণ যেভাবে আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, যদি রাসূলের জীবদ্দশায় তা প্রকাশ পেত, তাহলে রাসূল মহিলা সম্প্রদায়কে মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন। যেমন- ইহুদীরা (বনী ইসরাঈল) তাদের স্ত্রীলোকদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:)ও এ ধরনের বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখিত হাদীসে দুই পদ্ধতিতে পর্দার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়েছে:-
(ক) ইসলামের সবোর্ত্তম যুগের সাহাবায়ে কেরাম যারা আল্লাহ তাআলার নিকট শিষ্টাচারী, সদাচারী এবং ঈমানি পরাকাষ্ঠাসহ সৎকর্মের আদর্শ প্রতীক ছিলেন। তাদের স্ত্রীগণ, পরিপূর্ণ পর্দা করে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে অভ্যস্ত ছিলেন। তারাই আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ। অনুরূপভাবে তারাও অনুসরণীয় যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন:
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿100﴾
আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম ও অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য। (সূরা তাওবা-১০০)
যখন ইসলামের স্বর্ণ যুগের সাহাবা পত্নীগণ চলাফেরায় বেশ-ভূষায় ভদ্রতা-নম্রতায় ইসলামি কৃষ্টি কালচারে এভাবে অভ্যস্ত ছিলেন, যারা তাদের পদাংক অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি পেয়েছেন, তখন তাদের ন্যায় মহান ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মহিলাদের পথ প্রত্যাখ্যান করে আমরা কিভাবে অসভ্যতা ও অপসংস্কৃতির বশ্যতা স্বীকার করবো? যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সতর্ক উচ্চারণ করে বলেন:
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ। (সূরা নিসা-১১৫)
(খ) উম্মত জননী আয়েশা রা: ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. যারা ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী ও সূক্ষ্ম তত্ত্ববিদ ছিলেন তারা আল্লাহর বান্দাদের একান্ত হিতাকাঙ্খী হওয়ার ব্যাপারে কোনো সংশয় থাকতে পারে না। এ দুই মহান ব্যক্তিত্ব এ অভিমত পেশ করেন যে, আমরা এ যুগে মহিলাদের যে আচরণ পর্যবেক্ষণ করছি এ দৃশ্য যদি আল্লাহর রাসূল দেখতেন তাহলে মহিলা সম্প্রদায়কে মসজিদে গমনাগমন থেকে পূর্ণভাবে নিষেধ করতেন, অথচ তা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ যুগের অন্তর্ভুক্ত। সে সময় মহিলাদের এ ধরনের আচরণের ফলে মসজিদে আগমন না করার নির্দেশ প্রদানের উপক্রম হল। এবার চিন্তা করে দেখুন আমাদের যুগ যে যুগে সর্বক্ষেত্রে চরিত্রহীনতা, নির্লজ্জতা, উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা এবং ঈমানী দূর্বলতার ব্যাপক পরিস্থিতিতে মহিলাদের জন্যে পর্দার কি ধরনের নির্দেশ হতে পারে?
বস্তুত: উম্মত জননী আয়েশা (রা:) ও আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) এর উপলব্ধি যা শরিয়তের দলীল হিসাবে স্বীকৃত । যে সব বিষয় থেকে শরিয়ত নিষিদ্ধ বিষয় উদ্ভুত হয় তাও নিষিদ্ধ (এতে প্রমাণিত হল যে, নারীর মুখমন্ডল উম্মুক্ত রাখা হারাম, যারা এর বিরুদ্ধাচারণ করবে তারা হারামে পতিত হওয়ার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে।
চতুর্থ দলীল,
রাসূলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাস) বলেন:
من جر ثوبه خيلاء لم ينظر الله إليه يوم القيامة
“যে ব্যক্তি অহংকার বশে (পায়ের গোড়ালীর নীচে) কাপড় ঝুলিয়ে চলবে আল্লাহ কিয়ামত দিবসে তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করবেন না”।
নবী পত্নী উম্মে সালামা জিজ্ঞাসা করলেন, নারীগণ চাদরের নিম্নাংশ কতটুকু পরিমাণ ঝুলিয়ে রাখবে? রাসূল বললেন, অর্ধহাত পরিমাণ। উম্মে সালামা আবারও প্রশ্ন করলেন এ অবস্থায় মহিলার পা দৃষ্টিগোচর হবে। তদুত্তরে রাসূল বললেন- তাহলে একহাত পরিমাণ ঝুলিয়ে রাখবে এর অধিক নয়।
এ হাদীসে প্রমাণিত হল যে, মহিলার পা আবৃত রাখা ওয়াজিব, যা সাহাবি পত্নীগণের অজানা ছিল না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মহিলার পা দর্শনে যতটুকু ফিৎনার আশংকা রয়েছে তার চাইতে হাত ও মুখমন্ডল দর্শনে ফিৎনার আশংকা বেশি । অতএব পা দর্শন যা ফিৎনার নগণ্যতম মাধ্যম তাতে সতর্কবাণীর ফলে হাত ও মুখমন্ডল দর্শন যা সন্দেহাতীতভাবে অধিকতর ফিৎনাস্থল তার বিধান স্পষ্ট হয়ে গেল। আপনারা ভালোভাবে অবগত আছেন যে, প্রজ্ঞাভিত্তিক সুসম্পূর্ণ নিখুত শরিয়তে মহিলার পা যা ফিৎনার নগণ্যতম পন্থা তাতে পর্দার নির্দেশ দিয়ে হাত ও মুখমন্ডল যা ফিৎনার মূল উৎস তা উম্মুক্ত রাখার অনুমতি প্রদান করবে, তা কস্মিণকালেও হতে পারে না। কেননা, এটি মহাবিজ্ঞ আল্লহ রাব্বুল আলামীনের নিখুত আইন-কানুন ও বিধি- বিধানের পরিপন্থী।
পঞ্চম দলীল,
إذا كان لإحداكن مكاتب وكان عنده ما يؤدي فلتحتجب منه
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাস) বলেন:
“যখন তোমাদের (নারীদের) কারো কাছে মুক্তির জন্যে চুক্তিবদ্ধ কৃতদাস থাকে এবং তার নিকট চুক্তি অনুযায়ী মুক্তিপণ থাকে। তাহলে সে নারী কৃতদাসের সামনে পর্দা করবে”। (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ। ইমাম তিরমিজি একে সহীহ বলেছেন।)
উক্ত হাদীসে পর্দার অপরিহর্যতা এভাবে প্রমাণিত হয় যে, কৃতদাস যতদিন তার দাসত্বে বা মালিকানায় থাকবে। ততদিন তার সামনে মুখমন্ডল খোলা রাখা বৈধ হবে। যখন দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে, তখন পর্দা করা ওয়াজিব। কারণ, এখন সে গাইরে মাহরাম বলে গণ্য হবে। এতে প্রমাণিত হল, মহিলার জন্যে পরপুরুষের সামনে পর্দা করা অপিরহার্য।
ষষ্ঠ দলীল,
উম্মত জননী আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) বলেন,
كان الركبان يمرون بنا و نحن محرمات مع الرسول فإذا حاذونا سدلت إحدانا جلبابها على وجهها من رأسها فإذا جاوزنا كشفناه.
আমরা রাসূলের সাথে এহরাম অবস্থায় ছিলাম, উষ্ট্রারোহী পুরুষরা আমাদের পার্শ্বদিয়ে অতিক্রম কালে আমাদের মুখামুখি হলে আমরা মাথার উপর থেকে চাদর টেনে চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিতাম। তারা আমাদেরকে অতিক্রস করে চলে গেলে আমরা মুখমন্ডল খুলে দিতাম। (আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
হাদীসের অংশ, আমরা মাথা থেকে চাদর টেনে মুখমন্ডলের উপর ঝুলিয়ে রাখতাম। এ বাক্যটি চেহারা আবৃত রাখার সুস্পষ্ট দলীল। কেননা, আয়েশা রা. বলেন, যখনি আরোহীদল সামনে এসে যেত, আমরা পর্দা করে নিতাম। অথচ, অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে হজ্জ ও ওমরার এহরাম অবস্থায় মহিলাদের জন্যে চেহারা খুলে রাখা ওয়াজিব। আর কোন একটি ওয়াজিব বিধান তার চাইতে প্রবল শক্তিশালী বিধান আদায়ের খাতিরেই বর্জন করা যেতে পারে। এ জন্যেই যদি পর পুরুষের সামনে পর্দা করা ওয়াজিব না হত। তাহলে তার প্রতিকূলে এহরাম অবস্থায় চেহারা খোলার বিধান লঙ্ঘন করা বৈধ হত না।
সহিহ বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত আছে, এহরাম অবস্থায় মহিলার জন্যে নিকাব ও হাত মোজা পরিধান করা নিষিদ্ধ। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, রাসূলের যুগে এহরামরহ মহিলা ছাড়া অন্যান্য মহিলাদের হাত মোজা এবং নিকাব পরিধান করার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এতে প্রমাণিত হয়, হাত এবং চেহারা আবৃত রাখা অপরিহার্য ।
হাদিস শরীফ থেকে এই ছয়টি দলীল পেশ করা হল। যার মাধ্যমে মহিলাদের জন্যে গাইরে মাহরামের সামনে পর্দা করা এবং চেহারা আবৃত রাখা ফরজ সাব্যস্ত হল। এর সাথে পবিত্র কোরআন হতে বর্ণিত চারটি প্রমাণসহ মোট দশটি প্রমাণ পেশ করা হল।
তৃতীয়ত:
কিয়াসের আলোকে পর্দার অপরিহার্যতা।
ইসলামি শরিয়ত স্বীকৃত ও ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের সঠিক চিন্তা-গবেষণা ও চেষ্টা সাধনা হচ্ছে, কল্যাণকর বিষয়াদি ও তদীয় উপায় উপকরণাদি যথাযথ বহাল রাখার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা, অনুরূপভাবে অনিষ্টকর বিষয়াদি ও তার মাধ্যমসমূহের নিন্দা করা এবং তা থেকে বিরত থাকার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা। বলা বাহুল্য যেসব বিষয়ে শুধু খালেছ কল্যাণই নিহিত রয়েছে কিংবা অকল্যাণের তুলনায় কল্যণ প্রবল, সেসব বিষয় ইসলামি শরিয়তে নির্দেশিত, সেটা ওয়াজিব হবে বা মুস্তাহাব হবে। পক্ষান্তরে যেসব বিষয়ে কেবল অনিষ্টই অনিষ্ট বা অকল্যাণ কল্যানের চাইতে অধিক সেসব বিষয় যথাক্রমে প্রথমটি হারাম এবং দ্বিতীয়টি মাকরূহে তানযীহি হয়ে থাকে। আলোচ্য মূলনীতির ভিত্তিতে গভীরভাবে চিন্তা করলে উপলব্ধি করা যায় যে, নারীর জন্যে পরপুরুষের সামনে মুখমন্ডল খোলা রাখাতে (নৈতিকতা বিধ্বংসী) অনেক ফাসাদ ও অনাচার নিহিত রয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, মুখমন্ডল খোলা রাখাতে কিছু কল্যাণ নিহিত রয়েছে তবে তা অকল্যাণ ও ফাসাদের তুলনায় নগণ্য। কাজেই নারীর জন্যে পর পুরুষের সম্মুখে চেহারা খোলা রাখা হারাম এবং আবৃত রাখা ওয়াজিব বলে প্রমাণিত হল।
পর্দাহীনতার কতিপয় অনিষ্টতা:
(১) ফিৎনা ও অনাচারে পতিত হওয়া।
নারী মুখমন্ডল খোলা রেখে বেপর্দা হলে আপনা আপনি ফিৎনা ও অনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। কারণ, মুখমন্ডল খোলা রেখে চলতে হলে নারীকে তার মুখ মন্ডলে এমন কিছু বস্তু ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হয়, যাতে মুখমন্ডল লাবণ্যময়, সুদৃশ্য ও দৃষ্টি আকষর্ণকারী হয়। আর এটি হচ্ছে অনিষ্ট, অনাচার ও ফাসাদ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
(২) লজ্জাশীলতা বিলীন হয়ে যাওয়া।
পর্দাহীনতার ন্যায় অসৎ আচরণের কারণে নারীর অন্তর থেকে ক্রমে ক্রমে লজ্জা-শরম বিলুপ্ত হয়ে যায়, যা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত এবং নারী প্রকৃতির অন্যতম ভূষণ। তাইতো কোন এক সময় নারীকে লজ্জাশীলতার প্রতীক বলা হত। যেমন বলা হত, অমুক তো গৃহকোনে অবস্থানরত কুমারী রমণীর চাইতেও অধিক লাজুক। নারীর জন্যে লজ্জাহীনতা কেবলমাত্র দ্বীন ও ঈমান বিধ্বংসীই নয় বরং আল্লাহ তাআলা যে প্রকৃতির উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, সেই প্রকৃতির বিরোধিতা বা স্বভাব দ্রোহীতাও বটে।
(৩) পুরুষদের অপ্রীতিকর বিষয়ে জড়িয়ে যাওয়া।
বেপর্দা নারীর কারণে পুরুষদের জন্য ফিৎনা ও অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষত: যদি সেই নারী সুন্দরী ও তাদের সাথে ক্রিড়া কৌতুকে অভ্যস্থ হয়। এরূপ অশোভন আচরণ বেপর্দা নারীর সাথেই বেশি সংঘটিত হয়েছে। যেমন প্রবাদ রয়েছে:
আঁখি মিলন এরপর সালাম অনন্তর কালাম, অতএব অঙ্গীকার, সাক্ষাৎ, সঙ্গম শেষ পরিণাম।
বস্তুত: মানুষের চিরশত্রু শয়তান, মানব দেহে রক্তের ন্যায় শিরা-উপশিরায় চলাচল করে। নারীপুরুষের পারস্পরিক হাসি-ঠাট্টা ও কথা-বার্তার মাধ্যমে পুরুষ নারীর প্রতি কিংবা নারী পুরুষের প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণে কতইনা অমঙ্গল সাধিত হয়েছে, যা থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তা থেকে হেফাজত করুন।
(৪) নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা।
নারী যখন অনুধাবন করে যে, সেও পুরুষের মত চেহারা খোলা রেখে স্বাধীনভাবে চলতে পারে। তখন সে পুরুষের সাথে ঘেষাঘেষি করে চলাফেরা করতে লজ্জাবোধ করে না। আর এ ধরনের লজ্জাবিহীন ঘেষাঘেষি ও মেলামেশাই হচ্ছে ফিৎনা, ফাসাদ, অনাচার, ব্যাভিচারের সবচে বড় কারণ।
একদা মানব জাতির অনন্য নৈতিক মুয়াল্লিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাস) মসজিদ থেকে বের হয়ে রাস্তায় মহিলাদেরকে পুরুষদের সাথে মিলে মিশে চলতে দেখে, মহিলা সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বক্তব্য পেশ করেন:
استأخرن فإنه ليس لكن أن تحتضن الطريق عليكن بحافات الطريق
তোমরা পেছনে সরে যাও, রাস্তার মধ্যাংশে চলার অধিকার তোমাদের নেই। তোমরা রাস্তার কিনারায় চলাচল করবে।
রাসূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাস)-এর এই ঘোষণার পর মহিলাগণ রাস্তার পার্শ্ব দিয়ে এমনভাবে চলা ফেরা করতেন অনেক সময় তাদের পরিহিত চাদর পাশ্ববর্তী দেয়ালের সাথে লেগে যেত।
উক্ত হাদীসকে আল্লামা উবনে কাসীর রহ. (হে রাসূল! মুমিন নারীগণকে বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে, (সূরা নূর-৩১) আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ রহ. সর্বশেষ মুদ্রিত ফতওয়া গ্রন্থে (২য় খন্ডের ১১০ পৃষ্ঠায় ফেকাহ ও মাজমুউল ফতওয়ায় ২২তম খন্ডে) মহিলাদের জন্যে পর পুরুষের সামনে পর্দার অপরিহার্যতা সম্পর্কে সুস্পস্ট বক্তব্য পেশ করে বলেন:
প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তাআলা নারীর সৌন্দর্যকে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন:
প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তাআলা নারীর সৌন্দর্যকে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন:
(কা) প্রকাশ্য সাজ-সজ্জা
(খ) অপ্রকাশ্য সাজ-সজ্জা।
মহিলাদের জন্যে তাদের স্বামী ও মাহরাম পুরুষ -যাদের পারস্পপরিক সাক্ষাতে যৌন কামনা জাগ্রত হয় না এবং বিবাহ বন্ধন ইসলামি শরিয়ত অবৈধ ঘোষণা করেছে- তারা ব্যতীত পরপুরুষের সামনে প্রকাশমান সাজ-পোষাক প্রকাশ করা জায়েয আছে।
পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তৎকালীন মহিলারা চাদর পরিধান করা ব্যতীত বের হত এবং মহিলাদের হাত ও মুখমন্ডল পুরুষের দৃষ্টিগোচর হত। সে যুগে মহিলাদের জন্যে হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখা জায়েয হওয়ার কারণে পুরুষদের জন্যে মহিলার হাত ও মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা বৈধ ছিল। পরবর্তীতে যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পর্দার আয়াত অবতীর্ণ করে নির্দেশ প্রদান করলেন:
قل َيا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, (সূরা আহযাব-৫৯)
তখনই মহিলা সম্প্রদায় পুরুপুরী পর্দা অবলম্বন করতে লাগল। অত:পর শায়খূল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ (রহ:) জিলবাব শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন: জিলবাব বলতে চাদরকে বুঝায়। সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) জিলবাবের আকার আকৃতি সম্পর্কে বলেন। জিলবাব মানে চাদর এবং সাধারণ লোক জিলবাব বলতে ইজার বুঝে থাকে অর্থাৎ বিশেষ ধরনের বড় চাদর যা দ্বারা মস্তকসহ গোটা শরীর আবৃত করা যায়। অত:পর তিনি বলেন নারী জাতীকে জিলবাব তথা বড় চাদর পরিধান করার নির্দেশ এ জন্যেই দেয়া হল যে, যাতে কেউ তাদেরকে চিনতে না পারে। তাহলে এ উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে, যখন নারী মুখমন্ডল আবৃত রাখবে। সুতরাং, চেহারা এবং হাত সেই সাজ-পোষাকের অন্তর্ভুক্ত যা গাইরে মাহরাম পুরুষের সামনে প্রকাশ না করার জন্যে মহিলা সম্প্রদায়কে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হল যে, মহিলার পরিহিত কাপড় বা চাদরের উপরিভাগ ছাড়া হাত, মুখমন্ডল এবং শরীরের কোনো অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ পরপুরুষের দৃষ্টিগোচর হওয়া কস্মিনকালেও বৈধ হবে না।
উল্লেখিত বর্ণনা হতে প্রমাণিত হল যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) সর্বশেষ নির্দেশের বর্ণনা দিয়েছেন (তা হচ্ছে নারীর সাজ-পোষাকের বাহ্যিক দিক ছাড়া নারী দেহের অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দর্শন প্রদর্শন অবৈধ) আর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) ইসলামের প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। (তা হচ্ছে হাত, পা, মুখমন্ডল খোলা রাখা বৈধ) উল্লেখিত মতদ্বয়ের বিশুদ্ধ মতে নসখ তথা রহিত হওয়ার পূর্বেকার বিধানের পরিপন্থী। বর্তমানে নারীর জন্যে পরপুরুষ সমীপে মুখমন্ডল, হাত, পা, প্রকাশ করা বৈধ নয়। বরং কাপড়ের উপরিভাগ ছাড়া কোনো কিছুই প্রকাশ করার অনুমতি নেই। অত:পর শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (র:) বণির্ত গ্রন্থের ২য় খন্ডের ১১৭ ও১১৮ পৃষ্ঠায় পর্দা সম্পর্কিত মাসআলাটিকে আরো সুস্পষ্ট করে বলেন যে, মহিলার জন্যে হাত, পা ও মুখমন্ডল শুধুমাত্র মাহরাম পুরুষ ও নারীদের সামনে খোলা রাখা ইসলামি শরিয়ত সম্মত।
মূলত: ইসলামি শরিয়তে পর্দা সম্পর্কিত মাসআলায় দুটি উদ্দেশ্য প্রণিধানযোগ্য,
(ক) পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হওয়া।
(খ) নারী জাতি পর্দার অন্তরালে থাকা।
এটাই হল পর্দা সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইবেন তাইমিয়াহ (রহ:) এর বক্তব্য।
হাম্বলী মাজহাব অবলম্বনকারী পরবর্তী ফেকাহ শাস্ত্রবিদগণের দৃষ্টিতে পর্দার অপরিহার্যতা:
আল-মুন্তাহা নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,পুরুষত্বহীন (যার অন্ডকোষ ফেলে দেয়া হয়েছে) ও লিঙ্গবিহীন পুরুষের জন্য পর নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম।
আল-ইক্বনা নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, পুরুষত্বহীন, নপুংসক পুরুষের জন্যে নারী দর্শন হারাম। এই কিতাবের অন্যত্র উল্লেখ আছে, স্বাধীন পর নারীর প্রতি ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত করা এমনকি তার চুলের প্রতি নজর করাও হারাম।
আদ-দলীল গ্রন্থের মূল পাঠে উল্লেখ আছে,
দৃষ্টিপাত আট প্রকার। প্রথম প্রকার হল: সাবালক যুবকের পক্ষে (যদিও সে লিঙ্গ কর্তিত হয়) স্বাধীন প্রাপ্তবয়স্কা নারীর প্রতি (বিনা প্রয়োজনে) তাকানো হারাম। এমনকি রমনীর মাথার কৃত্রিম চুলের প্রতিও তাকানো জায়েয নয়।
শাফেয়ী মতাবলম্বী ফেকাহ শাস্ত্রবিদগণের পর্দা সম্পর্কিত অভিমত।
নারীর প্রতি কামুক দৃষ্টিতে তাকানো হারাম অনুরূপভাবে যে দৃষ্টিতে ফেতনার আশঙ্কা আছে সেটিও হারাম।
আর দৃষ্টি যদি কামোভাব সহকারে না হয় এবং এতে ফেৎনা সৃষ্টির আশংকাও না থাকে এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি অভিমত পেশ করেন। শারহুল ইক্বনা গ্রন্থকার অভিমতদ্বয় উল্লেখ করে বলেন, ত্রুটিমুক্ত ও বিশুদ্ধ মতটি হল: এ ধরনের দৃষ্টিপাত হারাম। তাদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মিনহাজে উল্লেখ আছে যে, রমণীর পক্ষে মুখমন্ডল খোলা রেখে বের হওয়া মুসলিমদের ঐক্যমতে নিষিদ্ধ। তাতে আরও বলা হয়েছে, মুসলিম শাসকবৃন্দের ইসলামি ও ঈমানি দায়িত্ব হচ্ছে, মহিলা সম্প্রদায়ের প্রতি মুখমন্ডল খোলা রেখে বের হওয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। কারণ, ফেৎনা সৃষ্টি ও যৌন উত্তেজনার মূলে দর্শনই দায়ী। যেমন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন:
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ
আর তুমি মুমিনদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে। (সূরা নূর-৩০)
প্রজ্ঞাভিত্তিক ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধানের লক্ষ্য হচ্ছে ফিৎনা-ফাসাদ, অনাচার, ব্যভিচারসহ যাবতীয় অবাধ্যতার ছিদ্রপথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া।
মুনতাকাল আখবার গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ নাইলুল আওতারে উল্লেখ আছে, নারীর জন্যে মুখমন্ডল খোলা রেখে বেপর্দা হয়ে বের হওয়া বিশেষত: দুষ্ট-দুরাচার-পাপীলোকদের সম্মুখে ইসলামপন্থীদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে হারাম।
• মুখমন্ডল খোলা রাখার মতাবলম্বীদের কতিপয় যুক্তি:
আমার জানামতে যারা নারীর হাত ও মুখমন্ডলকে ইসলামি পর্দা বহিভূর্ত মনে করে, এবং তা অনাবৃত রাখা এবং তার প্রতি পরপুরুষের দৃষ্টিপাত করা জায়েয বলে মত পোষণ করেন, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক তাদের কোনো দলীল নেই। হ্যাঁ কোরআন ও সুন্নাহ থেকে নিম্নোক্ত প্র্রমাণাদি পেশ করতে পারেন।
(১) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
আর তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। (সূরা নূর: ৩১)
কারণ, সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) মা জাহারা মিনহা (যা সাধারণত: প্রকাশ হয়ে পড়ে) আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, এখানে নারীর হাত, আংটি এবং মুখমন্ডল বুঝানো হয়েছে। (কেননা কোনো নারী প্রয়োজন বশত: বাইরে যেতে বাধ্য হলে চলা ফেরা ও লেন-দেনের সময় মুখমন্ডল ও হাত আবৃত রাখা খুবই কষ্টকর হয়)। এ তাফসীর ইমাম আমাশ সাঈদ বিন যুবাইরের মধ্যস্থতায় আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণনা করেছেন। আর সাহাবির তাফসীর শরিয়তের বিধান সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে দলীল হিসাবে গৃহীত।
(২) ইমাম আবু-দাউদ তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সুনানে আবু-দাউদ-এ উম্মত জননী আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, একদা আবু-বকর (রা.) তনয়া আসমা রা: পাতলা কাপড় পরিধান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সমীপে উপস্থিত হলে নবীজী চেহারা মুবারক অপর দিকে ফিরিয়ে হাত ও মুখমন্ডলের প্রতি ইংগিত করে আসমাকে বললেন, হে আসমা! মেয়ে মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তার মুখমন্ডল ও হাত ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অংশই দৃষ্টি গোচর হওয়া উচিত নয়।
(৩) বুখারি শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, বিদায় হজের সময় তার ভ্রাতা ফজল বিন আব্বাস রা: রাসূলের সাথে সওয়ারীর পিছনে উপবিষ্ট ছিলেন, ইতিমধ্যে খুসআম গোত্রের জনৈকা মহিলা রাসূলের সমীপে উপস্থিত হলে ফজল মহিলার প্রতি তাকাচ্ছিলেন এবং মহিলাও ফজলের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজল ইবনে আব্বাসের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মহিলাটির মূখমন্ডল খোলা ছিল।
(৪) সহীহ বুখারি ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে জাবের (রা:) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক লোকদের নিয়ে ঈদের নামাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাজ শেষ করে লোকদেরকে আখেরাত সংক্রান্ত উপদেশ প্রদান করে বললেন,
মহিলাদের কাছে গিয়ে হৃদয়গ্রাহী কিছু উপদেশ পেশ করেন আর বলেন: হে নারী সম্প্রদায় ! তোমরা আল্লাহর পথে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দান-দক্ষিণা কর, কেননা তোমরা অধিক হারে জাহান্নামের জ্বালানী হবে। তখন তাদের কালো বর্ণের চেহারা বিশিষ্ট জনৈকা মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন,...........( আল হাদিস)
এতে বুঝা গেল, মহিলাটির চেহারা খোলা ছিল, আবৃত ছিল না। নতুবা জাবের রা. কিভাবে জানতে পারলেন যে, মহিলাটির চেহারা কালো বর্ণের ছিল। আমার জানা মতে এই আয়াত ও হাদিস কয়টিই মহিলাদের জন্যে পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখার বৈধতার দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে।
উল্লেখিত দলীলগুলোর জওয়াব
নারীর হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখার বৈধতা প্রমাণকারী এই দলীল চতুষ্টয় পূর্বে বর্ণিত হাত ও মুখমন্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত করে তা আবৃত রাখা অপরিহার্যতার প্রমাণপঞ্জীর পরিপন্থী নয়, আর তা দুই কারণে,
(ক) নারীর চেহারা আবৃত রাখার প্রমাণাদিতে একটি স্বতন্ত্র ও নতুন নির্দেশ নিহিত আছে পক্ষান্তরে চেহারা অনাবৃত রাখার দলীল পেশ করার মৌলিক নির্দেশ রয়েছে, তা হচ্ছে পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেকার ব্যাপক প্রচলন।
উসূল শাস্ত্রবিদগণের প্রসিদ্ধ মূলনীতি হচ্ছে, সাধারণ অবস্থার বিপরীত নতুন দলীলকে প্রাধান্য দেয়া। কেননা, দলীল না পেলে তা বহাল রাখা যাবে। আর যখন সাধারণ অবস্থার অতিরিক্ত কোনো নতুন নির্দেশের দলীল উপস্থিত হবে, তখনই সাধারণ অবস্থাকে বহাল না রেখে নতুন নির্দেশের মাধ্যমে হুকুম পরিবর্তন করা হবে।
যেহেতু প্রত্যেক বস্তু তার স্বস্থানে বহাল থাকাকে আসল বলা হয়, সেহেতু যখনই আসলের পরিবর্তনকারী কোনো প্রমান পাওয়া যাবে, তখনই প্রতীয়মান হবে যে, বস্তুর আসলের উপর অন্য আরেকটি হুকুম আরোপিত হয়েছে এবং তার পূর্বেকার হুকুমের পুরবতর্ন ঘটেছে। এ জন্যই আমরা বলি, নতুন হুকুমের দলীল উপস্থাপনের অতিরিক্ত জ্ঞান যোগ হয়।
অর্থাৎ প্রাথমিক এবং সাধারণ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এবং নারীর চেহারা আবৃত রাখা ফরজ সাব্যস্ত হয়েছে। কাজেই নেতিবাচক হুকুমটির উপর ইতিবাচক হুকুমটির প্রাধান্য অর্জিত হবে।
এটি উল্লেখিত দলীলাদির সংক্ষিপ্ত জওয়াব। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, উভয় পক্ষের প্রমাণপঞ্জী মাসআলা সাব্যস্ত করার দিক দিয়ে পরস্পর সমপর্যায় সম্পন্ন তাহলেও ইতিবাচককে নেতিবাচকের উপর পাধান্য দেওয়া হয়। এই মূলনীতির দৃষ্টিতে নারীর মুখমন্ডল আবৃত রাখা অপরিহার্যতার প্রমাণপঞ্জী অগ্রাধিকার লাভ করবে।
(খ) আমরা যখন নারীর চেহারা খোলা রাখার বৈধতার দলীলাদি নিয়ে গভীর গবেষণা করি তখন এই বাস্তবতা ফুটে উঠে যে, এই বৈধতার দলীলাদির সমতুল্য নয়। বিস্তারিত বিবরণ প্রতিটি দলীলের পৃথক পৃথক জওয়াবের মাধ্যমে জানা যাবে ইনশাআল্লাহ।
(১) সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা:) বর্ণিত তাফসীরের তিনটি জওয়াব।
(১) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের অবস্থা বণর্না করেছেন। যেমন শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার উক্তি বর্ণনার স্থলে উল্লেখ হয়েছে।
(২) হতে পারে তার উদ্দেশ্য হল, ঐ সৌন্দর্য বর্ণনা করা যা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। যেমন- আল্লামা ইবনে কাসীর (র:) উক্ত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কিত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা:) যেই তাফসীর উল্লেখ করেছেন তাতেও আমাদের পক্ষ হতে উপরোক্ত জওয়াবদ্বয়ের সমর্থন পাওয়া যায়, যা কোরআন ভিত্তিক তৃতীয় প্রমাণের পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
(৩) যদি আমাদের উল্লেখিত দুই জবাব মানতে তাদের আপত্তি থাকে। তাহলে তৃতীয় জওয়াব হচ্ছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীর কেবলমাত্র তখনই দলীল হতে পারে যখন তার তাফসীরের প্রতিকূলে অন্য সাহাবির কোন বক্তব্য বিদ্যমান না থাকে। নতুবা পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলীলাদির যেটি অন্য দলীলের সমর্থনে প্রবল এবং প্রাধান্যযোগ্য সাব্যস্থ হবে, সে দলীল দ্বারা প্রমাণিত উক্তির উপরই আমল করা হবে। আমাদের বিতর্কিত মাসআলায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীরের প্রতিকূলে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীর ও বিদ্যমান। তিনি বলেন: (ততটুকু ভিন্ন যতটুকু এমনিই প্রকাশ পায়) বাক্যে উপরের কাপড় যেমন- বোরকা, চাদর ইত্যাদিকে পর্দার বিধানের ব্যতিক্রমের অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে যা সর্বাবস্থায় প্রকাশিত হয়ে যায়, যা আবৃত করা সম্ভবপর নয়।
এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কর্তব্য হচ্ছে। রাসূলের বিশিষ্ট সাহাবিদ্বয়ের তাফসীরের মধ্যে কোন তাফসীরটি প্রবল এবং প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য তা দলীল ভিত্তিক যাচাই করা এবং প্রবল এ প্রধান্য পাওয়ার যোগ্য তাফসীর অনুসারে আমল করা।
(২) উম্মত জননী আয়েশা (রা:) এর বর্ণিত হাদীসটি দুই কারণে দুর্বল।
(ক) খালেদ বিন দুরাই যে হাদীস বণর্নাকারীর মধ্যস্থতায় আয়েশা (রা:)-এর হাদিসটি বর্ণনা করেছেন , খালেদ সেই বর্ণনাকরীর নাম উল্লেখ করেননি, কাজেই হাদীসটি মুনকাতে প্রমাণিত হল। তাছাড়া ইমাম আবু দাউদ (র:) হাদীসটিকে দুর্বল বলে চিহ্নিত করে বলেন যে, খালেদ ইবনে দুরাই আয়েশা (রা:) হতে সরাসরি হাদীসটি শুনেছেন বলে এরূপ কোনো প্রমাণ নেই। হাদীসটি দুর্বল হওয়ার এ কারণটি আবু হাতেম রাজী (রহ.)ও বর্ণনা করেছেন।
(খ) এই হাদীসের সনদ তথা হাদীস বর্ণনা কারীদের ধারাবাহিক তালিকায় সাঈদ বিন বশীর আল-বসরী (পরবর্তীতে সিরিয়ার রাজধানী দামেশকের অধিবাসী।) নামের এক ব্যক্তি পাওয়া যায়। ইবনে মাহদী তাকে অনুপযুক্ত মনে করে পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনে মাঈন ইবনে মাদীনী এবং ইমাম নাসায়ী প্রমুখ অনুসরণযোগ্য মুহাদ্দেসীনে কেরাম তাকে দুর্বল বর্ণনাকারী সাব্যস্ত করেছেন। কাজেই হাদীসটি দূর্বল এবং তা আমাদের বর্ণিত পর্দার অপরিহার্যতা সম্পর্কিত বিশুদ্ধ হাদীসের মোকাবেলা করতে পারবে না। তাছাড়া আসমা বিনতে আবু-বকর (রা:)-এর বয়স হিজরতের সময় সাতাশ বৎসর ছিল, এই বয়স্কা নারী রাসূলের সমীপে এমন পাতলা বস্ত্র পরিধান করে যাবেন, যাতে তার হাত ও চেহারা ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকৃতিও প্রকাশ পাবে এটা সুস্থ্ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, হাদীসটি বিশুদ্ধ, তাহলে বলা যাবে আসমা সম্পর্কিত ঘটনাটি পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেই ঘটেছে। আর পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়ে পূর্বের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কাজেই পরবর্তী বিধান তথা পর্দার অপরিহার্যতার বিধান অগ্রগণ্য ও পালনীয় হবে।
(৩) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের জওয়াব, এই হাদীসে পরনারীর মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা জায়েয হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজল ইবনে আব্বাসের এই কর্ম অর্থাৎ তার নিকট আগমন কারী নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করার উপর সম্মতি প্রকাশ করেননি বরং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজলের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই ইমাম নববী (র:) সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন যে, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত মাসআলা সমূহের মধ্যে এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা যে, পর নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম।
হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী (র:) সহীহ বুখারীর শ্রেষ্ঠতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুলবারীতে এই হাদীসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন, এই হাদীস দ্বারা এটাও জানা হল যে, পরনারীর দর্শন ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ এবং এমতাবস্থায় দৃষ্টি নত রাখা ওয়াজিব।
কাজী আয়াজ (রহ:) বলেন, কতক লোকের ধারণা, যখন পরনারী দর্শনে ফেৎনা ও অনচারে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকে তখনই (পুরুষের জন্যে) দৃষ্টি নত রাখা ওয়াজিব। (এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আব্বাস তনয় ফজলের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। আর ফেৎনায় পতিত হওয়ার আশংকা না থাকলে পরনারী দর্শন জায়েয। কিন্তু আমার মতে কোনো কোনো বর্ণনামতে রাসূল যে ফজলের চেহারা ঘুরিয়ে দিয়েছেন, তার এই কাজটি মৌখিক নিষেধাজ্ঞার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। (কাজেই পরনারী র্দশনে ফেৎনায় লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থাতে হারাম এবং দৃষ্টি নত রাখা ওয়াজিব)
এখন প্রশ্ন হল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনাবৃত চেহারায় আগমন কারী মহিলাটিকে পর্দাবলম্বন করার নির্দেশ দেননি কেন?
এর উত্তর হচ্ছে,
• মহিলাটি এহরাম অবস্থায় ছিলেন, আর এহরামরত নারীর প্রতি ইসলামের বিধান হল পরপুরুষের দৃষ্টির আওতায় না থাকলে চেহারা খোলা রাখা ওয়াজিব।
• এমন সম্ভাবনাও আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পরবর্তীতে তাকে চেহারা ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা, হাদীস বর্ণনাকারীর পর্দার নির্দেশ উল্লেখ না করার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে মুখমন্ডল ঢেকে রাখার নির্দেশ দেননি। কারণ, কোনো বিধান উল্লেখ না হওয়াতে এমনটি জরুরি নয় যে বিধানটিই অস্তিত্বশূন্য।
সহীহ মুসলিম ও আবু দাউদে সাহাবি জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী (রা:) থেকে রাসূলুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি বর্ণিত আছে যে, অনিচ্ছকৃতভাবে (আকম্মাৎ) পর নারীর উপর দৃষ্টি পতিত হলে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। (বর্ণনাকারী সন্দেহ পোষণ করে বলেন) অথবা ইবনে আব্দুল্লাহ বাজলী (রা:) বলেন: রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে পর নারী দর্শন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
(৪) জাবের (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের জওয়াব হল,
• উল্লেখিত হাদীসে সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই যে, রাসূলের ঈদের নামাজ শেষে মহিলাদেরকে উপদেশ দান করা সম্পকির্ত ঘটনাটি কত সালে সংঘটিত হয়েছিল।
• হয়ত কালোবর্ণের মুখমন্ডল বিশিষ্ট মহিলাটি সেসব বৃদ্ধ নারীদের অন্তভুর্ক্ত ছিলেন (বাধ্যর্কের কারণে) যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনের আশা করা যায় না। এমন নারীদের চেহারা খোলা রাখা জায়েয। এসব বৃদ্ধ মহিলাদের উপর থেকে পর্দার বিধান উঠিয়ে নেয়ার দ্বারা অন্যান্য মহিলাদের উপর থেকেও পর্দার অপরিহার্যতা বিয়োগ হয় না। (বৃদ্ধ নারী ছাড়া অন্য সব নারীদের উপর পর্দার অপরিহার্যতা বহাল থাকবে।)
• হয়ত এই ঘটনাটি পর্দার আয়াত অবতরণের পূর্বেকার ঘটনা। কেননা,পর্দার বিধানাবলী বর্ণিত সূরা আল-আহযাব ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরী সনে অবতীর্ণ হয়েছে। আর ঈদের নামাজ প্রবর্তিত ২য় হিজরী সনে । এখন যেহেতু ঘটনাটি কত সনে ঘটেছে হাদীসে উল্লেখ নেই। তাই ঘটনাটি পর্দার আয়াত নাযিল হবার পূর্বেকার হলে তার দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, মহিলার জন্যে পর পুরুষের সম্মুখে চেহারা খোলা রাখা বৈধ। কাজেই মহিলার জন্যে চেহারা আবৃত রেখে পরিপূর্ণ পর্দা পালন করা অপরিহার্য।
স্মর্তব্য, পর্দা সম্পর্কিত এই মাসআলা বিস্তারিত আলোচনা করার কারণ হল,
* অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সামাজিক মাসআলাটি সম্পর্কে ইসলামি শরিয়তের বিধান কি? সাধারণ মানুষের এটি জানা খুবই জরুরি।
* হালকা জ্ঞানের অধিকারী কিছু লোক পর্দা বিষয়ে কলম ধরে বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছে। এবং এসব লেখনির মাধ্যমে তারা পর্দাহীনতা ও নগ্নতাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। (যার কারণে পর্দাহীনতা বেড়ে গেছে, ফলশ্রুতিতে যেনা-ব্যভিচার, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল আজ যৌন অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে কিশোরী, তরুণী ও যুবতী যথেচ্ছভাবে। ব্যভিচারের এ নগ্ন থাবায় আক্রান্ত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে হাজার হাজার তরুণী প্রতিদিন হাসপাতালে। তাদের আর্ত চিৎকারে আকাশ পাতাল ভারী হচ্ছে । পত্রিকার পাতা খুললে এমন বিভৎস চেহারা নিত্য ব্যাপার। পর্দাহীনতাই যে এসবের মূল কারণ তা আর ব্যাখ্যা করে বুঝানোর প্রয়োজন নেই।)
পর্দাহীনতার পক্ষাবলম্বী ব্যক্তিবর্গ পর্দা সম্পর্কিত বিষয়ে গভীর চিন্তা গবেষনা ও যথাযথ তাহক্বীক করেbনি। অথচ চিন্তাবিদ গবেষক ও তদন্তকারীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে,
ইনসাফ ও সমতা ভিত্তিক আচরণ করা এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্য বিষয়াদি অবগত হয়ে বিষয়ের গভীরে পৌঁছা ব্যতীত এ ধরনের উক্তি ও যুক্তি পেশ করা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকা।
অভীজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের করণীয় হচ্ছে, প্রমাণাদি ন্যায়পরায়ণ বিচারপতির মত ইনসাফ ও সমতা ভিত্তিক যাচাই করা। এবং গ্রহণযোগ্য প্রমাণাদি ব্যতিরেকে কোনো এক পক্ষকে প্রাধান্য না দেওয়া। বরং প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর চিন্তা-গবেষণা করে প্রকৃত তথ্য অবগত হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করা। এমনটি কোনোভাবেই সমীচীন হবে না যে, নিজের মনোপুত মতবাদকে (যদিও নিভুর্ল প্রমাণাদির দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য না হয়) সাব্যস্ত করার জন্যে ভিত্তিহীন যুক্তি দিয়ে সেই মতবাদের পক্ষে উপস্থাপিত দলীলাদিকে প্রবল করার চেষ্টা করা আর বিপক্ষের দলীলাদিকে অকারণে দূর্বল এবং অগ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা। এ জন্যেই প্রাজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম বলেন, ইসলামি আক্বীদার প্রতি ঈমান আনার পূর্বে তার প্রমাণপঞ্জী সম্বন্ধে গভীর গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে চুলচেরা যাচাই করে নিতে হবে যে, সে গুলো গ্রহণযোগ্য কি না। যাতে দলীলটি বিশ্বাসের অনুগত না হয়ে বিশ্বাসটি দলীলের অনুগত হয়। অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য দলীলাদির ভিত্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, বিশ্বাস স্থাপন করে তা টিকিয়ে রাখার জন্য দলীল অনুসন্ধান করবে না। কেননা, যারা প্রমাণাদির তোয়াক্কা না করে বিশ্বাস স্থাপন করে নেয়, তারা স্বীয় বিশ্বাস পরিপন্থী দলীলাদীর অর্থ বিকৃত করে তার অপব্যাখ্যা দিতে দ্বিধাবোধ করে না।
বিশ্বাস স্থাপন করার পর তা টিকিয়ে রাখার জন্যে দলীলাদির অনুসন্ধান করার অনিষ্টসমূহ,
আমরা সকলই প্রত্যক্ষ করে থাকি যে, কিভাবে তারা দুর্বল হাদীসকে সহীহ হাদীস বলে আখ্যায়িত করে থাকে। অথবা দলীলাদির মূল পাঠের এমন অর্থ করার চেষ্টা করে যা দলীলাদি থেকে মোটেও বুঝে আসে না। কিন্তু তারা তাদের (ভ্রান্ত) মতবাদকে প্রমাণ করার জন্যে এ সব করে থাকে। (সম্মনিত গ্রন্থকার বলেন) সম্প্রতি আমি পর্দা ওয়াজিব না হওয়ার উপর লিখিত একটি প্রবন্ধ পড়েছি। তাতে প্রবন্ধকার সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আয়েশা (রা:) কর্তৃক বর্ণনাকৃত হাদীসে উল্লেখিত সাহাবি আবু বকর (রা:) তনয়া আসমা (রা:) পাতলা বস্ত্র পরিধাণ করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়াসাল্লাম) সমীপে আগমন করা এবং রাসূল তাকে লক্ষ্য করে এ নির্দেশ প্রদান করা যে, হে আসমা নারী প্রপ্তবয়স্ক হবার পর মুখমন্ডল ও হাত ব্যতীত তার শরীরের কোনো অংশই অনাবৃত হওয়া উটিত নয়।
এ হাদীসটি উল্লেখ করার পর সে প্রবন্ধকার লিখেছেন, উল্লেখিত হাদীসটি সর্বসম্মত। অর্থাৎ ইমাম বুখারী ও মুসলিম প্রমূখ হাদীস শাস্ত্রবিদগণ এ গাদীসটি বিশুদ্ধ বলে একমত হয়েছেন। অথচ বাস্তবে হাদীসটি সর্বসম্মত হাদীস নয়, তা কিভাবে স্বয়ঙ হাদীসটি বর্ণনাকারী ইমাম আবু-দাউদ (র:) হাদীসটিকে মুরসাল হওয়ার কারণে দুর্বল হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন, এবং এ হাদীসটির বর্ণনা সনদ বর্ণনাকারঅদের ধারাবাহিক তালিকায় এমন একজন গাদীস বর্ননা কারীর নাম উল্লেখ রয়েছে, যাকে ইমাম আহমদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরামগণ দূর্বল বর্ণনাকারী সাব্যস্ত করেছেন। (বিস্তারিত বিবরণ সে হাদীস সংক্রান্ত জওয়াবে উল্লেখিত হয়েছে।) কিন্তু অজ্ঞতা, মুর্খতা ও অন্ধভাবে স্বীয় মতামত পক্ষপাতিত্ব করার দ্বারা মানুষ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়। (সেই পক্ষপাতিত্ব ও মূর্খতার পতন ঘটুক এটাই কামনা করি)
শায়খুল ইসলাম ইবনুল কাইয়িম কতই না সুন্দর বলেছেন:
و تعر من ثوبين من يلبسهما يلقى الردى بمذلة وهوان
ثوب من الجهل المركب فوقه ثوب التعصب بئست الثوبان
و تحل بالإنصاف أفخر حلة زينت بها الأعطاف والكتفان
দু ধরনের কাপড় পরিধান করা হতে নিজেকে মুক্ত করে নাও সেই দুই কাপড় পরিধান করে যে সে লাঞ্চিত, অপমানিত ও ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।
সেই বস্ত্রদ্বয়ের একটি হলো চরম মুর্খতা ও অজ্ঞতা, ২য়টি হলো অন্ধভাবে স্বীয় পক্ষে কঠোর হওয়া, কতই না নিকৃষ্ট এ বস্ত্রদ্বয়।
ইনসাফ ও ন্যায় পরায়ণতার মত গৌরবান্বিত সাজ-সজ্জার মাধ্যমে নিজেকে সজ্জিত করে নাও। যদ্বারা কাধ ও তৎপার্শ্বস্থও সজ্জিত হয়ে যায়। (সারকথা নিরেট মূর্খতা ও অজ্ঞতা এবং অন্ধভাবে পক্ষপাতিত্বের ন্যায় দুটি কুস্বভাব পরিহার করে ইনসাফ ও ন্যায় পরায়ণতা অবলম্বন করে নিজেকে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য করে নাও)
কোনো গ্রন্থকার ও প্রবন্ধকারকেই প্রমাণাদির চুলচেরা তাহক্বীক ও অনুসন্ধান করতে গিয়ে অলসতার জালে আবদ্ধ হওয়া উচিত নয়। বরং নিগুঢ় তত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া ছাড়া তাড়াহুড়ার মাধ্যমে কোনো উক্তি ও যুক্তি পেশ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। নতুবা তারা ঐ সমস্ত লোকদের দলভুক্ত হবে যাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কঠোর সতর্ক উচ্চারণ করা হয়েছে:
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا لِيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
সুতরাং তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে না জেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত করেন না। ( সূরা আন্আম-১৪৪)
আর এমনও উচিত হবে না যে, প্রমাণাদির অনুসন্ধান ও চুলচেরা তাহক্বীক করতে গিয়ে অলসতার জালে আবদ্ব হবে এবং গ্রহণযোগ্য ও প্রমাণিত দলীলাদিকে হঠকারীতা সূলভ মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। তারা ঐ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللَّهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ
সুতরাং তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে এবং তার কাছে সত্য আসার পর তা অস্বীকার করে? জাহান্নামেই কি কাফিরদের আবাসস্থল নয়? (সূরা জুমার: ৩২)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে হক কে হক বুঝে মেনে চলার এবং বাতিলকে বুঝে শুনে তা হতে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকার তাওফীক দান করেন এবং তারই মনোনীত সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন, তিনিই হচ্ছেন ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহ পরায়ণ।
• মহামান্য শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীনের সঙ্গে পর্দা সংক্রান্ত কতিপয় প্রশ্নোত্তর:
প্রশ্ন:- যদি বলা হয় কোনো কোনো আলেমেদ্বীন কিছু ঘটনা উল্লেখ করে বলেন যে, মহিলারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সামনে মুখমন্ডল উম্মুক্ত রাখত অথচ রাসূল তাতে অসম্মতি প্রকাশ করতেন না। এ জাতীয় ঘটনা দ্বারা তারা প্রমাণ করেন যে নারীর মুখমন্ডল আবৃত করা ওয়াজিব নয়।
একটি হল:-
• সাহাবি জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে উল্লেখিত ঘটনায় তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে ঈদের নামাজে উপস্থিত ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজান ও ইক্বামত ব্যতীত খুৎবা পাঠের পূর্বে নামাজ সমাপন করলেন। অত:পর বেলাল (রা:)-এর উপর ভরদিয়ে দন্ডায়মান হলেন (এবং আগত নারীদেরকে হৃদয়গ্রাহী কিছু উপদেশ দিয়ে বললেন, তোমরা অধিক হারে জাহান্নামের জ্বালানী হবে। ইত:মধ্যে কালো বর্ণের চেহারা বিশিষ্ট জনৈকা মহিলা দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন) ... (যাতে বুঝা যায় মহিলাটির চেহারা খোলা ছিল)
মাননীয় শায়খ, এর উত্তর কি?
উত্তর: এর উত্তর এভাবে দেওয়া যাবে যে, পর্দা সম্পকির্ত বিষয়টির দুই অবস্থা। পূর্ববর্তী অবস্থা হচ্ছে পর পুরুষের সামনে নারীর জন্যে চেহারা খোলা রাখা বৈধ ছিল।
আর পরবর্তী অবস্থা হচ্ছে, পর পুরুষের সম্মূখে মহিলাদের মুখন্ডল উম্মুক্ত রাখা দিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেননা, পর্দার অপরিহার্যতা সংক্রান্ত বিধান অবতীর্ণ হয়েছে হিজরী ৫ম সনে। কাজেই নারীর মুখমন্ডল খোলা রাখার বৈধতা সম্পর্কিত হাদীসসমূহকে রহিত হওয়ার পূর্বের অবস্থার উপর প্রয়োগ করা হবে।
আর যে সমস্ত হাদীসের বাহ্যিক পাঠে নারীর চেহারা খোলা রাখার বৈধতা বুঝা যায় এবং হাদীসগুলো মুখমন্ডল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত সংবলিত বিধান রহিত হওয়ার পরের হাদীস বলে বিবেচিত হবে, সে সমস্ত হাদীস কোনো বিশেষ অবস্থা বা বিশেষ ঘটনার উপর প্রয়োগ করা হবে। হয়ত সে সব অবস্থায় এমন বাধা-বিপত্তি ছিল যা পর্দার কিংবা নারীর জন্যে পর্দা বাধ্যতামূলক করার প্রতিবন্ধক। সুতরাং, এ ধরনের সন্দেহযুক্ত গুটি কয়েকটি হাদীসের কারণে সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীসসমূহ (বাস্তবায়নে) পরিত্যক্ত হবে না।
কেননা, সন্দেহযুক্ত বিষয়ের অনুকরণ করে সুস্পষ্ট বিষয়কে পরিত্যাগ করা ইসলামি জ্ঞানে জ্ঞানবান ব্যক্তি-বর্গের কর্মনীতি নয়। বস্তুত: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় প্রজ্ঞা দ্বারা নিজ কিতাবে ও তাঁর রাসূলের হাদীসে কিছু নস সুস্পষ্ট আর কিছু নস রূপক সাব্যস্ত করেছেন। যাতে করে যে ব্যক্তি সুস্পষ্ট প্রমাণ মেনে (কল্যাণময়) জীবন পেতে চায় সে যেন জীবন প্রাপ্ত হয়। নি:সন্দেহে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গ উপলব্ধি করবেন যে, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, নারীর মুখমন্ডল খোলা রাখা বৈধ। তাহলেও আমাদের এই ফ্যাসাদপূর্ণ ও উদাসীনতার যুগে নারীর চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব সাব্যস্ত হবে। কেননা, আজ পযর্ন্ত কোনো একজন আলেমও নারীর মুখমন্ডল খোলা রাখা ওয়াজিব বলে উক্তি করেননি। হ্যাঁ এতটুকু সত্য যে, ওলামায়ে কেরাম চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব কি ওয়াজিব নয় এ ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। আর তাতে এতটুকুই সাব্যস্ত হতে পারে যে চেহারা খোলা রাখা জায়েয়। অনর্থ ও অনিষ্টের ছিদ্রপথ বন্ধ করার ন্যায় পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামি নীতিমালার দৃষ্টিতে জায়েয বিষয়াদিতে যখন ফিৎনা, ফাসাদ ও অনিষ্টের আশংকা থাকে, তখন সেসব জায়েয বিষয়াদি থেকে বিরত থাকা অপরির্হায হয়ে পড়ে। (কাজেই বর্তমানে নারীর চেহারা খোলা রাখার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে আবৃত রাখা ওয়াজিব হওয়ার মতবাদ গ্রহণ করাই যুক্তি সম্মত ও শরয়ি নীতিমালার অনুকূল।)
নারীর মুখমন্ডল খোলা রাখার সিদ্ধান্তে নারী পুরুষের মিশ্রণ ও অবাধ মেলা মেশা করার পথ উম্মোচিত হতে বাধ্য। এর প্রমাণ ভোগবাদী লোকদের পর্দা সংক্রান্ত বিষয়ে হঠকারিতা ও জিদের আশ্রয় গ্রহণ। অথচ চেহারা খোলা রাখা সম্পর্কিত বিষয়ের চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও জনকল্যাণ মূলক অনেক বিষয় রয়েছে, সেসব বিষয়ে তাদেরকে যুক্তি পেশ করতে খুব একটা দেখা যায় না। অথচ এসব বিষয়ে যুক্তি পেশ করা বেশি জরুরি। অত:পর আমরা বলব চেহারা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে সব শহরে মহিলারা বেপর্দা চলাফেরা করে, সেসব শহরে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখুন। তারা কি শুধুমাত্র নিজেদের চেহারাই খোলা রাখে? নাকি চেহারার সাথে সাথে গলা, গ্রীবাদেশ, হাত, বাহু, পা, গোছা ইত্যাদিও খোলা রাখে। এবং সতর উন্মুক্ত করে আল্লাহর আদেশের অসম্মান করে।
প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবগের্র কর্তব্য হচ্ছে, যে কোনো বিষয়ের প্রতিক্রিয়া ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এবং কল্যাণ ও অকল্যাণ সব দিক গবেষণা করেই বিধি নিষেধ আরোপ করে। বস্তুত: প্রশংসা কেবল আল্লাহরই জন্য। নি:সন্দেহে, ইসলামি শরিয়ত সুপ্রশস্ত, সংকীর্ণ নয়। তাতে এমন মূলনীতিই সন্নিবেশিত রয়েছে যা বাস্তবায়নে অনিষ্টের মূলোৎপাটন সুনিশ্চিত ।
প্রশ্ন: মহান শায়খ! আপনি জবাবে উল্লেখ করেছেন, পর্দা সংক্রান্ত বিধান অবতীর্ণ হয়েছে ৫ম হিজরীতে। এটা কি সর্বসম্মত মত? এদিকে আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ:) উল্লেখ করেছেন, পর্দার আয়াত তৃতীয় কিংবা পঞ্চম হিজরীতে অবতীর্ণ হয়েছে।
উত্তর: প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়েছে হিজরী ৫ম সনে। আর যদি আল্লামা ইবনুল কাইয়িমের (রহ.) মত বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়, তাহলে বঝতে হবে যে, পর্দার দুটি অবস্থা রয়েছে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী। যে সব হাদীসের বাহ্যিক অর্থ মুখমন্ডল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত বুঝায় সেসব হাদীস পর্দা ওয়াজিব হওয়ার পূর্বের বলে বুঝতে হবে।
প্রশ্ন: মাননীয় শায়খ! যদি কেউ বলে, আমরা জাবের কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে উল্লেখিত ঘটনাটি পর্দা ফরজ হওয়ার পরের ঘটনা বলে প্রমাণ করতে পারব। তাহলে উত্তর কি হবে?
উত্তর: তুমি জাবের রা. বর্ণিত হাদীসে উল্লেখিত ঘটনার প্রতি ইংগিত করছ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন নারী সম্প্রদায়কে উপদেশ দান করে বলেছিলেন, তোমাদের বেশিরভাগ অংশই হচ্ছে জাহান্নামের জ্বালানী বা ইন্ধন। এরই মধ্যে কৃষ্ণকায় এক নারী দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো: কেন? হে আল্লাহর রাসূল।...
আমার বিশ্বাস, তুমি ঘটনাটিকে পর্দা ওয়াজিব হওয়ার পরের ঘটনা বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হবে না। আর যদি সাব্যস্ত হয়ও, তাতেও সমস্যা নেই কারণ
(ক) ঐ নারী কালো চেহারা বিশিষ্ট ও বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। আর বৃদ্ধা নারীর চেহারা খোলা রাখা নাজায়েয নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন:
وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ
আর বৃদ্ধা নারীরা, যারা বিয়ের প্রত্যাশা করে না, তাদের জন্য কোন দোষ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের কিছু পোশাক খুলে রাখে। (সূরা নূল-৬০)
(খ) অথবা, হয়ত নারীর ওড়না চেহারা থেকে পড়ে গিয়েছিল আর তখনই হাদীস বর্ণনাকারীর দৃষ্টি তার প্রতি পতিত হয়। কিংবা তিনি চিরসত্য রাসূলের মুখে জাহান্নামের জ্বালানীতে পরিণত হওয়ার কথা শুনে জ্ঞানহারা হয়ে গিয়েছিলেন। এমনটি হওয়া আল্লাহভীরু সাহাবিদের পক্ষে বিচিত্র কোনো ঘটনা নয়। অনন্তর সন্বিত ফিরে পেয়েই ওড়নাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে এনে মুখমন্ডল আবৃত করে ফেলেছিলেন।
(গ) হয়ত এটি একটি বিশেষ ঘটনা, যার কারণে তাতে চেহারা খোলা থাকার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিন্তু পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরও চেহারা খোলা রাখার এমন ঘটনা সুস্পষ্ট হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যেমন জনৈকা নারী বিদায় হজ্জের দিন মুজদালিফা হতে মিনা যাওয়ার পথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন আব্বাস (রা:) তনয় ফজল রাসূলের সওয়ারীর পেছনে উপবিষ্ট ছিলেন, ফজল তার দিকে তাকাচ্ছিলেন অনুরূপ সেই নারীও, আর রাসূল হাত দিয়ে ফজলের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন... (আল-হাদীস)
আমি বলব, নি:সন্দেহে এই ঘটনাটি বিশেষ ঘটনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। যার বিশেষ অবস্থা রয়েছে। যেমন বলা যায় যে, এহরাম অবস্থায় নারীর জন্যে পর পুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখা ইসলামি শরিয়ত মতে জায়েয। আর তিনি সেটিই মান্য করেছেন।
হয়ত তিনি পর্দা ও তার অপরিহার্যতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, আর যেহেতু তিনি মাসআলা জিজ্ঞাসা করছিলেন তাই নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চেহারা খোলা রাখার মত অপছন্দনীয় কাজে নারাজি প্রকাশ করতে তাড়াহুড়া করেননি। বরং তিনি ফজলের চেহারাকে অন্য দিকে ফিরিয়ে দিলেন। আর হাদীসে এমনটি উল্লেখ নেই যে রাসূল তার প্রশ্নের জওয়াব দেওয়ার পর পর্দা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে শিক্ষা দেননি। কারণ, কোন বস্তুর বর্ণনা না থাকাতে এমনটি অপরিহার্য হয়ে পড়ে না যে বস্তুটির অস্তিত্বই নেই। (রাসূলের চিরায়ত নিয়মে ধারণা করা যায় যে তিনি পরবর্তীতে তাকে পর্দা ওয়াজিব হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।)
এদিকে রাসূলুল্লাহর ফজলের চেহারাকে ফিরিয়ে দেওয়ায় একথা প্রমাণিত হয় যে, ফিৎনার উপকরণ থেকে বেচে থাকা বাঞ্ছনীয়। সন্দেহ নেই, বর্তমান যুগে নারীর চেহারা খোলা রাখা ফেতনা-ফ্যাসাদ, মানহানি, অপমান ও লজ্জাহীনতার একটি বৃহৎ কারণ।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, -আল্লাহ আপনাকে বরকতময় জীবন দান করুন- নারীর মুখমন্ডল উম্মুক্ত রাখা এবং বিদ্যালয়, কর্মশালা ইত্যাদিতে পুরুষের সাথে তাদের অবাধ মেলামেশার প্রতি আহ্বানকারী ভোগবাদী সম্প্রদায় সম্পর্কে জানবেন যে, নারীর জন্য মর্যাদা হানিকর সংষ্কৃতি ও ইসলামি রাষ্ট্রে বিজাতীয় সংষ্কৃতির অনুপ্রবেশের কারণে যেই বিপর্যয় ও ফ্যাসাদ দেখা দিবে সে সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ। এই দরজা ব্যবহার করে তারা বিজাতীয় সব চাল চলনের অনুশীলন করে যা অনাবৃত রাখা শরিয়তের সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে ফরজ তাও খুলে বের হবে। যেমন বুক, গ্রীবাদেশ, বাহু ইত্যাদি। অনুরূপভাবে চেহারা অনাবৃত রাখার সুযোগ পেলে এমনসব প্রসাধনী ব্যবহার করে বের হবে যার মাধ্যমে পর পুরুষ আকৃষ্ট হয়ে অঘটন ঘটাতে পারে। এটি কিন্তু কল্পনা প্রসূত কোনো দর্শন নয় বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাই ইসলামি শরিয়তের তাকাজা সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে তারা নিশ্চয় একমত হবেন যে চেহারা অনাবৃত রাখা যদি জায়েযও হতো তা সত্ত্বেও বর্তমান অবস্থার কারণে তা অনাবৃত রাখা ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টিই অধিক যুক্তিযুক্ত হবে।
এ কারণেই ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমর বিন খাত্তাব (রা:) যখন দেখলেন, অধিক হারে মানুষ মদ্যপানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তাই তিনি তার শাস্তি ৪০ বেত্রাঘাত হতে বৃদ্ধি করে ৮০ বেত্রাঘাত পর্যন্ত উন্নীত করলেন। অনুরূপভাবে তিনি যখন দেখলেন, মানুষ নিজ স্ত্রীকে পরপর এক সাথে তিন তালাক দেয়ার নিয়ম শুরু করল, অর্থাৎ মানুষ একসাথে তিন তালাকের বহুল প্রচলন করল। তখন তিনি তিন তালাক দেওয়ার পর তা প্রত্যাহার করে আবারো স্ত্রীকে গ্রহণ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। বললেন তিন তালাক দেয়ার পর কেউ এই স্ত্রীকে আর গ্রহণ করতে পারবে না। সেই তিন তালাক যদি একসাথেও হয়।
হে পাঠকবৃন্দ! চিন্তা করে দেখুন, রাসূলের যুগে এবং ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকরের (রা:) দুই বৎসর শাসনামলে স্ত্রীকে তিন তালাক দিলে এক তালাকই পতিত হত, যাতে প্রত্যাবর্তন করা যেত। কিন্তু ওমর বিন খাত্তাব (রা:) এক্ষেত্রে অধিকার থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাবর্তনের রাস্তা কিভাবে রহিত করে দিলেন। তিনি এটি করেছেন মানবতাকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য। তাদেরকে বিনষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য।
সুতরাং মুসলিম তরুণদের অবশ্য কর্তব্য যে, তারা যেন শরিয়ত সম্মত জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রতিটি বিষয় পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করে। কেননা, প্রথমত: সূচনাতে অনিষ্ট একেবারেই নগণ্য ও তুচ্ছ হিসেবে প্রকাশ পায়, এমনকি লোকে বলে যে, এটা কোন বিষয়ই নয় কিন্তু যখন ক্রমান্বয়ে প্রসারতা লাভ করে ও চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে তখন তা প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে যায়। আর তখন সেটি হারম ও অবৈধ হবার ব্যাপারে আর কারো সন্দেহ থাকে না। কিন্তু তাতেতো আর তখন কোনো কাজ হয় না।
শাইখ মুহাম্মাদ আমীন আশ-শ্বানক্বীতি (রহ:) তার আযওয়াউল বয়ান নামক তাফসীর গ্রন্থে সূরা আহযাবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নারীর জন্যে পর পুরুষের সামনে নারী দেহের সর্বাঙ্গ আবৃত করার দলীলাদি উপস্থাপন করার পর উল্লেখ করনে যে, যারা (মহিলারা পর পুরুষ সমীপে নিজেদের রূপ-যৌবন প্রদর্শন করে চলাফেরা ও মেলা মেশা করার প্রতি আহবানকারী ভোগবাদী সম্প্রদায়) বর্তমানে মুসলিম নারীদেরকে পবিত্রতা ও মান-মর্যাদার নিরাপত্তা সন্নিবেশিত আসমানী শিষ্টাচারে রাসূলের পূণ্যবতী পত্নীদের অনুকরণ করার নিষিদ্ধতার ইচ্ছা পোষণ করে তারা ব্যধিগ্রস্ত অন্তর বিশিষ্ট উম্মতে মুহাম্মদীকে আচ্ছন্ন করেছে।
(আযওয়াউল বয়ান গ্রন্থটি অধ্যায়ন করার জন্য আমি সকল পাঠককে বিনীত অনুরোধ করছি)
প্রশ্ন: হে শায়খ! যদি কেউ বলে, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে প্রতীয়মান হয় যে, যে, মহিলার প্রতি দৃষ্টিপাত করা পুরুষের জন্য বড় ফিৎনা বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সম্যক উপলব্ধি করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সেই নারীকে মুখমন্ডল আবৃত করার নির্দেশ দেননি।
উত্তর: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষটির চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছেন। যার মাধ্যমে প্রমাণ হয়, নারীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার ব্যাপারে রাসূল সম্মতি প্রকাশ করেননি। বরং তিনি অসম্মতই ছিলেন। আর হজ্জের ইহরাম অবস্থায় থাকার কারণে মহিলার জন্য চেহারা খোলা রাখা শরিয়ত সম্মত ছিল। আর এ কারণে ইমাম নববী (রহ:) এ হাদীস দ্বারা দলীল উপস্থাপন করেন যে, পর নারী দর্শন হারাম। কেননা, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজলের চেহারা ফিরিয়ে দিয়ে ছিলেন। পুরুষের পক্ষে মহিলার চেহারার দিকে তাকানো হারাম। এটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বিষয়টি একেবারিই সুস্পষ্ট।
প্রশ্ন- বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ ইবনে হজর আসক্বালানী (রহ:) অনুসন্ধান করে বের করেছেন যে এটি এহরাম থেকে হালাল হওয়ার পরের ঘটনা অর্থাৎ মহিলাটি তখন ইহরাম অবস্থায় ছিলেন না। তাহলে এটার কি উত্তর হবে?
উত্তর: এটি ঠিক নয়, কারণ তিনি মুযদালিফা থেকে মিনা যাওয়ার পথেই রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এখন আমরা কিভাবে বলব যে তিনি ইহরাম থেকে হালাল হয়েছিলেন, রমীর পর (কংকর নিক্ষেপ করা) মাথা মুন্ডন করা কিংবা চুল ছোট করা ব্যতীত প্রথম হালাল হওয়া যায় না। তাহলে তিনি কিভাবে হালাল হয়েছিলেন?
প্রশ্ন- এখন প্রশ্ন হতে পারে, ইহরাম অবস্থায় নারীর জন্যে চেহারা আবৃত করা জায়েয, তাহলে তিনি চেহারা খোলা রেখেছিলেন কিভাবে?
উত্তর:- হ্যাঁ এটা ঠিক, বরং নারীর কাছ দিয়ে পুরুষ পথ অতিক্রম করলে তখন চেহারা আবৃত করা ওয়াজিব। এবার আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি নিশ্চিত যে সেই নারীর পাশে কোনো পুরুষ ছিল? এমনওতো হতে পারে তিনি পেছন অথবা সামনের দিকে থেকে রাসূলের সাথে কথা বলেছেন, পাশে এমন কোনো পুরুষ ছিলনা যাদের সম্মুখে চেহারা আবৃত করা ওয়াজিব। আর ফজল বিন আব্বাসের ঘটনা দ্বারা চেহারা অনাবৃত রাখার বৈধতার ব্যাপারে দলিল হতে পারে না, কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে দৃষ্টি দেয়ার সুযোগই দেননি। বরং চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
আমি আপনাকে বলব, এ বিষয়ে আরো বিশদভাবে জানার জন্য শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ রহ.-এর ফতওয়া ও ‘হিজাবুল মারআতি ওয়া লিবাসুহা ফিসসালাহ’ নামক বইটি পড়ুন। তাছাড়া শায়খ আমীন আশ শানক্বীতির আজওয়াউল বয়ান দেখার জন্যতো আগেই বলেছি।
প্রশ্ন- বর্তমান যুগটি ফেতনা-ফাসাদের যুগ, যদি কেউ প্রশ্ন করে যে এটি ফেতনার যুগ কথা ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে পর্দা বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান কি? ওয়াজিব নাকি ওয়াজিব নয়?
উত্তর:- আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধান হচ্ছে, যদি কোন বস্তু ফেতনা ও অনিষ্টির কারণ হয় তাহলে তা হারাম ও অবৈধ হবে। যেমন মুশরিকদের মাবুদদেরকে গালি দেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখা যাক। তাদের গালি দেওয়া হারাম না হালাল নাকি ওয়াজিব? আমরাতো ওয়াজিব বলেই জানি। তবে হ্যাঁ, যদি তা ফেতনা ও অনিষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা ওয়াজিবতো দূরের কথা বরং হারাম সাব্যস্ত হবে। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ
“আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত”। (সূরা আনআম: ১০৮)
কাবা গৃহের নির্মাণ ইবরাহীমি নির্মাণের অনুরূপ পুনরায় নির্মান করার ব্যাপারটি দেখুন। এটা কি শরিয়ত সম্মত নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করতেও চেয়েছিলেন কিন্তু ফেতনার আশংকায় বিরত থাকলেন। আয়েশা রা.- কে বলেন, যদি তোমার সম্প্রদায় নও মুসলিম না হতো তাহলে আমি কাবা গৃহকে ভেঙ্গে ইবরাহীমি কাঠামোর অনুরূপ করে নির্মান করতাম। কাঙ্খিত বিষয়ে যদি ফেতনার আশংকা থাকে তবে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এবার আমি বলব, নারীর চেহারা অনাবৃত রাখার মাঝে ফেতনার আশংকা বিদ্যমান, এখন অনাবৃত রাখা যদি শরিয়তসিদ্ধ হয়ও তাহলেও সেই আশংকার বিদ্যমানতায় সিদ্ধ বিষয়টি আর সিদ্ধ থাকতে পারে না।
আর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা:) স্ত্রীকে তিন তালাক দেওয়ার পর ফিরিয়ে আনতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কারো অজানা নয় যে, স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর প্রত্যাহার করা কাঙ্খিত বিষয়। বিশেষ করে স্ত্রীর যদি সন্তনাদি থাকে। তা সত্ত্বেও তিনি তিন তালাকের বহুল প্রচলন বন্ধ করার জন্যে প্রত্যাহারের নিষেধাজ্ঞা জারী করেন।
প্রশ্ন: যদি প্রশ্ন করা হয়, স্বীকার করলাম ফেতনা বিদ্যমান থাকলে পর্দা ওয়াজিব। কিন্তু যদি ফেতনার আশংকা না থাকে (তখনকার বিধান কি হবে ?)
উত্তর: আমরা বলব এটি একটি কাল্পনিক বিষয়। যদি বাস্তবে এমনটি সম্ভব হয় তাহলে সেটি হবে এক অভিনব ব্যাপার। যা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থায় ও নির্ধারিত পরিসরে হতে পারে। কিন্তু ব্যাপক পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় আনলে নিশ্চিতভাবে আমরা জানব যে, নারীরা চেহারা খোলা রেখে হাট বাজারে পর পুরুষের সম্মুখে বের হলে, তাতে ফেতনা সৃষ্টি হওয়া সুনিশ্চিত। আর যারা চেহারা খোলার রাখার ব্যাপারে জেদ ধরেন তাদের জানা উচিত যে এটি এমন একটি বিষয় যার অপরিহার্যতা সম্পর্কে কোনো আলেম অভিমত প্রকাশ করেননি। বাস্তবে আমরা দেখতে পাই সেবব লোকদের অনেকেই শরিয়তের অনেক ওয়াজিব ও অপরিহর্য বিষয়ে উদাসীন। তাহলে চেহারা আবৃত রাখার বিষয়টিতে এত জেদ করার কারণ কি ? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই যে, আবৃত রাখার অপরিহার্যতার কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা চেহারা আবৃত রাখা ও খোলা রাখা, এই দুটির কোনটি পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা হওয়ার নকটবর্তী? স্বভাবত: আবৃত রাখাই হবে পবিত্রতার নিকটতর। যদি চেহারা আবৃত করাই শ্রেয় হয়ে থাকে, তাহলে কেন আমরা নারী মুক্তির দাবীদার হয়ে ইসলামি সংবিধানের মূল পাঠ সমূহে বিকৃতি সাধন করব? আমাদের মত হল, ভোগবাদীদের কথায় ধোকা না খেয়ে এ বিষয়ে অটল থাকুন। কেননা, আপনি তাদের কথা ও কাজে চিন্তা-ভাবনা করলে দেখবেন, তারা তাতে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে না এবং নারী ও মানবজাতীর কল্যাণও চায় না। (আল্লাহই ভাল জানেন)
আপনি কি চান যে আপনার মেয়ে বা বোন সেজে গুজে সৌন্দর্য প্রদর্শন করে, কিংবা চেহারা অনাবৃত রেখে হাটে বাজারে পর পুরুষের সম্মুখে বের হবে আর চরিত্রহীন যুবকরা তাদের পিছনে ঘুরে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করবে? যদি আমরা তাদের চেহারা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত পোষণ করি, তাহলে তারা নিজেকে আরো সাজিয়ে বের হবে। কিন্তু আল্লাহ যাদের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ চান তাদের কথা ভিন্ন।
প্রশ্ন: মাননীয় শায়খ এ অভিমত কি পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক?
উত্তর: আমি বলব আপনি কি বলেন? নারীর মুখমন্ডল খোলা রাখার বৈধতার উপর হাদীস ও আয়াতগুলি কি তাই প্রমাণ করে? বিশেষ করে যখন আমরা এর কুফল ও ফেতনা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করছি। বর্তমানে যে সব ইসলামি রাষ্ট্র মূল পাঠের সম্ভাব্য অর্থ অনুসরণ করে চলছে সেসব ইসলামি রাষ্ট্রের নারীদের অবস্থা কি পূর্বের মত রয়েছে? বর্তমানে যে নারীটি পর্দা অবলম্বন করে সে নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয় বরং তাকে নিজ দেশে তার নাগরিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
প্রশ্ন:- এমন দৃষ্টান্ত কি পাওয়া যাবে যে সাহাবি ও নির্ভরযোগ্য তাবেয়ীনদের যুগে তারা দলীলাদির আলোকে দ্বীন ইসলামের নীতিমালা পেশ করেছেন।
উত্তর : হ্যাঁ, এ বিষয়ে পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতে বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। পবিত্র কোরআন হতে দৃষ্টান্ত :
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ
“আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত”। (সূরা আনআম: ১০৮)
হাদীস শরীফ হতে দৃষ্টান্ত:
لو لا أن قومك حديثو عهد بكفر لبنيت الكعبة على قواعد إبراهيم
আয়েশা (রা:)-কে সম্বোধন করে রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যদি তোমার সম্প্রদায় নও মুসলিম না হত, তাহলে আমি কাবা গৃহকে ইবরাহীমি ভিত্তির উপর পুণ:নির্মাণ করতাম”
মুশরিকদের বাতিল উপাস্যদের গালি দেয়া ওয়জিব। আর কাবা গৃহকে ইবরাহীমি ভিত্তির উপর পুণ:নির্মাণ করা ওয়াজিব নিদেনপক্ষে মুস্তাহাব। রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ বিষয়ে পতিত হওয়ার আশংকায় এই বাঞ্চিত কাজটি পরিত্যাগ করেছেন। আর পরপুরুষেরে সামনে নারীর মুখমন্ডল খোলা রাখা ওয়াজিব কিংবা মুস্তাহাব এমন কথা আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি। এমনকি যারা মহিলার চেহারা খোলা রাখার পক্ষপাতি তারাও এমনটি বলেননি। তারা শুধু এতটুকু বলেছেন যে তা জায়েয। সুতরাং যেখানে ফেতনায় ভয়ে ওয়াজিবকে বর্জন করা হল। সেখানে ফেতনার আশংকা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় জায়েয কাজকে কিভাবে প্রাধান্য দেওয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে?
• খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল হতে দৃষ্টান্ত
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব রা. স্ত্রীকে তিন ত্বালাক দেওয়া হারাম হওয়া সত্ত্বেও প্রাবল্য দেখে তিন ত্বালাক প্রাপ্তা স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কেননা, মানুষ তার আত্মমর্যাদার বিষয়ে অতি তৎপরতা পোষণ করে, আর নারী কখনও কখনও সন্তান বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও মানুষকে অবৈধ ত্বালাক থেকে প্রতিহত করেন। আমরা কি ওমর বিন খাত্তাব রা. এর চাইতে অধিক প্রজ্ঞাভিত্তিক নীতিবিদ সংস্কারক ? কখনও না।
প্রশ্ন : হক্বপন্থী উলামায়ে কেরাম পর্দা বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করেন যে, ফেতনার কারণে বর্তমানে পর্দালম্বন করা ওয়াজিব। সাধারণ অবস্থায় সুন্নত এবং উম্মতজননী রাসূল পত্নীগণের পছন্দনীয় কর্ম। তারা আরো বলেন, উত্তম হল চোহারা আবৃত করা। কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব নাকি উত্তম কর্মের অন্তর্ভুক্ত?
উত্তর : আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিফল দান করুন, আমি বলব (চেহারা আবৃত করা) অতি উত্তম। তাহলে তারা কেন এই ফেতনা ফাসাদের যুগে মানুষের জন্যে ফেতনার পথ উম্মোচন করেন? তারা উত্তরে বলতে পারে যে, এটি পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক আলোচনা।
এটি ভাল কিন্তু তারা নিষ্পাপ নন। তাছাড়া এ বিষয়ে অন্যান্য হক্বানী আলেমগণ তাদের বিপরীত মত পোষণ করেছেন। শায়খ মুহাম্মদ আমীন আশ্ শ্বানক্বীতির তাফসীরে বর্ণিত তার অভিমত শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহর অভিমত এবং শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বাযের অভিমত এক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে। তারা যদি আমাদের সাথে ওলামাদের বক্তব্য দিয়ে মুকাবলা করে তবে আমরাও ওলামাদের বক্তব্য দিয়ে তাদের মুকাবিলা করবো। আর যদি তারা নুসূস বা উদ্ধৃতির মাধ্যমে মুকাবালা করে তাহলে আমরাও নুসূস বা উদ্ধুতির মাধ্যমে মুকাবালা করব।
এতে আমরা একমত যে, চেহারা খোলা রাখা নারীর জন্যে ইসলামি শরিয়ত সম্মতও নয় বাঞ্চিতও নয়। তাহলে আমরা যখন প্রত্যক্ষ করি যে এর কারণে অবস্থা অধিকতর অনিষ্টের দিকে চলে যাচ্ছে তখন কেমন করে এমন মত পোষণ করব যে, নারীর জন্যে চেহারা খোলা রাখা জায়েয। অথচ এটি ভিষণ ফেতনা। বর্তমানে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ফয়সালাও এটিই।
প্রশ্ন : যদি তারা বলে, হে মাননীয় শায়খ! আপনারা বলেন, নারীর চেহারা খোলা রাখা জায়েয তবে ঢেকে রাখা হল উত্তম। এতে আপনরা মতামত কি ?
উত্তর : আমরা জায়েয বলি না। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনায় বুঝা যায় এটা হারাম। তারা নুসূস থেকে জায়েয বুঝতে পারে কিন্তু আমরা বুঝেছি হারাম।
তাদরে কথা দ্বারা আমাদেরকে বাধ্য করা এবং আমাদরে কথা দ্বারা তাদেরকে বাধ্য করা সম্ভব নয়। আমরা বলব, আমরা ও আপনারা একদিক দিয়ে অভিন্ন মত পোষণ করি, তা হচ্ছে এটি ওয়াজিবও নয়, মুস্তাহাবও নয়। আর যদি এই দুয়ের একটি হয়ে থাকে, তবে আমরা মুসলিমদের সংঘটিত ঘটনা ও ফেতনাধিক্য প্রত্যক্ষ করেছি।
আর যারা চেহারা খোলা রাখার বৈধতার মত পোষণ করেন। এমনকি তাদের দেশের মধ্যেই বিষয়টি সংযত করতে পারেনি বরং অনিষ্টের প্রসারতা লাভ করেছে অধিক পরিমানে। যদি আমাদের নিকট নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কেরাম ফতওয়া দেন যে, নারীর জন্যে চেহারা খোলা রাখা জায়েয। তাহলে ঐ সময়টি অতি নিকটবর্তী যে, মহিলারা তাদের ঘাড় ও মাথা খোলা রেখেই চলাফেরা করতে আরম্ভ করবে। আর যদি পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর মূল পাঠ ও তার বর্ণনাবলীতে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে চান, তাহলে ইসলামি শরিয়ত সম্মত নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য করুন, এবং ঘটনা ও নীতিমালার মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করুন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশ প্রদান করুন এটি হবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, তাহলে আপনি হবেন আলেমে রাব্বানী। কারণ এ বিষয়ে আলেমে নজরী (নুসূসের বাহ্যিক অর্থ পোণষকারী) ও আলেমে রাব্বানী দুটি দল রয়েছে।
আলেমে নজরী : আলেমে নজরী হচ্ছেন, নুসূসের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য উদ্ঘাটনে মূলনীতির পরওয়া না করে কেবল বাহ্যিক অর্থের উপর আমলকারী। বা যারা হাদীসের মূল পাঠ গ্রাহ্য না অগ্রাহ্য, প্রসিদ্ধ না অপ্রসিদ্ধ এদিকে লক্ষ্য না করে কেবল সনদ তথা হাদীস বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিক তালিকার উপর স্থির থাকে।
আলেমে রাব্বানী : যারা মানুষের কল্যাণ উপলব্ধি করে, যদি বৈধ বিষয়াবলী অবৈধ বিষয়াদির দিকে নিয়ে যায় তবে সেসব বৈধ বিষয়ের উপর আমল করতে মানুষকে নিষেধ করেন। আর যদি বৈধ বিষয়াদি ওয়াজিব তথা অপরিহার্য বিষয়াদির প্রতি নিয়ে যায় তাহলে তারা সেসব বৈধ বিষয়াদির উপর আমল করতে বাধ্য করে। ওলামায়ে কেরাম সকলেই একমত যে, একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হচ্ছে মাধ্যম বিষয়াদির কিছু উদ্দেশ্যমূলক বিধান রয়েছে”। আপনারা এ ধরনের বিষয়াদির মাধ্যমে প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকবেন, এটিই আমার ঐকান্তিক চাওয়া। আপনারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত ও আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। কেউ কখনও এতে প্রতারিত হওয়া চলবে না।
• বর্তমান বিশ্বে সুপরিচিত ইসলামি ব্যক্তিত্ব, সাউদী আরবের প্রধান মুফতি, মহামান্য শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. রচিত পর্দা সম্পর্কিত নির্দেশনা হতে সংকলিত ইসলামি পর্দার অপরিহার্যতা সম্পর্কে এক মূল্যবান আলোচনা।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, দরূদ ও সালাম সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার পরিবার পরিজন ও সাহাবাগণের উপর।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নারী সম্প্রদায়কে ফেতনা ফাসাদ থেকে সংযত রাখার জন্যে এবং ফেতনা ফাসাদের উপকরণাদি থেকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআনে নারীদেরকে পর্দা অবলম্বন ও গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের নারীদের মত দেহসৌষ্ঠব ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে ঘুরাফেরা করতে বারণ করেছেন। আরো বারণ করেছেন পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকষর্ণীয় ভঙ্গিতে কথা বলতে। মহান আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এসব বিষয়ে সতর্ক করে ভীতি প্রদর্শন করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا ﴿32﴾ وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآَتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ﴿33﴾
হে নবী-পত্নিগণ, তোমরা অন্য কোনো নারীর মত নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক- জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। [সূরা আহযাব:৩২-৩৩]
লক্ষনীয় : যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলের পূণ্যবতী, পুতঃপবিত্র ও পরিপূর্ণ ঈমান বিশিষ্ট পত্নীগণকে এসব অবাঞ্চিত বস্তু থেকে সতর্ক করেন, তাহলে অন্যান্য নারীদেরকে এসব বিষয়ে সতর্ক করা এবং তাদের দ্বারা ফেতনা ফাসাদের কারণ উপকরণ সংঘটিত হওয়ার আশংকাকরা অধিকভাবে প্রযোজ্য।
মহান আল্লাহ ফেতনা ফাসাদের বিভ্রান্তি থেকে আমি আপনি ও সমগ্র উম্মতকে রক্ষা করুন। আমীন।
উল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত বিধান নবীপত্নী ও অন্যান্য সাধারণ নারীদের বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য বুঝা যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآَتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
“আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর”। (সূরা আহযাব আয়াত: ৩৩)
এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নারীকুলের শ্রেষ্ঠাংশ, নবীপত্নীদের প্রতি পুতঃপবিত্রা হওয়া সত্ত্বেও পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকষর্ণীয় ভঙ্গিতে বাক্যলাপ করার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। যাতে ব্যধিগ্রস্ত অন্তর বিশিষ্ট লোকেরা তাদের সাথে যিনা-ব্যভিচারের কু-লালসা না করতে পারে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করর এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ দান করেছেন।
কারণ, এ তিনটি হিদায়াত নবীপত্নীগণের জন্যে নির্দিষ্ট নয় বরং সমগ্র নারী জাতির জন্যে ব্যাপক। (এছাড়া পর্দা সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী হিদায়াতদ্বয়। সেগুলোও কেবল নবী পত্নীগণের জন্যে নির্দিষ্ট নয়। বরং মুসলিম নারীকুলের প্রতিও একই বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য। সামান্য চিন্তা করলেই বিষয়টি প্রতিভাত হয় একান্ত স্পষ্টভাবে।)
মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ
“তোমরা তাদের (নবী পত্নীগণের) কাছে কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল থেকে চাইবে, এটা তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ”। (সূরা আহযাব: ৫৩)
এ আয়াতে নারীদের জন্যে পরপুরুষের সমীপে পর্দার অপরিহার্যতা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে এবং পর্দার এ বিধান পুরুষ ও নারী উভয়ের অন্তরকে মানসিক কুমন্ত্রণা থেকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে, এবং আল্লাহ রাব্বুল আলমীন ইংগিত দিচ্ছেন যে, নগ্নতা ও পর্দাহীনতা হচ্ছে নোংরামী ও অপবিত্রতা। আর পর্দার অন্তরালে থাকা হচ্ছে প্রশান্তি ও পবিত্রতা।
হে মুসলিম জাতী ! আল্লাহ কর্তৃক শিষ্টাচারে শিষ্টাচারী হও, আল্লাহর বিধানের অনুকরণ কর এবং তোমাদের নারীদেরকে পর্দার অন্তরালে থাকতে বাধ্য কর। এটিই হচ্ছে পবিত্রতা, প্রশান্তি ও পরিত্রাণের উপায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ وَأَنْ يَسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ لَهُنَّ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
বৃদ্ধা নারী যারা বিয়ের আশা রাখেনা যদি তারা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের বস্ত্র খুলে রাখে, তাদের জন্যে দোষ নাই। তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্যে উত্তম, আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। ( সুরা নূর- ৬০)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা দিচ্ছেন যে, বৃদ্ধা নারী যে বিয়ের আশা রাখে না, যার প্রতি কেউ আকর্ষণ বোধ করেনা এবং সে বিবাহের যোগ্যও নয়, যদি সে সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাহলে তার জন্যে পরপুরুষের মুখমন্ডল ও হাত অনাবৃত রাখার অনুমতি রয়েছে বা সেগুলো খুলতে পারবে। তাতে কোনো দোষ নেই।
এতে প্রতীয়মান হল যে, সাজ-সজ্জা করে সৌন্দর্য প্রর্দশনের উদ্দেশ্যে বৃদ্ধা নারীর জন্যেও মুখমন্ডল, হাত ইত্যাদি পর পুরুষের সামনে খোলা রাখা বৈধ নয়।
(ক) কেননা প্রত্যেক পতিত বস্তুর জন্যে আরোহনকারী রয়েছে,
(খ) নারীর রূপ-যৌবন প্রদর্শন করে ঘুরা ফেরার ন্যায় অনাকাঙ্খিত কাজটি, সাজ-সজ্জা করে সৌন্দর্য প্রদশনকারিনীকে ফেতনার প্রতি ধাবিত করে। যদিও রূপ যৌবন প্রদর্শন কারিনী বৃদ্ধা নারী হয়। একটু চিন্তা করুন। তাহলে তরুণী নারী যদি সাজ-সজ্জা করত: রূপ যৌবন প্রদর্শন করে পৌরুষদীপ্ত যুবক সমীপে ঘুরে বেড়ায় তখন অবস্থাটা কেমন হবে? বলাবাহুল্য এতে যুবতীর হবে মহাপাপ। আর তাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হবে বৃহৎ ফেতনা ফাসাদ।
আল্লাহ সুবহানাহু ও তাআলা বৃদ্ধা নারীর বেলায় শর্তারোপ করেছেন যে, যে নারী বিয়ের আশা রাখে না, তা এ জন্যে যে স্বামীর অন্তরে উপভোগ ও আকর্ষণের উদ্রেক করার জন্যে তার বিয়ের আশা থাকার ন্যায় মনোভাবটি তাকে সুসজ্জিত করণ ও সাজ-সজ্জা করে রূপ যৌবন প্রদর্শন করতে উৎসাহিত করে। তাই বিয়ের আশান্বিতা বৃদ্ধা মহিলা ও নারীকুলকে ফেতনা থেকে সংরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে তাদের সাজ-সজ্জার স্থান (মুখমন্ডল, হাত ইত্যাদি) হতে বস্ত্র খুলে রাখার নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বৃদ্ধা নারীকে (আয়াতে বর্ণিত দুটি শর্তাধীনে বস্ত্র খুলে রাখার অনুমতি দেয়া সত্ত্বেও) তা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করে সুস্পষ্ট বর্ণনা করেছেন যে, সে যদি পর পুরুষ সমীপে আসতে পুরোপুরি বিরত থাকে তবে তা তার জন্যে উত্তম।
এতে প্রতীয়মান হয়, নারীকুল পর্দার অন্তরালে থাকা এবং বস্ত্রের দ্বারা সর্বাঙ্গ আবৃত করত: লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অনুমতি থাকা সত্ত্বেও বস্ত্র খুলে রাখার চাইতে অধিক উত্তম। নারী যদিও বৃদ্ধাই হোক না কেন। আর তরুণী যুবতীদের জন্যে পর্দার অন্তরালে থাকা ও সৌন্দর্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা অধিকভাবে অপরিহার্য হবে। এবং তা তাদেরকে ফেতনার উপকরণ থেকে দূরে থাকার উপায় হবে।
আর এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, নারীকুলের জন্যে দেহ সৌষ্ঠব ও রূপ যৌবন প্রদর্শন করে ঘুরাফেরা করা হারাম ও অবৈধ।
প্রকাশ থাকে যে, বর্তমান যুগের নারীরা সাজ-সজ্জার স্থান (তথা মুখমন্ডল, হাত, গ্রীবা, বক্ষদেশ, পা ইত্যাদি) প্রকাশ করতে ও দেহ সৌষ্ঠব প্রদর্শনে যে, সীমাতিরিক্ত শিথিলতা অবলম্বন করছে, এতে অনাচার ব্যভিচার ফেতনা ফাসাদের প্রতি ধাবিত করে এমন উপকরণের ছিদ্রপথ বন্ধ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আল্লাহ আমাকে আপনাকে এবং সমগ্র উম্মতকে তাকওয়া ও পরকালীন চিন্তার ন্যায় অমূল্য সম্পদ দান করে ফেতনা ফাসাদের উপায় উপকরণ থেকে যথাযথ ভাবে সংযত থাকার তাওফীক দান করেন।)
আমীন।
পর্দা কেন
পর্দার রয়েছে মৌলিক ছয়টি স্তম্ভ যার ভিত্তিতে পর্দার অপরিহার্যতা সাব্যস্ত হয়, তা নিম্নরূপ:
(১) আল-ঈমান: ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি সন্নিবেশিত বিধি-বিধানে আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন করা, যার সাথে সাথে মানব অন্তরে বিদ্যুৎ শক্তির উৎপত্তি হয়। যে শক্তি মানবের সর্বাঙ্গকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল প্রদর্শিত আনুগত্যের বিধানানুসারে পরিচালিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। সোজা কথায় আল্লাহ ও রাসূলের মনোনীত আইন কানুন মেনে নেয়া।
(২) আল-ইফ্ফাত: সতীত্ব সংরক্ষণ, নৈতিক পবিত্রতা বজায় রাখা।
(৩)আল-ফিতরাত: সৃষ্টিগত স্বভাব ও প্রকৃতি।
(৪) আল-হায়া: লজ্জাশীলতা।
(৫) আত-তাহারাত: আত্মার পবিত্রতা।
(৬) আল- গাইরাত: শালীনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ।
• আল-ঈমান: পর্দার স্তর ও অবস্থান হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল প্রদর্শিত আইন কানুনের আনুগত্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দাদের প্রতি তার আনুগত্যকে আবশ্যিক ও বাঞ্চনীয় করে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আনুগত্যের অপরিহার্যতা ঘোষণা করে বলেন:
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ
“আর আল্লাহ ও তার রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্যে নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে”। (সূরা আহযাব:৩৬)
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
“তোমার সৃষ্টিকর্তার সপথ, তারা কিছুতেই মমিন হতে পারে না যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক বিবাদ কলহে তোমাকে বিচারক রূপে মেনে নেয়। অত:পর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে তারা নিজেদের মনে কিছু মাত্র কুন্ঠাবোধ করবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে”। (সূরা নিসা:৬৫)
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
لا يومن أحدكم حتى يكون هواه تبعا لما جئت به
তোমাদের মধ্যে কেউই মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার মন আমার উপস্থাপিত আদর্শের বশ্যতা ও অধীনতা স্বীকার করে নেবে। (আল হাদীস)
আল্লাহ তাআলা পর্দার অপরিহার্যতার কথা বলতে গিয়ে বলেন:-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ ﴿30﴾ وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آَبَائِهِنَّ أَوْ آَبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴿31﴾
মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।[৩০] আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা নূর:৩০-৩১)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآَتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
“আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর”। (সূরা আহযাব আয়াত: ৩৩)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ
তোমরা তাদের (নবী পত্নীগণের) কাছে কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল থেকে চাইবে, এটা তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ। (সূরা আহযাব-৫৩)
মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
“হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়”। (সূরা আহযাব:৫৯)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
নারীর সর্বাঙ্গই সতর-অঙ্গ। (গোপনীয় বস্তু কাজেই নারীদেহ সম্পূর্ণটাই ঢেকে রাখা অপরিহার্য।)
উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, নারীর জন্যে কোন অবস্থাতে আবাস গৃহ থেকে বের হয়ে লোক চক্ষুর সামনে স্বীয় রূপ-সৌন্দর্য ও যৌবন প্রদর্শন করা বৈধ নয় বরং তা সন্দেহাতীত হারাম।
স্মর্তব্য, যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলের পূণ্যবতী, পুত:পবিত্র মহান চরিত্রের অধিকারী, পরিপূর্ণ ঈমান বিশিষ্ট পত্নীগণকে এসব অবাঞ্চিত বস্তু থেকে সতর্ক করলেন, তাহলে অন্যান্য নারীদের বেলায় কিরূপ বিধান প্রজোয্য হতে পারে?
• আল-ইফফাত: নৈতিক পবিত্রতা, সতীত্ব সংরক্ষণ।
মহান রাব্বুল আলামীন রমণীর জন্যে পর্দার বাঞ্চনীয় ও নৈতিক পবিত্রতা বজায় রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন- ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব-৫৯)
• আলোচ্য আয়াতের আনুষাঙ্গিক কিছু বিষয়:
(ক) নারীকুলকে পূর্ণ পর্দার আওতাধীন থাকার বিধান প্রদানে প্রতীয়মান হল যে, তার জন্য অবৈধ ও ফেরেঙ্গি আচরণ বর্জন করা তার নৈতিক দায়িত্ব। যাতে পাপাচারী ও লম্পটদের খপ্পরে পতিত হয়ে উত্যক্তের সম্মুখীন হতে না হয়।
হ্যাঁ, বৃদ্ধা নারী যাদের বিয়ের আশা নেই, ফেতনা ফাসাদ ও অশ্লীলতায় পতিত হওয়ারও আশংকা নেই। তাদের জন্যে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে যেসব অঙ্গ মাহরামের সামনে খোলা রাখা যায়, গাইরে মাহরামের সামনেও সেগুলো খুলতে পারবে, কিন্তু শর্ত হচ্ছে সাজ-সজ্জা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে না হওয়া।
পরিশেষে আরও বলা হয়েছে যে, যদি সে পরপুরুষ সমীপে আসতে পুরাপুরী বিরত থাকে তবে তা তার জন্যে উত্তম, বলুন তো? যুবতী, কোমলমতী রমণীর কি হুকুম হতে পারে? যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ وَأَنْ يَسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ لَهُنَّ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿60﴾
বৃদ্ধা নারী যারা বিবাহের আশা রাখেনা, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের বস্ত্র খুলে রাখে, তাদের জন্য দোষ নেই। তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। (সূরা নূর: ৬০)
• আল ফিতরাত: সৃষ্টিগত সহজাত প্রকৃতি।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
“অতএব তুমি একনিষ্ট হয়ে দীনের জন্য নিজকে প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর প্রকৃতি যে প্রকৃতির উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না”। (সূরা রুম:৩০)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
كل مولود يولد على الفطرة فأبواه يهودانه أوينصرانه أو يمجسانه
“প্রত্যেক নবজাত শিশু ফিতরাত তথা ইসলাম বা স্রষ্টাকে চেনার ও তাকে মেনে চলার যোগ্যতার উপরই ভূমিষ্ট হয়, কিন্তু তার পিতা মাতা (বা ইসলাম বিরোধী পরিবেশ) তাকে ইহুদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপূজকে পরিণত করে”। (আল-হাদীস)
আলোচ্য আয়াত ও হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, নারীদের জন্যে পর্দাবলম্বন করা স্বভাব-ধর্ম, সহজাত প্রকৃতি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের মা বোনেরা আজ তাদের স্বভাবধর্ম ও সৃষ্টিগত প্রকৃতি পরিত্যাগ করে পাশ্চাত্যের ফেরেঙ্গি আচরণকে নিজেদের জন্যে মনোনীত করে নিয়েছেন। অথচ মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে এজন্যে জন্য সৃষ্টি করেননি।
সুতরাং, মানব মন্ডলী বিশেষ করে নারীকুলের জেন্যে এমন পথ বেছে নেয়া বাঞ্চনীয়, যে পথ তাকে স্বভাবধর্ম স্মরণ করিয়ে আল্লাহ ভীতি ও পরকালীন চিন্তার মহাসম্পদ লাভে উৎসাহিত করে, ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করার দিশা দিবে।
• আল-হায়া: লজ্জাবোধ।
এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন:
إن لكل دين خلقا و خلق الإسلام الحياء
প্রত্যেক দ্বীনেরই একটি নৈতিক স্বভাব ও আখলাক রয়েছে। আর ইসলামের সেই আখলাক বা নৈতিক চরিত্রটি হচ্ছে লজ্জাশীলতা” (আল-হাদীস)
তিনি আরো বলেন,
الحياء من الإيمان و الإيمان في الجنة
লজ্জাশীলতা হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ আর ঈমান (এর ঠিকানা হচ্ছে) জান্নাত।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)আরো বলেন,
الحياء و الإيمان قرنا جميعا
“লজ্জাবোধ ও ঈমান হচ্ছে এক সাথে মিলিত ভ্রুস্বরূপ।
(একটির অবর্তমানে অপরটির বিয়োগ অনিবার্য।)
(একটির অবর্তমানে অপরটির বিয়োগ অনিবার্য।)
উম্মতজননী আয়শা সিদ্দিকা রা. বলেন: যে কামরায় রাসূলের সাথে সহগামী হয়ে আমার আব্বাজান (আবুবকর) কবরস্থ হয়েছেন, সে কামরায় আমি প্রবেশ করে আমার পরিহিত বস্ত্র খুলে রাখতে কোনো রকম সংকোচ মনে করতাম না, কারণ, সেখানে একজন আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী (রাসূল) অপরজন শ্রদ্ধাভাজন আব্বাজানই ছিলেন। কিন্তু যখন তাদের সাথে (ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা)ওমরকে রা.কে দাফন করা হল, তখন থেকে প্রয়োজন বশত: সেই কামরায় প্রবেশ করলে বস্ত্র দ্বারা আমার সর্বাঙ্গ ঢেকে প্রবেশ করতাম।
আলোচ্য হাদীস দ্বারা পর্দার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হল, আরও বুঝা গেল যে, উম্মত জননী আয়েশার প্রশংসনীয় আচরণ ছিল যে, পরপুরুষ মৃত ওমরের সমাধিতেও তিনি পর্দা করতেন। এতে প্রনিধাণযোগ্য যে, নৈতিকতা বিধ্বংসী শয়তানের চেলা লম্পটদের সামনে পর্দার কতটুকু প্রয়োজন হতে পারে?
• আত-ত্বাহারাত: পবিত্রতা
এ মর্মে আল্লাহ বলেন,
َوإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ
তোমরা তাদের (নবী পত্নীগণের) কাছে কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল থেকে চাইবে, এটা তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ। (সূরা আহযাব-৫৩)
এ আয়াতে মানব অন্তরের পবিত্রতার কারণ উপকরণ পর্দাকেই সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেননা, চোখের দ্বারা কোনো বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করা ছাড়া সে বস্তু সম্পর্কে অন্তরে কোনো রকম জল্পনা-কল্পনা ও চিন্তা-ভাবনা সৃষ্টি হয় না। তবে যখনই দর্শন করে তখন থেকে নানা ফেতনা ও অনাচারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে উপায়াদি হাছিল করে শেষ পযর্ন্ত ব্যভিচার সংঘটিত হয়। এতে প্রতীয়মান হল যে, নারীকুলের জন্যে পাপাচারীর খপ্পর থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে পর্দাবলম্বন করা । কারণ, ধর্ষনের মূলে দর্শনই দায়ী ।
আল্লাহ আরও গুরুত্ব সহকারে বলেন:
إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا
যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কন্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। (সূরা আহযাব-৩২)
• আল-গায়রাত : শালীনতা-আত্মর্মযাদা।
নারীর জন্যে শালীনতা যেহেতু তার মানমর্যদার অন্তর্ভুক্ত, তাই তার শালীনতাহানিকর যেকোনো আচরণই তার মানহানির নামান্তর। সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ তার স্ত্রী ও কন্যার প্রতি অপর কোন ব্যক্তির কামুক দৃষ্টিতে কখনও রাজী হতে পারে না । তাহলে সে অন্যের স্ত্রী কন্যা ও বোনের প্রতি কিভাবে কামুক দৃষ্টিতে তাকাবে? ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের লোকেরা তাদের স্ত্রী কন্যা ও বোনদের ইজ্জত, সম্মান, মান-মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত হত।
প্রখ্যাত সাহাবি ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী (রা:) বলেন, আমার নিকট সংবাদ এসেছে যে, তেমাদের নারীরা নাকি অনারবী পুরুষদের সাথে ভীড় করে ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে, এতে কি তোমরা আত্মমর্যদা বোধের অবক্ষয় মনে কর না? কিন্তু দূ:খের বিষয় পাশ্চাত্য সভ্যতার নামে অসভ্যতার মোহে পড়ে যারা বিকৃত ধ্যান ধারণা রাখে তারা শুধু তখনই নারীর মানহানি হয়েছে বলে মনে করে, যখন সে নারী পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হয়। কিন্তু আল্লাহর বিধানে এটা হচ্ছে নারীর মানহানির চূড়ান্ত পর্যায়। এর পূর্বে নারীর শালীনতা হারানোর আরও বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। সাধারণত: সে সব পর্যায় অতিক্রম করার পরই নারী পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের অপমানিত হয়ে থাকে। নারীকে পর পুরুষ যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে উপভোগ করলে যেমন অপমান হয় তদ্রুপ কামুক দৃষ্টিতে উপভোগ করলেও অপমান হয়।
নারী পুরুষের সমান অধিকারের শ্লোগানটা পাশ্চাত্যবাদীদের একটা মারাত্মক প্রতারণামূলক শ্লোগান। যখন থেকে সমান অধিকারের নামে নারীরা স্বার্থবাদী, ভোগবাদী, কুচক্রী পুরুষের চক্রান্ত জালে আবদ্ধ হয়ে বেপর্দা অবস্থায় চলা-ফেরা করতে শুরু করল তখন থেকেই তারা তাদের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হল। তখন থেকেই শুরু হল সারা বিশ্বে নারী কন্ঠের করুণ আর্তনাদ নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নারী পাচার ও নারীকে পুরুষের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত করার অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই।
সমান অধিকারের নামে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যের আমেরিকা, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নারী পুরুষের সহ অবস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হয় সহ শিক্ষার মাধ্যমে। তারপর পাশ্চাত্যের অনুকরণে বিশ্বের অন্যান্য দেশে সহশিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। এভাবে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও শিক্ষিত সমাজে নারীকে পুরুষ কর্তৃক যেখানে-সেখানে যখন-তখন যেভাবে ইচ্ছা উপভোগ করার পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। এর অনিবার্য পরিণতিতে আজ শিক্ষাঙ্গন সহ শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে গোটা বিশ্ব যৌন অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যে সকল কিশোরী, তরুণী ও যুবতী রমনী ধর্ষিত হয়ে হাসপাতাল কিংবা আদালতের শরনাপন্ন হচ্ছে তাদের সিংহভাগই কি পর্দা লংঘনকারী নয়? তাদের আর্তনাদের ভাষায় কি আজ দেশের পত্র-পত্রিকার পাতাগুলো কলুষিত নয়? এখনও কি তাদের শুভবুদ্ধি উদয় হবার সময় আসেনি?
স্মর্তব্য, সুহৃদ পাঠক পাঠিকা ও সহশিক্ষার দিকে আহবায়ক ব্যক্তিবর্গ, আমরা যদি আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকি এবং তারই প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মত বলে দাবি করে থাকি। তাহলে আমাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল প্রদর্শিথ বিধানকে অবশই বিনা দ্বিধায়, মস্তক অবনত করে হৃষ্টচিত্তে মেনে চলতে হবে। কেননা, পুরুষ হোক কিংবা নারী কোন মুমিনেরে পক্ষেই আল্লাহ ও রাসূলের আইন অমান্য করে মানব রচিত অন্য কোন মতবাদ গ্রহণ করার অধিকার ও ক্ষমতা রাখে না। কারণ, ভৃত্য মনীবের মনোনীত নীতির বিকল্প পথে চললে সেই ভৃত্যকে বলা হয় ধোকাবাজ ও অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। এ কথায় দ্বীমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। বরং সকলেই এক মত। যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের উচিত সহশিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, ও হৃত সম্ভ্রম উদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া। যদি তা পারা না যায় তাহলে শিক্ষাঙ্গন তথা স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পর্দার বিধান অপরিহার্য করে দেয়া। এবং ছাত্র ছাত্রীর বসার টেবিল আলাদা করে দেয়া। পুরুষ শিক্ষকের সম্মুখে নারী ছাত্রীর অনুরূপ নারী শিক্ষিকার সম্মুখে পুরুষ ছাত্রের বসাকে অনৈতিক জ্ঞান করা। সবচে ভাল হয়, বরং এটি অভিভাবকদের নৈতিক দায়িত্বও বটে, প্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা বয়োপ্রাপ্তির নিকটবর্তী হেয় গেলে নিজ মেয়েদেরকে বালিকা স্কুলে শিক্ষাদান করানো।
স্মর্তব্য,
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি আর তা হচ্ছে, শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হবে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের শিক্ষাকে। অত:পর বস্তুগত শিক্ষা। সুতরাং একজন মুসলিম নারীর বস্তুগত শিক্ষার পূর্ণতার জন্যে হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিগ্রী লাভ করে উচ্চ শিক্ষিত হওয়া অনর্থক। কেননা, মানব শিশুকে গর্ভে ধারণের দায়িত্বটা যেহেতু একচেটিয়াভাবে নারীকেই পালন করতে হয়, তাই রোজগারের জন্যে পরিশ্রম করার দায়িত্বটা একচেটিয়া পুরুষকে পালন করার বিধান দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। কাজেই নারীকে বস্তুগত শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিতা হিসেবে গড়ে তোলা অত জরুরি নয়। সাধারণত: ভাল চাকুরী পাওয়ার জন্যেই তো উচ্চ শিক্ষা লাভ করা হয়।
হ্যাঁ, মুসলিম সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে নারীদেরকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আর তাই গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় ব্যাপকভাবে বালিকা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করা। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমাদের তৎপরতা তেমন নেই বললেই চলে। আর বস্তুগত শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের জন্যে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষাই যথেষ্ট মনে করা উচিত।
সহশিক্ষার কারণে আজ নারী পুরুষ অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। আর সেই সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে তারা প্রেমালাপ, প্রেমপত্র চালাচালি ও টেলিফোন ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যৌন অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত করে ছেড়েছে। আর সমান অধিকারের নামে কর্মশালা, অফিস আদালত ইত্যাদিতে নারী পুরুষের অবাধ মেলা-মেশার সুযোগ থাকায় সেখানেও এমন অনৈতিক কার্যাদি সঙ্ঘটিত হচ্ছে অহরহ। ফলে রাষ্ট্রের উন্নতির পরিবর্তে অবনতির অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
নবীপত্নী ও উম্মত জননীগণ নারীকুলের মাঝে শ্রেষ্ঠ ও পুত:পবিত্র চরিত্রে অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের প্রতি পরপুরুষের সাথে কোমল ও আর্কষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। তাদেরকে গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করার নির্দেশ প্রদান করে বলেন:
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى
“আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না”।
কাজেই নারীরা শিক্ষা গ্রহণ করবে পর্দার অন্তরালে থেকে। অথবা শালীনতা বজায় রেখে বয়োপ্রাপ্তির পূর্বেই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষা সমাপন করে দ্বীনে ইসলামের উপর বিশ্বাসগত ও কর্মগতভাবে অবিচল থাকাই অপরিহার্য। এটাই তাদের জন্যে ইহকালীন শান্তি এবং পরকালীন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়।
আল্লাহ আমি আপনি এবং সমগ্র উম্মতকে তাকওয়া ও পরকালীন জীবনের পাথেয় অর্জনে রত থেকে ফেতনা ফাসাদের যাবতীয় উপায় উপকরণ থেকে যথাযথভাবে সংযত থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন
সমাপ্ত
সংকলন : মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রহ.
অনুবাদক : আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান
সম্পাদনা : ইকবাল হোসাইন মাছুম
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন