Views:
A+
A-
খ. পৃথিবী উপার্জন করার একমাত্র ক্ষেত্র
গ. পরিবারিক দায়িত্ব পালন করা
ঘ. উপার্জন করার ক্ষমতা দুনিয়ার কল্যাণকর বিষয়
ঙ. স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যম
চ. উত্তরাধিকারীদের স্বচ্ছল রেখে যাওয়ার উপায়
· হালাল উপার্জন
3.1. হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও ফযিলাত
খ. উপার্জনের উৎস সম্পর্কে কিয়ামাতে জিজ্ঞাসা করা হবে
গ. ইবাদাত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত
ঘ. হালাল উপার্জন করা আল্লাহর পথে বের হওয়ার শামিল
ঙ. হালাল উপার্জন আখেরাত বিমুখিতা নয়
চ. হালাল উপার্জন জান্নাত লাভের উপায়
ছ. হালাল উপার্জন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন
3.2. হালাল উপার্জনের সম্ভাব্য কিছু মাধ্যম
ক. কৃষি
খ. শিল্প
গ. ব্যবসা
ঘ. চাকুরি
3.3. হালাল উপার্জনের মূলনীতি
ক. উপার্জেয় বস্তুটি হালাল হওয়া
খ. উপার্জেয় বস্তুটি পবিত্র (তাইয়্যিব) হওয়া
গ. উপার্জনের ক্ষেত্রে মাধ্যমটি বৈধ হওয়া
ঘ. উপার্জনে কম বা বেশি হওয়াকে পরীক্ষা হিসেবে মনে করা
ঙ. উপার্জন আল্লাহর বিধান পালনে প্রতিবন্ধক হতে পারবে না
চ. কেবল সম্পদ অর্জনই আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় নয়
ছ. রিযক দেরিতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করা
3.4. হালাল উপার্জনে অর্জনীয়
খ. আমানতদারিতা
গ. ওয়াদা পালন করা
ঘ. আন্তরিকতা
ঙ. স্বচ্ছতা
চ. শৃঙ্খলা
ছ. ইলম অর্জন করা
৪.৫. হালাল উপার্জনে বর্জনীয়
খ. লোভ-লালসা
গ. সুদের সম্পৃক্ততা থাকা
ঘ. যুলুম করা
ঙ. অপচয় ও অপব্যয় করা
চ. ঘুষের সম্পৃক্ততা
ছ. খেয়ানত করা
খ. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ
গ. জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক
ঘ. হারাম উপার্জন যালিমের হাতিয়ার
ঙ. হারাম উপার্জনের দান আল্লাহ গ্রহণ করেন না
ক. হারাম উপার্জন করার জন্য অনুতপ্ত হওয়া
খ. হারাম উপার্জন না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা
গ. হালাল উপার্জন ও হারাম উপার্জনকে পৃথক করা
ঘ. অর্জিত হারাম উপার্জন সওয়াবের আশা না করে শুধু দায়মুক্তির জন্য জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা
ঙ. কোনো প্রতিষ্ঠানের হক নষ্ট হলে বা খেয়ে ফেললে তা দ্রুত ফেরত দেওয়া
চ. মাফ চেয়ে নেওয়া
ছ. বেশি বেশি সদকাহ বা ভাল কাজ করা
জ. আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা
উপার্জন: ইসলামী দৃষ্টিকোণ
উপার্জন: ইসলামী দৃষ্টিকোণ
إن الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه أجمعين أما بعد :
অর্থ-সম্পদ আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম নিয়ামাত। এ নিয়ামাত অর্জন করার জন্য রয়েছে নানাবিধ ব্যবস্থা। বেঁচে থাকার জন্য কোনো না কোনো পর্যায়ে অর্থসম্পদের প্রয়োজন পড়ে। মানবজীবনে এটি শরীরের রক্তের সাথে তুলনাযোগ্য। জীবনকে স্বার্থক করার ক্ষেত্রে উপার্জন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ অনেক কিছু করতে চায়, কিন্তু উপার্জন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। উপার্জনের উপর নির্ভর করে ব্যক্তির অর্থ-সম্পদ অর্জিত হয়। এটি বাস্তব এবং খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। উপার্জন করার ক্ষেত্রে কী করণীয় রয়েছে এবং কী বর্জন করতে হবে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এই প্রবন্ধে।
1. উপার্জন বলতে কী বুঝায়
উপার্জন শব্দটির সমর্থক শব্দসমূহ হচ্ছে আয়, রোজগার, কামাই, লাভ, প্রাপ্তি, সংগ্রহ, অর্জন ইত্যাদি।[1] আরবীতে الكسب এবং ইংরেজীতে বলা হয় Income.
পরিভাষায় উপার্জন হলো: জীবন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা।
অন্যভাবে বলা যায় যে, Income is the monetary payment received for goods or services, or from other sources, as rents or investments.[2]
2. মানবজীবনে উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা
ক. জীবন পরিচালনার জন্য উপার্জন আবশ্যকীয় বিষয়
জীবন ধারণ করার জন্য উপার্জনে সক্ষম প্রত্যেককে উপার্জন করতে হবে। উপার্জন ছাড়া পৃথিবীতে বসবাস করা সম্ভব নয়। উপার্জন না করে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আর তাই দেখা যায় যে সালাত শেষ হওয়ার পর উপার্জনে বের হওয়ার কথা আল-কুরআনে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
﴿ فَإِذَا قُضِيَتِ ٱلصَّلَوٰةُ فَٱنتَشِرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَٱبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِ ٱللَّهِ وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرٗا لَّعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ١٠ ﴾ [الجمعة: ١٠]
‘‘অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।’’[3]
খ. পৃথিবী উপার্জন করার একমাত্র ক্ষেত্র
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শুধু সৃষ্টিই করেননি, জীবন পরিচালনার জন্য এ পৃথিবীকে কর্মক্ষেত্র করে দিয়েছেন। সে সাথে উপার্জন করার জন্য অসংখ্য ক্ষেত্রের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ বলেন,
﴿ هُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ ذَلُولٗا فَٱمۡشُواْ فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُواْ مِن رِّزۡقِهِۦۖ وَإِلَيۡهِ ٱلنُّشُورُ ١٥ ﴾ [الملك: ١٥]
‘‘তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে-প্রান্তরে বিচরণ কর এবং তাঁর রিয্ক থেকে তোমরা আহার কর। আর তাঁর নিকটই পুনরুত্থান।’’[4]
গ. পরিবারিক দায়িত্ব পালন করা
প্রত্যেক ব্যক্তিই পরিবারের সদস্য। তাই পরিবারিক দায়িত্ব পালনে তাকে উপার্জন করতে হয়। পরিবারে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা রয়েছে, যা উপার্জন করে মেটাতে হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَعَلَى ٱلۡمَوۡلُودِ لَهُۥ رِزۡقُهُنَّ وَكِسۡوَتُهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ﴾ [البقرة: ٢٣٣]
ঘ. উপার্জন করার ক্ষমতা দুনিয়ার কল্যাণকর বিষয়
উপার্জন করার যোগ্যতা একটি কল্যাণকর বিষয়। এটা আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামাত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে চিন্তা, বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন, দু’টি হাত দিয়েছেন। যাতে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। অপরের নিকট হাত পাততে না হয়। উপার্জন করার মত কল্যাণকর বিষয়ে দু‘আ করার ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আল-কুরআনে,
﴿ وَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٗ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ حَسَنَةٗ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ٢٠١ ﴾ [البقرة: ٢٠١]
‘‘আর তাদের মধ্যে এমনও আছে, যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন আর আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।’’ [6]
ঙ. স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যম
ইসলাম অপরের উপর নির্ভর করে জীবন পরিচালনার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا تَزَالُ الْمَسْأَلَةُ بِأَحَدِكُمْ حَتَّى يَلْقَى اللهَ، وَلَيْسَ فِي وَجْهِهِ مُزْعَةُ لَحْمٍ»
‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমন্ডলে এক টুকরো গোশতও থাকবে না।’’ [7]
চ. উত্তরাধিকারীদের স্বচ্ছল রেখে যাওয়ার উপায়
সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন,
«إِنَّكَ أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَدَعَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ فِي أَيْدِيهِمْ»
‘‘তোমাদের সন্তান সন্তুতিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বী রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।’’ [8]
3. উপার্জনের প্রকারভেদ
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে মানুষের খাদেম করেছেন। মানুষ নির্দেশিত পথে তা থেকে উপার্জন বা সম্পদ আহরণ করবে। ইসলাম এমন একটি জীবন বিধান যা কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الحَلاَلُ بَيِّنٌ، وَالحَرَامُ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشَبَّهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى المُشَبَّهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ: كَرَاعٍ يَرْعَى حَوْلَ الحِمَى، يُوشِكُ أَنْ يُوَاقِعَهُ»
‘‘হালাল বা বৈধ সুস্পষ্ট এবং হারাম বা অবৈধও স্পষ্ট আর এ দু’এর মধ্যবর্তী বিষয়গুলো হলো সন্দেহজনক। আর বেশীরভাগ লোকই সেগুলো (সম্পর্কে সঠিক পরিচয়) জানে না। অতএব যে ব্যক্তি ঐ সন্দেহজনক জিনিসিগুলোকে পরিহার করলো সে তার দ্বীন ও মান-সম্মানকে পবিত্র রাখলো। আর যে ব্যক্তি সন্দেহের মাঝে পতিত হলো তার উদাহরণ ঐ রাখালের মত যে পশু চরায় সংরক্ষেত ভুমির সীমানায় এমনভাবে যে, যে কোনো সময় সে তাতে প্রবেশ করবে।’’।[9]
আলোচ্য হাদীস থেকে বুঝা যায় উপার্জন দুই ধরণের। ক. হালাল উপার্জন খ. হারাম উপার্জন।
· হালাল উপার্জন
এটা আল্লাহ তা‘আলার বান্দার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দার জন্য জমীনে উপার্জন করার বিরাট ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি আমাদের কল্যাণে অগণিত সেক্টর তৈরি করেছেন।
﴿مَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيَجۡعَلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ حَرَجٖ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمۡ وَلِيُتِمَّ نِعۡمَتَهُۥ عَلَيۡكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٦ ﴾ [المائدة: ٦]
‘‘আল্লাহ তোমাদের উপর কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তার নিআমত তোমাদের উপর পূর্ণ করতে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।[10]
3.1. হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও ফযিলাত
ক. হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তার ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। বান্দাহ যেসব ইবাদাত করে থাকে হালাল উপার্জন তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿فَٱبۡتَغُواْ عِندَ ٱللَّهِ ٱلرِّزۡقَ وَٱعۡبُدُوهُ وَٱشۡكُرُواْ لَهُۥٓۖ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ١٧ ﴾ [العنكبوت: ١٧]
‘‘তাই আল্লাহর কাছে রিয্ক তালাশ কর, তাঁর ইবাদাত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।’’[11]
খ. উপার্জনের উৎস সম্পর্কে কিয়ামাতে জিজ্ঞাসা করা হবে
কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে তার উপার্জনের উৎস সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। সেজন্য মুমিনের জন্য হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন,
«لَا تَزُولُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ، عَنْ عُمُرِهِ فِيمَ أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ، وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ»
‘‘কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও স্বস্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না।
১. তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে,
২. যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে,
৩. ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে,
৪. তা কিভাবে ব্যয় করেছে,
৫. সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।’’[12]
১. তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে,
২. যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে,
৩. ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে,
৪. তা কিভাবে ব্যয় করেছে,
৫. সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।’’[12]
গ. ইবাদাত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত
আল্লাহর ইবাদাত করবে অথচ তার উপার্জন হালাল হবে না, এটা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। অতএব হালাল উপার্জন ইবাদাত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ} [المؤمنون: 51] وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ} [البقرة: 172] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟»
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মু’মিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।’’ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘হে ইমানদারগণ তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।’’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে, হে আমার রব, হে আমার রব অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। সুতরাং তার প্রার্থনা কীভাবে কবুল হবে?।’’[13]
ঘ. হালাল উপার্জন করা আল্লাহর পথে বের হওয়ার শামিল
হালাল উপার্জন করার জন্য প্রয়োজনে বিদেশেও যেতে হতে পারে। সেজন্য এটিকে কুরআন মাজীদে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সাথে হালাল উপার্জনকে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَءَاخَرُونَ يَضۡرِبُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ يَبۡتَغُونَ مِن فَضۡلِ ٱللَّهِ وَءَاخَرُونَ يُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۖ ﴾ [المزمل: ٢٠]
ঙ. হালাল উপার্জন আখেরাত বিমুখিতা নয়
আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে এ দুনিয়াতে হালাল উপার্জন করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। সেজন্য উপার্জন করতে বৈধভাবে চাকুরী, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা অন্য কিছু করা আখেরাত বিমুখতা নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱبۡتَغِ فِيمَآ ءَاتَىٰكَ ٱللَّهُ ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَۖ وَلَا تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ ٱلدُّنۡيَاۖ وَأَحۡسِن كَمَآ أَحۡسَنَ ٱللَّهُ إِلَيۡكَۖ وَلَا تَبۡغِ ٱلۡفَسَادَ فِي ٱلۡأَرۡضِۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُفۡسِدِينَ ٧٧ ﴾ [القصص: ٧٧]
‘‘আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান কর। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও সেরূপ অনুগ্রহ কর। আর যমীনে ফাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না।’’[15]
চ. হালাল উপার্জন জান্নাত লাভের উপায়
মানুষের দু’টি জীবন রয়েছে, একটি দুনিয়ায়, অপরটি আখেরাতে। অতএব হালাল পন্থায় উপার্জনকারী দুনিয়াতে কখনও সমস্যায় থাকলেও আখেরাতে জান্নাতে যাবে। এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ أَكَلَ طَيِّبًا، وَعَمِلَ فِي سُنَّةٍ، وَأَمِنَ النَّاسُ بَوَائِقَهُ دَخَلَ الجَنَّةَ»
‘‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জিত খাবার খায় ও সুন্নাতের উপর আমল করে এবং মানুষ তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [16]
ছ. হালাল উপার্জন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন
পৃথিবীর জীবন নির্বাহে হালাল উপার্জন করার সুযোগ বা যোগ্যতা লাভ করা আল্লাহ তাআ’লার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামাত। সেজন্য হালাল পন্থায় উপার্জনকারী পরকালে জান্নাতে যাবে। আর অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে তার জন্য ভয়াবহ আযাব ও শাস্তি অপেক্ষা করছে। হাদীসে এসেছে,
«أربع إذا كن فيك فلا عليك ما فاتك من الدنيا حفظ أمانة وصدق حديث وحسن خليقة وعفة في طعمة»
‘‘চারটি জিনিস যখন তোমার মধ্যে পাওয়া যাবে তখন দুনিয়ার অন্য সব কিছু না হলেও কিছু যায় আসে না। তা হলো, আমানতের সংরক্ষণ, সত্য কথা বলা, সুন্দর চরিত্র, হালাল উপার্জনে খাদ্যগ্রহণ’’[17]
3.2. হালাল উপার্জনের সম্ভাব্য কিছু মাধ্যম
উপার্জন হল মানুষের সম্পদ লাভের প্রক্রিয়া। ইসলাম নির্দেশিত পথে মানুষ যে উপার্জন করে সেটিকে আমরা হালাল উপার্জন বলবো। পৃথিবীতে নানা উৎসে সম্পদরাজিকে আল্লাহ ছড়িয়ে রেখেছেন। মানুষকে অর্জন করতে হয় এই অর্জন প্রক্রিয়ায় নানাবিধ মাধ্যম। ইসলাম হালাল উপার্জন করার জন্য কী কী মাধ্যম হতে পারে তার স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে। মাধ্যমগুলো হলো কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও চাকুরি। এ মাধ্যমগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে তার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।
ক. কৃষি
সৃষ্টিকূলের খাদ্যের উৎস কৃষি। মহান রাব্বুল আলামীন মানুষের কৃষি কাজের সুবিধার্থে পৃথিবীর মাটি ও ভূমিকে উৎপাদন ও ফসল ফলানোর উপাযোগী বানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَلۡيَنظُرِ ٱلۡإِنسَٰنُ إِلَىٰ طَعَامِهِۦٓ ٢٤ أَنَّا صَبَبۡنَا ٱلۡمَآءَ صَبّٗا ٢٥ ثُمَّ شَقَقۡنَا ٱلۡأَرۡضَ شَقّٗا ٢٦ فَأَنۢبَتۡنَا فِيهَا حَبّٗا ٢٧ وَعِنَبٗا وَقَضۡبٗا ٢٨ وَزَيۡتُونٗا وَنَخۡلٗا ٢٩ وَحَدَآئِقَ غُلۡبٗا ٣٠ وَفَٰكِهَةٗ وَأَبّٗا ٣١ مَّتَٰعٗا لَّكُمۡ وَلِأَنۡعَٰمِكُمۡ ٣٢ ﴾ [عبس: ٢٤، ٣٢]
‘‘মানুষের কর্তব্য তার খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া-চিন্তা করা। আমিই বৃষ্টি বর্ষণ করি, পরে জমি বিস্ময়করভাবে দীর্ণ করি। আর তাতে শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবাজি, তরি-তরকারি, যয়তুন, খেজুর, বিশিষ্ট উদ্যানসমূহ, ফল এবং গবাদি-খাদ্য উৎপাদন করি, তোমাদের ও তোমাদের পশুর ভোগের জন্য’’।[18]
আলো-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, সমভূমি-মরুভূমি সর্বত্র মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টজীবের জীবিকার অসীম উপকরণ রেখে দিয়েছেন- যার অংশ বিশেষও কিয়ামত পর্যন্ত নিঃশেষিত হবে না। আলকুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তার সহজসাধ্যতার উপায়-উপকরণের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যেন মানুষ তা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। আর এ পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আল্লাহ তা‘আলার এ নিয়ামাত যে ব্যক্তি বা জাতি নিয়মিত ও পরিমিতভাবে আহরণ করতে পারে, সে ব্যক্তি বা জাতি তো সমৃদ্ধশালী হবেই।
খ. শিল্প
মানুষের জীবন যাপনের চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষি যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন শিল্পোন্নয়ন। অনেক কৃষিজাত দ্রব্য শিল্পের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী না করলে তা থেকে মানুষ উপকার লাভ করে না। ইসলাম কৃষি কাজের উৎসাহ দিয়েছে। তবে সকলে এ কাজে মগ্ন থাকা থাকতে হবে এমনটি নয়। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় বিপদ-আপদের মোকাবেলা কেবল মাত্র কৃষি দ্বারা সম্ভব নয়। এ জন্য কৃষি কাজের সাথে সাথে শিল্প পেশার কাজ করাও জরুরী। এ আকাশ-বাতাস, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, মাটি-বালি ও তার তলদেশে মহান আল্লাহ তা‘আলা যে সম্পদ সৃষ্টি করে রেখেছেন, তার সদ্ব্যবহারের জন্য শিল্পোন্নয়ন জরুরী। শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ সমৃদ্ধি ছাড়া জাতীয় আয়বৃদ্ধি করা যায় না। শিল্পকর্মের প্রতি পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَعَلَّمۡنَٰهُ صَنۡعَةَ لَبُوسٖ لَّكُمۡ لِتُحۡصِنَكُم مِّنۢ بَأۡسِكُمۡۖ فَهَلۡ أَنتُمۡ شَٰكِرُونَ ٨٠ ﴾ [الانبياء: ٨٠]
‘‘আর আমরা তাকে বর্ম তৈরি করার শিল্পবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলাম যেন তা যুদ্ধে তোমাদের প্রতি রক্ষা করতে পারে তাহলে তোমরা কি শোকর আদায় করবে।’’[19] সোলাইমান (আ.)-এর উঁচু উঁচু প্রাসাদ, বড় বড় পানি সঞ্চয় পাত্র এবং নূহ (আ.) এর নৌকা তৈরি বর্ণনা পবিত্র কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ নবীই শিল্পকাজে জড়িত ছিলেন। যাকারিয়্যাহ আলাইহিস সালাম ছিলেন কাঠমিস্ত্রি তাও আমরা হাদীস থেকে জানতে পারি।
গ. ব্যবসা
ব্যবসা-বাণিজ্য একটি সম্মানজনক পেশা। জীবিকা অর্জনের এটি একটি অন্যতম উপায়। যাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ রয়েছে তারা এই পেশা অবলম্বন করে। যে জনপদের উপর আল্লাহ তা‘আলার রহমত রয়েছে যে জনপদে ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ ﴾ [البقرة: ٢٧٥]
ব্যবসায়ীরা সাধারণ উদ্বৃত্ত অঞ্চলের সামগ্রী ঘাটতি অঞ্চলে পৌঁছিয়ে দিয়ে উদ্বৃত্ত অঞ্চলের অপচয় রোধ করে আর ঘাটতি অঞ্চলের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করে মানব সমাজের সে সেবা করছে তা সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ অনেক নবী-রাসূল, তাছাড়া অনেক সাহাবী যেমন আবু বকর, উমার, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুম ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন।
ঘ. চাকুরি
জীবিকা অর্জনের আরেকটি অন্যতম উপায় হচ্ছে চাকরি। চাকরির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করা ইসলামী আইনে বৈধ। তবে তাকে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ সক্ষম হতে হবে। ইসলামে চাকরি লাভের অন্যতম শর্ত হচ্ছে যোগ্যতা অর্জন। যথাযথ যোগ্যতা অর্জন ছাড়া কোনো পদের জন্য আবেদন করা ঠিক নয়। হারাম কাজ জনগণের ক্ষতিকারক কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। এক্ষেত্রে আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে,
«قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَا تَسْتَعْمِلُنِي قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِي ثُمَّ قَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةُ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ إِلَّا مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا»
‘‘আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিবেন না ! একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত আমার কাঁধের উপর রেখে বললেন, হে আবু যার! তুমি বড় দুর্বল ব্যক্তি। আর এ পদ হচ্ছে কঠিন আমানতের ব্যাপার। কিয়ামতের দিন তা-ই হবে লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ, তবে যে লোক এ দায়িত্বপূর্ণ যোগ্যতার সাথে সে দায়িত্ব গহণ করে এবং দক্ষতা ও সততার সাথে যথাযথভাবে তা পালন করবে তার বেলায় নয়।[21]
চাকরির ক্ষেত্রে ইসলামী আইন হচ্ছে উপযুক্ততা ও পরোপকারিতা। চাকুরিজীবিগণ স্ব স্ব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করবে এবং পরোপকারের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করবে।
3.3. হালাল উপার্জনের মূলনীতি
ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মূলনীতি রয়েছে। এ নীতিগুলো অনুসরণ না করলে উপার্জন হালাল হবে না। যা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
ক. উপার্জেয় বস্তুটি হালাল হওয়া
একজন ব্যক্তি যা উপার্জন করবে সে উপার্জেয় বস্তুটি অবশ্যই হালাল হতে হবে। আর ইসলাম কল্যাণকর সকল বস্তুকে মানবজাতির জন্য হালাল করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ كُلُواْ مِمَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ حَلَٰلٗا طَيِّبٗا وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٌ ١٦٨ ﴾ [البقرة: ١٦٨]
‘‘হে মানুষ পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যিব যা রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’’[22]
খ. উপার্জেয় বস্তুটি পবিত্র (তাইয়্যিব) হওয়া
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَكُلُواْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَٰلٗا طَيِّبٗاۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِيٓ أَنتُم بِهِۦ مُؤۡمِنُونَ ٨٨ ﴾ [المائدة: ٨٨]
‘‘আর আহার কর আল্লাহ যা তোমাদের রিয্ক দিয়েছেন তা থেকে হালাল, পবিত্র বস্তু। আর তাকওয়া অবলম্বন কর আল্লাহর যার প্রতি তোমরা মুমিন।’’[23]
সুতরাং শুধুমাত্র হালাল হলেই চলবে না; বরং তা অবশ্যই তাইয়্যিব (পবিত্র ও উত্তম) হতে হবে। এখানে তাইয়্যিব বলতে ভেজালমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত ইত্যাদি উদ্দেশ্য। এমন উপায় অবলম্বন করতে হবে যা মূলগতভাবেই নির্ভেজাল, খাটি ও পবিত্র। অবশ্য অধিকাংশ মুফাসসিরগণ আয়াতে হালাল শব্দ দ্বারা ‘মূলগত বৈধতা’ এবং ‘তাইয়্যিব’ দ্বারা পদ্ধতিগত বৈধতার অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং এ দু’শব্দ দিয়ে দু’টি মূলনীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
গ. উপার্জনের ক্ষেত্রে মাধ্যমটি বৈধ হওয়া
উপার্জনের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় উপায় ও মাধ্যমটি অবশ্যই বৈধ পন্থায় হতে হবে। কেননা যাবতীয় অবৈধ উপায় ও পন্থায় অর্থসম্পদ উপার্জন করতে ইসলাম নিষেধ করেছে। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুমিনগণকে সর্তক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ ﴾ [النساء: ٢٩]
‘‘হে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’’[24]
ঘ. উপার্জনে কম বা বেশি হওয়াকে পরীক্ষা হিসেবে মনে করা
বেশি বা কম উপার্জন করার মধ্যে আল্লাহ পরীক্ষা করে থাকেন। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ فَأَمَّا ٱلۡإِنسَٰنُ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ رَبُّهُۥ فَأَكۡرَمَهُۥ وَنَعَّمَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّيٓ أَكۡرَمَنِ ١٥ وَأَمَّآ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ فَقَدَرَ عَلَيۡهِ رِزۡقَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّيٓ أَهَٰنَنِ ١٦ ﴾ [الفجر: ١٥، ١٦]
‘‘আর মানুষ তো এমন যে, যখন তার রব তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মান দান করেন এবং অনুগ্রহ প্রদান করেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার উপর তার রিয্ককে সঙ্কুচিত করে দেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন’।’’[25]
ঙ. উপার্জন আল্লাহর বিধান পালনে প্রতিবন্ধক হতে পারবে না
অনেক সময় উপার্জন করতে করতে আল্লাহর কথা স্মরণ থাকে না। আল্লাহর ইবাদাতের কথা ভুলে যায়। এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُلۡهِكُمۡ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٩ ﴾ [المنافقون: ٩]
‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’’[26]
চ. কেবল সম্পদ অর্জনই আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় নয়
কেবল সম্পদ অর্জন আল্লাহর নৈকট্য লাভে বাঁধাও হতে পারে, এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ وَمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُكُم بِٱلَّتِي تُقَرِّبُكُمۡ عِندَنَا زُلۡفَىٰٓ إِلَّا مَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَأُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ جَزَآءُ ٱلضِّعۡفِ بِمَا عَمِلُواْ وَهُمۡ فِي ٱلۡغُرُفَٰتِ ءَامِنُونَ ٣٧ ﴾ [سبا: ٣٧]
‘‘আর তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন বস্তু নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দেবে। তবে যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে, তারাই তাদের আমলের বিনিময়ে পাবে বহুগুণ প্রতিদান। আর তারা (জান্নাতের) সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে থাকবে।’’[27]
ছ. রিযক দেরিতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করা
রিযক দেরিতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা যাবে না। জাবের রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا تَسْتَبْطِئُوا الرِّزْقَ، فَإِنَّهُ لَنْ يَمُوتَ الْعَبْدُ حَتَّى يَبْلُغَهُ آخِرُ رِزْقٍ هُوَ لَهُ، فَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ أَخَذِ الْحَلالِ، وَتَرَكِ الْحَرَامِ»
‘রিযক দেরিতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করো না। কেননা কোনো বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মারা যায় না যতক্ষণ না তার নির্ধারিত শেষ রিযক তার কাছে পৌঁছে যায়। অতঃপর তোমরা হালাল রিযক সুন্দরভাবে তালাশ করো। হালাল গ্রহণ কর, আর হারাম থেকে বিরত হও।’[28]
3.4. হালাল উপার্জনে অর্জনীয়
ক. সততা
উপার্জন হালাল করার ক্ষেত্রে সততা থাকতে হবে। উপার্জেয় বস্তু হালাল এবং পদ্ধতিগতভাবে হালাল হলেও সততা না থাকলে উপার্জন হালাল হবে না। আর সততা অর্জন করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার বিরাট সুযোগ রয়েছে। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ
‘‘আবু সাঈদ খুদরী রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) নবীগণ, সিদ্দিকীন ও শহীদদের সাথে থাকবে।”[29]
খ. আমানতদারিতা
আমানতদারিতা এমন একটি গুণ যা হালাল উপার্জন করার জন্য অপরিহার্য। আমানতদারিতা না থাকলে উপার্জন হালাল হবে না । আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَإِنۡ أَمِنَ بَعۡضُكُم بَعۡضٗا فَلۡيُؤَدِّ ٱلَّذِي ٱؤۡتُمِنَ أَمَٰنَتَهُۥ وَلۡيَتَّقِ ٱللَّهَ رَبَّهُۥۗ ﴾ [البقرة: ٢٨٣]
‘‘আর যদি তোমরা একে অপরকে বিশ্বস্ত মনে কর, তবে যাকে বিশ্বস্ত মনে করা হয়, সে যেন স্বীয় আমানত আদায় করে এবং নিজ রব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে।’’[30]
গ. ওয়াদা পালন করা
চাকরি বা ব্যবসায় যেসব ওয়াদা করা হবে তা অবশ্যই পালন করতে হবে। ওয়াদা পালন করে হালাল উপার্জন করার পাশাপাশি আল্লাহর ভালবাসাও পাওয়া যায়। আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন,
﴿ بَلَىٰۚ مَنۡ أَوۡفَىٰ بِعَهۡدِهِۦ وَٱتَّقَىٰ فَإِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَّقِينَ ٧٦ ﴾ [ال عمران: ٧٦]
‘‘হ্যাঁ, অবশ্যই যে নিজ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেন।’’[31]
তাছাড়া ওয়াদাপূরণ জান্নাতে যাওয়ার কারণ হবে। উবাদা ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«اضْمَنُوا لِي سِتًّا أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ اصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ وَأَدُّوا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ وَغُضُّوا أبصاركم وكفوا أيديكم»
‘তোমরা আমাকে ছয়টি বিষয়ের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমদেরকে জান্নাতে যাওয়ার যামীন হব, যখন কথা বলবে সত্য বলবে, যখন ওয়াদা করবে তা পূরণ করবে, যখন আমানত গ্রহণ করবে তখন তা আদায় করবে, তোমাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, তোমাদের চক্ষুগুলো নীচু করে রাখবে এবং হাতগুলো নিয়ন্ত্রনে রাখবে’।[32]
ঘ. আন্তরিকতা
উপার্জন হালাল করার জন্য উক্ত কাজে আন্তরিক হতে হবে। কথা ও কাজের গরমিল পাওয়া গেলে হালাল উপার্জন থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। আন্তরিকতার ঘাটতি মুনাফিকের লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَقُولُونَ بِأَفۡوَٰهِهِم مَّا لَيۡسَ فِي قُلُوبِهِمۡۚ ﴾ [ال عمران: ١٦٧]
ঙ. স্বচ্ছতা
উপার্জন হালাল করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে, কোনো গোজামিল বা অস্পষ্টতা থাকতে পারবে না । আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠ ﴾ [الاحزاب: ٧٠]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿ قُلۡ إِن تُخۡفُواْ مَا فِي صُدُورِكُمۡ أَوۡ تُبۡدُوهُ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٩ ﴾ [ال عمران: ٢٩]
‘‘বল, ‘তোমরা যদি তোমাদের অন্তরসমূহে যা আছে তা গোপন কর অথবা প্রকাশ কর, আল্লাহ তা জানেন। আর আসমানসমূহে যা কিছু আছে ও যমীনে যা আছে, তাও তিনি জানেন। আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।’’[35]
চ. শৃঙ্খলা
ব্যক্তির মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ থাকতে হবে। এমন বিধি-বিধান যা কুর’আন সুন্নাহ বিরোধী নয় তা মেনে চলতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ﴾ [النساء: ٥٩]
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের।’’ [36]
ছ. ইলম অর্জন করা
যেহেতু ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা চালু নেই, সেজন্য ব্যক্তিকে হালাল উপার্জন করার জন্য ইলম অর্জন করতে হবে। কারণ তাকে জানতে হবে কোনটি হারাম আর কোনটি হালাল। কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ قُلۡ مَنۡ حَرَّمَ زِينَةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِيٓ أَخۡرَجَ لِعِبَادِهِۦ وَٱلطَّيِّبَٰتِ مِنَ ٱلرِّزۡقِۚ﴾ [الاعراف: ٣٢]
‘‘বল, ‘কে হারাম করেছে আল্লাহর সৌন্দর্যোপকরণ, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র রিয্ক?’’[37]
· হারাম উপার্জন
হারাম উপার্জন সম্পর্কে জানা না থাকলে উপার্জনকে শতভাগ হালাল করা যাবে না। সেজন্য কোনটি হারাম উপার্জন তা সম্পর্কেও জানতে হবে । এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَدۡ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيۡكُمۡ ﴾ [الانعام: ١١٩]
হারাম উপার্জন দুইভাবে হতে পারে: একটি বস্তুগত হারাম অপরটি হলো পদ্ধতিগত হারাম।
১. বস্তুগত হারাম
কিছু কিছু বস্তু রয়েছে যা মূলগতভাবেই হারাম। এগুলোকে কোনভাবেই হালাল করার সুযোগ নেই। যেমন: মদ, চুরি করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, শুকরের গোশত, মৃত প্রাণির গোশত ইত্যাদি।
২. পদ্ধতিগত হারাম
কিছু কিছু বস্তু রয়েছে যা মূলগত হারাম নয় পদ্ধতির কারণে হারাম। যেমন, সুদ, ঘুষ বা উপরি আয় বা বখশিস বা Invisible cost বা speed money, জুয়া, লটারী, ধোঁকা, প্রতারণা, মওজুদদারী, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, ফটকাবাজারী, চোরাচালান, চটকদার ভুয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করা, ওযন ও পরিমাপে কম দেয়া, মালে ভেজাল মেশানো, ভেজাল পণ্য বিক্রি করা, বেশ্যাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি অশস্নীলতা প্রসারকারী ব্যবসা, অশ্লীল নাচ-গান, মাদক দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবসা, মূর্তি বানানো ও মূর্তির ব্যবসা, ভাগ্য গণনার ব্যবসা, জবরদখল, লুন্ঠন, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, মাস্তানী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, আত্মসাৎ, চোরাইমাল ক্রয়-বিক্রয়, খেয়ানত, ধাপ্পাবাজি, সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো ইত্যাদি।
৪.৫. হালাল উপার্জনে বর্জনীয়
ক. মিথ্যাচার ও প্রতারণা
মিথ্যা এমন একটি খারাপ গুণ যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আর মিথ্যা কথা বলে যে উপার্জন করা হবে তা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ »
‘‘আর তোমরা মিথ্যাচার থেকে বেঁচে থাকো, কেননা মিথ্যা নিয়ে যায় পাপ কাজের দিকে, আর পাপকাজ জাহান্নামে নিক্ষেপ করে’’।[39]
খ. লোভ-লালসা
সম্পদ অর্জনে অবশ্যই লোভ-লালসাকে বর্জন করতে হবে। লোভ-লালসা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। এ থেকে বিরত থাকার জন্য আলকুরআনে বিশেষভাবে তাকীদ দেয়া হয়েছে।
﴿ أَلۡهَىٰكُمُ ٱلتَّكَاثُرُ ١ حَتَّىٰ زُرۡتُمُ ٱلۡمَقَابِرَ ٢ كَلَّا سَوۡفَ تَعۡلَمُونَ ٣ ثُمَّ كَلَّا سَوۡفَ تَعۡلَمُونَ ٤ ﴾ [التكاثر: ١، ٤]
‘‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরের সাক্ষাৎ করবে। কখনো নয়, শীঘ্রই তোমরা জানবে’’।[40]
গ. সুদের সম্পৃক্ততা থাকা
সুদ দেওয়া, নেওয়া বা এর সাথে কোনো ধরণের সম্পৃক্ততা রাখা যাবে না । কেননা কুরআনে এসেছে,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَذَرُواْ مَا بَقِيَ مِنَ ٱلرِّبَوٰٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٢٧٨ فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ فَأۡذَنُواْ بِحَرۡبٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَإِن تُبۡتُمۡ فَلَكُمۡ رُءُوسُ أَمۡوَٰلِكُمۡ لَا تَظۡلِمُونَ وَلَا تُظۡلَمُونَ ٢٧٩ ﴾ [البقرة: ٢٧٨، ٢٧٩]
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলুম করবে না এবং তোমাদের যুলুম করা হবে না।’’[41]
ঘ. যুলুম করা
ইসলামে যেকোনো ধরণের যুলুম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা যুলুমের ভয়াবহ পরিণাম রয়েছে। সেজন্য তা থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ ؟ قَالُوا : الْمُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ ، وَلاَ مَتَاعَ لَهُ ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ ، فَيَأْتِي وَقَدْ شَتَمَ هَذَا ، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا ، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا ، فَيَقْعُدُ ، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُعْطِيَ مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ ، فَطُرِحَ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ»
তোমরা কি জান কপর্দকহীন কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো কপর্দকহীন। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো কপর্দকহীন, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমলনামা দিয়ে দেওয়া হবে।[42]
ঙ. অপচয় ও অপব্যয় করা
ব্যবসা-বণিজ্য ও সম্পদ অর্জন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই যেকোন ধরণের অপচয় ও অপব্যয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল-কুরআনের ঘোষণা,
﴿وَءَاتِ ذَا ٱلۡقُرۡبَىٰ حَقَّهُۥ وَٱلۡمِسۡكِينَ وَٱبۡنَ ٱلسَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرۡ تَبۡذِيرًا ٢٦ إِنَّ ٱلۡمُبَذِّرِينَ كَانُوٓاْ إِخۡوَٰنَ ٱلشَّيَٰطِينِۖ وَكَانَ ٱلشَّيۡطَٰنُ لِرَبِّهِۦ كَفُورٗا ٢٧ ﴾ [الاسراء: ٢٦، ٢٧]
‘‘আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। আর কোনভাবেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ’’।[43]
﴿ ۞يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ خُذُواْ زِينَتَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِدٖ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ وَلَا تُسۡرِفُوٓاْۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُسۡرِفِينَ ٣١ ﴾ [الاعراف: ٣١]
‘‘হে বনী আদম, তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের বেশ-ভূষা গ্রহণ কর এবং খাও, পান কর ও অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না।’’[44]
চ. ঘুষের সম্পৃক্ততা
ঘুষ দেওয়া, নেওয়া বা এর সাথে কোনো ধরণের সম্পৃক্ততা রাখার কোনো সুযোগ নেই। কেননা হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ «لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- الرَّاشِىَ وَالْمُرْتَشِىَ»
‘‘আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহণকারী উভয়কে লানত দিয়েছেন’’।[45]
ছ. খেয়ানত করা
খেয়ানতের মাধ্যমে যে উপার্জন করা হয় তা অবৈধ। তাই সকল প্রকার খেয়ানত থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ»
৫. হারাম উপার্জনের ক্ষতিকর দিকসমূহ
ক. আল্লাহর নির্দেশ অবজ্ঞা করার শামিল
আল্লাহ তা‘আলা কোনটি হালাল ও কোনটি হারাম তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে হারাম পথ বেছে নিবে সে আল্লাহর নির্দেশকে অবজ্ঞা করলো এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলো। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল উপায় অবলম্বন করতে হবে। যারা হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না, তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে বলেন,
«يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ»
‘‘মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোনো উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোনো ভ্রম্নক্ষেপ করবে না।’[47]
খ. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ
হারাম উপার্জন জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
»كُلُّ جَسَدٍ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ فَالنَّارُ أَوْلَى بِه»
গ. জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক
হারাম উপার্জন জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক হবে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«يَا كَعْبُ بْنَ عُجْرَةَ، إِنَّهُ لَنْ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ»
ঘ. হারাম উপার্জন যালিমের হাতিয়ার
যখন সমাজে হারাম উপার্জন করার সুযোগ থাকে তখন যুলুম-নির্যাতন ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। আর যুলুমের মাধ্যমে অসহায় মানুষ নানাবিধ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ أَمۡوَٰلَ ٱلۡيَتَٰمَىٰ ظُلۡمًا إِنَّمَا يَأۡكُلُونَ فِي بُطُونِهِمۡ نَارٗاۖ وَسَيَصۡلَوۡنَ سَعِيرٗا ١٠ ﴾ [النساء: ١٠]
‘‘নিশ্চয় যারা ইয়াতীমদের ধন-সম্পদ যুলুমের মাধ্যমে ভক্ষণ করে তারা তো তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে; আর অচিরেই তারা প্রজ্জ্বলিত আগুনে প্রবেশ করবে।’’[50]
ঙ. হারাম উপার্জনের দান আল্লাহ গ্রহণ করেন না
হারাম উপার্জন এমন খারাপ জিনিস যা থেকে দান করলেও কোনো লাভ নেই এবং আল্লাহ তা‘আলা তা গ্রহণ করেন না। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لاَ يَقْبَلُ اللَّهُ صَلاَةً بِغَيْرِ طَهُورٍ وَلاَ صَدَقَةً مِنْ غُلُولٍ»
‘‘আল্লাহ তা‘আলা পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত কবুল করেন না, আর হারাম উপার্জনের দানও আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না।’’[51]
৬. হারাম উপার্জন থেকে তাওবাহ
আমাদের উপার্জনের মধ্যে জেনে বা না জেনে অনেক সময় হারাম উপার্জন হয়ে থাকতে পারে। এমতাবস্থায় আমরা তাওবা করার মাধ্যমে পরিত্রাণ পেতে পারি। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَئَِّاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ ﴾ [التحريم: ٨]
‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা, আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’’[52]
ক. হারাম উপার্জন করার জন্য অনুতপ্ত হওয়া
নিজের উপার্জনের মধ্যে হারাম কোনো কিছু থাকলে তার জন্য অনুতপ্ত হতে হবে এবং অনুশোচনা করতে হবে। হারাম উপার্জন করার পর নিজের মনের মধ্যে ব্যাকুলতা অনুভব করবে, এজন্য নিজেকে হীন মনে করবে । এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿ إِنَّمَا ٱلتَّوۡبَةُ عَلَى ٱللَّهِ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسُّوٓءَ بِجَهَٰلَةٖ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٖ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَتُوبُ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمٗا ١٧ ﴾ [النساء: ١٧]
‘‘নিশ্চয় তাওবা কবুল করা আল্লাহর জিম্মায় তাদের জন্য, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে। তারপর শীঘ্রই তাওবাহ করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তাওবা কবুল করবেন আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’’[53]
খ. হারাম উপার্জন না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা
হারাম উপার্জন করতে থাকা অবস্থায় তাওবা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যে কোনো ধরণের হারাম উপার্জন না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَٰحِشَةً أَوۡ ظَلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ ذَكَرُواْ ٱللَّهَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ لِذُنُوبِهِمۡ وَمَن يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ إِلَّا ٱللَّهُ وَلَمۡ يُصِرُّواْ عَلَىٰ مَا فَعَلُواْ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٣٥ ﴾ [ال عمران: ١٣٥]
‘‘যারা অশস্নীল কাজ করার পর অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করার পর আল্লাহকে স্মরণ করে এরপর নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর আল্লাহ ব্যতীত গুনাহসমূহ ক্ষমা করতে কেউ সক্ষম নয় এবং তারা নিজেদের কৃতকর্মের উপর অটল থাকে না এবং তারা (গুনাহের বা পাপের উপর অটল থাকার ভীষণ পরিণাম) জানে।’’[54]
গ. হালাল উপার্জন ও হারাম উপার্জনকে পৃথক করা
বুঝা বা উপলব্ধির সাথে সাথে হালাল উপার্জন ও হারাম উপার্জনকে পৃথক করে ফেলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ قُل لَّا يَسۡتَوِي ٱلۡخَبِيثُ وَٱلطَّيِّبُ وَلَوۡ أَعۡجَبَكَ كَثۡرَةُ ٱلۡخَبِيثِۚ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ١٠٠ ﴾ [المائدة: ١٠٠]
‘‘বল,‘অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের আধিক্য তোমাকে মুগ্ধ করে। অতএব হে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা, আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। যাতে তোমরা সফলকাম হও।’’[55]
ঘ. অর্জিত হারাম উপার্জন সওয়াবের আশা না করে শুধু দায়মুক্তির জন্য জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা
হারাম পথে উপার্জন করা মাল নিজের কাছে গচ্ছিত রাখার সুযোগ নেই। বরং তা সওয়াবের আশা না করে কেবল দায়মুক্তির আশায় জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে ফেলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا كَسَبۡتُمۡ وَمِمَّآ أَخۡرَجۡنَا لَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِۖ وَلَا تَيَمَّمُواْ ٱلۡخَبِيثَ مِنۡهُ تُنفِقُونَ وَلَسۡتُم بَِٔاخِذِيهِ إِلَّآ أَن تُغۡمِضُواْ فِيهِۚ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ ٢٦٧ ﴾ [البقرة: ٢٦٧]
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা ব্যয় কর উত্তম বস্তু, তোমরা যা অর্জন করেছ এবং আমি যমীন থেকে তোমাদের জন্য যা উৎপন্ন করেছি তা থেকে এবং নিকৃষ্ট বস্তুর ইচ্ছা করো না যে, তা থেকে তোমরা ব্যয় করবে। অথচ চোখ বন্ধ করা ছাড়া যা তোমরা গ্রহণ করো না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত’’।[56]
ঙ. কোনো প্রতিষ্ঠানের হক নষ্ট হলে বা খেয়ে ফেললে তা দ্রুত ফেরত দেওয়া
কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান, কোম্পানীর কোনো হক নষ্ট করলে বা মাল হারাম পন্থায় ভোগ করলে তা দ্রুত ফেরত দিতে হবে। কেননা আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنِ اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِينِهِ فَقَدْ أَوْجَبَ اللَّهُ لَهُ النَّارَ وَحَرَّمَ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ». فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ وَإِنْ كَانَ شَيْئًا يَسِيرًا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ « وَإِنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ ».
“যে ব্যক্তি তার নিজ হাতে কোনো মুসলিমের হক খেয়ে ফেলে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেন। জান্নাত হারাম করে দেন। একজন লোক প্রশ্ন করলো, যদি তা সামান্য বস্তু হয়। তখন তিনি বললেন, দেখতে যদি তা আরাক গাছের ডাল পরিমাণও হয়।”[57]
চ. মাফ চেয়ে নেওয়া
কারো কোনো মাল খেয়ে ফেলার পর যদি তা ফেরত দেওয়ার সামর্থ না থাকে, তবে সে মাফ চেয়ে নিবে। কেননা হাদীসে এসেছে, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ ، أَوْ شَيْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ ، وَلاَ دِرْهَمٌ إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ»
‘যদি কেউ তার ভাইয়ের ওপর যুলুম করে থাকে, হোক তা মান-ইজ্জত অথবা সম্পদ বিষয়ক, সে যেন আজই তা থেকে দায়মুক্ত হয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যখন কোনো টাকা পয়সার লেনদেন হবে না। সেদিন যদি তার নেক আমল থেকে থাকে তবে যুলুম পরিমাণ নেক আমল তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তবে মাযলুম ব্যক্তির গুনাহ নিয়ে তার ওপর চাপানো হবে’।[58]
ছ. বেশি বেশি সদকাহ বা ভাল কাজ করা
বেশি বেশি সদকাহ বা ভাল কাজ করার মাধ্যমে পরিত্রাণ পাবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কেননা সওয়াবের কাজের মাধ্যমে গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّ ٱلۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ ٱلسَّئَِّاتِۚ ﴾ [هود: ١١٤]
জ. আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা
আল্লাহ তা‘আলা চান তার বান্দারা আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করুক। আর কোনো বান্দাহ অন্যায় করার পর তার নিকট ক্ষমা চাইলে তা ক্ষমা করে দেন। সেজন্য বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ سُوٓءًا أَوۡ يَظۡلِمۡ نَفۡسَهُۥ ثُمَّ يَسۡتَغۡفِرِ ٱللَّهَ يَجِدِ ٱللَّهَ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ١١٠ ﴾ [النساء: ١١٠]
‘‘আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি যুলম করবে তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’[60]
৭. উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা থেকে সাব্যস্ত হলো যে, আমাদেরকে হালাল উপার্জনের জন্য উল্লিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। উপার্জন করার সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোনোভাবেই হারাম উপার্জনের দিকে আমরা না যাই এবং যাবতীয় হারাম উপার্জনের পথ থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমনিভাবে সতর্ক থাকতেন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু। একদা আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এক চাকর তাঁকে কিছু খাবার দিল। খাওয়া শেষ হলে তিনি দাসকে জিজ্ঞেস করলেন,
«فمن أين الطعامُ يا غلام ؟ قال : دَفعه إليَّ أناسٌ كنتُ أحسنتُ إليهم في الجاهلية بكهانةٍ صنعتُها لهم ، وهنا ارتعدتْ فرائصُ الصديق ، وأدخلَ يده في فمه ، وقاء كلَّ ما في بطنهِ وقال : "واللهِ لو لم تخرجْ تلك اللقمة إلا مع نفسي لأخرجتها»
‘‘এটা কোথা থেকে এসেছে? এ প্রশ্নের জবাবে সে বলল, আমি জাহিলী যুগে এক ব্যক্তির ভাগ্য গণনা করেছি। অথচ আমি ভাগ্য গণনায় পারদর্শী নই। আমি লোকটিকে ধোঁকা দিয়েছি। আর সে আমাকে এটা দিয়েছে। আর তাই আপনি এইমাত্র খেলেন। এ কথা শুনে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ মুখে হাত ঢুকিয়ে বমি করে দিলেন। পেটে যা ছিল সব বের করে দিলেন। অত:পর বললেন, আল্লাহর শপথ, ‘যদি তা বের করতে গিয়ে আমার জীবন দিতে হতো তবে আমি তাই করতাম’ ।’’[61]
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে হালাল উপার্জন করা ও হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন। আমীন।
গ্রন্থপঞ্জি
আল-কুরআন।
আল-বুখারী, ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল. (১৪০০ হি.). সহীহ আল-বুখারী. দেওবন্দ: মাকতাবা মুস্তাফায়ী.
ইমাম মুসলিম. (তা.বি.). সহীহ মুসলিম, বিশেস্নষণ: ইমাম নবুভী (র.). কলকাতা: দার আল-ইশা’আত আল-ইসলামিয়াহ.
তিরমিযী, ইমাম আবু ঈসা. (তা.বি.). সুনান আত্-তিরমিযী.. দেওবন্দ
আলবানী, নাসির উদ্দীন, আসসিলসিলাতুস সহীহাহ।
আবু হাতিম, মুহাম্মাদ ইবন হাববান বিন আহমাদ আততামিমী আবাসতী, সহীহ ইবন হিব্বান।
আলবানী, নাসির উদ্দীন, সহীহ জামিউস সাগীর।
আল-বায্যার, আবু বকর আহমাদ বিন আমর বিন আবদুল খালিক, মুসনাদুল বায্যার।
ইবন খুযাইমাহ, সহীহ ইবন খুযাইমাহ।
<http://dictionary.reference.com/browse/income>, Retrieved August 25, 2012.
সম্পাদনা পরিষদ, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ৫ম পুনর্মুদ্রণ ২০০৩)।
মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম, প্রচলিত ও ইসলামী আইনে উপার্জন প্রসঙ্গ : একটি পর্যালোচনা, ইসলামী আইন ও বিচার, সংখ্যা:৩০, বর্ষ:৮, ঢাকা থেকে প্রকাশিত
মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম, প্রচলিত ও ইসলামী আইনে উপার্জন প্রসঙ্গ : একটি পর্যালোচনা, ইসলামী আইন ও বিচার, সংখ্যা:৩০, বর্ষ:৮, ঢাকা থেকে প্রকাশিত
প্রফেসর ড. আবদুল হালিম উমার, আততাওবাতু মিন মালিল হারাম,আলআযহার বিশ্ববিদ্যালয়,মিশর,১১অক্টোবর ১৯৯৯
ড.মুহাম্মাদ নুরুল ইসলাম, ইসলামে সম্পদ অর্জন, ব্যয় ও বণ্টন, জমজম প্রকাশনী,ঢাকা,১ জানুয়ারি,২০১০
<http://d1.islamhouse.com/data/bn/ih_books/single/bn_islam_e_halal_uparjon_gurutto_o_tatporzo.doc
[16] . ইমাম তিরমীযি, আল-সুনান, খ- ৪,পৃ. ৬৬৯, হাদীস নং ২৫২০, হাকিম হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন, আলবানীর মতে দায়ীফ।
[28]. মুহাম্মাদ ইবন হিব্বান ইবন আহমাদ আবু হাতিম আততামিমী আবুসতী, সহীহ ইবন হিব্বান, খ- ৭, পৃ. ৩২, হাদীস নং ৩২৩৯।
[32]. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ২৭১; নাসির উদ্দীন আলবানী, আসসিলসিলাতুস সহীহাহ, খ- ৩, পৃ. ৩৩, হাদীস নং ১৪৭০।
[46] .সহীহ আলবুখারী:১৭৩৯
[57]. ইমাম মুসলিম, সহীহ, অধ্যায়: বাবু ওয়ীদ মানিক তাতাআ হাক্কা মুসলিমিন বিইয়ামিনিন ফাজিরাতিন বিন নার, হাদীস নং৩৭০।
_________________________________________________________________________________
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন