Views:
A+
A-
ভূমিকা :
আল-কুরআনুল কারীম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরন্তন মু‘জিযা, বিশ্ব মানবতার মুক্তিসনদ। এতে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও দিক-নির্দেশনা, রয়েছে আলোকবর্তিকা, উপদেশ, রহমত ও অন্তরের যাবতীয় ব্যাধির উপশম। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدىً وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ (57) قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ﴾
‘‘হে মানুষ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমাত। বল, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে ও রহমাতে’। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশী হয়। এটি যা তারা জমা করে তার চেয়ে উত্তম।’’[1]
তিনি আরো বলেন,
﴿وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ وَهُدىً وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
‘‘আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি, শুধু এজন্য যে, যে বিষয়ে তারা বিতর্ক করছে, তাদের জন্য তা তুমি স্পষ্ট করে দেবে এবং এটি হিদায়াত ও রহমাত সে কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।’’[2]
কিয়ামাত পর্যন্ত আল-কুরআন হিফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নিজেই নিয়েছেন। আল-কুরআন সংরক্ষণের বিষয়টি মূলতঃ আল্লাহর মহান কুদরতের বিশাল নিদর্শন। যে প্রজন্মের মধ্যে কুরআন সরাসরি নাযিল হয়েছে তাদের জন্য এ গ্রন্থ যেমন উপযোগী ও চির আধুনিক ছিল, তাদের পরবর্তী আগত অনাগত সকল প্রজন্মের জন্যও তা চিরন্তন ও শাশ্বত জীবনাদর্শ। অতএব সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআনের শেখন ও শিক্ষাদান, নিয়মিত অধ্যয়নের মাধ্যমে একে সঠিকভাবে বুঝা, উপলব্ধি করা ও যথাযথ গুরুত্বের সাথে সে অনুযায়ী আমল করা সে সব লোকদেরই অনুসৃত নীতি যারা সর্বযুগেই ছিলেন সৎ ও পূণ্যবান। বরং এ হচ্ছে সে ঠিকানা যেখানে দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও সফলতা নিহিত।
সবযুগেই মুসলিম জনসাধারণ কুরআনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। মহান আল্লাহ ততদিন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহকে সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ জাতির স্বীকৃতি দেবেন যতদিন তারা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করবে, হিফয করবে, হিফাযত করবে, এর অর্থ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, এর গূঢ় তত্ত্বব উপলদ্ধি করবে, এর নির্দেশ মেনে চলবে এবং এর নিষেধকৃত সকল কিছু পরিহার করবে। ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল জাতির জীবনে এ গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা যেহেতু অপরিসীম, সেহেতু মুসলমানগণ এ গ্রন্থের প্রতি সর্বাধিক যত্ন ও গুরুত্ব দিয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন জাতির গ্রন্থ এ রকম গুরুত্ব পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেনি। কুরআন কারীমের এ অপরিসীম গুরুত্বের কারণে সারা বিশ্বের মুসলিম মানসে কুরআনের পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন ও কুরআন বুঝার এক অভূতপূর্ব সাড়া ও বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে, যেন কুরআন কারীমের এ বিশাল চর্চা থেকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিষ্ঠাবান মুসলিম মাত্রই উপকৃত হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় -কিভাবে আমরা কুরআনের সঠিক বুঝ ও উপলব্ধি অর্জন করব? এ প্রবন্ধে আমরা সে প্রশ্নটির সঠিক উত্তর পাওয়ারই চেষ্টা করব এবং পাশাপাশি এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করব যা পাঠকের মন ও মানস থেকে অবোধগম্যতার সকল দেয়াল তুলে দেবে এবং কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝে নিতে সহায়তা করবে।
কুরআন কেন আমাদের বুঝতে হবে?
কুরআন বুঝার পন্থা সম্পর্কে আলোকপাত করার আগে আমাদের বুঝতে হবে কুরআন বুঝার কেন এত গুরুত্ব। সেটিই নিচে তুলে ধরা হল :
1. কুরআন হচ্ছে দ্বীনের সকল জ্ঞানের উৎস এবং মৌলভিত্তির আধার। দ্বীন, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ এর মাধ্যমেই শুধু অর্জিত হয়। কুরআন নাযিল হয়েছে এর বিধান অনুযায়ী আমল করার জন্য। আমলের জন্য বোঝা ও উপলব্ধির প্রয়োজন। না বুঝে আমল করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে অথচ বুঝে না তার উদাহরণ হল - যেমন একদল লোকের কাছে তাদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি নির্দেশিকা আসল, যাতে লিখা আছে কি করা যাবে আর কি করা যাবে না, কিসে তাদের মঙ্গল হবে এবং কিভাবে ভুলপথে চললে শত্রু তাদেরকে পাকড়াও করবে, তারা সে নির্দেশিকা মাথায় রেখে খুবই সম্মান দেখাল এবং সুন্দর সূরে তা পড়ল কিন্তু বুঝার চেষ্টা না করে ভুল পথে চলল, ফলে অনিবার্যরূপেই তারা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হল।
2. কুরআনের অর্থ না বুঝার মানেই হল দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও ধারণা না থাকা। আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম, তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘‘এটা সে সময় যখন মানুষের কাছ থেকে জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে, ফলে তারা তা অর্জন করতে সক্ষম হবে না।’’ তখন যিয়াদ ইবন লাবিদ আল-আনসারী বললেন, কিভাবে জ্ঞান আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে অথচ আমরা কুরআন পড়েছি? আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই কুরআন পড়ব, আর আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে কুরআন পড়াব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘হে যিয়াদ তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক (তোমার মৃত্যু হোক)[3], আমি তো তোমাকে মদীনাবাসী ফাকীহদের মধ্যে গণ্য করতাম।এ তাওরাত এবং ইনজিল ইয়াহুদ ও নাসারাদের কাছে আছে। কিন্তু তা তাদের কি কাজে এসেছে?’’ জুবায়ের বললেন, এরপর আমরা উবাদাহ ইবন আস-সামিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, তুমি কি শুনেছ তোমার ভাই আবুদ্দারদা কি বলছে? আর আবুদ্দারদা কি বলেছে তা তাকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, আবুদ্দারদা সত্য বলেছে, তুমি চাইলে আমি তোমার কাছে সে ইলম সম্পর্কে বলব যা সর্বপ্রথম উঠিয়ে নেয়া হবে, তা হল খুশূ ও বিনয়। তুমি হয়ত কোন মাসজিদে প্রবেশ করে সেখানে কোন বিনয়ী লোক পাবে না।[4]
অতএব বুঝা গেল যে, ইলম ও জ্ঞান উঠে যাওয়ার কারণই হল এমন ব্যক্তিগণের অভাব ও অনুপস্থিতি যারা ইলমকে ধারণ করবেন এবং সঠিকভাবে উপলব্ধি করবেন ও আমল করবেন।
3. কুরআন বুঝা ও কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণার বিপুল সাওয়াব রয়েছে। উকবা ইবন আমের আল-জুহানী বলেন, আমরা আহলে সুফফার সাথে থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘‘তোমাদের কোন্ ব্যক্তির এটা পছন্দ যে, সে আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়াই এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করে বুতহান অথবা আকীক প্রান্তরে[5] গিয়ে দু’টো বিশালকায় উট নিয়ে আসবে?’’ আমরা বললাম, আমাদের সবারই তা পছন্দ। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ প্রতিদিন মাসজিদে গিয়ে কিতাবুল্লার দু’টো আয়াত শেখা কিংবা পড়া দু’ উটের চেয়েও তার জন্য উত্তম। আর তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে এবং চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। আর যতগুলো আয়াত সে অধ্যয়ন করবে তা সমসংখ্যক উটের চেয়ে উত্তম।’’[6] যদি জ্ঞানার্জন সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাকর কাজ হয়ে থাকে তাহলে এর অগ্রভাগে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে আল্লাহর কালাম জানা, বুঝা ও উপলব্ধি করা। কেননা জ্ঞানের মর্যাদা জ্ঞানগত বিষয়ের মর্যাদার উপর নির্ভর করে। কিতাবুল্লাহ হচ্ছে জগতের সবচেয়ে সম্মানিত বিষয়; সুতরাং এর জ্ঞানার্জনই হল সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাকর কাজ।
4. মুসলমানদের অনৈক্য, ভুল বুঝাবুঝি ও হানাহানি দূর করে ভালবাসা, সম্প্রীতি ও হৃদ্যতা আনয়নের বিশুদ্ধ উপকরণই হল আল-কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝা ও হৃদয়ঙ্গম করা। কুরআনকে সঠিকভাবে না বুঝাই হল যত অনৈক্যের মূল। ইবরাহীম আত-তাইমী বলেন, ‘উমার রা. একদিন একাকী ছিলেন, তিনি স্বগতোক্তি করে বললেন, কিভাবে এ উম্মতের মধ্যে বিভেদ থাকতে পারে, অথচ তাদের নবী এক এবং কিবলা এক!? এরপর তিনি ইবন আববাস রা.কে ডেকে পাঠালেন ও জিজ্ঞাসা করলেন, এ উম্মত কিভাবে বিভক্ত হতে পারে অথচ তাদের নবী এক ও কিবলা এক? ইবন আববাস বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন, আমাদের উপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা অধ্যয়ন করেছি এবং জেনেছি কোন ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। আর আমাদের পর একদল লোক আসবে যারা কুরআন পড়বে অথচ জানবে না কোন্ ব্যাপারে কুরআন নাযিল হয়েছে। ফলে সে ব্যাপারে তারা নিজস্ব মতামত দেবে। আর যখন তাদের নিজস্ব মতামত হবে তারা মতভেদ করবে এবং এভাবে মতভেদ করতে করতেই তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হবে...।’’[7]
5. কুরআন শেখা ও তা সঠিকভাবে বুঝা থেকে যারা বিরত থাকে ও মুখ ফিরিয়ে রাখে তারা মূলত কুরআনী জীবন যাপন থেকে সরে গিয়ে অন্য জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মাধ্যমে জানিয়েছেন, যাদের কাছে কুরআনের জ্ঞান এসেছে অথচ সে জ্ঞান থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ও তা পরিত্যাগ করেছে, তাদেরকে তিনি জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত করেননি, বরং অজ্ঞানতার মধ্যেই তারা হাবুডুবু খেয়েছে। তিনি ইয়াহুদদের সম্পর্কে বলেন,
﴿وَلَمَّا جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ نَبَذَ فَرِيقٌ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ كِتَابَ اللَّهِ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ كَأَنَّهُمْ لا يَعْلَمُونَ (101) وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُوا الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ ﴾
‘‘আর যখন তাদের নিকট আল্লাহর কাছ থেকে একজন রাসূল এল, তাদের সাথে যা আছে তা সমর্থন করে, তখন আহলে কিতাবের একটি দল আল্লাহর কিতাবকে তাদের পেছনে ফেলে দিল, (এভাবে যে,) মনে হয় যেন তারা জানে না। আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলায়মানের রাজত্বে পাঠ করত।’’[8]
ইয়াহুদদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব আসার পর তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বলে আল্লাহ তাদেরকে এমন এক নিকৃষ্ট গ্রন্থের ফিতনায় তাদেরকে আক্রান্ত করেছিলেন যা সুলায়মান আলাইহিস সালামের রাজত্বে শয়তান তিলাওয়াত করতো।[9]
আল্লাহ কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার শাস্তি সম্পর্কে বলেন,
﴿وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكاً وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى﴾
‘‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাব অন্ধ অবস্থায়।’’[10]
তিনি আরো বলেন,
﴿وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآياتِ رَبِّهِ ثُمَّ أَعْرَضَ عَنْهَا إِنَّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ مُنْتَقِمُونَ﴾
‘‘আর তার চেয়ে বড় যালিম আর কে, যাকে স্বীয় রবের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেয়ার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের কাছ থেকে প্রতিশোধগ্রহণকারী।’’[11]
কুরআন বুঝা সহজ :
কুরআনের পঠন-পাঠন, তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন এবং কুরআনের অনুশাসন মেনে চলাকে আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন বলে সূরা আল-কামারে মোট চারবার ঘোষণা দিয়েছেন।
﴿وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ﴾
আল-কুরআনের শব্দমালা সহজেই তিলাওয়াত ও হিফয করা যায়, এর অর্থ সহজেই বোধগম্য হয় এবং শেখা যায়; কেননা তা বাক্যবিন্যাসের দিক থেকে সবচেয়ে সাবলীল ও সুন্দর, শৈল্পিকতায় সবচেয়ে নিপূণ ও শ্রেষ্ঠ, অর্থের দিক থেকে সবচেয়ে সত্যবাদী, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে সবচেয়ে স্পষ্ট। যে বা যারাই কুরআনের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাদের জন্য তা নিতান্তই সহজ করে দেন। পৃথিবীর বড় বড় অমুসলিম বিজ্ঞানী যারা আরবী ভাষা শিখেনি তাদের অনেকেই শুধু কুরআনের তরজমা পড়েই আল্লাহর Message পেয়ে যায় এবং সেজন্যই পাশ্চাত্যের অনেক বড় পন্ডিত হয়েও তারা ইসলাম গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ﴾
﴿فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنْذِرَ بِهِ قَوْماً لُدّاً﴾
‘‘আর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি এর দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহপ্রিয় কওমকে তদ্বারা সতর্ক করতে পার।’’[14]
কুরআনকে সহজ করে দিয়ে আল্লাহ আমাদের উপর বড়ই অনুগ্রহ করেছেন। তা না হলে এটা অন্য ধর্মের মত পুরোহিতদের কঠিন নিয়ন্ত্রণেই আবদ্ধ থাকত। অতএব আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কে আছেন কুরআনের দিকে সর্বান্তকরণে এগিয়ে আসবেন, কুরআনের উপদেশ গ্রহণ করবেন, কুরআন শিখবেন এবং কুরআনের মর্মবাণী উপলব্ধি করে জীবনকে কুরআনের রঙে রঙিন করবেন?
কুরআন বুঝা এবং কুরআন নিয়ে গবেষণা কি শুধু আলেমগণেরই কাজ?
কুরআন বুঝা এবং কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা শুধু আলেমদের মধ্যেই ইসলাম সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে ঐ পরিমাণ কুরআন চর্চা করা, যতটুকু সাধ্য আল্লাহ তাকে দিয়েছেন এবং যতটুকু জ্ঞান, বুদ্ধি ও বুঝ তার রয়েছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সকলকেই কুরআন বুঝা ও তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার প্রতি আহবান করেছেন। কোন নির্দিষ্ট শ্রেণীকে তিনি বিশেষভাবে এ দায়িত্ব দেননি। কুরআন বুঝা ও গবেষণা যদি কোন একদল লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হত তাহলে কুরআনের কল্যাণ সীমিত হয়ে যেত এবং আয়াতের আহবান স্পষ্টভাবে শুধু তাদের ব্যাপারেই ব্যক্ত করা হত, কিন্তু কুরআনের আহবান এমনটি নয় - এটা উম্মাহর সকলেরই জানা।
ইবন আববাস রা. বলেন, কুরআনের তাফসীর চারভাগে বিভক্ত;
একভাগ আরবরা তাদের নিজেদের কথা থেকেই জানে।
দ্বিতীয় প্রকার তাফসীর না বুঝার ওজর কারো পক্ষ থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তৃতীয় প্রকার তাফসীর অনুধাবন শুধু আলেমগণের পক্ষেই সম্ভব।
তন্মধ্যে যে তাফসীর না বুঝার ক্ষেত্রে কারো ওজর শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয় তা হলো কুরআনে যে সব আহকাম ও বিধান স্পষ্ট, হৃদয়কে নাড়া দেয়া সুন্দর উপদেশাবলী, শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট দলীল ও প্রমাণসমূহ এবং সে সব সাধারণ বক্তব্য যা আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
যেমন আপনি যখন আল্লাহর কালাম নিয়ে ভাববেন, আপনি কি উপলব্ধি করবেন? আপনি উপলব্ধি করবেন, আপনি এমন এক সত্তাকে পেয়েছেন সকল কিছুই যার মালিকানাভূক্ত, তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা, প্রতিটি বিষয়ই তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সবকিছুর উৎস তিনি এবং তাঁর কাছেই সবার প্রত্যাবর্তন, তিনি আরশের উপর আছেন, জগতের কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই, তিনি বান্দার অন্তরের কথাও জানেন, তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল অবস্থা তাঁর জানা, তিনি একাই জগত পরিচালনা করছেন, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা, তিনি দান করেন ও কেড়ে নেন, তিনিই পুরস্কুত করেন ও শাস্তি দান করেন, তিনিই সম্মানিত করেন ও অপদস্থ করেন, তিনিই সৃষ্টি করেন ও রিয্ক দেন, তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, তিনিই তাকদীর ও ফয়সালা নির্ধারণ করেন, তাঁর অনুমতি ছাড়া কোন অণুও আন্দোলিত হয় না, তাঁর জ্ঞানের বাইরে কোন একটি পাতাও ঝরে না, যমীন ও আসমানের কোন কিছু তাঁর অজ্ঞাত নেই...
এরপর ভাবুন আল-কুরআনে কিভাবে তিনি তাঁর নিজের প্রশংসা করেছেন, গুণগান বর্ণনা করেছেন, বান্দাদেরকে নসীহত করেছেন আর বান্দাদেরকে ঐ পথের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যাতে রয়েছে তাদের সুখ-শান্তি ও সাফল্য এবং সতর্ক করেছেন সে সব বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে যাতে রয়েছে তাদের অশান্তি ও ধ্বংস। কুরআনের মাধ্যমেই বান্দা অতি সহজেই জানতে পারছে আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও মহান গুণাবলী সহ তাঁর পরিচয়। আল-কুরআন বান্দার সামনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আল্লাহর অনুগ্রহ ও নেয়ামতসমূহ তুলে ধরেছে, আর অনুগত বান্দাদের জন্য আল্লাহর দেয়া মর্যাদা, সুখ-শান্তি ও মহা পুরস্কারের সংবাদ এবং পাপিষ্ঠ ও অবাধ্য বান্দাদের ভয়াবহ ও মর্মান্তিক শাস্তির দুঃসংবাদ প্রদান করেছে।[16] এ বিষয়গুলো এবং এছাড়াও আরো বহুবিধ বিষয় আল্লাহর যে কোন বান্দা চাইলেই সহজে অনুধাবন করতে পারে। তবে এজন্যে তাদের প্রয়োজন কুরআন অধ্যয়ন করা এবং কুরআন নিয়ে কিছুটা চিন্তা-গবেষণা করা এবং এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত অথচ Authentic কিছু তাফসীরের সাহায্য নেয়া।
পাশাপাশি কুরআনে এমন সব বিষয়ও দেখা যায় যা বুঝার জন্য আলেম ও স্কলারদের বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, সাধারণ মানুষ মাত্রই তা বুঝতে পারে না। যেমন কুরআনের কাব্যিক অভিব্যক্তি, সাহিত্যিক শৈল্পিকতা এবং আরবীভাষার অলংকরণ ও বর্ণনাভঙ্গির বহু সুক্ষ বিষয় আরবী ভাষায় পারদর্শী বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। একইভাবে কুরআন থেকে হালাল-হারামের প্রতিটি বিষয় গবেষণা করে বের করা ফাকীহ ও মুহাদ্দিস-মুফাসসির ছাড়া অন্য সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। কুরআনে খুবই স্বল্প কিছু শব্দ ও বাক্য রয়েছে যার মর্ম শুধু আল্লাহই জানেন, যেমন কিছু সূরার শুরুতে ‘আলিফ-লাম-মীম’ ইত্যাদি Expression-সমূহ।
কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি কোথায়?
কুরআন অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরী। সতর্কতার অভাবে এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভুল-ত্রুটি হয়ে যেতেপারে; কেননা অনেক সময় কুরআনের কোন বক্তব্যের সাধারণ অর্থ কেউ বুঝে থাকতে পারেন, অথচ ঐ বক্তব্য দ্বারা বিশেষ অর্থটিই উদ্দেশ্য, সাধারণ ও ব্যাপক অর্থ নয়। কখনো পাঠক বুঝে থাকতে পারেন এমন অর্থ যা বুঝানো কুরআনের উদ্ধেশ্য নয়। এমনটি সাহাবাগণের কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘‘কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেয়া হবে তার আযাব হবে।’’ আমি বললাম, আল্লাহ কি বলেন নি,
﴿فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَاباً يَسِيراً﴾
তিনি বললেন, ‘‘এটা সে হিসাব নয়, বরং এটা শুধু উপস্থাপন মাত্র। কিয়ামতের দিন যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেয়া হবে, তার আযাব হবে।’’[18] এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আয়েশা রা. হিসাবের সাধারণ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছিলেন যা কম বেশী সব ধরনের হিসাবকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট করে দিলেন যে, আয়াতে উল্লিখিত হিসাব মানে হল - মুমিন ব্যক্তির কাছে তার আমল উপস্থাপন, যাতে সে আল্লাহর সে অনুগ্রহ অনুধাবন করতে পারে যা তিনি দুনিয়ায় তার দোষ গোপন করার মাধ্যমে এবং আখিরাতে ক্ষমা করার মাধ্যম করেছিলেন।[19]
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেন, যখন অবতীর্ণ হল ﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ﴾ ‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে যুলম দ্বারা মিশ্রিত করেনি।’’ আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে তার নিজের উপর যুলম করে নি? তিনি বললেন, ‘‘আয়াতটির ব্যাপারে তোমরা যা বলছ বিষয়টি তেমন নয়, বরং যুলম মানে এখানে শির্ক। তোমরা কি শোন নি লুকমান তার ছেলেকে বলছিলেন, ﴿لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾ “হে বৎস, তুমি আল্লাহর সাথে শরীক করো না, নিশ্চয় শির্ক বড় যুলম।’’ [সূরা লুকমান : ১৩][20]
এ ধরনের উদাহরণ অনেক। তবে এছাড়াও আরো অনেক ধরনের ভুল হয়ে থাকতে পারে। যেমন :
1. চিন্তা-গবেষণার ত্রুটির কারণে অনুধাবনে ত্রুটি।
2. যে সব মৌলিক বিষয় একজন মুসলিমের জানা থাকা উচিত, তা জানা না থাকার কারণে কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে ত্রুটি।
3. প্রবৃত্তির অনুবর্তী হওয়ার কারণে সৃষ্ট ত্রুটি। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোন ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও আকীদায় পূর্ব থেকেই একটি বিষয় স্থির হয়ে আছে, যে কোন ভাবেই সে নিজের ধারণাটি কুরআনের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। ফলে আয়াত দ্বারা সেভাবে বুঝা না গেলেও সে নিজের আকীদা ও পূর্বাহ্নে স্থিরীকৃত বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আয়াতের বিপরীত অর্থ বুঝে থাকে। অথচ মুলিম মাত্রই উচিত হল সর্বাবস্থায় আল্লাহর মাকসুদ ও প্রতিপাদ্য বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝে নেয়া। কেননা সঠিকভাবে বুঝার জন্য ব্যক্তির সদিচ্ছা, সত্যানুসন্ধিৎসা এবং ভেতর ও বাহিরের সত্যিকার তাকওয়া থাকা প্রয়োজন। প্রবৃত্তির অনুসরণ, দুনিয়া পূজা, প্রশংসা পাওয়ার লোভ ও তাকওয়া বিসর্জন ইত্যদির উপস্থিতিতে সঠিক বুঝ ও উপলব্ধি কখনোই আসবে না।[21]
আরেকটি কথা স্মরণ রাখতে হবে ,কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার মানে এটা নয় যে, ব্যক্তি নিজেকে মুফাসসির হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, তাই এখন থেকে আলেমগণের তাফসীর না দেখে এবং ভালভাবে বুঝে না নিয়েই প্রত্যেক আয়াতের ব্যাখ্যায় নিজ অভিমত পেশ করবেন না। ভুলে গেলে চলবে না, তাফসীর মানেই হল আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক উদ্দিষ্ট অর্থের বর্ণনা, সঠিক নিয়ম-নীতির আলোকে তাফসীর করা না হলে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
ইবন আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘‘যে ব্যক্তি কোন জ্ঞান ছাড়া কুরআনের ব্যাপারে বক্তব্য প্রদান করে, সে জাহান্নামে তার স্থান বেছে নিল।’’[22]
আবু বকর সিদ্দীক রা. বলেন, ‘কোন্ যমীন আমাকে আশ্রয় দেবে আর কোন্ আকাশ আমাকে ছায়া দান করবে যদি আমি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে এমন কিছূ বলি যা আমি জানি না’।[23]
উবায়দুল্লাহ ইবন মুসলিম ইবন ইয়াসার তার বাবার কাছ থেকে বর্ণনা করে বলেন,‘যখন তুমি আল্লাহ সম্পর্কে বক্তব্য দেবে তখন থেমে গিয়ে দেখ, এর পূর্বে ও পরে কি আছে।’ প্রখ্যাত তাবেয়ী মাসরুক বলেন,‘তাফসীর করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাক; কেননা তাতো আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণনা ছাড়া আর কিছু নয়।’ সাহাবা এবং তাবেয়ীগণের এ সকল বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় তারা তাফসীরের ক্ষেত্রে ইলম ও জ্ঞান ছাড়া কথা বলতে কি বিশাল সতর্কতা অবলম্বন করতেন।[24]
কিভাবে আমরা সঠিকভাবে কুরআন বুঝব?
কুরআন সঠিকভাবে বুঝার জন্য কুরআন গবেষণার সঠিক নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। নিম্নে সে সব নিয়ম-নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরছি।
1. কুরআন বুঝার সহজ পথ অনুসরণ। এ পথটির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে :
এক : কুরআনের তাফসীর প্রথমত কুরআন দিয়ে করা, তারপর সুন্নাহ দিয়ে এবং তারপর সাহাবাগণের বক্তব্যের মাধ্যমে। তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল কুরআন দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। যদি কেউ কুরআনকে বিশুদ্ধরূপে বুঝতে চায় তাহলে তার উচিত সামগ্রিকভাবে কুরআনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং পুরো আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্যের প্রতি খেয়াল রাখা। পাশাপাশি অন্য সূরায় যদি একই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত আয়াত থাকে তাহলে সে আয়াতের অর্থ কি তা জেনে নেয়া। যদি কোন আয়াতে বক্তব্য অস্পষ্ট থাকে তাহলে অন্য আয়াতে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, যদি কোথাও বক্তব্য সংক্ষিপ্ত থাকে তাহলে অন্যত্র বিস্তারিত বক্তব্য থাকবে। যারা কুরআনের কিছু অংশ গ্রহণ করে এবং কিছু অংশ বাদ দেয় আল্লাহ কুরআনে তাদের নিন্দা করেছেন,
﴿أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ﴾
﴿فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ﴾
‘‘সুতরাং যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে।’’[26]
কুরআন দিয়ে কুরআনের তাফসীরের উদাহরণ : আল্লাহর বাণী,
﴿وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكاً ﴾
এখানে ‘আল্লাহর স্মরণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি কুরআন, নাকি আল্লাহ যে সব কিতাব নাযিল করেছেন সেগুলো, অথবা তাসবীহ তাহলীলের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ?
আমরা যদি আয়াতটির পূর্বাপর বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে, ‘আল্লাহর যিকর বা স্মরণ’ দ্বারা এখানে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, অন্যগুলো নয়; কেননা আল্লাহ বলেছেন,
﴿قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيعاً بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدىً فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلا يَضِلُّ وَلا يَشْقَى (123) وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكاً وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى(124) قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيراً (125) قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى (126)﴾
‘‘তিনি বললেন, ‘তোমরা উভয়েই জান্নাত হতে এক সাথে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। অতঃপর যখন তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, তখন যে আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না’। ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, ‘হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন’? তিনি বলবেন, ‘এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী (কুরআন) এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’।’’[28]
এরপর আসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি। স্বয়ং আল্লাহই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার সুন্নার মাধ্যমে কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছেন। আল্লাহ বলেন,
﴿وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ﴾
‘‘এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে আর যাতে তারা চিন্তা করে।’’[29]
ইমাম শাফেয়ী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব হুকুম দিয়েছেন তার সবই তিনি কুরআন থেকে যা বুঝেছেন তার অন্তর্ভূক্ত। কেননা আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيماً﴾
‘‘নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন। আর তুমি খিয়ানতকারীদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়ো না।’’[30]
﴿وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ وَهُدىً وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
‘‘আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি, শুধু এজন্য যে, যে বিষয়ে তারা বিতর্ক করছে, তা তাদের জন্য তুমি স্পষ্ট করে দেবে এবং এটি হিদায়াত ও রহমত সেই কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।’’[31]
কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে কুরআনের তাফসীর করা না গেলে সে ক্ষেত্রে কুরআনের তাফসীর করতে হবে সাহাবাগণের বক্তব্যের মাধ্যমে; কেননা তারাই কুরআন নাযিলের অবস্থা ও প্রেক্ষাপট সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন, যা অন্যরা করতে পারেনি। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থেকে তারা সঠিক ইলম, প্রজ্ঞা ও ইসলামের মূল মাকাসিদের জ্ঞান দ্বারা আলোকিত হয়েছিলেন। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. বলেন, ‘ঐ সত্ত্বার শপথ যিনি ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য আর কেউ নেই, আল্লাহর কিতাবে যে আয়াতই নাযিল হত, আমি জানতাম সে আয়াতটি কার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এবং কোথায় নাযিল হয়েছে। আমার চেয়েও কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে বেশী জানে এমন কারো সন্ধান পেলে অবশ্যই আমি তার কাছে আসতাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের এক ব্যক্তি যখন দশটি আয়াত শিখত, তিনি সেগুলোর অর্থ ভালভাবে হৃদয়াঙ্গম করা ও আমল করা ছাড়া সেগুলো অতিক্রম করে অন্য আয়াতের দিকে যেতেন না।’[32] তারা ইলম ও আমলের মধ্যে চমৎকার সমন্বয় সাধন করেছিলেন।
দুই : আসবাবুন নুযূল তথা নাযিলের কারণ ও প্রেক্ষাপট জানা। আল-কুরআন মূলত আল্লাহর কালাম বা বক্তব্য, যার একটি শাব্দিক অর্থ রয়েছে। অনেক সময়ই সে শাব্দিক অর্থ বুঝার জন্য প্রয়োজন সার্বিক প্রেক্ষাপট ও যাদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন তাদের বিষয়টি অবগত হওয়া। এটি জানা না থাকলে কুরআনের আয়াত নিয়ে মুসলিম মানসে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা ও সংশয়। বুকাইর নামক একজন আলেম প্রখ্যাত তাবেয়ী নাফে‘কে জিজ্ঞাসা করলেন, হারুরী সম্প্রদায় সম্পর্কে ইবন উমারের অভিমত কেমন ছিল? তিনি বললেন, তিনি তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টির অধম বলে মনে করতেন; কেননা কাফিরদের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াতসমূহকে তারা মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করত।’
তিন : আরবী ভাষা জানা। কুরআন সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। অতএব যে সঠিকভাবে কুরআন বুঝতে চায় তাকে অবশ্যই আরবী ভাষা বুঝতে হবে। সাথে সাথে কথায়, কাজে ও কুরআন নাযিলের নানা প্রেক্ষাপটে আরবদের ‘আদাত ও প্রথার সাথে পরিচিত হতে হবে।
এ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে যদি আমরা এমন তাফসীর পেতে চাই যা আমাদেরকে কুরআন সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করবে, তাহলে আমাদেরকে এমন তাফসীর ও ব্যাখা গ্রন্থ চয়ন করতে হবে যাতে উক্ত তিনটি বিষয়ের প্রতি যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে। এ ধরনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, হাফিয ইবন কাসীরের তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, শায়খ আবদুর রহমান আস-সা‘দীর তাইসীরুল কারীম আর-রাহমান, আবু বাকর আল-জাযায়েরীর আইসারুত তাফাসীর, আবুল আ‘লা মাওদুদীর তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ কুতুবের ফী যিলালিল কুরআন, ড. মুহাম্মাদ আল-আশকার এর যুবদাতুয তাফাসীর ইত্যাদি।
তাফসীর পড়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে অনেকের তাফসীরে কিছু কিছু ভুল রয়েছে, আবার অনেকের আকীদাগত বিভ্রান্তি আছে। এ সব ভুল ও বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।
2. যা উপকারী ও সবার জন্য মঙ্গলজনক কুরআন বুঝা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সবসময় তাতেই নিজেকে সম্পৃক্ত ও নিয়োজিত রাখতে হবে। আর যা উপকারী ও প্রয়োজনীয় নয় তা এড়িয়ে যেতে হবে। আল্লাহ নিজেও মানুষের নানা অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে উত্তরে এমন বিষয় সমূহ তুলে ধরেছেন যা মানুষের জন্য কল্যাণকর। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাই আমরা নিম্নোক্ত আয়াতটিতে। আল্লাহ বলেন,
﴿يَسْأَلونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ ظُهُورِهَا وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾
‘‘তারা তোমাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, ‘তা মানুষের ও হজ্জের জন্য সময় নির্ধারক’। আর ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা পেছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। কিন্তু ভাল কাজ হল, যে তাকওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা গৃহসমূহে তার দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’’[33]
এ আয়াতটিতে লোকেরা চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। হয়তো তারা জানতে চেয়েছে চাঁদটা শুরুতে কেন ছোট থাকে তারপর বড় হয়, অথবা চাঁদের হাকীকত কি কিংবা চাঁদের উপকারিতা কি ইত্যাদি। কিন্তু আল্লাহ সরাসরি তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এমন বক্তব্য দিয়েছেন যা জানার মাধ্যমে সবাই উপকৃত হয়। এমন উদাহরণ কুরআনে আরো অনেক আছে। মোদ্দাকথা হল, কুরআনের বর্ণনার বাইরে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই, কুরআন বুঝার সময় এ কথাটিও মনে রাখতে হবে।।
3. কুরআনের বাণী তিলাওয়াতের সাথে সাথে এর অর্থ বুঝা ও তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় নিয়োজিত হওয়া এবং অন্তরকে সে অর্থ দ্বারা প্রভাবিত করা। অতএব কুরআন শুধু তিলাওয়াত করলেই হবে না, বরং এতে যে নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, সেগুলো গ্রহণ করতে হবে এবং আমল করতে হবে আর মানার ক্ষেত্রে ত্রুটি হলে ইস্তেগফার করতে হবে।
যখন রহমতের আয়াত পড়বে তখন হৃদয়ে আনন্দের শিহরণ সৃষ্টি করে মনে মনে প্রভুর কাছে তা পাওয়ার প্রার্থনা করবে। আবার আযাবের আয়াত পড়লে যেন মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং আল্লাহর কাছে তা থেকে পানাহ চাইবে। এভাবেই স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. করেছেন।[34]
4. কুরআনের মৌলিক মাকাসিদ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জেনে রাখা, যা কুরআনিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এবং যা কুরআনে পৌনপুনিকভাবে এসেছে। যেমন কুরআন সবচেয়ে বেশী আলোচনা করেছে ও গুরুত্ব দিয়েছে তাওহীদের বাস্তবায়ন, শির্ককে প্রত্যাখ্যান, ঈমান ও ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহের উপর। অতএব এগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা রেখেই কুরআন বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
5. আল্লাহর সুন্দর নামগুলো এবং যে সকল আয়াতে সেগুলো এসেছে এতদুভয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন ও সমন্বয় সাধন। অনেক সময় দেখা যায় আয়াত শেষ হয় আল্লাহর কোন একটি নাম দিয়ে। মনে রাখতে হবে আল্লাহর ঐ বিশেষ নাম আয়াতের শেষে উল্লেখ করার একটা Significance আছে যেমন রহমতের আয়াত শেষ করা হয় আল্লাহর রহমতসূচক নাম দিয়ে, আবার আযাব ও শাস্তির আয়াতগুলো শেষ হয় শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কর্তৃত্বসূচক নাম দ্বারা। আরো বেশী সতর্ক থাকতে হবে যাতে আল্লাহর গুণবাচক কোন নামকে তার প্রকৃত অর্থ থেকে তাবীল করা না হয়।
6. আয়াতের প্রাসঙ্গিক ও আনুষাঙ্গিক অর্থ সহ আয়াতকে বুঝতে হবে অর্থাৎ যে সব বিষয়ের উপর আয়াতের অর্থ বুঝা নির্ভরশীল সেগুলো সহ আয়াতটিকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ﴾
‘‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দন্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)।’’[35]
এখানে অযুর ফরযিয়াতের কথা বলা হয়েছে। তবে জানা কথা অযুর জন্য পানি দরকার, সে পানি অর্জনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা প্রয়োজন। অতএব অযু করার জন্য যত কাজের প্রয়োজন সবকিছু এ নির্দেশটির অন্তর্ভূক্ত হবে।
7. বৈজ্ঞানিক তথ্য ও সাম্প্রতিক কালের আবিষ্কারের বিষয়গুলোকে কুরআনের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সঙ্গতিপূর্ণ করা। তবে সতর্ক থাকতে হবে যে কুরআন বৈজ্ঞানিক তথ্য দেয়ার জন্য নাযিল করা হয়নি। সুতরাং সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভান্ডার এটি নয়। আর এ বিশ্বাসও জরুরী যে, কুরআনের সকল বৈজ্ঞানিক তথ্যই সঠিক। তবে সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন বৈজ্ঞানিক Facts নয় এমন বিষয়গুলোকে বিজ্ঞানের বিষয় মনে করে আমরা কুরআনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হই। এক্ষেত্রে পাঠকের কাছে কুরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যে Contradiction আছে বলে মনে হতে পারে এবং এ জন্য পাঠকের অসতর্কতাই দায়ী। কুরআনে মহাসত্যের বিপরীত কিছু নেই। বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে আমাদের কুরআন বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
পরিশেষে বলবো, কুরআন বুঝা সহজ; কেননা আল্লাহই তা আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। কিন্তু কুরআন বুঝার সঠিক পদ্ধতি আমাদের অনুসরণ করতে হবে। সঠিক পদ্ধতির অনুসরণ ছাড়া যে যার মত কুরআন বুঝার চেষ্টা করলে পদস্খলন অনিবার্য। আল্লাহ আমাদেরকে সকল ভুল বিভ্রান্তি হতে মুক্ত থেকে বিশুদ্ধভাবে কুরআন বুঝার ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের তাওফীক দান করুন।
[3] এটা কোন বদদোয়া নয়, বরং আরবী বাকরীতি। অপছন্দনীয় কিংবা সঠিক নয় এমন কথা বলা হলে আরবগণ এ বাক্য কিংবা ‘ওয়াইলাক’ (তোমার ধ্বংস) ব্যবহার করে থাকে।
[4] সুনান তিরমিযী, কিতাবুল ইলম, বাব: ইলম উঠে যাওয়া প্রসঙ্গে যা এসেছে, হাদীস নং ২৬৫৩, তিরমিযী বলেন, ‘এটি হাসান গরীব হাদীস’। আলবানী বলেন, ‘সহীহ’।
[6] সহীহ মুসলিম, কিতাব : মুসাফিরদের সালাত ও এর কসর, বাব : কুরআন শেখা ও সালাতের মধ্যে কুরআন অধ্যয়নের ফযীলত, হাদীস নং ১৯০৯।
[7] ইবরাহীম ইবন মূসা ইবন মুহাম্মাদ আশ-শাতিবী, আল-মুয়াফাকাত ফী উসূলিল ফিকহ, তাহকীক : মাশহুর হাসান সালমান, দার আফফান, ১৯৯৭, ৪/২০০.
[18] সহীহ বুখারী, কিতাব : তাফসীরুল কুরআন, বাব:আল্লাহর বাণী فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا , হাদীস নং ৪৫৫৮, সহীহ মুসলিম, কিতাব : জান্নাত, এর নিয়ামত ও জান্নাতবাসীদেও বর্ণনা, বাব : (আমলের) হিসাব সাব্যস্তকরণ, হাদীস নং ৫১২২
[20] সহীহ বুখারী, কিতাব : তাফসীরুল কুরআন, বাব : আল্লাহর বাণী وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ হাদীস নং ৩১৭৫, সহীহ মুসলিম, কিতাব :আল-ঈমান, বাব : ঈমানের সত্যতা ও ইখলাস, হাদীস নং ১৭৮
[22] সুনান আত-তিরমিযী, কিতাব : তাফসীরুল কুরআন, বাব :যিনি নিজ মতামত দ্বারা কুরআনের তাফসীর করেন তার ব্যাপারে যা এসেছে, ইমাম তিরমিযী বলেন, এ হাদীস ‘হাসান সহীহ’, হাদীস নং ২৮৭৪
[23] ইমাম আল-বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ২২০০, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং ৪১৫০-৪১৫১, জামি‘উল আহাদীস, হাদীস নং ২৭৩০২
লেখক : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
আরো পড়ুনঃ কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত
আরো পড়ুনঃ কুরআন তিলাওয়াত : ফযীলত ও আদব
আরো পড়ুনঃ কুরআন শিক্ষা: বিধান, পদ্ধতি ও ফযীলত
আরো পড়ুনঃ কুরআনের কয়েকটি বিশেষ সূরা ও আয়াতের ফজীলত
আরো পড়ুনঃ পবিত্র কুরআন পড়ার ফযীলতের হাদিস সমুহ
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
আরো পড়ুনঃ কুরআন তিলাওয়াত : ফযীলত ও আদব
আরো পড়ুনঃ কুরআন শিক্ষা: বিধান, পদ্ধতি ও ফযীলত
আরো পড়ুনঃ কুরআনের কয়েকটি বিশেষ সূরা ও আয়াতের ফজীলত
আরো পড়ুনঃ পবিত্র কুরআন পড়ার ফযীলতের হাদিস সমুহ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন