Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

See Our Articles In Different Styles... Grid View List View

সোমবার, ১৫ মে, ২০২৩

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়; সমস্যা

Views:

A+ A-

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়; সমস্যা




আমার জীবনের প্রথম বন্ধু আবদুল মালেক। অবুঝ বয়সে ও আর আমি একসঙ্গে মাদরাসায় যেতাম। আমার আর ওর বাড়ি থেকে খাবার আনত ওর বড় ভাই। আমি যখন দুনিয়ার ভালো-মন্দ কিছুই বুঝতাম না, তখন ও অনেক কিছুই বুঝত। ও প্রায়ই মাদরাসা পালিয়ে বাড়িতে যেত। পড়াশুনার বাইরের জগতের প্রতিই ওর ছিল যত আগ্রহ। বছর পার না হতেই সে মাদরাসায় না পড়ার জন্য নানা বাহানা খুঁজতে লাগল। অবশ্য ওর বাবা ওকে মাদরাসায় পড়ানোর জন্য চেষ্টায় কসুর করেন নি। একদিন সে সত্যিই মাদরাসাকে বিদায় জানাল।

মাদরাসা থেকে চলে যাবার পর অনেক বছর যাবত তার সঙ্গে আমার দেখা নাই। মক্তব ছেড়ে আমি একাডেমিক পড়াশুনা শেষ করলাম ওর সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। বেচারার কথা যে মনে পড়ে না, তা নয়। আসলে ওর খবর নেয়ার তেমন সুযোগই ঘটেনি। একদিন বগুড়ার এক ইসলামী মাহফিলে হঠাৎ দেখা ওর সঙ্গে। ছোটবেলায় ও আমার বাড়ি থেকে আনা খাবারে আগ্রহ দেখাত বলে ওকে পেটুক বলে ডাকতাম। এতদিন পর সাক্ষাতেও সে বাল্যকালের কথাই মনে করিয়ে দিল। বলল, দোস্ত কিছু খাওয়া। আমি হেসে বললাম, যাক তাহলে অভ্যাসটায় খুব একটা হেরফের হয়নি। ওকে সম্ভবত চটপটি আর পাপড় খাওয়ালাম। তারপর পড়াশুনার খাতিরে চট্টগ্রাম চলে এলাম। তিন মাস পর বাড়ি এসে শুনি আবদুল মালেক আত্মহত্যা করেছে! বাপের ওপর রাগ করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহনন করেছে। শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারপর ওর বাবা-মা’র সাথে সাক্ষাৎ করলাম। সেদিনের বিবরণ শুনলাম তাদের কাছে। আবদুল মালেক নাকি বাবার ওপর রাগ করে তিনদিন না খেয়ে চতুর্থ দিনে এসে এ কাজ করে বসে। দিন তারিখ মিলিয়ে হিসেব করে দেখলাম আমার সাথে সাক্ষাতের দিনটি ছিল ওর মৃত্যুর আগের দিন। হতবাক হয়ে গেলাম। ইস যদি আমি ওকে পেট ভরে ভাত খাওয়াতাম। তিনদিনের অনাহারী ছিল বলেই বোধ হয় অবশেষে বাল্যবন্ধুকে পেয়ে অকপটে খাওয়ানোর আবদার করেছিল। আর তাকেই কি-না বাল্যকালের দোহায় দিয়ে পেটুক বলেছিলাম বলে আফসোসে দগ্ধ হতে লাগলাম।      
আত্মহত্যা শব্দটির সঙ্গে অবশ্য পরিচয় এ ঘটনার অনেক আগে। আমাদের মহল্লার একটি পরিত্যক্ত বাসায় এক যুবক গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কৈশোরের অবুঝ মনে সেদিন বড় বিস্ময় উপহার দিয়েছিল আস্ত একটি মানুষের নিষ্প্রাণ দেহ। তবে প্রকৃতপক্ষে ক্ষণকালের তালিবুল ইলম আবদুল মালেকের আত্মহননই প্রথম আমাকে বিপুলভাবে নাড়া দেয়। তখনই আমি শুনতে পাই আত্মহত্যা সম্পর্কে বাঙালী সমাজে প্রচলিত সত্য-মিথ্যা নানা কথা। ওর বাবা-মা'র কান্নাভেজা কণ্ঠ আমাকে বড়ই আবেগাপ্লুত করে। আমাকে দেখে তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, 'হায় একই রকম দু'টি বাচ্চা একসঙ্গে মাদরাসায় যেত। আর এখন একজন জান্নাতের পথিক 'মাওলানা' আর আমাদের ছেলেটা চিরস্থায়ী জাহান্নামী'! জন্মদাতা বাবা-মা'র মুখে সন্তানের চিরস্থায়ী জাহান্নামবাসী হবার কথা আমাকে প্রবলভাবে কাঁপিয়ে দেয়। আমার মনে প্রশ্ন জাগে আত্মহত্যাকারী মুসলিম কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবেন যেমন মনে করে আমাদের সমাজ? শুধু তাই নয়, আমি যখন আবদুল মালেকের কথা স্মরণ করে দু'আয় কেঁদে উঠি, তখন কেউ কেউ বলেন, 'ছি, ওদের জন্য দু'আ করতে নেই'। সে থেকেই আত্মহত্যা নিয়ে আমার কৌতূহল আর এ সম্পর্কে জানার পর এ নিয়ে লেখার এবং মুসলিম সমাজকে এ সম্পর্কে সঠিক কথা জানানোর আগ্রহ। পাঠক, আজ চলুন এ বিষয়েই জানা যাক নানা কথা। 
আত্মহত্যা কী? 
আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানো আমাদের বাংলাদেশে অনেক নারী-পুরুষ বিশেষত যুবতী বোনেরা জীবন সংগ্রামের পরিবর্তে জীবন থেকে পালিয়ে যাবার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। তুচ্ছ পারিবারিক কলহবিদ্যালয়ের গমনাগন পথেবখাটেদের উৎপাতভালোবাসায় ব্যর্থতা ও প্রতারণা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তরুণীরা এবং স্বামীর নির্যাতন-অত্যাচারযৌতুক সমস্যাস্বামীর অর্থনৈতিক অক্ষমতাপারিবারিক অশান্তি থেকে বাঁচার পথ হিসেবে অনেক মহিলা আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছে। এসবই বড় ভুলএসব সমস্যা সব দেশেসব জাতিতে আছে আত্মহত্যা এসবের কোনো সুষ্ঠু সমাধান বা সঠিক প্রতিকার নয়। 
শরীয়তের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা
পবিত্র কুরআন থেকে : 
এবার চলুন যাওয়া যাক আত্মহত্যা সম্পর্কে আমাদের শরীয়ত কী বলেইসলামের দৃষ্টিতেআত্মহত্যা কবীরা গুনাহ। শিরকের পর সবচে বড় গুনাহ। সকল ফিকহবিদ এবং চার মাজহাবেই আত্মহত্যা হারাম। কারণ,  আল্লাহ তা'আলা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। ধনী-গরীব, বিদ্বান-মূর্খ, রাজা-প্রজা সবাইকে মরতেই হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, 
﴿ كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۖ ثُمَّ إِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ ٥٧ ﴾ [العنكبوت: ٥٧]  
'প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবেতারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।' {সূরা আল-আনকাবূতআয়াত ৫৭}  
আর এ মৃত্যু দান করেন একমাত্র তিনিই তিনি ছাড়া কেউ কাউকে মৃত্যু দিতে পারে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 
﴿ هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُ وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٥٦ ﴾ [يونس : ٥٦]  
'তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।' {সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৬} 
উপরোক্ত আয়াতদুটি থেকে বুঝা যায় মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র আল্লাহর। অতএব কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেন, নিজের মৃত্যু ঘটান নিজের হাতে তবে তিনি অনধিকার চর্চাই করবেন। আল্লাহ তা পছন্দ করেন না। কেউ অনধিকার চর্চা প্রত্যাশা করে না। ইসলামে তাই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। এ কাজ থেকে বিরত থাকতে মহান আল্লাহ বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিণামের কথা ভাববার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহা পবিত্র আল কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন
﴿ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا ٢٩ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ عُدۡوَٰنٗا وَظُلۡمٗا فَسَوۡفَ نُصۡلِيهِ نَارٗاۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرًا ٣٠  [النساء : ٢٩،  ٣٠]  
'আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করেঅন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবেঅবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবোআল্লাহর পক্ষে তা  সহজসাধ্য' {সূরা আন-নিসাআয়াত ২৯-৩০}
আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 
﴿ وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ ﴾ [البقرة: ١٩٥]  
‘আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫} 
হাদীসে নাববী থেকে : 
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাই কাজটি থেকে নানাভাবে বারণ করেছেন। এ থেকে মানুষকে সতর্ক করেছেন। যেমন 
ছাবিত বিন যিহাক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 
« مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَىْءٍ فِى الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ».
‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে।’ [বুখারী : ৫৭০০; মুসলিম : ১১০] 
অপর এক হাদীছে রয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
« مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَهْوَ فِى نَارِ جَهَنَّمَ ، يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ، وَمَنْ تَحَسَّى سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَسَمُّهُ فِى يَدِهِ ، يَتَحَسَّاهُ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ ، فَحَدِيدَتُهُ فِى يَدِهِ ، يَجَأُ بِهَا فِى بَطْنِهِ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ».
যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবেসে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে যে কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে [সহীহ বুখারী : ৫৪৪২; মুসলিম : ১০৯ 
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
« مَنْ خَنَقَ نَفْسَهُ فِي الدُّنْيَا فَقَتَلَهَا خَنَقَ نَفْسَهُ فِي النَّارِ ، وَمَنْ طَعَنَ نَفْسَهُ طَعَنَهَا فِي النَّارِ ، وَمَنِ اقْتَحَمَ ، فَقَتَلَ نَفْسَهُ اقْتَحَمَ فِي النَّارِ».
যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোজখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে আর যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন সে নিজেকে উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।’ [সহীহ ইবন হিব্বান : ৫৯৮৭; তাবরানী : ৬২১]
জুনদুব ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনরাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
« كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ فَجَزِعَ فَأَخَذَ سِكِّينًا فَحَزَّ بِهَا يَدَهُ فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتَّى مَاتَ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى بَادَرَنِي عَبْدِي بِنَفْسِهِ حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ».
তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেনআমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম [বুখারী : ৩২৭৬; মুসলিম : ১১৩
আত্মহত্যা তো দূরে থাক মৃত্যু কামনাও বৈধ নয় 
আত্মহত্যা তো দূরের কথা আমাদের পবিত্র এই শরীয়ত কোনো বিপদে পড়ে বা জীবন যন্ত্রনায় কাতর হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করতে পর্যন্ত বারণ করেছে। যেমন আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 
« لاَ يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمُ الْمَوْتَ لِضُرٍّ نَزَلَ بِهِ فَإِنْ كَانَ لاَ بُدَّ مُتَمَنِّيًا فَلْيَقُلِ اللَّهُمَّ أَحْيِنِى مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِى وَتَوَفَّنِى إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِى ».
‘তোমাদের কেউ যেন কোনো বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেন বলে, ‘হে আল্লাহ আমাকে সে অবধি জীবিত রাখুন, যতক্ষণ আমার জীবনটা হয় আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়।’ [বুখারী : ৫৬৭১; মুসলিম : ৬৯৯০] 
আত্মহত্যাকারী জানাযা না পড়ানো 
আত্মহত্যা এতই গর্হিত কাজ যে এর প্রতি ধিক্কার জানিয়ে অন্যদেরকে এ থেকে সতর্ক করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্মহত্যাকারীর জানাযা ত্যাগ করেন। যেমন জাবের বিন সামুরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 
أُتِىَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- بِرَجُلٍ قَتَلَ نَفْسَهُ بِمَشَاقِصَ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ.
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমীপে এক ব্যক্তিকে আনা হলো যিনি নিজেকে তরবারীর ফলা দিয়ে মেরে ফেলেছে। ফলে তিনি তার জানাযা পড়লেন না।’ [মুসলিম : ২৩০৯] 
অপর বর্ণনায় রয়েছে, জাবের বিন সামুরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَجُلا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَصَابَتْهُ جِرَاحٌ ، فَآلَمَتْ بِهِ ، فَدَبَّ إِلَى قَرْنٍ لَهُ فِي سَيْفِهِ فَأَخَذَ مِشْقَصًا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ " .
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সাহাবী আহত হন। এটি তাকে প্রচণ্ড যন্ত্রনা দেয়। তখন তিনি হামাগুড়ি দিয়ে একটি শিংয়ের দিকে এগিয়ে যান, যা তার এক তরবারির মধ্যে ছিল। এরপর তিনি এর ফলা নেন এবং আত্মহত্যা করেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা পড়ান নি। [তাবরানী : ১৯২৩] 
আত্মহত্যাকারীর কি জানাযা পড়া যাবে না?
অনেকে সমাজে অনেকে মনে করেন কেউ আত্মহত্যা করলে তার বুঝি জানাযা পড়া যাবে না। ওপরের হাদীসটিও কেউ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাতা ইমাম নাববী রহ. বলেন,   
وفي هذا الحديث دليل لمن يقول : لا يصلى على قاتل نفسه لعصيانه , وهذا مذهب عمر بن عبد العزيز والأوزاعي , وقال الحسن والنخعي وقتادة ومالك وأبو حنيفة والشافعي وجماهير العلماء : يصلى عليه , وأجابوا عن هذا الحديث بأن النبي صلى الله عليه وسلم لم يصل عليه بنفسه زجرا للناس عن مثل فعله , وصلت عليهالصحابة " انتهى . 
‘এ হাদীসকে তাঁরা প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, মানুষকে সতর্ক করার জন্য যারা আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া হবে না বলে মত দেন। এটি উমর বিন আব্দুল আযীয ও আওযাঈ রহ.-এর মত। তবে হাসান বছরী, ইবরাহীম নখঈ, কাতাদা, মালেক, আবূ হানীফা, শাফেঈ ও সকল আলিমের মতামত হলো, তার জানাযা পড়া হবে। উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত অন্যদেরকে এ ধরনের মন্দ কাজ থেকে সতর্ক করার জন্যই আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়ানো থেকে বিরত থেকেছেন। আর সাহাবীগণ তাঁর স্থলে এমন ব্যক্তির জানাযা পড়েছেন। [নাববী, শারহু মুসলিম : ৭/৪৭] 
তাই গণ্যমান্য আলেম ও বিশেষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের জন্য করণীয় হলো আত্মহত্যাকারীর জানাযা না পড়ানো। বরং সাধারণ কাউকে দিয়ে তাদের জানাযা পড়িয়ে দেয়া। এ সূত্র ধরেআমাদের সমাজে উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেমের স্থলে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেম দ্বারা আত্মহত্যাকারীর জানাযার সালাত পড়ানো হয়। 
আত্মহত্যাকারী কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী ?
কেউ যখন নিজেকে হত্যা করে তখন সে নিজেকে মূলত আল্লাহর গজব ও ক্রোধের শিকারে পরিণত করে। সে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কারণ, তা কোনো শিরকী কাজ নয়। একমাত্র শিরকই এমন গুনাহ আল্লাহ যা ক্ষমা  না করার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلَۢا بَعِيدًا ١١٦  [النساء : ١١٦] 
‘নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হল।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৪৮} 
শিরক ছাড়া যা আছে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আর আত্মহত্যা শিরক নয়। তেমনি যিনা, চুরি, মদ্য পান- সবকিছুই গুনাহ বটে। তবে তা শিরক নয়। এসবে লিপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। কেউ যখন এসব গুনাহে লিপ্ত হয়ে মারা যাবে আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন- তার নেককাজগুলোর বদৌলতে কিংবা ইসলামে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আর তিনি চাইলে তাকে তার অপরাধ অনুপাতে তাকে শাস্তি দেবেন। অতপর সে গুনাহ থেকে পবিত্র হবার পর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিশ্বাস মতে সে চির জাহান্নামী হবে না। কোনো গুনাহগারই অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। খুনী, মদ্যপ কিংবা অন্য কোনো অপরাধীও নয়। কিন্তু ওপরে যেমন বলা হলো, আল্লাহ চাইলে তাকে শাস্তি দেবেন, তার অপরাধ অনুযায়ী তাকে আজাব দেবেন তারপর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। একমাত্র কাফেররাই শুধু জাহান্নামে অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহতে অবিশ্বাসী মুশরিক কাফেররাই শুধু জাহান্নামে চিরকাল থাকবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।  রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনীত দীনকে যারা অস্বীকার করেছে। 
তবে শুধু খারেজী ও মুতাজিলা সম্প্রদায় মনে করে আত্মহত্যাকারী চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। তাদের মতে গুনাহগার ব্যক্তিরাও চির জাহান্নামী। এ দু’টি দলই ভ্রান্ত ফেরকা। এটি তাদের ভ্রান্ত মত। কেননা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীবৃন্দ এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর আদর্শ  অনুসারীদের মত হলো, গুনাহগার ব্যক্তিরা চির জাহান্নামী হবে না কারণ গুনাহগার মাত্রেই সে নিজেকে অপরাধী ভাবে। বরং শয়তানের প্ররোচনায় বা প্রবৃত্তির তাড়নায় সে গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। তাই সে অনন্তকাল জাহান্নামী হবে না। বরং আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে তার ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অন্যথায় তাকে তার সাজা ভোগ করার পর জাহান্নাম থেকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর এ ব্যাপারে হাদীসের কোনো অভাব নেই যে মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করবে অতপর সাজা খেটে সেখান থেকে জান্নাতে দাখিল হবে। অবশ্য কেউ যদি নিজের গুনাহকে বৈধ মনে করে বা আল্লাহর বিধানের সঙ্গে কুফরীবশত গুনাহ করে বা আত্মহত্যা করে তবে সবার মতে সে জাহান্নামী। জাহান্নামই তার স্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। 
আত্মহত্যাকারীর জন্য কি দু‘আ করা যাবে ?  ‌‌
তবে এসবের অর্থ এই নয় যে কেউ আত্মহত্যা করলে তার জন্য ক্ষমা ও রহমতের দু‘আ করা যাবে না যেমনটি আমাদের সমাজের অনেকে মনে করেন। এসব বরং অধিক পাপী হওয়ার দরুণ ওই ব্যক্তির জন্য আরো বেশি বেশি দু‘আ করা উচিত। আত্মহত্যা কোনো কুফুরী কাজনয়, যার মাধ্যমে মানুষ ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যায়। দু‘আ করা যাবে না কেবল ওই ব্যক্তির জন্য যে ঈমানহীন অবস্থায় মারা যায়। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 
﴿ سَوَآءٌ عَلَيۡهِمۡ أَسۡتَغۡفَرۡتَ لَهُمۡ أَمۡ لَمۡ تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ لَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٦ ﴾ [المنافقون: ٦]  
‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর অথবা না করউভয়টি তাদের ক্ষেত্রে সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।’ {সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত : ০৬} 
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, 
﴿ ٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ أَوۡ لَا تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗ فَلَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٨٠   [التوبة : 80]  
‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমা চাওঅথবা তাদের জন্য ক্ষমা না চাও। যদি তুমি তাদের জন্য সত্তর বার ক্ষমা চাওতবুও আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। কারণ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছেআর আল্লাহ ফাসিক লোকদেরকে হিদায়াত দেন না।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ১১৩-১১৪} 
একই সূরায় অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, 
﴿ مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ ١١٣ وَمَا كَانَ ٱسۡتِغۡفَارُ إِبۡرَٰهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوۡعِدَةٖ وَعَدَهَآ إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُۥٓ أَنَّهُۥ عَدُوّٞ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنۡهُۚ إِنَّ إِبۡرَٰهِيمَ لَأَوَّٰهٌ حَلِيمٞ ١١٤  [التوبة : 113-114]  
 ‘নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যেতারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা আত্মীয় হয়। তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যেনিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী। নিজ পিতার জন্য ইবরাহীমের ক্ষমা প্রার্থনা তো ছিল একটি ওয়াদার কারণেযে ওয়াদা সে তাকে দিয়েছিল। অতঃপর যখন তার নিকট স্পষ্ট হয়ে গেল যেনিশ্চয় সে আল্লাহর শত্রুসে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। নিশ্চয় ইবরাহীম ছিল অধিক প্রার্থনাকারী ও সহনশীল।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ১১৩-১১৪} 
অতএব আমাদের উচিত আত্মহত্যাকারীর জন্য বরং আরও বেশি বেশি দু‘আ করা। তার মাগফিরাত ও ক্ষমার জন্য এবং তার ওপর রহমত ও দয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে প্রার্থনা করা। হতে পারে আল্লাহ তা‘আলা এসব দু‘আ কবুল করে তাকে মাফ করে দেবেন। 
মানুষ কেন এবং কখন আত্মহত্যা করে?
ভাববার বিষয় হলো মানুষ কখন আত্মহত্যা করে ? যখন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়নিজেকে সে অসহায় ও ভরসাহীন ভাবেতখনই সে আত্মহত্যা করে বসে নানা সমস্যায় পড়ে মানুষ আত্মহত্যার এ নিন্দিত পথ বেছে নেয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : 
১. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কলহ এবং যৌতুক নিয়ে ঝগড়া-বিবাদকে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা। 
২. অভিভাবক তথা পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে অভিমানজনিত আত্মহত্যা। 
৩. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার প্রতিকিয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহত্যা। 
৪. আরোগ্য থেকে হতাশ হয়ে জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্থ যন্ত্রণাকাতর ব্যক্তির আত্মহত্যা 
৫. প্রেমে বা ভালোবাসায় ব্যর্থ বা প্রতারিত ও মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়া নারী বা পুরুষের আত্মহত্যা 
৬. ব্যবসা-বাণিজ্যে বা শেয়ার বাজারে বারবার ব্যর্থ হওয়া মানুষ বা তরুণ-যুবার আত্মহত্যা 
৭. প্রতাপশালী শক্রর হাতে ধরা পড়া থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা ইত্যাদি
আত্মহত্যা রোধে করণীয় 
মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন এক রকম কাটে না। ব্যক্তিগত জীবনপারিবারিক জীবনসামাজিক জীবনরাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্রই পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো দিন কাটে সখেকখনো কাটে দুঃখে। কখনো আসে সচ্ছলতা। আবার কখনো দেখা দেয় দরিদ্রতা। কখনো থাকে প্রাচুর্য কখনো আবার অভাব-অনটন। কখনো ভোগ করে সুস্থতা কখনো আক্রান্ত হয়ে পড়ে রোগ শোকে। কখনো দেখা দেয় সুদিনআবার কখনো আসে দুর্ভিক্ষ। কখনো আসে বিজয়আবার কখনো আসে পরাজয়। কখনো আসে সম্মান আবার কখনো দেখা দেয় লাঞ্ছনা। এ অবস্থা শুধু বর্তমান আমাদের সময়েই হয়ে থাকেতা নয়। এটা যুগ যুগ ধরে এভাবেই আবর্তিত হয়ে আসছে। আল্লাহ যেমন বলেন, 
﴿ ثُمَّ بَدَّلۡنَا مَكَانَ ٱلسَّيِّئَةِ ٱلۡحَسَنَةَ حَتَّىٰ عَفَواْ وَّقَالُواْ قَدۡ مَسَّ ءَابَآءَنَا ٱلضَّرَّآءُ وَٱلسَّرَّآءُ فَأَخَذۡنَٰهُم بَغۡتَةٗ وَهُمۡ لَا يَشۡعُرُونَ ٩٥ ﴾ [الاعراف: ٩٤]  
তারপর আমি মন্দ অবস্থাকে ভাল অবস্থা দ্বারা বদলে দিয়েছি। অবশেষে তারা প্রাচুর্য লাভ করেছে এবং বলেছে, ‘আমাদের বাপ-দাদাদেরকেও দুর্দশা ও আনন্দ স্পর্শ করেছে {সূরা আল-আরাফআয়াত ৯৫
যেহেতু বিপদ-আপদ, কষ্ট-শোক আমাদের নিত্যসঙ্গী তাই সমাজ থেকে আত্মহত্যা নির্মূলে প্রথমত দরকার পুরো সমাজ ব্যবস্থায় ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব অনুশীলন। কারণ, মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় হতাশার চরম মুহূর্তে। আর অনুশীলনরত মুসলিম জীবনে হতাশার কোনো স্থান নেই। আল্লাহ বলেন, 
﴿ قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٢]  
বল, ‘হে আমার বান্দাগণযারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীলপরম দয়ালু {সূরা আয-যুমার, আয়াত : ৫২} 
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যাবতীয় ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। এবং আল্লাহ যা-ই করেন বান্দার তাতে কোনো না কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে, সে কখনো নিজের জীবন প্রদীপ নিজেই নিভাবার মত হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সে তো হাজার বিপদেও অবিচল থাকবে এ বিশ্বাসে যে আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে অবশ্যই তিনি আমাকে পুরস্কৃত করবেন। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রথম দরকার ইসলামী শিক্ষা এবং দৈনন্দিন জীবন ইসলামের বাস্তবানুশীলন। নিচে একটি আত্মহত্যা সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরছি, সেটিই প্রমাণ করবে আমাদের এ দাবি কতটা যথার্থ। 
পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবগুলো কম্যুনিস্ট অধ্যুষিত দেশ সহ বৌদ্ধ ও উন্নত বিশ্বের সেক্যুলার দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। প্রথম পঞ্চাশটি দেশের মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত একটি মাত্র দেশ আছে। প্রথম পঁচাত্তরটি দেশের মধ্যে মাত্র চারটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আছে। দেশগুলো হচ্ছে কাজাখস্তানকিরগিজস্তানতুর্কমেনিস্তানও উজবেকিস্তান। মজারব্যাপার হচ্ছে এই চারটি দেশই কম্যুনিস্ট শাষিত সোভিয়েত রাশিয়ার অধীনে ছিল নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যাওয়ায় এই দেশগুলোও স্বাধীন হয় তার মানে দেশগুলো হয়ত কম্যুনিজমের বস্তুবাদী প্রভাব থেকে আজো সেভাবে মুক্ত হতে পারে নি
অধিকন্তুদেশ চারটি মুসলিম অধ্যুষিত হলেও মুসলিমদের শতকরা হার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো অত বেশি না ফলে এই দেশগুলোতে অমুসলিমদের মধ্যে হয়ত আত্মহত্যার হার বেশিআর সেটি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য দেশে আত্মহত্যার হার খুবই কম। যেমন ইরানে প্রতি আড়াই লক্ষে মাত্র একজন আত্মহত্যা করেসিরিয়াতে প্রতি পাঁচ লক্ষে একজনআর মিশরে প্রতি দশ লক্ষে একজন
প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে কম্যুনিস্ট অধ্যুষিত দেশ সহ বৌদ্ধ ও উন্নত বিশ্বের সেক্যুলার দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি – সেখানে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার এত কম কেনএর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনারা মনে করেন? কারণ তো সেটিই যার প্রতি আমরা ইঙ্গিত করলাম। মুসলিম সমাজে শত অবক্ষয়ের পরও এখনো তাকদীরের ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত এবং আল্লাহর ওপর আস্থার শিক্ষার কারণেই এ হার এত কম। 

আত্মহত্যা সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান

No.
Country
Rate
No.
Country
Rate
1.
Lithuania
81.0
49.
Netherlands
18.7
2.
Belarus
73.6
50.
Kyrgyzstan
18.5
3.
Russia 
67.9
51.
Argentina
17.6
4.
Sri Lanka 
61.4
52.
Turkmenistan
17.3
5.
Hungary 
53.5
53.
Mauritius
17.0
6.
Slovenia 
53.2 
54.
Spain
15.8
7.
Kazakhstan 
53.1
55.
Thailand
15.8
8.
Latvia 
51.6
56.
Zimbabwe
15.8
9.
Japan 
48.0
57.
Saint Lucia
15.4
10.
Ukraine
47.9
58.
Belize
15.0
11.
Guyana
45.4
59.
Ecuador
14.4
12.
Korea
43.7
60.
Italy
14.4
13.
Estonia
42.8
61.
Nicaragua    
14.4
14.
Belgium
42.6
62.
EI Salvador
13.8
15.
Finland
40.7
63.
Britain
13.6
16.
Croatia
40.2
64.
Macedonia
13.5
17.
Serbia
39.5
65.
Puerto Rico
12.7
18.
Moldova
36.6
66.
Costa Rica  
12.5
19.
France 
35.6
67.
Israel
12.5
20.
Switzerland
35.2
68.
Panama
12.5
21.
Hong Kong
35.1
69.
Malta
11.9
22.
Poland
32.4
70.
Colombia
11.5
23.
Austria
31.7
71.
Uzbekistan
11.1
24.
C Republic
31.1
72.
Venezuela
10.2
25.
Uruguay
30.9
73.
Seychelles 
9.1
26.
China
27.8
74.
Brazil
8.7
27.
Denmark
27.3
75.
Mexico
8.4
28.
Sweden
26.6
76.
Albania
 8.0
29.
Bulgaria
26.4
77.
Bahamas
7.3
30.
Germany
26.3
78.
Greece  
7.1
31.
Trinidad
25.8
79.
Grenadians
6.8
32.
Slovakia
25.7
80.
Paraguay
6.1
33.
Romania
25.5
81.
Bahrain
5.4
34.
Cuba
24.8
82.
Tajikistan
5.2
35.
Suriname
24.2
83.
Georgia
4.5
36.
New Zealand   
24.0
84.
Guatemala
4.3
37.
Bosnia
23.6
85.
Philippines
4.2
38.
Norway
23.1
86.
Kuwait
3.9
39.
Canada
22.7
87.
Armenia
3.7
40.
Portugal
22.4
88.
D republic  
3.5
41.
Iceland
22.3
89.
Azerbaijan 
2.3
42.
USA
22.2
90.
S.T. Principe
1.8
43.
Luxembourg 
22.0
91.
Peru
1.7
44.
Australia 
21.8
92.
Barbados
1.4
45.
India
21.3
93.
Iran
0.4
46.
Chili 
20.9
94.
Jamaica
0.3
47.
Singapore 
20.6
95.
Syria 
0.2
48.
Ireland 
19.5
96.
Egypt  
0.1

এ তো গেল সাধারণভাবে প্রযোজ্য করণীয়। এ ছাড়াও ওপরে আমরা আত্মহত্যার কারণ যেগুলো তুলে ধরেছি, সুনির্দিষ্টভাবে সেসবের প্রতিকার হিসেবে করণীয়গুলো যথাক্রমে এমন :   
১. পৃথিবীর সংঘাতময় জীবনে মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হবে- এটাস্বাভাবিক। আল্লাহ কুরআনে বলেছেনস্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিচ্ছদ স্বরূপ একে অপরের শান্তিদাতা ও শান্তিদাত্রী। ইরশাদ হয়েছে,
﴿ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ ١٨٧ ﴾ [البقرة: ١٨٧] 
তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৭} 
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]  
‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যেতিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেনযাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্যযারা চিন্তা করে।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত : ২১} 
দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। কারও মাঝে সব গুণের একত্র সমাহার বিরল। স্বামীর যেমন কিছু গুণ থাকে তেমনি কিছু দোষও থাকে। স্ত্রীর ব্যাপারেও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। তাই উভয়কে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে হবে। নিজেদের মধ্যে সংলাপ-সহযোগিতা-সমঝোতা-সহমর্মিতা থাকতে হবে উভয়কে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তদুপরি আল্লাহর কাছে পরস্পরের জন্য দু‘আ করতে হবে। আল্লাহ স্বয়ং আমাদের সে দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন, এই দু‘আটি আমরা নিয়মিত পড়ব। ইরশাদ হয়েছে, 
﴿ رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤ ﴾ [الفرقان: ٧٤]  
হে আমাদের রবআপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত : ৭৪} 
২. পিতা-মাতার প্রথম কাজ হবে সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা যা-ই বানান কেন সর্বপ্রথম তাকে কুরআন ও প্রয়োজনীয় ইসলামী জ্ঞান শিখিয়ে তবেই অন্য কোনো কিছু শেখানো। দ্বিতীয়ত তাদেরকে ইসলামী কায়দায় লালন-পালন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে। তাহলে বুঝতে পারবেন, কখন সন্তানকে শাসন করা যাবে আর কীভাবে সন্তানকে শাসন করতে হবে না। না জেনে প্রকৃত তথ্য না বের করে সাবালক সন্তানদের অযথা বকাঝকাও পরিহার করতে হবে। এমন মানসিক কষ্ট না তাদের কখনো দেয়া যাবে না যা তাদেরকে আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ দিতে বাধ্য করে। সর্বোপরি সন্তানের জন্যও পিতা-মাতা উপরোল্লেখিত আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া দু‘আটি পড়বেন। 
৩. শিক্ষার্থীদের মাঝে পারিবারিকভাবে এবং তাদের পাঠ্য বইয়ের মাঝে আল্লাহর ওপর ভরসা, হতাশা জয় করা এবং কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধারণের শিক্ষা শুরু থেকেই ঢুকে দিতে হবে। আর ছাত্র-ছাত্রীদের কর্তব্য হলো, সারা বছর ঠিক মত পড়ালেখা করা, শিক্ষাগুরু ও বাবা-মায়ের কথামত প্রতিদিন রুটিন মেনে পাঠ্য মুখস্থ করা। পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে অতিরিক্ত চেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে সালাত পড়ে বিশেষভাবে দু‘আ করা যেতে পারে। হে আল্লাহ। আপনিই তো জ্ঞান-প্রতিভা-মেধা ও ফল দেয়ার মালিক এগুলো দিয়ে আমাকে অনুগ্রহ করুন যাতে আমি পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারি সর্বোপরি পড়তে বসার সময়, পরীক্ষার হলে বিষয় মনে না এলে, সালাতের পর এবং সমসময় আল্লাহর শেখানো বাক্যটি পড়তে পারেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, 
﴿ وَقُل رَّبِّ زِدۡنِي عِلۡمٗا ١١٤ ﴾ [طه: ١١٤]  
‘আর তুমি বলো, হে প্রভু আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন। {সূরা ত-হা, আয়াত : ১১৪}
৪. মারাত্মক ও কষ্টদায়ক অসুখে পড়লে এ কথা মনে করা যে, দুনিয়া হলো মুমিনের পরীক্ষার স্থান। রোগ-বিসুখ দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। আর আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদেরই বেশি পরীক্ষায় ফেলেন। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَآ إِلَىٰٓ أُمَمٖ مِّن قَبۡلِكَ فَأَخَذۡنَٰهُم بِٱلۡبَأۡسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ لَعَلَّهُمۡ يَتَضَرَّعُونَ ٤٢ ﴾ [الانعام: ٤٢]  
আর অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে বিভিন্ন কওমের কাছে রাসূল প্রেরণ করেছি। অতঃপর আমি তাদেরকে দারিদ্র্য ও দুঃখ দ্বারা পাকড়াও করেছিযাতে তারা অনুনয় বিনয় করে {সূরা আল-আনআমআয়াত ৪২
আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ এ আয়াতে বাছা’ ও দাররা’ দুটো শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‌বাছা শব্দের অর্থ হলকঠিন অভাব ও দরিদ্রতাজীবনোপকরণের সংকট। আর দাররা শব্দের অর্থ হলশরীর ও স্বাস্থ্যের বিভিন্ন রোগ ব্যধি।
তাই কঠিন রোগ হলে কর্তব্য হলো, চিকিৎসার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত অনুনয়-বিনয়সহ আরোগ্য কামনা করা। সালাতে  দাঁড়িয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানানো। দাঁড়াতে না পারলে বসে পড়াতা না পারলে শুয়ে এবং তাও না পারলে ইশারায় পড়া আমরা আল্লাহর কাছে এ দু‘আটিও করতে পারি। হে আমার রব। আমাকে রোগে কষ্ট দিচ্ছে। আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। আমাকে রোগ-মুক্ত করুন। আইয়ুব আলাইহিস সালাম তাঁর ভীষণ অসুখে এ দু‘আ  পড়েছিলেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
﴿ وَأَيُّوبَ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُۥٓ أَنِّي مَسَّنِيَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ ٨٣ ﴾ [الانبياء: ٨٣]  
আর স্মরণ কর আইউবের কথাযখন সে তার রবকে আহ্বান করে বলেছিল, ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছি। আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু {সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৮৩
৫. ব্যবসায়ী ভাইদের প্রথমে মনে রাখতে হবে ব্যবসায় বলতে লাভ-ক্ষতির খেলা। ব্যবসা হালাল হলে তাতে অল্প লাভেই বরকত হয়। তাই ব্যবসায় সাময়িক কোনো লোকসানে একেবারে মুষড়ে না পড়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসায়ী ভাইদের উদ্দেশে যেসব বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন তা জেনে তদনুযায়ী আমল করতে হবে। উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক ফরয সালাতের পর এই দু‘আটি পড়তেন, 
»اللَّهُمَّ ، إِنِّي أَسْأَلُكَ رِزْقًا طَيِّبًا ، وَعِلْمًا نَافِعًا ، وَعَمَلا مُتَقَبَّلا«
‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে হালাল রিযক, উপকারী ইলম এবং মাকবুল আমল প্রার্থনা করছি।’ [মুসান্নাফ, আবদুর রাযযাক : ৩১৯১; তাবরানী : ১৯১৬৮] 
সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আমলটি আমরাও নিয়মিত করতে পারি। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নিচের দু‘আটিও পড়তে পারি আমরা নিয়মিত। পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা একজন খাদেম চাইতে আসলে তিনি তাঁকে এ দু‘আ শিখিয়ে দেন :   
«اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ ، وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ ، رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ ، مُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ الْعَظِيمِ ، أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ».
‘হে আল্লাহ, সপ্তাকাশের রব, আরশে আযীমের অধিপতি, আমাদের রব এবং প্রতিটি জিনিসের রব, তাওরাত, ইঞ্জিল ও মহা কুরআনের অবতরণকারী, আপনিই সর্ব প্রথম; অতএব আপনার আগে কোনো জিনিস নেই। আপনিই সর্ব শেষ; অতএব আপনার পরে কোনো জিনিস নেই। আপনিই যাহের; অতএব ওপর কিছু নেই। আপনিই বাতেন;  অতএব আপনার অজ্ঞাত কিছুই নেই। আপনি আমাদের ঋণ পরিশোধ করুন এবং অভাব ও দারিদ্র থেকে আমাদের মুক্তি দিন।’ [তিরমিযী : ৩৪৮১; মুসলিম : ৭০৬৪] 
তিরমিযীর অপর এক বর্ণনায় একই দু‘আ সম্পর্কে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে ঘুমানোর পূর্বে এ দু‘আ পড়ার শিক্ষা দেন। [তিরমিযী : ৩৪০০]
৬. আত্মহত্যার কথা মনে আসলে এ বিপদ থেকে রক্ষাকল্পে নফল নামাযে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং সিজদায় গিয়ে বিনীতভাবে আল্লাহর আগ্রহ-দয়া-সাহায্য কামনা করা প্রয়োজন। প্রতি মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করতে হবে মোট কথা যখনই নিজেকে অসহায় ও আশাহত মনে হয় এবং আত্মহত্যার চিন্তা আসে তখনই মনে করতে হবে এখন শয়তান এসেছে। ইসলামে আত্মহত্যা নাজায়েয এবং র পরিণতি জাহান্নাম। তাই এ থেকে দূরে থাকা বঞ্ছনীয়। সাথে সাথে মনে করতে হবে আল্লাহই আমার সহায় এবং আশার আলো। তাই পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামায পড়ার সাথে নফল নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর দয়া ও সাহায্য কামনা করতে হবে। প্রতি মুহূর্তে সবর অর্থাৎ ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এতে ইনশাআল্লাহ মন ও হৃদয় প্রশান্ত থাকবে এবং বিপদ দরীভূত হবে
৭. এছাড়াও বহু ছাত্র-ছাত্রীর জীবন বিসর্জন দিতে হচ্ছে-কৃত্রিম ভালোবাসারমিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়েঅপ্রত্যাশিত আশা-আকাঙক্ষার ফলে। আর এসবের পেছনে সবচে বড় হাত রয়েছে বেপর্দা ও অশ্লীলতার। একটি সুখীশান্তিময়সুন্দর সমাজ গঠনে শালীনতাপূর্ণরুচিসম্মতমার্জিত বেশ ভূষাচাল চলন ও আচার-আচরণের গুরুত্ব অপরিসীম। অশালীন বেশ ভূষা ও আচার-আচরণ মানুষের মধ্যকার পশু বৃত্তিকে জাগিয়ে তুলে। কুৎসিত কামনাকে উত্তেজিত করে। এতে নানা রকম পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নানা ধরনের পাপকর্ম সংঘটিত হয়। মহাবিপর্যয়অন্যায় ও অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহ বিধানকে মেনে চলাই সর্বোত্তম পন্থা পর্দার ওপর গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ বলেন
﴿ يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ لَسۡتُنَّ كَأَحَدٖ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ إِنِ ٱتَّقَيۡتُنَّۚ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِٱلۡقَوۡلِ فَيَطۡمَعَ ٱلَّذِي فِي قَلۡبِهِۦ مَرَضٞ وَقُلۡنَ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗا ٣٢ وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ وَأَقِمۡنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣ ﴾ [الاحزاب : ٣٢،  ٣٣]  
হে নবী পত্নীগণতোমরা অন্য কোন নারীর মত নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো নাতাহলে যার অন্তরে ব্যধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক- জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম করযাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবারআল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ {সূরা আল-আহযাবআয়াত : ৩২-৩৩} 

আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদের নির্দেশ দিয়েছেনতারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে। আপন ইজ্জত রক্ষা করে এবং আকর্ষণীয় অঙ্গগুলো আবৃত রাখে। যাতে কোনো অসুস্থ অন্তর বা অসংযত দৃষ্টির অধিকারী পুরুষ তার টিকিটিও স্পর্শ করতে না পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন
 ﴿ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ  [النور : ٣١]    
আর মুমিন নারীদেরকে বলতারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে।’ {সূরা আন-নূরআয়াত : ৩১}

এই আত্মহত্যার মাধ্যমে অনেক অবলা সতী নারীর জীবনের মায়া ত্যাগ করতে হচ্ছে  যৌতুকলোভী নরপিশাচদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্যাতনের কারণে। এসব আসলে পারিবারিক অশান্তিরই অংশ। পারিবারিক অশান্তি রোধেও প্রথমে দরকার পরিবারে ইসলামের চর্চা বাড়ানো তথা ইসলামী পরিবার গড়ে তোলা। শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীসহ পুরুষের পরিবারের সবাইকে মনে রাখতে হবে যৌতুকের নামে কোনো কিছু গ্রহণই তাদের জন্য বৈধ নয়। ইসলামে যৌতুকের কোনো স্থান নেই। মানুষের আন্তরিক প্রদান ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণই বৈধ নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, 
﴿ إِنَّمَا ٱلسَّبِيلُ عَلَى ٱلَّذِينَ يَظۡلِمُونَ ٱلنَّاسَ وَيَبۡغُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۚ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ ٤٢ ﴾ [الشورى: ٤٢]  
অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধেযারা মানুষের পর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি {সূরা আশ-শূরা, আয়াত : ৪২

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 
« لاَ يَحِلُّ مَالُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِلاَّ بِطِيبِ نَفْسِهِ ».
‘কোনো মুসলিমের সম্পদ তার আন্তরিক অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তির জন্য হালাল নয়।’ [বাইহাকী : ৫৪৯২; সুনান কুবরা : ১১৩২৫] 

আত্মহত্যা সংক্রান্ত কিছু তথ্য :
১. আত্মহত্যাকারীদের চেয়ে এতে চেষ্টাকারীর সংখ্যা তিনগুণ। 
২. খুনীদের তুলনায় আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা তিনগুণ। 
৩. মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রচেষ্টা সবচে বেশি। 
৪. সফল আত্মহত্যায় পুরুষদের সংখ্যা বেশি।  
৫. নারীরা আত্মহত্যা করে বেশি প্রাণনাশকারী অসুধ খেয়ে এবং আগুনে পুড়ে। আর পুরুষরা বেশি করে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। 
৬. বিবাহিত বিশেষত যাদের সন্তান রয়েছে এমন দম্পতিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার কম  
৭. আত্মহত্যাকারীদের হার সবচে বেশি বিশ্বের স্ক্যান্ডিনভিয়ান দেশগুলোতে। 
৮. প্রতি দশজন আত্মহত্যাকারীর পাঁচ জনই আত্মহত্যার আগে কোনো না বার্তা বা লক্ষণ রেখে যায়। 
৯. যুদ্ধকালীন ও জাতীয় সংকটের সময় আত্মহত্যার হার সবচে কম
আয় আল্লাহসকল স্তরের নারী-পুরুষ ও সন্তান-সন্ততিকে আত্মহত্যার মত মহাপাপ থেকে বেঁচে থাকার মত জ্ঞান বুদ্ধি ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মত সুচিন্তা ও চেতনা দান করুন। আমীন



লেখক: আলী হাসান তৈয়ব 
সম্পাদনা: ড. মুহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী
সূত্র: ইসলামহাউজ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন